গুণ্ডাদ্বয়

গুণ্ডাদ্বয়

ভোররাতে সুমিত্রার গর্ভপাত ঘটল।

পান-বসন্তে ছ-দিন ধরে ভুগছে। জ্বর উঠল একশো তিন। নিখিল শুয়েছিল মেঝেয়। সুমিত্রার চিৎকারে ঘুম ভেঙে দেখল বিছানায় বসে চাপা আতঙ্কে ও তখন চ্যাঁচাচ্ছে, বেরিয়ে গেল, বেরিয়ে গেল।

আলো জ্বেলে নিখিল দেখে সুমিত্রার দুই ঊরুর মাঝে কাপড়টা ফুলে রয়েছে। একটু নড়তেই দলমল করে উঠল সেই স্ফীতি। সুমিত্রা সাত মাসের পোয়াতি। ফ্যালফ্যাল করে নিখিলের দিকে তাকিয়েছিল। চোখ সরিয়ে নিল নিখিল। বসন্তের ক্ষতে মুখটা খোদলানো। পাশের ঘরে মা ঘুমোচ্ছে, তাকে ডেকে তুলল।

বাড়িওয়ালার বউ উপর থেকে নেমে এসে পরামর্শ দিল ডাক্তার ঢাকতে। পাড়ার ডাক্তারকে ঘুম থেকে তুলে আনল নিখিল। তিনি সুমিত্রার নাড়ি কেটে পনেরোটি টাকা নিয়ে যাওয়ার সময় বলে গেলেন ভয়ের কিছু নেই অর্থাৎ টাকা খরচ হবে না। বিছানার চাদর তোশক রক্তে জবজব করছে। সুমিত্রার শায়ার রং বদলে গেছে, শাড়ির কিছু অংশে রক্ত। এসব ফেলে দেওয়া ছাড়া উপায় নেই। ওকে কাপড় বদলিয়ে মা সেই চাদর, শায়া ও শাড়ি ঘরের এক কোণে জড়ো করে রেখেছেন, সেইসঙ্গে সুমিত্রার পেট থেকে যে-জিনিসটা বেরিয়েছে সেটাও।

বাড়িতে ধাঙড় আসতেই বাড়িওয়ালার বউ তাকে এই জিনিসগুলো ফেলে দিতে বলল। দেখেই সে মাথা নাড়ল। এ কাজ তার দ্বারা হবে না, পুলিশে ধরলে ফাটকে পুরে দেবে। দশ টাকা বকশিশ কবুল করেও তাকে রাজি করানো গেল না। তখন বাড়িওয়ালার বউ বাড়িওয়ালার সঙ্গে পরামর্শ করে এসে বলল, ডাক্তারের কাছ থেকে সার্টিফিকেট আনো। সেটা দেখালে পুলিশ কিছু বলবে না। উনি বললেন, এ তো আর আইবুড়ো বা রাঁড়ির পেট-খসানো মাল নয়। ভদ্রঘরের বউয়ের অ্যাকসিডেন্ট। তুমি বাপু ডাক্তারের কাছেই যাও।

তাই শুনে নিখিল ডাক্তারের কাছে ছুটল। তখন ডাক্তার বাড়ি ছিল না, কখন আসবে তারও ঠিক নেই। বাড়ি ফিরে সাত মাসের সন্তানটিকে বিছানার চাদর, শাড়ি ও শায়ার উপর রেখে নিখিল পরিপাটি করে ভাঁজ করল। শাড়ির পাড় ছিঁড়ে নিয়ে বেশ শক্ত করে বাঁধল যাতে জিনিসটার আকৃতি ছোটো হয়। তার উপর খবরের কাগজ মুড়ল। তাতে হুবহু মনে হতে লাগল একটা কাপড়ের প্যাকেট। কিছুদিন আগেই হ্যাণ্ডলুম হাউস থেকে পর্দার কাপড় ও ব্লাউজের ছিট কেনা হয়েছে। দোকানের নাম লেখা ছাপা কাগজের থলিতে জিনিসটা এখন রেখে দেওয়া আছে। তাইতে নিখিল প্যাকেটটা ভরে খাটের নীচে রেখে দিল। সুমিত্রা শুয়ে শুয়ে দেখছিল, কাতরস্বরে সে বলল, শাড়িটা তো কাচিয়ে নিয়ে পরা যায়। একটুখানি জায়গায় তো মোটে লেগেছে।

নিখিল একথা গ্রাহ্য করল না। সুমিত্রার দিকে তাকালও না। ওর মুখে বসন্তের ঘা টসটস করছে। সাড়ে বারোটা নাগাদ আবার সে ডাক্তারের বাড়ি গেল। ডাক্তার খেতে বসেছে। সার্টিফিকেটটা পাঠিয়ে দিল ছেলের হাত দিয়ে। ছেলেটি হেসে বলল, বাবা লিখেই রেখেছিল।

বলার ধরনে মনে হল বলতে চায়—কীরকম বুদ্ধি দেখেছেন, বলার আগেই করে রেখেছে। কিন্তু পনেরো টাকা ফি দিয়েছি-এই কথা নিখিল ভোলেনি। কৃতজ্ঞতা না জানিয়েই চলে এল। খুব ভোরে ঘুমভাঙা অভ্যাস নেই, তাই চোখ জ্বালা করছে। ভাত খেয়েই সে মেঝেয় সুমিত্রার খাটের পাশে শুয়ে পড়ল। মা পুরুতমশায়ের বাড়ি গেছে সত্যনারায়ণের পুজোর ব্যবস্থা করতে। ক্যাজুয়াল লিভের হিসাব কষতে কষতে নিখিল ঘুমিয়ে পড়ল।

বিকেলে চা খেয়ে নিখিল থলিটা হাতে ঝুলিয়ে বেরোল। বার বার পকেটে হাত দিয়ে দেখল ডাক্তারের সার্টিফিকেটটা আছে কি না।

গলি থেকে বড়ো রাস্তায় পা দিয়েই নিখিল ভাবল এবার কী করার? চারিদিকেই ঝকঝকে আলো, লোক, গাড়ি। থলিটা এখানেই কোথাও ফেলে রেখে গেলে কেমন হয়! এই ভেবে পায়ের কাছে সেটি রাখল।

অমনি কোথা থেকে একটা লোক এসে বলল, পুজোর বাজার সেরে ফেললেন? লোকটার লন্ড্রি আছে পাড়াতেই। থলিটা হাতে তুলে নিয়ে নিখিল মাথা নেড়ে হাঁটা শুরু করল।

সুদৃশ্য থলিটা রাস্তায় ফেলে রেখে গেলে অনেকেরই চোখে পড়বে, তার মধ্যে পাড়ার লোকও থাকতে পারে। তারপর কেউ হয়তো খুলবে। বস্তুটি দেখেই হাউমাউ করে পুলিশে খবর দেবে। সেই চেনা লোকটি তখন আগ বাড়িয়ে বলবে, হ্যাঁ হ্যাঁ, জানি লোকটাকে, আমাদের পাড়াতেই ছাব্বিশের দুইয়ে থাকে, নাম নিখিল চাটুজ্যে, ব্যাঙ্কে কাজ করে। তখন পুলিশটা হাতে কাগজের থলিটা ঝুলিয়ে এবং তার পিছনে একপাল লোক মজা দেখা এবং কেচ্ছা রটাবার জন্য বাড়িতে এসে হাজির হবে।

দৃশ্যটা কল্পনা করতে গিয়ে নিখিলের দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম। সামনেই চিলড্রেন্স পার্ক, তারই একটা বেঞ্চে কোলে থলিটা রেখে সে বসল। কিছুক্ষণ সে চারপাশে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখল চেনা এমন মানুষ কেউ আছে কি না। কাউকেই সে চিনল না। তবে তাকে চেনে এমন অনেকেই হয়তো থাকতে পারে। চিনেবাদামওয়ালা ডেকে এক আনার কিনল। বাদাম খেতে খেতে ভাঁজতে শুরু করল, কীভাবে থলিটার হাত থেকে বিনা ঝামেলায় রেহাই পাওয়া যায়।

একটু পরেই সন্ধ্যা হবে। আধমাইলটাক দূরে নির্জন গলি বা মাঠ দেখে থলিটা টুক করে নামিয়ে রেখে দিলেই ল্যাঠা চুকে যাবে। এই ভেবে নিখিল ভারি সুখবোধ করল। চিনেবাদামওয়ালাকে আবার ডেকে এক আনার কিনল এবং ঝগড়া করে দুটো বাদামও আদায় করল।

একা চুপচাপ বসে থাকা যায় না, বিশেষত তার সামনের দৃশ্য বাচ্চাদের ছুটোছুটি, কিশোরীদের পায়চারিতে নকল গাম্ভীর্য, অফিস-ফেরত বাসের জানলায় সারিবাঁধা বিবর্ণ মুখ, বারান্দায় কনুই রাখা নতদেহ নিঃসঙ্গ যুবতী, রিকশাচালকের ঘামে ভেজা ঘাড়-যদি খুবই একঘেয়ে হয়। নিখিল ভাবল লন্ড্রিওয়ালাটাকে। এমন কোনো বার যায়নি প্যান্টের একটা-না একটা বোম ভেঙেছে। শেষ বার ঝগড়া করতে হয়েছে শার্টে নম্বরি মার্কা দেওয়ার ব্যাপারে। লোকের চোখে পড়ে কালিটা। এই সময়ে হঠাৎ নিখিলের মনে পড়ল, খুব ছেলেবয়সে একটা ডিটেকটিভ বইয়ে সে পড়েছিল ধোপাবাড়িতে কাচা কাপড়ের নম্বরি মার্কা ধরে তদন্ত করতে করতে গোয়েন্দা শেষকালে খুনিকে ধরে ফেলে। এই থলির মধ্যে সুমিত্রার কাপড় এবং বিছানার চাদরে নিশ্চয়ই লন্ড্রিওয়ালাটা নম্বর দিয়েছে। সুতরাং যেখানেই ফেলা যাক-না কেন, পুলিশ ঠিক তাকে বার করে ফেলবেই।

এইবার ঘামতে শুরু করল নিখিল। যদি বছর খানেকেরও বাচ্চা হত, তাহলে সকলের চোখের সামনে দিয়ে শ্মশানে নিয়ে গিয়ে চিতা সাজিয়ে পোড়ানো যেত। কিন্তু কেউ যদি দেখে ফেলে! হইচই করে ভিড় জমাবে। কত কথা জিজ্ঞাসাবাদ করবে। শেষে পুলিশে দেবে। কী ফেললুম সেটা প্রমাণ করা সহজ কথা নয়। সার্টিফিকেটটা দেখালেও বিশ্বাস করবে কেন? ঠিক ওই জিনিসটাই ফেলেছি কি অন্য কাউকে খুন করে কুচিকুচি করে প্যাকেটে বেঁধে ফেলিনি তার প্রমাণ কী!

নিখিলের মাথা ঝিমঝিম করতে শুরু করল। আর হতে পারে ওই থলিটার রংচং দেখে যদি কেউ এটাকে চুরি করে। চোর নিশ্চয় পুলিশকে খবর দেবে না। নিখিল এধার-ওধার তাকিয়ে চোর খুঁজতে শুরু করল, এবং আশ্চর্য হল একটা লোককেও তার চোর-চোর মনে হচ্ছে না। অথচ প্রতিদিনই যত লোক দেখে তারমধ্যে প্রায় ডজন খানেককে তার চোর বলে মনে হয়। এমনকী ঘর থেকে ঘড়িটা চুরি যাওয়ায় ঝিকে সবাই সন্দেহ করলেও তার প্রথমেই মনে পড়েছিল বাড়িওয়ালার মুখ। কিন্তু এখন একটাও চোর সে দেখতে পাচ্ছে না।

চোর নিশ্চয়ই কলকাতায় আছে, হয়তো এখন এই জায়গাটায় এক জনও নেই। নিখিল থলি হাতে উঠে পড়ল। থলিটা হাতে ঘুরে বেড়ালে নিশ্চয়ই কোনো-না-কোনো ছিনতাইওয়ালাকে আকর্ষণ করবে। তবে অন্ধকার রাস্তায় ছাড়া তাদের পাওয়া যাবে না। নিখিল আবার বসে পড়ল সন্ধ্যাটা পুরোপুরি নামার অপেক্ষায়।

যখন জাঁকিয়ে সন্ধ্যা নামল নিখিল হাঁটতে শুরু করল উদ্দেশ্যহীনভাবে। বহু ডাস্টবিন সে পেল যেখানে থলিটা ফেলে দেওয়া যায়। কিন্তু একটা ভয় ওর মনে গেঁথে আছে, বলা যায়

কে কোথা থেকে দেখে ফেলবে—হয়তো অন্ধকার গলিতে কোনো যুবক পাড়ার মেয়েকে চুমু খেতে খেতে কিংবা কোনো বুড়ি অন্ধকার বারান্দায় জপ করতে করতে বা রান্নাঘর থেকে কোনো গৃহিণী। এক বার চেঁচিয়ে উঠলেই হল! তাও যদি না হয়, কাপড়ের নম্বরি মার্কা যাবে কোথায়? পুলিশের গোয়েন্দা তদন্ত করে ঠিক বার করে ফেলবে। তখন অবশ্য সার্টিফিকেট দেখিয়ে বলা যাবে, মশাই অবৈধ কোনো ব্যাপার নয়। বাড়িওয়ালাকে চোরের মতো দেখতে হলেও বলেছে অ্যাকসিডেন্ট। স্বেচ্ছাকৃত ঘটনা নয়। যেকোনো পরিবারেই এমন ঘটতে পারে। কিন্তু এসব বলার আগেই, পুলিশ দেখে পাড়ায় ফিসফাস শুরু হবে। গুজব রটবে। মাস কয়েক আগেই তো একটা সার্জেন্ট এসেছিল পাড়ায়, অমনি শোনা গেল দেবব্রতবাবু বাড়িতে জুয়া খেলত তাই ধরে নিয়ে গেল। শেষে জানা যায় ভদ্রলোকের একটা রিকশা আছে, সেটা অ্যাকসিডেন্ট করায় থানায় ডাক পড়েছে।

হাঁটতে হাঁটতে নিখিল ক্লান্ত হয়ে পড়ল। থলিটা ছিনিয়ে নিতে কেউ তার সামনে ছোরা বার করল না। অথচ বস্তি দেখলেই সে ঢুকেছে। কেউ তার দিকে ফিরেও তাকায়নি। প্রায় নির্জন গলি দিয়েও হাঁটল। একটা ঝি শ্রেণির মেয়েমানুষ শুধু তেরছা চোখে তাকে দেখল মাত্র। এ ছাড়া কিছুই না হওয়ায় নিখিল ভাবতে বাধ্য হল, তাহলে?

এইবার সে ভয় পেতে শুরু করল। তাহলে এই সাত মাসের মৃত সন্তানটিকে নিয়ে সে এখন করবে কী? পনেরো-ষোলো ঘণ্টা হয়ে গেল। এবার পচন ধরবে, গন্ধ বেরোবে। অন্তত সুমিত্রার পেটে পুরো সময়টা কাটিয়েও যদি বেরোত। দোষটা অবশ্য কারুরই নয়। অথচ এইরকম একটা নির্দোষ ব্যাপার তাকে বিপাকে ফেলল। নিখিলের খুব রাগও হল। সেইসঙ্গে এটাও টের পেতে লাগল—আসলে সে ভয়ানক ভীতু। রীতিমতো কাপুরুষ। এরকম ঘটনা নিশ্চয় কলকাতায় এই প্রথম ঘটছে না। সেসব ক্ষেত্রে কিছু-একটা অবশ্যই করা হয়েছে। কিন্তু নিখিল ভাবল, তারা তো আমার মতো নয়। মানুষের সঙ্গে মানুষের প্রকৃতিগত হুবহু মিল থাকতে পারে না। তারা নিশ্চয়ই সাহসী ছিল অন্তত আমার থেকে।

হঠাৎ নিখিলের মনে হল, তার থেকেও ভীতু এমন কারুর ঘাড়ে যদি দায়িত্বটা চাপিয়ে দেওয়া যায়, তাহলে রেহাই মিলবে। ভীতুরা পুলিশে যাবে না। থলিটা নিয়ে এইভাবেই ঘুরে বেড়াবে আর ভাববে কী করে রেহাই পাওয়া যায়। অবশ্য গোপনেই তার ঘাড়ে চাপাতে হবে, নয়তো জিনিসটা কার জানতে পারলে বাড়ি বয়ে ফেরত দিয়ে আসবে।

চেনাশুনো ভীতু কে আছে নিখিল তাই ভাববার জন্য একটা ট্রাম স্টপে দাঁড়িয়ে পড়ল। বহুজনের নাম তার মনে এল। তারা কী পরিমাণ ভীতু তার নানান উদাহরণ মনে করতে লাগল। অবশেষে শশাঙ্ককেই তার পছন্দ হল। প্রায় চার বছর সুমিত্রার গৃহশিক্ষক ছিল। সুমিত্রাদের তরফ থেকেই বিয়ের প্রস্তাব দেওয়া হয়। কিন্তু শশাঙ্ক নানান অজুহাত দেখিয়ে বিয়েতে রাজি হয়নি। নিখিলের সঙ্গে সুমিত্রার আলাপ ওই করিয়ে দেয়। অবশ্য মাস ছয়েক হল ও বিয়ে করেছে। এখন যদি শশাঙ্কর সামনে হাজির হওয়া যায়, তাহলে নিশ্চয় ওর মনের মধ্যে সুমিত্রা, প্রেম, বিবাহ প্রস্তাব অগ্রাহ্য অর্থাৎ যাবতীয় ধাষ্টামো এবং অন্য আরে এক জনকে বিবাহ সব মিলিয়ে অপরাধবোধ তৈরি করবে। প্রাক্তন প্রেমিকদের তুল্য ভীতু আর কে? এই থলিটা ওর হাতে কোনোরকমে গছাতে পারলে, তারপর শশাঙ্করই ঝামেলা। বস্তুত সুমিত্রার প্রতি ওর বিশ্বাসঘাতকতার এটা ভালো একটা শাস্তিও হবে।

নিখিল এতসব ভেবে প্রফুল্লবোধ করল। তবে পুরোপুরি অস্বস্তি ঘুচল না। শশাঙ্ক থাকে একটা গলির এক-তলায়। কড়া নাড়তে ঝি দরজা খুলল। শশাঙ্ক বেরিয়ে এল, পরনে লুঙ্গি এবং গেঞ্জি। নিখিলকে চিনতে পেরে উচ্চকণ্ঠে সাড়ম্বর অভ্যর্থনা জানিয়ে ঘরে নিয়ে গেল।

সন্ধ্যা, দ্যাখো দ্যাখো কে এসেছে। এই বলে শশাঙ্ক ডাকতেই ভিতর থেকে ওর বউ এল। দেখতে মোটামুটি। রেডিয়োয় গান গায়, দু-একটা রেকর্ডও আছে। নিখিল দাঁড়িয়ে উঠে

নমস্কার করল।

আপনার কথা ওর কাছে শুনেছি। সন্ধ্যার এই কথায় নিখিল বিস্মিত হল। সুমিত্রার স্বামীর প্রসঙ্গ বউয়ের কাছে ভীতু শশাঙ্ক কি তুলবে? না কি এটা আলাপ করার একটা কেতা!

আমার সব বন্ধুর গল্পই করেছি সন্ধ্যার কাছে, সুতরাং পরিচয় করিয়ে গুণপনা ব্যাখ্যার দরকার আর হবে না।

শশাঙ্ক একটা বেতের চেয়ারে হেলান দিয়ে পা নাচাতে লাগল। ঘরের সব আসবাবপত্রই যে ওদের বিয়ের পর কেনা তা রঙের ঔজ্জ্বল্যতেই বোঝা যায়।

ওঁর গুণপনার খবর অবশ্য না বললেও আমরা জানি। নিখিল ইচ্ছে করেই আমরা বলল। সন্ধ্যাও যথারীতি বিনয় জানাতে ভারি তো গুণপনা, আমার মতো গাইয়ে গন্ডা গন্ডা আছে ইত্যাদি কথা পরমসুখে বলে গেল। এরই মধ্যে নিখিল শশাঙ্কর হাবভাব জরিপ করে একটা প্ল্যান তৈরিতে হাত দিল।

আমি তো এলাম, এবার আপনারাও একদিন চলুন।

নিশ্চয়। শশাঙ্ক যেন এই প্রস্তাবটার জন্য ওত পেতেই ছিল। কবে যাব বলো, সামনের রোববার? তাহলে ইলিশ খাওয়াতে হবে। তেলাপিয়া খেয়ে খেয়ে পেটে চড়া পড়ে গেল। সুমিত্রা দারুণ ইলিশ-ভাতে করতে পারে।

নিখিলকে হাসতেই হল। সন্ধ্যা কপট উদবিগ্নতা দেখিয়ে বলল, এখন ইলিশ পাওয়া যায়

আর তুমি ভদ্রলোককে বিব্রত করতে বায়না ধরলে ইলিশ খাব। আরে ও আবার ভদ্রলোক কী, ও তো নিখিল। ওকে সবথেকে লেগপুল করতাম আমি আর সনৎ। সনৎ লিখেছে ছুটি পেলে জানুয়ারিতে কলকাতা আসবে। তোর ঠিকানাটা লিখে দিস ওকে পাঠাব। শশাঙ্ক সবিস্তারে সনৎ-এর গল্প করে চলল আর নিখিল ভাবল, একী!

পুজোর বাজার নাকি? হঠাৎ সন্ধ্যা প্রশ্ন করল। নিখিল লাজুক হেসে ঘাড় নাড়ল। শশাঙ্ক ছোঁ মেরে থলিটা হাতে তুলে নিয়ে বলল, দেখি বউয়ের জন্য কী শাড়ি কিনলি। নিখিল তাড়াতাড়ি ওর হাতটা চেপে ধরল। আরে ধ্যাত, দেখার কী আছে আর। মার থান, ঝিয়ের কমদামি একটা মিলের আর সুমিত্রার একটা তাঁতের ষোলো টাকার শাড়ি। খুলিসনি প্লিজ। বেশ বাঁধাছাদা রয়েছে আবার কেন খাটুনি বাড়াবি।

সন্ধ্যা দেখেছ, বউয়ের শাড়ি আছে কিনা, অন্যের হাতের ছোঁয়াতেও আপত্তি। কী রঙের কিনেছিস? স্লেট না ডিপ মেরুন? একটা রং সুমিত্রা একবায় পরেছিল মেরুনের ওপর গ্রিন

ফুটিফুটি, পাড়টা হোয়াইট, দারুণ দেখাচ্ছিল ওকে।

রং খুব ফর্সা বুঝি? সন্ধ্যাকে খুব কৌতূহলী দেখাল।

না খুব নয়, আপনার মতোই।

ওমা, তাহলে তো বেশ কালো।

আপনি কালো হলে আমরা তো বেশ কালো।

নিখিল হাস্যমুখে শশাঙ্কের দিকে তাকিয়ে সমর্থন চাইল। শশাঙ্ক বড় করে ঘাড় নাড়ল। রঙের প্রশংসায় পুলকিত সন্ধ্যা বলল, দেখেছেন চা দিতেই ভুলে গেছি।

সন্ধ্যা ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই নিখিল বলল, শশাঙ্ক, একটা খুব অসুবিধায় পড়ে গেছি। জিজ্ঞাসু নেত্রে শশাঙ্ক তাকিয়ে রইল। তখন নিখিল আদ্যোপান্ত ব্যাপারটা বলে টেবলের ওপর রাখা কাগজের থলিটা আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলল, ওর মধ্যেই সেটা রয়েছে।

শশাঙ্ক চড়াং করে সিধে হয়ে বসল। তার মানে, তুমি ওই কুৎসিত জিনিসটা আমার টেবিলের উপর রেখেছ? নামাও নামাও, বলছি। দাঁত চেপে হিসহিস করে শশাঙ্ক আঙুল দিয়ে মেঝে দেখাল। নিখিল নামিয়ে রাখল।

কী করতে এখানে এনেছ? চাপাস্বরেই শশাঙ্ক বলল, ভিতরের দিকে চোখ রেখে।

এটাকে নিয়ে কী করব ভেবে পাচ্ছি না।

ফেলে দেবে, আস্তাকুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে দেবে।

বলাটা তো খুবই সোজা, ফেলতে গেলেই লোকে দেখে ফেলবে। তখন চিৎকার হবে, একগাদা লোক জমবে, টানতে টানতে হাজার হাজার লোকের মধ্য দিয়ে থানায় নিয়ে যাবে। অশ্লীল কথা বলাবলি করবে।

তা আমার কী করতে হবে?

এটার একটা বন্দোবস্ত করে দে, শশাঙ্ক, প্লিজ। তোর কথাতেই বিয়ে করেছিলুম। এবার তুই আমার কথা রাখ। নিখিল হাত বাড়াল শশাঙ্কের হাত চেপে ধরার জন্য। হাত দুটো তার আগেই শশাঙ্ক তুলে নিয়েছে। টেবলে নিখিলের দুটো হাত থলিটার পাশে পড়ে রইল।

আমার কথাতেই কি শুধু বিয়ে করেছিলি? সুমিত্রাকে তোর পছন্দ হয়নি?

নিশ্চয়, ওকে নিশ্চয় ভালোবেসেছিলুম, আজও বাসি। কিন্তু তোর সঙ্গে ওর একটা সম্পর্ক ছিল তাও জানি।

তাই এক্সচেঞ্জ করতে এসেছিস এই জিনিসটার বদলে। শশাঙ্ক থলিটার দিকে আঙুল তুলেছে তখন চায়ের কাপ হাতে সন্ধ্যা ঢুকল।

কীসের এক্সচেঞ্জ? হাসিমুখে সন্ধ্যা একটা চেয়ারে বসল।

নিখিল বলছিল তুমি যদি গোটা কতক গান শোনাও। তাইতে বললুম বউয়ের শাড়িটা তার বদলে দিতে হবে।

আহা, পছন্দ করে উনি কিনেছেন। আর গান যা গাই সে এমন কিছু নয়।

সন্ধ্যা মেয়েটি ভালো। এরপর খুব বেশি সাধাসাধি করতে হয়নি। খালি গলায় তিনটি গান করল। শশাঙ্ক উঠে দাঁড়িয়ে বলল, নিখিলকে একটু এগিয়ে দিয়ে আসি। পাঞ্জাবিটা দাও।

ওরা দুজন চুপচাপ পাশাপাশি হাঁটতে লাগল। রাত হয়েছে। রাস্তায় লোকজন কম। দোকান গুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আলোর পরিমাণ খুবই অল্প। নিখিলের মনে হল, রাস্তার যেকোনো জায়গায় থলিটা রেখে নির্বিবাদে চলে যাওয়া যায়।

ওটা দে। শশাঙ্ক দাঁড়িয়ে পড়ল।

কেন!

ওই ডাস্টবিনটায় ফেলে দি।

সে তো আমিও পারতুম, তাহলে তোর কাছে এলুম কেন?

তবে কী মতলব তোর? হঠাৎ শশাঙ্ক গলার স্বর ও দাঁড়াবার ভঙ্গি পালটে ফেলল। নিখিল পা-পা করে পিছোল। দূরে পানের দোকানটা মাত্র খোলা। এখন থলি হাতে ছুটতে শুরু করলে চোর বলে ধরা পড়তেই হবে। নিখিল দাঁড়িয়ে রইল।

তুমি এখন সুমিত্রার বিয়ে করা স্বামী। শশাঙ্ক ওর বুকের জামা মুঠো করে ধরল, তুমি এই জিনিসটার বৈধ অভিভাবক, তার সার্টিফিকেটও পকেটে আছে। অতএব এর সম্পূর্ণ দায়িত্ব তোমার। আমার দায়িত্ব বহুদিন আগে শেষ হয়েছে। তবুও আমার কাছে কেন এসেছ? নিখিলকে ঝাঁকাতে শুরু করল শশাঙ্ক।

তুই আমার ঘাড়ে দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়েছিস। তুই কাওয়ার্ড, তুই ইররেসপনন্সিবল। নিখিল মরিয়া হয়ে উঠল শূন্য প্রয়ান্ধকার রাজপথে। শশাঙ্কর হাত থেকে নিজেকে মুক্ত করার জন্য ধাক্কা দিল। বদলে জোর চড় মারল শশাঙ্ক। এইবার ক্রোধে দিশেহারা হয়ে মারবার জন্য নিখিল ঝাঁপিয়ে পড়ল।

হঠাৎ জানালা খুলে দোতলা থেকে এক পুরুষকণ্ঠ গর্জে উঠল, কী হচ্ছে, অ্যা, গুণ্ডামি? লোকটা চিৎকার করে উঠল! দুড়দাড় করে কিছু লোকের ছুটে আসার শব্দ এল অন্ধকারের মধ্য থেকে।

নিখিল আর চিন্তা করার সুযোগ নিজেকে দিল না। প্রাণপণে রাস্তার নির্জন দিকে ছুটতে শুরু করল। ছুটতে ছুটতে যখন দম ফুরিয়ে এল, থামল। তখন পায়চারি করতে করতে এক কনস্টেবল তার কাছে এসে কেন সে এমন করে হাঁপাচ্ছে তার কারণ জানতে চাইল। নিখিল বলল, একটা গুণ্ডা তাকে তাড়া করেছিল। কনস্টেবলটি কিছুক্ষণ সেইদিকে তাকিয়ে থেকে আচ্ছা ঠিক হ্যায় বলে পায়চারি করতে করতে চলে গেল।

নিখিল এইবার টের পেল কাগজের থলিটা তার কাছে নেই। ছোটার সময়ও হাতে ছিল না। সেটি শশাঙ্কর কাছেই রয়ে গেছে। শশাঙ্ককে লোকগুলো জিজ্ঞাসা করলে ও নিশ্চয় বলবে গুণ্ডা তাড়া করেছিল। গুণ্ডা নিশ্চয়ই সুদৃশ্য কাগজের থলিতে ভরা কাপড়ের প্যাকেট ফেলে যায়নি। লোকগুলো খুব খুশি হয়ে নিজেদের মধ্যে বলাবলি করবে, ভাগ্যিস আমরা এসে পড়লুম তাই ভদ্রলোকের এই জিনিসটা রক্ষে পেল। এই বলে তারা তার থলিটা শশাঙ্কর হাতে তুলে দেবে।

নিখিল বুকপকেটে হাত দিয়ে সার্টিফিকেটটা অনুভব করে ভারি আরাম পেল। এবং সে মনশ্চক্ষে দেখল, শশাঙ্ক সেই থলিটা হাতে নিয়ে হেঁটে চলেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *