ফুলদানি

ফুলদানি

শৈলেনের একবার কিছুদিনের জন্য ইচ্ছে হয়েছিল ডায়রি লেখার। সে প্রথম লাইনটা লেখার জন্য তিন রাত ভেবে একদিন সকালে লিখল— আমার নাম শৈলেন্দ্রনাথ বারিক, আমি ছাব্বিশ বছর যাবৎ প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা করছি।

লেখার পর তার মনে হল, বড্ড সাদামাটা লাগছে। খুব পন্ডিত লোকেরা এইভাবে সাদামাটা লিখে বা কথা বলে নিজেদের জাহির করে। সুতরাং, ভাষায় আড়ম্বর থাকা উচিত। আড়ম্বরপূর্ণ শব্দ খুঁজতে হলে তাকে অভিধানের পাতা ওলটাতে হবে। অবশ্য অভিধান একটা রয়েছে কিন্তু বার বার পাতা উলটে একই শব্দ বার বার ব্যবহার করলে সেটা বোকামিই হবে।

শৈলেন সেদিন খাতাটা বন্ধ করে রাখে। পরদিন সে লিখল—আমার বিবাহ হয় ছাব্বিশ বছর আগে।

তার কাছে এই লাইনটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কেননা ছাব্বিশ বছর আগেই সে উলটোডাঙা রেলওয়ে স্টেশনের কাছে ভগবতী ইনস্টিটিউশন—যাকে পাড়ার লোকেরা ভগবতী পাঠশালা বলে, সেখানে চাকরি পায়। তার আগে সে স্কুল ফাইনাল ফেল করার পর দপ্তরির কারখানায় ছাপা ফর্মা ভাঁজ করার কাজে ঢুকেছিল। বছর দুই পর সেখান থেকে ছেড়ে সে আসে স্কুল বইয়ের এক প্রকাশকের দোকানে। কাউন্টারে বসে বই বিক্রি করার চাকরি। এখানে থাকাকালেই সে প্রাইভেটে স্কুল ফাইনাল আর পি ইউ পরীক্ষা পাস করে। দোকানের মালিক তাকে খুবই সাহায্য করেছিল পড়ার ব্যাপারে।

এই দোকানেই তার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল ভগবতী পাঠশালার মালিক এবং হেডস্যার রবীনবাবুর। কথায় কথায় যখন তিনি জানলেন শৈলেন শুধু তাঁর জেলারই নয় একই মহকুমার ছেলে, তারপর তিনি বিশেষ স্নেহভরে তার সঙ্গে কথা বলতেন। রবীনবাবুর একটা প্রাইমারি বাংলা বই ছাপার কাজ চলছিল। ছাপাখানা থেকে খুব জরুরি তাড়া দেওয়ায় শৈলেনকে একদিন দুপুরে প্রুফ নিয়ে পাঠশালায় রবীনবাবুর কাছে যেতে হয়েছিল। যখন তিনি প্রুফ দেখছিলেন শৈলেন তখন খেলাচ্ছলেই হোক, কৌতূহলেই হোক বা সময় কাটাবার জন্যই হোক চারটি ক্লাসের প্রায় পঁচিশটি ছেলে-মেয়েকে পড়ানোর ভার নিয়েছিল। পড়ানো বললে ভুল হবে, সামলানোই বলা উচিত।

প্রুফের বাণ্ডিল শৈলেনের হাতে দেওয়ার সময় রবীনবাবু বলেছিলেন, এখানে বাপ মায়েদের খুব ইচ্ছে বাচ্চাদের লেখাপড়া করাবার, তবে খুবই গরিব, কাছাকাছি প্রাইমারি স্কুলও নেই। ভাবছি আর একটা ঘর নেব। দেখলুম ভালোই তো পড়ালে, পড়াবে? আরে দোকানের কর্মচারী থাকার চেয়ে মাস্টারিতে সম্মান আছে।

এ হল ছাব্বিশ বছর আগের কথা। শুধুমাত্র সম্মানের লোভেই সে পঁচিশ টাকা কম বেতনে মাস্টার হয়। তখন সে থাকত শ্যামপুকুরে বাবা-মা-ভাই-বোনদের সঙ্গে। পঁচিশ টাকা তখন অনেক টাকা। পরিবারের সবাই, এমনকী পাশাপাশি ঘরের লোকেরাও বলল, এতগুলো টাকা! কাজটা বোকার মতো হল।

কয়েক দিন মাস্টারি করার পর সে বেবিকে তার কর্মস্থল দেখাতে নিয়ে গেছল। বেবির পোশাকি নাম শুভ্রা। বয়সে তার থেকে এক বছরের ছোটো। যোগ-বিয়োগ পর্যন্ত কষতে পারে, গুণ-ভাগ পারে না। সিনেমার ম্যাগাজিন কোনোক্রমে পড়তে পারে, খবরের কাগজ পারে না। বেবি ক্লাস ফাইভেই লেখাপড়া ছেড়ে দেয়। ওর মা হাসপাতালে আরার কাজ করত, তাকেও ওই কাজে ঢোকাবার চেষ্টা করছিল।

বেবির চোখ মুখের ভাব বদলে গেল চেয়ারে বসে শৈলেনকে পড়াতে দেখে। ছেলে মেয়েদের স্যার বলা, ব্ল্যাকবোর্ডে চকখড়ির খসখসে শব্দ, ধমক দেওয়া, বাইরে যাওয়ার জন্য ভয়ে ভয়ে অনুমতি চাওয়া, এসবের থেকেও মুগ্ধ করে এতাবৎকাল তার কাছে অনাবিষ্কৃত শৈলেনের এই গাম্ভীর্য। তার মনে হয়েছিল মুখচোরা ছেলেটা এখন ভারিক্কি একটা লোক হয়ে গেছে!

এসব অবশ্য বিয়ের পর প্রথম সাত দিনের মধ্যেই সে বেবির কাছ থেকে শুনেছিল। বেবি আরও দু-বার নতুন ঘরের পাঠশালায় এসে একধারে বসে তার পড়ানোে দেখেছে। দুখানা বাড়ির পরেই পুরোনো ঘরে রবীনবাবু উঁচু ক্লাসেরর ছেলে-মেয়েদের পড়াতেন। ওই ঘরেই থাকতেন, বেঁধে খেতেন, ছুটিতে গ্রামে যেতেন।

প্রথম যেদিন সে মাইনে পেল সেদিন সন্ধ্যায় সে হাতিবাগানের এক রেস্টুরেন্টে বেবিকে কবিরাজি কাটলেট খাইয়েছিল। খেতে খেতে বেবি বিয়ে করার কথাটা মনে করিয়ে দেয়। শীতলা প্রতিমার সামনে শৈলেন পুজোর ফুল হাতে নিয়ে যেকথা দিয়েছিল, বেবি সেটা তাকে ভুলে যেতে দেবার পাত্রীই নয়।

শৈলেন তখন স্বর্গের কাছাকাছি কোনো একটা জায়গায়। মাথা কাত করে জানিয়ে দিয়েছিল, কথা রাখবে। টিপ টিপ বৃষ্টিটা ঝমঝমিয়ে নামল যখন তারা রেস্টুরেন্ট থেকে বেরোয়। দৌড়ে বারান্দার নীচে গিয়ে ভিড় ঘেঁষে তারা দাঁড়ায়। বৃষ্টি এবং ভিড় দুটোই যখন বাড়ল, জলের ছাট যখন লোকেদের পিছিয়ে এনে ভিড়টাকে জমাট করে দিল। তখন বেবির পাছা তার দুই ঊরুতে চেপে রয়েছে।

একটা নতুন ধরনের আমেজ এবং শিহরন শৈলেন বোধ করেছিল, তার একটা হাত ধরে বেবি আঙুলে আঙুল জড়িয়ে রাখে। বাঙালি মেয়ের শরীর সাধারণত যেমন হয় বেবি তার থেকে একটু পুষ্ট, দেহে সামঞ্জস্য আছে এবং মুখখানি মোটামুটি সুন্দর। তার হাতটাকে বেবি বুকের কাছে তুলে এনে চেপে ধরেছিল। বেবি শোভনতার ধার বিশেষ ধারত না। বেপরোয়া আচরণ ও তাৎক্ষণিক আবেগ সামলাবার মতো শিক্ষাদীক্ষা তার নেই।

বৃষ্টি ধরে যাবার পর প্রায় নির্জন রাস্তা ধরে হাঁটার সময় বেবি বলেছিল, দেরি কোরো না। তোমরা নীচু জাত, মা আপত্তি করবেই আর তোমার বাপ-মাও আমাকে বউ করে ঘরে তুলবে না। তাতে বয়েই গেল, আমরা কালীঘাটে গিয়ে বিয়ে করে আসব।

শৈলেন আমতা আমতা করে বলেছিল, এই মাইনেতে কি আলাদা ঘর নিয়ে চালানো যাবে?

ও আমি চালিয়ে নোব। বেবি এই বলে ফুঁ দিয়ে সমস্যাটা উড়িয়ে দিয়েছিল। বাড়িতে ঢোকার সরু গলিটা অন্ধকার। শৈলেন আচমকা একটা দুর্দান্ত চুমু পেয়েছিল বেবির কাছ থেকে।

বেবির আন্দাজে মোটেই ভুল ছিল না। দুই পরিবার থেকে প্রবল আপত্তি ওঠায় তারা কালীঘাটেই বিয়ে করে এবং দু-দিন পর ভগবতী পাঠশালার কাছাকাছি মুরারিপুকুর বস্তির একটা ঘরে এসে ওঠে।

শুরু থেকেই তাদের যৌথ জীবনে বেবি একদমই সুখী হয়নি। শৈলেনও নয়, কারণ বিয়ের কিছুদিন পর থেকেই বেবি বলতে শুরু করে, তার মা আর বন্ধুরা নাকি পইপই বলেছে এই বিয়ে এক মাসও টিকবে না। শুনতে শুনতে শৈলেন ব্যাজার হয়ে উঠত বটে কিন্তু প্রকৃতিতে সে ঠাণ্ডা, কোনো কিছুতেই চঞ্চল হয়ে পড়ে না। বিয়েটাকে সে শ্যামপুকুর থেকে মুরারিপুকুর ঘর বদলের ব্যাপার হিসেবে ধরে নেয়।

মাসের শেষে সে মাইনের টাকা বেবির হাতে তুলে দিত। তাই থেকে তিরিশটা সিগারেটের দাম বাবদ দশটা টাকা সে পেত, রাতে শোবার আগে একটি করে সিগারেট খাওয়ার জন্য। মাইনের টাকা যথেষ্ট নয়, তাই সে সকালে ও রাত্রে দুটি টিউশনি নেয় ফলে নব্বই টাকা আয় বাড়ে।

কিন্তু তাদের বিয়ে এক মাসের বেশিই টিকেছিল। পুরো পাঁচ বছর। বেবি তাকে ছেড়ে যখন চলে যায় তখন শৈলেনের বয়স উনত্রিশ, বেবির আটাশ। ঝগড়াঝাঁটি প্রায়ই হত। তার আয়ের স্বল্পতা, উচ্চাকাঙ্ক্ষার ভীরুতা ইত্যাদি নিয়ে বেবি কুশ্রী ভাষায় আক্রমণ করত, হাতের কাছে যা পেত ছুড়ে মারত। তাদের জীবন ক্রমশ দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল। শৈলেনের তখন মনে হত, যেদিন থেকে পরস্পরের দিকে তারা চোখ ফেলেছে সেই দিন থেকেই ঝগড়া ছাড়া আর কিছু যেন তারা করেনি। চিরজীবন ধরে তারা শুধু যন্ত্রণাই ভোগ করে আসছে, এর আর বিরাম নেই। যতদিন তারা একসঙ্গে থাকবে ততদিন এইভাবেই চলবে। কিন্তু একুশ বছর পর এখন শৈলেনের মনে হচ্ছে—মাঝে মাঝে তখনও অবশ্য মনে হত, তাদের তখনকার জীবনের অনেকটা সময়ই টক ঝাল মিষ্টি স্বাদে ভরা ছিল। বেবিকে তার মন্দ লাগত না।

বেবির গৃহত্যাগের আগেই শৈলেনের মনে এই ধারণাটি তৈরি হয়ে গেছল, স্বামী এবং স্ত্রী হিসেবে তাদের জন্য বরাদ্দ সময়সীমা এবার বোধ হয় তারা অতিক্রম করতে চলেছে। দাম্পত্য জীবনের সবথেকে বিশ্রী ঝগড়াটি একদিন তাদের মধ্যে ঘটে যেতেই সে বুঝেছিল ভাঙন আসবে।

একদিন রাতের খাওয়া সেরে সিগারেট শেষ করে শৈলেন বিছানায় চিত হয়ে একটা উপন্যাস পড়ছিল। চমৎকার জমাটি গল্প, কুঁদ হয়ে গেছল বইয়ের মধ্যে। বেবি দরজার কাছে মোড়ায় বসে উল বুনছিল। নিজের জন্য কার্ডিগান। হঠাৎ সে বলল, আজকাল তুমি যেন কেমন হয়ে গেছ, আমার দিকে আর তাকাই না।

শৈলেন কথাটা শুনতে পেল না। উপন্যাসে মগ্ন হয়ে থাকলে শোনা সম্ভব নয়, বিশেষত কথাগুলো খুব মৃদুস্বরে বললে। কিছুক্ষণ পরে বেবি অধৈর্য স্বরে বলল, কথা কানে গেল

হাসিমাখা মুখটা বই থেকে তুলে এক বার বেবির দিকে তাকিয়েই শৈলেন আবার পড়ায় ডুবে গেল।

এত পড়লে চোখ খারাপ হয়ে যায়। বেবি কথাটা বলল, শৈলেনের বই পড়া বন্ধ করার জন্য।

খারাপ হয় না। শৈলেন বই থেকে চোখ না তুলেই বলল।

বাবা বলত শুধু গবেটরাই বই পড়ে, ওদেরই তো শিক্ষাদীক্ষার দরকার হয়।

কথাটা শৈলেনের কানে বাজল, মাথাটা ঝাঁঝাঁ করে উঠল। বইয়ে চোখ রেখেই গম্ভীর স্বরে বলল, তোমার বাবা কথাটা বলেছেন যেহেতু তিনি লেখাপড়া কখনো করেননি, তাই যারা লেখাপড়া করে তাদের হিংসে করতেন।

তোমাদের মতো বিদ্যের গোবরপোরা মাথাওলাদের হিংসে করার কোনো দরকার হয় না। বেবি চিবিয়ে কথাটা এমনভাবে বলল যাতে শৈলেনের বুঝতে অসুবিধা না হয় কার উদ্দেশে কথাগুলো বলা। শৈলেন টের পাচ্ছে, ঝড় এল বলে।

তুমিও তো বই পড়তে পার, পড় না কেন? শৈলেন বলল বটে কিন্তু জানে বেবির কাছে। বই বিষবৎ পরিত্যাজ্য বস্তু।

আমার তো ভীমরতি ধরেনি, কাজ করতে হয় আমাকে। মুখ বেঁকিয়ে ঘৃণা ঝরিয়ে সে বলল।

এবার শৈলেন ঝাঁঝিয়ে উঠল তবে গলা নামিয়ে, কেননা বেবিকে খেপিয়ে তুলে বই পড়াটা সে মাটি করতে চায় না। এখন এসব কথা থাক, বলার একটা সময় আছে। বইটা আমায় পড়তে দাও, ক্লান্ত লাগছে।

ক্লান্ত? তুমি তো সবসময়ই ক্লান্ত। বেবি বেশ জোরেই হেসে উঠল। পাঠশালার পন্ডিত তার আবার ক্লান্তি। বসে বসে বাচ্চাদের অ আ না-শিখিয়ে, একটু খাটাখাটনি করে দুটো পয়সা আনার চেষ্টা করো-না যাতে বাসনমাজার একটা লোক অন্তত রাখা যায়।

শৈলেন কথা না বাড়াবার জন্য চুপ করে রইল। তাইতে বেবির মাথায় রক্ত চড়ে গেল। হাত থেকে বইটা ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে সে বলল, খালি বই বই আর বই, গাধারও অধম। বইটা দরজা দিয়ে সে উঠোনে ছুড়ে ফেলল।

ধড়মড়িয়ে উঠে বসে শৈলেন একটা চড় কষাল বেবির গালে। পড়তে তার খুবই ভালো লাগছিল তো বটেই, তা ছাড়া ওটা লাইব্রেরির বই। নষ্ট হলে, ছিঁড়ে গেলে ফাইন দিতে হবে, তেমন হলে হয়তো পুরো দামটাই।

বেবি গালে হাত দিয়ে অদ্ভুত চোখে শৈলেনের দিকে তাকিয়েছিল জ্বালাভরা চোখে চোখে জল টেনে আনেনি কারণ সেটা তার প্রকৃতিতে নেই। শৈলেনের তখনই মনে হয়েছিল তাদের দাম্পত্য সম্পর্ক আর টিকবে না। এটা ভেবে সে দুঃখ বোধ করেনি, বুকও ভেঙে যায়নি। বরং ভগবানকে ধন্যবাদ দেয় তাদের ছেলেপুলে না হওয়ার জন্য। একবার বেবি গর্ভবতী হয়েছিল বটে কিন্তু বাচ্চা পেটেই নষ্ট হয়ে যায়। বাচ্চা হলে কে জানে, সংসারটা হয়তো একটু সহনীয় হত।

বইটা উঠোনে ছুড়ে ফেলার এক মাস পর বেবি ঘর ছেড়েছিল। প্রায় দুপুরেই সে শ্যামপুকুরে মা-র কাছে চলে যেত। সেখানেই আলাপ এবং ভাব হয় যাত্রার এক ছোটোখাটো অভিনেতার সঙ্গে। যাত্রায় সুযোগ করে দেবে এই আশায় বেবি লোকটির সঙ্গে পালায়।

একদিন পাঠশালা থেকে ফিরে শৈলেন একটা চিরকুট বিছানার ওপর পেয়েছিল। পাঠশালার পড়য়াদের মতো হাতের লেখায় আমি চিরকালের মতো চলে যাইতেছি আর ফিরিব না কথা ক-টি তাতে লেখা। শৈলেন স্তম্ভিত হওয়ার মধ্যেই হাঁফ ছেড়েছিল। চিৎকার চেঁচামেচি হল না, জিনিসপত্তর ভাঙা বা ছোড়াও হল না। কেমন দিব্যিই সে শান্তিতে একা হয়ে গেল। কাগজটার ওপর চোখের জলের দাগ নেই। মাত্র আটটি শব্দ ছেঁড়া হ্যাণ্ডবিলের উলটোদিকে পেন্সিলে লেখা। কাগজটা ভাঁজ করে সে ঘরের তাকে রাখা অভিধানের পাতার মধ্যে রেখে দিয়েছিল। কেন যে রেখেছিল তা সে জানে না। একুশ বছর পরও সেটা ওখানে রয়েছে।

যাত্রার সেই অভিনেতার সঙ্গে বেবি শ্যামপুকুরেই একটা গলিতে বসবাস শুরু করে। লোকটি মদ খেত এবং প্রায় রাতেই বেবিকে ঠ্যাঙাত। পাড়াপ্রতিবেশীররা অতিষ্ঠ হয়ে থানায় নালিশ জানায়। অবশেষে একদিন তারা কোথায় যেন চলে যায়। এসব কথা শৈলেন শুনেছিল তার ছোটোবোনের কাছে। বাড়ির লোকেরা ভেবেছিল দাম্পত্য সম্পর্ক ফিরে পাবার জন্য, অর্থাৎ পৌরুষের মর্যাদা রাখার জন্য শৈলেন মামলা ঠুকবে বেবির নামে। কিন্তু সে অমন কোনো চিন্তাকে বিন্দুমাত্র প্রশ্রয় দেয়নি।

শৈলেনের জীবনের যে-ছকটা বিবাহিত জীবনে গড়ে উঠেছিল সেটা অবশ্যই নাড়া খেয়েছিল এই ঘটনায়। পাঁচ বছর একই ঘরে একটি মেয়ের সঙ্গে বসবাস করার পর তার অভাব তো তারা পেয়েছে। বেবির হঠাৎ চলে যাওয়ার পর ঘরের দেওয়াল, সিলিং, টেবিল, বিছানা সব কিছুই শৈলেনের চোখে অন্যরকম ঠেকেছিল। তার নিজের ভিতরটাও কেমন যেন পালটে গিয়েছিল। তখন সে মনে মনে বার বার নিজেকে বলল, বেবি চলে গেছে তো কী হয়েছে, সব একইরকম আছে, কিছু বদলায়নি। প্রথম প্রথম ঘরে ফিরে সময় কাটাতে তার খুবই অসুবিধা হত। নিজেকে টানতে টানতে একাকী দিন কাটানোটা তাকে শিখতে হয়েছে। মাসের পর মাস, বছরের পর বছর সকাল আর সন্ধ্যা তার জীবনে এল আর চলে গেল। নিঃসঙ্গতা আর বিষণ্ণতাকে সঙ্গী করে নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই সে সুখী বোধ করতে থাকে। পৃথিবী থেমে নেই, শৈলেনের মনে হয় সেও চলেছে এর সঙ্গে।

কয়েক বছর পর রবীনবাবু একবার দেশে গিয়ে অসুস্থ হলেন। চিঠি এল, স্ট্রোক হয়ে শরীরের একটা দিক পড়ে গেছে। চার মাস পর চিঠি এল তিনি মারা গেছেন। ভগবতী ইনস্টিটিউশন চালাবার ভার শৈলেন নিল। দিন তার ভালোই কেটে গেছে। হোটেলের সঙ্গে ব্যবস্থা করে ঘরেই খাবার এসে যায়। কেরোসিন স্টোভে খাবার গরম করে নেয়, চা বা জলখাবার করে। ট্রানজিস্টর রেডিয়ো শোনে, বই পড়ে। টিউশনি বহুদিন আগেই ছেড়ে দিয়েছে। নিঃসঙ্গ বোধ করলেও শান্তিতেই সে দিন কাটাচ্ছে। দুপুরে স্কুলে-পাওয়া বহু মুখ বহু কথা তাকে রাত পর্যন্ত সঙ্গ দেয়। শৈলেন নিজের মতো করে সুখীজীবন তৈরি করে নিয়েছে।

এইভাবেই বারোটা বছর কেটে গেছে। বেবি সম্পর্কে শৈলেন এইটুকু মাত্র জানতে পেরেছে, সেই যাত্রার অভিনেতা শ্রীরামপুরে লন্ড্রির দোকান এবং বিয়ে করে ছেলেপুলে নিয়ে সংসারী। বেবি এন্টালিতে বাস করছে হোটেলের এক বেয়ারার সঙ্গে। একদিন সন্ধ্যা বেলায় বেবি দেখা করতে এল তার সঙ্গে।

শৈলেন তখন রাস্তার পানের দোকান থেকে প্রতিদিনের মতো রাতের জন্য সিগারেট কিনছিল। পর পর দু-দিন এই সময় লোডশেডিং হওয়ায় দোকানি মোমবাতি আর দেশলাই নিয়ে তৈরি হচ্ছে। উনুন ধরানোর ধোঁয়া বস্তির উপর মেঘের মতো বিছিয়ে রয়েছে। রাস্তায় বাচ্চাদের হুটোপুটি এখনও অব্যাহত। শৈলেন সিগারেট নিয়ে দূরে বাসরাস্তার দিকে তাকিয়েই ওকে দেখল এবং মুহূর্তেই চিনতে পারল।

বারোটা বছরে মানুষ এমন-কিছু বদলায় না যে তাকে দেখে চেনা যাবে না। কিন্তু নিশ্চিতভাবে বারো বছর পর চেনার জন্য অন্তত দ্বিতীয় বার তাকাতে হবে। দ্বিতীয় বার তাকিয়ে শৈলেন অল্প ধাক্কা খেল। বেবির হাটার ভঙ্গিতে আগের ঔদ্ধত্য যেন আর নেই। এখন অনেক মন্থর, যেন বারো বছর ধরে তার স্বাভাবিক মোরগের মতো চলন নিয়ে হাঁটতে গিয়ে অবিরাম সে দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে গেছে। অনেক মোটা হয়েছে। ফুল লতাপাতার ছাপ-দেওয়া গোলাপি আর বেগুনি রঙের কমদামি সিন্থেটিক শাড়ি ওর পরনে। চুল এলোমেলো, ঘাড় পর্যন্ত ছাঁটা।

ওকে দেখে শৈলেন খুশি বা অখুশি কিছুই হল না, তবে বুকের মধ্যে এক বার ছ্যাঁত করে উঠেছিল আর অবাক তো হলই। বেবিকে সে ভুলেই গেছল। দিনগুলো যতই ওর সঙ্গে দূরত্ব বাড়িয়েছে ততই তাদের বিবাহিত জীবন কুঁকড়ে একটা বছরে, একটা মাসে, একটা দিনে, একটা ফুলকিতে পরিণত হয়েছে। নিঃসঙ্গ জীবনে অভ্যস্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বেবি তার স্মৃতির বাইরে চলে গেছে।

যদিও বেবির হাঁটার ধরন বদলে গেছে তবু শৈলেন আশা করল হয়তো বলবে : এত তাড়াতাড়ি ফিরে আসব এখানে হয়তো ভাবনি, তাই না?

বেবি সামনে এসে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কেমন আছ, বলেই বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করল। শৈলেন ওর পিছু নিল। বাড়ির দরজায় এসে বেবি থমকে গিয়ে বলল, অনেক দিন পর।

হ্যাঁ, অনেক দিন পর। শৈলেন ঘরের দরজা খোলার সময় কোনোক্রমে একই কথা বলল তবে বেবির মতো স্বাচ্ছন্দ্যে নয়। আঁচলটা পিঠের উপর টেনে দিয়ে বেবি এমন ভঙ্গিতে ঢুকল যেন ঢোকা নয়, ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে।

তারপর, চলছে কেমন? শৈলেন চেয়ারের পিঠটা ধরে জিজ্জাসা করল। ওর হঠাৎ আবির্ভাবে খানিকটা নাড়া যে সে খেয়েছেই সেটা বোঝা গেল রাতের সিগারেটটা ঠোঁটে লাগিয়ে দেশলাই খোঁজার মধ্য দিয়ে।

ভালোই চলছে। বেবি পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে না। দিনে কটা সিগারেট খাও এখন?

শৈলেন তাড়াতাড়ি সিগারেটটা ঠোঁট থেকে তুলে নিল। একটাই, রাতে। অভ্যেসটা রেখেছি।

একা নিজের দেখাশোনা ভালোই পার দেখছি।

না পেরে উপায় কী। শৈলেনের গলার বিদ্রুপ নেই। সে লক্ষ করল বেবির ঠোঁটে লিপস্টিক, যা আগে কখনো দেখেনি। ঘামে-ভেজা পাউডার গলার ভাঁজে। বেবিকে বয়স্কা মনে হচ্ছে অন্যরকমভাবে। এর বদলে মুখে কিছুই না মাখলেই বরং শৈলেনের মনে হল ওকে কমবয়সি দেখাত। বারো বছর আগে ও যা ছিল সেটা আড়ালে রাখার জন্য যেন হালকা ছদ্মবেশ মুখে পড়েছে।

চেয়ারটা এগিয়ে দিয়ে শৈলেন বলল, বসো, জিরোও।

চেয়ারে বসে মুখ তুলে বেবি সামনের দেওয়ালের কুলঙ্গিটার দিকে চেয়ে রইল। শৈলেন। মাথা ঘুরিয়ে তাকাল। তারা এখানে আসার পর রবীনবাবু চিনেমাটির একটি ফুলদানি উপহার দিয়েছিলেন। সাদা জমিতে সবুজ লতাপাতা, সোনালি বর্ডার আর লাল ফুল। গলার কাছটা কলসির মতো সরু। রজনিগন্ধার এক হাত লম্বা ছড় ওতে ভালোমতোই রাখা যায়। প্রথম প্রথম শৈলেন রাখত। বেবিও ফুল কিনে আনত। একদিন তপ্ত কথাকাটাকাটির চূড়ান্ত পর্যায়ে বেবি ফুলদানিটা তাকে লক্ষ করে ছুড়েছিল। শৈলেন হাত দিয়ে আটকায় কিন্তু মেঝেয় পড়ে সেটির তলার কানা ভেঙে যায়, মাঝখানের অংশ থেকে খানিকটা চকলা খসে পড়ে। তা ছাড়া পলকাটা গলা থেকে একটা পলও ভাঙে। ফুলদানিটা বেবির খুব পছন্দের ছিল। ফুল না থাকলে সাবান জলে ধুয়ে সে টেবিলে রেখে দিত ঘরে শোভা আনার জন্য। দুজনের সম্পর্কটা যখন ভালো থাকত তখন শৈলেন বলত, খালি ফুলদানিতে ভূত এসে বাসা বাঁধে।

এখন করছ কী? চলছে কেমন?

ভালোই আছি।

বেবি আগের মতো আর অনর্গল কথা বলছে না। শৈলেন এটার সঙ্গে আরও লক্ষ করল কথার মধ্যে আগের মতো কামড় নেই, স্বরটা চাপা আর সাদামাটা। এর কারণ হিসেবে

শৈলেন ভাবল, হয়তো সেই পুরোনো ঘরে এত বছর পরও আবার তাকে দেখতে পাওয়ায়, যাবার সময় ঘরে সব কিছু যেমন ছিল ঠিক তেমনটিই রয়ে যাওয়ায় বেবি হয়তো আশ্চর্য বোধ করছে। ট্রানজিস্টরটাই শুধু তার কাছে নতুন।

কাজকম্ম কিছু করছ?

প্রশ্নটা এড়িয়ে যাবার জন্যই বোধ হয় না-শোনার ভান করে বেবি ফুলদানির দিকে তাকিয়ে রইল। ভাঙা টুকরোগুলো কুড়িয়ে শৈলেন ওর মধ্যেই রেখে দিয়েছিল। ফুলদানির আর দাঁড়াবার মতো অবস্থা ছিল না, কাগজ মুড়ে শোয়ানো ছিল কয়েক বছর। একদিন শৈলেন আঠা দিয়ে তলার টুকরোগুলো লাগিয়ে ফুলদানিটাকে দাঁড় করায়।

থাক কোথায় এখন?

বেবি মাথায় হাত বোলাল। শৈলেনের চোখে পড়ল দু-তিনটে রুপোলি চুল। এন্টালিতে থাকি।

ইতস্তত করে শৈলেন বলল, একা?

হ্যাঁ। কথাটা বলেই বেবি মাথা নামিয়ে মেঝের দিকে তাকাল। শৈলেনের মনে হল ওর জীবনীশক্তির অনেকটাই ক্ষয়ে বেরিয়ে গেছে। চাহনিতে আগেকার সেই মজাদার ঝকঝকানিটা স্তিমিত পান্ডুর লাগছে। চোখের চারধারে দাগ আর কালি জানিয়ে দিচ্ছে বয়স হয়েছে।

মাথাটা হঠাৎ ঝাঁকুনি দিয়ে তুলে বেবি বলল, তুমি সেই আগের মতোই ভ্যাদভ্যাদেই রয়ে গেছ।

তা রয়ে গেছি।

যদি না রইতে, গলায় কোনোরকম আবেগ না এনে বেবি বলল, তাহলে আমরা হয়তো…।

বড্ড দেরি হয়ে গেছে। হইচই, ঝগড়াঝাঁটি, আমার দ্বারা সম্ভব নয়। আমি শান্তিপ্রিয় মানুষ।

বেবি হেসে মাথাটা হেলাল, অনেক বই দেখছি।

সময় কাটাতে হবে তো।

কিছুক্ষণ কেউ আর কথা বলল না। রেডিয়োয় এই সময় খবর হয়। শৈলেন নিয়মিত তা শোনে। আজ সে রেডিয়ো খুলল না।

ফুলদানিটা আমার খুব পছন্দ।

ওটা চাই তোমার? নিতে পারো।

সত্যি সত্যি দেবে?

নিশ্চয়। আমার তো কোনো কাজে লাগে না এই ভূতের বাসাটাতে। তবে তলাটা আঠা দিয়ে জোড়া, আলতোভাবে বসিয়ে রাখতে হয়।

শৈলেন সন্তর্পণে ফুলদানিটা তুলে নিয়ে ফু দিয়ে ধুলো ঝাড়ল। আরও সবধানে ভিজে ন্যাকড়া দিয়ে মুছল। ঝকঝক করছে সবুজ, লাল, সোনালি, সাদা রং। খবরের কাগজে সেটা মুড়ে সুতো দিয়ে বাঁধল। এই নাও। শৈলেন টেবিলে রাখল ফুলদানিটা।

বেবি উঠে দাঁড়াল। এইবার যাই, পরে আর একদিন আসব।

নিশ্চয় আসবে। যখনই ইচ্ছে হবে…আমরা তো শত্রু নই।

কাগজে-মোড়া ফুলদানিটা তুলে বেবি সারা ঘরে এক বার চোখ বুলিয়ে আসি বলে বেরিয়ে গেল। তাকে এগিয়ে দেবার জন্য শৈলেন ঘর থেকে বেরোল না। অনেকক্ষণ পর, হিমালয়ভ্রমণ বিষয়ে বইটা পড়তে পড়তে মনে হল বেবিকে তো জিজ্ঞাসা করা হল না ছেলেপুলে হয়েছে কি না। তারপর মনে পড়ল, বেবি যখন বেরিয়ে যাচ্ছে তখন সে হেসেছিল, তার উত্তরে বেবি শুধু যান্ত্রিকভাবে ঠোঁট দুটো টেনে ধরে। আগের মতো ঠোঁটটেপা হাসির মতো কিছু-একটা পাবে, শৈলেনের সে-আসা পূর্ণ হয়নি।

কয়েক দিন পর এক সকালে শৈলেন লন্ড্রি থেকে কাপড় আনতে যায়। লন্ড্রির পাশে ভাঙা পুরোনো জিনিসের দোকান। কাচা ধুতি ও পাঞ্জাবি এবং খুচরো পয়সাগুলো নিয়ে ফেরার সময় সে পাশের দোকানটার দিকে এক বার তাকাল। একটা ভাঙা সেতার আর কাঠের টেবিল-ল্যাম্পের মাঝে দেখতে পেল সেই ফুলদানিটা, কয়েক দিন আগে যেটা সে বেবিকে দিয়েছিল। নিশ্চিত হবার জন্য সে এগিয়ে গিয়ে ঝুঁকে ফুলদানিটা দেখল। তার ভুল হয়নি, উপরের একটা পল ভাঙা, গায়ের চকলা ওঠা।

প্রায় এক মিনিট সে তাকিয়ে রইল। কী করে এটা এখানে এল তার বোধগম্য হচ্ছিল না। দোকানদারকে জিজ্ঞাসা করবে কি না ভেবেও সে তা করল না। নিশ্চয় বেবিই সেদিন ফেরার সময় এখানে বিক্রি করে দিয়ে গেছে। অভাবের তাড়না ছাড়া এমন কাজ করবেই-বা কেন। বেচারা বেবি! টাকার যদি দরকার তো চাইলেই পারত।

ফুলদানিটা হাতে নিয়ে শৈলেন দোকানদারের দিকে তাকাল। কত?

লোকটা তীক্ষ্ণ একটা চাউনিতে শৈলেনের মুখটা দেখে নিয়ে বলল, ছ-টাকা।

দরাদরি করলে কমানো যাবে কিন্তু শৈলেনের স্বভাবটা তেমন নয়। এক কথাতেই সে দাম চুকিয়ে ফুলদানিটা তুলে নিল।

কেন জানি শৈলেনের মনে হতে লাগল, বেবি আবার আসবে। এবং কয়েক দিন পর সত্যিই এল, সেই একই সময়ে, সেই একই শাড়ি পরে। ওর মুখ দেখেই তার মন হল বেবি প্রচন্ড ক্ষুধার্ত।

পাঊরুটি আর ডিমসেদ্ধ আছে, চলবে?

বেবি মাথা নামিয়ে কী যেন ভাবল। দাও। কিন্তু তোমার?

আমি এইমাত্র খেলাম। তবে আর এক কাপ চা খাব, তোমার সঙ্গে। শৈলেন যে মিথ্যা বলল বেবি সেটা নিশ্চয় বুঝতে পেরেছে। কিন্তু এই নিয়ে ঢং না করায় শৈলেন স্বস্তি পেল।

বেবির খাওয়ার সময় ওর মুখের দিকে তাকবে না ঠিক করেই সে পিছন ফিরে চা করতে বসল। কেউ সামনে বসে তাকিয়ে থাকলে খেয়ে তৃপ্তি হয় না। কুলুঙ্গিটা বেবির সামনেই। নিশ্চয় এতক্ষণে ফুলদানিটা নজরে পড়েছে। কিছু-একটা ও বলবে, বলতেই হবে।

একটিই মাত্র কাপ। সেটা বেবির সামনে টেবিলে রেখে শৈলেন কাচের গ্লাস হাতে বিছানায় বসে বেবির চোখের দিকে তাকাল। বেবির প্লেটে আর পাঁউরুটি নেই কিন্তু চিবিয়ে চলেছে। এক বার কুলুঙ্গির দিকে তাকাল। কোনো বিস্ময় চোখে ফুটল না ফুলদানিটাকে দেখে। শৈলেন তাতে একটু হতাশ হল।

একটু তাড়াতাড়িই যাব। একজনের সঙ্গে দেখা করতে হবে, কাজের ব্যাপারে। ফুলদানিটার সম্পর্কে একটা কথাও নয়।

কাজ চলছে কেমন?

কাজ নেই, ছাড়িয়ে দিয়েছে। ছেঁড়া ন্যাকড়া, কাপড়ের ছাঁট এইসব বাছাইয়ের কাজ, রোজ বারো টাকা। যেতে দেরি হয়েছিল বলে কাজে বসতে দেয়নি। দু-কথা শুনিয়ে দিয়েছি।

মাসে তিনশো টাকা। আজকের দিনে একটা লোক আধপেটা খেয়েও মাস চালাতে পারবে। শৈলেনের মনে হল, বেবি বোধ হয় আবার এখানে থাকতে চায়। যদি চায় তাহলে থাকতে পারে। ও যা মেয়ে তাতে সোজাসুজিই এটা জানাতে পারে। তবে শৈলেন যেচে

একথা বলবে না।

বেবি আবার ফুলদানিটার দিকে তাকাল। আমাকে দশটা টাকা ধার দিতে পার?

নিশ্চয়। বালিশের তলা থেকে দুটো পাঁচ টাকার নোট বার করে শৈলেন ওর হাতে দিল। বেবি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে কিছু বলল না।

সামনের হপ্তায় শোধ করে দেব। একটু ঘোরাঘুরি করলেই কাজ একটা পেয়ে যাব। বেবি উঠে দাঁড়াল।

একটা হাফ পাউণ্ড রুটি আছে, নিয়ে যাবে?

না। বেবি আবার ফুলদানিটার দিকে তাকাল। সুন্দর দেখতে তাই না? আমার খুব পছন্দের।

শৈলেন পুরোনো রসিকতাটাই করল, খালি ফুলদানিতে কিন্তু ভূতে বাসা বাঁধে।

সেইজন্যই এটাকে ভালো লাগে।

বেবি চলে গেল। এটাকে পুরোনো জিনিসের দোকানে বেচে দেওয়া নিয়ে একটা কথাও বলল না!

আট-দশ দিন অন্তরই বেবি আসতে শুরু করল, মাসের পর মাস, একই দিনে একই সময়ে। তারা এটা ওটা নিয়ে কথা বলত, বাংলা বনধ, বৃষ্টিতে রাস্তার অবস্থা, কাজকর্ম, ভগবতী পাঠশালা, ছিনতাই গুরুতর বিষয়ে কখনো নয়। কখনো চুপ করে দুজনে রেডিয়োর গান বা কথিকা শুনত। কেউই অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করত না। শৈলেন কখনো চা তৈরি করত কখনো করত না। এক বারের জন্য বেবি কিন্তু আসা বন্ধ করেনি। ঝড়, বৃষ্টি, লোডশেডিং, রাস্তায় কোমরজল, এমনকী সর্দি জ্বর অগ্রাহ্য করেও সে এসেছে। একটা আলগা ধরনের সম্পর্কের মধ্য দিয়ে তারা পরস্পরের সান্নিধ্য অল্প কিছুক্ষণের জন্য উপভোগ করত তো বটেই, আবার দেখা হওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়েও থাকত। শৈলেনের ধারণা তারা একসঙ্গে এত ভালো সময় আর কখনো কাটায়নি।

বেবি সেই একই শাড়ি পরে আসত। ক্রমশ সেটার রং জ্বলে গিয়ে বিবর্ণ মলিন দেখাতে লাগল। অবশেষে সেলাইয়ের সুতোও জায়গায় জায়গায় ফুটে উঠল। ফিরে যাবার সময় কয়েকটা টাকা ধার না নিয়ে সে যেত না। শৈলেন প্রতিবারই দিয়েছে এবং ধার কখনোই শোধ হয়নি। তাই নিয়ে সে কিছু মনে করত না কেননা, কিছুক্ষণের এই চমৎকার সময়টা সে মনে করত খুব সস্তাতেই পেয়ে যাচ্ছে। ধারের অঙ্কটা অবশ্য দুশো পঁচিশ টাকা উঠেছিল যখন বেবি মারা যায়।

বেবিকে সাহায্য করতে পেরে শৈলেন আনন্দই পেত। জগৎসংসারে ওর কেউ নেই, এই বাস্তবতা সম্পর্কেও সে সজাগ ছিল। বেবিকে সে এক বারের জন্য জিজ্ঞাসা করেনি কোথায় সে থাকে, কীভাবে থাকে, কারুর সঙ্গে না একাই থাকে, কী কাজ করছে, কত রোজগার করছে। তবে বেবি নিজেই এক বার বলেছিল এখন সে বেনেপুকুরে থাকে, পার্কসার্কাসে একটা কারখানায় চামড়ায় রং মাখাবার কাজ করছে।

শৈলেনের ঘরে বেবি যত বারই এসেছে, মাঝে মাঝেই সে ফুলদানিটার দিকে তাকাত। তার মতে ওটা সুন্দর, ওটাকে শৈলেনের হাতছাড়া করা উচিত নয়, ওর লতাপাতা আর ফুলের রঙের সঙ্গে সোনালি পাড় যে কী দারুণ বাহার তৈরি করেছে সেটাও উল্লেখ করত। আবার এর কয়েক মিনিট পরই সে ফুলদানিটা তাকে দিয়ে দেবার ইঙ্গিত দিয়ে কথা বলত। শৈলেন অবশ্য পুরোনো জিনিসের দোকানে ফুলদানিটাকে আর দেখতে না চাওয়ার জন্য ইঙ্গিতগুলো না বোঝার ভান করত।

একবার শৈলেন তাকে কিছু বেশি টাকা দিতে চেয়েছিল, বেবি প্রস্তাবটা কানে নেয়নি। তবে তার মনে হয়েছিল, বিক্রি করে টাকা পাবার জন্য বেবি ফুলদানিটা চায় না বা নিজের ঘরে রাখার জন্যও নয়। সে চায় পুরোনো জিনিসের দোকানে বেচলে ওটা অন্য কেউ কিনবে ফলে দুজনের কারুর কাছেই আর ফুলদানিটা থাকবে না।

অবশেষে একদিন বেবি ফুলদানিটা সোজাসুজিই চাইল। শৈলেন তাকে প্রত্যাখ্যান করল। সাত বছর আগে যেভাবে ধুলো ঝেড়ে, কাগজে মুড়ে দিয়েছিল, সেইভাবেই বেবির হাতে সেটা তুলে দিল। বেবিকে তখন খুব খুশিই দেখাচ্ছিল।

তারপর আবার সেই পুরোনো ব্যাপার। শৈলেন পরদিন সকালেই পুরোনো জিনিসের দোকানে কৌতূহল নিয়ে গেল। দোকানটা তখনও খোলেনি। রাত্রে গিয়ে দূর থেকেই দেখতে পেল একটা লেডিজ ব্যাগ আর ছবিহীন একটা নিকেলের ফ্রেমের মাঝখানে ফুলদানিটা দাঁড়িয়ে।

বেবি মারা যায় লরির ধাক্কায়। রাত একটা নাগাদ একটা ট্যাক্সি থেকে সিআইটি রোডে নেমে রাস্তা পার হবার সময় ঘটনাটা ঘটে। ফুটপাথের এক বাসিন্দা দেখেছিল ট্যাক্সি থেকে নেমে বেবি টলছিল এবং সেইভাবেই রাস্তা পার হচ্ছিল। হাসপাতালে তাকে নিয়ে যাবার আগেই সে মারা যায়। নাক-মুখ থেকে প্রচুর রক্ত বেরিয়েছিল।

শৈলেন এইসব কথা জেনেছে বেবির এক প্রতিবেশীর কাছ থেকে। পর পর তিন সপ্তাহ বেবি না আসায় সে শূন্যতা বোধ করতে শুরু করে। খালি কুলঙ্গিটার দিকে চোখ পড়লেই তার মনে হতে থাকে, ফুলদানিটা ওকে দিয়ে দেওয়া ঠিক হয়নি। এটা দেখার লোভেই ও আসত। একদিন সে পুরোনো জিনিসের দোকানের সামনে দিয়ে হেঁটে গেল। ফুলদানিটা দেখতে পেল না। কেউ হয়তো কিনে নিয়েছে। নানারকম ভয়ের সম্ভাবনা তাকে উত্ত্যক্ত করতে থাকায় একদিন স্কুল ছুটির পর বিকেলে সে বেবিকে খুঁজতে বেনেপুকুর রওয়ানা হয়। বেবি বলেছিল বাসরাস্তা থেকে পুবে গলি দিয়ে সে যায়। গলির মুখে একটা পানের দোকান থেকে মিঠে পান কেনে। দোকানের ভিতর চাররকম রঙের কাচের শেড-লাগানো একটা আলো আছে। শেডটা ঘোরে আর রংগুলো ঝিলিক দেয়। বলেছিল, ওই ঝিলিকগুলো দেখবার জন্যই পান কিনতে দাঁড়াই।

আধ ঘণ্টার চেষ্টায় শৈলেন পানের দোকানটা খুঁজে বার করেছিল। তখন দিনের আলো, তাই আলো জ্বালানো হয়নি। পানওয়ালা বিহারি। কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে বলেছিল, সেই মেয়েমানুষটা তো লরিচাপা পড়ে মারা গেছে। ওই জায়গাটায়। আঙুল দিয়ে একটু দূরে রাস্তাটা দেখাল। তা কুড়ি-পঁচিশ দিন তো হয়ে গেল। আপনি ওর কে হন?

আত্মীয় হই। শৈলেনের ভিতরটা কয়েক মুহূর্তের জন্য পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হয়েছিল। পানওয়ালার কাছ থেকে জানল, এই গলিটার মধ্যে বস্তির কোন ঘরে বেবি থাকত।

শৈলেন খুঁজে পেয়েছিল। অল্পবয়সি রুগ্ন একটি বউ, তাকে ঘিরে তিনটি ছেলে-মেয়ে।

এই তো পাশের ঘরেই শুভ্রাদি থাকত।

ঘরে এখন অন্য পরিবার ভাড়া এসেছে।

আমরা খবর পেলুম তো পরের দিন সকালে। থানা থেকে লোক এসেছিল খোঁজখবর নিতে। আমরা তো ওর সম্পর্কে কিছুই জানি না, কোনোদিন কাউকে আসতেও দেখিনি। বলেছিল কোনো আত্মীয়স্বজন নেই, একা।

ওর কোনো জিনিসপত্তর ছিল না।

জিনিস! ওই রান্নার একটা হাঁড়ি আর একটা কড়া, থালা, গেলাস, দুখানা শাড়ি। আর তেমন কিছু থাকার মতো অবস্থা তো ছিল না। রোজগারের যে লাইন ধরেছিল তাতে যৌবন না থাকলে কি আর হয়?

এই সময় বছর ছয়েকের ছেলেটি বলে ফেলে, মা, শুভ্রামাসির ফুলদানিটা?

কড়া চোখে ছেলের দিকে তাকিয়ে বউটি বলে, একটা চিনেমাটির ভাঙা ফুলদানিই শুধু ওর ঘরে ছিল, সেটা আমি রেখে দিয়েছি। আপনি নিয়ে যাবেন তো নিয়ে যান।

কই দেখি।

সেই ফুলদানিটাই। হাতে নিয়ে শৈলেন ভাবল, এটা পুরোনো জিনিসের দোকানে অবশ্যই সে দেখেছিল কিন্তু তারপর বেবিই আবার ফিরিয়ে নিয়ে গেছে। নিশ্চয় বিক্রির দামের থেকে বেশিই ওকে দিতে হয়েছে।

না থাক, এটা রেখে দিন।

এখন শৈলেন রোজ রাতে ঘুমোবার আগে কুলুঙ্গির দিকে তাকায়। বউটি ফুলদানিটা দিতে চেয়েছিল, ফিরিয়ে নিলে ভালো হত কি হত না, এই সমস্যাটা ঘুমিয়ে পড়ার আগে পর্যন্ত তাকে ছটফট করায়। সে ডায়েরি লেখার চেষ্টা করেছিল। আমার বিবাহ হয় ছাব্বিশ বছর আগে, এর বেশি লেখা আর এগোতে পারেনি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *