মমতাজ-দুহিতা জাহানারা – ৯

বাদশাহের অনুমানই ঠিক। মহম্মদ একা এসে দুর্গে প্রবেশ করে। তার পশ্চাতে পত্রবাহক। বহুদিন পরে দেখলেও দূর থেকে চিনতে কষ্ট হয় না মহম্মদকে। আওরঙজেবের চেহারার ছাপ আছে। আওরঙজেবের চেয়েও বলিষ্ঠ। প্রতিটি পদক্ষেপে মহম্মদের ব্যক্তিত্ব প্রকাশ পায়। কোনওদিকে না চেয়ে সোজা এগিয়ে আসছে সে। অথচ জানে, এখানে অস্ত্রধারী সিপাহির অভাব নেই। আওরঙজেব হলে কখনই এভাবে আসতে পারত না। যা শুনতে পেতাম তাই সত্যি বটে—বড় হৃদয় নিয়েই জন্মেছে মহম্মদ। ময়ূরাসনে আওরঙজেবের পরিবর্তে সে যদি বসে আমি সব চাইতে আগে গিয়ে তাকে অভিনন্দন জানাব।

পত্রবাহক অন্দরের প্রথম-ঘরটি দূর থেকে দেখিয়ে দিয়ে থেমে যায়। মহম্মদ একা এগিয়ে আসে। আমি ওড়না দিয়ে মুখ ঢেকে তার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকি। প্রথমেই পরিচয় দেব না। আগে দেখে নেব তাকে—তারপর।

কক্ষে প্রবেশ করে সামনে আমাকে দেখে সে দাঁড়িয়ে পড়ে। তারপর ধীরে ধীরে প্রশ্ন করে, —আমি কী বাদশাহ্-বেগম জাহানারার সম্মুখে এসেছি?

—না। তিনি এখনি আসবেন।

—ও।

—আপনি দয়া করে বসুন।

মহম্মদ আসন গ্রহণ করে। আমাকে তবু দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সে ছটফট করে। ভাবে হয়তো, অনর্থক কেন দাঁড়িয়ে রয়েছে এই মহিলাটি।

—শাহজাদা।

চমকে উঠে সে আমার ওড়না ঢাকা মুখের দিকে চায়।

—একটা প্রশ্ন করতে পারি কি?

মহম্মদের স্থির চোখে কৌতূহল প্রকাশ পায়। সে আমার অনাবৃত হাত দুখানার দিকে ক্ষণিকের তরে চায়। তারপর বলে—কী প্রশ্ন?

—আপনি এখনো জাহানারা বেগমকে বাদশাহ্-বেগমের সম্মান দিচ্ছেন কেন?

—তিনি বাদশাহ্-বেগম, তাই

কিন্তু আপনার পিতার এই জয়লাভের পর তাঁর এই উপাধি কি হাস্যকর হয়ে দাঁড়ায়নি।

কী যেন ভাবে মহম্মদ। তারপর বলে,–হয়তো তাই। কিন্তু আমি তাঁকে চিরকাল বাদশাহ্-বেগমের সম্মান দেব।

—তাঁকে আপনি শ্রদ্ধা করেন দেখছি।

—মানুষ হয়ে তাঁকে শ্রদ্ধা করতে না পারাটা দুর্ভাগ্যের

—তক্ত-তাউস আর সাম্রাজ্যের কাছে মনুষ্যত্বের মূল্য কতটুকু?

মহম্মদ হঠাৎ উঠে দাঁড়ায়। আমার দিকে দুপা এগিয়ে এসে বলে, কে তুমি?

।—সামান্য এক নাজীর।

কিন্তু তোমার কথাবার্তা তো ঠিক নাজীরের মতো নয়। তোমার পোশাক তেমন নয়।

মনে মনে ভাবি, আমি না হয় জাহানারাই হলাম মহম্মদ, কিন্তু পাশেই ওই থামের আড়ালে কোয়েল দাঁড়িয়ে রয়েছে। সে তো সত্যিই নাজীর। তার কথাবার্তা শুনলে এই কথাই বলতে।

—কথা বলছ না? মহম্মদের স্বরে অধৈর্য। নবীন যুবক। ধৈর্য একটু কম হবেই।

—আমি জাহানারা বেগমের নাজীর। তাই হয়তো আমার কথাবার্তায় তাঁর কথার ছাপ রয়েছে। আমার পোশাকও তাঁরই রুচি অনুযায়ী।

—তোমার মুখের ওড়না একটু তুলবে?

বুক কেঁপে ওঠে,–কেন শাহজাদা?

—মুখ দেখব।

সেই একই গলার স্বর, যা শুনেছিলাম ছত্রশালের মুখে। ছি ছি। কেন যে মিথ্যে পরিচয় দিতে গেলাম।

—না শাহজাদা, আমি যাই। ডেকে দিই বাদশাহ্-বেগমকে।

মহম্মদ সহসা আমার হাত চেপে ধরে বলে,—কিন্তু তারপরে আমার সঙ্গে দেখা করবে। তুমি সুন্দরী, তুমি বুদ্ধিমতী—নাজীর কী চিরকালই থাকতে হবে?

কী করব ভেবে পাই না। সেই সময়ে কোয়েল সামনে এসে আমাকে ধমক দিলেও চলে যাবার পথ পেতাম। ছি ছি। কেন যে মরতে পরিচয় গোপন করতে গিয়েছিলাম। পরিচয় যখন গোপন করলাম, তখন কেন যে বড় বড় কথা বলতে গেলাম। ছি ছি।

—ছেড়ে দিন শাহজাদা। পরে দেখা করব।

—ঠিক?

—ঠিক।

—ভুল কোরো না লক্ষ্মীটি। মুঘল-হারেমে প্রাণ বলে কোনও পদার্থ নেই। তাই যেখানে প্রাণের সন্ধান পাই, সেখানে আমি চাতক পাখির মতো ছটফট করি। ভুলো না।

মহম্মদ আমাকে ছেড়ে দিতেই ছুটে পালিয়ে যাই। বেচারা, আমার বয়সটাও অনুমান করতে পারল না। করবেই বা কী করে। হাত দুটো যেন সেই আগের মতোই রয়েছে। মুখে চিন্তার ছাপ পড়লেও হাত নিটোল। বেচারা। আওরঙজেবের পুত্র হয়ে প্রাণের সন্ধান করে বেড়াচ্ছে। জীবনে শান্তি পাবে না। তক্ত-তাউসও পাবে না। মানুষের সূক্ষ্মগুণে ভরপুর হৃদয় নিয়ে বাদশাহ হবার দিন চলে গিয়েছে মুঘলবংশ থেকে।

পরিচ্ছদ পরিবর্তন করে নিই তাড়াতাড়ি। মুখে নিয়ে আসি কৃত্রিম গাম্ভীর্য। তারপর ধীর গতিতে এগিয়ে যাই সেই একই ঘরে। এবারে ওড়নার কোনও বালাই নেই। কিন্তু হাত দুখানা ভালভাবে ঢাকা।

আমাকে দেখেই মহম্মদ উঠে দাঁড়ায়।

—তুমি মহম্মদ? আমার স্বর যতটা পারি ভারী করি।

—হ্যাঁ। হেসে এগিয়ে এসে সে আমাকে অভিবাদন করে।

—বোসো। বহুদিন পরে তোমাকে দেখলাম।

—আপনাকে আমি দেখলেও, আমার মনে নেই। অথচ আজ মনে হচ্ছে আপনি আমার কত পরিচিত বাদশাহ্-বেগম।

—এ নামে ডাকতে কে বললে?

—এ-নামে আমি চিরকাল ডাকব।

—তোমার বাবা সন্তুষ্ট হবেন না নিশ্চয়

—তা হবেন না বটে।

—তবে? তোমার নিজের ভবিষ্যৎ নেই?

—নিজের সততা আর বিবেককে বিসর্জন দিয়ে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ আমার কাম্য নয়।

—ভুল করছ মহম্মদ। আফশোস হবে।

—আমাকে চিনতে আপনি বোধ হয় ভুল করছেন বাদশাহ্-বেগম

হেসে বলি,—না। শুধু একটু পরীক্ষা করছিলাম মহম্মদ। বাদশাহ্ শাহজাহান এখন আওরঙজেবের শত্রু। সে হিসাবে আমিও তার শত্রু। কারণ আমি পিতার কাছে রয়েছি। তবু তোমাকে আমি পুত্রের মতোই দেখি। তোমার মনের পরিচয় পেয়ে বড় আনন্দ হল।

মহম্মদ আমার সামনে নতজানু হয়ে বসে আমার হাত দুটি তার দুহাতে তুলে নিয়ে কপালে ঠেকায়। আমি তার পিঠে সস্নেহে হাত রেখে বলি,—উঠে বোসো মহম্মদ

মহম্মদ আসন গ্রহণ করে। একটু পরেই সে চঞ্চল হয়ে ওঠে। বলে,—কিন্তু আমার তো অপেক্ষা করা চলে না। তাড়াতাড়ি না ফিরলে আপনাদের পানীয় জলের মীমাংসা হবে না। দেরি করলে হয়তো পিতা সন্দেহ করবেন।

—সে কি প্রথম থেকেই সন্দেহ করছে না?

—নিশ্চয়ই করছেন। কিন্তু সন্দেহ আরও গাঢ় হয়ে দেখা দেবে। এর পরিণাম অশুভ হতে পারে। আমি যাই।

—বাদশাহের সঙ্গে দেখা করবে না?

—আবার আসব।

—সে উঠে দাঁড়ায়। একটু ইতস্তত করে। চারিদিকে চায়। গোপনে হাসি আমি। এ চাহনির অর্থ জানি।

—কিছু বলবে মহম্মদ?

—না। আপনার একজন নাজীর দেখলাম। সে কোথায়?

—কেন তাকে কী প্রয়োজন?

মহম্মদ রক্তিম হয়ে ওঠে। কোনওরকমে বলে,—সুন্দর কথা বলে সে।

—হ্যাঁ। কোয়েল বুদ্ধিমতী।

—কোয়েল? নামটিও সুন্দর তো।

—ডাকব তাকে?

—ডাকুন।

ডাকতেই কোয়েল সামনে এসে হাজির হয়। মুখে তার ওড়না ছিল না। বয়স প্রৌঢ়ত্বের সীমা স্পর্শ করেছে।

মহম্মদ সজোরে ঘাড় নেড়ে বলে,—না, না। এ নয়। অন্য কেউ।

আর তো কোনও নাজীর নেই মহম্মদ। অন্যদের নাজীর এদিকে একজনও আসে না। বিস্ময়ভরা চোখ নিয়ে মহম্মদ বলে,—কিন্তু আমি যে দেখলাম। আর কেউ আছে? নাজীর ছাড়া?

—কেউ নেই।

—সে কী? সে কিন্তু বললে, সে আপনারই নাজীর।

কোয়েল ধীরে ধীরে বলে,—আমি জানি।

আমরা দুজনা একসঙ্গে ঘুরে কোয়েলের দিকে চাই। সে আমার কথা বলে দেবে নাকি?

মহম্মদ প্রশ্ন করে, —কে?

গম্ভীর হয়ে কোয়েল উত্তর দেয়,—নূরজাহান বেগম।

চমকে ওঠে মহম্মদ। আমি কিছু বলার আগেই কোয়েল বলে ওঠে,—আমি হিন্দু। আমি বিশ্বাস করি। আমি দেখেছি তাঁকে। জেসমিন প্রাসাদের আশেপাশে।

মহম্মদের মুখে ভাষা নেই। স্থির হয়ে আমাদের দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সে। শেষে বলে, কিন্তু আমি যে তাকে স্পর্শ করেছি।

—স্পর্শ? তাকে তুমি স্পর্শ করতে যাবে কেন মহম্মদ?

—ছোঁয়া লেগেছে তার দেহের সঙ্গে।

কোয়েল বলে,—অমন হয়। মনের ভুল। আপনি তখন সচেতন ছিলেন না শাহজাদা।

গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে মহম্মদ ধীরে ধীরে চলে যায়।

সে চলে যেতেই কোয়েলের দিকে মুখ ফিরিয়ে বলি,—ব্যাপার কী কোয়েল? সত্যিই দেখেছ? হেসে ফেলে কোয়েল! বলে, —না। আপনার আর শাহজাদার লজ্জা ঢেকে দেবার জন্যেই মিথ্যেটুকু বলতে হল। হারেমের সব নাজীরদের জড়ো করলেও আপনার মতো অমন একজনও খুঁজে পাওয়া যাবে কি? রোশনারা বেগমের হাতও কি এত সুন্দর? তাই সুন্দরী নূরজাহানকে চোখে দেখতে হল।

—তোমার অতিবুদ্ধির জন্যে আমি একদিন বিষ দিয়ে হত্যা করব।

—সেদিনের জন্যেই অপেক্ষা করছি শাহজাদী।

কোয়েলের হাসির মধ্যে দুঃখ ঝরে পড়ে।

.

মহম্মদ চলে যাওয়ার পর প্রচুর পানীয় জল আসে। তবু আওরঙজেব নিজে আসেনি। সে তেমনিভাবে কিছুদিন শিবিরে অপেক্ষা করে রইল।

তারপরই ঘটে গেল সেই ভয়াবহ ঘটনা যা বাদশাকে স্তব্ধ করে দিল। শোক প্রকাশের শক্তিটুকুও আর তাঁর রইল না। আমিও যেন পাথর হয়ে গিয়েছি নইলে দারার ছিন্নশির দেখে ভেঙে তো পড়লাম না। একটু চমকে উঠেছিলাম মাত্র। এই জাতীয় একটা কিছুর জন্যে আমার মন যেন প্রস্তুত ছিল—কদিন আগে আর পরে।

আওরঙজেব জানত, বাদশাহের কাছে এই ছিন্নশির ভেট পাঠাবার একান্ত প্রয়োজন ছিল। কারণ দারার মৃত্যুর পর ময়ুরাসনের ওপর যে-কেউ দাবি করুক তিনি আপত্তি করবেন না। সে জানত, দারাকে হত্যা করা যেতে পারে, কিন্তু বাদশাহকে হত্যা করলে সারা ভারতে দাবানল জ্বলে উঠবে। পরিণামে তক্ত-তাউসে বসার কল্পনা ধোঁয়ার মতো মিলিয়ে যাবে।

বুদ্ধির খেলায় আওরঙজেবই জয়ী হল। দুর্বুদ্ধির কাছে শুভবুদ্ধি অনেক সময়ই এইভাবে পরাজয় বরণ করে। পরমাত্মীয়ের রক্ত নিয়ে যে হোলি খেলতে শুরু করেছে তার সঙ্গে কে পেরে উঠবে?

মনে পড়ে যায় নাদিরার কথা, সুলেমান, সিপার আর তাদের বোন জানির কথা। বড় দুর্ভাগ্য নিয়ে জন্মেছিল তারা! মনে পড়ে রানাদিল্ আর উদীপুরী বেগমের কথা। কোথায় তারা কে জানে। হয়তো সব সংবাদই পাব যখন শেষ হয়ে যাবে সব। কারণ একথা আমি জানি, আত্মীয়ের রক্ত নিয়ে যারা মারাত্মক খেলায় মত্ত হয়, তারা জানে না কোথায় থামতে হবে। শুনলাম ধান্দরের অধিপতি মালিক জিওয়ান দারাশুকোকে ধরিয়ে দিয়েছে। এককালে দারা ওকে মস্ত বিপদ থেকে বাঁচিয়েছিল। কৃতজ্ঞতা জানাবার এর চাইতে ভাল পথ আর ছিল না জিওয়ানের। আওরঙজেব ঘোষণা করল দারা ‘রাফিজী’–তাই তাকে হত্যা করা হয়েছে। প্রজারা তাই বুঝল। দারার মৃত্যুর চাঞ্চল্য স্তিমিত হয়ে যেতে দুদিনও লাগল না।

তারপর খাজুয়ার প্রান্তর। বীর সুজা সদলবলে সেখানে আওরঙজেবকে শক্তি পরীক্ষায় আহ্বান করল। যুদ্ধের গতি দেখে আওরঙজেবের মুখের রঙ বিবর্ণ হল। সুজার অসির প্রতিটি আঘাতে ময়ূরাসনের স্বপ্ন ভাঙতে শুরু করল। অস্থির হয়ে উঠল আওরঙজেব। শেষে সেখানেও মিলল খলিলুল্লা, শায়েস্তা আর নাজির খাঁয়ের দলের লোক। আলীবর্দী খাঁ। সুজার একান্ত বিশ্বাসী সে। অথচ অর্থ আর প্রতিপত্তির মোহে আওরঙজেবের দলে ভিড়ল। জয় যখন সুজার করায়ত্ত তখন আলীবর্দীর সর্বনাশা পরামর্শের জন্যে পরাজয় বরণ করতে হল তাকে। ভাঙা দলবলের কয়েকজনকে নিয়ে ভাঙা মনে সুজা পালিয়ে গেল। জয়ী হতে হতেও পরাজয়ের কালিমা তার মুখ কলঙ্কিত হল। ইতিহাসের পাতায় এ সব কথা নিশ্চয়ই লেখা থাকবে।

আর লেখা থাকবে সরল মুরাদকে বন্দি করে গোয়ালিয়র দুর্গে নিক্ষেপ করার জঘন্যতম কৌশল। নিদ্রিত ছিল নিজের শিবিরে মুরাদ। সবে যুদ্ধ শেষ হয়েছে। তাই সুখ-স্বপ্নে বিভোর ছিল সে। তবু কোমরের অসি কোমরেই ছিল তার। চিরকালের অভ্যাস। নিদ্রিত মুরাদের সামনেও নিজে এগিয়ে যেতে সাহস পায়নি বিজয়ী আওরঙজেব। নিজের চার বছরের শিশুপুত্র আজীমকে মোহরের লোভ দেখিয়ে পাঠিয়ে দিল মুরাদের কোমর থেকে তলোয়ারখানা চুরি করে আনতে। হঠাৎ জেগে উঠলেও শিশুকে দেখে বিন্দুমাত্র সন্দেহ জাগবে না মুরাদের মনে।

শিশু কৃতকার্য হল। ঘুম ভাঙল না মুরাদের। সেই অবসরে হাত-পা শৃঙ্খলিত হল। সুখস্বপ্ন ভেঙে গেল তার। চোখ মেলে সব কিছু দেখে শুধু একটা তীব্র ঘৃণার দৃষ্টি নিক্ষেপ করল আওরঙজেবের দিকে। কোনও কথা বলেনি সে।

গোয়ালিয়র দুর্গে বেশিদিন জীবিত থাকতে পারেনি মুরাদ। ভালই হয়েছে। প্রতিদিন খাবারের সঙ্গে বিষ দিয়ে অন্যান্য আত্মীয়দের মতো তিলে তিলে মারেনি তাকে। সঙ্গে ছিল তার পরমাসুন্দরী যুবতী সরসুন বাঈ। সেই সরসুন বাঈ তার মৃত্যু ত্বরান্বিত করল। দুর্গ থেকে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করতেই সে তাকে সঙ্গে নিয়ে যাবার জন্যে চিৎকার করে ওঠে। প্রহরীরা জেগে ওঠে। ফলে ধরা পড়ে যায় মুরাদ। এর পরই এক বিচারের প্রহসন বসে। কবে কোন্ যুগে গুজরাটে এক রাজপুরুষকে সে হত্যা করেছিল। তারই ফলে শাস্তি হয় প্রাণদণ্ড। চমৎকার বিচার।

সুজাও শেষ পর্যন্ত নিজেকে বাঁচাতে পারেনি। সুদূর আরাকানে তার জীবন শেষ হল। আওরঙজেব নিষ্কণ্টক।

এবার আসবে সে বৃদ্ধ শাহজাহানের কাছে। শুধু বৃদ্ধই বললাম। কারণ বাদশাহ্ শাহজাহান আর কী করে বলি? তবু আওরঙজেব চতুর! পিতাকে অসহায় জেনেও তাঁর কাছ থেকে তক্ত-তাউসে বসার অনুমতি চাইবে।

আগ্রার দুর্গের দ্বারে দ্বারে নতুন প্রহরী। পরীক্ষার জন্যে কোয়েলকে বাইরে পাঠাই। সে ফিরে এল। বাইরে যাবার হুকুম নেই। বুঝলাম শাহজাহান বন্দি। সেই সঙ্গে আমিও। এখানে এসে উপস্থিত হবার আগেই আমাদের স্বাধীনতাটুকু কেড়ে নিয়েছে আওরঙজেব।

কোয়েল কাঁদে। কেঁদে কী হবে? চলে যেতে বলি তাকে। যেতে চায় না সে। শেষ পর্যন্ত আমাদের দুর্ভাগ্যের সঙ্গে নিজের ভাগ্যকে বেঁধে রাখতে চায়। অদ্ভুত নারী।

ধূসর আকাশ। তাজমহলের শুভ্রতা মলিন বলে প্রতিভাত হয়। বাতায়নে সর্বনাশা-সংবাদ- বহনকারী কপোতটি দূরের এক বুনো পায়রাকে দেখে একমনে ঘুরে ঘুরে ডাকতে শুরু করেছে। সে নিশ্চিত জানে, তার এই নাচ আর ডাক বুনো পায়রাটিকে মুগ্ধ করে কাছে ডেকে আনবে। সুন্দর এদের মন। কোনও ঘটনাই দাগ কেটে যায় না সেখানে। স্মৃতি বলে কোনও কিছুর বালাই নেই এদের। শুধু বর্তমান নিয়ে ব্যস্ত।

বর্তমান নিয়ে আমি বাঁচতে পারতাম না। পাগল হয়ে যেতাম। অতীতের দুঃখ স্মৃতিগুলো ছিল বলেই সেগুলোকে রোমন্থন করে সময় কাটিয়ে দিই। ভুলে যাই আমি বন্দি। ভুলে যাই এক বৃদ্ধ ঠিক পাশেরই কক্ষে তার জীবনের সব গৌরব থেকে বঞ্চিত হয়ে মৃত্যুর অপেক্ষায় সময় গুণছে। তার হাতে আপেলের সুঘ্রাণ আজও আছে কিনা জানি না। না থাকাই ভাল। তবু সাহস করে সেই শীর্ণ হাতখানা তুলে নিয়ে ঘ্রাণ নিতে পারি না। বৃদ্ধ আছে বলেই এখনো আমার নিজের বেঁচে থাকার একটা ক্ষীণ অর্থ খুঁজে পাই। কিন্তু যে মুহূর্তে ওই বুকের ওঠা-নামা বন্ধ হয়ে যাবে—যে মুহূর্তে ওই দুর্বলতম দেহের স্পন্দন স্তব্ধ হবে, সেই মুহূর্তে আমার বেঁচে থাকারও যেন কোনও অর্থ খুঁজে পাওয়া যাবে না। তাই নিশ্ছিদ্র অবসরের অপরিসীম ক্লান্তিকে উপেক্ষা করে ক্ষতবিক্ষত মন নিয়ে দিনে রাত্রে বার বার পাশের ঘরে গিয়ে দাঁড়াই। সন্তর্পণে এগিয়ে গিয়ে দেখি, বৃদ্ধ জীবিত না মৃত। কখনো নিমীলিত চক্ষু দেখে কেঁপে উঠি একটু কেশে উঠি তখন। চোখের পাতা খুলে যায় বৃদ্ধের। একটা নিস্পৃহ দৃষ্টি নিয়ে আমার দিকে ফিরে তাকান ক্ষণিকের তরে। তারপরই আবার চোখ বন্ধ করেন। আমার উপস্থিতি তাঁর মনে এখন কোনও আশা কোনও আনন্দই আর জাগাতে পারে না।

এমনি একদিনে আওরঙজেব এল। বিজয়ী সে। দুর্লভ ময়ূরাসনের অধিকারী। কিন্তু বিজয়ীর মতো বুক ফুলিয়ে সে প্রবেশ করতে পারল না প্রাসাদে। দূর থেকে দেখলাম, কেন যেন তার মাথা নত হয়ে এল। পদক্ষেপেও একটা ইতস্তত ভাব। নিজেকে অপরাধী বলে ভাবছে কি। কৃতকর্মের জন্যে কী সে অনুতপ্ত? না, না। আর ভুল করব না। অভিনয়ে দক্ষ আওরঙজেবের পক্ষে সব কিছুই সম্ভব।

পিতার কক্ষে প্রবেশের পূর্বে সে আমার দর্শনপ্রার্থী হয়। অনিচ্ছা সত্ত্বেও এগিয়ে যাই। সামনে গিয়ে দাঁড়াই।

—জাহানারা! আওরঙজেবের চোখ দুটো কী সত্যি চিক্ চিক্ করে উঠল?

চুপ করে অপেক্ষা করি।

—জাহানারা, আমি ঘোরতর পাপী।

মনে মনে হাসি। সে ভেবেছে, তাকে আমি অভিশাপ দেব, তিরস্কার করব। সেই তিরস্কারে তার ভারাক্রান্ত মন হাল্কা হয়ে উঠবে। সে সহজ হবে। অতটা নির্বোধ আমি নই। যে দুর্দমনীয় চাপে তার মনে ধীরে ধীরে অশান্তি দানা বেঁধে উঠছে সে চাপ ভেতরে ভেতরে চিরকাল তাকে অস্থির করে রাখুক। অন্যায় থেকে সে জীবনে কখনো সরে আসতে পারবে না জানি। সজ্ঞানে একটার পর একটা অন্যায় সে করে যাবে। তার ওই রক্তাক্ত হাত আরও লাল হয়ে উঠবে—যার পরিণামে অশান্তি তাকে রাহুর মতো গ্রাস করবে।

—জাহানারা আমি অপরাধী।

—তুমি বৃদ্ধ শাহজাহানের সঙ্গে দেখা করতে চাও?

—হ্যাঁ, কিন্তু তার আগে—

—আদেশ করো। আমি নিয়ে যাচ্ছি।

—এ কী জাহানারা, তুমি এভাবে কথা বলছ?

—শাহজাহান যে সময়ে বাদশাহ্ ছিলেন, তখন তাঁর সঙ্গে এভাবেই কথা বলতাম বাদশাহ্। আজকাল আদব-কায়দার পরিবর্তন হলেও আমি তা জানতে পারিনি। কারণ আমি বন্দি।

—কে বলে তুমি বন্দি?

কোনও সুযোগ দিই না কথার ওপর কথা বলতে। তাই নিজের বন্দিত্ব প্রমাণ করতে তৰ্ক জুড়লাম না।

সে আবার বলে ওঠে—কে বলে তুমি বন্দি?

—বৃদ্ধ ওই ঘরে শুয়ে রয়েছেন। এসো।

স্তব্ধ আওরঙজেব আমাকে অনুসরণ করে।

আনুষ্ঠানিকভাবে যে শাহানশাহ্’ উপাধি অনেক আশা নিয়ে বহুদিন পূর্বে গ্রহণ করেছিলেন শাহজাহান, আজই তার শেষ দিন। আজ আওরঙজেব তার অভিনয়ের পরাকাষ্ঠা দেখাবে এক রক্তাক্ত হৃদয়ের মৃত্যুপথযাত্রী বৃদ্ধের সম্মুখে। কৌতূহল যে আমার হয় না একেবারে, এ-কথা বলতে পারি না।

নতজানু হয়ে আওরঙজেব বৃদ্ধের শয্যার পাশে বসে পড়ে। চোখে তার অশ্রু। সে শাজাহানের ডানহাতখানা উঠিয়ে চুম্বন করে। বৃদ্ধের চোখ তবু খোলে না। আজকাল আর ঘাড় ফিরিয়ে যখন তখন তাজমহলের দিকে চেয়ে থাকেন না। হয়তো দৃষ্টিশক্তি দ্রুত ক্ষীণ হয়ে এসেছে। চোখে পড়ে না তাজমহল।

—আপেলের গন্ধ যদি না পাস জাহানারা, বলিস না। খবরদার বলিস না।

কান্না পায় আমার। আওরঙজেবকে আমি বলে ভুল করেছেন পিতা। চেয়ে দেখে শিউরে উঠল আওরঙজেব। রোশনারার মুখে নিশ্চয়ই সে শুনেছে আপেলের বৃত্তান্ত।

চোখ বন্ধ করেই তিনি বলে চলেন,—জাহানারা। এপারে শ্বেতশুভ্র তাজমহল, ওপারে রক্তবর্ণ সমাধি। কৃষ্ণবর্ণ সেতু মৃত্যুর মতো দুই সমাধিকে যোগ করে দিয়েছে।

আওরঙজেবের মুখ বন্ধ। সে একবার অসহায়ভাবে আমার দিকে চায়। সে অধৈর্য হয়ে ওঠে। বাইরে তার অনেক কাজ পড়ে রয়েছে।

ধীরে ধীরে ডাকি, —বাবা।

—রাগ করিস না জাহানারা। যেকথা বলেছিলাম, স্বপ্নের ঘোরে বলেছিলাম। আমি আর কল্পনা করি না। পৃথিবীকে আওরঙজেবের মতোই দেখতে চেষ্টা করি। রঙচঙে দেখি না আর। দেখছিস না, তাজমহল চোখে পড়বে বলে ভয়ে চোখ বন্ধ করে থাকি?

—বাবা, আওরঙজেব এসেছে।

—কে?

—আওরঙজেব।

চোখ খুলেই নিজ পুত্রকে দেখতে পান তিনি। একদৃষ্টে চেয়ে থাকেন। যেন কত অচেনা ধীরে ধীরে অদ্ভুত হাসিতে ভরে ওঠে মুখ। শীর্ণ হাতখানা তাড়াতাড়ি বুকের ওপর নিয়ে গিয়ে বুকখানা খুলে দেবার চেষ্টা করতে করতে বলেন,—শত হলেও এককালে বাদশাহ্ ছিলাম আওরঙজেব। দাদার মতো মাথা কেটে ফেলো না। এইখানে, এই বুকের ওপর বসিয়ে দাও।

অধীর আগ্রহে তিনি চেয়ে থাকেন—অপেক্ষা করেন।

আওরঙজেব আরও নত হয়। শেষে সে শয্যার ওপর মাথা রেখে কাঁদতে থাকে।

—না, না। আর ওসব অভিনয়ের প্রয়োজন কী? শেষ করে দাও। জাহানারার কথা ভাবছ বুঝি? সে সব দেখবে? ওকেও শেষ করে দাও। মিটে যাক। ওর জীবনও বড় বেশি টেনে-হেঁচড়ে চলছে। কিছুই মনে করবে না। মনে করবি জাহানারা?

—না বাবা।

—আমরা প্রস্তুত আওরঙজেব।

—হত্যার জন্যে আমি আসিনি পিতা। ক্ষমা চাইতে এসেছি। যদিও জানি, এ-কথা আজ আমার মুখে বিদ্রূপের মতো শোনাচ্ছে। কারণ আমি অপরাধী। মুঘল-বংশের ওপর যে অভিশাপ রয়েছে, আপনার মতো আমিও তা কাটিয়ে উঠতে পারিনি।

আওরঙজেব থামে।

শাহজাহান বলেন,—তারপর?

তাঁর কথার ধরনে আমি চমকে উঠি। যেন কোনও রূপকথার গল্প শুনে যাচ্ছেন তিনি। আওরঙজেব থেমে গেল বলে আরও শোনার জন্যে বায়না ধরেছেন। কৌশলে আওরঙজেব উল্লেখ করেছে সে সিংহাসন লাভের পথে তাঁরও অসি আত্মীয়ের রক্তে সিক্ত হয়েছিল! কিন্তু তাতে বিন্দুমাত্র বিচলিত হননি তিনি। তিনি বরাবরই জানতেন সিংহাসন লাভ করতে না পারলে তাঁর নিজের জীবন অনিবার্যভাবে বিপন্ন হত। কারণ নূরজাহান তখন ছিলেন ক্ষমতার অধিকারিণী। অসীম প্রতিপত্তি ছিল তাঁর। যেটুকু রক্তপাত ঘটেছে তখন, তা রোধ করা যেত না। তাই বলে আত্মীয়তার সূত্র ধরে আওরঙজেবের মতো একের পর একজনকে গোয়ালিয়র দুর্গে নিক্ষেপ করে খাদ্যের সঙ্গে বিষ মিশিয়ে দেননি। নিজের পুত্র ছাড়া বাকি সবাইকে হত্যা করেননি। শিশু কিংবা রমণীর কোনও ক্ষতিই তিনি করেননি। আর সবার চেয়ে বড় কথা এই যে, নীচতা আর হীনতা তাঁর মনে স্থান পায়নি।

আওরঙজেব বুঝতে পারে তার কৌশল ব্যর্থ হয়েছে। তাই আবার ঢোক গিলে বলে, —ছেলেবেলা থেকে আমি অবহেলিত। যার হাতে আমি গড়ে উঠেছি শিক্ষার নামে এক উদারতাহীন অশিক্ষা সে আমার মনে গেঁথে দিয়েছে। এর ফলে এক আপসহীন মুসলমান আমার ভেতরে অবিরত কাজ করে যাচ্ছে। সে অন্য কোনও ধর্মকে সহ্য করতে পারে না। সে মুসলমান ধর্মেও কোনও শিথিলতা সহ্য করতে পারে না। তাই দারাশুকোকে আমি বেঁচে থাকতে দিতে পারিনি।

—তুমি মহানুভব, আওরঙজেব। মুসলমানরা যুগে যুগে তোমার কীর্তিগাথা গাইবে।

—বাদশাহ্, জানি আজ আমি আপনার বিদ্রূপের পাত্র। তবু ক্ষমা চাইতে এসেছি। তবু অনুমতি নিতে এসেছি ভারতের শাসনভার গ্রহণের পূর্বে। শত অপরাধ করলেও আপনি চাইবেন না—মুঘল ছাড়া অন্য কেউ দিল্লির তক্ত-তাউসে বসুক।

—ও! ক্ষমা চাইতে এসেছো? জাহানারা, আওরঙজেব ক্ষমা চাইতে এসেছে। ক্ষমা করি, কী বলিস? ক্ষমা করলাম আওরঙজেব।

শাহজাহানের মুখের কথার ধরনে আওরঙজেবের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যায়। সে আমার দিকে চায়। আমার মুখে কোনও সমর্থন সে খুঁজে পায় না। তাই আবার বাদশাহের দিকে মুখ নিয়ে কিছু বলতে যেতেই বাদশাহ্ তাকে থামিয়ে দিয়ে বলেন,–হাঁ হাঁ, আমি জানি। শাসনভারের অনুমতি তো? জাহানারা, আমি অনুমতি না দিলে বেচারা তক্ত-তাউসে বসতে পারছে না। অনুমতি দিই, কী বলিস? অনুমতি দিলাম আওরঙজেব।

কিছুক্ষণের জন্যে আওরঙজেব স্থাণুর মতো বসে থাকে। বুঝতে পারি চেষ্টা করেও সে নড়তে পারছে না। দরজার বাইরে তার দেহরক্ষীরা সম্ভবত অপেক্ষা করছে। ভেতরে শুধু সে একা—আর তার কোষবদ্ধ অসি। কিন্তু সে অসি দিয়ে আত্মরক্ষার ক্ষমতা তার নেই।

আমার বুকের ভেতরে লুকোনো রয়েছে তীক্ষ্ণধার ছুরিকা। আওরঙজেবের আগমন সংবাদ পেয়েই আমি লুকিয়ে রেখেছি। এতক্ষণেও তার শীতলতা দেহের উত্তাপে নষ্ট হয়নি। গোয়ালিয়র দুর্গে এখনো আমার হতভাগ্য ভাইদের কোনও পুত্র হয়তো জীবিত আছে। সেখান থেকে নিয়ে এসে এখনো ময়ূরাসনে বসিয়ে দেওয়া যায়! যদি সবাই জানতে পারে, শাহজাহানের তাই অভিলাষ—কেউ আপত্তি করবে না। শাহজাহানকে দর্শনের জন্যে আগ্রার দুর্গদ্বার সবার কাছে খুলে দেব। তারা নিজের চোখে দেখে যাবে তাঁকে। শুনে যাবে আওরঙজেবের বিশ্বাসঘাতকতার কাহিনী। নজরৎ, খলিলুল্লা, শায়েস্তা খাঁ, আলীবর্দীর সব চক্রান্ত এক মুহূর্তে ব্যর্থ হয়ে যাবে।

আমার বুক কাঁপতে থাকে। অস্ত্রের শীতলতা শরীরে কাঁপুনি ধরায়। সামনে আওরঙজেব বসে—নিশ্চেষ্ট। আমার ভাই আওরঙজেব। প্রাণের টানে এই ভাই একদিন দক্ষিণভারত থেকে ছুটে এসেছিল আমাকে দেখতে। আজ তার কী পরিণতি!

তড়িৎগতিতে ছুরিকা বার করে আওরঙজেবের সামনে ধরি। সে বিহ্বল। কোষের অসি টেনে বার করার অবসর পায় না। চিৎকার করতে পারে না। সে জানে, চিৎকারের চেষ্টা করলে এই তীক্ষ্ণ অস্ত্র বক্ষ ভেদ করবে। অস্ত্রবিদ্যায় আমার পারদর্শিতার কথা তার অজানা নয়।

—আওরঙজেব, দিল্লির তক্ত-তাউসে কোনও রমণী বসলে বেশ হয়। তাই না?

শাহজাহান নির্বাক। আওরঙজেব কাঁপতে থাকে। আমার কব্জির জোরের পরিচয় সে আগে অনেক পেয়েছে। আমি যদি রোশনারা হতাম, এক ঝটকায় এতক্ষণে সে সরিয়ে দিত। কিন্তু আমার দাঁড়াবার ভঙ্গি ছিল নিখুঁত।

—জাহানারা! আওরঙজেবের কণ্ঠস্বর ভগ্ন। তার সব আশা সব আকাঙ্ক্ষার সমাধি। মনে মনে আফশোস করছে সে। এমন আফশোস জীবনে আর সে করেনি।

একটুও নড়বার চেষ্টা করো না আওরঙজেব। হাত দুটো ওইভাবেই যেন শয্যার ওপর থাকে।

—তুই ওকে মেরে ফেলবি জাহানারা? মেরে কী হবে? ছেড়ে দে চলে যাক। ছত্রশালের মুখ মনের মধ্যে ভেসে ওঠে। এই অবস্থায় পড়লে আওরঙজেবের মতো সে কখনো সঙ্কুচিত থাকত না। হেসে উঠত সশব্দে। নারীকে সে কখনো আক্রমণ করেনি। কিন্তু আঘাত না করেও নিজেকে বাঁচাবার ক্ষমতা সে রাখত। আওরঙজেবও কম শক্তিমান নয়। কিন্তু তার অপরাধ-বোধ তাকে দুর্বল করে তুলেছে।

—ভেবে দেখ বাবা, তোমার সব পুত্রের হত্যাকারী এই আওরঙজেব। তোমার বংশের সবার মৃত্যুর কারণ।

—জানি রে জানি। তবু ছেড়ে দে। আমি তো জানি তক্ত-তাউসের ওপর তোর কোনও লোভই নেই। জীবনে তোর একটি আশাই ছিল। সে আশার প্রদীপ নির্বাপিত

আওরঙজেব সকৃতজ্ঞ নয়নে পিতার দিকে চেয়ে থাকে। তার দৃষ্টিতে অনুনয় ঝরে পড়ে।

—আওরঙজেব, কৌশল আর হীনতার দ্বারা অনেক কিছুই করা যায়। কিন্তু সব মানুষ সে পথে চলতে পারে না। চললে, এই পৃথিবী হয়ে উঠত শয়তানের রাজত্ব। মসজিদে আজান-ধ্বনি শুনতে পেতে না তাহলে। ফকির সাহেবরা সংসার ছেড়ে পথে পথে ঘুরে বেড়াতেন না। তাজমহলেরও সৃষ্টি হত না। বেহেস্ত-এর ছোঁয়া পায় বলেই পৃথিবীতে আজও মানুষ আশায় বুক বেঁধে বেঁচে আছে—আজও শিল্পী বেঁচে আছে, সাহিত্য বেঁচে আছে। শুনলাম, একদল গায়ক তাদের বাদ্যযন্ত্রগুলো কবরস্থ করেছে। তুমি খুব আনন্দ পেয়েছ। বলেছ, কবর থেকে যেন না তোলা হয়। ভালই বলেছ। তোমার মতো মানুষের বোধহয় প্রয়োজন আছে। তোমাদের কার্যকলাপের ফলেই মানুষ উপলব্ধি করতে পারে সততা কী, মনুষ্যত্ব কী, শিল্প কী।

—আমায় ক্ষমা করো জাহানারা।

—ক্ষমার প্রশ্ন এখানে উঠছে না। কেন উঠছে না সেকথা তুমি জানো। তবু একটি খবর জেনে নিতে চাই। নাদিরা কোথায়?

—মারা গিয়েছে। আমার হারেমে আসতে চায়নি। নিজে জোর করে মরেছে।

—জানতাম। রানাদিল?

—সে-ও। রূপ ছিল তার অফুরন্ত। সেই রূপের কথা আমি উল্লেখ করায় নিজের ওপর নিজে সে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। ছোরা দিয়ে ক্ষতবিক্ষত করল নিজের মুখ, নিজের বুক।

—শুনছ বাবা? রানাদিল।

—হ্যাঁ। তাইতো পথ থেকে তুলে আনতে বাধা দিইনি।

—উদীপুরী বেগম?

—আমার হারেমে। সুখে আছে সে।

—সুখে থাক।

—ছুরিকা নিক্ষেপ করি কক্ষের এক প্রান্তে। ঝনঝন করে শব্দ হয়। সমস্ত প্রাসাদ যেন কেঁপে ওঠে—কেঁপে ওঠে সারা ভারতবর্ষ। এতক্ষণ যেন কোটি কোটি হৃদয় অপেক্ষা করছিল চরম একটা কিছু দেখবার জন্যে। কিন্তু তাদের আশায় ছাই ঢেলে দিয়ে আমি ছুরিকা নিক্ষেপ করলাম। আওরঙজেব ছুটে গিয়ে সেটি নিজের হাতের মধ্যে চেপে ধরে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সে। তার চোখ-মুখে ফুটে ওঠে নিশ্চিন্ততা।

শয্যার সামনে এগিয়ে গিয়ে বলে,—আমি চলি বাবা।

—হ্যাঁ। এসো। তবে পাহারার ব্যবস্থাটা একটু শক্ত করবে। কারণ জাহানারাকে ঠিক বিশ্বাস নেই। অনেক কিছুই করতে পারে। এই মাত্র যা দেখাল, আমি চমকে গিয়েছিলাম। তোমার এত সাধের তক্ত-তাউস-। এসো।

মাথা নিচু করে আওরঙজেব।

আমি প্রশ্ন করি,—আবার আসবে নাকি আওরঙজেব?

—আসব। ইতিমধ্যে বাবার সময় কাটাবার জন্যে কিছু পশু পাঠিয়ে দেব। তাদের লড়াই দেখবেন।

—দেখতে পারবেন কি?

—নিশ্চয়ই পারবেন। ওঁকে ধরে নিয়ে গিয়ে বাইরে বসালে দেখতে পারবেন। সব রকম পশুই পাঠাব। বাঙলার বাঘও থাকবে।

মনে মনে জানি, ওভাবে পিতাকে বাইরে নিয়ে যাওয়া কতখানি অসম্ভব। তবু মুখে বলি, —ধন্যবাদ।

আওরঙজেব বাইরে যাবার সময় ইশারায় আমাকে ডাকে। বিস্মিত হই। এত কিছুর পরেও এসে স্থির। শুধু একটু কুণ্ঠার আভাস ছাড়া আর কিছু নেই তার মুখে। কাছে সে বলে,—জাহানারা, তোমার ওপর আমার বিন্দুমাত্রও রাগ হচ্ছে না। রোশনারা আমার জন্যে অনেক করেছে। কিন্তু তুমি আমার শ্রদ্ধেয়া। তুমি আমার বন্দি নও। তুমি স্বাধীন। কিন্তু পিতার সঙ্গে যতদিন আছো, ততদিন—।

—আমি বুঝেছি আওরঙজেব।

—আমাকে ভুল বুঝো না বোন।

চুপ করে থাকি। সে চলে যায়।

সে যাবার অনেক পরে কোয়েলকে একবার দুর্গদ্বারে পাঠাই। ফিরে এসে খবর দেয় প্রহরীর সংখ্যা দশগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।

আওরঙজেবকে চিনতে এখন আর একটুও ভুল হয় না।

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *