বৃষ্টির মতো

বৃষ্টির মতো

বৃহস্পতিবার মাঝরাতে জোলো হাওয়ার ঝাপটায় নন্দার ঘুম ভেঙে গেল। জানলা দিয়ে দেখল আকাশের রং মেটেলাল। দূরে রাস্তার আলোয় বৃষ্টির ধারা দেখে বুঝল সারারাতই ঝরবে। সাত মাসের ছেলে পাশেই ঘুমোচ্ছে। তার গায়ের চাদরটা টেনেটুনে দিয়ে সে উঠে বসল। দোতলায় জানলার পাল্লা মোট আঠারোটা। বন্ধ করে না দিলে দালান ঘর ভেসে যাবে। খাট থেকে নামার সময় সে জানলা বন্ধ করার শব্দ পেল।

কে বলাইয়ের মা নাকি?

হ্যাঁ।

ছোটাখাটো শীর্ণ চেহারা, বয়স পঞ্চান্ন থেকে ষাটের মধ্যে। অর্ধেক চুলই পাকা। সিঁথিতে মোটা করে সিঁদুর। মাথায় সবসময়ই ঘোমটা। বলাইয়ের মা স্বল্পবাক, ধীর প্রকৃতির। ওর স্বামী ভূপতিও বেঁটে গড়নের। স্ত্রীর থেকে চুল বরং একটু কালোই, ষাট-পঁয়ষট্টির মধ্যে বয়স। মাঝে মাঝে হাঁপানির টান ওঠে। ওর একটা চোখের মণি ঘোলাটে। একদমই দেখতে পায় না। দুজনে থাকে গ্যারেজের লাগোয়া একটা ছোট্ট ঘরে।

জানলা বন্ধ করে বলাইয়ের মা নীচে নেমে যাচ্ছে। নন্দা বলল, গ্যারেজের শাটারের তলা দিয়ে জল ঢুকছে কি না একটু দেখতে বলো তো ভূপতিকে।

সকালে ঘুম থেকে উঠে নন্দা দেখল অঝোরে বৃষ্টি হচ্ছে। মেঘলা আকাশ। ঘরের মধ্যে আবছা আবছা আলো। জানলা দিয়ে বাড়ির সামনের রাস্তাটা দেখে তার চক্ষুস্থির! ছুটে নেমে এসে দেখল বলাইয়ের মা বাসন মাজছে।

ভূপতি দুধ এনেছে কি? রাস্তায় যা জল জমেছে দুধের ভ্যান হয়তো নাও আসতে পারে!

এখনও ফেরেনি।

মিনিট দশেক পর ভূপতি ফিরে এসে জানাল, বাড়ির সামনের রাস্তায় পায়ের গোছ ডোবা জল কিন্তু বড়ো রাস্তায় হাঁটুর কাছাকাছি। একটা দোকানও ভোলা নেই। দুধের গাড়িও আসেনি। পাঁচিল-ঘেরা বাড়ির ফটক দিয়ে রাস্তার জল ঢুকে ইঞ্চি চারেক গভীর হ্রদের মাঝে বাড়িটাকে দ্বীপ বানিয়ে ফেলেছে।

কী গেরো বলোতো, বৃষ্টি থামলেই বাঁচি। বাজার তো বসবে না, একটাও কি দোকান খোলা নেই?

ভূপতি মাথা নাড়ল।

চালে ডালে খিচুড়ি বসাও, আর কী করা যাবে।

ভিজে জবজবে খবরের কাগজ দিয়ে গেছে। ওড়িশায় বারিপদার কাছে নিম্নচাপ কেন্দ্রীভূত হয়েছে। এর প্রভাবে গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গে বৃষ্টির সম্ভাবনা আছে। এ ছাড়া আর কিছু বলা নেই। বলবেই-বা কী করে, মাঝরাতে বৃষ্টি শুরু হলে পরদিন কাগজে সে-খবর দেওয়া সম্ভব নয়। নন্দা গ্র্যাজুয়েট, বুদ্ধিমতী, বিবেচক। তার স্বামী রঞ্জন কাঠের ব্যবসায়ী। চার দিন আগে সে অসম গেছে। প্রায়ই তাকে বাইরে যেতে হয়।

বৃহস্পতিবার সারাদিন বৃষ্টি পড়ল। তার সঙ্গে দমকা বাতাস। নন্দা মাঝে মাঝে বারান্দায় গিয়ে ঝুঁকে রাস্তার অবস্থা দেখল। গাছপালা আর বাড়ির ফাঁক দিয়ে বহু দূরের রাস্তায় চলন্ত বাসের চালটুকু দেখা যায়। সে একটাও বাস দেখতে পেল না। গ্যারেজের শাটারের নীচে এক হাত জল। যদি জল ঢুকে থাকে তা হলে গাড়িটার এঞ্জিনের তলার দিকটা এতক্ষণে ডুবে গেছে। কী আর করা যাবে।

সন্ধ্যাতেও বৃষ্টি বন্ধ হল না। নন্দা টিভি-র খবর থেকে শুনল, বারিপদার থেকে নিম্নচাপ উত্তর থেকে উত্তর-পূর্ব দিকে বাঁক নিয়ে কলাইকুন্ডার কাছে অবস্থান করছে। বিকেল সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত গত চব্বিশ ঘণ্টায় ১৭২ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। পূর্বাভাসে বলা হয়েছে শুক্রবারও সারাদিন জোর বৃষ্টি ও দমকা বাতাস চলবে তবে সন্ধ্যা থেকে বৃষ্টি ধীরে ধীরে কমতে পারে।

শুক্রবার বৃষ্টি কমার বদলে আরও বেড়েই গেল। খবরের কাগজওয়ালা পর্যন্ত আসতে পারেনি যখন, নন্দা বুঝল রাস্তায় অন্তত কোমরের উপর জল উঠেছে। বৃষ্টির শব্দ শুনতে শুনতে সে বিরক্ত হয়ে পড়ল। সাত মাসের ছেলের সঙ্গে কতক্ষণ আর কথা বলা, খেলা করা যায়! সময় কাটাতে সে ফোন করল তার বাপের বাড়িতে। এত বৃষ্টিতেও ফোন কাজ করছে। দেখে সে অবাকই হল। ভাই জানাল, একতলা থেকে জিনিসপত্র দোতলায় তুলে আনা হচ্ছে, তারা এখন খুব ব্যস্ত।

ফোন রেখে নন্দা কী ভেবে নীচে এল। ডাইনিং টেবিলের ধারে মেঝেয় বুড়োবুড়ি দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসে। তাকে দেখেই উঠে দাঁড়াল।

তোমাদের ঘরে কি জল ঢুকেছে?

দুজনেই মাথা নাড়ল।

জিনিসপত্র এখানেই নিয়ে এসো।

টিভিতে সন্ধ্যার খবরে সে শুনল আজ আলিপুর আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, সারাদিনে ২৫৯ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে কলকাতায়। শনিবারও বজ্রবিদ্যুৎ-সহ কয়েক পশলা জোর বৃষ্টি হতে পারে।

রাত্রে একতলায় ডাইনিং টেবিলে বসে খেতে খেতে নন্দা দেখল ঘরের কোনায় একটা টিনের সুটকেস আর ভিজে কাপড়। পোঢ় কার্ড আকারের একটা বাঁধানো ছবি উপুড় করে শুকোতে দেওয়া হয়েছে। ছবির পিছনের হলদে রঙের কাগজের বোর্ডটা ভিজে ফুলে উঠেছে। সে ধরে নিল ছবিটা মা কালীর অথবা শ্রীকৃষ্ণের।

শনিবার সকালেই বৃষ্টি ঝিরঝিরে হয়ে এল। দুপুরে প্রায় বন্ধই। তা হলেও আকাশ থমথমে, ঘন মেঘে ছেয়ে আছে। রাস্তায় লোক চলছে না, গাড়ি তো নয়ই। দুটো কাক সামনের বাড়ির কার্নিশে বসে। তা ছাড়া সে আর কোনো জনপ্রাণীও দেখতে পেল না।

টেলিফোন বেজে উঠল।

হ্যালো, কে দিদি? কী অবস্থা যে…

নন্দা বড়ো বিপদ, শিগগিরি তুই সতুদের…আমার দেওর সতুদের বাড়িতে একটা খবর দেবার ব্যবস্থা কর, যেভাবেই হোক। ওর ছেলে মাস্তু পাঁচ দিন হল আমাদের বাড়িতে রয়েছে। আজ সকালে চুপিচুপি কখন যে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে কেউ লক্ষ করিনি। আট বছরের ছেলে। রাস্তাঘাট জলে থইথই। সকাল থেকেই খোঁজাখুঁজি করছি আমরা। এইমাত্র পাশের বাড়ির একজন খবর দিল, রাস্তার পাশে ড্রেনের মধ্যে একটা ছেলের বডি পাওয়া গেছে। জলে ডোবা। বয়সও বেশি নয়। হাসপাতালে নিয়ে গেছে। শুনেই সবাই আর জি কর এ রওনা হয়ে গেছে। তুই এক বার ওদের বাড়িতে খবর দেবার ব্যবস্থা কর। পরের ছেলে বাড়িতে এনে একী বিপদে পড়লাম।

নন্দা কান্নার শব্দ পেল। খবরটা শুনে সেও স্তম্ভিত। মাকে সে দেখেছে। ওরা কাছাকাছি থাকে। হেঁটে মিনিট পনেরো-কুড়ির পথ। মাস দুয়েক আগেই ওরা নন্দার ছেলেকে দেখতে সন্ধ্যে বেলায় এসেছিল। সঙ্গে মান্তুও ছিল। ছটফটে চঞ্চল প্রকৃতির ছেলে। একদন্ডও বসে থাকতে পারে না।

নন্দা, যদি সম্ভব হত তা হলে আমি এখুনি বেলগাছিয়া থেকে দৌড়ে যেতুম। রাস্তায় বুক সমান জল, একটা গাড়ি নেই। ওদের এখুনি খবর না দিলে সারাজীবন অপরাধী হয়ে থাকব। তুই একটা ব্যবস্থা কর। আমার প্রেশার বাড়ছে। আর কথা বলতে পারছি না হাত-পা কাঁপছে, বুকের মধ্যে কী যে হচ্ছে! তোর বাড়ি থেকে তো আর বেশি দূর নয়।

আচ্ছা আমি দেখছি। তুমি ব্যস্ত হোয়য়া না।

ফোন রেখে নন্দা নীচে নেমে এল। বুড়োবুড়ি দুজনে পাশাপাশি বসে সদর দরজায়। সিঁড়ির প্রথম ধাপটা জলের নীচে। ওরা জলের দিকে তাকিয়ে। নন্দাকে দেখে উঠে দাঁড়াল।

ভূপতি, ভীষণ বিপদে পড়েছে আমার দিদি। তোমাকে এখুনি একটা কাজ করতে হবে।

ভূপতি তার ভালো চোখটা দিয়ে স্তিমিত চাহনিতে তাকিয়ে। শীর্ণ গলার কণ্ঠটা কয়েক বার ওঠা নামা করল। বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর হয়েছে। সকাল থেকে খায়নি।

নন্দা ঝড়ের বেগে কথাটা বলে গেল। ওরা দুজন তার মুখের দিকে চেয়ে আছে। এক বার শুধু নিজেদের মধ্যে দৃষ্টি বিনিময় করল যখন নন্দা বলল, শেষ দেখাটা অন্তত তা হলে ওরা দেখতে পাবে। যাবে তুমি?

ভূপতি বউয়ের মুখের দিকে তাকাল।

যাব। বলাইয়ের মা শান্ত মৃদুস্বরে বলল।

একটা চিঠি লিখে দিচ্ছি তাহলে, মুখে আর কিছু তোমাকে বলতে হবে না। বাড়ির ঠিকানা তোমাকে বলে কোনো লাভ নেই, মনে থাকবে না। তবু লিখে দিচ্ছি। কোনো লোককে দেখালে বাড়ি বলে দেবে। আমি তোমাকে বরং জায়গাটা বুঝিয়ে দিচ্ছি, সেইমতো চলে যাও। খুব শক্ত হবে না খুঁজে বার করতে।

মিনিট দশেক পর গেট খুলে ভূপতি রাস্তার দু-দিকে তাকাল। বৃষ্টি আপাতত ধরে গেছে। দূরে একটি লোককে সে দেখল রাস্তা ধরে আসছে টলতে টলতে। তার কোমর থেকে দেহ জলের নীচে। বলাইয়ের মা গেট পর্যন্ত সঙ্গে এসেছে, নন্দাও।

ভূপতির হাতে ছাতা, জামার বুকপকেটে চিঠি। সে পা ঘষড়ে এগিয়ে পাথরের কিনারে পোঁছে, সন্তর্পণে ইঞ্চি ছয়েক নীচে রাস্তায় নামল। জলে স্রোত রয়েছে। কাছেই একটা বড়ো পুকুর আছে, জলের টান সেই দিকে। কয়েক পা টানের বিরুদ্ধে গিয়ে সে দাঁড়িয়ে পড়ল। পিছন ফিরে বউয়ের দিকে তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করল।

বলাইয়ের মা উৎকণ্ঠা নিয়ে তাকিয়েছিল। স্বামীর চাহনি থেকে কী বুঝে নিয়ে সেও জলে নামল। মুখ ফিরিয়ে নন্দাকে শুধু বলল, আমি সঙ্গে যাচ্ছি। ওর শরীরটা ভালো নয়।

নামার সঙ্গে সঙ্গে জল তার কোমর ছাড়িয়ে গেল, ভূপতির কাছে এসে সে হাত বাড়াল। ভূপতি হাতটা ধরল। তারপর পায়ে পায়ে দুজনে এগোতে লাগল জলের টান ঠেলে।

পা ঘষে ঘষে হেঁটো না তাহলে ঊরুতে ব্যথা করবে। তুলে তুলে হাঁটো। বলাইয়ের মা বলল। ওরা মোড় ঘুরে না যাওয়া পর্যন্ত না তাকিয়ে রইল। বড়ো রাস্তার মুখে এসে চলা থামিয়ে দুজনে রাস্তা বরাবর তাকাল। চওড়া একটা নদীর মতো দেখাচ্ছে। দু-ধারে ফুটপাথে বড়ো বড়ো গাছের গুঁড়ি জলের নীচে। তাদের ডালপালাগুলো বড়ো ছাতার মতো লাগছে। কয়েক জন লোক জল ঠেলে চলেছে। পার্কের রেলিঙের সঙ্গে শেকলবাঁধা একটা ঠেলাগাড়ি জলে ওঠা-নামা করছে নৌকোর মততা, রোল বিক্রির একটা কাঠের গাড়ি হেলে রয়েছে বাড়ির গায়ে। ভাঙা পাইপ দিয়ে ছড়ছড়িয়ে জল ছাদ থেকে পড়ছে। নতুন বাড়ি তৈরি হচ্ছে। তার বাঁশের ভারা থেকে একটা বাঁশ ঝুলছে। যেকোনো সময় নীচে পড়বে। ফুটপাথে রাখা দুটো মোটর গাড়ি, জলে তার অর্ধেক ডোবা। জলে ভেসে যাচ্ছে কাঠের টুকরো, গাছের ডাল, পাতা, ন্যাকড়া, রবারের চটি, কৌটো, মরা পায়রা।

আঃ!

ভূপতি হুমড়ি খেয়ে পড়ছিল। বউয়ের হাত ধরে সামলে নিতে গিয়ে বলাইয়ের মাকে নিয়ে জলে পড়ে গেল। মাথা ভিজিয়ে দুজনে উঠে দাঁড়াল। ছাতাটা হাত থেকে পড়ে জলে ভাসছে বলাইয়ের মা খপ করে ধরে নিল।

গর্ত রয়েছে। ভূপতি সাবধান করে দিল।

চিঠিটা ভিজেছে কি না দ্যাখো! ব্যস্ত স্বরে বলল বলাইয়ের মা।

ভূপতি পকেট থেকে চিঠির খামটা বার করল। খামের কাগজ চুপসে গেছে। ঠিকানা লেখা অক্ষরগুলো ধ্যাবড়ানো। ভীত চোখে বউয়ের দিকে সে তাকাল।

আমায় দাও।

বলাইয়ের মা ভিজে খাম ধরা হাতটা উঁচু করে তুলে আবার এগোতে শুরু করল।

প্রায় দশ মিনিট হাঁটার পর ভূপতি দাঁড়িয়ে পড়ল। হাঁফাচ্ছে। ব্যথায় ঊরু দুটো তুলতে পারছে না। কোমরে ব্যথা করছে। চোখে শ্রান্তি। বলাইয়ের মা ওর বাহু ধরে দাঁড়িয়ে রইল। এক বার স্বামীর কপালে হাত দিয়ে তাপ বুঝে নিল। মাথায় ঝাঁকুনি দিয়ে ভূপতি আবার চলতে শুরু করতেই বলাইয়ের মা হাত টেনে ধরল।

আর একটু জিরোও।

কয়েক মিনিট অপেক্ষা করে দুজনে চলতে শুরু করল। কিছু লোক রাস্তায় নেমেছে। একজন ওদের জিজ্ঞাসা করল, সিগারেটের দোকান খোলা দেখেছে কি না। ওরা মাথা নাড়ল। দুটো বড়ো মোড় পেরিয়ে গিয়ে আর একটা মোড় যার মাঝখানে পাঁচিলঘেরা জমি। সেই জমিতে একটা টুপিপরা লোকের দাঁড়ানো মূর্তি। এই পর্যন্ত তারা এসেছে। এবার আরও সোজা এগিয়ে ডান দিকে প্রথম রাস্তাটায়।

ওরা ডান দিকের প্রথম রাস্তা ধরে চলল। জল এখানে হাঁটুর কাছাকাছি। অল্পবয়সি কয়েকটা ছেলে গামছা দিয়ে রাস্তায় মাছ ধরছে। সামনে আলোর থামের পাশে লাল অক্ষরে লেখা সাইনবোর্ড দেখে ওরা দাঁড়াল। এবার এই বাড়ির গা দিয়ে যে কাঁচা রাস্তাটা গেছে তাই ধরে যেতে হবে। কিন্তু জলডোবা রাস্তাটা কাঁচা না পাকা বোঝা যাচ্ছে না।

দুজনে সেই রাস্তাটাই ধরল। বাড়িগুলো সবই ডান দিকে। বাঁ-দিকে থইথই জল। ডান দিকেও বাড়ির কিনার পর্যন্ত সাত-আট হাত জল। বোঝা যাচ্ছে না রাস্তাটা কতটা চওড়া। বোঝা যাচ্ছে না জলের নীচে ডাঙা না পুকুর না রাস্তার নালা কী রয়েছে!

ওরা থমকে দাঁড়াল, ঝিরঝির বৃষ্টি নেমেছে। দমকা হাওয়াও চলছে। ভূপতি ছাতা খুলতেই হাওয়ার ঝাপটায় হাত থেকে উড়ে যাবার উপক্রম হল। সে ছাতাটা বন্ধ করার চেষ্টা করেও পারছে না। বলাইয়ের মা হাত বাড়িয়ে দু-হাতে ছাতার বাঁট চেপে ধরল আর তখন খামটা হাত থেকে জলে পড়ল। তাড়াতাড়ি জল থেকে তুলে নিয়ে সেটা শেমিজের মধ্যে রেখে সে ছাতাটাকে আঁকড়ে ধরে বন্ধ করল। ভূপতির লাজুক চাহনিটা দেখেও দেখল না!

আবার ওরা এগোচ্ছে। পা টিপে, পা ঘষড়ে হুশিয়ার হয়ে। বাঁ-দিকে বাজার বসে কিন্তু এখন জায়গাটা দিঘির মতো। সেটার পর তিন-তলা বাড়ি। তারপর টালির চালের ঘর। কয়লার দোকান, কেরোসিনের উনুন সারাইয়ের দোকান, মুড়ির দোকান। সব বন্ধ। তারপর মুদির দোকান। একটা পাল্লা খুলে মুখ বার করে আছে একটা লোক, তারপরই এক-তলা বাড়িটা। বাইরের দালান লোহার সাদা জাল দিয়ে ঘেরা।

দালানে একজন মহিলা দড়িতে কাপড় মেলছে। ওরা দুজন দাঁড়িয়ে পড়ল। এই বাড়িটাই? ওরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। বৃষ্টি এখন টিপ টিপ পড়ছে। বলাইয়ের মা এগিয়ে গেল জালের দিকে। মহিলাটি এইসময় মুখ ফিরিয়ে ওকে দেখে ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে রইলেন। যেন চেনা চেনা লাগছে তাঁর। জালের কাছে এগিয়ে এলেন।

তুমি কি নন্দার বাড়িতে কাজ কর?

বলাইয়ের মা-র মুখে স্বস্তির ছাপ পড়ল।

হ্যাঁ। এই চিঠিটা।

কে পাঠিয়েছে, না?

বলাইয়ের মা মাথা কাত করল।

শেমিজের মধ্য থেকে ভেজা খামটা বার করে ভাঁজ করে জালের ফাঁক দিয়ে গলিয়ে দিল। মুখ ফিরিয়ে ভূপতির দিকে তাকিয়ে মাথাটা হেলাল।

এ তো একেবারে ভিজে কালি লেপটে একশা হয়ে গেছে, একটা লাইনও তো পড়া যাচ্ছে না। তুমি জলে দাঁড়িয়ে কেন, ভেতরে এসো।

মহিলা দরজা খুলে দিলেন। বলাইয়ের মা ইতস্তত করে এক বার মুখ ফিরিয়ে ভূপতির দিকে তাকাল। ভূপতি ইশারা করল তাকে ভিতরে যাবার জন্য।

তোমার সঙ্গে এসেছে? ওকেও আসতে বলো, জলের মধ্যে কি দাঁড়িয়ে থাকা যায়?

জ্বর হয়েছে। বলাইয়ের মা কৃতজ্ঞ চাহনি দিয়ে দোষ স্বীকার করার মতো গলায় বলল। তারপর হাতছানি দিয়ে ভূপতিকে ডাকল।

চিঠিটা ভিজিয়ে ফেলেছ। কী লেখা আছে তা তো বুঝতে পারছি না। এই দুর্যোগে এতটা পথ ভেঙে পাঠিয়েছে যখন নিশ্চয় খুব দরকারিই কোনো ব্যাপার হবে!

ওরা দুজনে মুখ ফেরাল পরস্পরের দিকে। চিঠিতে যা বলা হয়েছে সেটা তারা জানে। কিন্তু সেটা কি তারা মুখে বলবে? দুজনে দুজনের কাছে প্রশ্নটা রাখল।

তোমরা কি বলতে পারবে নন্দা কী লিখেছে?

ভূপতির দিকে তাকিয়ে বলাইয়ের মা-র চোখে অনুনয় ফুটে উঠল। ভূপতি ধীরে ধীরে মুখটা ফিরিয়ে রাস্তার দিকে তাকাল।

আপনার ছেলে জেঠির বাড়িতে গেছে।

হ্যাঁ, বেলগাছিয়ায়।

বলাইয়ের মা আবার ভূপতির মুখের দিকে তাকাল। আবার সে মুখ ফিরিয়ে নিল। আঙুল দিয়ে সে জাল আঁকড়ে ধরেছে, চোয়ালটা শক্ত হয়ে উঠল।

আজ সকালে সে চুপি চুপি বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে এখনও ফেরেনি।

অ্যাঁ! সেকী কথা? গেল কোথায় তাহলে? সকাল থেকে বাড়ি নেই? নন্দাকে খবরটা দিল কে?

ফোন করে জানিয়েছেন বউদির দিদি।

ঠিক কী বলেছে? আঃ চিঠিটাও এমন ভিজিয়েছ যে কিছু পড়া যায় না। এমন সাংঘাতিক একটা ব্যাপার, সাবধানে চিঠিটা রাখবে তো।

এই সময় ভিতর থেকে খালিগায়ে পাজামাপরা একটা লোক বেরিয়ে এল। মান্তুর বাবা, মহিলার স্বামী সতু। তাকে দেখেই মহিলা ব্যাকুল হয়ে বললেন, এরা কী বলছে শোনো। নন্দা পাঠিয়েছে এই চিঠি দিয়ে। কিছু পড়া যাচ্ছে না এমনই ভিজিয়েছে। বলছে মান্তু সকাল বেলা বাড়ি থেকে বেরিয়ে এখনও ফেরেনি। দিদি ফোন করে নন্দাকে বলেছেন, তাই সে খবরটা চিঠি লিখে এদের হাত দিয়ে পাঠিয়েছে। কিন্তু এরা এমনই গাধা যে… এখন কী হবে?

তোমরা ঠিক জান? ঠিক বলছ? সতু উৎকণ্ঠিত হয়ে জানতে চাইল।

বউদি তো এই কথাই বললেন।

আর কী বললেন?

বলাইয়ের মা পাশের দিকে মুখ ফিরিয়ে ভূপতির চোখ দেখার চেষ্টা করল। দেখতে পেল না। সে ইতস্তত করল। সতু তখন অধৈর্য হয়ে চেঁচিয়ে উঠল, আর কী বললেন সেটা বলো।

হ্যাঁ, বলেছেন…

ওরা তিন জনই ভূপতির দিকে তাকাল।

একটা ছেলে জ্বলে ডুবেছে। তার লাশ পাওয়া গেছে।

কযেক সেকেণ্ডের জন্য প্রাণঘাতী নীরবতা বিরাজ করল। তারপরই মান্তু রে বলে মহিলা চিৎকার করে উঠলেন।

বলাইয়ের মা বিষণ্ণ চোখে ভূপতির দিকে তাকাল, তার চাহনিতে ভৎসনা, কেন কথাটা বলতে গেলে?

ছেলেটা কে? মান্তুই কি? সতু স্তম্ভিত অবস্থা থেকে শান্ত গলায় বলল।

আর কিছু বলেননি।

হ্যাঁ, বলেছেন বাড়ির সবাই হাসপাতালে গেছেন। বলাইয়ের মা কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গে ঘোমটা তুলে দিল।

সেটা এতক্ষণ বলনি কেন? কোন হাসপাতালে? নাম কী হাসপাতালের?

সতুর ব্যগ্র অ্যাকুল স্বরে কুঁকড়ে গেল দুজনেই। পরস্পরের মুখের দিকে অসহায় ভঙ্গিতে তাকিয়ে থেকে আবার তারা সতুর দিকে তাকিয়ে একইসঙ্গে মাথা নাড়ল। মহিলাটি চিৎকার করে যাচ্ছেন উবু হয়ে বসে। চিঠিটা চোখের সামনে ধরে উন্মাদের মতো চোখে সতু পড়ার চেষ্টা করে হতাশায় ছুড়ে ফেলে দিল।

কথা বলছ না কেন, তোমরা কি বোবা? সতু ফেটে পড়ল, এমন একটা ভয়ংকর খবর, অথচ বলতে পারছ না কোন হাসপাতালে গেছে। ইডিয়ট, উল্লুক কোথাকার! ইচ্ছে করছে জুতোপেটা করি। এখন নন্দার বাড়ি গিয়ে জানতে হবে. ওহহ, মানসবাবুর বাড়ি থেকে তো ফোনই করা যায়। আমি ফোন করতে যাচ্ছি, বুঝলে?

সতু দ্রুত বাড়ি থেকে বেরোতে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে, তোমরা এবার এসো। আর কখনো তোমাদের যেন… বলতে বলতে ছুটে বেরিয়ে গেল।

দুজনে ব্যথিত চোখে মেঝেয় গড়াগড়ি দেওয়া মহিলাটির দিকে তাকিয়ে রইল। বলাইয়ের মা এগিয়ে এসে ঝুঁকে মহিলার বাহুতে হাত রেখে বিড়বিড় করে কী যেন বলতে লাগল।

আয়, চলে আয়। ভূপতি একটু তীক্ষ্ণ কণ্ঠে কথাটা বলেই দরজার দিকে এগোল। সামনের বাড়ির দুজন মহিলা ছুটে আসার সময় তাকে ধাক্কা দিয়েই ভিতরে ঢুকল।

বলাইয়ের মা ধীর পায়ে বেরিয়ে এল। দুজনে আবার জল ঠেলে ঠেলে ফিরছে। বৃষ্টি এখন বন্ধ। মেঘের জন্য চারিদিক স্যাঁতসেঁতে আলোয় নির্জীব, বিষগ্ন। তাদের জলভাঙার শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। মুখ নামিয়ে তিন-চার হাত ব্যবধান রেখে ওরা এগোচ্ছে।

হঠাৎ ভূপতি দেখল বলাইয়ের মা হেলে পড়ছে। দু-হাত তুলে বাতাস আঁকড়ে ধরার জন্য তালু আর আঙুলগুলো মুঠো হল, তারপর জলের নীচে চলে গেল, আবার একটুর জন্য ভেসে উঠল মুখ আর দুটো হাত।

ডুবে যাচ্ছে। ভূপতি ছাতাটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ধর, ধর।

তৃতীয় বার ভেসে উঠে ডুবে যাবার সময় বলাইয়ের মা ছাতার প্রান্তটা মুঠোর মধ্যে পেয়ে গেল। ভূপতি ওকে টেনে আনল ছাতার সঙ্গে। বলাইয়ের মা-র চোখে ভয়। মৃত্যুর সঙ্গে দেখা হওয়ার বিস্ময় ছড়িয়ে রয়েছে মণিতে। ঠোঁট দুটো থরথর করছে। ভয়টা এবার কুয়াশা সরে যাবার মতো আবছা হতে হতে একেবারেই সরে গেল। একটা রাগ এবার সেই জায়গায় উঠছে।

তুমি বলাইকে তাহলে কেন ধরনি?

নৌকোটা উলটোতেই বাঁশের খোঁচাটা চোখে তখন যদি…বলেছি তো তোকে কত বার। দু-হাত ঝাঁকিয়ে ভূপতি চেঁচিয়ে উঠল। আমি তো নাম ধরে তারপর চেঁচিয়েছি, চোখে দেখতে পাচ্ছিলুম না অন্ধ হয়ে গেছলুম, সাঁতার দিতে দিতে কত বার চেঁচিয়েছি, ডুবে ডুবে নদীর তল পর্যন্তও গেছি।

সে হাঁফাতে লাগল। বলাইয়ের মা কাছে এসে ওর বুকে কপালে হাত রাখল। সেই সময় উদভ্রান্ত সতু তাদের পাশ দিয়ে চলে গেল সামনে ঝুঁকে, দৌড়োবার চেষ্টায় শরীরটা পড়ো পড়ো, দু-হাত ভারসাম্য রাখার জন্য পাখির ডানার মতো ঝাপটাচ্ছে। সতু ওদের দেখেও দেখল না। কিছুটা পিছনে সেই মহিলা, মান্তুর মা। লেপটানো শাড়িতে জড়িয়ে-যাওয়া পা ফেলতে গিয়ে বার বার জলে আছাড় খাচ্ছে। কয়েক হাত হামা দিয়ে আবার উঠে দাঁড়িয়ে চলতে গিয়ে আবার পড়ছে। মুখ থেকে একটা উ উঁ শব্দ একটানা বেরিয়ে আসছে। মান্তুর মাও ওদের পাশ দিয়ে এগিয়ে গেল।

ওরা দাঁড়িয়ে দেখল। দু-তিন বার মাথা নাড়াল।

যদি মান্তু না হয় তো ওরা বেঁচে যাবে।

ভূপতি যেন নিজেকেই প্রবোধ দিয়ে শোনাল।

অন্য কোনো বাপ-মায়ের ছেলে তো! তাদের কী অবস্থা হবে?

দুজনে ধীরে ধীরে সতর্ক পায়ে হাঁটতে শুরু করল। যত এগোচ্ছে জল ক্রমশ বাড়ছে। কাঁচা পথটুকুই শুধু যা ভয়ের।

হাঁপির টান কি বোধ করছ? ফিরে গিয়ে মালিশ করে দেব। আজ কিছু খেয়ো না, উপোস দাও। একটু গরম দুধ যদি…।

ওরা কাঁচা রাস্তা পার হয়ে একসময় বড়ো রাস্তায় পৌঁছোল। ধু-ধু নদীর মতো রাস্তাটাকে আবার ওরা অবাক হয়ে দেখল।

না বললেই হত। ফুটপাথ থেকে পা টিপে টিপে রাস্তায় নেমে বলাইয়ের মা-র দিকে হাত বাড়িয়ে ভূপতি বলল। কথাটার উত্তর সে পেল না।

আমার মুখ দিয়ে কেন যে বেরিয়ে এল!

বিস্ময় নিয়ে ভূপতি স্ত্রীর হাত চেপে ধরে জল ঠেলতে ঠেলতে বাড়ি ফিরে এল। গেটের থেকেই তারা দেখল বারান্দায় নন্দা দাঁড়িয়ে। তাদের দেখতে পেয়ে সে অস্বাভাবিক উত্তেজিত গলায় চেঁচিয়ে উঠল, বলাইয়ের মা, ভূপতি..মাস্তু নয়, বডিটা মান্তুর নয়। ওরা হাসপাতাল থেকে একটু আগে ফিরে এসেছে। ভেতরে এসো বলেছি।

ওরা এক-তলার দরজা দিয়ে ঢোকার আগেই নন্দা নেমে এসেছে।

উঃ, কী ভয় যে পাইয়ে দিয়েছিল! ওটা অন্য ছেলে। এই মান্তুর দিদি আবার ফোন করেছিল, পাঁচ মিনিটও হয়নি। মিছিমিছি চিঠি দিয়ে তোমাদের পাঠালাম। পড়ে কী হল ওদের?

দুজনে মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। হঠাৎ দপ করে বলাইয়ের মা-র চোখ জ্বলে উঠল, হাত মুঠো হল কয়েক সেকেণ্ডের জন্য। তারপর ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে এল চোখের চাহনি।

চিঠিটা জলে পড়ে ভিজে গেছে। পড়া গেল না।

বাঁচা গেছে, বাব্বা! পড়লে কী যে ওদের অবস্থা হত!

ফোন করেননি? ভূপতি জিজ্ঞাসা করল।

না তো? বোধ হয় ওদের লাইন খারাপ। তোমরা আর ভিজে কাপড়ে থেকো না। চা করো…না না আমিই করে দিচ্ছি।

মাঝরাতে ভূপতির ঘুম ভেঙে গেল, টানা বৃষ্টির মতো কান্নার শব্দে। সে শুধু একটা হাত বলাইয়ের মা-র পিঠে রাখল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *