বুড়ো এবং ফুচা

বুড়ো এবং ফুচা

ভাড়া নিয়ে বসবাস শুরু করার প্রথম কয়েকটা দিন শব্দটা সে টের পায়নি। বাবান, তনু আর কাজের মেয়ে শম্পা ঘুমিয়ে পড়ার পর বিশ্বনাথ লিখতে বসে। শোবার ঘরটা আজকালকার সাধারণ ঘরের প্রায় আড়াই গুণ। এককোণে কাঠের ছোটো টেবিলে দুটো অভিধান, কলম রাখার জন্য একটা নকশাকাটা পিতলের গ্লাস, লেখার প্যাড, লেখা পাতাগুলো জমা করার একটা ফাইল, কয়েকটা দরকারি বই, সবই গুছিয়ে রাখা। অনাবশ্যক একটি জিনিসও সে টেবিলে রাখে না।

ঝরাপাতার উপর দিয়ে সাপ চললে যেমন শুনলেই শিরশির করে ওঠে গায়ের চামড়া, শব্দটা সেইরকমই। বিশ্বনাথ অবশ্য ঝরাপাতার উপর দিয়ে সাপ কেন কোনো সরীসৃপকেই চলতে দেখেনি বা চলার শব্দও শোনেনি। ছোটোবেলায় একটা অ্যাডভেঞ্চার বইয়ে পড়েছিল, খরখর, সরসর শব্দ করে সাক্ষাৎ মৃত্যু যেন এগিয়ে আসছে গোপনে। এটা এখনও তার মাথার মধ্যে গেঁথে আছে। মুখটা তুলে কড়িকাঠের দিকে তাকায়, গত শতাব্দীর বাড়ি। ছাদটা এখনকার ঘরের প্রায় দ্বিগুণ উঁচুতে। পাখা ঝোলাবার জন্য পাঁচ ফুট লম্বা রড় কিনে দু-ধারে প্যাঁচ কাটিয়ে আনতে হয়েছে। মোটা মোটা পাঁচটা কাঠের কড়ি আর গোটা ষাটেক বরগায় ভর দিয়ে রয়েছে দোতলার ঘরের মেঝেটা। সেটা বরফির মতো সাদা আর কালো পাথরে ঢাকা। অনেকগুলো পাথর ফেটে গেছে। ফাটলে ময়লার দাগটানা। তাদের নীচের ঘরটার মেঝেও হুবহু একই দশায় ফাটা, পাথরের ফাঁকে নোংরা জমে আছে। উপর-নীচের ঘর দুটো আয়তনে উচ্চতায় একই রকমের।

বিশ্বনাথ সরসর শব্দটা শুনেছিল রাত বারোটা নাগাদ। ঠিক মাথার উপর ঘরের একধার থেকে অন্যধার তারপর দরজা দিয়ে পৌঁছোল লম্বা বারান্দাটায়। কয়েক সেকেণ্ড থেমে বারান্দার অন্য প্রান্তে সিঁড়ির মাথা পর্যন্ত গিয়ে অবশেষে আবার ঘরে ফিরে আসে। সাপ চলার শব্দের সঙ্গে ছিল ছপ ছপ বাড়তি একটা অস্পষ্ট শব্দও। নৌকার দাঁড় জলে পড়ার মতো এই শব্দটা। বিশ্বনাথ নৌকায় গঙ্গা পারাপার করেছে বলেই সেইরকম মনে হল শব্দটাকে। সর্ব অর্থেই প্রায় তখন নিশুতি। পার্টিশন করা পাশের সরিকি বাড়িতে রোজ রাতে কেউ একজন মোটরে ফেরে। বন্ধ করার আগে দু-তিন বার ইঞ্জিনটাকে গোঁ-গোঁ করিয়ে নেয়। সেটা করা হয়ে গেছে। আশেপাশের টিভি সেটগুলো বন্ধ। যদি কোনো রিকশার চাকা রাস্তার গর্তে পড়ে ঘটাং ঘট করে ওঠে সেটা বরং এইসময় সজীব লাগে। কিন্তু মাথার উপরের এই শব্দটা সিলিং থেকে হিমের মতো নেমে এসে শিরদাঁড়ায় যে অনুভূতি দিচ্ছে, এটা তার ভালো লাগছে না। হঠাৎই খরখর সরসর করে সাক্ষাৎ মৃত্যু শব্দ ক-টা মনের মধ্যে কেন যে ঝিলিক দিল তার কোনো কারণ সে নিজের কাছে দর্শাতে পারল না। সে মুখ তুলে শব্দটা কে করছে সেটাই বুঝতে চেষ্টা করল।

উপরে থাকে একটা বুড়ো। এই বাড়ির মালিক। মাঝারি উচ্চতায় শীর্ণ ছোটোখাটো দেহ। পাতাকাটা কাঁচা পাকা হালকা চুল। টানা সরু চোখ এবং একটু বেমানান লম্বা নাক। গায়ের চামড়া ফ্যাকাশে ট্রেসিং কাগজের মতো পাতলা। বিশ্বনাথ এক বারই মাত্র কয়েক সেকেণ্ডের জন্য ওকে খালিগায়ে দেখেছে যখন অ্যাডভান্সের টাকা দিতে আসে। লম্বা বারান্দার শেষে একটা ভারী পায়াওয়ালা চেয়ারে হেলান দিয়ে অলস ভঙ্গিতে বুড়ো বসেছিল সামনের দেওয়ালটার দিকে তাকিয়ে। সিঁড়িতে পায়ের শব্দ পেয়ে চমকে উঠে মুখ ফিরিয়ে তাকে দেখেই দ্রুতপায়ে শোবার ঘরে ঢুকে পাঞ্জাবি গায়ে দিয়ে বেরিয়ে আসে। বুড়োর পায়ে ছিল পাতাঢাকা ক্যানভাসের সাদা চটি। পাঞ্জাবির মতো চটিটাও সবসময় পরে থাকে। চলার সময় শব্দ হয় না।

তাহলে এত রাতে শব্দটা কেন? উপরে বুড়ো ছাড়া আর তো কোনো মানুষ বাস করে না! বিশ্বনাথ ভুলে গিয়েছিল বুড়োর সঙ্গে একটা কুকুরও উপরে থাকে। সেটা মনে পড়তেই কুকুরের চেহারাটা তার চোখে ভেসে উঠল। ঘুমন্ত বউ আর ছেলের দিকে এক বার তাকিয়ে সন্তর্পণে দরজার ছিটকিনি খুলে সে দালানে বেরিয়ে আলো জ্বালল। দোতলার বারান্দার নীচেই তাদের এই দালান, যেটাকে ভাড়াটের জন্য দেয়াল তুলে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছে দোতলায় যাবার সিঁড়ির সঙ্গে। এই দেয়ালঘেরা দালানেই রান্নাঘর ইত্যাদি এবং শম্পা রাতে ঘুমোয়। ঘুমন্ত মেয়েটিকে পাশ কাটিয়ে সে বাইরে বেরোবার দরজাটা খুলল।

বাড়িটার তিন দিক ঘিরে সরু জমি। আরও জমি ছিল কিন্তু বিক্রি হতে হতে এবং সম্পত্তি ভাগ হয়ে বুড়োর এই বাড়িটা বড়ো শরিকের পিছনের অংশে পড়ে গেছে। সামনের বাড়ির, যাকে বলা হয় ও-বাড়ি, তাদের ভাগে লোহার ফটক কিন্তু বুড়োর অংশে আসতে হলে পাশের সরু গলিটায় ঢুকে কোমরসমান লোহার পাতের দরজাটা ব্যবহার করতে হয়। সেখান থেকে হাত দশেক চওড়া জমি বাড়িটাকে ঘুরে বিশ্বনাথের দরজার সামনে দিয়ে এগিয়ে একটা দেয়ালে শেষ হয়েছে। সেখানে এক কালোয়ারের টিনের চালা, যাতে জমা করা আছে বাতিল বা নিলামে কেনা মেশিনপত্তর। মাঝে মাঝে কুলিরা লোহালক্কড় রাখতে বা তুলে নিয়ে যেতে আসে। রাতে একজন পাহারাদার চালার নীচে ঘুমোয়।

কালোয়ারের লাগানো একটা ষাট পাওয়ারের বালব চালার বাইরে জ্বলছে। তাইতে অন্ধকার ঘঘাছে না তবে চেনা জায়গাটা চেনা যায়। সামনের দেওয়ালে দুটো হুকে কাপড় মেলতে দেওয়ার নাইলন দড়িটা যেখানে ঝুলে পড়েছে সেখানে আলকাতরায় লেখা ঝাপসা হয়ে-যাওয়া খতম শব্দটাকে বিশ্বনাথ এখন চিনতে পারছে এইজন্যই, ওটা ওখানে যে রয়েছে তা জানে বলেই। নয়তো সে দূর থেকে আসা ষাট পাওয়ারের আলোয় খতম-কে বুঝে উঠতে পারত না। কলকাতার বহু দেওয়ালে এই শব্দটা একসময় সে দেখেছে, এখন আর দেখতে পায় না।

দরজা থেকে বেরিয়ে খতম-এর কাছাকাছি এসে ঘুরে উপর দিকে সে তাকাল। শব্দ কীভাবে এবং কে তৈরি করছে এটাই সে জানতে চায়। ঢালাই লোহার ধূসর নকশাদার রেলিং, দু-তিন জায়গায় লোহা অদৃশ্য। বিশ্বনাথ বারান্দায় দুই প্রান্তে রেলিং-এর উপর দিয়ে কয়েক বার দৃষ্টি টানল। রেলিং-এর ফাঁক দিয়ে কিছুই গোচর হল না। কান পেতেও কোনো শব্দ পেল না। পাহারাদারটা খাটিয়ায় ঘুমোচ্ছে দেখে সে বাড়ির মধ্যে ঢোকার জন্য চার-পাঁচ পা এগিয়েই দাঁড়িয়ে পড়ল। কেন জানি তার মনে হল বারান্দার কেউ রয়েছে। আর এক বার বারান্দার দিকে তাকাবার ইচ্ছাটা সামলাতে না পেরে সে মুখ তুলল।

একটা সাদা ছুঁচোলো মুখ বারান্দার ভাঙা রেলিংয়ের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে, ঠিক তার মাথার উপর। কলিজাটাকে এক বার কে যেন কচলে দিয়ে ছেড়ে দিল। বিশ্বনাথের প্রায় এক মিনিট সময় লাগল ধীরে ধীরে শ্বাস-প্রশ্বাসের ছন্দ ফিরে পেয়ে স্বাভাবিক হয়ে উঠতে। সে ভূতপ্রেত, দৈত্যদাননা প্রভৃতি ব্যাপারে বিশ্বাসী নয়। মাথার কয়েক হাত উপরে, নিশুত আধা অন্ধকারে অপ্রত্যাশিত একটা সাদা জন্তুর মাথা দেখতে পেয়ে সে ভয় পেল। নীচের দিকে মাথাটা নামিয়ে জন্তুটা তার দিকেই যেন তাকিয়ে। মাথাটা কয়েক সেকেণ্ড রেলিংয়ের বাইরে থাকার পর অদৃশ্য হল। বিশ্বনাথ ছুটে ভিতরে ঢুকে পড়ল। দরজা বন্ধ করে চেয়ারে বসার পর মুখ তুলে কড়িকাঠের দিকে তাকিয়ে সে নিজের মনে বলল, কুকুরটার চোখ দুটো কী ভীষণ জ্বলজ্বল করছিল।

সেই প্রথম দিন অ্যাডভান্সের টাকা দিতে এসে বুড়োর চেয়ারের পিছনে সে কুকুরটাকে দেয়ালঘেঁষে ঘুমোতে দেখেছিল। তাদের কথাবার্তার শব্দে ওর ঘুম ভাঙেনি। বড়ো সাদা লোম কিন্তু নোংরা। এক নজরেই বোঝা যায় ওকে কখনো স্নান করানো হয় না, কোনো কালে চিরুনিও পড়েনি। লেজের ডগায় চটা পড়ে একটা ডেলা হয়ে রয়েছে। কোমরের দিকে পিঠের উপর লোম গুলো চর্মরোগের চুলকানিতে কামড়ে কামড়ে ছিঁড়ে ফেলা। জায়গাটায় কাঁচা দগদগে ঘা। পাঁজরের লোম উঠে যাওয়ায় গোলাপি রঙের চামড়া দেখা যাচ্ছে। ওর চার পায়ের নখ কিন্তু বিশ্বনাথকে অবাক করেছিল। সেগুলো প্রায় ইঞ্চি দুয়েক লম্বা। তখন এক বার মনে হয়েছিল এত বড়ো নখ নিয়ে চলাফেরা করে কী করে? সে আরও দেখেছিল কুকুরটার বকলসের বদলে একটা কাপড়ের ফালি গলায় বাঁধা আর তাতে লাগানো রয়েছে একটা লোহার চেনা চেনটা মেঝেয় পড়ে আছে। কুকুরটি পুরুষ, বৃদ্ধ আর তার প্রভুর মতোই রুগ্ন।

পরদিন সকালে তনু স্কুলে যাবার জন্য যখন শায়ার উপর শাড়িটাকে পাক দিয়ে আঁচলটা পিঠে ঝোলাতে ব্যস্ত, বিশ্বনাথ তখন ব্রাশে পেস্ট লাগাতে লাগাতে বলল, রাতে একটা সরসর শব্দ হয় ওপরের মেঝেয়, শুনেছ কি?

রাতে! কখন?

এই বারোটা নাগাদ।

তখন তো ঘুমে কাদা, শুনব কী করে। এই বলে নাভির উপরে পাট-করা শাড়ির গুছিগুঁজতে খুঁজতে তনু কৌতূহলী চোখে তাকাল। বিশ্বনাথ খুবই পছন্দ করে তনুর ক্ষীণকটি। মা হবার পর মেয়েরা দেহের ছন্দ সম্পর্কে উদাসীন হয়ে পড়ে, তনু পড়েনি। ওর চরিত্রের কাঠিন্য দেহতেও বিস্তৃত।

অত রাতে মাথার উপর গা-শিরশির-করা একটা শব্দ, তার সঙ্গে আর একটা ছপ ছপ শব্দ রীতিমতো ভয় লাগিয়ে দেয়।

কীসের শব্দ, বুড়োটা পায়চারি করছিল?

তাই জানতেই তো কাল রাতে বাইরে বেরিয়েছিলুম। বারান্দার দিকে তাকিয়ে দেখি রেলিং থেকে মুখ বার করে কুকুরটা আমাকে দেখছে।

তনুর উদবিগ্ন চোখ হাতঘড়ি হয়ে শম্পার কোলে বাবানের মুখের উপর পড়ল। ঠিক তিনটের সময় ওকে মুসুম্বির রস করে খাওয়াবি…দাদা না ফেরা পর্যন্ত বাড়ির বাইরে যাবি না। … হ্যাঁ তারপর, কুকুরটা দেখছে বললে…

মনে হল চোখ দুটো জ্বলছে।

অন্ধকারে জন্তুজানোয়ারের চোখ অমন দেখায়।

বউদি, দাদাকে সেই কথাটা বলেছ। শম্পা মনে করিয়ে দিল।

কোন কথা?

ওপর থেকে বাড়িওয়ালা আমাদের জানালার পাশে কুকুরের গু ফেলে।

হ্যাঁ, এই এক বিশ্রী ব্যাপার করে বুড়োটা, এটা নিয়ে ওকে বলা দরকার। হাগাতে-মোতাতে রাস্তায় নিয়ে যেতে পারে তো! জানালার ধারে এইসব নোংরা জমলে রোগভোগ হতে কতক্ষণ। তুমি এক বার ওকে বলো। হাতব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে, রামকৃষ্ণের ছবির সামনে চোখ বন্ধ করে সেকেণ্ড পনেরো মাথা নামিয়ে তনু দাঁড়িয়ে থাকল। হাতঘড়িটা আর এক বার দেখেই সে চটি পরে নিয়ে যাচ্ছি বলে বেরিয়ে গেল। শম্পা পিছু নিল বাবানকে কোলে নিয়ে, সদর দরজা থেকে বাবান তার মাকে টা-টা করবে।

তনিমা বাস ধরে শেয়ালদা স্টেশন যাবে। ন-টা আটাশের কৃষ্ণনগর লোকাল ধরে যাবে চাকদা। দেড় ঘণ্টা ট্রেনের পর কুড়ি মিনিট ভ্যান রিকশায় সহজপুর। সীতানাথ আদর্শ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে তার প্রথম ক্লাস সাড়ে এগারোটায়। স্কুল ছুটির পর ছ-টি ছেলে-মেয়েকে সে অঙ্ক আর ফিজিক্যাল সায়েন্স পড়ায় এক ঘণ্টা। এটা সে করে যাতায়াতের আর যৎসামান্য খাওয়ার জন্য খরচটা তুলে নিতে। সাতটা এগারোর কৃষ্ণনগর ধরে বাড়ি ফিরতে ফিরতে প্রায়শই রাত সাড়ে নটা হয়। ক্ষুকাতর, অবসন্নতায় বসে যাওয়া মুখ নিয়ে সে মোটামুটি বারো ঘণ্টা বসবাসের জন্য বাড়ি ফেরে। বিয়ের আগে থেকেই সে জীবনযাপনের এই প্রণালীর সঙ্গে সড়োগড়ো। বিশ্বনাথ ওর জন্য কষ্টবোধ করে, ওকে সমীহ করে, ভয়ও পায়।

স্নান করতে যাবার আগে সে বাইরে গিয়ে ঘরের পিছন দিকটা দেখতে গেল। বুড়োকে বলার আগে ব্যাপারটা দেখে রাখা উচিত। যা দেখল তাতে বিরক্ত হতে হতে মাথা গরম হয়ে উঠল। সরু জমিটা এতরকম জঞ্জাল, আগাছা, ভাঙা ইট-রাবিশে ভরা যে পরিষ্কার করতে ময়লা ফেলার অন্তত তিনটে হাতগাড়ির দরকার হবে। তনু মিথ্যা বলেনি, জানলার গায়েই রোগের ডিপো! বিশ্বনাথের মনে হল, এটা তারই ত্রুটি। যতক্ষণ সে ঘরে থাকে শুধু লেখার চিন্তা নিয়ে সংসারকে পাশ কাটিয়ে যাওয়াতেই ব্যস্ত থাকে। জানলার বাইরে কী জমা রয়েছে সেটা তারও তো লক্ষ করা উচিত ছিল। বাবানের স্বাস্থ্যের কথাটাই আগে ভাবা দরকার। বুড়োকে আজ সন্ধ্যা বেলায়ই সে বলবে দু-দিনের মধ্যে যেন সে পরিষ্কারের ব্যবস্থা করে। শুধু ঘরভাড়া দিয়েই বাড়িওয়ালার কর্তব্য যে শেষ হয় না, এটা ওঁকে বুঝিয়ে দেওয়া দরকার।

বাড়ি ফিরতে বিশ্বনাথের একটু বেশিই দেরি হল। এক বিদেশি ওষুধ কোম্পানিতে সে মার্কেটিং ম্যানেজারের স্টেননা। তা ছাড়া সে চিত্রনাট্য লেখে টিভি সিরিয়ালের জন্য। অফিস ছুটির পর ভবানীপুরে স্নেহময়ের বাড়িতে গেছল চিত্রনাট্যের কিছু অংশ দেখাবার জন্য। স্নেহর সঙ্গে কলেজে পড়ার সময় তার পরিচয়। কলেজের বড়ো ঘরটায় ইউনিয়নের কালচারাল কমিটির উদ্যোগে বছরে তিন-চার বার যেসব অনুষ্ঠান হত তাতে দু-বার বিশ্বনাথের লেখা একাঙ্ক হাসির নাটক অভিনীত হয় স্নেহর পরিচালনায়। সবাই খুব হেসেছিল। বিকম পাস করার পর বিশ্বনাথ নাট্যকার হবার শখটা আর লালন করেনি ভেঙে পড়া সংসারটাকে মেরামত করার জরুরি তাগিদে। এর বছর দশেক পর পাড়ার এক বন্ধুর বাড়িতে সে ওয়ান-ডে ক্রিকেট ম্যাচ টিভিতে দেখতে যায়। ম্যাচ শেষ হবার পর একটা ডকুমেন্টারি হচ্ছিল প্রতিবন্ধীদের সম্পর্কে। সেটা শেষ হতেই বিশ্বনাথ পাঁচ-ছ সেকেণ্ডের জন্য একটা নাম দেখেছিল : পরিচালক স্নেহময় মান্না। তার মনে হল এই লোকটি তার সহপাঠী স্নেহ ছাড়া আর কেউ নয়। অতঃপর সে খুঁজে বার করে স্নেহকে, এবং তার স্ক্রিপ্ট লেখক হয়ে যায়। কয়েকটা ডকুমেন্টারির পর ছোটোগল্পের একটি তেরো পর্বের সিরিয়ালের স্ক্রিপ্ট লিখে বিশ্বনাথ প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেছে। এখন সে স্নেহের সঙ্গে আলোচনা করে অস্ট্রেলীয় একটি সিরিয়ালকে তেরো পর্বে বঙ্গীকরণের কাজে ব্যস্ত। এজন্য প্রায়ই তাকে ভবানীপুরে স্নেহের বাড়িতে যেতে হচ্ছে সিরিয়ালটির ভিডিয়ো ক্যাসেট দেখার জন্য।

ভবানীপুর থেকে তার এবং চাকদা থেকে তনুর ফেরাটা প্রায় একই সময়ে ঘটল। বারান্দায় রেলিঙের ধারে বুড়োটা চেয়ারে বসে মাথা ঝুকিয়ে কিছু-একটা পড়ছে, বাড়ি ঢোকার সময় এটা দুজনেই দেখেছে। বিশ্বনাথই শুরু করল :

রাত হয়ে গেছে, আজ থাক। বুড়োকে কাল কি পরশু বলব।

বলার সময় একটু মাথা ঠাণ্ডা রেখে বোলো। ঝগড়া করে বোস না। খাটে পা ঝুলিয়ে চিত হয়ে শুয়ে তনু বলল।

চেয়ারে-বসা বিশ্বনাথ মুখ ঘুরিয়ে তনুর দেহের মাঝামাঝি অংশটায় চোখ রেখে বলল, পাগল নাকি। এমন নিরিবিলি পরিবেশ, ভিড়ভাট্টা চ্যাঁ-ভ্যাঁ নেই, ঝুটঝামেলা নেই, এইরকম জায়গায় ঝগড়া করে অশান্তি টেনে আনতে যাব কেন? এই একটা ঘর মানে তো দুটো ঘর, সঙ্গে অতবড়ো দালান, এই ভাড়ায় কলকাতায় এখন কোথায় পাব। বুড়োমানুষ, একা, ওর সঙ্গে মানিয়ে আমাদেরই চলতে হবে।

বুড়োকে কখনো দোতলা থেকে নামতে দেখেছ? তনু মুখ ফিরিয়ে স্বামীর দিকে তাকাল এবং খোলা পেটের উপর শাড়িটা টেনে দিল। বিশ্বনাথের চোয়াল শক্ত হয়েই আবার শিথিল হল। চোখ দেখেই ও বোধ হয় বুঝতে পারে স্বামী কী চায়। তার মনে হচ্ছে রাতে তনু বলবে, আজ থাক, বড্ড ক্লান্ত। তারপর পাশ ফিরে বাবানকে জড়িয়ে ধরে অঘোরে ঘুমিয়ে পড়বে। তনু অবশ্য সত্যিই ক্লান্ত থাকে।

লক্ষ করিনি। কাজের লোকজন নেই যখন নিশ্চয় বেরোয়। তুমি দেখেছ?

বেরোয়। শম্পা দেখেছে, বেলা দশটায় থলি হাতে বেরোয়। কালোয়ারের দারোয়ানটা কেরোসিন এনে দেয়। বুড়ো নিজের হাতে রান্না, কাচা, ঘরমোছা সব কাজ করে। … খুব কিপটে। তনু স্বামীর দিকে তাকাল কিছু-একটা মন্তব্য আশা করে।

কুকুর পোষার শখ আছে। বিশ্বনাথ মন্তব্য না করে উঠে পড়ল। এখন স্নান করে, কিছু খেয়ে বিছানায় চিত হয়ে সকালে চোখ-বুলোনো খবরের কাগজটা সে খুঁটিয়ে পড়বে।

টিভি সেট-এর কী হল, খোঁজ নিলে? তনু উঠে বসে আলগা স্বরে জানতে চাইল। প্রােগ্রাম গুলো তো তোমার দেখা দরকার।

দেখার আর কী আছে। আমার কাজ গল্প তৈরি করা আর সাজানো। আসল কাজটা তো করবে স্নেহ।

তবু, খোঁজ নাও।

নিয়েছি। ব্ল্যাক অ্যাণ্ড হোয়াইট দু-হাজারের মধ্যে, কালার চোদ্দো হাজার।

চোদ্দো! অত টাকা দিয়ে তো নেওয়া সম্ভব নয়।

বিশ্বনাথ কথা না বাড়িয়ে স্নানে চলে গেল। সে জানেই তনু চোদ্দো হাজার টাকা খরচে আপত্তি জানাবে। আপত্তি তার নিজের নেই বটে কিন্তু টাকার অঙ্কটার সঙ্গে শখের বনিবনা যে সম্ভব নয় অসহায়ভাবে সেটা তাকে মেনে নিতে হয়েছে। তারা দুজনেই টাকা জমাচ্ছে একটা ফ্ল্যাট কেনার জন্য। কলকাতার আশেপাশে ছোটো দু-ঘরের ফ্ল্যাট তিন লাখের কমে পাওয়া যাবে না এটা তারা জানে। আজ পর্যন্ত দুজনে যা জমিয়েছে আর নানান জায়গা থেকে ধার বা আগাম হিসেবে যা সংগ্রহ করতে পারবে, সব মিলিয়ে যোগ করে দেখেছে আধখানা ফ্ল্যাটের মালিক হবার মতো অবস্থায় তারা এখন রয়েছে। সুতরাং দু-রকমের টিভি সেট-এর মধ্যে বারো হাজারের ব্যবধানটা তাদের কাছে মাটির মেঝের সঙ্গে মোজাইক টালির মতো। টিভি সেট কেনার বাসনাটা এতদিন তারা দমন করেই রেখেছিল। কিন্তু স্ক্রিপ্ট লেখার কাজ থেকে বাড়তি আয়ের পথ খুলে যাওয়ায় তারা পরিজনে-ঠাসা পৈতৃক বাড়ির ছোটো একটা ঘর, অবিরাম চেঁচামেচি এবং নিত্য বিবাদের কবল থেকে রেহাই পেতে বেরিয়ে এসেছে। এজন্য প্রতি মাসে আটশো টাকা বেশি খরচ হবে। বিশ্বনাথ তখন সেটা তনুকে বলেছিল।

হোক, তবু এখানে আমি বাবানকে মানুষ হতে দেব না। এত ইতরোমি আর নোংরা কথাবার্তার মধ্যে ও একটা অমানুষ হয়ে উঠবে। ওকে আমি ভালোভাবে মানুষ করব, ওকে ভালো ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়াব। কঠিন গলায় তনু জানিয়ে দিয়েছিল শ্বশুরবাড়িতে সংসার পেতে সে ভবিষ্যৎ নষ্ট করবে না। বাপ-ঠাকুরদার বাড়ি ছেড়ে আসতে বিশ্বনাথের কষ্ট হয়েছিল কিন্তু তনুর উচ্চাকাঙ্ক্ষা তার কষ্টটাকে ঘাড় ধরে নুইয়ে দিয়েছিল। এখন আর ব্যথা করে না।

রাত্রে লিখতে বসে বিশ্বনাথ অনেকক্ষণ পর আবিষ্কার করল সে এক লাইনও লেখেনি, উৎকর্ণ হয়ে দোতলা থেকে সরসর আর ছপ ছপ শব্দ দুটো কখন নেমে আসবে তার জন্যই সে অপেক্ষা করছে। বার বার সে সিলিংয়ের দিকে তাকাল। কোনো শব্দ নেই। অপেক্ষা করতে করতে অবশেষে হতাশ হয়ে পড়ল। আজ আর লেখা হবে না, এমন এক ধারণায় পৌঁছে সে আলো নিভিয়ে শুয়ে বাঁ-হাতটা অঘোরে-ঘুমোনো তনুর কোমরের উপর আলতো রাখল। বিশ্বনাথ আশা করল তনু নড়েচড়ে উঠবে। কিছুই হল না। আঙুলগুলো কোমরে চেপে বসাতে যাচ্ছে আর তখনই দোতলায় সরসর শব্দটা চলতে শুরু করল। আঙুলগুলো প্রথমে অসাড় হল তারপর নেতিয়ে পড়ল। সরসর শব্দের সঙ্গে ছপ ছপটাও যথারীতি দালানের এমাথা থেকে ওমাথা পর্যন্ত তারপর ঘরের মধ্যে, থেমে থেমে যাতায়াত শুরু করল। বিশ্বনাথের মনে হল, বাসি ভাতের মতো তার শরীর কড়কড়ে ঠাণ্ডা লাগছে। তনুর কোমর থেকে হাতটা তুলে নিয়ে সে স্থির করল, বুড়োর সঙ্গে কাল অবশ্যই কথা বলবে।

পরদিন সকালে সে সময় করে উঠতে পারল না। সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফিরে নিজের দরজায় না থেমে সে সোজা দোতলার সিঁড়ি ধরল। বাঁকটা নিয়ে সিঁড়ি ধরে উঠতে উঠতেই সে দেখল বারান্দায় মাঝখানে কুকুরটা উবু হয়ে সামনের পায়ের থাবা দুটো পাশাপাশি রেখে বসে। সিঁড়ির দিকে মুখ করে সোজা এমনভাবে তাকিয়ে যেন তার জন্যই প্রতীক্ষা করছে। বারান্দার অল্প পাওয়ারের বালবটা কুকুরটার পিছনে, তাই মুখটা বিশ্বনাথের কাছে স্পষ্ট লাগল না। চেয়ারে বসে চশমাপরা বুড়ো মাথা ঝুঁকিয়ে একটা বই পড়ছে। সে থমকে গেল।

আর দুটো ধাপ উঠলেই দালান। কুকুরটার স্বভাব তার জানা নেই, পাশ দিয়ে যেতে গেলে যদি কামড়ে দেয়? বিশ্বনাথ গলাখাঁকারি দিল বুড়োর মুখ ফেরাবার জন্য। মুখ ফিরল। বুড়ো যখন বোঝার চেষ্টা করছে লোকটি কে, তখন বিশ্বনাথ বলল, আমি আপনার ভাড়াটে, নীচে

চশমাটা খুলে ঠাণ্ডা মৃদুস্বরে বুড়ো বলল, দাঁড়িয়ে কেন, আসুন।

আপনার কুকুরটা।

ও কিছু বলবে না, পাশ দিয়ে চলে আসুন। চেয়ার থেকে উঠতে উঠতে বুড়ো বলল। কিছু কি দরকার আছে?

হ্যাঁ, একটা কথা বলার জন্য এসেছি। বাকি দুটো ধাপ এখনও ওঠেনি। এখনও সে পুরো ভরসায় পৌঁছোতে পারেনি। কুকুরটা একটা পাথরের মূর্তির মতো বসে, একইভাবে সিঁড়ির দিকে সোজা তাকিয়ে। ভয়ে ভয়ে বিশ্বনাথ ওর চোখ দুটো লক্ষ করল। ছায়াঢাকা মুখের মধ্যিখানে দুটো অনুজ্জ্বল মার্বেলের গুলি যেন বসানো রয়েছে। মনে মনে সে বলল, তবে কি ভুল দেখেছিলাম সেদিন।

ঘর থেকে একটা মোড়া এনে দালানে রেখে বুড়ো বলল, আসুন আসুন, ভয়ের কিছু নেই। জীবনে ও কখনো কাউকে কামড়ায়নি।

বিশ্বনাথ যখন আড়ষ্ট ভাবে পা টিপে কুকরটিকে অতিক্রম করছে বুড়ো তখন বলল, ফুচা দেখতে পায় না, ও অন্ধ।

বিশ্বনাথ ধাক্কা খেল কথাটা শুনে। ঘাড় ঘুরিয়ে অবাক হয়ে সে ফুচার দিকে তাকিয়ে রইল। একইভাবে ও বসে রয়েছে সিঁড়ির দিকে মুখ করে। বসার ভঙ্গিতে রয়েছে যেন কারুর জন্য অপেক্ষা। নিশ্চয় তার জন্য নয়। সে যে আজ দোতলায় উঠে আসবে ফুচার সেটা জানার কথা নয়।

মোড়ায় বসে বিশ্বনাথ বলল, রোজ রাতে ওপরে একটা সরসর, ছপ ছপ শব্দ শুনতে পাই।

বুড়োর ভ্রু কুঁচকে উঠল। চোখ দুটো সরু করে একটু রুক্ষ স্বরে বলল, তাতে কী হয়েছে? কোনো অসুবিধে হচ্ছে নাকি?

বিশ্বনাথ সাবধান হয়ে গেল। চটাচটির মধ্যে কোনোক্রমেই সে যাবে না। তেমন কিছু নয়, তবে কৌতূহলও হয়।

বুড়ো চাপা গলায় নরম সুরে ডাকল, ফুচা, ফুচা …

এখানে আয়। ফুচা মুখ ফিরিয়ে কিছুক্ষণ পিছনে তাকিয়ে থেকে মাথা নামিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে এল বুড়োর দিকে। গলার চেনটা মেঝেয় ঘষড়াননার দরুন যে-শব্দটা হচ্ছে বিশ্বনাথ সেটা চিনতে পারল। বড়ো বড়ো নখগুলো ওর প্রত্যেক বার পা ফেলাতে যে শব্দ তৈরি করল, সেটা বুঝে নিতেও তার অসুবিধে হল না।

ফুচা কি সারারাতই ঘুরে বেড়ায়?

হ্যাঁ। এটা ওর অনেক দিনের অভ্যেস। আজীবন একা একাই ওর কেটেছে। জীবনের শেষ সীমায় এখন ও।

বুড়োর থেকে তিন হাত দূরত্বে উবু হয়ে মুখ তুলে ফুচা কথাগুলো শুনছে। বিশ্বনাথ কয়েকটা কালো পোকা ওর চোখের কোণে, কানের পাশে, হাঁটুর কাছে দেখতে পেল।

পোকা হয়েছে, খুব কষ্ট পায় নিশ্চয়।

হয়তো পায়।

পোকা মারার জন্য তো পাউডার পাওয়া যায়।

বুড়ো তীব্র চোখে তাকিয়ে বলল, তা যায়। আপনি কি পোকা নিয়ে কথা বলার জন্য এসেছেন?

বিশ্বনাথ আর এক বার সাবধান হল।

ওপর থেকে আমার জানলার ধারে যেসব জিনিস পড়ে তাতে একটু অসুবিধে হচ্ছে। কী পরিমাণ জঞ্জাল, কী ধরনের ময়লা জমে উঠেছে সেটা যদি দয়া করে এক বার দেখে আসেন। যথাসম্ভব বিনীত স্বরে সে বলল।

সচকিত বুড়ো সোজা হয়ে বসল। জঞ্জাল? আপনার জানলার ধারে! ছি ছি ছি, এটা আমারই দোষ। বহুদিনের অভ্যেস তো, নীচে কেউ থাকত না বলে তাই .. বুড়ো দুই তালু চেপে বলল, আমারই অন্যায়।

বিশ্বনাথ আশা করেছিল তিরিক্ষে বা মেজাজি স্বরে দায় এড়িয়ে যাওয়ার মতো জবাব পাবে। তার বদলে ওকে এমন অনুতপ্ত হতে দেখে সে অপ্রতিভ বোধ করল।

কালকেই আমি রামবিলাসকে বলে জঞ্জাল সরাবার ব্যবস্থা করব।

এত ব্যস্ত হবার কী আছে। সে কোনো একদিন পরিষ্কার করে দিলেই হবে।

বিশ্বনাথ উঠে দাঁড়াল। ফুচা একইভাবে বুড়োর মুখের দিকে তাকিয়ে বসে আছে। চোখ দুটো ফুলে উঠে কোটর থেকে অল্প বেরিয়ে, পুরোটাই ঘোলাটে সাদা। বোধ হয় ছানি পড়েছে। কুকুরেরও তো ছানি অপারেশন হয়। বলতে গিয়েও বিশ্বনাথ নিজেকে সামলে নিল। হয়তো চটে গিয়ে বলবে হ্যাঁ হয়। আপনি কি ছানি নিয়ে কথা বলার জন্য এসেছেন?

ফুচার পাশ দিয়ে এগোতে গিয়ে সে চেনটা মারিয়ে অল্প একটু হড়কে যেতেই পাথরের সঙ্গে লোহা ঘষার শব্দ হল। কর্কশ শব্দটায় তার দুই বাহুর রোমের গোড়া শিরশির করে উঠল। তার মনে হল একটা সাপ যেন সে মারিয়ে ফেলেছে।

মাঝে মাঝে একটু মেজাজ খারাপ করে, তখন বেঁধে রাখতে হয় বলে চেনটা গলায় লাগিয়েই রেখে দিয়েছি। কে আর খোলে-পরায়। বুড়ো নীচু গলায় বলল।

প্রসঙ্গটা বদলাতে বিশ্বনাথ বলল, আপনার তো ছাদে যাওয়ার সিঁড়ি নেই, টিভি অ্যান্টেনা লাগাই কী করে সেটাই ভাবছি।

কেন, ও-বাড়ি দিয়ে ছাদে আসবেন। আমার ভাইপো রবিকে বলবেন ও আপনাকে ছাদে নিয়ে যাবে। বাড়ি পার্টিশনে সিঁড়িটা ওদের ভাগে পড়ল। আমার দিকে নতুন সিঁড়ি করে নেওয়ার কথা কিন্তু করা আর…

সিঁড়ি দিয়ে নামতে বিশ্বনাথ ঘাড় ফিরিয়ে দেখল ফুচা বুড়োর মুখের দিকে তাকিয়ে একইভাবে বসে রয়েছে আর বুড়ো তাকিয়ে সিঁড়ির দিকে।

জঞ্জাল পরিষ্কার করে দেবে বলল, তনু ফেরামাত্রই বিশ্বনাথ জানিয়ে দিল।

ভালো।

কুকুরটাকে ভালো করে দেখলুম … একদম অন্ধ, শুধুই বুড়োর মুখের দিকে তাকিয়ে বসে। থাকে। গায়ে পোকা অজস্র। … রাতে যে শব্দ শুনি সেটা যে ওরই কাজ আজ বুঝলুম। গলায় একটা চেনবাঁধা মেঝের উপর দিয়ে টানতে টানতে যায়, আর পায়ের বড়ো বড়ো নখ, তাই থেকেই শব্দটা হয়। … বাবা বাঁচা গেল, যা টেনশন হয়! আমি ভাবতুম না-জানি অন্য কিছু…

অন্য কিছু মানে ভূতটুত?

স্কুলের শাড়িটা খাটের উপর বিছিয়ে তনু আলনা থেকে শাড়ি নিতে এগোল। শায়াটা ধবধবে, বিশ্বনাথ চোখ বুলিয়ে একটা কোনো দাগও দেখতে পেল না। এই বয়সে তনুর শরীর একটু ভারী হওয়ার কথা। কিন্তু সেই রোগাই রয়ে গেল।

প্রায় তাই-ই। সিনেমায় দ্যাখোনা, পোড়াবাড়িতে কুয়াশা আর ঝিঝির ডাকের সঙ্গে কতরকম শব্দ আর গান হয়, অনেকটাই সেইরকম লাগত। কথাটা বলার সঙ্গেই বিশ্বনাথের দৃষ্টি থেকে তনুর নিতম্বের বক্র ভাঁজ অদৃশ্য হয়ে গেল শাড়ি জড়িয়ে নেওয়ায়। আধময়লা ছাপাশাড়ি। সাশ্রয়ের জন্য হপ্তায় এক দিন, রবিবার, তনু সারা পরিবারের কাচাকাচির কাজ করে, ইস্ত্রি করে স্কুলের জন্য মাড় দেওয়া শাড়ি। ছুটির দিনেও নিজেকে ও ক্লান্ত করতে হন্যে হয়ে ওঠে।

শম্পা চা দিয়ে গেল দুজনকে। খাট থেকে শাড়িটা পাট করতে করতে তনু বলল, তুমি আগে গা ধুয়ে এসো।

টিভি শনিবার আনব। রোববার সকালে প্রােগ্রাম চলার সময় ওদের লোক এসে অ্যান্টেনা লাগাবে। বুড়ো বলল ও-বাড়ির সিঁড়ি দিয়ে ছাদে যাওয়া যাবে।

ভালো। তার আগে জঞ্জালগুলো পরিষ্কার হোক তো।

বিশ্বনাথ রাতে সিলিংয়ের দিকে মুখ করে শুয়ে অপেক্ষা করছিল। সরসর শব্দটা শুরু হতেই সে আজ এর মধ্যে কোনো রহস্য অনুভব করল না। ওপাশ ফিরে শোয়া তনুকে কাঁধ ধরে হ্যাঁচকা টানে সোজা করে দিতেই সে কে, কে বলে উঠে বসতে গেল।

কে আবার, আমি।

বিশ্বনাথ বুকে ছোট্ট ঠেলা দিয়ে ওকে শুইয়ে দিল। মিনিট পাঁচেক পর শাড়িটা ঊরু থেকে নামিয়ে, বিড়বিড় করতে করতে তনু আবার পাশ ফিরে শুল।

রবিবার অ্যান্টেনা লাগাবার লোকটিকে নিয়ে বিশ্বনাথ হাজির হল ও-বাড়িতে। বরফিকাটা তকতকে পাথরের মেঝে, দরজা-জানলায় উজ্জ্বল রং, আসবাবে ধুলো নেই অথচ সবই প্রাচীন। বুড়োর ভাইপো রবির কথাবার্তা মার্জিত ও নম্র। বছর পঁয়তাল্লিশ বয়স। সাদা পাজামা আর গেঞ্জিটা তনুর শায়ার মতোই নিদাগ। বিশ্বনাথের অস্বস্তি ছিল হয়তো ছাদে যেতে দেবে না। জ্যাঠার সঙ্গে শরিকি সম্পর্কটা কেমন রয়েছে সেটা তার জানা নেই। সাধারণত ভালো থাকে না।

নিশ্চয় যাবেন, এতে আপত্তি করার কী আছে। ওদিকে ছাদটা তো জ্যাঠামশায়েরই।

জলছাদের সুরকির আস্তরণ উঠে গিয়ে খোয়া বেরিয়ে পড়েছে। বৃষ্টির জল বেরোবার নলের মুখে আবর্জনা। পাঁপড়ের মতো মড়মড়ে হয়ে রয়েছে শুকিয়ে-যাওয়া শ্যাওলা। গাছের পাতা, কাগজ, কাঠকুটোয় ঝাঁঝরির মুখ বন্ধ। পলেস্তারা-খসা ইট বহু জায়গায় বেরিয়ে হাঁটুসমান একটা পাঁচিল দিয়ে ছাদটা ভাগ করা।

আমরা মাঝে মাঝে নর্দমার মুখ পরিষ্কার করে দিই। বৃষ্টির জল বসে বসে জ্যাঠামশায়ের পোর্শানটার যা অবস্থা হয়েছে।

চোখে জ্বালা-ধরানো রোদে দাঁড়িয়ে তারা। লোকটি অ্যান্টেনা লাগাবার কাজে ব্যস্ত। ঘণ্টা খানেক সময় তো লাগবেই। বিশ্বনাথের মনে হল, এখানে তার দাঁড়িয়ে কাজ দেখার কোনো দরকার নেই।

এই রোদে দাঁড়িয়ে থেকে কী লাভ, আপনি নীচে গিয়ে বসতে পারেন, ততক্ষণ ও কাজ করুক।

বিশ্বনাথ হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। এক তলায় বসার ঘরে গোল একটা মেহগনির টেবিল ঘিরে চারটে কাঠের চেয়ার। সবই পুরোনো আমলের। একটা লোক সামনের চেয়ারে বসে, কিছু একটা বিষয় পেড়ে কথা তো বলতে হবে, তাই বিশ্বনাথ শুরু করল, আমার ঘরের বাইরে বহুদিনের জঞ্জাল জমে ছিল। ওনাকে বলেছিলুম তাই আজ সাফ হচ্ছে।

এসব ব্যাপারে উনি খুব পার্টিকুলার ছিলেন, আপনাকে সাফ করার কথা বলতেই হত না। এখন অবশ্য…।

আপনার জ্যাঠামশাই বোধ হয় একা থাকতেই ভালোবাসেন।

বছর কুড়ি-বাইশ হল উনি এইরকম হয়ে গেছেন। স্বরটাকে গাঢ় করে রবি কিঞ্চিৎ বিষাদ মাখিয়ে বলল, ওঁর একমাত্র ছেলে ভান্তু, আমার থেকে বছর পাঁচেকের ছোটো, নকশাল আমলে খুন হল। তারপর থেকেই উনি এমন হয়ে গেলেন।

বিশ্বনাথ নড়েচড়ে বসল। বলেন কী! ওঁর ছেলে খুন হয়েছে? কোথায়, কারা করল?

যে দরজা দিয়ে আপনি ঢোকেন ঠিক তার সামনে, সন্ধেবেলায়। আমরা শুধু একটা চিৎকার শুনেছিলুম। আট বার স্ট্যাব করে। ছুটে গিয়ে যখন পৌঁছোলুম তখন ওরা পালিয়ে গেছে। জ্যাঠামশাই দোতলার বারান্দা থেকে ব্যাপারটা নিজের চোখে দেখেছিলেন।

নিজের অজান্তে বিশ্বনাথ মুখ তুলেই আবার নামিয়ে নিল। মোটা মোটা কাঠের কড়ি আর বরগা এ বাড়িতেও।

ভান্তুকে আমরাই মেডিকেল কলেজে নিয়ে যাই, তখন আর বেঁচে নেই।

দেয়ালে এখনও আলকাতরার অস্পষ্ট একটা কথা পড়া যায়।

সে কী! এখনও আছে? বিস্ময়ের সঙ্গে ধাক্কাটা সঙ্গে সঙ্গে কাটিয়ে উঠে রবি বলল, সেদিন রাতেই লিখে দিয়ে গেছল, খুন নয় খতম। কথাটার মানে আজও বুঝি না। শুনেছি

জ্যাঠামশাই দোতলায় বসে থাকেন ওই দেয়ালটার দিকে তাকিয়ে।

হ্যাঁ আমিও দেখেছি, কারণটা এতদিন জানতাম না। ভান্তু পলিটিকস করত কি?

বলতে পারব না। অ্যাপ্লায়েড ফিজিকস নিয়ে পড়ত। মুখচোরা, বাবার মতোই রুগ্ন ছিল। জেঠিমা তো পাগলের মতো হয়ে গেলেন। ওঁদের মেয়ে টরন্টোয় কম্পিউটার সায়েন্স পড়তে গিয়ে ওখানেই বিয়ে করে সেটল করেছে। সে এসে মাকে নিয়ে চলে যায়। মাঝে মাঝে বাবাকে টাকা পাঠাত। জেঠিমা ওখানেই মারা গেছেন, এখন বোধ হয় আর টাকা আসে না। রবি নিশ্চিত ভঙ্গিতে ছোটো করে মাথা নাড়ল। ওর কথা বলার ধরন থেকে বিশ্বনাথের মনে হল, লোকটি গল্প শোনানোর মতো কাউকে পেলে অনর্গল বকে যেতে পারে।

আপনার জ্যাঠামশায়ের একটা কুকুর আছে?

জানি, স্পিৎজ। খুব বুড়ো, মরার টাইম হয়ে গেছে।

ও অন্ধ।

রবি কথাটা কানে নিল না বরং নম্র করে জানতে চাইল, আপনার স্ত্রী কোথাও বোধ হয় পড়াতে যান?

প্রশ্নটা শুনে বিশ্বনাথের ভ্র উঠে গেল। রবি তাহলে তাদের সম্পর্কে খবর রাখে। চাকদায় একটা স্কুলে।

অতদূরে! তাই ফিরতে এত রাত হয়। আপনি তো সিরিয়াল লেখেন, আমার মেয়ের কাছে শুনেছি।

এইসময় চাকর এসে রবিকে জানাল, তাকে ভিতরে ডাকছে। রবি উঠে যাবার পরও বিশ্বনাথ কিছুক্ষণ বসে বুড়োর কথা ভাবল। ছাদে অ্যান্টেনা লাগানোর কাজ আর সে দেখতে গেল না, নিজের ঘরে ফিরে এল।

টিভি সেটটা রাখা আছে তার টেবিলে। ওটাকে অন্য কোথাও রাখার ব্যবস্থা করতে হবে।

টেবিলেই থাক-না। তনু বলল। লেখার জন্য তা অনেকটা জায়গা থাকবে।

না থাকবে না। হঠাই রেগে উঠল বিশ্বনাথ। নিজেকে তার মনে হচ্ছে চারদিক থেকে চাপ-খাওয়া কুঁকড়ে-যাওয়া একটা মানুষ। অত অল্প জায়গায় আমি লিখতে পারব না।

একইরকম তিক্ত স্বরে তনু বলল, না পার তো সেটটাকে রান্নাঘরে রেখে এসো, শম্পা বসে বসে দেখবে।

সেই ভালো।

ওটা তোমার জন্যই আনা, আমার বা বাবানের জন্য নয়। শান্ত ধীর গলায় তনু বলল।

এত বড়ো ঘর অথচ এইটুকু একটা জিনিস রাখার জন্য আমার টেবিল ছাড়া কি আর জায়গা নেই।

নিজের চোখেই তো দেখতে পাচ্ছ, কী আছে কী নেই।

জানলা ঘেঁষে কালো ফিতের মতো অ্যান্টেনার তার ঝুলছে। গোল করে পাকানো তারের বাকিটা জানলা গলিয়ে ঘরের মধ্যে বাড়িয়ে এইসময় লোকটি বলল, ধরুন।

বিশ্বনাথ ধরল। লোকটা এবার ঘরে আসবে। নরম গলায় সে বলল, টেবিলেই এখন থাকুক, পরে দেখা যাবে।

সারাদিন দেখা আর হল না। টেবিলে যতটুকু জায়গা, বিশ্বনাথ সেইটুকুতেই কাজ চালিয়ে রাতে লেখায় বসল। বিকেল থেকে টিভি চালানো হয়েছে। সবাই বাংলা সিনেমা দেখেছে, তিন ভাষায় খবর শুনেছে। ওরা সবাই খুশি। ভোরে উঠতে হবে বলে রোজকার মতো দশটাতেই তনু শুয়ে পড়েছে বাবানকে নিয়ে।

মাথার মধ্যে ছুঁচ ফোটানোর মতো একটা যন্ত্রণা হচ্ছে। দু-হাতের চেটোয় রগ চেপে বিশ্বনাথ মাথা নামিয়ে বসে আধ ঘণ্টার বেশি। একটা লাইনও লেখা হয়নি। বাড়ির সুইমিং পুলে পূর্ণিমার রাতে জলবিহার করতে নামবে বিশাল শিল্প সাম্রাজ্যের মালিক আর তার স্ত্রী। শিল্পপতির মৃত্যু ঘটিয়ে সাম্রাজ্য দখল করার জন্য চক্রান্ত করেছে শিল্পপতির মধ্যবয়সি স্ত্রী এবং তার তরুণ প্রেমিক। বিশ্বনাথ আপত্তি করে বলেছিল, এই ধরনের অবৈধ প্রেম আমাদের ভিউয়াররা পছন্দ করবে না। স্নেহ বলেছে, পছন্দ করাতে হবে। আমরা তো এই ধরনের প্রেমের বিরুদ্ধেই বলতে চাই। ওদের বিরুদ্ধে ঘৃণা আনতে চাই বলেই…।

সুইমিং পুলের জলে গলায় চেনবাঁধা একটা কুমির গোপনে রেখে দেওয়া হবে। খিলখিল হেসে মজা করার জন্য স্ত্রী ধাক্কা মেরে স্বামীকে জলে ফেলে দেবে। তারপর একটা বীভৎস কান্ড। কুমিরে–ধরা একটা লোকের চিৎকার, জলের তোলপাড়, চোখের পাতা না ফেলে স্ত্রী কঠিনমুখে তাকিয়ে থাকবে এবং ধীরে ধীরে জল শান্ত হয়ে যাবে জলের রং বদলে যেতে থাকবে। এই দেখিয়ে ঘৃণার সঞ্চার করা যাবে। স্নেহ পাগল নয়, খুব ঠাণ্ডা মাথাতেই সে ঘটনাটা ছকেছে।

দৃশ্যটা কল্পনা করে বিশ্বনাথ নিজের মধ্যে কী প্রতিক্রিয়া হয় সেটা বুঝে নিতে গিয়ে দেখল

কোনো প্রকারের ঘৃণা তার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে না। বরং মাথার মধ্যে একটা উঁচ অবিরত ফুটে চলেছে। ঘৃণাটাকে ঠিকমতো কবজা করতে না পারলে দৃশ্যটা সে লিখবে কী করে? অসহায়ভাবে বিশ্বনাথ মুখ তুলে সিলিঙের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে অবাক হয়ে পড়ল। একী, কোনো শব্দ তো সে এখনও পেল না। টেবিলে রাখা রিস্টওয়াচে দেখল সওয়া বারোটা।

ফুচার চলাফেরা কি শেষ হয়ে গেছে? কুমিরের মানুষ-খাওয়া দেখতে দেখতে সে খুবই কি আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল? কিন্তু সরসর শব্দটা এমনই যে সেটা তার শরীরের যেকোনো জায়গা স্পর্শ করবেই, বীভৎস সুখে তার সর্বাঙ্গ মোড়া থাকলেও। ফুচা আজ সময় রাখতে পারেনি। আলো নিভিয়ে বিশ্বনাথ চিত হয়ে শুয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। একসময় সে ঘুমিয়ে পড়ল। ফুচার চলাফেরা হল কি না সে জানল না।

পরের রাতেও একই ব্যাপার, ফুচার চলাফেরার আভাসটুকুও নেই। কৌতূহলী হয়ে বিশ্বনাথ দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এল। সামনের দেয়ালে খতম-এ পিঠ লাগিয়ে দোতলার বারান্দায় রেলিঙের ফাঁক দিয়ে যতদূর দেখা যায়, দেখার জন্য গোড়ালিও তুলল। কিছুই নেই। খাটিয়ায় রামবিলাস ঘুমোচ্ছে। ফিরে আসার জন্য দরজার কাছে এসে থমকে সে মুখ তুলল। চোখ বন্ধ করে এক বার শিউরে উঠে চোখ খুলল।

ফুচার মাথাটা বেরিয়ে নেই, সেই জ্বলজ্বলে চোখ দুটোও নেই। জন্তুজানোয়ারের চোখ, তনু বলেছে অন্ধকারে জ্বলে। কিন্তু ফুচার চোখে কোনো আলো থাকার কথা নয়, ও-দুটো তো ছানি পড়ে সাদা হয়ে গেছে। ফিরে এসে বিছানায় শুয়ে বিশ্বনাথের একটাই চিন্তা, আমি ভুল দেখলাম কেন? কূলকিনারা না পেয়ে সে ঘুমিয়ে পড়ল।

পরদিন সকালে সে তনুকে বলল, আশ্চর্য ব্যাপার, ফুচার নখ অর চেনের শব্দ দু-দিন হল পেলাম না!

শাড়ি পাট করে নাভির উপর গুঁজে দিতে দিতে তনু আড়চোখে বিশ্বনাথের দিকে তাকিয়ে নিয়ে বলল, বুড়ো হয়তো কোথাও চেনটা বেঁধে রেখেছে তাই ও চলছে না … শম্পা ঠিক তিনটের সময় মনে করে কিন্তু রসটা খাওয়াবি। রামকৃষ্ণর ছবির সামনে সে চোখ বন্ধ করে দাঁড়াল।

বোধ হয় তাই, ফুচাকে বেঁধেই রাখা হয়েছে কেননা আরও চার দিন বিশ্বনাথ শব্দ পেল। এখন তার শব্দ না পাওয়ার অস্বস্তিটা আর হয় না। কিন্তু শম্পার একটা কথায় সে বিচলিত বোধ করল।

আজ সকালে বউদি বলল, জানলা দিয়ে কীরকম যেন একট গন্ধ আসছে। তুমি কি পাচ্ছ?

বিশ্বনাথ জানলার কাছে এসে কয়েক বার শ্বাস টানল। একটা গন্ধ সে পেল। কথা না বলে সে বেরিয়ে এসে জানলার বাইরে দাঁড়াল। ইঁদুর কি বেড়াল কিছু-একটা মরেছে, সকালে দেখা যাবে এই ভেবে সে ফিরে এল।

তনু ফিরে এসে জানলাটা বন্ধ করে দিয়ে বলল, আবার ওপর থেকে ফেলা শুরু করেছে। কাল সকালেই গিয়ে বোলো।

বিশ্বনাথ সকালে বলতে যাবার আগে প্রমাণ সংগ্রহের জন্য জানালার বাইরে এক বার খোঁজাখুঁজি করল। উপর থেকে কোনো কিছু পড়ার চিহ্ন নেই। তবে সে মাংস পচার গন্ধ পেল। কিছুই যখন পাওয়া গেল না তাহলে কী বলতে সে উপরে যাবে? বিশ্বনাথ ফাঁপরে পড়ল।

বলো একটা উৎকট গন্ধ পাচ্ছি। এ ব্যাপারে বাড়িওয়ালা হিসেবে ওঁরও তো কিছু কর্তব্য আছে, নাকি নেই? তনু স্নান করে ভিজে শাড়ি জড়িয়ে ঘরে এসেছে। মাথা দিয়ে গলিয়ে এবার শুকনো শায়াটা পরবে, যাতে একটা দাগও নেই। তারপর শায়াটাকে বগলের আর নিচে না নামিয়ে দড়ি বাঁধবে এবং ভিজে শাড়িটা প্রতিদিনের মতো ঝরে পড়বে পায়ের কাছে। হাঁটু পর্যন্ত ঝোলা শায়ার তলায় সরু দুটো পা দেখলে বিশ্বনাথের হাসি পায় কিন্তু সে কখনো হাসে না।

শম্পা মেলে দিয়ে আয়। তনু চেঁচিয়ে কথাটা বলে বিশ্বনাথের দিকে ফিরে বলল, দাঁড়িয়ে থেকো না।

বিশ্বনাথ আর দাঁড়াল না। দোতলার সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতেই গন্ধটা তার নাকে ধাক্কা দিল। বারান্দার শেষ প্রান্তে বুড়ো মাথা ঝুকিয়ে খবরের কাগজ পড়ছে। তার পিছনেই পাশ ফিরে ঘুমোচ্ছে ফুচা। চেনটা গলায় বাঁধা।

ওটা যে ফুচার মৃতদেহ এটা বুঝতে বিশ্বনাথকে অর্ধসমাপ্ত একটি মাত্র বাক্য খরচ করতে হল।

একটা বিশ্রী পচা গন্ধ আজ দু-দিন ধরে আমরা…

বুড়ো মুখ ফিরে বিশ্বনাথের দিকে শান্ত চোখে তাকাল এবং কয়েক সেকেণ্ড পর আঙুল দিয়ে ফুচাকে দেখাল—মরে গেছে।

হতভম্ব বিশ্বনাথ ধাতস্থ হবার পর বলল, এটা কীরকম ব্যাপার হল? মরে গেছে তো ফেলে দেননি কেন?

থাক-না যতদিন খুশি ও থাক-না। বুড়ো আবার খবরের কাগজে মাথা ঝোঁকাল।

বিশ্বনাথ স্তম্ভিত। একটা মরা কুকুর নিয়ে এটা কী ধরনের আদিখ্যেতা? সে শুনেছে অনেকে ছেলে-মেয়ের মতনই কুকুরকে ভালোবাসে, মারা গেলে কান্নাকাটি করে, নাওয়া খাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। খবরের কাগজে ছবি দিয়ে শোকও প্রকাশ করে। কিন্তু এটা কী করছে বুড়ো।

আপনি এই মরা কুকুরটাকে রেখে দেবেন। বিশ্বনাথ অবিশ্বাসভরে বলল।

হ্যাঁ। কেন, তাতে আপনার আপত্তি আছে।

অবশ্যই আছে। আপনি কি এখনও গন্ধটা পাচ্ছেন না?

না তো। বুড়ো মাথা ঘুরিয়ে ফুচার লাশটার দিকে তাকাল। না পাচ্ছি না। শান্ত গলায় আবার বলল।

আমরা নীচের থেকে পাচ্ছি আর আপনি… বিশ্বনাথ ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে রইল।

আমি কী করতে পারি?

কর্পোরেশনের ধাঙড় ডেকে, কিছু টাকা দিয়ে এটাকে নিয়ে যাওয়ায় ব্যবস্থা করতে পারেন।

না। বুড়ো খবরের কাগজটা চোখের সামনে তুলে ধরল। বসার ভঙ্গিতে বুঝিয়ে দিল আর সে কোনো কথা শুনতে চায় না।

বিশ্বনাথ প্রায় ছুটেই ফিরে এল। তনু তখন ভাত খেতে শুরু করেছে। ওপরে কুকুরটা মরেছে, তারই পচা গন্ধ। ওটাকে ওইভাবেই রেখে দেবে বলল।

অ্যাঁ! থালার উপর তনুর হাতটা স্থির হয়ে গেল। মরাটাকে রেখে দেবে? কী বলছ তুমি!

তাই তো বলল।

ব্যস্ত হয়ে খাওয়া ফেলে উঠে কোনোক্রমে হাতটা ধুয়েই তনু সিঁড়ির দিকে ছুটল। বিশ্বনাথ ওকে অনুসরণ করে সিঁড়ির প্রথম ধাপে পা রেখে দাঁড়িয়ে পড়ল।

আপনি নাকি এই মরা কুকুরটাকে রেখে দেবেন?

বুডোর উত্তর বিশ্বনাথ শুনতে পেল না।

আপনার কি কান্ডজ্ঞান লোপ পেয়েছে? জানেন এর থেকে কত রকমের রোগ ছড়াতে পারে, মহামারিও হতে পারে। ঘরে বাচ্চা রয়েছে।

বিশ্বনাথ দু-ধাপ উঠেও বুড়োর কথাগুলো বুঝতে পারল না। কেন জানি তার মনে হল, বুড়ো তার জেদ থেকে এক ইঞ্চিও সরবে না।

এই পচা গন্ধ নাকে নিয়ে আপনার সঙ্গে আর তর্ক করতে পারব না, বসে বসে প্রাণভরে আপনি খুঁকে যান কিন্তু দয়া করে এটাকে বিদেয় করুন। এটা সভ্যসমাজ, পাঁচজনের কথা

ভেবে চলতে হয়। আপনি যদি আজকেই এটাকে…

গেট আউট, গেট আউট, গেট আউট।

বুড়োর তীক্ষ্ণ চিৎকারের সঙ্গেই চেয়ার সরাবার শব্দ বিশ্বনাথ শুনতে পেল। তারপরই ভীতমুখে তনুকে নেমে আসতে দেখল।

তেড়ে এল আমার দিকে। মনে হচ্চে পাগল হয়ে গেছে। … চোখ দুটো যেন কীরকম… তনু থেমে গেল।

বিশ্বনাথ অস্ফুটে বলল, জ্বলজ্বল করছিল।

জানলে কী করে! তুমি তো নীচে ছিলে।

তনুর ভাত খাওয়া আর হল না। ন-টা আটাশের কৃষ্ণনগরটা এখনও ধরার সময় আছে। বেরোবার সময় সে বলে গেল, এক বার ও-বাড়িতে গিয়ে বরং রবিবাবুকে বললা যদি বুঝিয়ে সুঝিয়ে কুকুরটা ফেলার ব্যবস্থা করতে পারে। আর এখুনি ফিনাইল এনে চারিদিকে ছড়িয়ে দাও …শম্পা মনে করে রসটা খাওয়াস।

ফিনাইল কিনে ফেরার সময় বিশ্বনাথ ও-বাড়িতে ঢুকল। খবর পেয়ে নেমে এল রবি।

কুকুরটা মরে গেছে … আজ চার দিন।

বলেই ছিলাম টাইম হয়ে এসেছে। রবির মুখ তৃপ্তিতে ভরে উঠল।

আপনার জ্যাঠামশায়ের মাথা বোধ হয় খারাপ হয়ে গেছে। উনি ওই মরা কুকুরটাকে রেখে দিয়েছেন।

বলেন কী! রবি খাড়া হয়ে বসল। মরা কুকুরটাকে?

হ্যাঁ। এখন কী করি বলুন তো। আমি বললুম, আমার স্ত্রীও বলল, উনি তো তেড়ে প্রায় মারতেই এলেন। অথচ এই সেদিন জঞ্জাল সাফ করে দেওয়ার কথা বলতেই উনি লজ্জিত হয়ে তাড়াতাড়ি সাফ করিয়ে দিলেন। … আপনি কি এক বার ওঁকে বলবেন?

আমি কী বলব?

যাতে কুকুরটার ব্যবস্থা করেন।

ও-বাড়িতে আমরা কেউ যাই না। আপনি বরং কর্পোরেশনে কি পুলিশে খবর দিন। ওপরে আমি কাজ ফেলে এসেছি, কিছু মনে করবেন না। রবি চেয়ার থেকে উঠল।

মরা কুকুর পড়ে থাকলে আশপাশের বাড়িতে রোগভোগ তো হতে পারে। বিশ্বনাথ শেষ চেষ্টা করল রবিকে সক্রিয় করে তুলতে।

তা তো পারেই। আচ্ছা।

বিশ্বনাথ দরজা-জানলার বাইরে ফিনাইল ছড়িয়ে তনুর মতো না খেয়েই অফিসে গেল। যাবার আগে শম্পাকে হুঁশিয়ার করল, বাবান যেন ঘরের বাইরে না যায়। অফিস থেকে আজ সে তাড়াতাড়ি ফিরল এবং তনুও ফিরল প্রাইভেট কোচিং না করেই। বিশ্বনাথ আর এক বার ফিনাইল ছড়িয়ে এসে ঘরের জানলা বন্ধ করে দিল।

এভাবে কতদিন চলা যাবে? তনুর প্রশ্নে বিশ্বনাথ অসহায়ভাবে শুধু তাকিয়ে রইল।

কাল সকালেই থানায় যাও। পুলিশ দেখলে হয়তো বুড়ো ভয় পাবে।

কিন্তু পুলিশ যে আসবেই তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। ব্যাপারটা একদমই অবাস্তব। ওরা বিশ্বাসই করতে চাইবে না। কেনই-বা করবে, আমি নিজেকে তো বিশ্বাস করাতে পারছি না।

তবু তুমি সকালে এক বার যাও। লোক পাঠিয়ে অন্তত এক বার ওরা দেখে যাক। ব্যাপারটা সত্যি কি না। পুলিশ ছাড়া তাড়াতাড়ি কিছু করার আর তো উপায় নেই।

পুলিশ তো আর হাতে করে কুকুরটাকে ফেলতে আসবে না, কর্পোরেশনের ডোমকে দিয়ে ফেলবে। গড়িমসি করে, সময় নেবে। আমি তো কেষ্টবিষ্ট্র নই। তবে আমার মনে হয় সোজা যদি কাউন্সিলারের কাছে যাই তাহলে তাড়াতাড়ি একটা ব্যবস্থা হতে পারে।

সেই ভালো।

ওরা টিভি দেখল না। বিশ্বনাথ লিখতে বসল না। রাতে খেতে বসে তনু বমি করতে ছুটে গেল কলঘরে। বিশ্বনাথ বিষণ্ণ মুখে চেয়ারে বসে মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, এই রকম পাগলের বাড়িতে বাস করা যায় না, অন্য কোথাও ঘর দেখতে হবে। জায়গাটা কিন্তু আমার খুব পছন্দের ছিল।

বালিশে মুখ চেপে তনু উপুড় হয়ে শুয়ে। মুখ ফিরিয়ে শুকনো গলায় বলল, বাবানকে নিয়ে কালই আমি শ্যামপুকুরে চলে যাব।

গালে হাত দিয়ে কিছুক্ষণ বসে থেকে আলো নিভিয়ে বিশ্বনাথ শুয়ে পড়ল। ভোররাত্রের দিকে হঠাৎই তার ঘুম ভেঙে গেল। জানলার বাইরে কীসের যেন একটা শব্দ। কিছু-একটা দিয়ে মাটিতে আঘাত করার মতো ধস ধস ধস হয়ে চলেছে।

প্রথমেই তার মনে হল চোর। ভয়ে সে কিছুক্ষণ সিঁটিয়ে রইল। মিনিট কয়েক পর শব্দটা থেমে গেল। বিশ্বনাথ ভাবল, এক বার উঠে জানলাটা খুলে দেখবে কি না। বিছানায় উঠে বসতেই শব্দটা আবার শুরু হল আর সেইসঙ্গে জোরে জোরে শ্বাস ফেলার শব্দ। কোনো মানুষই হবে তবে চোর নয়।

অন্ধকারে পা টিপে জানলায় এসে সন্তর্পণে একটা পাল্লা সে ইঞ্চি চারেক ফাঁক করল। দূর থেকে রাস্তার আলোয় অন্ধকারটা ঈষৎ ফিকে। বিশ্বনাথ চোখ সইয়ে নিতে কিছুটা সময় নিল। জানলার পাশেই গেঞ্জি-ঢাকা একটা পিঠ। কেউ উবু হয়ে বসে। হাতে শাবলের মতো একটা কিছু, তাই দিয়ে মাটি খুঁড়ে চলেছে।

এত রাতে এখানে, এমন কাজে ব্যস্ত হল কে? তাকিয়ে থাকতে থাকতে বিশ্বনাথ প্রায় বলে ফেলছিল, কী করছেন আপনি? তার বদলে সে বিস্ফারিত চোখে বুড়োর দিকে শুধু তাকিয়ে রইল।

হাঁটু গেড়ে বুড়ো এবার দু-হাত দিয়ে গর্ত থেকে মাটি তুলছে। কুঁজো হয়ে ঝুঁকে পড়া দেহ থেকে বিশ্বনাথের মনে হল গর্তটা হাত খানেক গভীর। মাটি তোলার সঙ্গে রয়েছে হাঁফ ধরার শব্দ। কিছুক্ষণ ধরে গর্ত খোঁড়া ও মাটি ভোলা চলল। বুড়ো তারপর শাবলটা মাটিতে রেখে ব্যস্তভাবে জানলার সামনে থেকে চলে গেল। বিশ্বনাথ ভাবল, বেরিয়ে কি দেখে আসবে, বুড়ো এত রাতে গর্ত খুঁড়ছে কেন?

ইতস্তত করে অবশেষে অন্ধকার ঘর থেকে সে দালানে বেরিয়ে আলো জ্বেলে শম্পাকে দেখে নিয়েই নিভিয়ে দিল। বাইরের দরজার খিল নিঃশব্দে নামিয়ে পাল্লাটা খুলতে যাবে তখনই নাকে লাগল একটা মাংসপচা গন্ধের এগিয়ে আসা। বিশ্বনাথ অপেক্ষা করল দরজার ফাঁকে চোখ রেখে। একটা পুঁটুলি বুকের কাছে দু-হাতে ধরে বুড়ো তার সামনে দিয়ে চলে গেল। পুঁটলিটা থেকে ঝুলছে একটা লোহার শিকল যেটাকে সে চেনে। বিশ্বনাথ পায়ে পায়ে ফিরে এসে খাটে শুয়ে পড়ল। জানলার বাইরে মাটি থাবড়ানোর শব্দ হচ্ছে এবং সেটাও একসময় থেমে গেল। তার আর ঘুম এল না।

সবেমাত্র ভোরের আলো ফুটেছে। জানলার ফাঁক-করা পাল্লা দুটোর মাঝে ধূসর রেখাটি একটু উজ্জ্বল হতেই বিশ্বনাথ বাইরে বেরিয়ে এল। বাড়িটা ঘুরে ঘরের জানলার কাছে এসে দেখল হাত দুয়েক লম্বা জায়গায় মাটির রং গাঢ়। ওখানে গর্ত খুঁড়ে আবার তা বুজিয়ে ফেলা হয়েছে। আলগা মাটির উপর পায়ের ছাপ। পা দিয়ে চেপে মাটি বসানো হয়েছে। জায়গাটি কচ্ছপের পিঠের মতো ঈষৎ উঁচু তবে চোখে পড়ার মতো নয়। বৃষ্টি আর রোদ একসময় এটাকে সমান করে দেবে।

বিশ্বনাথ একদৃষ্টে ফুচার কবরের দিকে তাকিয়ে। একটা স্বস্তি ভোরের বাতাসের মতো তার চেতনার উপর দিয়ে বয়ে চলেছে। বুড়ো কেন যে এমন একটা কান্ড করল সেটা কোনোদিনই জানা যাবে না। চিরকাল এটা রহস্যই থেকে যাবে। ফুচা আর বুড়োর সম্পর্কটা এই মাটির নীচেই বরং রয়ে যাক। তাকিয়ে থাকতে থাকতে সে চমকে উঠল। ওটা কী? কবরের মধ্য থেকে ওটা কী বেরিয়ে? সে ঝুঁকে পড়ল।

ফুচার চেনের একটা প্রান্ত সে দেখতে পেল। অন্ধকারে তাড়াহুড়োয় বুড়ো বোধ হয় দেখতে পায়নি চেনটা পুরোপুরি মাটির নীচে চাপা পড়েনি। আঙুলে করে তুলে নিয়ে চেনটায় অল্প টান দিতেই বিশ্বনাথের মনে হল এটা এখনও ফুচার গলায় বাঁধা রয়েছে। অদ্ভুত একটা আতঙ্ক তাকে ধীরে ধীরে গ্রাস করতে শুরু করল। চেনটা হাত থেকে ফেলে দিতে গিয়ে তার মনে হল এটা তার আঙুলের সঙ্গে আটকে গেছে, হাজার চেষ্টা করলেও সে আঙুল থেকে ছাড়াতে পারবে না। সারাজীবন ফুচা তাকে টানতে টানতে নিয়ে যাবে, কিন্তু কোথায়?

বাবানের জন্য, তনুর জন্য তার চোখ জলে ভরে উঠল। চেনটা নরম মাটির মধ্যে চেপে বসিয়ে সে মাটি দিয়ে ঢেকে দিল। ওরা যেন কখনো জানতে না পারে এখানে ফুচা রয়েছে।

ঘরে ফিরে আসার সময় বিশ্বনাথ মুখ তুলল। বারান্দায় বুড়ো চেয়ারে বসে গভীর মনোযোগে সামনের দেয়ালটা দেখছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *