বৃষ্টিতে

বৃষ্টিতে

সত্যেন বাঁড়ুজ্জের বড়োছেলে বাবুলকে কুকুরে কামড়াচ্ছিল, অল্পের জন্য বেঁচে গেছে। সিনেমা দেখে রাত সাড়ে নটা নাগাদ সে বাস থেকে নামে। একটা খালি জমির প্লট কোনাকুনি পেরিয়ে রাস্তায় পড়লেই বাঁদিকে বস্তি আর ডান দিকে বিরাট একটা পাঁচিল-ঘেরা অ্যাপার্টমেন্ট হাউজিং। রাস্তাটাকে দু-ভাগ করে মাঝখানে, প্রায় পঞ্চাশ মিটার পর্যন্ত নানানরকম পাতাবাহার গাছের সারি। এই বস্তিরই কিছু কুকুর রাত ন-টার পর রাস্তাটাকে বিভীষিকায় রূপান্তরিত করে। পদচারী বা সাইকেলে কেউ ওই বস্তির সামনে দিয়ে গেলেই পাঁচ-ছটি কুকুর ঘেউ-ঘেউ রবে ছুটে গোড়ালি পর্যন্ত মুখ নিয়ে আসে। বুদ্ধিমানেরা দাঁড়িয়ে পড়ে, মুখে চু-চু, চুকচুক শব্দ করে ওদের বোঝাবার চেষ্টা করে, আমি ভালো লোক। ওরা তখন কামড়াবার মতো দূরত্বে এসে হিংস্রভাবে দাঁত দেখায়, ঘেউ ঘেউ করে গাছের সারির শেষ পর্যন্ত পায়ে পায়ে চলে। যারা ভীতু তারা চিৎকার করে ওঠে এবং ছুটতে গিয়ে বিপদ ডেকে আনে। গত তিন মাসে চার জনের হাঁটু থেকে গোড়ালি পর্যন্ত নানান জায়গার মাংস খুবলে নিয়েছে ওরা। সঠিক বললে, একটি কুকুরই।

হ্যাঁ হ্যাঁ, কালুয়াটাই। দেখলেই চিনতে পারবে। ইয়া তাগড়াই, কুচকুচে কালো, শুধু বুকের কাছে সাদা আর দুটো চোখের ঠিক উপরে ব্রাউন দুটো স্পট, মনে হবে একস্ট্রা দুটো চোখ। ওটাই পালের গোদা।

প্যান্টের তলার দিকে ফালা হয়ে যাওয়া অংশটা সকলের সুবিধার জন্য বাবুল পা তুলে দেখাল। দাঁতের আঁচড়ে জুতোর পিছনেও ছাল ওঠা।

কী শয়তান কুকুর গো? বাবুলের মা, পুরোনো হাঁপানির রোগী সুপ্রভা আতঙ্কে কেঁপে উঠল। বাবুল তাদের একমাত্র সন্তান। সেদিন অরুণ দত্তকে কামড়ে পায়ের এতটা মাংস ছিঁড়ে নিয়েছে, এখনও ইঞ্জেকশন চলছে। ভদ্রলোকের পায়ের যা অবস্থা শুনছি হাসপাতাল যেতে হবে।

ভয়ে প্রথমে চেঁচিয়ে উঠেছিলাম। বস্তির পাঠশালার রকে কয়েকটা লোক বসেছিল। তাদের একজন কুকুরগুলোকে ডাকতেই আর আমার দিকে এগোল না! বাবুলের গলা এখনও শুকিয়ে রয়েছে। সন্তর্পণে সে পায়ে হাত বোলাল।

কিছু-একটা করা দরকার। সত্যেন চিন্তিত স্বরে বলল।

কর্পোরেশনে খবর তো মদনদের চাকরকে কামড়াবার পরই দেওয়া হয়েছিল, কিছুই হল না। শুনলুম একদিন নাকি কুকুরধরারা এসেছিল। ওদের দেখেই বস্তির লোকেরা কুকুরগুলোকে ঘরে লুকিয়ে ফেলে।

ওভাবে হবে না, অন্য কিছু ভাবে এই উৎপাত থেকে বাঁচার কথা ভাবতে হবে। সত্যেন বলল বটে কিন্তু কীভাবে বাঁচবে তার হদিস সে জানে না।

পরদিন অফিসে যাবার সময় সত্যেন কয়েকটি কুকুরকে রাস্তায় দেখল। বস্তিতে ঢোকার সরু রাস্তাটার মুখেই টালির চালের পাঠশালার ঘর। হাত তিনেক চওড়া একটা সিমেন্টের রকের উপর পর্যন্ত চাল নামাননা। স্কুলের একমাত্র দরজায় তালা, দশটার পর খুলবে।

দুটি কুকুর রাস্তার কিনারে কুণ্ডলী পাকিয়ে। আর একটা বস্তির ভিতর থেকে ছুটে আসছে আর পিছনে বছর দশেকের একটি মেয়ে বাখারি হাতে তাকে তাড়া করছে। কুকুরটা রাস্তায় বেরিয়ে মাঠের দিকে নিরাপদ দূরত্বে গিয়ে দাঁড়াল। মেয়েটি ব্যর্থ হয়ে, রাগ প্রকাশ করল ঘুমন্ত দুটির উপর। বাখারির আচমকা আঘাতে কিউ শব্দ করে ধড়মড়িয়ে উঠে তারাও মাঠের দিকে সরে গিয়ে মুখ ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে রইল, আক্রমণকারীর চলে যাওয়ার অপেক্ষায়।

আশ্চর্য! সত্যেন ভাবল, দিনের বেলায় কুকুরগুলো এমন নিরীহ ভীতু আর রাত্তিরে এরাই কিনা অন্য চেহারা নেয়। মেয়েটিকে অনুসরণ করে তার চোখ গিয়ে পড়ল দূরে পাঠশালার রকে। একটি কালো কুকুর সামনের দুই পা ছড়িয়ে কাত হয়ে শুয়ে। দুই পায়ের মধ্যে মুখটা মেঝেয় রাখা। কান দুটি খাড়া। চোখ খোলা না বন্ধ দূর থেকে বোঝা যাচ্ছে না। বাবুলের বর্ণনা মতোই ঘোর-কালো এবং দুই জাতে ব্রাউন স্পট। দেখলে মনে হয় রেগে রয়েছে। সত্যেন কুকুরের জাতপাত বোঝে না, তবে মুখের গড়ন, কান আর মসৃণ গা দেখে তার মনে হল দোআঁশলা। নিছকই নেড়ি নয়।

এই তাহলে সেই পালের গোদা, সুপ্রভাকথিত শয়তান যে চার জনের পায়ের মাংস তুলেছে। বস্তির লোকেরা একে কালুয়া নামে ডাকে। কালুয়ার থেকে হাত ছয়েক দূরে কালোয়-সাদায় মেশানো আর একটি লম্বা হয়ে ঘুমোচ্ছে। পেটটা ঝুলে রয়েছে এবং স্তনের সারি। দূর থেকেই বোঝা যায়, বাচ্চা হবে। ওই শয়তান ব্যাটারই কাজ। সত্যেন নিশ্চিত এ সম্পর্কে। মদ্দা আর তো চোখে পড়ছে না।

এবার সে পাঠশালার কাছাকাছি এবং ইচ্ছে করেই মন্থর হল। মেয়েটি রকে বসল এবং কালুয়ার মাথায় একটা থাপ্পড় মারল। কালুয়া মেঝেয় গড়িয়ে টানটান হয়ে আড়মোড়া ভাঙল। মেয়েটি আবার মারার জন্য হাত তুলেছে, কালুয়াও দু-পা তুলে হাতটা ধরার চেষ্টা করল, আদুরে ভঙ্গিতে।

এইসব দেখতে দেখতে সে পাঠশালা ছাড়িয়ে মাঠে উঠে বাস স্টপের দিকে এগিয়ে গেল। অফিসে কয়েক জনকে সে গত রাত্রে কুকুরের কামড় থেকে ছেলের বেঁচে যাওয়ার কথা বলল। তাইতে অনেকেই নানাবিধ মন্তব্য করল। বস্তির ভোট, কর্পোরেশন ইলেকশন থেকে শুরু করে কুকুর পোষার উপকারিতা, দিশি ও বিলিতি কুকুরের মধ্যে স্বভাবের পার্থক্য, রাস্তায় প্রকাশ্যে তাদের যৌনবিহারের ফলে কতরকম অসুবিধার সামনে পড়তে হয় ইত্যাকার কথাবার্তা অবশেষে পৌঁছোল কুকুরের সঙ্গে মানুষের যৌন তাড়নার তুলনামূলক বাদানুবাদে।

কুকুর জানোয়ার হতে পারে, কিন্তু মানুষের মতো বছরে তিনশো পঁয়ষট্টি দিনই গরম হয়। ওদের সিজন আছে, শুধু সিজনেই মেট করে। আর আমরা, মানুষরা? এক যুবক বাঁকা স্বরে কথাটা বলে জামার গলা ঢিলে করে পাখার নীচে বসল। মাস ছয়েক তার বিয়ে হয়েছে।

এ বিষয়ে বউমা কী বলেন, সেটা না জানা পর্যন্ত আর এসব কথা নয়। কাজে ব্যস্ত হওয়ার ভান করে এক মাঝবয়সি আলোচনা বন্ধ করে দিলেন।

কিছুক্ষণ পর মোহিত এসে সত্যেনের কাছে দাঁড়াল। পঁচিশ বছর বেয়ারার কাজ করছে। নম্র, বিনীত, অল্পকথার মানুষ। অল্পবয়সি কেরানিরা ওকে মোহিতদা বলে ডাকে।

বিষ দিয়ে কুকুর মারুন। দু-চারটে মরলেই দেখবেন ঠাণ্ডা, আর কামড়াতে আসবে না। আমার পাড়াতেও কুকুরের উৎপাত ছিল, এখন একদম নেই।

তুমি মেরে দিলে?

হ্যাঁ, একসঙ্গে তিনটে।

বিষ পাব কোথায়?

আমার শালা ওষুধের ল্যাবরেটরিতে কাজ করে। ওখানকার এক কেমিস্ট তৈরি করে ওকে দিয়েছিল। বললে এনে দিতে পারে।

কী করে বিষ খাওয়াব?

কেন, কিছু-একটা খাবারের মধ্যে, সন্দেশ বা কেক বা পাঁউরুটির মধ্যে পুরে ছুড়ে দেবেন। কপাৎ করে খেয়ে নেবে।

তক্ষুনি মরে যাবে?

না না, তক্ষুনি কি মরে! সকালে দেখবেন মরে পড়ে আছে।

এনে দাও তো আমায়। পয়সা লাগবে?

সে সামান্য দু-পাঁচ টাকা। তবে খুব সাবধান, পাড়ার লোক যেন না জানতে পারে আর নিজেও সাবধান, হাতেটাতে লাগলে তক্ষুনি সাবান দিয়ে ধুয়ে ফেলবেন। এতে মানুষও কিন্তু মরে।

মোহিত চলে যাবার পরই ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে ভাবতে সত্যেন ক্রমশ উত্তেজিত হয়ে উঠল। তাহলে এবার শয়তানটাকে শায়েস্তা করার মোক্ষম জিনিস সে পেয়েছে। আর কোনোদিন ওখানকার মানুষ আতঙ্কে চলাফেরা করবে না। বাবুলকে যদি কামড়াতই তা হলে কী অবস্থা ওর হত? যন্ত্রণাকর চোদ্দোটা ইঞ্জেকশন। জলাতঙ্কও হতে পারে, মারাও যেতে পারে। অথচ সে কিছুই করেনি, রাস্তা দিয়ে শুধু হেঁটে যাচ্ছিল। এজন্য চড়াও হয়ে কামড়ে মাংস ছিঁড়ে নেওয়া?… সত্যেন দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিল, বিষ খাইয়ে শয়তানটাকে মারাই উচিত।

অফিস থেকে ফেরার সময় সে একটি ছাড়া কোনো কুকুরই দেখতে পেল না। বস্তির কিছু মেয়ে-পুরুষ রাস্তার ধারে বসে কথা বলছে। বাতির নীচে হাঁড়ি নিয়ে বসে এক ঘুগনিওয়ালা। রাস্তায় এখন লোক চলাচল খুবই কম। রাত আটটার পর একদমই লোক চলে না, কেননা লোকালয় ক্রমশই পাতলা হয়ে গেছে দু-তিনটি হাউজিংয়ের পরই। ট্যাক্সি বা স্কুটার হয়তো কচিৎ দেখা যায়।

কালুয়াকে দেখতে না পেয়ে সত্যেনের কিছুটা আশাভঙ্গ হল এবং সেজন্য রেগেও উঠল। শয়তানটা গা-ঢাকা দিয়ে রয়েছে। ওর চালাকি ভাঙব… দেখব কেমন করে বাঁচে। হঠাই, একটা চ্যালেঞ্জের মতো ব্যাপার হিসাবে এটাকে মনে করে সে উত্তেজিত হয়ে উঠল।

দূর থেকে দুটি কুকুরকে দুলকি চালে আসতে দেখে সত্যেন থমকে গেল। বস্তির লোকেরা তার কাছাকাছিই। ভয় কাটিয়ে পায়ে পায়ে সে এগোল। কালুয়া আর সেই পেট-ঝোলা মাদিটা। ওরা তার পাশ দিয়েই চলে গেল। সত্যেনের মনে হল, শয়তানটা এক বার যেন তার দিতে তাকাল। শিরশির করা শিরদাঁড়াটা সোজা রেখে সে বাড়ির দরজা পর্যন্ত পৌঁছোল।

তিন দিন পর মোহিত তাকে একটা মোড়ক দিল দেশলাই বাক্সের মধ্যে। দাম নিল দশ টাকা।

খুব সাবধানে হাত লাগাবেন কিন্তু।… বড়ো কুকুর হলে এক চিমটেতেই কাজ হবে। মোটামুটি পাঁচ-ছটা মারার মতো মাল এতে আছে।

বাক্সটা পকেটে রেখে সত্যেন অস্বস্তিতে পড়ল। কীরকম একটা ভয় যেন সে পাচ্ছে। কীভাবে এটা খাওয়াবে? যদি বুঝে ফেলে খেতে না চায় আর তাকে যদি খুনিহিসাবে চিনে রাখে? জানোয়াররা নাকি এসব ব্যাপার ভালো বোঝে আর ওদের স্মৃতিশক্তিও নাকি দারুণ! জামাকাপড়ের বা গায়ের গন্ধ ওরা মনে রাখতে পারে বহুদিন। তা ছাড়া এটা খেয়ে যদি না মরে? হয়তো শুধুই পেটখারাপ হল, বমি করল, তারপর ঠিক হয়ে গেল। তখন তো আরও ডেঞ্জারাস হয়ে উঠবে। তবে মোহিত বাজেকথা বলার লোক নয়, পঁচিশ বছর ধরে ওকে সে দেখছে তো!

বাস থেকে নেমে মিনিট ছয়েক হেঁটে একটা মোড়ে পাঁচ-ছটি দোকান। সিগারেট-পানের, স্টেশনারির, মিষ্টির, তারপর মুদির দোকান। সত্যেন সস্তার একটা কেক মুদি দোকান থেকে কিনল। কিন্তু আগে বৃষ্টি হয়ে গেছে। মাঠের মাটি ভিজে, রাস্তায় মাঝে মাঝে জল জমে। বস্তির লোকজন কেউ বসে নেই, একটা কুকুরও দেখতে পেল না।

সে একটু দমে গেল। তার মনে হল, মারতে হলে মনের ভিতরে একটা তীব্রতা না থাকলে কাজটা সম্পন্ন করা যায় না। খুনিরা এজন্যই মদটদ খেয়ে নিজেদের খেপিয়ে নিয়ে কাজে নামে। তবে ঠাণ্ডা মাথায়ও অনেকে খুন করে, স্বদেশিরা করত। ওদের একটা সংকল্প বা উদ্দেশ্য ছিল দেশপ্রেম, দেশকে স্বাধীন করা, অত্যাচার পীড়ন দেখে দেখে আর সয়ে সয়ে মহৎ আদর্শে উদবুদ্ধ হয়ে ওরা মারত, নিজেরাও মরত। সত্যেনের খুড়শ্বশুর ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেটকে খুন করার চেষ্টা করেছিল। ধরা পড়ে ফাঁসিও হয়। তাঁর একটা ছবি শ্বশুরবাড়ির বৈঠকখানার দেয়ালে এখনও ঝোলানো আছে। খুবই মলিন তার কাচ ও ফ্রেম। প্রেরণা পাওয়ার মতো স্বচ্ছ নয়।

কিন্তু সত্যেন এই মুহূর্তে কুকুর মারার জন্য তীব্র ইচ্ছা অনুভব করছে না। কিন্তু এটা তার খুবই দরকার। সামনের বাড়ির অরুণ দত্তর এক-তলার জানলায় আলো জ্বলছে। সত্যেন বাড়িতে ঢুকে কলিং বেল টিপল। দরজা খুলল ঝি। ভিতরের ঘর থেকে উঁকি দিল অরুণ দত্তর বউ।

অরুণবাবু আছেন কেমন?

আজ বিকেলেই নার্সিংহোমে ভরতি হলেন। ধীর কিন্তু উদবিগ্ন স্বরে বলল। পা-টা খুব ভালো ঠেকছিল না। ডাক্তারবাবু সকালে দেখে বললেন, হয়তো অপারেশন করতে হতে পারে।

সত্যেন অবাক হবার মতো অবস্থায় পৌঁছে গেছে। অপারেশন কেন? পা কেটে বাদ দিতে হবে নাকি? কিন্তু একথা তো ওঁকে জিজ্ঞাসা করা যাবে না, তাহলে আরও ভয় পেয়ে যাবেন।

কী কান্ড দেখুন তো, এভাবে কুকুর কামড়ে মানুষের কত ক্ষতি করল। কত অর্থব্যয়, কত শারীরিক কষ্ট, আত্মীয়স্বজনদের দুশ্চিন্তা… কিছু-একটা করা দরকার। সত্যেন টের পাচ্ছে। সে উত্তেজনা অনুভব করছে। তা-ই নয়, অবলম্বনরূপে একটা উদ্দেশ্যও পাচ্ছে…কত ক্ষতি, কত কষ্ট! নিজের উদবেগ, সহানুভূতি ও কিছু সান্ত্বনা জানিয়ে সে বাড়ি ফিরে এল।

বিকেল থেকে সুপ্রভার শ্বাস ওঠায় সে রান্না করতে পারেনি। কোলে বালিশ নিয়ে বিছানায় বসে। বাবুল আটটার আগে অফিস ও আড্ডা থেকে ফেরে না। সত্যেন ভাত ফুটিয়ে, মাছের ঝাল বেঁধে রেখে কলঘরে ঢুকে আলো জ্বেলে দরজা বন্ধ করল।

উবু হয়ে বসে সন্তর্পণে দেশলাই বাক্সটা খুলে দেখল-পাতলা কাগজে ওষুধের পুরিয়ার মতো ভাঁজ-করা। দু-আঙুলে টিপে বুঝল জিনিসটা পাউডারের মতো। ধীরে ধীরে সাবধানে ভাঁজ খুলে দেখল সাদা গুঁড়ো। গন্ধ শুকতে গিয়েও নাক তুলে নিল। নিশ্বাসের সঙ্গে যদি ভিতরে চলে যায়।

কেকটা কপাৎ করে খাওয়ার পক্ষে বড়োই, তাই দু-আধখানা করে নিয়েছে। পেরেক দিয়ে খুঁচিয়ে গর্ত করে শক্ত একটা কাগজে খানিকটা বিষের গুঁড়ো তুলে সে-গর্তে রাখল। আঙুলে টিপে টিপে গর্তের মুখ বুজিয়ে ফেলে কেকের টুকরোটা কাগজে মুড়ে নিল। কলঘর থেকে বেরিয়ে আসার আগে শক্ত কাগজটা প্যানের মধ্যে ফেলে সিস্টার্ন টেনে দিয়েছিল। সমস্যা হল দেশলাই বাক্সটা কোথায় লুকিয়ে রাখবে? শোবার ঘরে নয়, রান্নাঘরে তো নয়ই। ভেবেচিন্তে অবশেষে ঠিক করল, পাঞ্জাবির পকেটেই থাকুক, অফিসে তার ড্রয়ারে কাল রেখে দেবে। কেকের বাকি আধখানা, যাতে বিষ নেই, সেটা বাড়িতেই থাকুক পরে কাজে লাগতে পারে। তবে বিষাক্ত টুকরোটা পকেটে রাখল। এটাও সঙ্গে নিয়ে অফিসে যাবে, কাল বাড়ি ফেরার সময়, যদি ভগবান সদয় হন, শয়তানটাকে যদি তিনি এগিয়ে দেন কেকটা গেলাবার জন্য! সত্যেন উত্তেজনায় রাতে ঘুমোতে পারল না।

পরদিন অফিসে বেরোনোর মুহূর্ত থেকে তার স্নায়ুগুলো টানটান হয়ে উঠল। রক্ত চলাচলের বেগ বেড়ে উঠে শরীরটা ঝিমঝিম করতে লাগল। সারাদিন এই অবস্থায় একটা ঘোরের মধ্যে সে অফিসে কাটাল। কুকুরটার চেহারা, ভাবভঙ্গি অবিরত তার চোখের সামনে ভেসে উঠল। মনে মনে সে মহড়া দিল কীভাবে কেকটা ওকে দেবে। দূর থেকে ছুড়ে না কাছে এলে হাতে নিয়ে অপেক্ষা করবে? হাত থেকে খাওয়ানোটা কি নিরাপদ? যদি টের পেয়ে যায় তাকে মারার ষড়যন্ত্র হয়েছে, কেকে বিষ আছে, তাহলে কামড়ে দিলেও দিতে পারে। জানোয়ারদের অদ্ভুত একটা সিক্সথ সেন্স আছে। হঠাৎ আদিখ্যেতাকে ওরা সন্দেহ করবেই।

একটু দেরি করে ফেরার জন্য সত্যেন অফিস থেকে বেরিয়ে গঙ্গার দিকে গেল। অনেক দিন পর এই নদী দেখতে তার ভালো লাগল। কৈশোরে আহিরিটোলা ঘাটে সাঁতার কাটার, পাড়ার দুর্গা আর কালী পুজোর ভাসানের কথা তার মনে পড়ল। বাবুঘাটে অনেকক্ষণ বসে তার শরীর ও মন স্নিগ্ধ, ঢিলেঢালা হয়ে গেল। অবশেষে সে বাসে উঠল বাড়ি ফেরার জন্য।

দূর থেকেই দেখল বস্তির কয়েকটি শিশু রাস্তায় খেলা করছে। কয়েক জন বয়স্কা মেয়েমানুষ বসে গল্প করছে। কুকুর? সত্যেনের চোখ খুঁজে বেড়াল। রাস্তার নিয়ন আলোয় পাতাবাহারিগাছগুলোর নীচে একটা সাদা পুটলির মতো দেখেই তার মাথার মধ্যে রক্ত ছুটে এল। পেয়েছি একটাকে।

স্বাভাবিক কদমে হাঁটার চেষ্টা করেও তার পা জড়িয়ে আসছে। লক্ষ করল তাকে কেউ দেখছে কি না। শিশুরা ওই দিকটায় যাচ্ছে না দেখে সে আশ্বস্ত হল। পকেটে হাত দিয়ে কেক মোড়া কাগজটার সঙ্গে দেশলাইটাও পেল। আশ্চর্য, এটা ড্রয়ারে রেখে দিতে ভুলে গেছে!

সেই মাদি কুকুরটা। সত্যেনকে দেখেই মুখ তুলল।

আয়, আয়, চু-চু।

উঠে দাঁড়িয়েছে। কাগজের মোড়কটা খোলার সময় হাতটা এমনই কেঁপে গেল যে কেকের টুকরোটা রাস্তায় পড়ে গেল। নীচু হয়ে তুলতে গিয়েও তুলল না। যদি ছুটে এসে কামড়ে দেয়?

কিন্তু ছুটে এল না, বরং ল্যাজটা নাড়াল। তারপর সত্যেনকে স্তম্ভিত করে সে এগিয়ে এসে কেকের টুকরোটা এঁকেই মুখে তুলে চিবোতে শুরু করল। আর পায়ে পায়ে পিছিয়ে গিয়ে সত্যেন ভীত একটা আর্তনাদ করে প্রায় ছুটেই পালাতে লাগল।

বাড়িতে ঢুকতেই সুপ্রভার সঙ্গে মুখোমুখি। তার মুখের দিকে তাকিয়ে সুপ্রভা অবাক স্বরে বলল, ভূত দেখেছ নাকি?

শরীর খারাপের অজুহাত দিয়ে সে শুয়ে পড়ল। রাত্রে খেল না, ঘুমোতেও পারল না। পরদিন অফিস যাবার সময় দেখল রাস্তা প্রতিদিনের মতোই স্বাভাবিক। বস্তির ভিতর থেকে ঝগড়ার আর কুকুরের ডাকের আওয়াজ পেল। কোথাও মরা কুকুরের চিহ্নও নেই। বুক থেকে একটা ভার নেমে যাওয়ার স্বস্তি নিয়ে সে অফিস পৌছোল।

একসময় মোহিতকে ডেকে সে জানিয়ে দিল, তোমার বিষে ভেজাল আছে। যা বলেছিলে সেইভাবেই একটাকে খাইয়েছি কিন্তু মরেনি। সত্যেন ড্রয়ার থেকে দেশলাই বাক্সটা বার করে টেবিলে রাখল। নিয়ে যাও এটা, যে দিয়েছে তাকে বোলো।

কবে খাইয়েছেন?

কাল সন্ধ্যার পর। রাস্তা থেকে নিজেই খেল। যতটা বলেছিলে ততটাই দিয়েছিলাম।

খোঁজ নিয়ে দেখুন মরেছে কি না, তারপর ফেরত নেব।

বাড়ি ফেরার সময়ও সে দেখল রাস্তা একইরকম। দু-তিনটে কুকুর ঘুরছে, এমনকী শয়তানটাকেও দেখতে পেল গ্রামোফোন রেকর্ডের কুকুরটার মতো বসে আছে বস্তিতে ঢোকার গলিটার কাছে। একটি লোক তার পাশে বসেই ঘুগনি খাচ্ছে। সত্যেন কার কাছে আর খোঁজ নেবে? বাড়িতে কাউকে এসম্পর্কে কিছু বলল না।

তবে সে শুনল, অরুণ দত্তর পায়ে পচ ধরেছে, খুব সিরিয়াস অবস্থা, পা কেটে-না বাদ দিতে হয়। পরের দিনই শয়তানটা কামড়াল কান্তি ঘোবের ভাইপোকে। বাড়িতে আত্মীয়রা এসেছিল। রাত হয়ে যাওয়ায় তাদের বাসে তুলে দিয়ে সে ফিরছে, তখন তাড়া করে কামড়ায়। তবে বস্তির একজন চেঁচিয়ে ওঠায় কামড়টা ভালোমতো দিতে পারেনি। চারটে সেলাই হয়েছে। শোনামাত্র সত্যেনের মাথা গরম হয়ে গেল।

কিন্তু সকালে ঠিকে ঝি একটা খবর দিল যেটা অপ্রত্যাশিত।

একটা কুকুর পরশু থেকে মরে পড়ে আছে হাউজিং-এর পিছনে পাঁচিলের গায়ে। দুর্গন্ধে ওদিককার ফ্ল্যাটের লোক টিকতে পারছে না। কর্পোরেশন আপিসে খবর দিয়েছে, এখনও কেউ আসেনি।

আর সন্দেহ নেই কোন কুকুরটা। মোহিত খাঁটি মানুষ, ভেজাল জিনিস সে গছাবে না। সত্যেন আবার উত্তেজনার মধ্যে পড়ে গেল। আবার একটা ঘোর তার শরীরে মনে লাগছে। তাহলে বিষটায় কাজ হয়েছে। তাহলে এবার শয়তানটাকে শেষ করার চেষ্টা করা যেতে পারে।

বাসি কেকের টুকরোটা শক্ত হয়ে গেছে। আবর্জনার বালতিতে ফেলে দিয়ে সে স্থির করল, অফিসে মোহিতকে দিয়ে একটা কেক কিনে আনিয়ে নেবে। দেশলাই বাক্সটা ড্রয়ারেই রাখা আছে। অফিস ছুটির পর ঘর ফাঁকা হয়ে গেলে তখন জিনিসটা তৈরি করে নেবে। আজই সন্ধের পর যদি সুযোগ মেলে, তাহলে আজই পৃথিবীতে ওর শেষ দিন!

বিকেল থেকেই মেঘ ঘনিয়ে আসে। দেরিতে ফিরবে বলে সত্যেন ধীরেসুস্থে সময় নিয়ে কেকটা তৈরি করে অফিস থেকে যখন বেরোল তখন প্রথম বার বিদ্যুৎ চমকে উঠল। বাতাসে ঠাণ্ডা ভাব। বাসে ঠাসা ভিড়। বৃষ্টি নামার আগেই সবাই বাড়ি পৌঁছোতে চায়। সত্যেন ঠেলেঠুলে তার বাসে উঠল, তাকেও বৃষ্টির আগে পৌঁছোতে হবে। কিন্তু বাস থেকে নামার আগেই ফোঁটা ফোঁটা পড়ছিল। নামামাত্রই চড়বড়িয়ে বড়ো বড়ো ফোঁটায় শুরু হল। একটা কোনো আশ্রয় নেই যার তলায় দাঁড়ানো যায়। সত্যেন বাড়ির দিকে ছুটল।

মাঠটা পার হয়েই বুঝল ছোটাটা অর্থহীন। যে বেগে নামছে তাতে ভিজে ঢোল হয়ে যেতে হবে বাড়ি পৌঁছোনোর আগেই। পাঠশালার ঢাকা রকটা দেখে সে দৌড়ে বস্তির গলিতে ঢুকে রকে উঠে পড়ল। আর সেই মুহূর্তে বিদ্যুৎ ঝলসানির সঙ্গে প্রচন্ড শব্দে মেঘ ডাকল আর জলের ধারা প্রবল তোড়ে নামতে থাকল।

খুব বেঁচে গেছি। সত্যেন হাঁফ ছাড়ল। আর কয়েক সেকেণ্ড দেরি হলেই চুবিয়ে দিত। কপালের জল মোছার জন্য রুমাল বার করতে গিয়ে কেকের টুকরোটা হাতে ঠেকল। এটার আজ আর দরকার হচ্ছে না। এমন বৃষ্টিতে জানোয়ারও বেরোবে না।

বৃষ্টি থামার কোনো লক্ষণ নেই। একই বেগে ঝরছে আর সঙ্গে হাওয়ার ঝাপটা। রাস্তার নিয়ন আলো ছাড়া চারিদিকে আর কোনো আলো নেই। সব বাড়ির জানলা বন্ধ। বিদ্যুৎ চমকানোর সঙ্গে সে দেখতে পাচ্ছে নির্জন গলি। বৃষ্টিটা চাদরের মতো ঝুলে রয়েছে, দমকা বাতাসে চাদরটা নড়ে উঠলেই নিয়ন আলোর কণিকা ঝলমল করে উঠছে। সত্যেন মুগ্ধচোখে তাকিয়ে ছিল।

হঠাৎ তার শরীর শিরশির করে হাতের নোম খাড়া হয়ে উঠল। কেউ একজন রকে রয়েছে। বিদ্যুৎ চমকাতেই দেখল রকের একপ্রান্তে বসে আছে শয়তান। মুখটা তার দিকেই ফেরানো। সত্যেন থরথর করে উঠল। এক-পা পিছোতেই দেয়ালে পিঠ লেগে গেল।

কুকুরটা গা ঝাড়া দিল। ধোঁয়ার মতো জলের গুঁড়ো ওর লোম থেকে রাস্তার আলোয় ছিটকে বাষ্পের মতো উঠল। আর সত্যেনের মনে হল একটা অলৌকিক জীব তার সামনে। মুখটা ঘুরিয়ে সত্যেনের দিকে তাকিয়ে। চোখ জ্বলজ্বল করছে।

আমাকে কি চিনেছে? বুঝে গেছে কি পকেটে ওকে মারার বিষ রয়েছে? ওদের সিক্সথ সেন্স নাকি প্রখর! দৌড়, একদম নয়। তাহলে।

বৃষ্টির ছাট হাওয়ার দমকায় রকটায় আছড়ে পড়ল। কুকুরটা সরে এল সত্যেনের দিকে। আর সত্যেন পকেটে হাত ঢুকিয়ে কেকটা আঁকড়ে রইল। কুকুরটা আরও সরে এল। ভয়ে একটা কাতরানি তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসতেই কুকুরটা মুখ তুলে তাকাল। অন্ধকারে চোখ দুটো জ্বলজ্বলে দেখাচ্ছে। সত্যেনের মনে হল, যদি দাঁড়িয়ে ওঠে তাহলে গলার কাছে ওর দাঁত পৌঁছোবে শয়তান মুখ তুলে তার গলা পর্যন্ত দূরত্বটা আন্দাজ করছে।

দুজনের মধ্যে হাত ছয়েকের ফাঁকা জায়গা। সত্যেন এখনও দু-হাত পিছিয়ে যেতে পারে। কিন্তু তাতে কী লাভ, কুকুরটাও তাহলে সরে আসবে। জল উঠতে উঠতে রকের প্রায় সমান সমান। অল্প বৃষ্টিতেই এই অঞ্চলে হাঁটুজল জমে আর এখন তো তোড়ে অন্তত পনেরো মিনিট হচ্ছে।

হঠাৎ প্রচন্ড ঝলসানি দিয়ে ডান দিকে হাউজিং-এর একটা টিভি অ্যান্টেনায় বাজ পড়ল। সত্যেনের মুখে গরম হলকা লাগল, চোখ বন্ধ করে ফেলে সে ঠকঠক কেঁপে উঠল আর ক্ষীণ আর্তনাদ করে কুকুরটা গুঁড়ি মেরে তার পায়ের কাছে সরে এল। দমকা হাওয়ার সঙ্গে জলের একটা ঝাপটা আসতেই সত্যেন পিছিয়ে যাবার জন্য পা সরাতেই মাড়িয়ে ফেলল কুকুরের পা। তার বুকটা হিম হয়ে গেল কয়েক সেকেণ্ডের জন্য। অবধারিত এইবার দাঁতগুলো বসবে তার গোছের কিংবা হাঁটুর কাছে। একটা মোচড় দিয়ে এক খামচা মাংস তুলে নেবে। দাঁতে দাঁত চেপে, দু-হাত মুঠো করে সে তৈরি। তাকে এবার কামড়াবেই, এই সময় আবার একটা বিদ্যুতের ঝলসানি হতেই সে মা গো বলে দু-হাতে কান ঢাকল এবং দেয়ালের দিকে মুখ ফেরাল। আগেরটার থেকে কিছুটা দূরে এবারের বাজটা পড়ল। কুকুরের কুঁই কুঁই কাতরানি তার কানে এল।

বিমূঢ়ত্বটা কেটে যেতেই দেখল কুকুরটা তার দু-পায়ের ফাঁকে প্রায় মুখটা গুঁজড়ে। এবার সে সরে যাবার চেষ্টা করল না। তার মনে হচ্ছে, কুকুরটা তাকে আক্রমণ করবে না। আরও মনে হচ্ছে, কুকুরটা ভয় পেয়ে তার কাছ থেকে বোধ হয় ভরসা চাইছে।

সত্যেনের স্নায়ুগুলো ঢিলে হয়ে গেল। বিরক্ত হল সে নিজের উপর। কেন যে মরতে এই পাঠশালার রকে উঠলাম! নয় একটু ভিজতামই, তবু সোজা বাড়ি চলে গেলেই ভালো হত। এই বৃষ্টি কখন যে থামবে কে জানে। এরপর সে কুকুরটার দিকে ঘাড় নীচু করে তাকাল। এটাই-বা এখানে কেন! বস্তির যেকোনো ঘরেই তো গিয়ে ঢুকতে পারত। নাকি তার মতোই ভেবেছিল, বৃষ্টি তো কিছুক্ষণ বাদেই ধরে যাবে, ততক্ষণ বরং এই রকে আশ্রয় নেওয়া যাক। নীচু জমির বস্তিতে এখন আর দাঁড়াবার মতো ডাঙা থাকা সম্ভব নয়।

সত্যেন দ্বিধায় পড়ল। বাড়ির দিকে এখনই রওনা হবে না কি আর একটু অপেক্ষা করে দেখবে। চোখ কুঁচকে মুখ তুলে একদৃষ্টে সে বৃষ্টির চাদরের দোলা দেখছে। মেঘ ভেদ করে দপ দপ করল লালচে বিদ্যুৎ। গুম গুম চার-পাঁচটা শব্দ গড়িয়ে গেল আকাশ দিয়ে। ভয় পাওয়ার মতো কিছু তাতে নেই। মেঘটা সরে যাচ্ছে বাজ ফেলতে ফেলতে।

চমকে পা সরিয়ে নিল সে। কুকুরটা চেটে দিয়েছে।

অ্যাই, ধ্যাত ধ্যাত। সত্যেন ধমকে উঠল, পা ঠুকল এবং জুতোর ডগা দিয়ে মুখটা সরিয়ে দিল। ব্যাটা ভয় পেয়েছে। এখন তাকে কাছে রাখার জন্যই এইসব চাটাফাটা…শালা শয়তান! সত্যেনের মাথা গরম হয়ে উঠল। মনে থাকে না মানুষকে কামড়াবার সময়? এখন যদি তোকে কেকটা দিই কী হবে? কপাৎ করে তো গিলে ফেলবি! নিজের মনেই সে গজগজ করে চলল। ব্যাটা কুত্তা, এতগুলো মানুষকে কামড়ে মাংস ছিঁড়ে নিয়েছিস, একটা লোক তোর জন্যই পা হারাতে বসেছে! আর শালা শয়তান, তুই কিনা সেই মানুষেরই কাছে কিঁউ কিউ করছিস ভয় পেয়ে?

ভাগ ব্যাটা। সত্যেন হঠাৎ লাথি কল পাঁজরে। এক-পা পিছিয়ে গেল কুকুরটা, ভীত শব্দ তুলে।

এইবার যদি তোকে খেতে দিই? সত্যেন পকেট থেকে কাগজে-মোড়া কেকের টুকরো বার করল। তুই তো খাবিই। হ্যাংলার জাত, যা পাবি তাই-ই তো খাস, এটা তো দারুণ জিনিস তোর কাছে। মোড়কটা ভিজে গেছে। কেকের সঙ্গে সেঁটে-যাওয়া কাগজ ছাড়াতে ছাড়াতে সে লক্ষ করল কুকুরটা মুখ তুলে তাকিয়ে লেজটা অল্প অল্প নাড়ছে।

ধীরে ধীরে কেকসমেত হাতটা সে পকেটে ভরে নিল। শয়তানটা বুঝতে পেরেছে এটা খাবার জিনিস।

কী রে, খাবি?

লেজটা জোরে জোরে নেড়ে কুকুরটা ছটফট করে উঠল। কু-কুঁ শব্দ বেরোচ্ছে মুখ থেকে। কোমর থেকে পিছনটা ঘন ঘন নড়ছে। সামনের পা দুটো অধৈর্যে তুলছে আর নামাচ্ছে। এগিয়ে এসে সত্যেনের গা ঘেঁষে মুখটা তুলে ছোট্ট করে তিন বার ডেকে উঠল। পকেট থেকে কেকের টুকরোটা বার করে সে হাতটা উঁচু করে তুলে ধরে রইল। কুকুরটা এবার দ্বিগুণ ছটফটানি শুরু করল।

এইবার? এইবার?

কুকুরটা হঠাৎ সামনের পা দুটো সত্যেনের পেটে ঠেকিয়ে পিছনের পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে উঠল। তখন সে হাতটা আরও উঁচুতে তুলল।

কী রে ব্যাটা, মরতে চাস? তোর প্রাণ এখন আমার হাতে, তা কি জানিস?

বলার পরই সত্যেন অদ্ভুত একটা মজা বোধ করল। প্রাণ এই ছোট্ট শব্দটা ঝনঝন শব্দে তার মাথা থেকে পা পর্যন্ত বজ্রের মতো গড়িয়ে নেমে গিয়ে আবার উঠে এল। এই কুকুরটারই হাত থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে বাড়ি ফেরার সময় সেদিন যেমন সে ভয় পেয়ে গেছল, অনেকটা সেইরকম একটা আতঙ্ক এখন তাকে যেন ছুঁয়ে যাচ্ছে। ইচ্ছে করলেই এখন সে আবার খুন করতে পারে, কেউ জানবে না, বুঝতে তো পারবেই না। একটা প্রাণ এখন তার হাতে। তারই দয়ার উপর! অদ্ভুত তো?

বৃষ্টির তেজ কমে এসেছে। ইতিমধ্যে জল রকে উঠে পায়ের গোছ এবং জুতো যে ডুবিয়ে দিয়েছে সে-হুশ তার ছিল না। পেটে নখের অধৈর্য আঁচড় সুড়সুড়ি দেবার মতো লাগছে। সত্যেন কেকের টুকরোটা একটু নামিয়েই আবার তুলে নিল। কুকুরটা কাতরানির মতো শব্দ করে ডেকে উঠল।

হুঁহুঁ বাব্বা, এটা টপাস করে ফেলব আর কপাৎ করে গিলবি, সেটি হচ্ছে না। ভাগ ভাগ। সত্যেন তালু দিয়ে ওর মুখে সজোরে ধাক্কা দিল। টাল খেয়ে কুকুরটা পা দুটো নামিয়ে নিয়েই চাপা গজরানির মতো শব্দ করল।

ওসব ফোতো রাগ আমাকে দেখালে এমন লাথ কষাব-না… তোকে বাঁচিয়ে রাখছি আর শালা আমাকেই কিনা… সত্যেন লাথি ছোঁড়ার জন্য পা তুলে টলে পড়ে যাচ্ছিল। দেয়ালটা ধরে নিজেকে সামলাচ্ছে তখন হাত থেকে কেকের টুকরোটা মেঝের জলের উপর পড়ে গেল। নীচু হয়ে সেটা সবে তুলেছে তখনই কুকুরটা ঝাঁপিয়ে পড়ল এবং কবজির কাছে কামড়ে ধরল। ঝটকা দিয়ে হাতটা সরিয়ে নিতেই কুকুরটা দ্বিতীয় বার আক্রমণ করে বাহু কামড়ে ধরতেই পিছিয়ে যেতে গিয়ে সত্যেন গড়িয়ে রক থেকে জলে পড়ল। কেকের টুকরোটা আবার হাত থেকে মেঝেয় ভাসছে।

রাস্তার আলোয় যতটুকু দেখা যায়, বাহুটা তুলে ফ্যালফ্যাল করে সে তাকিয়ে। সাদা হাড়ের আভাস যেন দেখা যাচ্ছে। খোদলটা ক্রমশ ভরে উঠছে রক্তে। পাঠশালার রকের উপর জলে পা ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে কুকুরটা মুখ নীচু করে চিবোচ্ছে। সত্যেন ধড়মড়িয়ে উঠে দাঁড়াল। জল হাঁটু ছাড়িয়ে গেছে। পালাবার জন্য নিজেকে টানতে টানতে সে জলের মধ্য দিয়ে রাস্তার দিকে এগিয়ে গেল।

রাস্তায় হাঁটুর নীচে জল। টলতে টলতে সে এগোচ্ছে। বৃষ্টি প্রায় থেমেই গেছে। নিস্তব্ধ এবং জনশূন্য চারিদিক। সে এক বার পিছন ফিরে তাকাল। পাঠশালার রকে জলবন্দি হয়ে একটা অবয়ব নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে। সত্যেনের চোখ জলে ভরে উঠল। যন্ত্রণা শুরু হয়েছে তার হাতে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *