ছাদ

ছাদ

রােদ্দুরের ঝাঁঝ কমে আসার সঙ্গে সঙ্গেই রেখার মন আনচান করে ওঠে। কলটা খােলাই থাকে। বকবক শব্দ হলেই কড়ি বাসনগুলােকে টেনে আনে উঠোনে। প্রত্যহের অভ্যাসে হাত দুটো যেন যন্ত্র হয়ে পড়েছে। বাসনমাজা শেষ করেই ঘর মুছতে বসে যায়। রান্নাঘরটা তবু দুপুরে খাওয়ার শেষেই ধুয়ে রাখে। ঘরমােছা শেষ হবে আর লেখা স্কুল থেকে ফিরবে। এক দিনও নড়চড় হয় না সময়ের। ওদের খাবার দিয়ে চুল বাঁধতে বসবে সে সুধার কাছে। টুকটাক কথা হয় তখন। পাউডার ফুরিয়ে গেছে আজ দেড় হপ্তা, বাবাকে কিনে আনতে বলার জন্য মাকে চাপ দেয়। সুধা প্রতিবাদের মতােই বলে, অত পাউডার মেখে কী হবে, কোথাও তাে আর যাচ্ছিস না।

কোথাও না গেলে বুঝি মাখতে নেই! মুখ গোঁজ করে থাকে রেখা। ছেড়া ব্লাউজের কথা আর বলে না। তারপর কথা হয় ইতিকে নিয়ে।

ইতি এবারে একটা ভ্যানিটি ব্যাগ কিনেছে। এই নিয়ে তিনটে হল ওর।

সুধা বলে, যাস-না ওদের বাড়িতে, ছােটোবেলায় তাে খুব ভাব ছিল তাদের। ঠোঁট দুটোকে মুচড়িয়ে বলে রেখা, আগে তবু ছাদে উঠত, দু-একটা কথা বলত-টলত; এখন তাে ওর যত ভাব ছেলেদের সঙ্গে। কলেজে পড়ে। চুপ করে শুনে যায় সুধা; তারপর একসময় বলে, লেখাপড়া জানা মেয়ে, ও কি আর যেচে কথা বলতে আসবে। তুই যাবি, গপ্পোটাপ্পা করবি। শিক্ষিত মেয়ে আলাপ-সালাপটা থাকা ভালাে।

হ্যাঁ, এই ছেড়া জামাকাপড় পরে যাই আর কি ওদের বাড়ি। রেখা জবাব দেয়।

এরপর সুধা ও-প্রসঙ্গ এড়িয়ে যায়। ইচ্ছে থাকলেও রেখা যেচে আলাপ জমাতে চায় না ইতির সঙ্গে। মনের মধ্যে কোথাও একটা আড়ষ্টতা অনুভব করে। ছােটবেলায় একসঙ্গে খেলাধুলা করেছে, স্কুলে পড়েছে। রেখাকে স্কুল থেকে ছাড়িয়ে সংসারের কাজে ভরতি করে দেওয়া হল। ইতি স্কুলেই রয়ে গেল। তারপর থেকেই দুজনে সরে গেল দু-দিকে। খিড়কির ডােবা, আবর্জনা আর ছাদ। বাইরের বাতাসে ঢেউ ওঠে না, শুকনাে পাতা উড়ে পড়ে। লালচে হয়ে যায় জল। পাঁক থেকে গ্যাঁজলা উঠে আসে। বাসন-ধােয়া জলে একঘেয়ে দিনগুলােকে দেখে দেখে ক্লান্ত রেখা। বাতাস লাগা, ঢেউতােলা সরােবর কৌতূহল জাগায়। সূর্যের আলােয় বিচিত্র হয়ে ওঠা জলের রং বিস্মিত করে রেখাকে। তবু কোথায় যেন ব্যবধান। ইতিকে আর ছেলেবেলার মতাে ইতু বলে ডাকা যায় না। ইতু যেন আর এক জগতের নাগরিকত্ব নিয়েছে।

চুল বাঁধা শেষ হলে গা ধুয়ে দোতলায় উঠে আসে রেখা। আজ দুপুরে ঘুমিয়ে ফুলাে ফুলাে গাল আর চোখ নিয়ে হয়তো তখন চায়ের বাটিতে চুমুক দিচ্ছে মঞ্জু। রেখাকে দেখে এটো। বাটিটাই এগিয়ে দেবে। চায়ে চুমুক দিতে দিতে রেখা বলবে, তার হল না এখনও!

বাবারে বাবা, এইতাে বিকেল পড়ল, তাের আর তর সয় না।

গামছা আর সাবানের বাক্স নিয়ে গা ধুতে চলে গেল মঞ্জু। রেখা গল্প শুরু করে মঞ্জুর পিসিমার সঙ্গে। ফিরে এসে মঞ্জু জিজ্ঞেস করে, কী কথা হচ্ছিল রে তােদের?

ছাদে চ বলছি।

প্রতিদিন নয়, যেকোনাে একদিনের ঘটনা। দোতলা আর একতলার সমবয়সি দুটি ভাড়াটে পরিবারের মেয়ে। বিকেল হলেই সাজগােজ করে উঠে আসে ছাদে। শাঁখ বাজলেই নেমে যায়। দিনের পর দিন আজ পাঁচ বছর ধরে।

আজকে রেখার আসতে দেরি হয়ে গেল। মঞ্জু তখন আয়নার সামনে শেষ বারের মতাে নিজের মুখটাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে নিচ্ছিল। পাউডার পাফটা ডুবিয়ে নিল রেখা কৌটোর মধ্যে। মঞ্জুর ভুরু দুটি টঙ্কার দিল। দেখেও দেখল না রেখা। মঞ্জুকে সরিয়ে দিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়াল।

তাের বড়াে বদস্বভাব রেখা। না বলে-কয়ে পরের জিনিসে হাত দিস।

পাফটা রেখে দিল রেখা আহত ভঙ্গিতে।

অপ্রস্তুত হল মঞ্জু, এ মাসটা তাে ওই দিয়েই চালাতে হবে। কতটুকুই-বা আর আছে। তা মাখবি তাে মাখ-না।

থাক। গরিব মানুষ গরিবের মতােই থাকব।

অনুতাপ জানাবার জন্যে আঁকুপাঁকু করে উঠল মঞ্জু, আহা-হা, আমরাই যে কত বড়ােলােক! খুব ঠেস দিয়ে কথা বলতে শিখেছিস বাপু। গল্পের বই পড়লে এই হয়। নে মাখ! পাউডার পাফটা তুলে ধরল মঞ্জু।

হাতটা সরিয়ে দিয়ে দূরে দাঁড়াল রেখা। পাউডার মাখলেই কী আর না মাখলেই কী, যেমন দেখতে তেমনিই থাকব। তুই বরং মাখ তােকে দেখায় ভালাে। মিছিমিছি নষ্ট হবে আমার মুখে। চোখের পাতা আর গলা ভারী হয়ে আসে রেখার।

মন খারাপ শুরু হয়ে যায় মঞ্জুর। দু-হাতে জড়িয়ে ধরে সে রেখাকে। তাের মনটা বড়াে কুচুটে। আমি কি তাই ভেবে বলেছি? তােকে কুচ্ছিত দেখতে কে বলেছে? নিজে নিজেই যত কথা বানাবি আর মন খারাপ করবি। জোর করে পাউডার-পাফটা বুলিয়ে দিল সারা মুখে। রেখার ভুরু আর চোখের পাতা পর্যন্ত সাদা হয়ে গেল। তারপরই আচমকা ওর গালে চুমু দিল মঞ্জু।

ধ্যাৎ, কী করলি বল তাে। মঞ্জুর হাত ছাড়িয়ে আয়নার সামনে এসে দাঁড়াল রেখা। সযত্নে বাড়তি গুড়ােগুলােকে মিলিয়ে দিতে লাগল চামড়ার সঙ্গে। মঞ্জু পাশেই দাঁড়িয়েছিল। ওর দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে ফেলল রেখা, তাের সবটাতেই বাড়াবাড়ি। অতখানি মাখিয়ে দিলি কেন?

ছাদে উঠে এল ওরা দুজন। ছােট্ট ছাদ। বুক-সমান উঁচু পাঁচিল। ভাঙা কুঁজোর টবে তুলসী আর গাঁদা। চিড়-খাওয়া ছাদের মেঝেয় কালাে কালাে ছাপ। গুল দেওয়া হয়। তিন দিক চাপা তিন বাড়ির দেওয়ালে। ছাদের উত্তর দিকটায় এসে দাঁড়াল ওরা। রাস্তার একটা টুকরাে বুকে পড়লে দেখা যায় এখান থেকে। তা ছাড়া সামনের কয়েকটা বাড়ি দোতলা। চোখ অনেকখানি খােলা জায়গা দেখতে পায়।

পাঁচিলে কনুই রেখে ওরা দাঁড়াল। একই ভঙ্গিতে। আলতাে আঙুলগুলাে ঝুলে পড়ল। শরীরের ভর একপায়ে রেখে আর একটাকে তুলে দিল পাঁচিলের নীচের ঘুলঘুলিতে। চোখ দুটোকে আকাশ থেকে নামিয়ে ওরা দুজনে একসঙ্গেই সিধে হয়ে মুখােমুখি দাঁড়াল।

কথা বলছিস না যে। ভয়ে ভয়ে বললে যেন মঞ্জু।

এমনি। রেখা চোখদুটো আবার ফিরিয়ে নিল আকাশে।

এখনও বুঝি রাগ পড়েনি? তুই বড়াে গালফুলােনি মেয়ে।

হেসে ফেলল রেখা। একটু থেমে বললে, আজ খুনুপিসি এসেছিল।

খুনু পিসি! অবাক হওয়া আর জিজ্ঞাসা দুটোই ফুটে উঠল মঞ্জুর গলায়।

বাবার পিসতুতাে বােন, ভবানীপুরে থাকে। বা রে, তােকে বলিনি খুনুপিসির বডােমেয়ে টুলুদি প্রেম করে বিয়ে করেছে। রেখাকে মর্মাহত দেখাল।

তুই তাে টুলুদির কথা বলেছিস, খুলুপিসির কথা তাে বলিসনি। মঞ্জুও ক্ষুব্ধ হল।

নিশ্চয়ই বলেছিলুম, তাের মনে নেই তাহলে। জানিস, টুলুদি চাকরি করছে! রেখা হঠাৎ বললে।

সেকী, এইতাে বিয়ে হল, এখন তাে কনেবউ!

মঞ্জুর সরল বিস্ময়ে খুশি হল রেখা। আর একটু সরে এল মঞ্জুর কাছে। —টুলুদির বর— মেয়েরা ঘরের মধ্যে বসে থাকবে, একদম পছন্দ করে না। টুলুর্দিকে নিয়ে রােজ সন্ধ্যের সময় বেড়াতে বােরােয়। আর যেদিন বন্ধুরা আসে, টুলুদি তাদের চা দেয়। নিজে হাতে চা এনে দেয় গান পর্যন্ত গেয়েছে। টুলুদির তাে খুব ভালাে গলা।

টুলুদির বন্ধুরা আসে না? উত্তেজনায় থমথমে মুখে জিজ্ঞাসা করল মঞ্জু।

কী জানি? খুনুপিসিকে জিজ্ঞাসা করিনি। আর জানিস, টুলুদির বর রােজ অফিস থেকে ফেরার সময় ফুল কিনে আনে।

সত্যি! নিশ্বাস বন্ধ হয়ে এল মঞ্জুর, রােজ আনে?

হ্যাঁ।

আর কী আনে রে?

কী জানি।

টুলুদিকে দেখতে খুব ইচ্ছে করছে। একদিন দেখাবি?

হঠাৎ বিরক্ত হয়ে উঠল রেখা, দেখে কী করবি, চারটে হাত গজাবে?

মঞ্জু লজ্জা পেল। তাই তাড়াতাড়ি বলল, না, এমনি বলছিলাম। তারও দেখতে ইচ্ছে করে না?

সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল না রেখা। অন্যমনস্কর মতাে দোতলার ছাদগুলাের দিকে তাকিয়ে রইল। প্রায় আধ মিনিট পর নিজের মনেই বললে, ভালাে বর পেয়েছে, পয়সাওলা ঘরে পড়েছে। এ আর দেখবার কী আছে!

মঞ্জু ও তাকিয়েছিল সামনের দিকে। রেখার কথাগুলাে বােধ হয় শুনতে পায়নি। হঠাৎ কনুই দিয়ে ধাক্কা দিল সে রেখাকে, ওই দ্যাখ, আবার এসেছে।

নীচু ছাদগুলাের পরেই প্রথম তিনতলার ছাদটায় দাঁড়িয়েছিল একটা লােক। গেঞ্জিটা যত পরিষ্কার, গায়ের রং ততই কালাে। পাঁচিলের ওপর থেকে শুধু দেখা যায় সরু বুক, গলার কণ্ঠা, কনুইয়ের হাড় আর ভুরুর ওপরের খানিকটা। সযত্নে পাট-করা চুলে মাঝে মাঝে আঙুল ছুইয়ে আদর করে। যদিও হাতে একটি বই আছে, তবু চোখ দুটো অন্যদিকে নিবদ্ধ। মঞ্জু আর রেখাকে তার দিকেই তাকাতে দেখে চোখ ঘুরিয়ে নিল।

ছাদে ওঠারও জো নেই। এমন ছাগলের মতাে তাকিয়ে থাকে—ইচ্ছে করে চোখ দুটো গেলে দিই রাগে গরগর করে উঠল মঞ্জু। রেখা শুধু কৌতূহলী চোখে তাকিয়েই রইল।

পুরুষমানুষের আবার ছাদে ওঠা কী? তাও আবার বিকেলে। মঞ্জু কিছুতেই বরদাস্ত করতে পারছে না লােকটার উপস্থিতি।

কী আর করবে বেচারি, বল! যা চেহারা, কেউ বােধ হয় বিয়ে করতে চায় না। তাই মনের দুঃখে…

দুজনেই হেসে উঠল। বােধ হয় শুনতে পেয়েছে লােকটা। কেমন ছটফটিয়ে উঠল। বার কয়েক এদিকে তাকিয়ে পায়চারি শুরু করে দিল।

মনের দুঃখ না আর-কিছু। পরশু দিনই তাে এদিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছিল।

কই বলিসনি তাে আমায়! বিস্মিত হল রেখা। এমন একটা ব্যাপার এখনও মঞ্জু তাকে না বলে মনের মধ্যে জমিয়ে রেখেছে কী করে? রেখার বিস্মিত হওয়ার কারণটা তাই।

হ্যাঁ ভারি তাে একটা বলার মতাে কথা। কৈফিয়তের সুরে কথাটা বললে মঞ্জু।

পায়চারি থামিয়ে লােকটা ওদের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়েছে। শরীরটা কাঁপছে, বােধ হয় পী নাচাচ্ছে।

ওদিকে তাকিয়ে থাকিনি, আশকারা পেয়ে যাবে।

যেজন্যে রেখার কথাটা বলা, তাই হল। লােকটার দিকে পিঠ ঘুরিয়ে দাঁড়াল মঞ্জু। গাল দুটো ফুলে রয়েছে। অনেকক্ষণের চেপে রাখা নিশ্বাসটা বেরিয়ে এল। কথা বলছে না রেখা। চুলের কাঁটাগুলাে টিপে বসিয়ে দিতে ব্যস্ত সে। মঞ্জুরও হাতটা তার অজান্তেই খোঁপায় উঠে এল। রেখা বুঝতে পারছে, মঞ্জু সত্যি সত্যিই রােগেছে। আর তার চুপ করে থাকাতে রাগটা ক্রমশই বাড়ছে।

খুনপিসি কেন এসেছিল জানিস?

মঞ্জুর জানবার কথা নয়। তাই উশখুশ করল সে।

খুনুপিসির ননদরা তাে দিল্লিতে থাকে। প্রায় পনেরাে বছর আছে।

মঞ্জু শুধু তাকালই না, রেখার গা ঘেঁষে সরে এল।

ছেলেরা সব ওখানেই লেখাপড়া করে চাকরিবাকরি করছে। বড়াে ছেলে, খুনুপিসির ননদের বড়ােছেলে দিব্যেন্দু, বেশ নামটা, না রে? সতর্ক চোখে রেখা তাকাল মঞ্জুর দিকে। খুশিখুশি ভাব ফুটে উঠেছে।

সুন্দর নামটা।

আশ্বস্ত হয়ে রেখা আবার বলতে শুরু করল, দিল্লিতেই ভালাে চাকরি করছে। বিএ পাস, গরমেনট চাকরি…। কথা বলায় ছেদ দিল রেখা। মঞ্জুর মুখে প্রশ্ন জমে উঠেছে।

খুনুপিসির ননদের মেয়ে নেই? ছেলেই বুঝি বড়াে?

হ্যাঁ দিব্যেন্দুই বড়াে। এক বােন দীপিকা, সামনের বছর কলেজে ঢুকবে। বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। ছেলে বিলেত থেকে ফিরলেই বিয়ে হবে। ওদের আর ভাই-বােন নেই।

রেখাকে থামিয়ে আবার প্রশ্ন করলে মঞ্জু, বাবা নেই? খুনুপিসির নন্দাই?

ও মা, সে তাে কবে মরে গেছে। আজ দেড় বছর। ছেলেই তাে এখন সংসারের কড়া।

মা তাে বামুন চাকরের হাতে সংসার ছেড়ে দিয়ে দিনরাত ঠাকুর নিয়ে পড়ে আছে। আর লােকজনের হাতে সংসার পড়লে যা হয়। চুরিচামারি, নষ্ট, ব্যবস্থা বলে যদি একটা জিনিস থাকে!

কেন, মেয়ে তাে রয়েছে।

হ্যাঁ, সে তাে মেমসাহেব। দিল্লির ব্যাপারস্যাপার অন্যরকম। এ আর কলকাতা নয়, মেয়েরা সেখানে সাইকেল চেপে বেড়ায়।

ওমা, লজ্জা করে না! পারে কী করে!

দিল্লির মেয়ে হলে তুইও পারতিস।

মা গাে, মরে গেলেও না। মঞ্জু হেসে উঠল খিলখিল করে। দিল্লিতে তাে চেনা লােক আছে। যা-না, বেড়িয়ে আয়-না। হাসি থামলে মঞ্জু বললে।

হঠাৎ মুখ নামিয়ে হাতের নখ দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল রেখা। বিকেলের শেষ আলােটা বিভ্রান্তিকর। মনে হয় যেন লাল হয়ে উঠেছে রেখার মুখ।

খুনুপিসি বলেছিল, দিব্যেন্দুর মা চিঠি দিয়েছে দিব্যেন্দুর জন্যে মেয়ে দেখতে। তাই খুনুপিসি এসেছিল। বাধােবাবাে স্বরে বললে রেখা।

ওমা, বােনের বিয়ে না দিয়েই ভাই বিয়ে করবে?

আহা-হা, বােনের বিয়ে তাে ঠিক হয়েই আছে। এদিকে সংসার ভেসে যাচ্ছে, দেখাশােনার লােক নেই বলে। তখন অত নিয়ম মেনে চলার কোনাে মানে হয়?

খামােকা রেখা রােগে উঠল কেন তার কারণ বুঝতে না পেরে মঞ্জু আমতা আমতা করে বলল, তবু অদ্দিন যা হয়ে আসছে…

হয়ে আসছে বলে চিরদিনই হবে তার কী মানে আছে। বােনের বিয়ের এখনও দু-তিন বছর দেরি। তাই বলে ভাই বিয়ে করবে না? দিন-কে-দিন তুই বােকা হয়ে যাচ্ছিস।

রেখাকে বিরক্ত করে নিজেকে আরও বােকা প্রতিপন্ন করতে চাইল না মঞ্জু। সে চুপ করে রইল।

বিরক্তিবােধটা কাটিয়ে উঠতে বেশি সময় নিল না রেখা। স্বাভাবিক স্বরে আবার কথা শুরু করল সে, এরই মধ্যে ছ-সাতটা সম্বন্ধ এসেছে। সব ওখানকার মেয়ে। একটাও পছন্দ হয়নি ছেলের। তাইতাে খুনুপিসিকে চিঠি দিয়েছে ছেলের মা।

সেইজন্যেই বুঝি খুনুপিসি এসেছিল? ফিসফিস করে কথাটা বললে মঞ্জু। মাথা নুইয়ে ছােট্ট করে ঘাড় নাড়ল রেখা।

কী কথা হল?

এখন আর কী কথা হবে। ফোটো আর পরিচয় লিখে আগে পাঠাতে হবে। পছন্দ হলে অন্য কথাবার্তা হাব।

সন্ধ্যা অনেকখানি নেমে এসেছে। শাঁখ অনেক বাড়ি থেকে বেজে উঠল। ওরা দুজন নীচে নামার জন্য সিঁড়ির দিকে এগােল। সিঁড়িতে নামার আগেই দুজনেই মুখ ফিরিয়ে থাকল। সাদা গেঞ্জিটাই শুধু দেখা গেল।

এখনও দাঁড়িয়ে আছে রে! হালকা সুরে বলে উঠল রেখা।

থাকুক গে। তাের তাে ফোটো নেই, তাহলে পাঠাবি কী? রেখার পেছনে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতেই জিজ্ঞাসা করল মঞ্জু।

কালকে বাবা অফিস থেকে ফিরে নিয়ে যাবে দোকানে।

পরের দিন দুপুরেই রেখা ডেকে নিয়ে গেল মঞ্জুকে তাদের ঘরে। দুখানি ঘর। একখানিতে সুধা তখন ঘুমােচ্ছে, অন্য ঘরখানিতে ওরা দুজন এসে ঢুকল। তার ওপর দুখানি শাড়ি আর ব্লাউজ। শাড়িতে ইতস্তত ভাঁজ আর ন্যাপথলিনের গন্ধ। দুটি শাড়িই তুলে নিয়ে দেখতে শুরু করল মঞ্জু।

এটা তাে জেঠিমার, না?

ঘাড় নাড়ল রেখা।

আর এটা? তাের?

তবে নাতাে কার?

পরতে দেখিনি তাে।

বিরক্ত বােধ করতে শুরু করল রেখা। মঞ্জুটা বড় বােকা; এমন খুটিয়ে জিজ্ঞেস করে। বল, কোনটা পরব।

চট করে জবাব দিতে পারল না মঞ্জু। মনে মনে সে ভেবে নিয়েছে, অদ্ভুত এইবার সে নিজেকে বুদ্ধিমতী প্রতিপন্ন করবে। মঞ্জুর মুখ চোখের অবস্থা দেখে মনে হয় তার সামনে ছড়ানাে গুটি পঞ্চাশেক শাড়ির মধ্য থেকে একটিকে বেছে নিতে বলা হয়েছে। রেখাও চুপ করে আছে। মঞ্জুর মতামতের ওপর তার যে খুব আস্থা আছে তা নয়, শাড়ি বাছাই তার কাছে সত্যিই গুরুতর সমস্যা, বিশেষ করে আজকে সে ঘাবড়ে গেছে। তার নিজের মত হালকা বেগুনি রঙের জর্জেটটাই পছন্দ। ওটা তার রঙের সঙ্গে খুলবে ভালাে। এখন মঞ্জুর

কাছ থেকে যাহােক একটা সমর্থন পেলেই সে আশ্বস্ত হতে পারে।

ফোটো তা রাত্তিরে তােলা হবে? নখ খুঁটতে খুটতে গম্ভীর সুরে প্রশ্ন করল মঞ্জু।

হুঁ।

মঞ্জু আপাদমস্তক দেখে নিল রেখাকে। বুঝতে পারল রেখা তার গায়ের রং দেখছে মঞ্জু। গােড়ালি থেকে শাড়িটাকে অল্প তুলে একটা ঘামাচি মারল সে। সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল, মঞ্জুর সামনে সে অনেক দিন হাঁটু পর্যন্তও কাপড় তুলেছে। শাড়িটা নামিয়ে দিল রেখা। মঞ্জুর মুখে বিশেষ কোনাে ভাবান্তর ঘটেছে বলে মনে হল না। রেখার গােড়ালি থেকে মাথার দিকে তাকাল সে। চুল খােলাই আছে। তুব এক বার মাথা ঝাঁকিয়ে চুলগুলাে দুলিয়ে দিল রেখা। ঘন কোঁকড়ানাে, কোমর পর্যন্ত এলানাে চুল।

চুলে তেল দিসনি কেন?

মঞ্জুকে শাড়ি বাছাতে বলা হয়েছে, আর সে কিনা এখন চুল নিয়ে পড়ল। বিরক্ত হলেও জবাবটা কোনােরকমে দিল রেখা, বডড মাটি পড়েছিল, তাই মাথাটা ঘষলুম।

কী-একটা বলতে যাচ্ছিল মঞ্জু, থামিয়ে দিয়ে ধমকে উঠল রেখা, যা জিজ্ঞেস করেছি তাই বল। কলে জল এসে গেছে; তিনু, লেখা ওরা এক্ষুনি ইশকুল থেকে ফিরে হইচই লাগবে।

এত তাড়াতাড়ি বলা যায় নাকি! একি তাড়াহুড়াের ব্যাপার। ভেবেচিন্তে ঠিক না করলে যদি…

মঞ্জু কথাটা শেষ করল না বলেই রেখা কৃতজ্ঞ হল ওর ওপর। শেষ করলে কী বিশ্রীই না শােনাত। বােকা মেয়েদের জিভের আড় বলে কিছু থাকে না। দুখানা শাড়ি নিয়ে প্রায় ঘেমে উঠেছে মঞ্জু। রেখার ভবিষ্যতের ভালাে মন্দ সব কিছুই এখন নির্ভর করছে শাড়ি বাজার ওপর! নিজের শুভাশুভের দায়িত্বের ভার তার ওপর তুলে দিয়ে রেখা নিশ্চিন্ত হয়ে রয়েছে, এই চিন্তায় দিশাহারা হয়ে পড়তে লাগল মঞ্জু।

তাহলে এইটেই পরি, কী বল? শেষপর্যন্ত সম্মতির অপেক্ষা না রেখেই জর্জেটটা তুলে নিল রেখা।

দাঁড়া, পরিয়ে দিই।

এখন পরল ময়লা হয়ে যাবে না!

তাহলে চুলটা বেঁধে দিই একটা সমস্যার হাত থেকে রেহাই পেয়ে খুশি হয়ে উঠেছে মঞ্জু।

কিন্তু চুল বাঁধতে গিয়েও আর একটা পরিস্থিতির উদ্ভব হল। মঞ্জুর ইচ্ছে, বিড়ে খোঁপা; রেখা চায় চুলটা খােলাই থাক।

আমি কি পেছন ফিরে ছবি তুলব যে, খোঁপার কায়দা দেখাতে হবে?

আসলে রেখা জানে, চুলই হচ্ছে তার একমাত্র গর্বের জিনিস। কিন্তু মঞ্জু সেরকম বােকা, হয়তো খোঁপা না বাঁধিয়ে ছাড়বে না। সরু গলার ওপর মুখটাকে অনাবশ্যক বড়াে মনে হয়, তারপর একটা বিরাট খোঁপা যদি বাড়তি হয়ে আটকে থাকে তাহলে মােটেই সুশ্রী দেখাবে না। নিজের সম্বন্ধে এত রূঢ় সমালােচক আর কোনােদিন হয়নি রেখা। বেশ, তাহলে বিনুনি করে দিই। সামনে ঝুলিয়ে দিবিক্ষণ।

আপত্তি করার মতাে কিছু খুঁজে না পেয়ে রাজি হয়ে গেল রেখা। দুগাছি বিনুনি কাঁধের দু দিক দিয়ে বুকের ওপর ঝুলিয়ে দিল মঞ্জু। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখতে দেখতে রেখা লাজুক হাসল, বডড খুকি খুকি দেখাচ্ছে।

আহা, খুকি দেখাবে না তাে কী! কুড়ি বছরের মেয়েকে কি বুড়ি দেখাবে?

—দুটো রিবন ফুলের মতাে বেঁধে দিলে কেমন দেখাবে রে? রেখার সুরে সংশয় ছিল, তাই খুব জোর দিয়ে সমর্থন করতে পারল না মঞ্জু। তা ভালােই দেখাবে। তাের তাে রিবন নেই; লেখা আসুক ইশকুল থেকে, ওরটাই নয় বেঁধে নিস।

তাের সাবানটা দিবি? আমারটা ফুরিয়ে গেছে।

কথা না বলে ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল মঞ্জু। শুধু সাবান নয়, পাউডারের কৌটো আর। স্নাে-র শিশিটাকেও নামিয়ে আনল।

এখন যেন গা ধূসনি, ঠিক যাবার আগে গা ধুয়ে মাখবি।

বেশিক্ষণ আর বসতে পারল না মঞ্জু। রেখার সংসারের কাজগুলােকে আজ তাড়াতাড়ি সেরে ফেলতে হবে। আজ দুজনের কেউই ছাদে উঠল না। ঘর মুছে, উনুন ধরিয়ে, বাসন মেজে সাজগােজ শেষ করতে করতেই সন্ধ্যা উতরে গেল। বাবার সঙ্গে যখন রেখা বেরিয়ে গেল, মঞ্জু সদর দরজা পর্যন্ত তাকে এগিয়ে দিল।

ইতিদের ঝি রাস্তায় দাঁড়িয়েছিল। মাকে দেখে এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করল, সেজেগুজে কোথায় গেল গা?

ফোটো তােলাতে।

হঠাৎ, বিয়ে-থা হবে নাকি?

হ্যাঁ।

মঞ্জুর গা ঘেঁষে সরে এল ইতিদের ঝি। ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞাসা করল, কোথায় গাে?

দিল্লিতে। আমাদের দিদিমণিরও বিয়ে, এই শ্রাবণে। ছেলে খুব পন্ডিত, কলেজে পড়ায়। ভাব করে বিয়ে হচ্ছে।

মঞ্জু যেন প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুর খুঁজে পেলে ঝিয়ের কথাতে। ভাব করে বিয়ে যেন একমাত্র ওর দিদিমণিই করতে পারে। আর পন্ডিত ছেলে ভূভারতে ওই একটিই আছে। হালকা, কিছু-না সুরে মঞ্জুও বলল, রেখুরও বিয়ে এই শ্রাবণে। ছেলের গাড়ি আছে। দিল্লিতে বিরাট চাকরি করে। রেখাকে পছন্দ করে বিয়ে করছে।

ওমা! তবে আর ফোটো তােলাতে গেল কেন?

সত্যিই তাে। না দেখে পছন্দই-বা হয় কী করে। ঝি মুখে বুঝে ফেলেছি হাসি এনে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে রয়েছে।

যাই, এখনও সন্ধ্যে দেখানাে হয়নি। প্রায় ছুটে পালিয়ে গেল মঞ্জু।

ফোটো পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন শুধু অপেক্ষা করা। ছাদে সেই গল্পই করে মঞ্জু আর রেখা। দূরের ছাদ থেকে আড়চোখে তাকিয়ে থাকে সেই লােকটা। বই হাতে পায়চারি করে আর চুলে হাত বুলােয়। মঞ্জু বা রেখা তাকে দেখেও দেখে না। সেদিন ছাদে উঠেছিল ইতি। কথা থামিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বলল রেখা, দেখেছিস কেমন সুন্দর হয়েছে।

হবেই তাে, এখন তুইও তাে হয়েছিল।

যাঃ, ওর তাে বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। আর আমার কোথায় কী!

রেখার কথায় কান না দিয়ে মঞ্জু আবার বলল, টুলুদির মতাে ইতিও ভাব করে বিয়ে করছে। আচ্ছা, বিয়ের পর ইতিও চাকরি করাবে তাে?

কী জানি! ওর বর যদি চাকরি করতে দেয় তাে করবে।

আচ্ছা, বরের সঙ্গে এ তাে বেড়াতে বেরুবে—সিনেমায় কিংবা পার্কে। ফুল কিনে আনবে, বন্ধুরা এলে চা দেবে, গান গাইবে, তাই না? ঝুকে পড়ল মঞ্জু রেখার চোখের নীচে।

সবাই যে একরকমই করবে, তার কী মানে আছে।

তুই হলে কী করতিস?

আমি! দম বন্ধ হয়ে এল রেখার। এমন করে দম বন্ধ হওয়া তার এই প্রথম।

হ্যাঁ, তুই হলে কী করতিস? আবার ফিরে বলল মঞ্জু। আগ্রহে জ্বলজ্বল করছে ওর চোখ।

মুখ ফেরাল রেখা। এত সহজে কি বলা যায়। কুড়ি বছর বয়সের যেকোনাে মেয়েই শুধুমাত্র এই একটি কথার ওপরেই মহাভারত লিখতে পারে। কৈশাের থেকে আজ পর্যন্ত দেখা, শােনা এবং পড়ার মধ্য দিয়ে এক রূপকথার প্রদীপ জ্বালিয়েছে রেখা। বাসন মাজা, রান্না আর ছােটো ভাই-বােনদের পরিচর্যার মধ্যে সময় করে টুকরাে টুকরাে মুহূর্তগুলােকে সেই প্রদীপের আলােয় রঙিন করেছে। বয়স বাড়ছে, যথেষ্ট টাকা খরচ করে বিয়ে দেবার ক্ষমতা বাবার নেই, তবু এতটুকু স্তিমিত হয়নি সে-আলাে। সে ভেবেছে তার নিজের একটা সছিল সংসারের কথা, একটি স্বামী স্বেচ্ছায় যার খুশিতে নিজেকে সঁপে দেওয়া যায়। দিনরাতের একটা অনুভূতি—যাকে সে লালন করবে তাদের যৌথ ভালােবাসা দিয়ে ঘিরে।

কী দেখছিস অমন করে?

মঞ্জুর নাড়া খেয়ে চমকে উঠল রেখা। কিছু-একটা বলার জন্যেই বলে উঠল, না, ওই লােকটাকে দেখছি।

বিরক্ত হল মঞ্জু রেখার কথায়। আর প্রকাশ্যেই সে তা জানিয়ে দিল, এধার ঘুরে দাঁড়া, নইলে এক্ষুনি হাঁ করে তাকাবে।

মঞ্জুর দিকে ঘুরে দাঁড়াল রেখা। অল্প হাসল ওকে প্রশ্রয় দিয়ে।

হ্যাঁ রে, ওদের গাড়ি আছে?

কাদের! অবাক হল রেখা।

কাদের আবার, তাের বরেদের। ধ্যাত, তুই এখন থেকেই যা-তা বলতে শুরু করেছিস। মুখ তুলে পশ্চিম আকাশ থেকে আসা আলাের মুখােমুখি হল রেখা। হালকা হলুদের গুঁড়ােয় নরম হয়ে গেছে আলাের তাপ। কনে-দেখা আলাে। সারাদিনের শেষে একুটখানির জন্য ফুটে ওঠে, তারপরই অন্ধকার এসে নি:শেষ করে দেয়। চোখের পাতা কাঁপছে রেখার। দু-চোখ ভরে দেখে নিচ্ছে সে কেমন করে একটা দিন তার স্বপ্নের সঞ্চয় নিয়ে এগিয়ে চলেছে রাত্রির আয়ােজনে।

খুনুপিসি বলছিল গাড়ি কিনবে। সত্যি! তাহলে তাে রােজ বেড়াতে পারবি। আকাশ থেকে সবটুকু খুশি কুড়িয়ে নিল মঞ্জু তার দু-চোখে। মিষ্টি হেসে ওর দিকে তাকাল রেখা।

বেড়িয়ে এসে তারপর কী করবি? গল্প?

ধুর, তাের বুদ্ধিসুদ্ধি কোনােদিন হবে না। মা বােন এদের সামনে কেউ বউয়ের সঙ্গে গল্প করতে পারে? লােকে বলবে কী!

তাহলে গল্প করবি কখন?

উত্তর না দিয়ে চোখে রহস্য এনে মুচকি হাসল রেখা।

রাত্তিরে বিছানায় শুয়ে? রেখার কানে কথাটাকে মিশিয়ে দিল মঞ্জু।

সেইরকম আস্তেই মঞ্জুকে ধাক্কা দিয়ে বলল রেখা, সব কথা কি বলতে আছে?

আমাকেও বলতে নেই?

মঞ্জু রাগ করল না, বরং দু-হাতে জড়িয়ে ধরল রেখাকে—বাদসাদ দিয়েও বলবি না?

আচ্ছা, বলব ক্ষণ।

সারাদিনের শেষে কখন বিকেল আসবে, কখন দুজনে মুখােমুখি হয়ে আর এক জগতে পাড়ি জমাবে তারই প্রত্যাশায় ছটফট করে মঞ্জু আর রেখা। কথা আর কথা। জ্যৈষ্ঠ শেষ হয়ে আষাঢ় পড়ল, তবু ওদের ক্লান্তি নেই। আষাঢ়ও শেষ হয়ে শ্রাবণ ধরল। দিল্লি থেকে চিঠি এসে গেল। মেয়ে পছন্দ হয়নি। কোনাে কারণ তারা জানায়নি। থমথমে মুখ নিয়ে ওরা দাঁড়াল ছাদে। ইতিদের ছাদে ম্যারাপ বাঁধার আয়ােজন শুরু হয়ে গেছে। বাঁশের কঙ্কালের থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে মঞ্জু শুধােল, কী লিখল ওরা?

উত্তরের জন্য সারা দুপুর নিজেকে তৈরি করেছে রেখা। একতলার স্যাঁতসেঁতে ঘর। ঘামে জবজবে ছটফটে দুপুর। তারপরেই বিকেলের ছাদ। কিছু আকাশ আর কিশােরী লজ্জা রােদ। কথায় কথায় তৈরি আর এক পৃথিবীর চেনা সংসার। ভয়ে কেঁপে উঠেছিল রেখা। এ সবই হারাতে হবে। ফুরিয়ে যাবে সব কথা, মরে যাবে এই আকাশ, রােদুর আর ছাদের প্রত্যক্ষমান স্পন্দন। শুধু শুনতে হবে হাঁপটানা ক্লান্তিকর দিনরাতের নিশ্বাস…

সযত্নে তৈরি উত্তরটাকে রেখা সাজিয়ে তুলল, লিখেছে পছন্দ হয়েছে; কিন্তু ছেলে এখন মত করছে না। বােনের বিয়ে না দিয়ে বিয়ে করবে না বলেছে। আস্তে আস্তে পড়ন্ত আলাের মতাে থেমে গেল রেখার কথাগুলাে। শুন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সে ইতিদের ছাদের দিকে।

মঞ্জুও চুপ করে রইল কিছুক্ষণ, তারপর বলল, দুটো বছর তাে, তারপর বােনের বিয়ে হয়ে যাবে। তাই না?

কোনাে কথা বলল না রেখা। মুঠোয় চিবুক রেখে আকাশে তীক্ষ্ণ চোখ মেলল সে। কনে দেখা আলােকে পিষে গুঁড়িয়ে দেবার জন্য আকাশে আকাশে ষড়যন্ত্রী অন্ধকারের ব্যস্ততা। আর এক ছাদে সাদা গেঞ্জিটায় ঘামে-ভেজা রং ধরেছে। আত্মীয় রং চেনা যায়। কিন্তু দিব্যেন্দু, বড়াে দূরের। মঙ তাে পরে সবই জানতে পারবে। তখন নিভে যাবে রূপকথার প্রদীপ। দমচাপা অন্ধকারের থেকে নিজেকে বাঁচার আকুলতায় টেনে টেনে হেসে বলে উঠল রেখা, না, ভাবছিলুম এই লােকটার কথা। আচ্ছা ধর, যার সঙ্গে ওর বিয়ে হবে, সেও তাে অনেক…

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *