মমতাজ-দুহিতা জাহানারা – ৪

অঙ্গুরিবাগের দিকে চেয়ে বসেছিলাম। দুপুরের তীব্র সূর্যকিরণ ধীরে ধীরে নরম হয়ে এসেছে। বাগের গাছপালা আর সবুজ তৃণের ওপর সোনার ছোপ এখনো লাগেনি। ফুলের দল এতক্ষণ অসহ্য জ্বালায় অস্থির হয়ে উঠেছিল। ধীরে ধীরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে তাদের স্বাভাবিক বর্ণ আর সৌন্দর্য নিয়ে নিজেদের মেলে ধরবার জন্য প্রস্তুত হয়।

অঙ্গুরিবাগের ওই কোণে কারুকার্যশোভিত আসনটির দিকে দৃষ্টি পড়লে সুজার কথা মনে হয়। কত আশা আর আকাঙ্ক্ষা নিয়ে সে ওটি তৈরি করিয়ে ওখানে স্থাপন করেছিল। প্রথমে আমরা কেউ-ই বুঝতে পারিনি। প্রশ্ন করলে সে মৃদু হাসত। তারপর এক সন্ধ্যায় বাগের ভেতরে হাজার সুন্দরীর মেলা দেখে অবাক্ হয়েছিলাম। ভালভাবে লক্ষ করে দেখি, সুজা বসে রয়েছে তাঁর শখের আসনটির ওপর। বহুমূল্য পরিচ্ছদ তার পরনে। আর তার সামনে দিয়ে নৃত্যের ভঙ্গিমায় একটির পর একটি সুন্দরী এগিয়ে চলেছে তাদের শরীরের সবটুকু মাধুর্য পরিস্ফুট করে। নিজের নয়ন আর যৌবনের পরিতৃপ্তির এই অভাবনীয় আবিষ্কারের উন্মাদনায় সুজা মত্ত হয়ে উঠেছিল সেদিন। কিন্তু কপালে তার এ-আনন্দ সইল না বেশিদিন।

বাদশাহ্ একদিন দরবারে আমীর ওমরাহদের সামনে তার হাতে একটি হুকুমনামা ধরিয়ে দিলেন। বাংলার শাসনকর্তার পদ। একদিকে অভাবনীয় আনন্দ, অন্যদিকে হাজার সুন্দরীর বিরহ। সুজা দিশে হারিয়ে ফেলেছিল।

তার বিদায়ের দিন ঘনিয়ে এলে আমার কক্ষে এসে চুপি চুপি বলেছিল- বাাদশাহ্ আমায় ঈর্ষা করেন জাহানারা। তিনি চান জগতে তিনিই শুধু বিলাসিতার পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে যাবেন—আর কেউ নয়। হাজার মেয়ের খেল্ দেখে তিনি চমকে গিয়েছেন। তাই পাঠিয়ে দিলেন দূরে।

—রাগে সব মানুষই জ্ঞান হারায় সুজা। তুমিও হারিয়েছ। তাই বাদশাহ্ সম্বন্ধে এমন হীন মন্তব্য করতে পারলে। একটু ভাবলে বুঝতে পারতে, তোমার অন্ধকার ভবিষ্যৎকে উজ্জ্বল করে তুলবার পথ দেখিয়ে দিলেন তিনি। এখন পারা না পারা তোমার শক্তি, সাহস আর বুদ্ধির ওপর নির্ভর করছে। নিষ্কর্মা হয়ে বসে থেকে বিলাসিতার নতুন নতুন পথ দেখাতে আমার দরজার বাইরে ওই খোজাটিও পারে।

মুখ বেজার করে চলে গিয়েছিল সুজা সেদিন। আমার কথার কোনও জবাব দিতে পারেনি সে। আর সে আসেনি। বাংলায় ভালই কাজ দেখাচ্ছে বলে শুনেছি।

অঙ্গুরিবাগের গাছপালায় ক্রমে সোনার পরশ লাগে! চেয়ে চেয়ে দেখি। কোনও কাজ নেই কোয়েল চলে যাবার পর থেকে বড় ফাঁকা লাগে। কথা বলার লোক পাই না। ছোট বোনটি প্রায় রোজই আসে। তাকে নিয়ে কিছু সময় কাটে। নাদিরার ঘরে যাই, দ্বারা যদি উপস্থিত না থাকে। রোশনারা আমাকে এড়িয়ে চলে। বুঝতে পারি, আমাকে সে ঠিক সহ্য করতে পারে না। সে খাঁটি পৃথিবীর মেয়ে। নিজের দেহ, নিজের রূপ আর নিজের ইচ্ছে নিয়েই মশগুল রয়েছে। জানে না রূপের আয়ু কতটুকু। বাদশাহের ভগিনীদের ঘরগুলো একবার করে ঘুরে এলেই বুঝতে পারত। যদি বুঝত, তাহলে ওর চিন্তার গভীরতাও অনেক বেড়ে যেত।

পদশব্দে ফিরে দেখি আমার নাজীর সযত্নে আমার অপরাহ্ণের জলখাবার নিয়ে হাজির করেছে। নূরজাহানের পরামর্শে এ সময়ে আমি কিছু ফলমূল আহার করি। চেয়ে দেখি অনেক ফল। দর্দ-ই-চিরাগ, সফতালু, জর্দলু এমন কী অসময়ে একটি নবজকও ফলগুলির মধ্যে উঁকি দিচ্ছে। হাসি পায়। আমাকে তুষ্ট করার প্রয়াসের অন্ত নেই এর। সেই কবে কোয়েল চলে গিয়েছে, তারপর থেকে ওই-ই রয়েছে। কাজেকর্মে বেশ চট্‌পটে। কাজই ওর ধ্যান-ধারণা তার বেশি ভাববার মতো মস্তিষ্ক ওর নেই। তাই ও এত চট্‌পটে, এত পটু। কোয়েল এমন ছিল না। কোয়েলের কাজ আমাকে কোনওদিন আনন্দ দিয়েছে কি না চিন্তা করারও অবসর পাইনি। কারণ ও আশেপাশে থাকলেই আমার মনটি ভরে থাকত। ও নেই আজ, তাই আমার মনও ফাঁকা। এই নাজীরের সহস্র প্রচেষ্টা আমার মনের ফাঁকটুকু ভরাট করতে পারছে না। সামান্য একটু জলযোগ সেরে আঙুরের রস পান করি। ওকে ইঙ্গিতে সব উঠিয়ে নিয়ে যেতে বলে আবার বাইরে দৃষ্টি ফেরাই। হারেমের এই গণ্ডির ভেতরে বসে থেকে ইচ্ছে হয় মনটিকে মিলিয়ে দিই অসীমের সঙ্গে।

হঠাৎ নজর পড়ে অঙ্গুরিবাগের ঠিক পাশে একজন পুরুষের দিকে। একটু দূরে হলেও চিনতে মোটেই দেরি হয় না। অমন প্রশস্ত আর উন্নত বক্ষ আমিরদের মধ্যে শুধু একজনেরই রয়েছে। সে নজরৎ খাঁ। একদৃষ্টে চেয়ে রয়েছে সে আমার বাতায়নের দিকে। খোজাদের মধ্যে কাউকে অর্থ দ্বারা বশ করেছে নিশ্চয়ই। নইলে শাহজাদী জাহানারা কোন্ প্রকোষ্ঠে থাকে সেকথা জানার কথা নয় নজরৎ খাঁয়ের। বাইরের কেউ-ই জানে না। নজরৎ খাঁয়ের অঙ্গুরিবাগের পাশে উপস্থিতিও ঠিক স্বাভাবিক নয়। কারণ স্থানটি বাদশাহের পরিবারের জন্য সুরক্ষিত। সম্ভবত কৌশলে বাদশাহের অনুমতি নিয়েছে সে। দারার কাছ থেকেও ছাড়পত্র পেতে পারে। দারার সঙ্গে কিছুদিন তার বড় বেশি মাখামাখি। ভাইদের মধ্যে দারার প্রতি যে আমার একটু পক্ষপাতিত্ব রয়েছে, জেনে ফেলেছে নাকি? এত তাড়াতাড়ি জানা সম্ভব নয়। দারাই একমাত্র শাহজাদা যে আগ্রায় রয়েছে। তাই দুটো পথই মসৃণ করে নিয়েছে বন্ধের আমির।

স্পষ্ট বুঝতে পারি আমির সাহেব আমাকে দেখতে পাচ্ছে না। কক্ষের অপেক্ষাকৃত কম আলোই তার কারণ।

হাবভাবে তার অস্থিরতা প্রকাশ পায়। এত আয়োজন সব ব্যর্থ হতে বসেছে। খুব মজা লাগছে।

হঠাৎ রোশনারার ভূত আমার ঘাড়ে চাপে। বম্বসের ভূতও হতে পারে। নজরৎকে লোভ দেখাতে ইচ্ছে হয় আমার। নিজেই টোপ হয়ে বাতায়নের বাইরে মুখ বাড়াই।

নিশ্চল হয় বল্কের আমিরের মূর্তি। দূর থেকে তার চোখ দুটো দেখতে না পেলেও সে চোখ যে আমাকে গিলছে তা অনুভব করতে অসুবিধা হয় না মোটেই। গিলুক। দেখে যদি তৃপ্তি পায় ক্ষতি কী! আমি জানি আমার মন।

মাথাটাকে একবার একটু ভেতরে টেনে নেবার ভান করি। সঙ্গে সঙ্গে সব কিছু ভুলে নজরৎ খাঁ তার দেহটিকে অদ্ভুতভাবে নাড়া দিয়ে দু’হাত তুলে প্রার্থনার ভঙ্গিতে দাঁড়ায়। নিশ্চিন্তে হেসে ফেলি। জানি, সে হাসি ওর চোখে পড়বে না। আরও কিছুক্ষণ সেইভাবে দাঁড়িয়ে থাকি। শেষে হঠাৎ ঘৃণা জন্মায় নিজের ওপর। ছি ছি। এই সস্তা আনন্দে আমিও মেতে উঠলাম! ভুলে গেলাম নিজের শিক্ষা, নিজের রুচির পরিচয়! শিল্পীর কথা এত তাড়াতাড়ি মন থেকে মুছে গেল! তবে কি অবচেতন মনে আমি দুজন পুরুষের সঙ্গ-লিপ্সু? একজন আমার মনের জন্যে, অপরজন দেহের? না না।

শামুকের মতো মুহূর্তে নিজেকে গুটিয়ে নিই কক্ষের ভেতরে। নাজীর দাঁড়িয়ে ছিল দূরে। তাকে বলি মমতাজ বেগমের কাছাকাছি কোনও ঘরে আমার থাকার ব্যবস্থা করতে।

মায়ের সান্নিধ্যের বড় প্রয়োজন। বহুদিন মা-ছাড়া। ভেতরের আর বাইরের যত কিছু দ্বিধাদ্বন্দ্বের তিনিই ছিলেন আমার পথপ্রদর্শক। তাঁর ঘরের কাছে থাকলে তাঁর উত্তাপ হয়তো অনুভব করব। মনের ক্লেদ তাতে দূর হবে।

.

ঠিক পরদিনই দরবার শেষ হবার মুখে দারা দ্রুত ঝরোকার পেছনে এসে দাঁড়ায়।

—কী হল দারা?

—একটি প্রস্তাব রয়েছে। রাখবে?

—শুনি আগে।

—শুনলে সম্ভবত আনন্দই হবে তোমার। চাঘতাই বংশের একটা নতুন দিক খুলে যাবে।

—ভণিতা রাখো।

—নজরৎ খাঁ কেমন লোক?

চমকে উঠি। কোনওরকমে সংযত হয়ে বলি,—ভালই তো।

—বন্ধের বেগম হবে?

—মানে?

—মানে, নজরৎকে শাদি করবে?

ম্লান মুখে হাসি ফুটিয়ে বলি, শাহানশাহ্ শাহজাহানের জ্যেষ্ঠপুত্রের উপযুক্ত কথাই বটে।

—ঠাট্টা করছি না জাহানারা।

—নিজের কাজে যাও দারা। আর যদি কাজ না থাকে, নাদিরাকে একলা রেখো না।

মুহূর্তের অস্বস্তি কাটিয়ে, দারা বলে,–তোমাকে আমি প্রতিজ্ঞা করে বলতে পারি কথাটা বাজে নয়। বাদশাহের কানে পৌঁছেছে।

—কে দিয়েছে কানে?

—আমি।

—তিনি রাজি হয়েছেন?

—নিমরাজি। জোর করলে বাধা দেবেন না!

—তবে তুমি একজনের মস্ত উপকার করতে পারো। তার জীবনকে বিকৃতির পথ থেকে মুক্তি দিতে পারো। তার ভেতরের সুকোমল বৃত্তিগুলো আবার জাগিয়ে তুলতে পারো দারা।

—কে সে?

—রোশনারা। তার ব্যবস্থা করো দারা। আমি তোমার কাছে চিরকাল কৃতজ্ঞ থাকব।

—বাদশাহ্ রাজি হবেন না। তবে তুমি যদি এ ব্যাপারে রাজি হও, পরে তাঁকে রোশনারার বেলাতেও মত দিতে হবে।

—তার মানে তিনি নিজে উদ্যোগী নন।

—না।

—নজরৎ খাঁকে আমার পছন্দ নয়।

বিস্মিত দারা বহুক্ষণ কথা বলতে পারে না। নজরৎ হয়তো কালকের অঙ্গুরিবাগের ঘটনাকে আশাপ্রদ মনে করে দারাকে বুঝিয়েছে সেই অনুযায়ী। তাই আমার কথায় সে অবাক্ হয়। শেষে বলে,—বল্কের শক্তি আমাদের কতখানি সহায়ক তুমি জানো।

—জানি। তাই বলে, সে শক্তির কাছে নিজের মনকে কোরবানি দিতে পারি না।

—সে কী জাহানারা। জিনিসটাকে এভাবে নিচ্ছ কেন?

—অন্যভাবে নেবার উপায় নেই। রোশনারার ব্যবস্থা করো দারা যদি পারো, তাহলে বন্ধের চেয়েও বড় শক্তি তোমার করায়ত্ত হবে।

মুখখানা বিকৃত করে দারা।

—তবে যাও।

—নজরৎ কিন্তু অন্যরকম বলেছিল।

—সে ভুল বলেছে। মুঘল শাহজাদীরা খেয়ালের বশে কিছু করে না। তারা ভেবে দেখে —কিন্তু কী বলব তাকে?

—বলবে, এখনো কিছু বলার সময় আসেনি। আর একটা কথা শাহজাদা হয়ে আমির-ওমরাহের অভিন্ন-হৃদয় বন্ধু হতে যেও না। পরিণামে ভুগবে।

মুখখানা ভার করে চলে যায় দারা। আশাহত হল সে। এত অদ্ভুত চরিত্রের মানুষ এই ভাইটি। চরিত্রের জটিলতার জন্যে হয়তো কোনওদিনই সে শান্তি খুঁজে পাবে না। সে জ্ঞানী গুণী, আবার সেই সঙ্গে সে লোভীও। মুখে সে দার্শনিকসুলভ নির্লিপ্ততা মাখিয়ে রাখলে কী হবে, যত দিন যাচ্ছে আমি বুঝতে পারছি আমার অন্যান্য ভাইদের মতো তারও সিংহাসনের প্রতি লোভ কম নেই। বরং বেশিই। তাই বাদশাহ্ কালেভদ্রে তাকে বাইরে পাঠাতে চাইলেও সে যেতে চায় না। সব সময়ই তাঁর পাশে পাশে থেকে নিশ্চিন্ত থাকতে চায়। বাদশাহের ক্ষমতার কিছু কিছু ব্যবহার করে তৃপ্তিলাভ করে। আভাসে ইঙ্গিতে তাকে জানাতে চেষ্টা করেছি কত, দেশ সম্বন্ধে অভিজ্ঞতা লাভের এই সুযোগ সে হেলায় হারাচ্ছে। কিন্তু জানতে চায়নি সে। তার ধারণা মসনদের আশেপাশে নিজেকে আবদ্ধ করে রাখলেই ওর ওপর অধিকার পাওয়া সহজ। বুঝতে পারে না রাজনীতি অত সরল জিনিস নয়। নিজের মেজাজের বশে চলে রাজনীতি করা যায় না। রাজধানীর আমির-ওমরাহদের খোশামোদ করে নিজের দলে রাখার চেষ্টা রাজনীতির এক চালেই ভণ্ডুল হয়ে যেতে পারে। জাহানারাকে বল্কের আমিরের হাতে সঁপে দিলেও সব দিক রক্ষা করা যায় না। দাক্ষিণাত্য থেকে যে খবর ভেসে আসে, তাতে আওরঙজেব সম্বন্ধে সবারই উঁচু ধারণা জন্মেছে। বাদশাহ চিন্তিত হয়েছেন—সেই সঙ্গে আমিও। আওরঙজেবের চতুরতায় যত বেশি শান্ পড়বে ততই বিপদ। দাক্ষিণাত্যের শাসনকর্তা সে—অথচ নাকি ফকির সেজে বসে আছে। নিজের হাতে টুপি তৈরি করে বিক্রি করে। আর সেই পয়সায় সংসার চালায়। মুসলমান ধর্মের এত বড় আদর্শ সবার সামনে ধরে রেখে মন জয় করা অত সহজ। শুধুমাত্র জাহানারাকে সমর্পণ করে এত ব্যাপকভাবে মন জয় করা সম্ভব নয়। দারা বিজ্ঞ কিন্তু সে চতুর নয়। আমার দুঃখ এইখানেই।

.

দশ-পঁচিশীর সেরা নর্তকী গোয়ালিয়রের গুলরুখবাঈ-এর নৃত্যের আয়োজন করি প্রাসাদের ভেতরের বিরাট চত্বরে। স্থানটি দরবারের কাছাকাছি। গুলরুখের নুপুরের শব্দ নিঃসন্দেহে দেওয়ান-ই খাসে বাদশাহের কর্ণে প্রবেশ করবে। পাগল-করা নৃত্যের তাল একসময়ে বাদশাহকে অন্যমনস্ক করে তুলবে। কিন্তু দরবার ছেড়ে হয়তো তিনি আসবেন না। দরবারের সম্মান তিনি সব সময় বজায় রাখেন।

লক্ষ চিরাগদানির বাতিতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে চত্বর এবং চত্বরের আশপাশ। হারেমের সবাই আমার এই আয়োজনে নিমন্ত্রিত। একে একে তারা এসে আসন গ্রহণ করে। গুলরুখবাঈ অনতিদূরে একটি কক্ষে নিজেকে শেষবারের মতো সাজিয়ে নিচ্ছে। তার একটা নিয়ম নৃত্য শেষ করে সে দাঁড়ায় না। হাওয়ায় উড়তে উড়তে দরবারকক্ষের পাশের অলিন্দ দিয়ে ভেসে যায় তার নিজের আবাসে। অনেকদিন তাকে বলেছি, নৃত্যের শেষে একটু অপেক্ষা করে বেগম শাহজাদীদের ধন্যবাদ গ্রহণ করতে। ওভাবে যাওয়া দৃষ্টিকটু। সে হাসে আমার কথা শুনে। তার হাসি এত সংযত আর এত দৃঢ় যে আমি বুঝতে পারি নাচ শেষ করার পর বাদশাহ্ স্বয়ং তাকে অপেক্ষা করতে বললেও সে অপেক্ষা করবে না। চলে যাওয়াটাও যেন তার নৃত্যেরই একটি অঙ্গ। ওটুকু না হলে নৃত্য আর সম্পূর্ণ হয় না। সত্যিই যে অঙ্গ, সে কথা অস্বীকার করেও লাভ নেই। তার এই অপস্রিয়মাণ দেহখানা দেখবার জন্য ইতিমধ্যেই হারেমে একটা আগ্রহের সৃষ্টি হয়েছে।

ওস্তাদদের বাদ্যযন্ত্র বেজে ওঠে। এক স্বর্গীয় পরিবেশ। ভুলে যেতে হয় পৃথিবীর সবকিছু ক্লেদ-গ্লানি। ভুলে যেতে হয় রাজনীতির নোংরামি। মন চলে যায় ঊর্ধ্বে—বহু ঊর্ধ্বে।

পাশেই রোশনারা বসে রয়েছে। গুলরুখকে সে অপছন্দ করে। অপছন্দ করে তার রূপের জন্য। তবু তার আসরে হাজির হয় সে। নাচ ভালবাসে রোশনারা। আওরঙজেবের সব নির্দেশ সে অক্ষরে অক্ষরে পালন করেও নৃত্যের বেলায় আদর্শভ্রষ্ট। আওরঙজেব নাকি দাক্ষিণাত্য থেকে লিখেছে, তার নিজের হারেমে নাচগানের চল বন্ধ করে দিয়েছে সে। ওসব ধর্মবিরুদ্ধ। দিন দিনই আমার ভাইটির মন শুকিয়ে যাচ্ছে। শেষ পরিণতি কী হবে জানি না!

গুলরুখ আসরের মাঝখানে এসে দাঁড়ায়। হাত জোড় করে প্রার্থনার ভঙ্গিতে সে আকাশের দিকে প্রণাম জানায়। হিন্দুদের রীতি। তারপর অভিবাদন করে আমাকে আর আশেপাশের সবাইকে। যারা তার নাচের ভক্ত, তাদের সবারই ভক্ত সে। শিল্পীর সঙ্গে শিল্প-রসিকের মনের যে সম্বন্ধ তাতে উভয় পক্ষই উভয়ের ভক্ত।

নাচ শুরু হয় মৃদুমন্থর গতিতে। স্তব্ধ আসর। শুধু গুলরুখের নুপুরের শব্দ। তার পা যেন মাটি স্পর্শ করে না। কী করে এমন সম্ভব বুঝে উঠতে পারি না। শুধু তার দেহখানা নানান্ ভঙ্গিমায় তরঙ্গায়িত হয়ে চলেছে। হাওয়ায় যেন নদীর জলে শিহরন তুলে ঢেউ-এর সৃষ্টি করে, সুর তেমনি তার দেহে ঢেউ তোলে। কতবার দেখেছি, আশা মেটে না। প্রতিবারই নতুন করে চমক জাগে—প্রাণে এক অনাস্বাদিত সুরের হিল্লোল বয়।

গুলরুখকে আমি ভালবাসি। নারী হয়ে নারীকে যতটা ভালবাসা সম্ভব ততখানি। একবিন্দু কম নয়। অনেক দিন আমার নিজের কক্ষের দরজা বন্ধ করে ওর নাচ দেখেছি। সেখানে আমিই একমাত্র রসিক। সেই একক আসরে গুলরুখ যেন পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। খেয়াল থাকে না তার কতক্ষণ সে নেচে চলেছে। আমারও খেয়াল থাকে না। কোনও কোনওদিন এমন হয়েছে, ক্লান্ত হয়ে সে অজ্ঞান হয়ে পড়েছে। মৃত্যু হয়েছে ভেবে ছুটে গিয়ে তার দেহখানা জড়িয়ে ধরে কেঁদেছি। একটু পরেই যখন দেখেছি প্রাণের সাড়া পাওয়া যাচ্ছে, সরে গিয়েছি তার কাছ থেকে। আমি শাহজাদী। সে সামান্যা নর্তকী।

গুলরুখ নেচে চলেছে। রোশনারা উত্তেজিত। এ উত্তেজনা কীসের বুঝতে পারি না। মনে হয়, অক্ষমের উত্তেজনা। সে চায় গুলরুখের মতো নেচে নেচে ক্লান্ত হয়ে পড়তে। সে চায় মোগলাইখানা প্রতিদিন তার শরীরে যে শক্তির সঞ্চয় করছে সে শক্তিকে সন্ধ্যার শীতলতায় নিঃশেষ করে দিতে। কিন্তু পারছে না। গুলরুখের পায়ের ছন্দ, তার লীলায়িত দেহবল্লরীর গুণাবলির অভাব রয়েছে রোশনারার। তাই সে উত্তেজিত।

তার এই অবস্থা একবার দারাশুকোকে দেখাতে পারলে হত। কিন্তু দারা নেই। যদিও পাশের দরবারে সে উপস্থিত, একবারও তাকে এই আসরে উঁকি দিতে দেখিনি। দিল্লিতে রাজধানী স্থানান্তরের ব্যাপারে কিছুদিন থেকেই দরবারের প্রতিটি লোক বড্ড ব্যস্ত। সেখানকার হর্মরাজি অতি দ্রুত শেষ হয়ে আসছে। দারা নূপুরের শব্দ শুনেও তাই পালিয়ে আসার সুযোগ পাচ্ছে না। নাদিরার দিকে ফিরে চাই। একটু দূরেই সে বসে ছিল। তার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই হেসে ফেলে। সে হাসির অর্থ পরিষ্কার। সেও দারার কথাই ভাবছিল।

নাচ-শেষে গুলরুখের চলে যাবার পথের সরু দীর্ঘ অলিন্দে শত শত প্রদীপের সারি। দুই পাশের সেই প্রদীপগুলির শিখা মৃদু হাওয়ায় দুলছে। নৃত্যের তালে তালে তাল দিচ্ছে যেন। প্রদীপের আলোয় গুলরুখকে শেষ পর্যন্ত স্পষ্ট দেখতে পাওয়া যাবে।

নাচের তাল দ্রুততর হয়। শেষ হয়ে আসছে। আমাদের সবার মন একাগ্র। রোশনারাও এ সময়ে নিজের ব্যর্থতার কথা ভাবতে পারছে না। নাদিরা দারার কথা ভুলে গিয়েছে। বাদশাহের অবহেলিত বেগমদের জ্বালাধরা হৃদয়ে সাময়িক শান্তি বিরাজ করছে। গুলরুখ বিদায় নেবে। যে কোনও মুহূর্তে সে ওই অলিন্দপথ দিয়ে ছুটে যাবে।

সহসা ওস্তাদের বাদ্যযন্ত্র ‘ঝম্’ করে একটা আওয়াজ তুলে মুহূর্তের জন্য থেমে যায়। এই আওয়াজটি গুলরুখ-নৃত্যের বিশেষত্ব। তারই নির্দেশে বাদ্যের এই ছেদ। এই ছেদ মুহূর্তের জন্যে। স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে গুলরুখ। শুধু তার সর্বাঙ্গে এক অপরূপ হিল্লোল। ঠিক তারপরই গুলরুখ ছোটে অন্দরের দিকে। ‘বাহবা’ ওঠে আসর থেকে। আমার মন তৃপ্ত। গুলরুখের সম্মানে আমার সম্মান। তার জয়ে আমার জয়। কিন্তু একী!

আর্তনাদ করে ওঠে গুলরুখ! চিরাগদানির কম্পিত শিখা তার ওড়নার প্রান্ত স্পর্শ করেছে। আগুন লেগেছে ওড়নায়। চুলের সঙ্গে আটকানো রয়েছে ওড়না। খুলতে পারছে না গুলরুখ। দিশেহারা সে। আগুন ছড়িয়ে পড়েছে।

আসরে সবাই বোবা। তারাও গুলরুখের মতো দিশেহারা।

আমি ছুটে যাই পাগলের মতো। তাকে জড়িয়ে ধরতে যেতেই সে অসীম যন্ত্রণার মধ্যেই দু হাত সরিয়ে নেয়—না না শাহজাদী। আসবেন না।

—পাগলামি কোরো না গুলরুখ।

আগুন আরও ছড়িয়ে পড়ে। ওর সর্বাঙ্গে লেলিহান শিখা।

—শাহজাদী মরতে দিন! বেঁচে আর লাভ নেই।

তার বাধা মানি না। সে বুঝতে পেরেছে অগ্নিদগ্ধ কুৎসিত রূপ নিয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে গুলরুখবাঈ-এর মৃত্যু ভাল। কিন্তু আমি তো তা ভাবতে পারি না। আমি দেখছি আমার প্রিয় নর্তকীর যন্ত্রণা। মৃত্যু ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। জড়িয়ে ধরি তাকে। আমার শরীরের শীতলতা যদি তার দেহের অগ্নিশিখাকে শান্ত করতে পারে।

কিন্তু পারল না। লোভীর মতো লক্লকে জিভ বের করে নতুন জিনিসের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে আগুন। চিৎকার করে ওঠে রোশনারা। কেঁদে ওঠে নাদিরা।

দেওয়ান-ই-খাসের টনক নড়ে এতক্ষণে। শুনতে পাই অনেক পুরুষের ব্যস্ত পদশব্দ। নিদারুণ যন্ত্রণার মধ্যেও লজ্জা পাই। দারা ছুটে এসে দাঁড়িয়ে পড়ে। পেছনে নজরৎ। সে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরতে চায়।

মরিয়া হয়ে চিৎকার করে উঠি—খবর্দার। মুঘল-শাহজাদীর গায়ে যেন হাতের স্পর্শ না লাগে।

থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে নজরৎ।

আগুন ছড়িয়ে পড়ে। পাশেই মাটিতে অর্ধদগ্ধ গুলরুখ। ছট্‌ফট্ করছে। আমার গুলরুখ। তাকে আর চেনা যায় না। আমারও ওই অবস্থা হবে।

—জাহানারা। দারা চিৎকার করে ওঠে।

সহসা দেখি দেওয়ান-ই খাসের ভারী পর্দা ছিঁড়ে নিয়ে কে যেন এগিয়ে আসছে। আমি বাধা দিয়ে উঠি—স্পর্শ করবেন না।

—শান্তি দেবার যথেষ্ট অবসর পাবেন শাহজাদী। এখন ভাল মেয়ের মতো চুপ করে থাকুন।

সে পর্দা দিয়ে আমাকে বলিষ্ঠভাবে জড়িয়ে ধরে।

মুহূর্তের জন্যে চেয়ে দেখি ওকে। এমন সুপুরুষ। অথচ আগে দেখিনি। চোখের দিকে দৃষ্টি পড়ে এর মধ্যেও। সেই চোখ—তাজমহলের শিল্পীর মতো।

আমার আঁখি নিমীলিত হয় আপনা থেকে। নিজের যন্ত্রণাকাতর দেহকে নিশ্চিন্তে সমৰ্পণ করি। আর কিছু মনে নেই।

.

আমি স্বার্থপর। নইলে এই দুই মাসের মধ্যে গুলরুখের কথা একবারও মনে হয়নি কেন? শয্যাশায়ী হয়ে আকাশপাতাল অনেক চিন্তাই করি। অথচ গুলরুখের চিন্তা মাথা থেকে সেই দুর্ঘটনার পরই বিদায় নিয়েছে।

পাশে বাদশাহ্ বসেছিলেন। আমার কপালে তাঁর হাতখানা। দেখলে মনে হয় এর মধ্যে তার বয়স আরও অনেক বেড়ে গিয়েছে। আমি অসুস্থ হবার পর তাঁকে দেখবার কেউ নেই। রোশনারা যদি একটু দায়িত্বসম্পন্ন হত, অনেক দুশ্চিন্তা থেকে রক্ষা পেতাম আমি।

—বাদশাহ্।

আমার মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ে তিনি বলেন, বাদশাহ্ কিরে? বাবা বল্।

—বাবা! চোখ ছাপিয়ে জল বের হয় আমার।

বাদশাহ্ও অন্য দিকে মুখ ফেরান।

—গুলরুখ কেমন আছে বাবা?

—সে নেই। ভালই হয়েছে জাহানারা। বেঁচে থাকলে সে আত্মহত্যা করত।

—তবে আমাকে বাঁচাতে চেষ্টা করলেন কেন?। নানান্ দেশ থেকে এত হাকিম আনার প্রয়োজন কি? নর্তকী না হলেও মেয়ে তো আমি।

—জানি। তোকে বাঁচতে হবে আমার জন্য। তুই-ই যে আমার প্রাণ, জাহানারা। এক নিদারুণ অসহায়তা ফুটে ওঠে বাদশাহ্ শাহজাহানের চোখেমুখে। মায়া হয়। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে মনে হয় শাহজাহানও স্বার্থপর। নিজের স্বার্থের জন্য আমাকে কুরূপ নিয়ে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন।

—আমি বাঁচব না বাবা।

—কেন?

—আমি শাহজাদী। রূপ না থাকলে আবার শাহজাদী?

—কে বলে তোর রূপ নেই জাহানারা?

ম্লান হেসে বলি—সান্ত্বনা দিচ্ছেন।

—না। তোর মুখে তো কিছুই হয়নি। তোর বুক আর ঊরু জখম হয়েছে।

—দেখা যায় না?

—না। এতদিন তুই সত্যিই জানতিস না?

মন আমার অনেক হাল্কা হয়ে যায়। বলি—জানতাম না বাবা। আরশি চাইতে ভরসা হত না। যদি চোখের সামনে কদাকার একটি মুখ ভেসে ওঠে!

—তুই পাগল। বাদশাহ্ ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ান। অনুমানে বুঝতে পারি দরবারে যাবার সময় হয়েছে তাঁর।

আমার বুকের পাষাণ-ভার নেমে যায়। মনে মনে আল্লাকে ধন্যবাদ দিই। তাঁর কাছে প্রার্থনা করি। যত বড় শাহানশাহ্ই হোন না কেন, সবার উপরে তিনি। তিনি না থাকলে দেশ-বিদেশের হাকিমেরা কিছুই করতে পারতেন না। তিনি না থাকলে দেহের সব অংশ বাদ দিয়ে শুধু মুখখানাই দগ্ধ হত। আমার এই মুখের দ্বারা তাঁর সব উদ্দেশ্য এখনো সিদ্ধ হয় না। আমার এই দেহ দ্বারাও নয়। নইলে সাত সাগর তের নদী পার হয়ে এদেশে এসে ঠিক এই সময়েই সাহেব-হাকিম হাজির হত না। কী যেন হাকিমের নাম? গাব্রাল ব্রিংটন, না কী যেন! যেমন অদ্ভুত নাম, তেমনি অদ্ভুত চিকিৎসা। এদেশের সবাই হার মানলো, তারপর তো সে এল। সত্যিকারের ব্যথা সেই-ই কমিয়েছে। যদিও আরও দু মাস লাগবে সম্পূর্ণ ভাল হয়ে উঠতে। সে নাকি পোড়া দাগও মিলিয়ে দেবে অনেক

বাদশাহ্ বিদায় নেবার কিছু পরেই দরওয়াজার পর্দা আবার দুলে ওঠে। নিশ্চয়ই নাদিরা কিংবা দারা।

না। আওরঙজেব! ও এল কোথা থেকে? সে-ই কবে দাক্ষিণাত্যে গিয়েছিল, তারপর এই প্রথম।

—আওরঙজেব?

—জাহানারা। লম্বা লম্বা পা ফেলে আমার সামনে এসে দাঁড়ায় সে। ওর ইচ্ছে হচ্ছিল আমার পাশে বসে আমার হাতে হাত রাখে। কিন্তু ওর সংযত স্বভাব বসতে দেয় না ওকে।

—আওরঙজেব?

হাসে আওরঙজেব। বলে—বিশ্বাস হচ্ছে না?

—কতদিন পরে এলে?

—অনেক দিন। এখনো তো আসতাম না। কিন্তু দুর্ঘটনার খবর যে মুহূর্তে শুনলাম, আমি সব ছেড়ে তখনি রওনা দিলাম। তবু আসতে কত দেরি হয়ে গেল।

—সত্যি?

—হাঁ জাহানারা। আমার সম্বন্ধে তোমাদের মনোভাব কী আমি জানি। সে মনোভাব ভুল নয়। তবু আমার ভেতরের স্নেহ, প্রীতি, ভালবাসা সবই আছে। কঠিন আবরণে ঢাকা পড়ে থাকে। সে আবরণ ধর্মের। মসনদের ওপর আমার কতখানি লোভ আছে তা জানি না। তবে তুমি যদি ধর্মের বিরোধিতা করো আর যদি আমার যথেষ্ট ক্ষমতা থাকে, তোমাকে আমি মৃত্যুদণ্ড দিয়ে একফোঁটা চোখের জলও না ফেলে মনের ভেতরটাকে ক্ষতবিক্ষত করে তুলব।

—কী সাংঘাতিক!

—তোমরা একে সাংঘাতিক বলো। কিন্তু নিজেকে আমি এইভাবেই গড়ে তুলেছি।

আমি প্রতিবাদ করি না। এতদিন পরে এসেছে, তাই চুপ করে থাকি। প্রতিবাদ করার শক্তি ও আমার নেই, একটানা কথা বলে বলে ক্লান্ত মনে হয় নিজেকে।

এতক্ষণে আওরঙজেব পাশে বসে। গায়ে হাত বুলিয়ে শেষে আলখাল্লার ভেতর থেকে মালা বার করে জপ করতে শুরু করে। আল্লার কাছে প্রার্থনা করছে ও আমার জন্যে। ওর গম্ভীর মুখের দিকে চেয়ে বড় ভাল লাগে। এক বিরাট ব্যক্তিত্ব।

অনেকক্ষণ পরে চোখ মেলে আওরঙজেব। মালাটি আলখাল্লার ভেতরে রেখে উঠে দাঁড়িয়ে বলে—যাই জাহানারা। বাদশাহের সঙ্গে এখনো দেখা হয়নি। ভেবেছিলাম তোমাকে আরও খারাপ অবস্থায় দেখব। তাই আগে এখানে এসেছি।

—আল্লার কৃপা।

—নিশ্চয়। সেই কথাই সব সময় মনে রেখো। আর সব ঝুট।

লম্বা লম্বা পা ফেলে সে বের হয়ে যায়।

নাজীর কাছে আসে নিঃশব্দে। তাকে বলি,—আজ অনেক খানার আয়োজন করতে বলো। আমার খিদে পেয়েছে খুব।

নাজীরের চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। নিজে থেকে আমাকে ও খাবার কথা বলতে শোনেনি কখনো।

—সব বানাতে বল—বুজুগ, তন্দুরি বাব্বোরা, হালিম-গোস্ত, সমকোক্ষ।

—আর কিছু? নাজীর ঢোক গেলে।

—দো-পালা, মৃতাঞ্জনতু মোরগ মুসল্লাম।

নাজীরের চোখ বড় বড় হয়। অসুস্থ ব্যক্তি এত খেতে পারে না। তার ভাগ্যেই সব জুটবে। মনে মনে হাসি। আওরঙজেব এল এতদিন পরে, সবরকম খানারই আয়োজন থাকা উচিত। তার মন যা চাইবে তাই খাবে। বাদশাহ্ আর দারার পাশে বসে খাবে সে আজ। অস্বস্তি হবে সবার—তবে খুশিও হবে। শরাবের আয়োজন করব কিনা বুঝতে পারি না। খাঁটি মুসলমান আওরঙজেব। শরাবের আয়োজন করলে যদি খানা ফেলে উঠে পড়ে?

শেষে খাদ্য-তালিকায় শরাবকেও রাখলাম। খাঁটি মুসলমান ও আজ নতুন হয়নি। অথচ কোনওদিনই সুরাপাত্রের মোহ ও ছাড়তে পারেনি। দাক্ষিণাত্যে যদি ছেড়েও থাকে সেখান থেকে শত শত যোজন দূরে এই আগ্রার প্রাসাদে খানার পাশে সুরা পাত্র দেখলে হাত তার আপনা হতেই এগিয়ে যাবে। মুসলমান হলেও আওরঙজেব মুঘল। ওর শিরা-উপশিরায় ভারতে মুঘল-বংশের প্রতিষ্ঠাতা বাবরের রক্ত প্রবাহিত। বাবরের মুখের প্রসিদ্ধ উক্তি :

নওরোজ উয়-নওবহার-উয়
মি-উয় দিলরে-খাশত্
বাবর বেশ কুশকে আলম
দো-বারা নিস্ত।

রিকাবখানা, আবদারখানা আর মেওয়াখানার কর্মচারীদের কাছে আমার নির্দেশ পৌঁছে দেবার জন্যে নাজীরকে পাঠাই। সেই সঙ্গে বলে দিই, ঠিক সময়ের কিছু আগেই যেন ‘খুরিশ গরাণ খাদ্যের স্বাদ গ্রহণের জন্য উপস্থিত থাকে।

পাশ ফিরে শুই। অসুস্থ হলেও দায়িত্বের বোঝা মাথা থেকে নামে না।

তাজমহলের শুধু আভাস পাওয়া যায় শুয়ে শুয়ে। নিশ্চিন্তে মা নিদ্রা যান সেখানে। কোনও অশান্তি নেই তাঁর মনে। নিত্য দুবেলা কোর-আন শরিফ আবৃত্তি করে শোনাচ্ছেন মৌলবী।

কেন যে সবটুকু ভার আমার ওপর ছেড়ে গেলেন তিনি। বইতে পারব তো?

.

সম্পূর্ণ নিরাময় হয়ে উঠি একদিন। আওরঙজের চলে গিয়েছে। সব কিছু একঘেয়ে। কিছুই যেন ভাল লাগে না। এতদিন পালঙ্কে শুয়ে থাকার পর সুস্থ হবার যে আনন্দ, সে আনন্দ মোটেই উপভোগ করতে পারি না। নাদিরা এজন্যে আমার মনকে দায়ী করে। বলে, দু-চারদিন বাইরে ঘোরাফেরা করলে নাকি ঠিক হয়ে যাবে। দেখা যাক।

এদিকে বাদশাহ্ বড় ঘন ঘন অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। আগ্রার জলবায়ু মোটেই আর সহ্য হচ্ছে না তাঁর। বাবর-বংশের কোনও পুরুষের স্বাস্থ্য যে এত স্পর্শকাতর হতে পারে ভাবিনি। চূড়ান্ত বিলাসিতাই হয়তো তাঁর দেহকে এই পর্যায়ে এনে ফেলেছে। দিল্লিতে রাজধানী স্থানান্তরের জন্যে বড় বেশি ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন তিনি। তাঁর ধারণা, দিল্লিতে ফিরে গেলে তিনি আবার স্বাস্থ্য ফিরে পাবেন, আবার কর্মঠ হয়ে উঠবেন।

কক্ষের মধ্যে আপন মনে পায়চারি করি। নাজীরকে বাইরে পাঠিয়েছি। এ সময়ে একা একা থাকতে ভালই লাগছে। একা আকাশ-পাতাল চিন্তা করেও সুখ। এতদিন শয্যাশায়ী থেকেও যেন তৃষ্ণা মেটেনি।

হঠাৎ এক সময়ে নিজের দেহের দগ্ধ অংশ ভালভাবে দেখবার ইচ্ছে হয়। কেউ কোথাও নেই। ধীরে ধীরে গিয়ে দরওয়াজা অর্গলবন্ধ করি। একটির পর একটি শরীরের রেশমের পোশাক পালঙ্কের ওপর রাখি। শেষে আর কোনও পোশাকই থাকে না।

দেওয়ালে প্রকাণ্ড আরশি। তার সামনে গিয়ে দাঁড়াই। সুযোগ পেলে এভাবে নিজের দেহকে সব মেয়েই যাচাই করে দেখতে চায়। যারা বলে যাচাই করে না, তারা মিথ্যা বলে। কিন্তু আমি নিজের দেহের সৌন্দর্য দেখতে চাই না। সে বাসনা না মরলে যাবে না তাও জানি। তবু আজ আমি শুধু দেখতে চাই কতখানি অসুন্দর আমাকে করেছে সেই ভয়ংকর আগুনের শিখা যার গ্রাসে পড়ে গোয়ালিয়রের গুলরুখবাঈ-এর নূপুর-পরা পায়ের ছন্দ পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিয়েছে

দেখতে পাই নিজের বুক। বাম স্তনের নীচে খানিকটা জায়গা সাদা হয়ে রয়েছে। কোমরের ওপর আর কোথাও বিশেষ ক্ষতচিহ্ন চোখে পড়ে না। শুধু গায়ের রঙ যেন একটু মলিন। হয়তো শুয়ে থেকে থেকে এমন হয়েছে।

এবার দেহের নীচের অংশের দিকে চোখ নামাই। কোমর থেকে পায়ের আঙুল অবধি। ঊরুর ক্ষত আরও বিস্তৃত। অনেকখানি জায়গা বিশ্রী হয়ে রয়েছে। থাকুক। জাহানারা বেগমের দেহের এই দুই বিকৃতি যদি আমরণ এইভাবেই থাকে ক্ষতি নেই। পৃথিবীতে দ্বিতীয় ব্যক্তির দেখার সুযোগ ঘটবে না। চাঘতাই বংশের কুমারী জাহানারা বেগম—জীবন তার আকবর শাহের নিষ্ঠুর বিধানে গণ্ডিবদ্ধ।

হিন্দুরা আগুনকে বলে অগ্নিদেব। দেবতা যখন, তখন নিশ্চয়ই পুরুষ। আমার সঙ্গে রসিকতা করেছেন অগ্নিদেবতা। আমার কুমারীত্বের দিকে বহুদূর হাত বাড়িয়েছিলেন। কিছুটা হরণও করেছেন বলতে হবে। পৃথিবীতে পুরুষ মিলল না দেখে কৃপা করেছেন তিনি। আজ কোয়েল থাকলে আলোচনা করতে পারতাম! আমার বক্তব্য শুনে সে রাগত কিনা কে জানে। সে যে হিন্দু

কোয়েল থাকলে আর একটি খবরও এতদিনে মিলত, যে খবরের জন্য রোগশয্যার ওপর ছট্‌ফট্ করেছি, অথচ মুখ ফুটে কাউকে প্রশ্ন করতে পারি নি কখনো। আমার এই ধরনের সংকোচ জীবনে খুব অল্পই অনুভব করেছি।

এ পর্যন্ত কখনো কাউকে প্রশ্ন করতে পারিনি—আমার রক্ষাকর্তা কে? সেই সুপুরুষ বলিষ্ঠ আগন্তুকের চাহনি একটি বারের জন্যও ভুলতে পারিনি। মনের মণিকোঠায় কৃপণের ধনের মতো আগলে রেখেছি। প্রশ্ন করতে ভয়ও হয়েছে। এক অজানা আশাভঙ্গের ভয়। কিন্তু আজ যখন দু পায়ের ওপর দাঁড়াতে পেরেছি, আরশির সামনে নিজের নিরাবরণ দেহখানাকে মেলে ধরেছি, তখন আর নিজের এতদিনের সংযমকে ধরে রাখতে পারি না। জানতে হবে—এই মুহূর্তেই জানতে হবে।

পোশাকগুলি একটির পর একটি পরে ফেলি। একটু ক্লান্ত বোধ হয়। তবু দেয়াল ধরে দরওয়াজার দিকে অগ্রসর হই। খুলে দিই দরওয়াজা। কিন্তু আর পারি না। চোখের সামনে কেমন যেন অন্ধকার হয়ে যায়। কোনওরকমে শয্যায় এসে শুয়ে পড়ি।

—বেহুঁশের মতো পড়ে থাকি—কতক্ষণ জানি না। শেষে একসময়ে কপালে নরম হাতের স্পর্শ পাই। চোখ মেলে দেখি নাদিরা। আমার মুখের সামনে ঝুঁকে উৎকণ্ঠিত হয়ে চেয়ে রয়েছে।

—শরীর খারাপ হয়েছে?

—না নাদিরা। একটু দুর্বল বোধ করছি।

—এখন তবে যাই। পরে আসব।

—না বসো। ওর হাত ধরে বসাই।

চুপ করে বসে থাকে নাদিরা। কীভাবে শুরু করবে বুঝতে পারছে না বোধ হয়। এতদিন কেটে গেল তবু ওর সংকোচ গেল না। দারার নিশ্চয়ই ভালই লাগে ভীরু নম্র স্বভাব।

—দারার তবির আঁকা কেমন চলছে নাদিরা?

—অনেক দিন ছেড়ে দিয়েছে।

—সে কি? ছাড়ল কেন?

—বলতে পারি না।

—অমন খেয়ালে চললে কোনওটাই হবে না।

—এখন আবার সংগীত শিক্ষার ঝোঁক চেপেছে।

—সে আবার কী!

—বুন্দেলা রাজা ছত্রশালের গান শুনে মুগ্ধ হন। তারপরই গানের দিকে ঝোঁক।

—বুন্দেলা রাজা? তিনি তো দরবারে আসেননি কখনো।

—এসেছিলেন। আপনি তখন অসুস্থ।

—তাই হবে।

হঠাৎ নাদিরার চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। সজোরে আমার হাত চেপে ধরে বলে ওঠেন—কিন্তু আপনি তো দেখেছেন তাঁকে।

—আমি?

—হ্যাঁ আপনি। নিশ্চয়ই দেখেছেন। তবে তা মনে থাকবার কথা নয়। অমন সময় কারও কিছু মনে থাকে না।

—কবে দেখলাম?

—সেই দুর্ঘটনার দিনে।

—কত লোক সেদিন দরবার ছেড়ে মজা দেখতে এসেছিল।

—কিন্তু তিনি যে আপনার আগুন নিভিয়েছিলেন। আপনার কথা শুনে কেউ সাহস পায়নি এগোতে। তিনি সে কথায় ভ্রূক্ষেপ না করে আপনাকে জড়িয়ে ধরলেন। তবেই তো বাঁচলেন আপনি। সামান্য আহতও হয়েছিলেন তিনি।

আমার বুকের মধ্যে কাঁপতে থাকে। চোখের সামনে আবার অন্ধকার হয়ে আসে যেন। কোনওরকমে নাদিরাকে চলে যাবার জন্যে ইঙ্গিত করি। মাথার দিকে দু হাত ছড়িয়ে উপুড় হয়ে শুই। ছত্রশাল—ছত্রশাল—ছত্রশাল। প্রশ্ন না করতেই উত্তর পেয়ে গেলাম। ছত্রশাল। গায়ক সে। আমি জানতাম এমন একটা কিছু হতেই হবে। দারা মুগ্ধ হয়েছে ওর গানে।

আবার কি আসবে সে? আসবে। আমাকে দেখেছে-আমার দেহ স্পর্শ করেছে। সে আসবে। আমার মন ডেকে বলছে, সে আসবেই।

.

সে এল। আরও অনেক পরে।

জাহানারার শত স্বপ্ন মিথ্যে হতে পারে। কিন্তু তার মন ডেকে যা বলে তা কখনো মিথ্যে হয় না। তাই নিজের মনকে যেমন ভালবাসি, তেমনি ভয়ও করি!

ঝরোকার পাশে সেদিনও দাঁড়িয়েছিলাম। দৃষ্টি ঘুরে মরছিল দরবারের প্রতিটি মানুষের মুখে মন ভরে উঠেছিল হতাশায়। সহসা দেখলাম প্রবেশ পথ দিয়ে দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে আসছে এক পুরুষ। চমকে উঠলাম। ও চাহনি ভোলবার নয়। আমার গাল দুটি লাল হয়ে ওঠে কি? জানি না। সাক্ষী নেই কেউ। কোয়েল চলে যাবার পর থেকে একাই এসে দাঁড়াই এখানে। কিন্তু বুক যে বড় বেশি ওঠা-নামা করছে। মনে হয়, যতটা প্রশ্বাস সাধারণত আমি নিই তার চেয়েও বেশি বাতাস চাইছে আমার বুক। হাঁপিয়ে উঠি।

বাদশাহের একেবারে সামনে এসে অভিবাদন করে সে। বাদশাহ্ উঠে দাঁড়ান। বহু সম্মানের অতিথি কিংবা আমির-ওমরাহ্ ছাড়া বাদশাহ্ নিজে কখনও উঠে দাঁড়ান না। নিজের পিতার প্রতি মন আমার প্রসন্নতায় ভরে যায়।

—ছত্রশাল, আপনার কাছে আমি ঋণী–সে কথা আবার স্বীকার করছি।

ছত্রশালের জবাব আমি শুনতে পাই না। চাইনি শুনতে। কারণ যেটুকু সন্দেহের অবকাশ ছিল তাও ভেঙে দিয়েছেন বাদশাহ্। নানান চিন্তার জাল আমার মস্তিষ্কে। তবু তার মধ্যেও এটুকু আমি ভাবতে পেরেছি যে ছত্রশাল নয়, রাজা—আমি ওকে ছোট্ট করে ‘রাজা’ বলেই ডাকব।

ছত্রশাল সামনের একটি আসন গ্রহণ করেন। তাঁর পাশে নজরৎ খাঁ উপবিষ্ট। তুলনা হয় না। দেহে নজরৎ কম সুন্দর নয়। কিন্তু দেহের মধ্যেও সব মিলিয়ে দেহাতীত এক সৌন্দর্য রয়েছে রাজার যার তুলনা সহসা মেলা ভার। সেই সৌন্দর্য এক অপূর্ব আভিজাত্য এনে দিয়েছে তার বসবার ভঙ্গিতে, তার দৃষ্টিতে। আমির হয়ে জন্মালেই এ জিনিস পাওয়া যায় না—এ জিনিস আল্লার দান। নিজের চেষ্টায় যেটুকু পাবার নজরৎ খাঁ তা পেয়েছে, কিন্তু চেষ্টার অতিরিক্ত যে জিনিসটি রয়েছে সে তা কী করে পাবে?

দারাকে বলা ছিল যে ঝরোকার ছিদ্র দিয়ে ওড়নার প্রান্ত গলিয়ে দিলে সে বুঝবে যে তাকে আমি ডাকছি। ঝরোকার পেছনে আমি থাকলে সে তাই ঘন ঘন চায় এদিকে। কিন্তু আজ সে একবারও চাইছে না, বহুক্ষণ আগেই আমার ওড়নার অনেকখানি ছিদ্রপথে ওদিকে চলে গিয়েছে। হয়তো হাওয়ায় দুলছে ওদিকে আমার চুমকি বসানো মসলিন।

বড় রাগ হয়। দারার খেয়াল নেই। সংগীতগুরুকে পেয়ে সে আত্মহারা। তার মুখ চোখের চেহারা দেখেই বোঝা যায়। নিজের আসন ছেড়ে সে গিয়ে রাজার পাশে শূন্য আসনে বসে তার হাতের ওপর হাত রাখে। রাজাও তার হাতখানায় চাপ দেয়। দারার কক্ষ হলে দারার মুখ দিয়ে কথার ফিনকি ছুটত। বড় রাগ হয়।

শেষে একসময় দয়া করে দারা এদিক-ওদিক দৃষ্টি ফেলে। দেখতে পায় সে মসলিনের চুমকির উজ্জ্বলতা। ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়। বাদশাহের পানে মুহূর্তকাল চেয়ে থেকে ঝরোকার দিকে এগিয়ে আসে। আমি আবার হাঁপিয়ে উঠি।

লজ্জিত হাসি হেসে আমার সামনে দাঁড়িয়ে সে বলে—একেবারে মনে ছিল না।

—তা থাকবে কেন? অমন ভুলো-মন নিয়ে নাদিরার পাশে বসে থাকা যায়। মসনদে বসার দুরাশা করা যেতে পারে না।

—খুব রেগেছ?

—না, রাগব কেন? মুঘল-শাহজাদীদের রাগের কোনও মূল্য আছে?

—জাহানারা!

—দারা, এতদিন পরে ছত্রশাল এলেন। তাঁর দয়াতেই আমি গুলরুখকে অনুসরণ না করে এখানে দাঁড়িয়ে আছি। অথচ তোমাদের কারও একবারও মনে হল না যে আমি কৃতজ্ঞতা জানাতে পারি?

—অন্যায় হয়েছে। আমি এখনি নিয়ে আসছি তাঁকে।

—তুমি না এলেও চলবে। শুধু তাঁকে পাঠিয়ে দাও।

দারা চলে যেতেই আমি দেওয়ান-ই-খাসের পাশে ছোট একটি ঘরে গিয়ে বসি। সে ঘর বেগম এবং শাহজাদীদের সঙ্গে বাইরের লোকদের সাক্ষাতের জন্যে নির্মিত। সে ঘরের সবটুকুতে ঝরোকার সূক্ষ্ম কাজ। বেগম শাহজাদীরা যাকে কৃপা করে, ঘরটির একপাশে এসে সে দাঁড়িয়ে মুঘল-নারীদের সঙ্গে কথা বলার সৌভাগ্য অর্জন করে। অথচ ঠিকমতো দেখতে পায় না ঝরোকার ভেতর দিয়ে। দরবার থেকে এই সাক্ষাৎকার দেখা যায় না।

কিছুক্ষণ পরে ভারী পায়ের শব্দ এগিয়ে আসে। নজরৎ খাঁয়ের মুখের অবস্থা একবার কল্পনা করি। তার পাশের আসন ছেড়ে রাজা এদিকে আসায় তার মনে ঝড় বইছে কি? জানি না। জানার মতো মনের অবস্থা আমার নেই। আমি ভাবি, কীভাবে কথা শুরু করব।

রাজা এসে দাঁড়ায় নির্দিষ্ট স্থানে।

—রাজা!

আমার কণ্ঠস্বরে আরও মধু ঢালতে পারতাম কি? ঝরোকার ভেতর থেকে দেখতে পাই ছত্রশালের উন্নত বক্ষ ফুলে ওঠে।

—রাজা, কাকে আপনি বাঁচালেন একবার দেখতেও ইচ্ছে হয়নি কি?

বলা হল না। আমি জানি এর চেয়েও সুন্দর কথা আমি বলতে পারতাম। কিন্তু পারলাম না। অনেক চেষ্টা করেও পারলাম না। অতি সাধারণভাবে অতি নগণ্যভাবে তাই নিজের দীনতা প্রকাশ করে ফেলি।

জবাব দেবার আগে অপেক্ষা করে রাজা। এমনভাবে কথার সূত্রপাত করব, সে কল্পনা করেনি। ভেবেছিল, নিয়ম-মাফিক একটু কৃতজ্ঞতা, একটু কুশল প্রশ্ন করে ইতি টেনে দেব। ভাবেনি আমার প্রথম প্রশ্নের মধ্যে একটা প্রচ্ছন্ন দাবির সুর মেশানো থাকবে।

ধীরে ধীরে বলে রাজা,—বিপদ থেকে রক্ষা করা রাজপুতদের ধর্ম শাহজাদী। আর শাহজাদীকে রক্ষা না করা অপরাধ।

—সেই অপরাধের ভয়েই তবে সেদিন—

—না না। কোনও কিছুই মনে হয়নি সে মুহূর্তে।

—কিছুই নয়?

রাজা ইতস্তত করে।

—বলুন।

—শাহজাদী, রাজপুতরা তাদের মনের মধ্যে অনেক কথাই চেপে রাখতে পারে। কিন্তু মুখ ফুটে একবার বলতে শুরু করলে মিথ্যা বলতে পারে না। আপনি আমাকে প্রশ্ন করবেন না। -কিন্তু প্রশ্ন যে আমি করবই রাজা। একটা কথা জেনে রাখুন, যাঁর দয়ায় আমি আজ বেঁচে আছি তিনি যদি সত্যি কথা বলেন, সে সত্যি যত অপ্রিয় হোক না কেন, অপরাধ বলে গণ্য হতে পারে না।

—সে কথা ঠিক বলে মেনে নিলেও এখানে মুঘল-বংশ, রাজনীতি, আরও অনেক আদব-কায়দার প্রশ্ন জড়িত রয়েছে। আপনি শাহানশাহ্ শাহজাহানের দুহিতা আর আমি তাঁর অনুগত সামান্য এক রাজা।

—আপনি তো কোনও রীতিই মানেন না।

—সে কি শাহজাদী!

—আমার কথা শুনে নজরৎ খাঁ তো সেদিন আমাকে রক্ষা করতে সাহস পাননি। আপনি কেন এগিয়ে এলেন? আমি শাহজাদী, আমার আদেশ অমান্য করেছেন আপনি

রাজা চুপ করে থাকে। সে বোধহয় জবাব খুঁজে পায় না। খুব লজ্জা হয় আমার। অমন দীর্ঘ দেহ বলিষ্ঠ পুরুষ আমার সঙ্গে কথায় হেরে গেল।

—তাই আমি বলছিলাম রাজা, ওসব ভুলে যান। ভাবুন আমরা দুজনা সাধারণ মানুষ। এখানে সত্যি কথা বলার বাধা নেই।

—তবু আছে।

—কোন্ বাধা?

—আপনি নারী।

—তবে আমি কি বুঝব নারীর কাছে পুরুষেরা সত্যি বলে না কখনো?

—বলে, নিশ্চয়ই বলে। তবে নারীবিশেষকে।

—আর আমি সেই বিশেষ নারীটি তাই না রাজা?

রাজা আবার চুপ। বড় সাংঘাতিক লোক দেখছি। নজরৎ হলে এতক্ষণ কী করত? সহজেই অনুমান করতে পারি। হাতে বেহেস্ত পেত সে। গলে পড়ত।

—রাজা, আগুনে আমি কতটা কুৎসিত হয়েছি?

—আপনি কুৎসিত হননি।

—কে বললে?

—সব খবর আমি রাখি।

—ও! যদি হতাম?

—আফশোস থাকত।

বড় কাটা কাটা কথা বলে। ভেতরে কি রস বলে পদার্থ নেই? চোখের দৃষ্টি তো অন্য কথা বলে। সে দৃষ্টির মধ্যে চূড়ান্ত কিছু আছে।

হঠাৎ আমার চোখ ছাপিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। রাজা বুঝতে পারে না। সে ঝরোকার ওপাশে দাঁড়িয়ে।

—রাজা, সত্যি কথা জানতে চাই না। কিন্তু আপনাকে আমি জীবনে ভুলব না।

—শাহজাদী কাঁদছেন? ছত্রশাল পাথরের জালের ওপর হাত রেখে ছটফট করে।

—না কাঁদব কেন?

দরবার-কক্ষের উত্তেজিত আলোচনা ভেসে আসে। দিল্লিতে যাবার দিন স্থির হচ্ছে সম্ভবত। আর বেশি দেরি নেই। বাদশাহ্ দিল্লি গিয়ে দেখে এসেছেন ইতিমধ্যে। প্রাসাদ নির্মাণের কাজ প্রায় শেষ। আমাদের দুজনার কথা এ-সময়ে কারও মনে নেই। শুধু নজরৎ ছাড়া।

ছত্রশাল ঝরোকার ওপর মাথা রেখে বলে,—আমি সত্যি কথাই বলব শাহজাদী।

আমার স্বর কেঁপে ওঠে,—কিন্তু আমি তো সেই বিশেষ নারী নই।

—হ্যাঁ। আপনি সেই নারী। সন্দেহ নেই তাতে। শাহজাদী, সেদিনের মতো ঘটনা যে-কোনও জায়গায় ঘটলেই আমি ছুটে যেতাম। কিন্তু সেদিন আমার মনের প্রথম কথাটি ছিল এই

অপরূপাকে পৃথিবী থেকে মুছে যেতে দেব না, কিছুতেই নয়। তাই আপনার আদেশ অমান্য করেছিলাম। আজ আপনি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। এবারে শাস্তি দিন।

এবারে কী বলব? মাথায় যে আসে না। সময় চলে যায়। ও পক্ষও নীরব। অথচ অনেক কিছুই যে বলার আছে। যদি শাহজাদী না হতাম, বলতে পারতাম।

—শাস্তি আপনি পেতে চান রাজা?

—হ্যাঁ, অন্যায়ের শাস্তি মাথা পেতে নিতে রাজপুতরা অভ্যস্ত।

—জানি। খুব ভালভাবে জানি। মুঘল-দুহিতাকে রাজপুত সম্বন্ধে বলবেন না। এই দেহের অনেকটাই যে রাজপুত।

একটু থেমে ধীরে ধীরে বলি,—শাস্তি আমি দেব আপনাকে। কঠিন শাস্তি।

আমার কথা বলার ভঙ্গি কতখানি কঠিন হল বলতে পারি না। কারণ অপরদিকে রাজার মুখে কৌতুকের হাসি ছড়িয়ে পড়ে। সে বলে,—শাস্তির কথা কি দরবার কক্ষে শুনতে পাবো শাহজাদী?

—না। এখনি বলছি। আজ দরবার-শেষে সবাই যখন চলে যাবে, তখন দারাকে ডেকে নিয়ে আপনি এই ঝরোকার সামনে গালিচায় এসে দাঁড়াবেন। আমি তানপুরা আনিয়ে রাখছি।

—শাহজাদী!

—কোনও প্রতিবাদ নয়। আমার হুকুমের নড়চড় হয় না। এখানে বসেই আমি শুনব আপনার সংগীত।

শাহজাদী, আপনার দেহটিকে রক্ষা করার জন্য সেদিন যখন ছুটে গিয়েছিলাম, তখন কিন্তু কল্পনাও করতে পারিনি আপনার মন এত সুন্দর।

—এত সহজেই আমার মন জানা হয়ে গেল?

—হ্যাঁ। এতক্ষণ ধরে তবে কি বৃথাই কথা বললাম?

—আর কিছু জেনেছেন?

একটু ইতস্তত করে রাজা বলে,—হ্যাঁ। কিন্তু তাতে কি কিছু এসে যায়?

—যায় বই কী। আমার গলা কাঁপে।

রাজার প্রশস্ত ললাটে বিন্দু বিন্দু ঘাম ফুটে ওঠে। সে বলে,—মাঝখানে পাথরের জালের ব্যবধান, শাহজাদী। চেষ্টা করলে বোধ হয় আমি এ জাল ভেঙে ফেলতে পারি।

—শুধু শুধু অত শক্তিক্ষয়ের প্রয়োজন নেই। সংগীত-শেষে দারা আপনাকে অঙ্গুরিবাগে পৌঁছে দেবে। সেখানে দেখা হবে। এখন আপনি দরবারে ফিরে যান। মুখখানা যতটা সম্ভব ফ্যাকাশে করে মাথা নিচু করে টলতে টলতে গিয়ে আসন সংগ্রহ করুন।

ছত্রশাল অট্টহাস্য করে উঠতে গিয়ে চেপে যায়।

সে চলে যেতে আমি ভাবি, বাদশাহ্ শাহজাহানের দুহিতা হয়েও বড় তাড়াতাড়ি ধরা পড়ে গেলাম। যেন এতদিন ধরা দেবার জন্যেই উন্মুখ হয়ে বসে ছিলাম। নিজের দৈন্য এতটা কিছুতেই প্রকাশ করতাম না। কিন্তু ও যদি হঠাৎ আবার চলে যায়? তাছাড়া মাঝখানে রয়েছে নজরৎ খাঁ। তার প্রতি দারার প্রীতির প্রাবল্য। রাজার কাছে একটু সুলভ হলামই বা।

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *