জলের ঘূর্ণি ও বকবক শব্দ
বিয়ের পর ঘরের অকুলান এবং ডেইলি প্যাসেঞ্জারির ধকল, এই দুই ঝকমারি সামলাতে, বিশ্বনাথ কলকাতার উত্তরে বাসা পেয়ে গোবরডাঙার পৈতৃক বাড়ি ছেড়ে উঠে এসেছে। সে চাকরি করে বিরাট এক হোটেলে। প্রায় সাড়ে সাতশো কর্মচারির ছুটির হিসাব রাখা তার কাজ। বউ পূর্ণিমা, সাত মাসের পুত্র বুবুন আর বাসু নামে বছর বারোর একটি কাজের মেয়েকে নিয়ে তার সংসার। হাজার টাকা সেলামি দিয়ে দেড়শো টাকা ভাড়ায় দেড়খানি ঘর, ছোট্ট রান্নাঘর আর সরু একটি দালান নিয়ে তার সংসার। টানাটানি নেই আবার সচ্ছলও নয়, যেমন পূর্ণিমা সাদামাটা নয় আবার সুন্দরীও নয়।
বিশ্বনাথ জন্মরুগ্ন। শরীর কমজোরি হওয়ায় ছোটো থেকেই সে ভীরু প্রকৃতির। পূর্ণিমা কিছুটা বিপরীত। সে চটপটে, পরিশ্রমী এবং কিঞ্চিৎ রাগী। কলকাতায় ভাড়াবাড়িতে বসবাস পদ্ধতির সঙ্গে দ্রুত মানিয়ে নিতে তার অসুবিধা হয়নি শুধু জলের ব্যাপারটা বাদে। সে অস্বাচ্ছন্দ্যে পড়ে সকাল বেলাটায়।
এই বাড়ির তিনটি পরিবারের জন্য উঠোনে এজমালি একটি জলের কল। স্নানের ঘরেও একটি কল আছে চৌবাচ্চার উপরে। পূর্ণিমাদের মুখোমুখি উঠোনের ওধারে একটি ঘরে থাকে স্যাকরা কানাই দত্ত, তার দ্বিতীয় পক্ষের বউ সুপ্রিয়া এবং দুই পক্ষের মোট তিনটি ছেলে মেয়ে। বাড়িওয়ালা রূপেন পাল কাঠের ব্যবসায়ী। তার সংসারে স্ত্রী, এমএ পাঠরতা কন্যা আর নিমাই নামে একটি চাকর মাত্র। জনা বারো প্রাণী নির্ভর করে একটি কলের উপর। প্রতিদিন দু-বেলা কে আগে কলের নীচে কলসি বা বালতি বসাবে, এই নিয়ে তিন পরিবারের লোকেদের মধ্যে মিউজিক্যাল চেয়ারের মতো জলধরার প্রতিযোগিতা চলে। মছলন্দপুরের বাপের বাড়িতে টিউবওয়েল, পাতকুয়া এবং পুকুর পূর্ণিমাকে যথেচ্ছ জল খরচ করার অভ্যাস তৈরি করে দেওয়ায় এখন চার বালতি জলের সঙ্গে সে কিছুতেই মানিয়ে নিতে পারে না। স্বামীকে সে প্রায়ই অনুযোগ করে, বাড়িওলাকে বলো আর একটা কল বসাতে, এভাবে রোজ পারা যায় না। উঠোন ধুতে দু-বালতি জল ঢেলেছি অমনি ওপর থেকে মাসিমার চিৎকার, চৌবাচ্চা খালি করে দিয়ো না গো। চান করছি আর তখন দরজার কাছে এসে সুপ্রিয়া বলবে, উনি চান করবেন, একটু জল রেখো। বাড়িওলাকে এবার বলো আর একটা কল বসাক।
বললেই কি কল বসানো যায়। কলকাতার জলের অবস্থাটা আগে বোঝো। কল দিয়ে বেরোবার জন্য জলটা কোথায়? জল দেবে কর্পোরেশন, বাড়িওলা তো নয়।।
বিশ্বনাথ সর্বদাই বিরোধ বিসংবাদ এড়িয়ে চলতে চায়, সে জানে চিৎকার ঝগড়া হাতাহাতি করে সামান্য কিছু আদায় করা গেলেও মানসিক উৎপীড়নে অশান্তিতে ভুগতে হবে। পূর্ণিমাকে সে বোঝায়, সব কিছু কি আর করে দেওয়া যায়, মানিয়ে নিয়ে চলতে হয়, কিছুটা ছেড়ে দিয়ে অ্যাডজাস্ট করতে হয়। যখন যেরকম অবস্থা পড়ে তখন তেমনভাবে চলা।
মানিয়ে চলারই তো চেষ্টা করি। যখন কেরোসিন পাওয়া যাচ্ছিল না, মাসিমা বোতল হাতে এলেন তখন কি আমি আধ বোতল দিইনি? হঠাৎ যেদিন দুধের ধর্মঘট হল, মিন্টু এসে বলল বাবা চা খেতে পাচ্ছে না একটুখানি দেবে কাকিমা? বুবুনের বেবিফুড থেকে তো দু-চামচ দিলুম। মানিয়ে চলতে একা আমি চাইলেই তো হবে না। লোডশেডিং হলে হারিকেনটা রান্নাঘরের দরজার বাইরে রেখে কাজ করি, তাতে আমার অসুবিধে হলেও কিছুটা আলো তো সদরে পড়ে। এসব কেন করি, মানিয়ে চলার জন্যই তো।
অন্যে আমার জন্য কী করল বা না করল তাই নিয়ে মন খারাপ করে লাভ কী, তোমার কর্তব্য তুমি করে যাও।
সংসার চালাতে গেলে অত ভালোমানুষ হলে চলে না।
বিশ্বনাথ তখন ট্রানজিস্টারের চাবি ঘোরাল ছায়াছবির গান শোনার জন্য।
কয়েক দিন পর সকালে খবরের কাগজ পড়ার মধ্যেই বিশ্বনাথ এক বার রান্নাঘরের দিকে তাকিয়ে উঁচুস্বরে বলল, পলতায় জলের পাইপ বদলানো হবে, বুধবার বিকেল থেকে বারো ঘণ্টা জল আসবে না, জল ধরে রেখো।
কথাটা পূর্ণিমার কানে পৌঁছোল কিন্তু গভীরে নয়। দু-দিন পরে বুধবার এল। প্রতিদিনের মতোই সে সংসারের জন্য জল তুলল। শুধু বিকেল আর রাতে জল বন্ধ, বৃহস্পতিবার সকালেই পাওয়া যাবে এই নিশ্চিন্তিতে সে বাড়তি জল ধরেনি। কিন্তু বিশ্বনাথের নজরে পড়ল কানাই দত্তর বউ আর বড়োমেয়ে অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়ি, ডেকচি, গামলা করে চৌবাচ্চা থেকে জল নিয়ে গেল প্রায় চোরের মতো। এভাবে জল নেওয়ার কোনো কথা নয়। এখনও বাড়ির কারুরই স্নান হয়নি। ঠিক তখনই দোতলা থেকে নিমাইও দুটো ঢাউস প্লাস্টিকের বালতি হাতে নামল।
বিশ্বনাথ রান্নায় ব্যস্ত, পূর্ণিমাকে বলল, জল ধরে রেখেছ তো?
খাবার জল দু-বালতি রেখেছি, হবে না ওতে? কাল সকাল পর্যন্ত তো। রাস্তার টিউবয়েল থেকে দরকার হলে বাসু এনে দেবে।
সেটা তো কতদিন ধরে খারাপ হয়ে রয়েছে, ওদিকে চৌবাচ্চা খালি করে ওরা জল নিয়ে গেল।
তাহলে চটপট তুমি কলঘরে ঢুকে পড়ো, চানটা করে নাও। দেখলে তো কেমন স্বার্থপরের মতো নিজেরা চৌবাচ্চার সব জল নিল? যেন ওরা ছাড়া এ বাড়িতে আর কেউ নেই।
বুধবার বিকেলে কলে জল এল না। চৌবাচ্চা শুকনো। রাতে সকড়ি বাসন জলে ভিজিয়ে রাখা পূর্ণিমার অভ্যাস। তুলে রাখা দু-বালতি জলের একটি থেকে অর্ধেক খরচ হয়ে গেছে। তাই থেকে দু-গ্লাস জলে গামছা ভিজিয়ে গা মুছল। ভ্যাপসা গরমের জন্য বিশ্বনাথ পাখার নীচে মেঝেয় শোয়। ন্যাতা ভিজিয়ে মেঝে মুছতেও এক গ্লাস খরচ হল। প্রতিদিনের মতো দাঁত ব্রাশ করার জন্য বিশ্বনাথের দু-গ্লাস জল দরকার হল। বালতিটায় তারপর আর কিছু রইল না।
আর এক বালতি তো রইল।
পূর্ণিমার নিশ্চিন্ত মুখে বিশ্বনাথ অনিশ্চিত চাহনি রেখে বলল, কিন্তু সকালে যদি জল না আসে?
পরদিন সকালে জল এল না।
পূর্ণিমার হতভম্ব অবস্থাটা কেটে যেতেই কথার খেলাপ করার জন্য কর্পোরেশনের উপর রেগে উঠল। সংসারের নিত্যকর্মগুলো শুরু করতে গিয়ে ভয়ে সিঁটিয়ে গেল। এক বালতি জল কোন কর্মে লাগবে।
বিশ্বনাথ একটা বালতি নিয়ে কোনো কথা না বলে বেরিয়ে গেল। আধ ঘণ্টা পর আধ বালতি জল নিয়ে ফিরল।
কী লাইন আর কী ঝগড়া রে বাবা!
কোথায় গেছলে?
এই পিছনে বাজার যাবার পথে যে-বস্তিটা। ওরা নিতে দিচ্ছিল না, অনেক বলে-কয়ে আধ বালতি নিতে দিল।
চান তো হবে না, তুমি বরং এটা নিয়ে পায়খানায় যাও।
আর তুমি, বাসু?
সে যাহোক করে হয়ে যাবে, তোমাকে তো এখন বেরোতে হবে।
তাহলে থাক, আমি হোটেলেই সব সেরে নেব। ওখানে নিজেদের জলের ব্যবস্থা আছে।
বাজার থেকে কলাপাতা এনো।
বুবুনকে কোলে নিয়ে বাসু শুনছিল, বলল, বউদি চাপাকল থেকে জল আনব?
রাস্তার ওই নোংরা জল, ম্যাগা!
গঙ্গার জল তো, কত লোক নিচ্ছে।
নিক গে, বিকেলেই জল এসে যাবে।
বিকেলে জল এল না। কলের নীচে বালতি রেখে পূর্ণিমা দুপুর থেকে অপেক্ষা করেছে, সেঁকুর তুলে সর্দি ঝাড়ার মতো শব্দ কখনো বেরিয়ে আসে।
বালতি পেতে কোনো লাভ নেই গো৷ উঠোনের ওধার থেকে সুপ্রিয়া বলল, এরকম আগেও তো হয়েছে, এক বেলা বলে চার বেলা, একদিন বলে তিন দিন। এবার কতদিন চলবে তার কি ঠিক আছে। আমি বাবা কাল সকালটা দেখব, এল তো ভালোই নইলে শিবপুরে দিদির বাড়ি চলে যাব।
পূর্ণিমা শুনেই গেল। কলকাতার ত্রিশ-চল্লিশ মাইলের মধ্যে তার কোনো আত্মীয়স্বজন নেই। এখন তার শরীরে টোকো গন্ধ। জষ্টি মাসের গরম, বাতাসও বইছে না। এক-তলার ঘরে দরদর ঘামের সঙ্গে ধুলো মিশে চামড়ার উপর কাদার পরত ফেলেছে। সারাদেহে চিটচিটে অস্বস্তি। পায়খানায় যেতে পারেনি, তলপেটে একটা গুমোট ক্রমান্বয়ে চাপ দিচ্ছে।
বুবুনের জন্য দুধ তৈরি করতে হবে কিন্তু জল রয়েছে বড়জোর এক গ্লাস। তেষ্টায় পূর্ণিমার ছাতি ফেটে যাবার মতো অবস্থা অথচ জলটুকু সে খেতে পারছে না, বুবুনের বেবিফুড গুলতে দরকার। সুপ্রিয়ার কাছে এক গ্লাস চাইতেই সে পরিষ্কার বলে দিল, না ভাই, জল এখন চাওয়াচাওয়ি কোরো না। দুপুরে মিনুর বাবা মারামারি করে টিউকল থেকে এক বালতি এনে দিয়েছে…আমাদেরও তো দরকার লাগবে।
গেলাস নিয়ে সে দোতলায় গেছল। মাসিমা বিষগ্ন কণ্ঠে বললে, পোড়া কপাল, দুপুর থেকে গলা ভেজাবার মতো জলও নেই। নিমাই একটা ভারীকে ধরেছিল এক টিন জলের জন্য, ব্যাটা বলে দিল দিতে পারব না। তিন গুণ চার গুণ দাম দিয়ে দোকানদাররা যে নিচ্ছে!
পূর্ণিমা মুখ কালো করে নীচে নেমে এসে দেখল বাসু চাপাকল থেকে বালতি ভরে জল এনে পায়খানার দিকে যাচ্ছে। তাকে দেখেই কুঁকড়ে গেল। তারপর করুণ স্বরে বলল, বউদি আমি আর পারছি না।
দুর্বল স্বরে পূর্ণিমা বলল, সবটা খরচ করিসনি, আমার লাগবে।
সন্ধ্যায় বিশ্বনাথ ফিরল বেশ উদবেগ নিয়েই। শুনছি জল নাকি অনেক দিন পাওয়া যাবে না। পাইপ না ভালভ কী যেন বদলাতে গিয়ে সব ভেঙে পড়েছে, আবার নতুন করে বসাতে হবে।
পূর্ণিমা ফ্যালফ্যাল করে তার মুখের দিকে তাকিয়ে। সে আবার বলল, হোটেলে নোটিশ দিয়েছে এমপ্লয়িরা চান করতে পারবে না। আমি অবশ্য একটা খালি রুমে ঢুকে ম্যানেজ করে নিয়েছি।।
বাসু বলল, আমাদের এক ফোঁটা জলও নেই। বউদি খাবার জন্য এক গ্লাস জল চাইতে গেছল, নীচে ওপরে কেউ দিল না, আমি পাশের বাড়ি থেকে দু-গ্লাস জল আনলুম, ওরা লোক খুব ভালো!
বিশ্বনাথ ঈষৎ অপ্রতিভ হয়ে সে কী! বলে এক ঝটকায় দুটো প্লাস্টিকের বালতি তুলে নিয়ে বেরিয়ে গেল এবং মিনিট পনেরো পর ফিরে এল খালি বালতি নিয়েই।
চলো তো আমার সঙ্গে, ওরা নিতে দেবে না। মেয়েছেলে দেখলে হয়তো ছেড়ে দেবে…বেশি দূর তো নয়, বস্তিতে ঢুকে সোজা কুড়ি-পঁচিশ পা এগোলেই টিউবওয়েলটা।
গলির তিনটি বাঁক ঘুরেই ডান দিকে পড়ে কয়েকটা টালি। টিন আর খোলার চালের দোকান ঘর, উলটোদিকে ডালখোলা। মুদি আর তেলেভাজা দোকানের মাঝে বট গাছের ধার দিয়ে সাত-আট হাত চওড়া কাঁচা রাস্তা বস্তির মধ্যে ঢুকে গেছে। সবে সন্ধে হয়েছে, রাস্তাটার মুখে এবং ভিতরে কর্পোরেশনের আলো জ্বলছে।
তৃতীয় বাঁকের আগে বিশ্বনাথ দাঁড়িয়ে পড়ল। সন্তর্পণে কোণের বাড়ি ঘেঁষে উঁকি দিল। দুটো বাচ্চা ছেলে, একজনের হাতে পেট্রোলের টিন, আর খয়েরি লুঙ্গিপরা খালি গা শীর্ণ চেহারার একটি লোক আঙুল তুলে চলে যেতে বলছে। ধমকের তর্জন দূর থেকে বিশ্বনাথ শুনতে পেল। এই লোকটিই তাকে ঢুকতে দেয়নি বস্তিতে। বলেছিল, অনেক হুজ্জত ঝামেলা করে এই কল আদায় করেছি, তখন তো আপনারা সাপোর্ট দিতে আসেননি…জলফল হবে না, অন্য জায়গায় দেখুন। কয়েক জন স্ত্রীলোক তখন দাঁড়িয়েছিল। একজন বলে ওঠে, তিন তলা বাড়িতে থাকার সুখ এবার পিছন দিয়ে বেরুবে।
বাচ্চা দুটো গুটিগুটি ফিরে আসছে। লোকটা লুঙ্গি টেনে তুলে মুদি দোকানের গায়ে ধাপটায় পা ঝুলিয়ে বসল।
কী বলল রে তোদের?
বিশ্বনাথের দিকে এক বার মাত্র তাকিয়ে যেতে যেতেই একজন জবাব দিল, কিনে খেতে বলল।
বিশ্বনাথ ইতস্তত করে পূর্ণিমাকে বলল, তুমি একাই যাও, পারবে তো দু-হাতে দুটো বয়ে আনতে?
পারা না পারা নয়, পারতেই হবে।
পূর্ণিমা বালতি নিয়ে এগোল। তার চলনের মধ্যে গোঁ ফুটে উঠেছে। মুদির দোকান পেরিয়ে বস্তিতে ঢুকতে যাচ্ছে তখন লোকটি চেঁচিয়ে উঠল, এই যে যাচ্ছেন কোথায় বালতি হাতে? …জল? হবে না।
না শোনার ভান করে পূর্ণিমা এগিয়ে যাচ্ছিল। লোকটা ধাপ থেকে লাফিয়ে নেমে প্রায় ছুটেই তার সামনে পথ জুড়ে দাঁড়াল। শুনতে পাননি, কালা নাকি?
একটু জল নেব।
অন্য জায়গায় যান, এখানে হবে না।
বড্ড দরকার, বাচ্চার খাবার জলটুকুও বাড়িতে নেই। পূর্ণিমার স্বরে অকৃত্রিম কাকুতি। ফুটে উঠল।
বলে তো দিয়েছি, অন্য জায়গায় যান, কলকাতায় আরও অনেক টিউকল আছে।
খাবার মতো জল অন্তত নিতে দিন।
খাবার, জলপটি দেবার, ছোঁচাবার কোনো জলই এখানে মিলবে না।
পূর্ণিমা গলা নামিয়ে মৃদুস্বরে বলল, পয়সা দেব, এক-এক বালতি কত করে নেবেন বলুন?
লোকটার পাশে বস্তিরই আরও দুটি মাঝবয়সি লোক ও একটি কিশোরী দাঁড়িয়ে। কিশোরীটি হঠাৎ বলল, পয়সার গরম দেখাচ্ছেন?
সঙ্গে সঙ্গে লোকটা গলা চড়িয়ে বলে উঠল, আমরা বস্তিতে থাকি বলে কি ভেবেছেন পয়সা দিয়ে কিনে নেবেন?
কৌতূহলে পথচারী দু-তিন জন থমকে গেল। বস্তির ভেতর থেকে কয়েক জন এগিয়ে এল, দোকান থেকে মুখ ঝুঁকে পড়ল।
কেনাকেনির কথা তো বলিনি, একটু জল চাই শুধু।
আপনি পয়সার কথা বলেননি, মিথ্যুক। ভদ্দরলোকের মেয়ে যদি হন তো বলুন পয়সার কথা বলেননি?
বলেছি, কিন্তু সে তো জল কিনব বলে!
একই কথা।
আমাদের বাড়ির কাছেরটা ভেঙে পড়ে আছে আজ বারো-চোদ্দো দিন, আর কোথায়…
তাই বলে এখানে পয়সার ফুটুনি মারতে আসা? জল কেনার শখ হয়েছে, তিন-তলা বাড়িতে ফ্যানের হাওয়া খেয়ে জল তুলতে এসেছেন…যান যান জলফল হবে না।
কেন হবে না?
পূর্ণিমা হঠাৎ কোণঠাসা বেড়ালের মতো কুঁজো হয়ে বালতি দুটো ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে তীক্ষস্বরে বলল, কেন জল পাব না, কলটা কি আপনাদের পৈতৃক সম্পত্তি, মগের মুল্লুক নাকি? আমি জল নেবই।।
সামনের দু-তিন জনকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে সে বস্তির মধ্যে যাবার জন্য হনহনিয়ে এগোতেই কিশোরীটি ছুটে গিয়ে পিছন থেকে তার আঁচল টেনে ধরল। শরীরের উপর থেকে শাড়িটা খুলে কোমরে টান পড়তেই পূর্ণিমা ঘুরে বালতি দিয়ে মেয়েটির বাহুতে আঘাত করল।
ওরে মেজদি, ওরে শেফালি শিগগিরি আয়, আমাকে মারছে রে।
মেয়েটি তারস্বরে চিৎকার করে উঠতেই দু-পাশ থেকে পাঁচ-ছটি স্ত্রীলোক ছুটে এল। নারী পুরুষের একটা ভিড় পূর্ণিমাকে ঘিরে। তার মধ্য থেকে এক বিবাহিতা তরুণী বিশ্রী একটা গালি দিয়ে পূর্ণিমার গালে চড় মারল।
হারামির বাচ্চা মারপিট করতে এসেছিস, দাঁড়া তোর বাপের নাম ভোলাচ্ছি।
একটি অল্পবয়সি মেয়ে পূর্ণিমার চুল টেনে ঝাঁকুনি দিতে দিতে বলল, হাত ভেঙে দোব, কোতায় খাপ খুলতে এসেচ জান? চোক উপড়ে লোব।
হাত থেকে বালতি দুটো কে ছিনিয়ে নিয়েছে। অপ্রত্যাশিত অকল্পনীয় ঘটনায় পূর্ণিমা বিহ্বল চোখে এধার-ওধার তাকিয়ে ভিড় থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করতেই তিন চারটে মেয়ে তাকে আটকে রেখে টানতে শুরু করল। ব্লাউজ ভেঁড়ার শব্দ হল। তার ঘাড়ে নখ বসিয়ে মাংস খুবলে তুলতে চাইল একজন। হাঁটু দিয়ে একজন তার তলপেটে আঘাত করল। অন্ধের মতো দু-হাত ছুড়তে ছুড়তে পূর্ণিমা চিৎকার করে উঠল, ছোটোলোক, ছোটোলোকের দল। …আমায় যেতে দাও, যেতে দাও।
পুরুষ কন্ঠে কে বলল, চোপা কত! হাতটা ভেঙে দে-না।
আর একজন বলল, ন্যাংটো করে দে মাগিকে, পয়সার গরম তাহলে কমবে।
ঠেলাঠেলির মধ্যে কেউ তার শাড়ি ধরে টেনেছে। পূর্ণিমা দুই মুঠোয় শাড়ি ধরে আর্তনাদ করে উঠল, খুলো না, পায়ে পড়ি তোমাদের খুলো না।
টান টান, খুলে দে।
দুটি মেয়ে হ্যাঁচকা টান দিতেই পূর্ণিমা মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ল। শাড়িটা শক্ত করে সে ধরে রেখেছে। সেইভাবেই হাত দশেক তাকে ওরা টেনে নিয়ে গেল। তখন সে হাউহাউ করে ওঠে, আমার শাড়ি নিয়ো না, ওগগা খুলে নিয়ো না।
একটি স্থূলকায় বিধবা পূর্ণিমার দুই মুঠির উপর দাঁড়াতেই শাড়িটা তার দখল থেকে বেরিয়ে গেল। মাটিতে মুখ চেপে সে ফোঁপাতে শুরু করল। মিনিট তিনেকের মধ্যে ব্যাপারটা ঘটে গেল, সেই সময় ভিড়ের ফাঁক দিয়ে বিশ্বনাথ উঁকি দিল আর পূর্ণিমাকে ওই অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে চিৎকার করে উঠল।
একী একী, অ্যাাঁ একী!
উত্তেজনায় ঠকঠক করে সে কাঁপছে, আর কোনো কথা তার মুখ দিয়ে বেরুচ্ছে না। শুধু শায়াটা হাঁটুর কাছ থেকে নীচে নামিয়ে দেওয়া ছাড়া তার শরীর আর কোনো আবেগ বা
প্রতিবাদ প্রকাশ করতে পারল না।
বিশ্বনাথ এতক্ষণ সেই রাস্তার বাঁকেই অপেক্ষা করছিল। পূর্ণিমা সঙ্গে সঙ্গে ফিরে না আসায় সে ধরে নেয় দুটো বালতি ভরার জন্যই সময় লাগছে। স্বস্তি বোধ হতেই সে সিগারেট কিনল সামনের দোকান থেকে। দড়ির আগুন সিগারেটে যখন লাগাচ্ছে তখন কানে এল—বস্তিতে একটা মেয়েলোক জল নিতে এসেছে তাকে ধরে সবাই যা ঝাড় দিচ্ছে-না–শোনামাত্র সে ছুটে গেছে।
শাড়িটা দিন।
বিশ্বনাথ ভিড়ের মুখের দিকে তাকাল। শাড়ির জন্য কেউ ব্যস্ততা দেখাল না। বালতি দুটোরও হদিস নেই। ভিড় ক্রমশ পাতলা হয়ে যাচ্ছে।
শাড়িটা ফিরিয়ে দিন।
বিশ্বনাথ প্রার্থনার মতো দু-হাত মুঠো করে মেয়েদের দিকে তাকাল।
শাড়ি না হলে ও যাবে কী করে?
কেন শায়া তো রয়েছে।
বিভ্রান্ত চোখে বিশ্বনাথ তাকিয়ে রইল মাটিতে উবুড় হয়ে থাকা তার স্ত্রীর দেহের দিকে। নিজের শার্টটা খুলে পূর্ণিমার পিঠের উপর রেখে বলল, চলো বাড়ি যাই।
পূর্ণিমার ঘাড় আর গাল থেকে রক্ত ঝরছে। ফালা দেওয়া ব্লাউজের ফাঁক দিয়ে চামড়ায় রক্তের ছড় দেখা যাচ্ছে। চোখের জল আর মাটিতে মুখ লেপা। বিশ্বনাথ রুমাল দিয়ে মুখটা মুছে দিল। তখনও সে ঠকঠক করে কাঁপছে।
ওরা বাড়ি ফিরে এল। শার্ট আর শায়াপরা পূর্ণিমাকে রাস্তার দু-ধারের কৌতূহলী চোখ দেখছিল, কিন্তু তাই নিয়ে বিব্রত বা লজ্জিত হবার মতো বোধক্ষমতা তাদের ছিল না। অপমান, রাগ, দুঃখ কিছুর দ্বারাই ওরা পীড়িত হয়নি। অনুভবহীন, শব্দহীন শূন্যতার মধ্য দিয়ে দুজনে ফিরে এল।
সেই রাত্রেই কলে জল এল। বালতি বসাবার জন্য যখন হুড়োহুড়ি চলছে পূর্ণিমা তখন বিছানায় কাঁপছে জ্বরের তাড়সে।
দিন দশেক পর সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে বিশ্বনাথ দেখল রান্নাঘরের প্রায় সিকিভাগ জুড়ে রয়েছে দুটো জালা, যার মধ্যে একটা মানুষ উবু হয়ে থাকতে পারে।
দুপুরে বাজারে গিয়ে কিনে আনলুম। তিরিশ টাকা পড়ল, এক টাকা মুটে। এবার জল জমাব।
জলের ক্রাইসিস কি ঘন ঘন হয় যে চাল বা কেরোসিনের মতো জমিয়ে রাখবে।
যদি দু-বছর, চার বছর, দশ বছর পরও হয় তবুও… রাগটা যন্ত্রণার চাপে পূর্ণিমার গলায় আটকে গেল। বিশ্বনাথ ওর চোখের দিকে তাকিয়ে ভয় পেয়ে মুখ ফিরিয়ে নিল।
পূর্ণিমা প্রতিদিন এক বালতি করে জল দুটি জালায় ঢালতে লাগল। সকালের প্রথম বালতির এবং বিকালের প্রথম বালতির জল। এজন্য সংসারে ব্যবহারের জন্য জলের পরিমাণ তাকে কমাতে হল। চায়ের জন্য বাসু একদিন দু-বাটি জল জালা থেকে নেওয়ায় চড় খেল। দিনে তিন চার বার সে সরা তুলে দেখে কতটা ভরল।
একদিন জালা দুটি ভরে গেল। পূর্ণিমা দুটি ছোটো ছোটো জালা কিনে বড়ো দুটির মুখের উপর বসিয়ে দিল।
এতে ক-দিন চলবে? একদিন বিশ্বনাথ জিজ্ঞাসা করল।
পূর্ণিমা মনে মনে হিসেব করে বলল, দু-সপ্তাহ চলবে শুধু খাওয়া আর রান্নার জন্য, তবে নির্ভর করছে কীভাবে খরচ করবে। বাসনমাজা, কাচাকাচি, ঘরমোছা চলবে না।
তোমার টার্গেট কত?
আমার টার্গেট নেই।
অবশেষে ছোটো জালা দুটোও ভরে গেল। রান্নাঘরে আর জায়গা নেই। দালানটা অরক্ষিত। শোবার ঘরে রাখা যায় কি না, পূর্ণিমা তাই নিয়ে কয়েক দিন চিন্তা করল। একদিন সে বিশ্বনাথের কাছে জানতে চাইল, বড়ো বড়ো ঘিয়ের টিন কোথায় পাওয়া যায়?
কেন জল রাখবে বলে? টিনে মরচে পড়ে তো ফুটো হয়ে যাবে।
ছাদে কয়েকটা ইট পড়েছিল। কয়েকটা আঁচলের আড়াল দিয়ে নামিয়ে এনে পূর্ণিমা শোবার খাটটাকে উঁচু করল। এরপর মাটির কলসি কিনে জল ভরে খাটের নীচে রাখতে লাগল।
শুধু জল আর জল রাখার পাত্র ছাড়া পূর্ণিমার আর কিছু কথা বলার নেই। বাড়ির বাইরে গেলে ছটফট করে ফেরার জন্য। তার ভয় জালা বা কলসি যদি কেউ ভেঙে ফেলে। খড়ি দিয়ে ওগুলোর গায়ে কেনার তারিখ লিখে রেখেছে। কোনটি থেকে প্রথম খরচ করবে, তারপর কোনটি, তারপর কোনটি, মনে মনে সে পাত্রগুলিকে সাজিয়ে ফেলেছে। কোন কাজের জন্য কোনটি থেকে জল খরচ করবে তাও সে ঠিক করে রেখেছে। দু-তিনটি পাত্রের তলা থেকে জল চুইয়েছিল। দোকান থেকে পুডিং এনে লাগিয়েছে। কী এক ঘোরের মধ্যে তার দিন এবং রাত কেটে যায় এই জল নিয়ে। এক-এক সময় সে বিড়বিড় করে হিসেব করে। বাসুকে বলে, চানটানের কথাই ওঠে না। হাতধােয়া আর কুলকুচোর জন্য এক বাটি তার মানে তিন জনের জন্য তিন বাটি, দু-বেলায় ছ-বাটি। বুবুনের কাঁথা প্রথম দু-তিন দিন রোদে শুকিয়ে নিতে হবে…গন্ধ হবে তো কী আর করা যাবে। বাজারের আনাজ ধােয়ার জন্য এক গামলা…হবে না রে?
এখন সে সকালে খবরের কাগজের জন্য অপেক্ষা করে। বিশ্বনাথের হাতে দেবার আগে খুঁটিয়ে দেখে, জল সরবরাহ বন্ধের খবরের জন্য।
বাড়ির সকলে জেনে গেছে তার জল-জমানোর ব্যাপারটা। উপরের মাসিমা একদিন এসে তার জলভান্ডার দেখে গেল।
তাকগুলো খালি কেন? বোতলে ভরে ভরে রেখে দাও। ঠাট্টা করেই কথাগুলো বলা, কিন্তু পূর্ণিমার কানে সেটা বিচক্ষণ পরামর্শ মনে হল। শিশি-বোতলওলার দোকান থেকে সে দশটি বোতল কিনে জল ভরে তাকে রাখল।
সুপ্রিয়া মাঝে মাঝে উঁকি দিয়ে যায়। একদিন বলল, তুমি তো বাপু ছোটোখাটো টালার ট্যাঙ্ক করে ফেলেছ। এবার জল বন্ধ হলে তোমার কাছেই হাত পাতব, দেবে তো? অবশ্য পয়সা দিয়েই নোব।।
পয়সা শব্দটা পূর্ণিমার মাথায় ভারী হাতুড়ির মতো পড়ল এবং অবশ করে দিল। সারা দিন সে কথা বলল না, থালায় ভাত ফেলে রেখে উঠে পড়ল। অকারণে বার বার তার কান্না পেল।
আশপাশের বাড়িতেও জেনে গেছে। কিছুদিন হাসাহাসি করে তারা ভুলে গেল। প্রতিদিনই কল থেকে জল বেরিয়ে আসছে, পূর্ণিমা তাই দেখে দেখে এখন বিরক্ত। বিশ্বনাথকে বলল, জল কি আর বন্ধ হবে না?
তোমার তাই নিয়ে ভাবনা করার কী? তিন-চার মাসের তো স্টক হয়েই গেছে।
স্তিমিত ক্লান্ত কণ্ঠে সে বলল, কাজে না লাগলে জমানোর কোনো মানেই হয় না।
এই কথার দু-দিন পরেই ভোরে কাগজ দেখতে দেখতে পূর্ণিমা চিৎকার করে উঠল, হয়েছে হয়েছে, ওগো, শুনছ, ওরে বাসু…সোমবার সকালে জল আসবে না।
কাগজ হাতে সে ছুটে উঠোনে এল। সুপ্রিয়া কলে মুখ ধুচ্ছে। পূর্ণিমা চেঁচিয়ে প্রায় সারা বাড়িকে শুনিয়ে বলল, সোমবার সকালে জল আসবে না গো।।
অদ্ভুত এক সুখ পূর্ণিমাকে গ্রাস করেছে। তিন দিন পর সোমবার। তিনটে দিন সে তীব্রভাবে অপেক্ষা করল। তার ঘর ভরে আছে জলে, সে নিজেও ভরে যাচ্ছে কানায় কানায়। এতদিন ধরে ধিকিধিকি যে দুঃখ তাকে পোড়াচ্ছে এইবার তা নিভবে। উদাসীন চোখে সে দেখল অন্যান্যদের ব্যস্ততা, ক্ষোভ, উৎকণ্ঠা, ভাবনা। অলসভাবে সংসারের কাজ করে গেল এবং মাঝে মাঝেই উজ্জ্বল হয়ে মৃদু হাসিতে তার মুখ ভরে যাচ্ছিল। বহুদিন ধরে সে অপেক্ষা করেছে এই দিনটির জন্য।
জল তুলে রাখবে না বউদি?
দরকার নেই।
সোমবার সকাল থেকে কলকাতায় কলের জল নেই। বড়ো জালা থেকে পূর্ণিমা সংসারের জন্য জল ব্যবহার শুরু করল। স্নান বন্ধ, কলাপাতায় খাওয়া। বাসু চাপাকলের জলও আনল। অস্বাচ্ছন্দ্য রয়েছে কিন্তু যেন বিরাট নিরুদবিগ্নতাকে আরও উপভোগ্য করার জন্য। বার বার সে জলের পাত্রগুলোর গায়ে হাত বোলাল, বার বার তাকিয়ে দেখল। এইবার সে তৈরি হয়ে রয়েছে।
দুপুর থেকে সে উৎকণ্ঠার সঙ্গে তাকিয়ে রইল কলের দিকে। জল আসার সময় পেরিয়ে যেতে সে সুখবোধ করল। জল আসেনি। যেন তার মুখ চেয়েই মসৃণভাবে প্রহর গড়িয়ে চলেছে।
এক বেলার জন্য বলেছিল, কথার কোনো দাম নেই গো, কত বেলা যে লেগে যাবে জল আসতে তার কি ঠিক আছে?
সুপ্রিয়া সন্ধ্যায় সময় সদরে ধুনো দিতে এসে বিমর্ষ কণ্ঠে পূর্ণিমাকে বলল, তোমার আর কী, ঘরে টালার ট্যাঙ্ক নিয়ে দিব্যি তো কাটিয়ে যাবে।
রাত্রে সে বিশ্বনাথকে বলল, তোমার কী মনে হয়, এবার কত দিন চলবে?
বিশ্বনাথ দু-চার দিনের বেশি নয় বলায় পূর্ণিমা ক্ষুব্ধ হল। পাশ ফিরতে ফিরতে সে শুধু বলল, দেখা যাক।
মঙ্গলবার সকালে ঘুম ভাঙার পর আধা জাগরণ, আধা অচেতন অবস্থায় পূর্ণিমা ক্ষীণভাবে একটানা একটা শব্দ শুনতে পেল। শব্দটা বেড়ে উঠতে উঠতে তার মাথার মধ্যে ঝম ঝম কড়া নাড়ার মতো আওয়াজ করে উঠল। ধড়মড়িয়ে সে উঠে বসল।
কলে জল এসে গেছে।
বাব্বাঃ বাঁচালে…ধরেই রেখেছিলুম এবারও ভোগাবে!
তবু কিছুটা কথা রেখেছে…ওরে নিমাই বালতিটা নিয়ে এবার নাম বাবা।
পূর্ণিমা পাথরের মতো বিছানায় বসে রইল। ঘরের বাইরের পৃথিবীটা প্রতিদিনের মতো স্বাভাবিকভাবেই শুরু হয়ে গেছে, কিন্তু তার নিজের জগৎ চুরমার হয়ে ভেঙে ভেঙে পড়েছে।
ঘরের দরজা খুলে সে বাইরে এল। ভরা বালতি হাতে নিমাই দোতলার সিঁড়ির দিকে এগোচ্ছে, সুপ্রিয়া উবু হয়ে উনুন সাজাচ্ছে, কলে বালতি পেতে মিনু ঘাড় হেঁটে করে দাঁড়িয়ে, দোতলা থেকে বাড়িওয়ালার জিবছোলার শব্দ আসছে। পূর্ণিমার মনে হল তার অভ্যস্ত এই দৃশ্য থেকে সে ছিটকে বেরিয়ে গেছে। এখন যেন সে ছেড়া ব্লাউজের উপর শার্ট আর শায়া পরে সারা মুখে মাটিলেপা অবস্থায় অনুভবহীন শূন্যতার মধ্যে। এইভাবেই কি তাকে দিনযাপন করতে হবে?
পূর্ণিমা দ্রুত সরে এল। ওরা তাকে দেখতে পায়নি। রান্নাঘরে ঢুকে সন্তর্পণে দরজা বন্ধ করে খিল তুলে দিল। বাটনবাটার নোড়া দিয়ে ঠুকে ঠুকে জালার তলায় ঘা দিতেই ফুটো থেকে ছিটকে জল বেরিয়ে তার পা ভিজিয়ে দিল।
ঘরের নর্দমার মুখে জলের ঘূর্ণি আর বক বক শব্দটা তাকে অসম্ভব অবাক করে দিল।
খুব সুন্দর শিক্ষণীয় একটা গল্প
sience এর মৌলিক গ্রন্থ যেমন origin of specices ইত্যাদির মত বই দিলে ভালো হয়