৮
দারার ইচ্ছাই পূর্ণ হল। শায়েস্তা খাঁ, মীরজুমলা, খলিলুল্লা খাঁ আর নজরৎ খাঁয়ের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হল। আমি যেন দিব্য চক্ষে দেখতে পাই তাদের শিবিরে আনন্দের হিল্লোল। এতক্ষণে শরাবের নদী বয়ে যাচ্ছে সেখানে।
আগ্রা আর মাত্র একদিনের পথ। বাদশাহ্ আবার অসুস্থ বোধ করতে শুরু করলেন। তাঁর দেহের একদিক ধীরে ধীরে অবশ হতে লাগল। হয়তো দারার নেতৃত্ব বরণের সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর সেই বিস্ময়কর মনের জোরে ভাঁটার টান শুরু হয়েছিল। ভয় হয় আমার। আর একটা দিন যেন তিনি ভাল থাকেন।
দারা প্রস্তুত হয়ে বাদশাহের কাছে বিদায় নিতে এলে তিনি বললেন,—মানুষকে অবিশ্বাস করা হয়তো পাপ দারা, কিন্তু এই পৃথিবীতে বিরাট দায়িত্ব যাদের মাথায় এসে পড়ে, সূক্ষ্ম বিচার করে চলতে হয় তাদের। নইলে জীবনে প্রতি ক্ষেত্রেই ব্যর্থ হতে হয়। বাস্তব বুদ্ধি দিয়ে সব কিছু বিচার করে চলবে। তাতে যদি অতি বিশ্বস্ত বলে যাকে জান, তাকেও অবিশ্বাস করতে হয় করবে। দোষের কিছু নেই।
—ঠিক বুঝতে পারলাম না। আপনি কি শায়েস্তা খাঁ, দেওয়ান মীরজুমলার মতো মানুষকেও অবিশ্বাস করতে বলেন?
—নির্দিষ্টভাবে কাউকেই অবিশ্বাস করতে বলি না। তেমন কিছু দেখলে নিজের পুত্রকে ও অবিশ্বাস করতে হয়। দেখতেই তো পাচ্ছ।
দারার ভ্রু কুঞ্চিত হয়। সে বাদশাহের কথায় আঘাত পেয়েছে। নিজের পুত্রদের কথা হয়তো ভাবছে।
আমি তাড়াতাড়ি বলে উঠি,—হ্যাঁ, শায়েস্তা খাঁ, মীরজুমলা—এদেরও অবিশ্বাস করতে হবে, তেমন দেখলে।
—নারীর উপযুক্ত কথাই বললে জাহানারা।
—নারী এর চেয়েও কঠিন কথা বলতে পারে, যদি সে দেখে পুরুষ পৃথিবীর মাটির ওপর না দাঁড়িয়ে নিজের চিন্তাধারায় ভেসে বেড়াচ্ছে।
তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে সে বলে ওঠে—তোমার উপদেশ মনে থাকবে বাদশাহ্-বেগম।
—মনে থাকলেই মঙ্গল। নইলে মুঘল-ইতিহাসে এমন কিছু ঘটে যাবে, যার ফল হয়তো স্বয়ং বাদশাকে ভোগ করতে হবে। মনে থাকলেই মঙ্গল। নইলে এ-ই বোধহয় তোমার সঙ্গে আমার শেষ কথা।
ধন্যবাদ। দারা চলে যায়।
বাদশাহ্ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলেন, আমারও সেই ভয় জাহানারা। ইচ্ছে ছিল, ওকে নিজের সঙ্গে রাখব। একা যেতে দেব না। কিন্তু কেন যেন অনুমতি দিয়ে ফেললাম। তারপর থেকেই অসুস্থ বোধ করছি।
—আগ্রায় পৌঁছে একটু বিশ্রাম নিলেই সুস্থ হয়ে উঠবেন বাবা।
আগ্রায় পৌঁছে বাদশাহ্ আরও অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তাঁকে কোনও রকমে কেল্লায় নিয়ে গিয়ে শয্যায় শুইয়ে দেওয়া হল। আমার মন স্থির হয়ে ওঠে। একটা ঘোর অমঙ্গলের ছায়া যেন সমস্ত দেশকে আচ্ছন্ন করছে।
দারা এগিয়ে গিয়েছে। সুলেমানশুকো সুজাকে পরাস্ত করে ফিরে আসছে। তার কাছে বার্তা পাঠানো হয়েছে, সে যেন সোজা গিয়ে দারার সঙ্গে মিলিত হয়ে তার শক্তি বৃদ্ধি করে। তবু কেন যেন ভরসা পাই না। কারণ দারার সঙ্গে রয়েছে কয়েকটি সাপের মতো খল লোক, যাদের প্রভাব সে কাটিয়ে উঠতে পারবে কি না জানি না।
এই সময়ে যদি রাজা থাকত। তার কী হয়েছে জানি না। কোনও বিপদ না হলে এতদিন সে নিশ্চয়ই আসত। অভিমানে আমার চোখে জল আসে। বিপদ হলে একটা সংবাদও কি দিতে নেই।
.
চোখের জল মুছে ফেলে বাদশাহের শয্যার কাছে গিয়ে দাঁড়াই। তিনি আমাকে লক্ষ করেন না। তিনি চেয়ে রয়েছেন বাতায়নের দিকে—যে বাতায়নপথে দেখা যায় দূরের তাজমহলকে। বাদশাহের চোখে অশ্রু। অস্ফুটস্বরে তিনি ক্রমাগত উচ্চারণ করে চলেছেন,–মমতাজ, মমতাজ, মমতাজ—
এখানে এসে অবধি তাজমহলের দিকে ভালভাবে চাইবার অবসর আমি পাইনি। আজ বাদশাহের দৃষ্টি অনুসরণ করে সেদিকে চাই! স্তব্ধ তাজমহল। দুঃখভারাক্রান্ত তাজমহল। তার মর্মরের প্রতিটি বিন্দুতে শোকের ছাপ। তাজমহল কাঁদছে।
—জাহানারা! চিৎকার করে ওঠেন বাদশাহ্।
—এই যে বাবা।
—ওঃ, তুই এখানে। দেখছিস জাহানারা, তোর মা কাঁদছে আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। কোনও কথা বলি না। সযত্নে বাদশাহের চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে স্থান ত্যাগ করি।
প্রাসাদ শিখরে উঠে সামনের দিকে চেয়ে থাকি। এখান থেকে রাস্তা চোখে পড়ে। পথের দিকে চাইলে যেন দেশকে অনুভব করা যায়। লোকের যাতায়াত আগের মতোই রয়েছে। কিন্তু কেমন যেন থমথমে ভাব। আগ্রা প্রায় আগের মতোই রয়েছে, কিন্তু কে যেন তার প্রাণটিকে সযত্নে তুলে নিয়ে কোথায় রেখে এসেছে। দেখলে মনে হয় মৃত-নগরী।
দূর থেকে একদল অশ্বারোহী ছুটে আসে দেখতে পাই। তাদের চেনা যায় না, অথচ তাদের মধ্যে একজনের দেহের গঠন দেখে মনের মধ্যে তোলপাড় করে। হে আল্লা, সে যেন হয়। তাকে আমার বড় প্রয়োজন।
অশ্বারোহীরা দুর্গের দ্বারদেশে এসে থেমে যায়। এবারে চিনতে পারি। আনন্দে চিৎকার করে উঠতে ইচ্ছে হয়। ছুটে নীচে নামি। সিঁড়ির যেন শেষ নেই। এত সিঁড়ি আগে তো কখনো ছিল না।
নীচে নামতেই একজন খোজা এসে বলে,—ছত্রশাল দর্শনপ্রার্থী।
—এখনি তাকে নিয়ে এসো। আমি অপেক্ষা করছি পাশের ঘরে।
প্রহরী চলে যায়। অধীর আগ্রহে আমার বুক ওঠা-নামা করে। নিজেকে মনে হয় সেই কত বছর আগের কিশোরী। হাসব, না কাঁদব বুঝতে পারি না। বুঝতে পারি না অভিমানে ঠোঁট ফুলিয়ে থাকব কি না। হয়তো এ বয়সে সেটা শোভা পাবে না। কিন্তু রাজার কাছে কি আমার বয়স বেড়েছে? আমার কাছে তো ও তেমনিই আছে। খোজার সম্ভ্রমসূচক আহ্বান কানে আসে। সে কক্ষের দরওয়াজা দেখিয়ে দিয়ে থেমে যায় বাইরে। ছত্রশাল ভেতরে প্রবেশ করে।
একি! এত রোগা হয়ে গিয়েছে? দূর থেকে তো বুঝতে পারিনি একটুও। চোখের কোণে কালি পড়েছে। নির্বাক দৃষ্টিতে ওর মুখের দিকে চেয়ে থাকি। সব ভুলে যাই। ভুলে যাই প্রাসাদের অন্য কক্ষে বাদশাহ্ অসুস্থ হয়ে পড়ে আছেন। ভুলে যাই দারাশুকো আওরঙজেবের বিরুদ্ধে অভিযান করেছে। ভুলে যাই মুরাদও এগিয়ে আসছে—আওরঙজেব তাকে কৌশলে দলে টেনেছে। সব ভুলে যাই।
—রাজার ওষ্ঠ নড়ে ওঠে। কিন্তু শব্দ বের হয় না। আমি ছুটে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরি। আর পারি না। ভেঙে পড়ি কান্নায়। ছত্রশাল আমাকে চেপে না ধরলে তার পায়ের কাছে পড়ে যেতাম।
বহুক্ষণ পরে ছত্রশাল ধীরে ধীরে প্রশ্ন করে, কবে এমন হল?
—কী হল রাজা?
—বাদশাহের মৃত্যু?
চমকে উঠি। দূরে সরে যাই। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলি,–কোথায় শুনলে একথা?
—নিজের রাজ্য থেকে শুরু করে আগ্রা পর্যন্ত—সব জায়গাতেই।
—আমিন খাঁ আবার নোংরা খেলা শুরু করেছে। আর এবারে সফলও হয়েছে।
—বাদশাহ্ তবে মৃত নন?
—না। তিনি অসুস্থ।
ছত্রশালকে চিন্তান্বিত দেখায়। বলে,—আজ থেকে বিশ্বস্ত লোক দিয়ে প্রচার শুরু করো যে তিনি বেঁচে আছেন। নইলে যুদ্ধ ছাড়াই আওরঙজেব জিতে যাবে।
—তুমি ব্যবস্থা করো।
—আমি পারতাম। কিন্তু এখানে অপেক্ষা করলে তো আমার চলবে না। শাহজাদা দারাশুকোর পাশে গিয়ে আমাকে দাঁড়াতে হবে।
—তুমি এখানেই থাকো রাজা! আমার পাশে।
—ক্ষমা করো জাহানারা। তোমার এই একটি অনুরোধ শুধু আমি রাখতে পারলাম না। যুদ্ধের সময় বুন্দীরাজের স্থান বাদশাহের পাশে। এখন দারাশুকো বাদশাহের প্রতিনিধিত্ব করছেন। তাঁকে ছেড়ে থাকতে পারি না।
ছত্রশাল আমার মাথায় ধীরে ধীরে হাত বুলিয়ে দেয়। যেন ঘুম পাড়িয়ে দেখে এখুনি। আমি কোনও প্রতিবাদ করতে পারি না। সে যা বলেছে তার চেয়ে সত্যি কথা তো কিছু হতে পারে না। তবু ওকে অপ্রস্তুত করার লোভ সংবরণ করতে পারি না। বলি,—আমার কোন্ অনুরোধ তুমি রেখেছ? কপোত পাঠিয়ে তোমার জন্যে প্রতিটি মুহূর্ত অপেক্ষা করেছি। তুমি এলে না। একটা সংবাদও পাঠালে না।
—আমি অসুস্থ ছিলাম জাহানারা। তুমি তো জানো, তোমার ডাকে সাড়া না দিয়ে আমি পারি না।
—কপোতটিকে ফিরিয়ে দিতে পারতে খবর সমেত।
—ভেবেছিলাম তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠে নিজেই দেখা করব।
—আমি এদিকে ভেবে মরি।
—তোমার শরীরও তো ভাল নেই জাহানারা।
—সূর্য যে আমার মাত্র একটি রাজা। সেই সূর্যের উদয় না হলে কি সূর্যমুখী বাঁচে? রাজা আবার আমাকে জড়িয়ে ধরে। তার বুকের মধ্যে মুখ লুকিয়ে আমি তার দ্রুত হৃদস্পন্দন শুনে যাই।
.
রাজা চলে যাবে। চলে যাবে চম্বল নদীর তীরে, যার অপর পাড়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে আওরঙজেবের সৈন্যবাহিনী।
কেন যেন মনে হয় রাজা আর ফিরবে না। ভাগ্যদেবী আজকাল পাপীদের প্রতিই বেশি প্রসন্ন। রুস্তম খাঁ, রামসিংহ, দায়ুদ খাঁ আর ছত্রশালকে নিয়ে দারাশুকোর যে বিরাট বাহিনী, বীরত্বে সমস্ত পৃথিবীকে কাঁপিয়ে দিতে পারে। কিন্তু অন্যদিকে রয়েছে সেই পাপীর দল—যারা বুক ফুলিয়ে সামনে না দাঁড়িয়ে পেছন থেকে ছুরি চালায়। এদের হীনতা আর চতুরতা বীরেরা তাদের উদার হৃদয় নিয়ে সব সময় ধরতে পারে না। পারলে শুধু ছত্রশাল আর দায়ুদ খাঁ-ই পারবে। তারা বীর আবার এই সঙ্গে তীক্ষ্ণবুদ্ধির অধিকারী। কিন্তু দারা শুকোকে তারা কতখানি প্রভাবিত করতে পারবে জানি না বলেই আমার ভয়।
আমার প্রকোষ্ঠে বসে রাজাও সেই কথা বলল। তার ভয় খলিলুল্লা খাঁকে। দারা এখনো তাকে বিশ্বাস করে অন্ধের মতো। রাজার অনুরোধে আমি দারাকে একখানা পত্র লিখে দিই। ছত্রশালের সঙ্গে যুদ্ধ-সংক্রান্ত আরও বহু বিষয় নিয়ে আলোচনা করার পর হাঁপিয়ে উঠি। মনে হয় আজই শেষ দিন। এরপর হয়তো রাজার উষ্ণ সান্নিধ্য জীবনে আর কখনো পাব না। তাড়াতাড়ি কথার মোড় ঘুরিয়ে বলি,—আমার কপোতটিকে তো ফেরত দিলে না।
—সেটি আমার সঙ্গেই রয়েছে। তুমি পাবে না।
—কেন?
—বলব?
—বলো।
—যুদ্ধক্ষেত্রে কপোতটিকে নিয়ে আমার বিশ্বস্ত অনুচর আমাকে অনুসরণ করবে।
—কেন?
—তোমাকে শেষ সংবাদ দেবার জন্যে।
—শেষ সংবাদ?
—হ্যাঁ। আমি জানি, আমাকে হত্যা করার জন্য নজরৎ খাঁ সব আয়োজনই করে রেখেছে। সে তা পারত না, যদি আমি বারবার শাহজাদার সঙ্গে থাকতাম। কিন্তু সে সুযোগ পেয়েছে নজরৎ। অবিশ্যি আমার সামনে এলে তার নিস্তার নেই। কিন্তু সামনে সে আসবে না। সাহস নেই। যদি আমি নিহত হই জাহানারা, আমার অনুচরটি তোমার কপোতের গায়ে আমার রক্তের ছোপ লাগিয়ে ছেড়ে দেবে। তুমি বুঝতে পারবে রাজা আর নেই।
—উঃ!
—শুনতে খারাপ লাগে জাহানারা। কিন্তু এর চেয়ে তাড়াতাড়ি আর কেউ তো এসে তোমাকে দুঃসংবাদ দিতে পারবে না।
কী উত্তর দেব। কিছুই বলার নেই।
—জাহানারা। রাজার স্বর আবেগ-কম্পিত। সে একেবারে আমার কাছটিতে এগিয়ে আসে।
কত সময় চলে যায় জানি না। শেষে দেখি বাইরে দিনের আলো ফিকে হয়ে এসেছে। সন্ধ্যার একটি মাত্র তারা আকাশে জ্বলজ্বল করছে।
—চলো রাজা।
—কোথায়?
—তাজমহলে।
দুজনা হাত ধরাধরি করে তাজমহলে প্রবেশ করি। আজ আর কোনও লজ্জা, কোনও সংকোচ আমাকে বাধা দিতে পারল না। আমাদের এ সম্পর্ককে বাদশাহ্ অনুমোদন করেছেন। হয়তো এভাবে প্রকাশ্যে যাওয়াতে আমার সম্মান কিছুটা নষ্ট হল, কিন্তু সম্মান ফিরে পাবার অনেক সুযোগ আসবে। আজকের এই সুযোগ জীবনে না-ও আসতে পারে।
মায়ের সমাধির পাশে গিয়ে দাঁড়াই দুজনা। স্তব্ধ পবিত্রতা বিরাজ করছে সেখানে। বাতিগুলি সমাধির চারপাশে নিঃশব্দে পুড়ে চলেছে। রাজা মাথা নত করে। হিন্দুর ছেলে সে। দেখে মনে হয় ঠিক যেন মায়ের আশীর্বাদ মাথা পেতে নিচ্ছে। সুন্দর লাগে দেখতে। নয়ন ভরে দেখে নিই ওকে।
—এই মুহূর্তে এই বিরাট তাজমহলের শ্বেতমর্মর প্রচণ্ড শব্দ করে একসঙ্গে ভেঙে পড়তে পারে না রাজা?
—লাভ কী? এ মৃত্যুতে তো বীরত্ব নেই।
—তা নেই বটে। কিন্তু দুজনা একসঙ্গে মরতে পারতাম।
—না। তুমি বেঁচে থাকো জাহানারা।
—বড় স্বার্থপর তুমি।
রাজা হাসে। দুষ্টুমি করে বলে,—বেশ ভেঙে পড়ুক তবে। এমন একটি সৌন্দর্য পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাক।
রাজার মুখ চেপে ধরে বলি,—ভয় নেই। অক্ষয় হয়ে থাকবে তাজমহল। এর প্রকৃত শিল্পী এক অসাধারণ পুরুষ।
—দেখেছ তাঁকে?
—হ্যাঁ।
—কেমন দেখতে?,
—ঠিক তোমার মতো
—আমার মতো এই এতবড় দেহ শিল্পীর?
অনেকক্ষণ ভেবে, শেষে হতাশ হয়ে বলি,—তা তো মনে নেই। কিন্তু তার চোখদুটি ঠিক তোমার চোখের মতো।
—তাকে ভালবেসেছিলে বুঝি?
—খুব। কত বছর আগেকার কথা। তোমার নামও শুনিনি তখন। এই শিল্পীকে বোধহয় হৃদয় দিয়ে ফেলেছিলাম।
—ভাগ্যবান সে।
—না, ভাগ্যাহত সে। আমার ভালবাসায় অভিশাপ আছে রাজা।
—না। তোমার ভালবাসায় আশীর্বাদ রয়েছে জাহানারা।
—সান্ত্বনা দিচ্ছ।
—একটুও না। আমার যা বিশ্বাস তাই বলছি। শিল্পীর কী বিশ্বাস ছিল জানি না।
—সে আমার পরিচয় জানত না রাজা। শুধু একবার একটু সময়ের জন্যে দেখেছিল। রাজাকে সব কথা খুলে বলি।
রাত হয়।
মৌলবী এক হাতে বাতি নিয়ে দূর থেকে ধীরে ধীরে সমাধির দিকে এগিয়ে আসেন। তিনি আমাদের দিকে না চেয়ে সমাধির পাশে সযত্নে রক্ষিত কোর- আন খুলে বসেন
—মৌলবী সাহেব।
মুখ তুলে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আমাদের দিকে চান তিনি।
—আমরা রয়েছি, অসুবিধা হবে না?
—আমি তো জানতাম না মা তোমরা রয়েছ।
—আমাদের দেখতে পাননি?
—না। খেয়াল করিনি।
অবাক হই। তাঁর সৌম্য মুখের দিকে চেয়ে মন শ্রদ্ধায় ভরে ওঠে। তাজমহলের উদ্বোধনের দিনের কথা মনে হয়। ঠিক আগের মতোই চেহারা রয়েছে—বিশেষ পরিবর্তন হয়নি। পৃথিবীতে রাজত্ব পেলে বাদশাহ্ শাহজাহানের মতো দ্রুত চেহারার পরিবর্তন হয়। কিন্তু তারও ওপরের রাজত্বের সন্ধান পেলে বয়স আর চেহারা যেন নিজেদের কাজ করতে ভুলে যায়।
—আমাদের আশীর্বাদ করুন।
—আমার আশীর্বাদের প্রয়োজন কী? এখানে যিনি রয়েছেন তাঁর আশীর্বাদই তো যথেষ্ট। পাশাপাশি তোমাদের দুজনকে দেখে তিনি বুঝতে পেরেছেন—আশীর্বাদ করেছেন। কিন্তু তোমরা কে? এই সময়ে এলে কী করে?
একটু ইতস্তত করি। চিনতে পারেননি তিনি শাহানশাহ্ শাহজাহানের দুহিতাকে। কী করেই বা চিনবেন? তাঁর জগতে তিনি একা—একচ্ছত্র। সেখানে বাদশাহেরও কোনও মূল্য নেই।
—আমি জাহানারা।
তিনি অনেকক্ষণ একদৃষ্টে আমার দিকে চেয়ে থাকেন। ধীরে ধীরে তাঁর মুখ পবিত্র হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে,—মায়ের কাছে এসেছ। খুব ভাল করেছ। ইনি কে? ও, বুঝেছি।
লজ্জা পাই। অপাঙ্গে রাজার দিকে চেয়ে দেখি তার চোখে কৌতূহল।
—এঁকে আশীর্বাদ করুন মৌলবী সাহেব। ইনি কাল প্রত্যুষে যুদ্ধযাত্রা করছেন।
—তুমি কি পার্থিব সুখের জন্যে আশীর্বাদ চাইছ জাহানারা? তবে ভুল করেছ মা।
ছত্রশাল তাড়াতাড়ি বলে ওঠে—না, পার্থিব সুখ নয়। সুখ বলতে আপনি যা বোঝেন, তাই চাইছি।
মৌলবী আনন্দিত হন। প্রসন্ন দৃষ্টিতে রাজার দিকে চেয়ে বলেন,—তার অর্থ যে দুঃখ।
আমরা চুপ করে থাকি।
মৌলবী ধীরে ধীরে বললেন,– তোমাদের মনকে আমি জানতে পেরেছি। খাঁটি প্রেম মানেই তো দুঃখ। এই যে ইনি শায়িত রয়েছেন এখানে—মনে হয় কত দুঃখের। তোমাদের দুজনকে আশীর্বাদ করলাম জাহানারা।
বুকের ভেতর আমার কেঁপে ওঠে। কিন্তু রাজা উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। সে আমার হাত ধরে। আমি তাড়াতাড়ি মায়ের সমাধি থেকে একটি তাজা ফুলের মালা তুলে রাজার সঙ্গে বাইরে যাই
নির্জন উদ্যান। আকাশে অসংখ্য নক্ষত্র। আমি রাজার গলায় মালা পরিয়ে দিই।
রাজার চোখ চিকচিক করে ওঠে। সে বলে,–এ মালা আমার গলায় থাকবে জাহানারা।
—আর তো দেখা হবে না।
—না কাল ভোরেই চলে যাব।
মনে মনে ভাবি, রাজা যদি বাদশাহ্ হত? আর আমি যদি তার বেগম হতাম, আজ সারারাত তাকে জড়িয়ে ধরে থাকতাম। কিন্তু উপায় নেই। হারেমে সে থাকতে পারে না। আমিও হারেমের বাইরে যেতে পারি না রাত্রে। এই শেষ। হয়তো শেষ বিদায়। রাজার নরম চুলে ভর্তি মাথা দু হাত দিয়ে নামিয়ে এনে আমার বুকের মধ্যে চেপে ধরি।
ইতিহাস আমি লিখছি না। ইতিহাস লেখার জন্যে অনেক গুণী কলম উঁচিয়ে অপেক্ষা করছেন। শাহানশাহ্ শাহজাহানের রাজত্বকালের সব ঘটনাও তাঁরা নিশ্চয়ই দিনের পর দিন লিখে যাচ্ছেন। তাঁর রাজত্বের শেষের দিকের এই অশান্তির কথাও হয়তো বাদ যাবে না। যদি ঘোর অমঙ্গল কিছু তাঁর জন্যে অপেক্ষা করে, নিঃসন্দেহে তাও টুকে রাখবেন এঁরা। তারপর শাহজাহানের দিন ফুরিয়ে যাবে একদিন। তক্ত-তাউসে নতুন বাদশাহ্ এসে বসবেন। কে সেই নতুন বাদশাহ্ কেউ জানে না এখন। কিন্তু একদিন জানবে। তখন তাঁর জয়গান, তাঁর কীর্তি কাহিনিও লেখা শুরু হয়ে যাবে। সত্যি-মিথ্যা অনেক কিছুই মিশানো থাকে এসব লেখায়। তবু মূল্য রয়েছে এর। কারণ মোটামুটি সব ঘটনাই তাতে বিবৃত থাকে।
আমার লেখার কোনও মূল্যই নেই। নিজের খুশিমতো যা যখন মনে আসে লিখি। এই লেখা যদি কয়েক যুগ পার হয়ে কারও হাতে গিয়ে পড়ে, সে আমার নিজস্ব চিন্তাধারারই পরিচয় পাবে পাত্র। আর কিছু নেই।
তবু লিখে চলি। না লিখে থাকতে পারি না। সেই কবে কৈশোর আর যৌবনের সন্ধিক্ষণে পিতার কাছ থেকে দুখানা কিতাব পেয়ে অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম—তাঁর কথা শুনে মুগ্ধ হয়েছিলাম। ভেবেছিলাম আমিও বুঝি মুঘল বিদূষীদের একজনের মতো হতে পারব। আজ এতদিন পরে বুঝতে পারছি আশার মরীচিকার পিছনে ছুটেছি শুধু। হয়তো আমি বিদূষী। কিন্তু প্রতিভার ছিটেফোঁটাও নেই আমার মধ্যে। থাকলে এমন স্বার্থপরের মতো লিখতে পারতাম না। আমি বুঝতে পারি, এ লেখায় আমার অন্তরের আর বাইরের জ্বালাই শুধু প্রকট হয়ে উঠেছে। ব্যক্তি থেকে সমষ্টিতে সঞ্চারিত হবার মতো কোনও গুণই এ রচনার নেই। তবু থামতে পারি না। অনেক দিনের পুরোনো অভ্যাস যে।
রাজা বিদায় নেবার পর কয়েকদিন হয়ে গেল। যুদ্ধক্ষেত্রের সংবাদ নেই কোনও। শুনেছি সামুগড়ে প্রচণ্ড সংঘর্ষ শুরু হয়েছে। আর শুনেছি মুরাদ আওরঙজেবের পক্ষ হয়ে লড়ছে।
নিজের ঘরে এসে শত চেষ্টা সত্ত্বেও চোখে জল আসে না। বুকের ভেতরে আনচান করে, অথচ চোখ শুকনো। শয্যায় উপুড় হয়ে বালিশে মুখ গুঁজে কত দুঃখ, কত কষ্টর কথা ভাবি। তবু কান্না আসে না। নারীর পক্ষে মাঝে মাঝে চোখের জল ফেলতে না পারা যে কতখানি দুঃসহ, নারী ছাড়া সে কথা আর কে বুঝবে?
বাইরে বেলা বাড়তে থাকে। একটু পরেই খাবার নিয়ে আসবে ঘরে। এখনো স্নান হয়নি। নহরী-বেহেস্ত-এর মতো কৃত্রিম কল্লোলিনী এখানকার কোনও কক্ষের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়নি। তবু এখানকার জল গায়ে দিলে প্রাণ জুড়োয়। আমার ছেলেবেলাকার অনুভূতি মনের মধ্যে জেগে ওঠে।
শয্যা ছেড়ে উঠতে গিয়ে আবার শুয়ে পড়ি। ভাল লাগে না কিছু। পৃথিবীর কোনও কিছুতে আর আকর্ষণ নেই। কেন যে ভবিষ্যতে রাজার পরশ লাভের আশায় বুক বাঁধতে পারছি না। মন ডেকে বলছে, এ আশা নয়—দুরাশা। মৌলবীর কথাই ঠিক। খাঁটি প্রেম মানেই দুঃখ
চোখে জল আসে এতক্ষণে। কী শান্তি! কোথায় ছিল এই জলরাশি! যমুনা কী শুকিয়ে গিয়েছিল।
বাইরে শুনতে পাই কোনও খোজার পদশব্দ। আমার দরজার পাশে এসে থেমে যায়। কাকে যেন সে ঘর অবধি পৌঁছে দিল। নতুন কে আসবে? হয়তো রোশনারার নাজীর কিংবা অন্য কেউ। তাকাই না আমি। এভাবে আমাকে দেখলে আসতে সাহস পাবে না।
যদি রাজা হয়? পর্দা তুলে হয়তো আমার দিকে চেয়ে রয়েছে। এখনি ছুটে এসে অনায়াসে সে আমার দেহখানাকে তুলে ধরবে। না, না। কী ভাবছি? এ যে অসম্ভব।
পর্দা ছেড়ে দেবার মৃদু শব্দ হয়।
মনে হয় বহুদূর থেকে কে যেন ডাকে—শাহজাদী।
নারী কণ্ঠ। নিজের যুক্তিতর্ককে পরাস্ত করে যে অবাধ্য প্রদীপটি এখনি মনের মধ্যে জ্বলে উঠেছিল, সেটি দপ্ করে নিভে যায়। রাজা নয়।
—শাহজাদী। কণ্ঠস্বর গাঢ় এবারে।
এ সম্বোধন কে করবে? আমি যে অনেক বছরের বাদশাহ বেগম। কণ্ঠস্বর ঠিক পরিচিত নয়, অথচ খুবই চেনা। বুঝতে পারি না।
দৃষ্টি ফেরাই দরওয়াজার দিকে। সাদা ওড়নায় ঢাকা মুখ।
—কে তুমি?
—আমায় চিনলেন না শাহজাদী? আমি তো চিনেছি আপনাকে।
—তোমায় আমি খুব চিনি। অথচ—
ধীরভাবে থেমে থমে সে বলে—বলেছিলাম আপনার দুঃসময়ে আবার ফিরে আসব। তাই এসেছি। আমি কোয়েল।
—কোয়েল! তুমি! আমাকে তুমি বিশ্বাস করতে বলো যে তুমি ফিরে এসেছ? না, না। তুমি কোয়েলের প্রেতাত্মা। কিংবা আমি স্বপ্ন দেখছি।
—আমি সত্যিই কোয়েল শাহজাদী।
—তোমাকে আমি ধরতে পারব? তোমার গায়ে হাত দিয়ে তোমাকে আমি স্পর্শ করতে পারব? বলো কোয়েল।
—এই তো আপনার গায়ে হাত দিলাম।
—কী আশ্চর্য! যখন নিজের লোক একে একে পর হয়ে যাচ্ছে তখন এত বড় ব্যতিক্রম কেন হল কোয়েল? তুমি যে আমার নিজের লোক। তোমার সুখের জন্য তোমাকে ছেড়ে দিয়ে আমার যে কত বড় ক্ষতি হয়েছে, তা যদি জানতে কোয়েল। আমি দিনের পর দিন মুখ বুজে সে ক্ষতি সহ্য করেছি। কাউকে বলিনি। আমার বুকের ব্যথা প্রতি পলে সুচ ফুটিয়েছে, তবু—।
আমাকে জড়িয়ে ধরে কোয়েল। সে তো নাজীর নয়। শখ করে আমার নাজীর হতে এসেছে। এত দুঃখেও শান্তি পাই। এভাবে আমাকে ধরার অধিকার আর শুধু একজনেরই আছে—সে এখন সামুগড়ের যুদ্ধক্ষেত্রে ছুটে বেড়াচ্ছে।
—শাহজাদী। আগে তো আপনি বিচলিত হতেন না।
—এখনও হই না কোয়েল। কিন্তু আঘাতের পর আঘাত যখন এসে হানে তখন অন্তত একজনের কাছে বিচলিত না হতে পারলে যে পাগল হয়ে যাব কোয়েল।
—শাহজাদা সুজা সসৈন্যে বাংলা ছেড়ে দিল্লি আক্রমণ করতে আসছেন শুনে বুঝলাম অঘটন কিছু ঘটেছে।-এক মুহূর্তও আর অপেক্ষা করিনি। ছুটে এসেছি। শাহজাদা পরাস্ত হয়ে পথের মাঝে সৈন্যদল নিয়ে বসে রয়েছেন। আমি পাশ দিয়ে চলে এসেছি। ভেবেছিলাম বাদশাহ্ মৃত কারণ পথে যাকে বাদশাহের কথা জিজ্ঞাসা করেছি সে-ই আকাশের দিকে হাত উঁচিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। কেমন করে এমন হল শাহজাদী?
—আমির খাঁয়ের কৌশল। সে-ই রটিয়েছে এ সব। বাদশাহ্ উত্থানশক্তি রহিত। তাঁকে যদি আগ্রা দুর্গের মাথায় এনে দাঁড় করাতে পারতাম, তাহলে ওরা বুঝতে পারত কতখানি হীন ষড়যন্ত্র তাদের প্রিয় বাদশাহের বিরুদ্ধে করা হয়েছে। কিন্তু উপায় নেই। তাঁকে তুলতে গেলেই হয়তো শেষ হয়ে যাবেন। হাকিমের আশঙ্কাও তাই।
কোয়েল স্তব্ধ হয়ে বসে থেকে আমার মাথার বিনুনি নিয়ে খেলা করে। অতীতের দিনগুলির সঙ্গে এখনকার দিন মিলিয়ে নিয়ে সে নিজের মনকে শান্ত করছে। বাধা দিই না আমি। সময় নিক সে। ধাতস্থ হোক।
পর্দা আবার দুলে ওঠে। নাজীর সসঙ্কোচে মুখ বাড়িয়ে বলে,—খানা।
আমি কিছু বলার আগেই কোয়েল বলে, —নিয়ে এসো।
নাজীরের মুখ অন্তর্হিত হয়।
—কেন আনতে বললে কোয়েল। আমার কিছু খেতে ইচ্ছে নেই।
—তবু খেতে হয় শাহজাদী। জীবনে এ এক অদ্ভুত নিয়ম। দুঃখ ভোগ করার জন্যেও খেতে হয়। সব দুঃখের জ্বালা জল হয়ে যায়।
—সে-ই তো ভাল।
—সত্যি কি তাই? আমার তো মনে হয় দুঃখ ভোগের মধ্যেও আনন্দ আছে। সে এক রক্তাক্ত আনন্দ।
মনের মধ্যে শিল্পী সম্বন্ধে প্রশ্ন করতে প্রবল ইচ্ছা জাগে, অথচ কেন যেন মুখের সামনে প্রশ্ন এসে থেমে যায়। শিল্পীকে কি আবার সঙ্গে করে এনেছে কোয়েল? এতদিন পরে নিজের সৃষ্টি দেখতে সে কি আগ্রায় ফিরে এসেছে?
—শাহজাদী।
—বলো।
—কে উনি?
চমকে উঠি। প্রশ্ন করি,—কার কথা বলছ কোয়েল?
—যাঁর কথা ভেবে আপনার দেহ-মনের এই অবস্থা?
—বাদশাহের ঘর থেকে একবার ঘুরে এসো কোয়েল। বুঝতে পারবে।
ম্লান হাসে কোয়েল। আমার বুকের ওপর হাত রেখে বলে,—তাতে কি বুক এত ফুলে ফুলে ওঠে? শাহজাদী, আমি অভিজ্ঞ।
উত্তর দেবার ভাষা খুঁজে না পেয়ে কোয়েলের হাতখানা আরও জোরে বুকের মধ্যে চেপে ধরি। যে-আগুন জ্বলছে সেখানে সে আগুনে ওর হাত দগ্ধ হবে হয়তো। তবু শীতলতার পরশে একটু আরাম বোধ করব।
—বলবেন না শাহজাদী?
—আমাকে কী এতই স্বার্থপর ভাব কোয়েল, বাদশাহের এই দুর্দিনে আমি ব্যক্তিগত কারণে বিচলিত হব?
—না। স্বার্থপরতা আপনার মধ্যে নেই। তবু দুঃখ প্রকাশের পথ এক এক ক্ষেত্রে এক এক প্রকারের। আপনি নারী, আপনাকেও কি বুঝিয়ে বলতে হবে? অভিজ্ঞতা আপনার অতটা হয়েছে কিনা জানি না; কিন্তু এ-জিনিস যে জন্মগত।
—তুমি এক আশ্চর্য নারী কোয়েল।
—না। আমি অতি সাধারণ নারী। তবে আমার মতো আপনার মনকে যাচাই করার দুঃসাহস কারও হয়নি। হলে যে-কেউ বুঝতে পারত।
আমি থেমে থেমে বলি,—ছত্রশাল, কোয়েল।
—বুন্দীরাজ?
ঘাড় নেড়ে জানাই, —হ্যাঁ।
—কতদিন?
—বহুদিন। আগ্রা ছেড়ে যাবার আগেই এক অগ্নিকাণ্ডের সূত্র ধরে।
কোয়েল নীরব। সে আমাকে প্রশ্ন করে না। সে বুঝে নিয়েছে—সব কিছু বুঝে নিয়েছে। তবু তাকে একে একে ঘটনাগুলো বলে যাই। অশ্রুসজল চোখে সে শুনে যায়। মনে হয়, যেন আমার মন, আমার হৃৎপিণ্ড তার দেহ মনে কাজ করে চলেছে। নাজীর খানা রেখে গিয়েছে। সে খানা তেমনি পড়ে থাকে। কোয়েলও অনুরোধ করতে ভুলে যায়।
শেষে আমিই ওকে সজাগ করার জন্য বলে উঠি,–অনেক তো শুনলে। এবার তোমার কথা বলো।
—আমার কথা?
—হ্যাঁ। প্রথমে বল, কীভাবে হারেমে প্রবেশ করলে? প্রহরীরা বাধা দেয়নি?
—না। তাদের মনে কোনও সন্দেহই জাগেনি। কীভাবে জাগবে? এখানকার হালচাল সবই আমার জানা।
—এবার বলো তোমার কথা।
—এখন কি আমার কথা শোনার ধৈর্য আপনার হবে শাহজাদী? সে অতি সামান্য কাহিনি।
—সামান্য? তোমার কথা সামান্য? শিল্পীর কথা সামান্য?
—আপনি মহৎ শাহজাদী।
—না। শিল্পী আমার মনের এক বিশেষ তন্ত্রীতে প্রথম ঝংকার তুলেছিল। তুমিও জানতে সে কথা। এ ক্ষেত্রে মহৎ হবার মতো নির্লিপ্ততা আমার নেই। বল কোয়েল তোমার কথা। মাথা নিচু করে কোয়েল। সেইভাবেই বসে থাকে সে বহুক্ষণ। যখন সে মাথা তোলে, মুখখানা তার জলে ভেসে যাচ্ছে। নিঃশব্দে চেয়ে দেখি আমি। কোয়েলের মুখ বন্ধ।
—শাহজাদী।
—কোয়েল।
—কিছু মনে করবেন না শাহজাদী। আমি না জেনে অতীতের মধ্যে ডুবে গিয়েছিলাম। ভুলে গিয়েছিলাম আমি আগ্রার হারেমে বসে আছি, আর সামনে রয়েছেন আপনি।
—এমন হয় কোয়েল।
—শাহজাদী, একটি দিনের তরেও সে শান্তি পায়নি।
আমার বুক কেঁপে ওঠে। সে শান্তি পাবে না জানতাম। কিন্তু এতদিন পরে সেই কথাই স্পষ্টভাবে শুনতে পেয়ে মন বিষণ্ণতায় ভরে যায়।
—শাহজাদী, সৃষ্টির ব্যর্থ বেদনায় সে মাঝে মাঝে পাগল হয়ে যেত। তখন আমাকেও চিনতে পারত না। একজন অশরীরী দেবীর সঙ্গে একমনে কথা বলে যেত। প্রথম প্রথম বুঝতাম না সে কে। পরে বুঝেছিলাম।
—কে?
—আপনি। আপনাকে সে জীবনে একটি দিনের তরেও ভুলতে পারেনি। তাকে দেখে মনে হত সে যেন স্পষ্ট আপনাকে দেখতে পাচ্ছে। সেইভাবে কথা বলে যেত। সে ভাবত আপনি ক্রমাগত অনুযোগ করে চলেছেন আপনার মূর্তি তৈরি হয়নি। সান্ত্বনা দিত তাই আপনাকে। আশ্বাস দিত। তারপরই নিজের আঙুলের দিকে লক্ষ পড়ত। উন্মাদ হয়ে যেত সে। প্রথম প্রথম মাঠ ঘাট পার হয়ে দিগন্তের দিকে ছুটে যেত সে। পেছনে পেছনে আমিও ছুটতাম। অনেক সময় সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি এইভাবে ছুটেছি। শেষে সে একসময় থমকে দাঁড়িয়ে পড়ত। সবকিছু মনে পড়ে যেত তার। আমার কাঁধের ওপর মাথা রেখে শিশুর মতো কেঁদে উঠত ফিরিয়ে নিয়ে যেতাম ঘরে।
কোয়েল থামে। আমি অশ্রুসিক্ত চোখে চেয়ে থাকি তার দিকে।
—শাহজাদী, সে যখন শান্ত থাকত, তখন সে একান্ত আমার। আমাকেও সে ভালবেসেছিল। কিন্তু পাগল হলেই আমাকে ভুলত। বড় রাগ হত আপনার ওপর। আপনার কথা যাতে মনে না হয় সেজন্যে পাগলামির উপক্রম হলেই একতাল মাটি এনে দিতাম সামনে। মাটি দিয়ে সুন্দর নারীমূর্তি গড়ে তুলত, ডান হাতের চার আঙুলের সাহায্যে। আমি সযত্নে সেগুলো শুকিয়ে রাখতাম। কিন্তু বেশিদিন রাখতে পারতাম না। লুকিয়ে সে ভেঙে টুকরো টুকরো করে ফেলত।
—কেন?
—সে চাইত পাথরের মূর্তি গড়তে, মাটির নয়। সে ভাস্কর।
—তাকে এনেছ সঙ্গে?
থরথর করে কেঁপে ওঠে কোয়েলের দেহ। আমার দিকে নির্বোধের মতো চেয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর বলে,—সে নেই।
—নেই!
—না পনেরো বছর বেঁচে ছিল। শেষে—
—শেষে?
—আত্মহত্যা করেছে।
বাদশাহ্ শাহজাহানের কথা ভুলে যাই। সামুগড়ের যুদ্ধের কথা মনে থাকে না। ছত্রশালের কথা মন থেকে অপসারিত হয় মুহূর্তের জন্যে। চোখের সামনে ভেসে ওঠে বহু বছর আগের নির্মীয়মাণ তাজমহলের পথের ওপর যমুনার ধারে দেখা এক তরুণ মুখের ছবি। সে মুখে সেদিন দেখেছিলাম আশাতীত সম্ভাবনা আর উচ্চাশার প্রতিচ্ছবি। আমার চোখের অশ্রু এবার ফোঁটা ফোঁটা—ঝরে পড়ে।
—শাহজাদী, তাকে আপনার পরিচয় দিয়েছি। সব বলেছি খুলে।
—খুব ঘৃণা হল তার তাই না?
—না। শুধু বলেছিল, আমাকে আগে বলোনি কেন? এরপর আর কথা বলতে পারেনি। বিষের ক্রিয়া শুরু হয়েছিল।
স্তব্ধ হয়ে বসে থাকি আমি। কোয়েল নীরব। দেশে গিয়েই কেন সে আমার কথা বলে দেয়নি জানি না। সেইরকমই কথা ছিল।
সেই সময়ে একজন নাজীর ছুটে আসে। বাদশাহ্ এই মুহূর্তে আমাকে ডেকেছেন। এ সময় তিনি কখনো ডাকেন না। নিশ্চয় শরীর খুব খারাপ হয়েছে।
তাড়াতাড়ি কোয়েলকে সঙ্গে নিয়ে তাঁর ঘরে প্রবেশ করি।
—কে? জাহানারা? দেখ তো একটা পায়রা এসে বড় জ্বালাতন করছে আমায়। কিছুতেই চোখ বন্ধ করতে দিচ্ছে না। বার বার মুখে পাখার ঝাপ্টা মারছে।
সমস্ত বুকখানাকে খালি করে দিয়ে আতঙ্কে চিৎকার করে উঠি,–কোথায় সে? কোথায়?
আমার চোখের সামনে সমস্ত পৃথিবী ঘুরতে থাকে। শত চেষ্টাতেও দাঁড়িয়ে থাকতে পারি না। কোয়েলকে চেপে ধরি শক্ত করে।
বাদশাকে বলতে শুনি এই তো এখানে ছিল। কোথায় গেল। কিন্তু তুই অমন ভয় পেয়ে গেলি কেন জাহানারা?
আমি কোনওদিকে তাকাতে পারি না। তাকাতেই চাই না। কী দেখব আমি জানি। পারাবতের গায়ে রক্ত মাখানো। সে রক্ত হাওয়ায় শুকিয়ে গিয়েছে। আমি জানি। আর কিছু হতে পারে না। হলে ওটি আসত না এখানে। অমন ব্যাকুলভাবে অসুস্থ বাদশাহকে উত্ত্যক্ত করে তুলত না। আমার জীবনের সব সাধ সব আনন্দ নির্মূল হল আজ। যোগ্য প্রতিশোধই নিলে নজরৎ।
কোয়েল ধীরে ধীরে বলে,–জানালায় বসে রয়েছে শাহজাদী।
কতক্ষণ কেটে যায় জানি না। বুঝতে পারি কে যেন আমার মাথায় হাওয়া দিচ্ছে। চোখ মেলে দেখি কোয়েল। বাদশাহের দিকে চাইতে পারি না। সেদিকেই যে জানালা।
—ওটি কোথায় কোয়েল?
—এখনো জানলাতেই বসে রয়েছে।
—নিয়ে এসো।
—ধরতে পারব?
—ধরা দেবার জন্যেই বসে রয়েছে। নিয়ে এসো।
কোয়েল সেটিকে এনে কাছে এসে বলে,–এর গায়ে—
—চুপ! আমার ঘরে এসো। ওটিকে তোমার ওড়নার নীচে ঢেকে রাখো।
—জাহানারা।
—পরে আসব বাবা।
—কিন্তু কী হয়েছে?
—বলছি এসে।
ঘরে এসে তাড়াতাড়ি দরজা বন্ধ করি। পায়রা তখনো কোয়েলের ওড়নার নীচে। বলে উঠি; —ওর গায়ে রক্ত, তাই না কোয়েল?
—হ্যাঁ শাহজাদী।
—আমি জানতাম।
—কিন্তু কী করে?
—সে রকমই কথা ছিল।
সব সংশয়ের অবসান। সব চিন্তার শেষ। এক গভীর দুঃখ আমার দেহ মনকে নিস্তেজ করে তোলে। মৌলবীর কথা কানে বাজে,—খাঁটি প্রেম মানেই তো দুঃখ।
—কিছুই বুঝতে পারছি না শাহজাদী।
—ছত্রশাল আর নেই। তারই শেষ রক্ত বহন করে এনেছে কপোতটি।
কোয়েল বিস্ফারিত দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে থাকে।
আমিও তোমার দলে কোয়েল। ভয় কী? আমার বুকের সঙ্গে দৃঢ়-নিবদ্ধ ছত্রশালের উপহার দেওয়া কাঁচুলি। যেন তাঁরই স্পর্শ অনুভব করছি। এ কাঁচুলি যদি আর কখনো খুলতে না হত, বেশ হত।
ছত্রশাল নেই। নেই। পৃথিবী আর তার পদভরে কম্পিত হবে না। বাতাস আর তার গানের সুরে উন্মত্ত হবে না। সবকিছুর শেষ। আমার কাছে পৃথিবী চিরকালের মতো শুকিয়ে গেল। তবু আমি বেঁচে আছি। আরও কতদিন হয়তো বাঁচব। এই কয় বছর শুধু নীরব কর্তব্যই আমার জন্যে অপেক্ষা করছে—আর কিছু নয়।
সামুগড়ের যুদ্ধ শেষ। আওরঙজেব জয়ী। দারা বিতাড়িত। ছত্রশাল আর দায়ুদ খাঁয়ের কথা সে অবহেলা করেছে। তারই ফল হাতে হাতে পেয়েছে। খলিলুল্লাই শেষ পর্যন্ত তার পরম বিশ্বস্ত অনুচরের রূপ নিয়ে সর্বনাশ করল। তারই চক্রান্তে নিশ্চিত জয় শোচনীয় পরাজয়ে রূপান্তরিত হল। প্রতিশোধ নিয়েছে খলিলুল্লা। এ প্রতিশোধ দারার বিরুদ্ধে নয়। স্বয়ং বাদশাহের বিরুদ্ধে।
দারা আর ফিরতে পারবে না জানি। পুত্র আর পরিবার নিয়ে এখন দিনের পর দিন দুর্গম পথ ভেঙে তাকে এগিয়ে যেতে হবে অজানা দেশের উদ্দেশে। জানি না কোথাও ঠাঁই পাবে কি না। ময়ূরাসনের আশা তার টুলো।
—বাদশাহ্-বেগম?
তীব্রস্বরে চমকে উঠি। চেয়ে দেখি দরওয়াজায় দাঁড়িয়ে রোশনারা। চোখ দুটো তার জ্বলজ্বল করছে। মহামূল্য পরিচ্ছদে সজ্জিত সে। বহুদিন পরে সে আমার ঘরে এল।
—রোশনারা?
—হ্যাঁ। চিনতে পারছ না?
—বাইরে যাচ্ছিস?
—হ্যাঁ। যাবে তুমি?
—না।
—এত মন-মরা কেন বাদশাহ্-বেগম?
—আমাকে তুইতো কখনো বাদশাহ্-বেগম বলে ডাকিসনি।
—আজ ডাকছি। এরপরে এ-ডাক শোনার তো সৌভাগ্য হবে না তোমার।
—ও। তা বেশ করেছিস।
—আওরঙজেব কোথায় জানো?
—না।
—আর পাঁচ ক্রোশের মধ্যে।
চমকে উঠি। এত তাড়াতাড়ি? মুখের একটা রেখাও যাতে কুঞ্চিত না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখি।
—আজ এসে পৌঁছবে বুঝি!
—হ্যাঁ। তাই তো এগিয়ে যাচ্ছি। অভ্যর্থনা করব বলে।
—যা।
—যদি বাঁচতে চাও তুমিও চলো।
হেসে বলি,—বাঁচতে আমি চাই না রোশনারা।
—ও! বিদ্রূপ ফুটে ওঠে রোশনারার কথায়। দাঁত দিয়ে সে নীচের ঠোঁট কামড়ে ধরে। তারপর এক ঝটকায় বের হয়ে যায়
সত্যিই হাসি পায় আমার। জীবন আর মৃত্যুর সীমারেখা আমার কাছে যে কত তুচ্ছ রোশনারা তা কী করে অনুভব করবে? তাই সে বিদ্রূপ করে চলে গেল। আওরঙজেব শুনবে একথা। হয়তো শাস্তিও দেবে আমাকে। কাউকে নিষ্কৃতি দেবার মতো উদারতা তার কাছ থেকে প্রত্যাশা করা যায় না। এ পর্যন্ত ভাইদের কেউ খুন হয়নি তার হাতে। হলেও বিন্দুমাত্র বিস্মিত হব না। যেভাবে দারাকে কাফের বলে ঘোষণা করে চলেছে, ভয়ই করছে আমার। তবে বাদশাহের বিরুদ্ধে কোনও কথাই বলেনি এ পর্যন্ত। বলতে বোধ হয় সাহস হচ্ছে না। দেশবাসীর ওপর শাহানশাহ্ শাহজাহানের অসীম প্রভাবের কথা ভেবে সে ভীত। সে জানে বাদশাহ্ যদি সুস্থ থাকতেন, তাহলে সারা ভারতের সৈন্যদল নিয়েও একা বাদশাহের বিরুদ্ধে সে অভিযান করতে পারত না।
কিন্তু আর তো সময় নেই। সহজে প্রাসাদে প্রবেশ করতে দেব না আওরঙজেবকে। বাধা দিতে হবে। দেখাতে হবে বাদশাহ্ অক্ষম হলেও তাঁর শক্তি একেবারে নিঃশেষিত নয়। রোশনারা যত সহজে হারেম থেকে বাইরে গেল অত সহজে তাকে আর ফিরতে দেব না। তার প্রিয়তম ভাই-এর শিবিরে দু-চারদিন কাটিয়ে অমন সোনার মতো গায়ের রঙ একটু কালো করে আসুক। বাদশাহের ঘরে গিয়ে উপস্থিত হই। তাঁর মতামতটা জানতে হবে। তাঁর অমতে কিছু করা আমার পক্ষে অসম্ভব।
সেই একইভাবে বাইরে চেয়েছিলেন পঙ্গু বাদশাহ্।
—বাবা।
—কে জাহানারা? শুনেছিস?
—হ্যাঁ বাবা।
—দারা ময়ূরাবসনের উপযুক্ত নয়। আমি বরাবরই জানতাম সেকথা। আজ সে পথের ভিখিরি হয়ে অজানার উদ্দেশে ছুটে চলেছে। আমার বুক ফেটে যাচ্ছে জাহানারা। তবু তাকে তক্ত-তাউসের উপযুক্ত বলে মনের কাছ থেকে সায় পাচ্ছি না। আমি যদি আওরঙজেবের বুদ্ধি আর দারার হৃদয় দিয়ে মেশানো একটি পুত্র পেতাম জাহানারা। তুই যদি আমার পুত্র হতিস।
—আওরঙজেব আগ্রার দুর্গ অধিকার করতে আসছে বাবা।
—সে তো আসবেই। এখানে যে আমি রয়েছি। অপমানের দিন শুরু হল জাহানারা।
—আমি বাধা দেব।
—বাধা? কী দিয়ে? লোক কই।
—যা আছে তাই দিয়ে। তাছাড়া আমাদের সুবিধা বেশি।
—বেশ। যা খুশি কর।
এত তাড়াতাড়ি অনুমতি পাব ভেবে পাইনি। কারণ প্রস্তাবটি প্রস্তাবই নয়। লক্ষ সৈন্যে বলীয়ান আওরঙজেবকে মুষ্টিমেয় কয়েকজনকে দিয়ে বাধা দেওয়া পাগলের কল্পনা। তবু বাদশাহ্ অনুমতি দিলেন শুধু আমার মুখের দিকে চেয়ে। আর দিনেল একটি ক্ষীণ সম্ভাবনা বাস্তবে রূপায়িত হতে পারে ভেবে। তাঁর ধারণা যারই সৈন্যদল হোক না কেন শাহানশাহ শাহজাহান জীবিত আছেন জানলে তাঁর বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করবে না।
—আওরঙজেবের সৈন্যদল এসে উপস্থিত হয় বিকেলের দিকে। দূর থেকে তাদের দেখে বাদশাকে খবর দিই। তিনি নিশ্চিন্তে ঘাড় নাড়েন শুধু।
প্রবেশদ্বার খোলা থাকবে ভেবেই হয়তো দ্রুত এগিয়ে আসছিল আওরঙজেব। রোশনারার কাছ থেকে এখানকার সব সংবাদ পেয়েছে সে। কিন্তু দুর্গ বন্ধ দেখে সদলবলে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে। বুঝতে পারে না, ইতিমধ্যে এমন কী ঘটেছে যার ফলে দ্বার রুদ্ধ।
আমাদের পক্ষ থেকে আক্রমণের কোনও চেষ্টাই করা হবে না। আমার নির্দেশও তাই। শুধু দেখতে হবে বাইরে থেকে একটি প্রাণীও যেন ভেতরে আসতে না পারে। আওরঙজেব সত্যিই সুচতুর, সে জানে, আক্রমণের শক্তি আমাদের নেই। তাই কোনওরকম হৈচৈ না করে তার সৈন্যদলকে দিয়ে ঘিরে বসে থাকল আগ্রার প্রাসাদ।
একদিন। দুদিন। তিনদিন।
দিন যায়। উভয় পক্ষই নিশ্চেষ্ট। এমন ফল হবে ভেবে উঠতে পারিনি। আওরঙজেব চায় আমাদের তরফ থেকে আক্রমণ আসুক প্রথমে। সে জানে, আজ হোক, কাল হোক, একদিন মরীয়া হয়ে আমরাই আক্রমণ করব। কারণ অবরুদ্ধ হয়ে থেকে রসদ ফুরোবেই একদিন।
রসদ আমাদের প্রচুর রয়েছে। কিন্তু জল নেই। জলাভাব ঘটল। দিনে দিনে তার তীব্রতা বৃদ্ধি পেল। শেষে বাদশাহের সামনে ধরে দেবার মতো জলেও অনটন দেখা দিল।
সব দায়িত্ব আমার। তাই চিন্তার বলিরেখা আমার কপালে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। নির্জনে বসে কোনও সিদ্ধান্তে আসার জন্যে প্রাসাদের ছাদের ওপর গিয়ে দাঁড়াই। ঠিক সেই সময়ে একটি তির এসে আমার পায়ের সামনে পড়ে। তিরের মাথায় একটি পত্র।
খুলে দেখি আওরঙজেব লিখেছে বাদশাহকে : দারাকে বাদশাহ্ করার অভিপ্রায় কোনও মুসলমানের ছিল না। তাই আমাকে তার বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরতে হয়েছিল। নইলে দিল্লির তক্ত-তাউসে বসার জন্যে আমার মতো সামান্য একজন ফকির লালায়িত নয় কখনই। তক্ত-তাউসে আমার প্রিয় ভাই মুরাদের জন্যে সংরক্ষিত! মুরাদ আমার সঙ্গেই রয়েছে। আপনি রাগ করে দুর্গদ্বার বন্ধ রাখবেন না। আপনার আশীর্বাদ আমাদের উভয়েরই পরম কাম্য। তাই জয়ের নেশায় উন্মত্ত সৈন্যদেরও ধৈর্য ধরতে বলেছি। জানি না কতদিন তারা আমার কথা শুনে চলবে। কারণ আপনি অসুস্থ।
চতুর আওরঙজেব। তার পত্রের ছত্রে ছত্রে চতুরতা বিচ্ছুরিত হচ্ছে। পত্রটি নিয়ে গিয়ে বাদশাকে দেখাই। ম্লান হাসেন তিনি। যে হাসির অর্থ আমি বুঝি। তাঁর কথামতো আওরঙজেবকে লিখি : তোমার শক্তির বিরুদ্ধে সামান্য একটি দুর্গ বেশিক্ষণ আত্মরক্ষা করতে পারবে না, একথা সবাই জানে। তবু দুর্গদ্বার খোলার আগে আমার কয়েকজন লোককে বাইরে থেকে পানীয় জল সংগ্রহ করে আনতে দাও। দুর্গে জলাভাব
গোপন পথ দিয়ে একজন পত্রবাহক দুর্গের বাইরে যায়, আওরঙজেবের হাতে পত্রটি পৌঁছে দেবার জন্যে এবং তার উত্তর সঙ্গে করে আনার জন্যে। লোকটিকে শিবিরগুলোর দিকে দ্রুত এগিয়ে যেতে দেখে আবার বাদশাহের পাশে বসি।
—তোর কী মনে হয় জাহানারা?
—জল পাবো না বাবা।
—আমারও তাই অনুমান। চতুর হলেও এতটা চতুর আওরঙজেব নয় যে আমার লোককে জল নিয়ে আসতে দেবে। সেইখানেই ওর ভয়, ওর অবিশ্বাস। ভাববে, এই কয়দিনের সময় চেয়ে নিয়ে আমি কোনও গূঢ় উদ্দেশ্যে কালক্ষয় করছি। ওঃ জাহানারা, আমিই না শাহানশাহ্ শাহজাহান। জ্যোতিষীর কথা কেমন বর্ণে বর্ণে মিলে যাচ্ছে দেখছিস। পুত্রের হাতে অবরুদ্ধ, এরপর হয়তো বন্দি হব! চূড়ান্ত অপমান
বাদশাহ শয্যার ওপর মাথাটা আছড়ে ফেলেন। আমি নীরব। অক্ষমতা আর অপমানের হা হুতাশ কখনো তাকে করতে দেখি না। অসীম সংযম আর মানসিক বলের অধিকারী তিনি। তবু এক এক সময়ে তাঁর সংযমের বাঁধ ভেঙে যায়। শুধু তখনি মাথাটাকে অমনভাবে আছড়ে ফেলেন।
আমি সহানুভূতি দেখাবার কোনও চেষ্টা করি না। জানি, দেখাতে গেলে দ্বিগুণভাবে নিজের অক্ষমতা তাঁকে পীড়া দেবে। অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে ভাবি, সত্যিই কি ইনি শাহানশাহ্ শাহজাহান? আপেলের গন্ধ হাত থেকে একেবারে মুছে যাক্।
অনেক পরে পত্রবাহক ফিরে এল—রিক্ত হাত, শুকনো মুখে। আমাদের অনুমান ঠিক হল পত্রবাহক বলে, চিঠিখানা পড়ে আওরঙজেবের মুখে এক বিচিত্র হাসি ফুটে উঠেছিল। মুহূর্তকাল পরেই সে গম্ভীর হয়ে বলেছিল, এ পত্রের জবাব দেওয়া প্রয়োজন মনে করি না। তুমি যাও।
ক্রোধে বাদশাহের রেখা-পাণ্ডুর মুখখানাও আরক্তিম হয়ে ওঠে। কাঁপতে কাঁপতে বলেন, —দেখ তো জাহানারা আমি উঠতে পারি কিনা? একবার ধরে তোল আমাকে –প্রাসাদের ওপর দাঁড়িয়ে একবার ঝরোকা দর্শন দেব শুধু। আওরঙজেব ওর শিবিরের মধ্যে গুঁড়িয়ে যাবে।
কিছু বলি না, পিতাকে তুলে ধরার চেষ্টাও করি না। জানি, তাঁর কথার প্রতিটি বর্ণ সত্যি। কিন্তু তিনি উঠতে পারবেন না। কোনওদিনই পারবেন না।
—কী! চুপ করে রইলি কেন?
তাঁর মাথায় আস্তে হাত রেখে বলি, বাবা, ভাগ্য মাঝে মাঝে বড় নিষ্করুণ হয়ে দেখা দেয়। তবু তাকে মেনে না নিয়ে উপায় নেই।
—কিন্তু আমি, শাহানশাহ্ শাহজাহান জীবিত থাকতে—
—হ্যাঁ। অন্য কোনও পথ খোলা নেই। দারার শৌর্যের ওপর বিশ্বাস করে ভুল করোনি। ভুল করেছিলে তার বুদ্ধির ওপর বিশ্বাস করে। ভুলের মাসুল না গুনে উপায় নেই। তুমি অক্ষম—শোচনীয়ভাবে অক্ষম।
এমনভাবে কঠোর সত্য শুনিয়ে ব্যথা পাই। আমার কথাগুলো পিতার উত্তেজনার ওপর যেন মুহূর্তে জল ঢেলে দেয়। তিনি নিস্তেজ হয়ে শুয়ে থাকেন। বুঝলাম শেষবারের মতো ভাগ্যকেই মেনে নিলেন তিনি। চেয়ে দেখি তাঁর শীর্ণ হাত শয্যার ওপর দিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে শিয়রে রক্ষিত কোর-আন খানা চেপে ধরে শিশুর মতো নিশ্চিন্ত হয়।
খানিক পরে মৃদু দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি বলেন,—ওদের আসতে দে।
—আসতে দেব। কিন্তু দলবল নিয়ে নয়। একা আসুক আওরঙজেব তার পরিবার নিয়ে।
—অতটা বিশ্বাস সে আমাদের করবে না।
—দেখা যাক্। তার পুত্র মহম্মদকে প্রথমে পাঠাতে বলি। সেই কবে ছোটবেলায় আমাদের দেখেছে সে। পিতামহকে একবার দেখে যাক্
—মহম্মদকে পাঠালেও পাঠাতে পারে। কারণ মহম্মদের জীবনের কোনও আশঙ্কা স্বয়ং আওরঙজেবকে স্পর্শ করবে না।
—এ কী বলছ বাবা? এত নীচ ভাবো আওরঙজেবকে? নিজের পুত্রের জীবনের আশঙ্কায় সে বিচলিত হবে কিনা?
স্পষ্টস্বরে বৃদ্ধ বাদশাহ্ বলে ওঠেন,—না। হবে না।
—নিজের নামে আওরঙজেবকে চিঠি লিখি। মনে পড়ে বহুবছর আগে, আমি অগ্নিদগ্ধ হয়ে শয্যাশায়ী হলে বহুদূর থেকে শুধু প্রাণের টানেই ছুটে এসেছিল সে আমাকে দেখতে। তারপর কত বছর কেটে গেল। আওরঙজেবের মনের সেই গুপ্ত নরম স্থানটুকু এতদিনে নিশ্চয়ই পাথরের মতো শক্ত হয়ে উঠেছে। পিতার উক্তিতে এইটুকুই প্রতীয়মান হয়, সে এখন আত্মসর্বস্ব। পুত্রের জীবনের মূল্যও তার উচ্চাশার কাছে কানাকড়িও বোধহয় নয়।
লিখি, শুধু মহম্মদ যেন প্রাসাদে আসে প্রথমে। তারপর ইচ্ছে করলে আওরঙজেব তার পরিবার নিয়ে প্রবেশ করতে পারে। কিন্তু সৈন্যদল কখনই নয় কারণ বাদশাহ্ শাহজাহান এখনো জীবিত।
পত্রবাহক আবার ছোটে আওরঙজেবের শিবিরে। সবার মতো সেও পিপাসার্ত। একটা মীমাংসার জন্যে সবাই আকুল, তাই সে আবার ছোটে। সৈন্যদের দু-চারজন ইতিমধ্যেই অচেতন হয়ে পড়ছে। বাদশাহ নিজের পানীয় জল তাদের দিতে বলেছেন। তিনি নিজে জলাভাবে মরতে রাজি আছেন, কিন্তু আমাদের ফাঁকা জিদের বশে একটি প্রাণীও যেন না মরে—এই তাঁর হুকুম।
.