মমতাজ-দুহিতা জাহানারা – ৩

রোশনারা, শাহজাদীর সম্মান বোধ হয় জলাঞ্জলি দেবে। তার মনের সুতীব্র কামনা আর বাসনা, রূপ হয়ে ফেটে পড়েছে তার দেহ বেয়ে। পুরুষেরা সে রূপের দিকে চাইলে উন্মাদ হয়। রোশনারা জানে সে কথা। পুরুষের সামনে তাই অল্পতেই তার শরীরে ব্যথা লাগে। সে কাতর হয়ে পড়ে। এই কাতরতার মধ্যে তার মনের আদিম ক্ষুধা উৎকটভাবে প্রকাশ পায়। দেখে শিউরে উঠি আমি। সে মনে করে কেউ বুঝি বুঝতে পারে না। পুরুষেরা বোঝে না হয়তো; কিন্তু আমার চোখকে কীভাবে ফাঁকি দেবে সে, আমিও যে নারী। যে প্রবৃত্তিগুলি তার মধ্যে দেখা দিয়েছে, আমাকেও যে সেগুলি অহরহ চঞ্চল করে তোলে। কিন্তু ওর মতো আমি ভুলে যাই না যে আমি শাহানশাহ শাহজাহনের কন্যা। আর সবার ওপর আমি নারী।

রোশনারা এক সমস্যার সৃষ্টি করেছে। মা বেঁচে থাকলে হয়তো একটা সমাধানের পথ খুঁজে দিতেন। কিন্তু তিনি নেই।

হঠাৎ মনে পড়ে জেসমিন প্রাসাদের কথা। হয়তো নূরজাহান এই বিপদে কোনও পথ দেখাতে পারবেন।

বাবা পছন্দ করেন না জেসমিন প্রাসাদে যাতায়াত। তাঁর ধারণা যত পরিবর্তনই হোক ভূতপূর্ব দিল্লিশ্বরীর, সুযোগ পেলে নিজে জামাতা শাহরীয়রের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে ছাড়বেন না। অনেক আশা নিয়েই নূরজাহান জাহাঙ্গীরের অপর পুত্র শাহরীয়রের সঙ্গে নিজের কন্যার বিবাহ দিয়েছিলেন। আশা ছিল কন্যা একদিন তাঁর মতোই দিল্লির অধীশ্বর হবে। সে আশায় ছাই ঢেলে দিয়েছেন শাহজাহান। তাই তাঁর ভয়।

মা জীবিত থাকতে যখন একবার জেসমিন প্রাসাদে গিয়েছিলেন, মুখে কিছু না বললেও মনে মনে আতঙ্কিত হয়ে উঠেছিলেন বাদশাহ্। মুখে মায়ের কোনও কাজেরই কোনওদিন আপত্তি করেননি তিনি। সেই থেকে জেসমিন প্রাসাদে যাওয়া ছেড়ে দিয়েছিলেন মা।

তাই বলে বাদশাহ্ কখনো অসম্মান করেননি নূরজাহানকে। বার্ষিক পঁচিশ লক্ষ টাকা বৃত্তি বরাদ্দ করে সযত্নে এককোণে সরিয়ে রেখেছিলেন নিজের বিমাতাকে। যে নারী ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত থাকাকালে মুহূর্তের জন্যেও শাজাহানের মঙ্গল চিন্তা করেননি, তাঁকে এইভাবে সসম্মানে বেঁচে থাকবার অধিকার দেওয়া শাজাহানের মতো উদার ব্যক্তির পক্ষেই সম্ভব।

পিতার অজ্ঞাতসারে জেসমিন প্রাসাদে যাবার জন্যে প্রস্তুত হই। গায়ে জড়িয়ে নিই ‘বাদল-কিনারী’ ওড়না। এই ওড়না নূরজাহানেরই আবিষ্কার। ভাবলাম এভাবে সজ্জিত অবস্থায় গেলে প্রথম দর্শনে তিনি খুব খুশিই হবেন। সেই ছোটবেলায় কবে তিনি আমাকে দেখেছেন, এখন হয়তো চিনতে পারবেন না।

কাউকে সঙ্গে নিই না। কোয়েলকেও না। একা গিয়ে জেসমিন প্রাসাদের সোপানে দাঁড়াই। প্রহরী আর নাজীররা আমাকে দেখে অবাক হয়। আমার পরিচ্ছদের বৈশিষ্ট্যে তারা বুঝতে পারে সাধারণ নারী আমি নই। তাই বাধা দিতে পারে না ভেতরে প্রবেশ করতে। আবার নূরজাহানের অনুমতি ব্যতীত ছেড়ে দেওয়াও বিপদ। শেষে তাদেরই একজন অন্তঃপুরের দিকে দৌড়ে যায়।

মাথার ওপর ওড়নাটা ভালভাবে টেনে দিই—এসেই যাতে আমার মুখখানা স্পষ্ট না দেখতে পারেন তিনি। সোপানের ওপর অপেক্ষা করি।

একটু পরেই ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে আসেন একজন শুভ্রবসনা নারী। কিন্তু একী রূপ। যে-রূপ এক সময়ে ভারতের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এনেছিল প্রচণ্ড আলোড়ন—যে রূপের উগ্র মোহে বাদশাহ্ জাহাঙ্গীর অনেক সময়ই তাঁর ব্যক্তিত্বটুকু পর্যন্ত বিসর্জন দিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করেননি, সে-রূপ এখনো ম্লান হয়ে যায়নি। এখনো তিনি নূরজাহান। ভারতবাসীরা হয়তো তাদের অসামান্য রূপসী ভূতপূর্ব সাম্রাজ্ঞীকে ভুলতে বসেছে। অন্তত বাদশাহ্ শাহজাহানের সদা সতর্ক ব্যবস্থার ফলে নূরজাহানের বর্তমান জীবন সম্বন্ধে তাদের আগ্রহ নেই। কিন্তু একবার যদি এই শুভ্রবসনা রমণী আগ্রার দুর্গে উঠে ঝরোকা-দর্শন দেবার সুযোগ পান তবে কি শাহজাহানের শান্তির রাজ্যে ঝড় ওঠা একেবারে অসম্ভব?

হারেম কিংবা দরবারে নূরজাহানের নাম উচ্চারিত হয় না। কিন্তু আমি সোপানশ্রেণির ওপর দাঁড়িয়ে অস্ফুটস্বরে বার বার বলি—নূরজাহান—নূরজাহান—নূরজাহান

মায়ের অসামান্য রূপ দেখেছি। যেন শিশির-স্নাত একগুচ্ছ বসরার গুলাব। তবু যেন তাতে কীসের অভাব ছিল। সমালোচকের নিক্তির বিচারে হয়তো মা অধিকতর রূপসী। কিন্তু ব্যক্তিত্বের সমন্বয়ে তাঁর রূপ নূরজাহানের মতো এতখানি পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছিল কি?

শুনেছি বড় উগ্র ছিল নূরজাহানের রূপ। কিন্তু কোথায় সেই উগ্রতা? তবে কি আঘাত পেয়ে সে উগ্রতা বিনষ্ট হয়েছে? হয়তো তাই। আমি দেখি অতি স্নিগ্ধ জ্যোতি।

প্রথম দর্শনেই বুঝলাম সত্যিই পরিবর্তন হয়েছে নূরজাহানের। তিনি এসে একেবারে সামনে দাঁড়ান। কৌতূহলী নাজীর আর খোজারা দূরে দাঁড়িয়ে ব্যগ্রভাবে চেয়ে থাকে।

আমি মুখের ওপর থেকে ওড়নাখানা ধীরে ধীরে সরিয়ে দিই। চমকে ওঠেন তিনি। অস্ফুটস্বরে বলে ওঠেন,–আরজমন্দ বানু?

মৃদু হাসি আমি।

—কে তুমি?

—জাহানারা।

—আশ্চর্য।

—সত্যিই কি এতটা সাদৃশ্য?

—হ্যাঁ। তবে তার ত্বক ছিল আরও মসৃণ। তার চোখের তুলনা ছিল না কিন্তু প্রথম দর্শনে চমকে দিতে পার।

নূরজাহান আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরেন। অনেকক্ষণ সেইভাবে থাকেন। বুঝতে পারি আমার মাথার ওপর দু ফোঁটা চোখের জল পড়ে

তিনি আমাকে ছেড়ে দিয়ে বলেন,—আরজমন্দ এককালে আমার খুব প্রিয় ছিল। কিন্তু ঐশ্বর্য অনেকের মতো তাকেও আমার কাছ থেকে অনেক দূরে সরিয়ে দিয়েছিল। সে কিন্তু আমাকে ভোলেনি। বেগম মমতাজ হয়ে অনেক অসুবিধার মধ্যেও আমার সঙ্গে দেখা করে গিয়েছে

—জানি।

নূরজাহান আপ্রাণ চেষ্টায় তাঁর ভাবাবেগ মন থেকে ঝেড়ে ফেলে আমার হাত ধরে প্রাসাদের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেন। চলতে চলতে আমার ওড়না স্পর্শ করে বলেন, –বাদল-কিনারী?

—হ্যাঁ। দেখে আপনি খুশি হবেন—তাই।

—অমন আরও অনেক জিনিসের প্রচলন করেছিলাম। থাকবে কি না জানি না।

শেষে একটি কক্ষের মধ্যে এসে তিনি থেমে যান। সে কক্ষে আসবাবপত্রের বালাই নেই। বন্দি হলেও, নূরজাহানের বিলাসিতার পথে কোনোরকম অন্তরায়ের সৃষ্টি করেননি বাদশাহ্। উপযুক্ত বার্ষিকীর ব্যবস্থা করেছেন। তবে এমন শ্রীহীন কেন নূরজাহানের কক্ষ? দেখি শুধু মাঝখানে একটা উচ্চ বেদির ওপর অতি সাধারণ শয্যা। পরিধানে পোশাকের তো কোনও চাকচিক্য নেই। মনে মনে দুঃখ হয়। হিন্দু সন্ন্যাসিনীর মতো হয়তো তিনি দিনের পর দিন একটি করে বিলাসিতার সামগ্রী বিসর্জন দিয়ে চলেছেন। কতখানি মনের জোর আর সাধনার ফলে তাঁর মতো নারীর পক্ষে এটি সম্ভব! হয়তো জীবনের শেষ দিনে লজ্জা নিবারণের জন্য পরিধেয় বস্ত্রটি ছাড়া আর কিছুই তিনি রাখবেন না।

নূরজাহান কি হিন্দুধর্মের দ্বারা প্রভাবিত হলেন শেষ পর্যন্ত?

না। কক্ষের এককোণে একটি ছোট্ট চৌকির ওপর কোর-আন শরিফ তখনো খোলা অবস্থায় রয়েছে। তাঁর চোখ-মুখের পবিত্র ভাব দেখলে স্পষ্ট বোঝা যায় আমি আসার পূর্ব-মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি একমনে পড়ছিলেন ওটি।

জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাঁর দিকে চাই।

মৃদু হাসেন তিনি। আমার মনোভাব বুঝতে পারেন। ইঙ্গিতে পাশের ঘরে তাঁকে অনুসরণ করতে বলেন।

সে ঘরে গিয়ে স্তম্ভিত হই। যেন এক ফুলের রাজ্যে গিয়ে উপস্থিত হয়েছি। কক্ষের চারপাশে দেয়াল পুষ্পে পুষ্পে ঢাকা পড়েছে। একটি বিরাট শয্যা পাতা রয়েছে মাঝখানে, তার চতুর্দিকে চারটি সোনার বড় ধূপদানি। ধূপের সুগন্ধে কক্ষ আমোদিত। শয্যার ওপর গুচ্ছ গুচ্ছ রজনিগন্ধা আর সেই রাশিকৃত পুষ্পের মাঝখানে সুবর্ণ-নির্মিত পটে বাদশাহ্ জাহাঙ্গীরের প্রতিচ্ছবি।

আমি বিহ্বল হয়ে পড়ি। মুখ দিয়ে কথা সরে না। জাহাঙ্গীরের হাসি মুখখানা অতি পরিচিত হলেও একটি পরিতৃপ্তির ভাব এর আগে কখনো চোখে পড়েনি। তিনি যেন তাঁর প্রিয়তমা বেগমের প্রতিটি ভাব, প্রতিটি আবেগ আর কার্যকলাপের স্বাদ গ্রহণ করে চলেছেন একটু একটু করে। ফুলের শয্যার ওপর বসে গর্বে তাঁর বুক ভরে উঠেছে। বেঁচে থাকতে নূরজাহান হয়তো তাঁর সামনে কোন দিনই এভাবে নিজেকে নিঃস্ব করে মেলে ধরতে পারেননি। হয়তো দিল্লিশ্বরের মনে চিরদিনই এক অপরাধ-বোধ ছিল যে মেহেরউন্নেসাকে তিনি জবর-দখল করেছেন পূর্ব- স্বামীর হেফাজত থেকে হীন চক্রান্তের দ্বারা—সেজন্য বেগমকে খুশি রাখতে তাঁর চেষ্টার অন্ত ছিল না।

নূরজাহানের চোখে জল। আমারও চোখ কেন যেন শুষ্ক থাকে না।

—আজ ওঁর জন্মদিন।

বড় লজ্জিত হই আমি। ভূতপূর্ব বাদশাহের জন্মদিনটি অন্তত পালন করার রীতি থাকা উচিত ছিল দেশে। হয়তো সব দেশেই পালন করা হয়। শুধু অভিশপ্ত মুঘল-বংশে এ রীতি চিরতরে বন্ধ। ভালভাবে ভাবতে গেলে বাদশাহ জাহাঙ্গীরকেই দায়ী বলে মনে হয়। মসনদ নিয়ে পিতার সঙ্গে বিবাদের এক মারাত্মক সংক্রামক ঐতিহ্যের প্রচলন করে গিয়েছেন তিনি, যা তাঁর পুত্ররাও অনুসরণ করছেন। আমার ভাইদের রক্তের মধ্যেও সেই সর্বনাশা বীজ লুকিয়ে রয়েছে কি না কে বলতে পারে?

—তুমি সঙ্কুচিত হয়ো না জাহানারা। তোমার সঙ্কোচের কোনও কারণ নেই। এ দিনটি আমার ব্যক্তিগত। এ দিনের খবর আর কেউ রাখে না বলে কাউকে দোষ দিই না। দোষ তো ওঁর—যিনি ওখানে বসে মুচকি হাসছেন।

নূরজাহান আঙুল দিয়ে ছবিটি দেখিয়ে দেন।

এই অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতির প্রভাব কাটতে সময় লাগবে জানি। তাই যে জন্যে ছুটে এসেছি এখানে সে প্রসঙ্গ উত্থাপন করতে পারি না। বলতে পারি না তাঁকে, রোশনারার মতিগতির কথা! উপদেশ চাইতে পারি না।

বাইরের অলিন্দে গিয়ে দাঁড়াই আমরা। স্তব্ধ দ্বিপ্রহর। উদ্যানে সূর্য কিরণস্নাত গাছপালাগুলি অপরাহ্নের শীতল হাওয়া গায়ে লাগাবার জন্যে উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছে। ফুলের সজীবতাও ম্রিয়মাণ।

—খুশবু পাচ্ছ জাহানারা?

—ফুলের?

—না।

—গোস্ত?

—হুঁ। মতবাখ থেকে ভেসে আসছে।

—গোস্ত! বিস্মিত হই আমি।

—হ্যাঁ। জহাঁগিরী খিচুরী, দো-পেঁয়াজা, হালিম গোস্ত আর আবাজীর। বে-গোস্তও রয়েছে।

—কিন্তু আপনি তো গোস্ত খাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন বলে শুনেছি।

—না, না, আমার জন্যে নয়। ওঁর জন্মদিনে খাওয়াব। আর সুরাও। বড় ভালবাসত সুরা। শেষের দিকে খেতে পারত না। হাকিমের কড়া নির্দেশ ছিল। খেলেই পেটে অসহ্য ব্যথা হত। তাই দেখতে পেলেই হাত থেকে ছিনিয়ে নিতাম আমি। এখন সে কথা ভাবলে বড় কষ্ট হয়। তাই মনের সাধ মিটিয়ে সুরা দেব।

নূরজাহান পাগল নন। তাঁর চোখের দৃষ্টি বুদ্ধিতে উজ্জ্বল।

অনেকক্ষণ নীরব থাকি দুজনা। তারপর টুকরো টুকরো কথার আদান প্রদান হয়। রোশনারার প্রসঙ্গ উত্থাপনের সুযোগ উপস্থিত হয়েছে জেনে ধীরে ধীরে তার দ্রুত পরিবর্তনের কথা নূরজাহানকে খুলে বলি।

শুনে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থাকেন তিনি। শেষে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন—এমন হওয়াই তো স্বাভাবিক জাহানারা। কী করতে পার তুমি?

আমি বাধা দেব। বাবাকে বলব। ভাইদের বলব।

—খবর্দার। সর্বনাশ হয়ে যাবে।

—আত্মহত্যা করবে তো? করুক।

—না আত্মহত্যা খুব সহজ সমাধান। তার চেয়েও ভয়ংকর কিছু ঘটতে পারে।

—তাই বলে সে হারেমকে কলুষিত করবে?

নূরজাহান হেসে ওঠেন। আমার পিঠের ওপর আলগোছে হাত রেখে বলেন—হারেম আবার পবিত্র হল কবে থেকে জাহানারা?

আমার সহ্য হয় না। উত্তেজিতভাবে বলে উঠি—যে হারেমে যোধাবাঈ জীবন কাটিয়েছেন, যে হারেমে তাজবেগম শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন, পরভেজের কন্যা দারাশুকোর বেগম নাদিরার চপ্পল যে হারেমের পাষাণ স্পর্শ করে—সে হারেমে পবিত্রতার ছোঁয়া লেগেছে বই কী।

নূরজাহানের মুখখানা মায়ের স্মৃতিসৌধের মতো সাদা হয়ে যায়। তবুও থামতে পারি না। বলে চলি–হারেমের ছাদের গোপন কোণে বাদশাহের দৃষ্টির অলক্ষ্যে রাজপুত বেগমদের প্রতিষ্ঠিত শিবলিঙ্গ ভারতের সব শক্তিটুকু হাতে পেয়েও কি আপনি সরিয়ে ফেলতে পেরেছিলেন? বাদশাহ্ জাহাঙ্গীরের সময়ে হারেমের অনেক প্রকোষ্ঠেই কোর-আন-এর সুললিত সুর ধ্বনিত হত। একথা ভালভাবে জেনেও ক্ষমতায় মত্ত আপনার মর্মে গিয়ে পৌঁছায়নি সেদিন। কিন্তু আজ এই জেসমিন প্রাসাদের অখণ্ড নীরবতার মধ্যেও কেন পৌঁছায় না বুঝে উঠতে পারি না।

ভূতপূর্ব ভারত সম্রাজ্ঞীর চোখের দৃষ্টি বিহ্বল। যে দৃষ্টিতে এক সময় অগ্নিবর্ষণ হত, সে দৃষ্টি, দু’ফোঁটা জল হয়ে গড়িয়ে পড়ে আমার সামনে। চেয়ে চেয়ে দেখি অথচ নড়তে পারি না।

—তোমার কথায় যথেষ্ট সত্য আছে জাহানারা। তবু আমি স্বীকার করতে পারি না যে হারেমের পবিত্রতা মুহূর্তের জন্যেও কোনওদিন সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কালো মেঘের বুকে বিদ্যুতের চমকের মতো হয়তো তা মাঝে মাঝে হারেমকে আলোকিত করেছে।

—আমাকে ক্ষমা করুন বেগমসাহেবা।

—সেকি?

—আপনার প্রতি রূঢ় হয়েছি।

—সত্যি বলে যা বিশ্বাস করো, তার প্রকাশ রূঢ় হলেও অন্যায় হয় না জাহানারা।

—কিন্তু আপনার মর্যাদা রেখে আমি কথা বলতে পারিনি।

—তোমার কথায় আমি আঘাত পেয়েছি। কিন্তু অমর্যাদা করেছ বলে নয়। এভাবে আমার মন বহুদিন নাড়া খায়নি। মনের নীচে অনেকদিন ধরে যে ময়লা জমেছিল ঝাঁকি খেয়ে আজ তা ওপরে ভেসে উঠেছে। এ ময়লা পরিষ্কার করে ফেলার সুযোগ পাব। তুমি আমার মস্ত উপকার করেছ জাহানারা।

মতবাদ থেকে এখন হাজার পাত্র বাদশাহী খানা এসে পৌঁছবে জাহাঙ্গীরের চিত্রপটের জন্যে, নূরজাহান তখন অতিমাত্রায় ব্যস্ত হয়ে পড়বেন। আমার সঙ্গে কথা বলার সময় পাবেন না। আমার উপস্থিতি তখন অবাঞ্ছিত বলে মনে হবে তাঁর কাছে।

তাড়াতাড়ি বলি—রোশনারাকে তবে তার সর্বনাশা পথেই চলতে দিতে পরামর্শ দিচ্ছেন আপনি?

—না। সে পরামর্শ আমি দিতে পারি না। তবে উপায় নেই কোনও। শুধু সে যাতে মাত্ৰা না ছাড়ায় কৌশলে তার ব্যবস্থা করতে পারো।

—তার সঙ্গে আপনার পরিচয় নেই। জানেন না সে কোন্ ধাতুতে গড়া। স্পষ্ট বলে দিয়েছে, ‘দশ-পঁচিশী’ খেলতে শুরু করবে শিগগিরই।

—‘দশ-পঁচিশী’?

—হ্যাঁ। জীবন্ত ক্রীতদাসী নিয়ে আকবরশাহ্ শতরঞ্জ খেলতেন। ঘরটি পড়ে রয়েছে এখন

রোশনারার খেয়াল চেপেছে জীবন্ত পুরুষ নিয়ে সেই ‘দশ-পঁচিশী’ খেলাঘরকে আবার জীবন্ত করে তুলবে। পুরুষেরা হবে ঘুঁটি।

নূরজাহানের নিভাঁজ কপালে চিন্তার সূক্ষ্মরেখা দেখা যায়। কিছুক্ষণ স্থির হয়ে থেকে তিনি বলেন—মারাত্মক খেয়াল।

—ভীষণ মারাত্মক। আমি বাধা দেব।

—না। হঠাৎ ওভাবে কিছু করতে যেও না।

—কিন্তু —

—শোন। ‘দশ-পঁচিশী’ ঘর তো দেওয়ান-ই-খাসের পথেই পড়ে। আজই গিয়ে সে ঘরখানা সুন্দরভাবে সাজিয়ে ফেলো। প্রাসাদের সব ঘরের চেয়ে সে ঘরখানা যেন আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে।

—কেন বলুন তো?

—কারণ আছে বই কী। কাজের চাপে পরিশ্রান্ত হয়ে বাদশাকে অনেক কক্ষ পায়ে হেঁটে পার হতে হয় বিশ্রামের জন্য। দেওয়ান-ই-খাসের কাছে অত সুন্দর জায়গাটিতে যদি বিশ্রামের সবরকম উপকরণ থাকে তবে কি তিনি বেশিদূর হাঁটতে চাইবেন।

সপ্রশংস দৃষ্টিতে নূরজাহানের দিকে চেয়ে থাকি।

তিনি স্মিত হেসে বলেন,—আমার ভেতরে কুটিলতার আভাস পেয়ে তোমার বোধহয় ঘৃণা হচ্ছে জাহানারা।

মাথা ঝাঁকিয়ে অস্বীকার করে বলি,—না। নিজের পরিবারকে সবরকম ঝড়ঝাপটা থেকে রক্ষার জন্যে প্রতিটি নারীর এই কুটিল হওয়া প্রয়োজন। প্রকৃত নারীর ভেতরে আল্লা বোধহয় এই বীজটি বপন করে দিয়েছেন।

—সত্যি কথাই তুমি বলেছ। কিন্তু ক্ষমতার লোভে এই কুটিলতা যখন ছড়ায় তখন নারী আর নারী থাকে না, হয়ে পড়ে রাক্ষসী। যেমন আমি হয়েছিলাম।

—নিজের সম্বন্ধে এভাবে বলার অধিকার আপনার নেই। আজ আপনি সব সমালোচনার ঊর্ধ্বে। আজ থেকে অনেক বছর পরে ঐতিহাসিকেরা নিরপেক্ষভাবে বেগম নূরজাহানের সমালোচনা যদি করতে পারেন, আমার ধারণা তখন তাঁরা খুব বেশি দোষের সাক্ষাৎ পাবেন না আপনার চরিত্রের মধ্যে।

কথা ঘুরিয়ে দিয়ে নূরজাহান বলেন,—ওসব থাক। অনেক দেরি হয়ে গেল। তুমি হয়তো আর বেশি সময় পাবে না। ‘দশ-পঁচিশী’ ঘরের পাশে নর্তকীদের থাকবার আয়োজন করবে।

—আমি এখনি গিয়ে সব বন্দোবস্ত করে ফেলছি। ফল ভালই হবে মনে হয়। বাবা যদি ঘরখানাকে পছন্দ করেন, তবে রোশনারার জীবন্ত পুতুল নিয়ে শতরঞ্জ খেলা এ-জীবনে আর হয়ে উঠবে না।

জেসমিন প্রাসাদের উদ্যানে এসে উপস্থিত হই। মৃদু হাওয়ায় আমার ‘বাদল-কিনারী’ ওড়নায় সমুদ্রের ঢেউ খেলে যায়।

পেছন ফিরে চেয়ে দেখি ওপরে দাঁড়িয়ে রয়েছেন নূরজাহান। হাত নেড়ে আমাকে বিদায় দেন। সন্ধ্যার দরবার শেষ হলে বাদশাহ্ দেওয়ান-ই-খাস হতে বের হয়ে আসেন। আমি পাশের ঝরোকার আড়ালে লুকিয়ে পড়ি। ‘দশ-পঁচিশী’ ঘরের পাশ দিয়ে যাবার সময় বাদশাহের মুখভাব কেমন হয় দেখতে হবে। সেখানে নর্তকীরা আমার নির্দেশে আসর জমিয়েছে। ঘরখানির শোভা অপূর্ব দেখতে হয়েছে। একদিন এই অসম্ভব সম্ভব হবে কল্পনা করিনি। ইজ্জত খাঁ সত্যিই করিতকর্মা পুরুষ। মাত্র পনেরো জন লোকের সাহায্য নিয়েছিল সে। হারেম থেকে কিছুটা দূরে বলে রোশনারার কানে এই ওলটপালটের কথা পৌঁছয়নি এখনো।

ঘরে ঢুকতে সামনেই একটি শ্বেতপাথরের চৌকির ওপর অপূর্ব জিল্লাদার সুরার পাত্র শোভা পাচ্ছে। মায়ের মৃত্যুর পর বাদশাহের স্বাস্থ্য যেভাবে ভেঙে পড়েছিল, আমি অত্যন্ত চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলাম। অতি সতর্কতার সঙ্গে তাঁর কাছে নিয়মিত সুরাপানের প্রস্তাব উত্থাপন করি।

আমার কথা শুনে প্রথমে বিস্মিত হলেও অনেক ভেবে শেষে গম্ভীর হয়ে বলেছিলেন, বেশ।

সেই থেকে তিনি সুরাপান করেন।

নর্তকীদের নূপুরের ঝংকারে আকৃষ্ট হয়ে বাদশাহ্ যদি পর্দা তুলে ধরেন, তবে প্রথমেই কারুকার্য শোভিত সুরার পাত্র চোখে পড়বে। একটু চোখ ফেরালে শ্রেষ্ঠ নর্তকী গুলরুখ বাঈকে অপূর্ব বেশে সজ্জিত দেখতে পাবেন। তার পরেই দেখবেন কক্ষটির শোভা।

নিজের পিতার জন্যে এ-জাতীয় আয়োজনে মন থেকে সাড়া পাওয়া যায় না। তবু আমি নারী। ভারতের সেরা রমণী নূরজাহানের শিক্ষা আমাকে গ্রহণ করতেই হবে। বাদশাহকে দেখে অবসাদগ্রস্ত বলে মনে হয়। তাঁর মুখে ক্লান্তির ছাপ। তিনি এগিয়ে যেতেই আমি ঝরোকার আড়াল হতে বের হয়ে তাঁকে অনুসরণ করি।

নর্তকীরা আমার নির্দেশমতোই কাজ করল। পিতা ‘দশ-পঁচিশী’ ঘরের কাছাকাছি যেতেই তাদের নূপুরের মিষ্টি আওয়াজ সেখানকার আবহাওয়াকে চঞ্চল করে তুলল। বাদশাহ্ দাঁড়িয়ে পড়েন। চারদিকে মুখ ঘুরিয়ে দেখেন। রীতিমতো অবাক্ হয়েছেন তিনি। আকবরের মৃত্যুর পর যে-মহল নির্জন পড়ে থাকত, সেখানে হাজার বাতির রোশনাই-এর মধ্যে শিল্পের ইঙ্গিত তাঁর বিলাসী মনে সাড়া জাগায়; অবসাদ কেটে যায় তার মুহূর্তে। দ্রুত পায়ে এগিয়ে গিয়ে ‘দশ-পঁচিশী’ ঘরের পর্দা তুলে ধরেন। পরক্ষণেই ভেতরে অদৃশ্য হন।

ছুটে গিয়ে আমি পর্দার পাশে দাঁড়াই। উঁকি দিয়ে দেখি, সুরার পাত্র হাতে নিয়ে তিনি হাসিমুখে ঘরের প্রতিটি জিনিস খুঁটিয়ে দেখছেন। একটু পরেই তাঁর জন্যে নরম শয্যার ওপর উঠে বসে প্রশ্ন করেন,–এখানে এই আয়োজন কেন?

গুলরুখ বাঈ অভিবাদন করে জানায়,—দরবার থেকে বের হয়ে কষ্ট করে অনেকটা পথ আপনাকে যেতে হয় জাহাঁপনা। তাই।

—কার হুকুমে এ সব হয়েছে?

ইতস্তত করে ওরা। সম্ভব হলে আমার নামটা এড়িয়ে যেতে বলেছিলাম ওদের। কিন্তু বাদশাহ্ উত্তরের প্রত্যাশায় তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকেন। সে দৃষ্টির পানে চেয়ে নর্তকীরা কাঁপে।

গুলরুখ বলে,—আপনার শরীরের খবর তো শাহজাদী জাহানারাবেগমই শুধু রাখেন। বোধ হয় তাঁর হুকুমেই।

—হুঁ। বাদশাহ্ মুখের সামনে সুরার পাত্র তুলে ধরেন। বহু বছর আগে চম্বল হ্রদে তিনি সমস্ত সুরা নিক্ষেপ করেছিলেন। মূল্যবান সুরার পাত্রগুলি ভেঙে টুকরো টুকরো করে গরীবদের মধ্যে বিলিয়ে দিয়েছিলেন। সে অনেকদিন আগের কথা।

আমি সরে আসি। একটু পরেই নেশাগ্রস্ত হতে পারেন বাদশাহ্। তারপর অনেক কিছুই ঘটতে পারে, কন্যা হয়ে যা আমার পক্ষে দেখা শালীনতাবিরোধী। আমার লজ্জা হয়—ভীষণ লজ্জা। আমার দেহও যে ওই নর্তকীদের দেহের মতোই।

রোশনারা বহুদিন আগেই আমাকে বলেছিল, সে নাকি সব কিছুই দেখেছে। সে সবিস্তারে বর্ণনা শুরু করেছিল। আমার ধমক খেয়ে চুপ করে যায়। শুধু রোশনারা কেন, আমি জানি হারেমের অধিকাংশ নারীই বাদশাহের প্রমোদকক্ষে উঁকি দেবার জন্যে জীবন-পণ করে। তবে তারা পারে না। কড়া প্রহরা থাকে চারদিকে। সে প্রহরার ফাঁক গলিয়ে কেউ কাছে ঘেঁষতে পারে না। তারা জানে, কেউ কাছে যেতে চেষ্টা করলে খোজারা তাকে নির্বিচারে হত্যা করতে পারে। বাদশাহের কোনও পুত্র হলেও পারে। হুকুম রয়েছে তেমনি। রোশনারার কথা যদি সত্যি হয় মোটারকম ‘দিনার’ খরচা করতে হয়েছে তাকে।

‘দশ-পঁচিশী’র কক্ষে নৃত্য শুরু হয়েছে। সে নৃত্যের শব্দ ভেসে আসে। আমি তাড়াতাড়ি দূরে চলে যাই—যেখানে গেলে নর্তকীদের নৃত্যের তাল আমার মনে কোনওরকম প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করতে পারবে না।

হঠাৎ খেয়াল হয়, কোনওরকম পাহারার ব্যবস্থা করা হয়নি ‘দশ-পঁচিশী’র চারদিকে। হারেমে খবরটা রটলে হারেম খালি হয়ে যাবে। আর বাদশাহ্ সে খবর জানতে পারলে আমাকে রেহাই দেবেন না। নিজের কন্যা বলেও নয়।

নিজের কক্ষে ছুটে যাই। পর্দা সরিয়ে ঘরে প্রবেশ করে দেখি কোয়েল পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে

—কী হয়েছে কোয়েল?

ওর ওষ্ঠদ্বয় বারকয়েক কেঁপে কেঁপে থেমে যায়। কাছে গিয়ে ওর কাঁধ ধরে ঝাঁকি দিই। তবু কথা বলে না সে। শুধু দু চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে।

কোয়েলকে আমি বড় একটা কাঁদতে দেখিনি। যদিও সে নারী। বুঝলাম, এমন কোনও ঘটনা ঘটেছে যা ওকে রীতিমতো আঘাত করেছে। কিন্তু একজন নাজীরের হৃদয়-বেদনার কথা শোনার মতো যথেষ্ট সময় হাতে নেই। পাহারার ব্যবস্থা করতে হবে এখনি—হারেমের কেউ কিছু না জানার আগেই।

তাই দৃঢ়স্বরে বলি—তোমার কথা পরে শুনব কোয়েল। এখন শিগগির যাও খোজাদের আড্ডায়। বলে এসো, নর্তকীরা আজ ‘দশ-পঁচিশী’ ঘরে জমায়েত হয়েছে। বাদশাহ্ এসেছেন সেখানে। পাহারা বসাক তারা এই মুহূর্তে।

কোয়েলের চোখের জল শুকিয়ে যায় মুহূর্তে। যেটুকু গালে লেগেছিল ওড়না দিয়ে মুছে ফেলে এগিয়ে যায় দরজার দিকে।

—যদি ওরা তোমার কথা না শোনে, বলবে আমার হুকুম

আর আসবার সময় ‘দশ-পঁচিশী’র পাশ দিয়ে এসো। কক্ষের ভেতর উঁকি দেবার চেষ্টা করো না। শুধু দেখো হারেমের কেউ সেখানে ভিড় করেছে কিনা।

কোয়েল ঘাড় হেলিয়ে সম্মতি জানিয়ে চলে যায়।

আমি পায়চারি করি। বাদশাহ্ সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত হতেই কোয়েলের চিন্তা মাথায় এসে ঢোকে। আমার ঘরে বসে কী এমন আঘাত সে পেতে পারে, যার জন্য অত বিচলিত হয়ে পড়েছিল। ভেবে কুলকিনারা পাই না।

তার বোনের পোশাক পরার পর থেকে একটু একটু করে কোয়েলের পরিবারের কথা মোটামুটি জেনে নিয়েছিলাম। বলতে কিছুতেই চায়নি। সহানুভূতি দেখিয়ে, মন ভিজিয়ে জানতে হয়েছে। ওদের কথা শুনলে পৃথিবীকে অন্যরকম বলে মনে হয়। প্রকৃত ভারতবর্ষকে চেনা যায়। কতখানি দরিদ্র ওরা—অথচ মানবিক বৃত্তিগুলির প্রাচুর্য শুধু ওদের মধ্যেই রয়েছে। ওদের পরস্পরের প্রতি স্নেহ-প্রীতি-ভালবাসার কথা শুনলে অবাক হতে হয়। ভাবি, পৃথিবীতে মানুষ মানুষকে এতখানি ভালও বাসতে পারে কোনওরকম স্বার্থ ছাড়া। মনে হয়, কোনও সাধারণ ভারতবাসী যদি তার ঘর থেকে বের হয়ে এক-পা এক-পা করে বাদশাহী মহলের দিকে অগ্রসর হয়, তবে তার মনের প্রকৃত গুণগুলি প্রতি পদক্ষেপে একটি একটি করে ঝরে পড়তে থাকবে। মসনদের পাশে এসে যখন সে পৌঁছবে তখন তার হৃদয় হবে ঠিক আমার মতো, রোশনারার মতো, আওরঙজেবের মতো—। হৃদয়ে তখন শুধু স্বার্থের পোকাগুলো কিলবিল করবে।

আপনা হতেই একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ে।

কোয়েলের স্থান কেন যেন আজ হারেমে, তার কারণ আমি জেনেছি। আর জানেন বাদশাহ্ নিজে। কিন্তু তিনি কখনো ওর সম্বন্ধে আমার সঙ্গে আলোচনা করেননি। এই সামান্য ব্যাপারে সময় নষ্ট করা শাহানশাহের শোভা পায় না। তবু যদি তিনি কোয়েলকে আমার কাছে প্রথম পাঠানোর সময় তার সম্বন্ধে অল্প কিছু বলে দিতেন, তবে আজ পিতা হিসাবে আমার কাছ থেকে আরও বেশি শ্রদ্ধা পেতে পারতেন।

বাইরে কর্তব্যরত খোজার সচকিত কুর্নিশের আওয়াজ কানে ভেসে আসে। দ্রুত পদশব্দ ও শুনি সেই সঙ্গে। হয়তো কোনও শাহজাদী চলে যাচ্ছেন এ-পথ দিয়ে।

কিন্তু পরক্ষণেই কক্ষের ভারী পর্দা দুলে ওঠে। কোয়েল ফিরে এল? সে এলে খোজা কুর্নিশ করবে কেন?

রোশনারা!

পর্দার পটভূমিকায় উন্মুক্ত তলোয়ার হাতে রোশনারা। একদৃষ্টে চেয়ে থাকে সে আমার দিকে ক্ষুধিত বাঘিনীর মতো। চোখেমুখে তার নিদারুণ ঘৃণা।

—দাঁড়ালি কেন? এগিয়ে আয়। কাজ শেষ করে পেছনের দরজা দিয়ে চলে যা কেউ নেই ওদিকে।

রোশনারা সত্যিই এগিয়ে আসে।

কিন্তু বাইরের খোজাটা দেখে ফেলেছে। তাকে আগে শেষ করে আয়। সাক্ষী রাখিস না বোন!

—বিশ্বাসঘাতক।

—বাঃ, গালভরা কথা বলছিস দেখছি।

—আজ তোর জন্যে শুধু ঘৃণাই তোলা রইল আমার এই বুকে। রোশনারা তার সুপুষ্ট বুকের ওপর বাঁ হাতে সজোরে আঘাত করে।

—আহা! অত জোরে নয়। অমন সুন্দর বুকের গড়ন নষ্ট হয়ে যাবে যে। ফিরেও তাকাবে না তোর ‘দশ-পঁচিশী’র জীবন্ত ঘুঁটিগুলি।

—ছি ছি। মায়ের পেটের বোনই বটে।

রোশনারার মুখের দিকে চেয়ে আমার হাসি পায়। এত আয়োজন সব ব্যর্থ হয়ে গেল। সব মাটি!

—তলোয়ারটা শুধু শুধু খাপ থেকে টেনে বের করলি?

—না।

—না? তাই নাকি? তবে দাঁড়িয়ে কেন?

—তোকে নয়। তোর সেই নাজীরকে। মৃত্যুকে যে ভয় পায় না। তলোয়ার দেখলে হাসে। কত বড় স্পর্ধা!

—ও। তবে তুই-ই এসেছিলি আর একবার?

—হ্যাঁ।

ঘরে ঢোকার সময় কোয়েলকে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলাম। আসল ঘটনা জানতে আগ্রহ হয়।

—তাকে মারতে চেয়েছিলি?

—হ্যাঁ। শুনে সে হাসল। হাঁটু ভেঙে বসে বুক পেতে দিয়ে বললে, শাহজাদীকে মারবেন না তো?

—বড় বোকা তো।

—তখন তাকে শেষ করে দিলেই ভাল হত। আবার ছুটে আসতে হত না। নিজের ঘরে ফিরে গিয়ে যতই ভাবলাম, ততই মাথাটা গরম হয়ে উঠল। আবার এলাম তাই। সামান্য নাজীরকে তুই মাথায় তুলে দিয়েছিস।

—মাথায় না তুললে কি আমার হয়ে নিজের বুক পেতে দিত?

—সে বুকে পদাঘাত করেছি।

—কী? ক্রোধে আমার মাথা ঝাঁ ঝাঁ করে ওঠে। মরুভূমির উত্তপ্ত বালুরাশির মতো গরম হয়ে ওঠে আমার সর্বাঙ্গ। সম্মুখে দন্ডায়মান নিজের বোনকে দেখে মনে হয় সাক্ষাৎ শয়তানী। কোমরের কাছে গুপ্ত ছোরার বাঁটে আমার ডান হাতখানা আপনা হতে গিয়ে স্পর্শ করে। জানি, তড়িৎগতিতে রোশনারার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লে তার তলোয়ার তাকে রক্ষা করতে পারবে না। সাধারণভাবে অস্ত্র চালনার ক্ষমতা ছাড়া বিশেষ কোনও পারদর্শিতা তার নেই।

তবু—তবু চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকি। সাময়িক উন্মত্ততা অনেক কিছু অঘটন ঘটিয়ে দেয়, পরে যার জন্যে আফশোসের সীমা থাকে না। আকবরশাহ্ যে জন্যে মৃত্যুদন্ডাজ্ঞা দিয়ে, সে দণ্ডাজ্ঞা একদিনের জন্যে মুলতবী রাখার ব্যবস্থা করেছিলেন। তাঁর দ্বিতীয় দিনের আজ্ঞাই ছিল চূড়ান্ত।

মাথার রক্ত ধীরে ধীরে নেমে যায়। দপদপে শিরা-উপশিরা স্তিমিত হয়ে আসে। রোশনারার মুখের ওপর দৃষ্টি ফেলে দেখি আমার ভাবান্তর লক্ষ করে সে যেন একটু অপ্রস্তুত।

—কোয়েলকে তুই চরম আঘাত দিয়েছিস রোশনারা। তলোয়ারের আঘাতে তার কোটিভাগের একভাগও হত না।

চুপ করে থাকে রোশনারা।

—কোয়েল রাজপুত রমণী। মৃত্যুর ভয় দেখাস ওকে? ভয় ওর অপমানে। সেই অপমান তার বুকে-এঁকে দিয়েছিস তুই।

—নাজীরের আবার অপমান।

—নাজীর? হ্যাঁ সেই রকমই দাঁড়িয়েছে বটে! কিন্তু আজকের এই ঘটনার জন্যে বাদশাহ্ শাহজাহানকে আল্লার কাছে জবাবদিহি করতে হবে।

—তার মানে?

তোর কাছে প্রকাশ করা উচিত হবে কি না বুঝতে পারছি না। তবু বলব তোকে। কারণ এর পরে কোয়েলকে অপমান করার আগে অন্তত একবার ভেবে দেখবি।

আমি দরওয়াজার দিকে যাই, পর্দা তুলে যতদূর দৃষ্টি যায় দেখে নিই। কোয়েল নেই। ফিরে আসি। রোশনারার মুখোমুখি দাঁড়াই।

—আজ তুই শাহজাদী রোশনারা। ভারত ঈশ্বর শাহজাহানের কন্যা। কিন্তু আজ তুই না-ও থাকতে পারিস। এ দেশের সিংহাসনে হয়তো অন্য কেউ বসত। আর এই হারেমে তোর বদলে অন্য কেউ ঘোরাফেরা করত।

—কেন? রোশনারার ভ্রূ কুঞ্চিত হয়।

—কোয়েল নাজীর। সে তোর পদাঘাত বুক পেতে নেয়। কিন্তু তার বাবার বুকের রক্ত আর তলোয়ার আজ থেকে বহুবছর আগে বাদশাহের প্রাণ বাঁচিয়েছিল। শত্রুর বর্শা যখন বাদশাহের বুকের পাঁজর ভেদ করতে উদ্যত, ঠিক সেই মুহূর্তে কোয়েলের বাবা চকিতে ছুটে এসে সেই শত্রুর ডান হাত খণ্ডিত করেন। বাদশাহ্ রক্ষা পান, কিন্তু তাঁর রক্ষাকর্তা বাঁচেননি সে যুদ্ধে। বৃদ্ধা মা, বিধবা স্ত্রী আর দুই কন্যাকে অকূলে ভাসিয়ে তিনি চিরবিদায় নেন পৃথিবী থেকে। তাই কোয়েল আজ নাজীর। তাই আজ তোর পদাঘাত তাকে মুখে বুজে বুক পেতে নিতে হয়।

রোশনারা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। শেষে ধীরে ধীরে আমার কক্ষ থেকে বাইরে চলে যায়। হয়তো সে ভাবে বাদশাহের প্রাণরক্ষা করাই সৈন্যদের কর্তব্য। তার জন্যে মৃত্যু হলে ক্ষতি কী?

.

দূরে যমুনার কূলে মায়ের স্মৃতিসৌধ শেষ সূর্যের আলোয় একবিন্দু রক্তের মতো টলটল করছে। বাবা কৌশলে ভাইদের আলাদা করে রেখেছেন। দারাশুকো শুধু রয়েছে রাজধানীতে। তবু যেন মনে হয়, ভেতরে প্রবল চক্রান্ত চলেছে এক অনির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে। পৃথিবীর অভ্যন্তরের প্রচণ্ড আলোড়নের মতো সে চক্রান্ত মাঝে মাঝে অগ্ন্যুৎপাতের সৃষ্টি করে সচকিত করে দেয়। বাদশাহ্ স্থির হয়ে থাকেন। তিনি যেন জানেন, ভবিষ্যতের ললাটে কী লেখা রয়েছে। কিন্তু আমার ভয় হয়। তার চেয়ে হয় দুঃখ। এক অন্তহীন বিমৰ্ষতা আমাকে আচ্ছন্ন করে। সে বিমর্ষতা প্রাণহীন।

মায়ের স্মৃতিসৌধের কাজ সমাপ্ত হয়েছে। তাজমহল। বাদশাহের স্বপ্নের তাজমহল তার স্বপ্নকে ছাড়িয়ে গিয়েছে শিল্পীর কল্পনায়। তাজমহলকে ঘিরে যে গুলিস্থান তাতে ইতিমধ্যেই নানান ফুলের শোভা। শৌধের কাজ শেষ হবার আগেই ফুলের গাছ এনে বপন করার ব্যবস্থা হয়েছিল। শুধু বড় বড় গাছের চারা এখনো আকাশের দিকে বেশিদূর উঠতে পারেনি।

দুদিন আগে আনুষ্ঠানিকভাবে তাজমহলের উদ্বোধন করে এলেন বাবা। সঙ্গে ছিলাম আমি আর রোশনারা। দেশের বড় বড় মৌলবীরা এসে জমা হয়েছিলেন তাজবিবির সমাধির পাশে। তাঁদের অধিকাংশের চোখেই লক্ষ করেছি লোভাতুর উজ্জ্বলতা। তাঁরা জানতেন, তাজমহলের ভার ছেড়ে দেওয়া হবে তাঁদেরই মধ্যে একজনকে বেছে নিয়ে—যিনি মমতাজের সমাধির পাশে প্রতিদিন কোর-আনের পুণ্য বাণী শোনাবেন—যিনি প্রতি জুম্মাবারে সমাধি স্বর্ণখচিত বস্ত্রদ্বারা আবৃত করে দেবেন। তাজমহলেরই যে কোনও মিনারের এক প্রকোষ্ঠে বসে তিনি সারা দিনরাত নিশ্চিন্তে আল্লার আরাধনা করতে পারবেন। মৌলবীর কাছে এর চাইতে অধিক ঈপ্সিত পদ আর কী থাকতে পারে? বাদশাহের এত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখে স্বচ্ছন্দে পৃথিবীর সুন্দরতম ইমারতে জীবন কাটিয়ে দেবার সৌভাগ্য সারা দেশে একজনের ভাগ্যেই হওয়া সম্ভব।

অনুষ্ঠানকালে বাদশাহের দৃষ্টি প্রতিটি মৌলবীর মুখে মুখে ঘুরে শেষে আমাদের ঝরোকার ওপর এসে থেমে যায়। ঝরোকার পেছনে আমার সঙ্গে ছিল রোশনারা। বাবা ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে মৃদু স্বরে ডাকেন।—জাহানারা।

—কী বাবা?

—পছন্দ করতে পারছি না। তুমি করেছ কী?

—হ্যাঁ।

—কাকে?

—সত্যিই কি আপনি পছন্দ করতে পারেননি?

—না।

—না।

—কোনও বৈশিষ্ট্যই কি কারও মধ্যে দেখতে পাননি?

—না। আজ আমি বিচারের ক্ষমতা হারিয়েছি। কেন যেন আমি বড় বেশি উত্তেজিত বাদশাহের উত্তেজনার কারণ রয়েছে। মায়ের প্রতি তার মনোভাব অজানা নয়।

—কাকে পছন্দ করলে জাহানারা?

—এঁদের মধ্যে যিনি শুধু আপনার নির্দেশ পালন করতেই এসেছেন অন্যদের সঙ্গে। গ্রামের ভগ্ন মসজিদ আর তাজমহলের অভূতপূর্ব সৌন্দর্যের মধ্যে যিনি কোনও তফাত বুঝতে পারেননি। যাঁর মন আর চোখ আরও উঁচুতে—ধূলিময় পৃথিবীর সব কিছু ছাড়িয়ে বহুদুরে।

—কে তিনি? বাদশাহের কণ্ঠস্বরে বিস্ময়।

—ওঁদের মধ্যে সবচেয়ে শেষে যিনি দাঁড়িয়ে রয়েছেন জড়সড়, তাজমহলের মণিমাণিক্যের দিকে যাঁর দৃষ্টি নেই। বাদশাহের দিকেও নয়।

বাদশাহ দ্রুত এগিয়ে যান।

রোশনারার মুখে বিদ্রুপের হাসি। আমার কথায় পিতা গুরুত্ব দিলেন বলে হয়তো। কিংবা মৃতা মায়ের জন্য এতদিন পরে এত বেশি মাথাব্যথা সে বরদাস্ত করতে পারছে না বোধহয়। সে জানে না তাজবিবি কী ছিলেন। জানে না বল্গাছাড়া বিলাসিতার মধ্যেও তাঁর প্রধান মহিষীকে বাদশাহ্ মুহূর্তের তরেও ভুলতে পারেননি। পরে সেদিনের অনুষ্ঠান শেষে বাদশাহ্ পরিতৃপ্তি নিয়ে ফিরে এসেছিলেন। বার বার সপ্রশংস দৃষ্টিতে চেয়েছিলেন আমার দিকে। সঙ্কুচিত হয়েছিলাম আমি।

মৌলবী নির্বাচনে আমি খুশি হয়েছি। জানি, আমার মায়ের কানে যাঁর মুখনিঃসৃত কোর-আনের বাণী ঝংকৃত হবে তার হৃদয়কে অর্থের লোলুপতা বিন্দুমাত্র স্পর্শ করতে পারবে না কোনওদিনও। তাজমহলের শ্বেতপাথরের মূল্য তাঁর কাছে আরাবল্লীর প্রস্তরের চেয়ে বেশি নয়। উজ্জ্বল মণিমাণিক্য তাঁর কাছে স্তব্ধ রজনীর গ্রহ-তারা-নক্ষত্র খচিত আকাশের তুলনায় তুচ্ছ।

তবু হঠাৎ আজ অস্তগামী সূর্য-স্নাত তাজমহলকে একবিন্দু রক্তের মতো মনে হয় কেন? মা কি তবে কাঁদছেন? তাঁরই সন্তানদের ভবিষ্যৎ কল্পনা করে কি তাঁর হৃদয় আজ রক্তাক্ত? কিন্তু কেন হবে? জাহাঙ্গীরে যে রক্ত স্রোতের শুরু শাহজাহানেই তো তা শেষ হয়ে যেতে পারে। তার জের কেন চলবে আরও?

মাথাটা ভালভাবে ঝাঁকিয়ে নিই, উদ্ভট চিন্তা করতে করতে আমারই মাথা খারাপ হয়েছে। দর্শন না ছাই। নূরজাহান শুধু শুধু আমার প্রশংসা করে আমাকে ফাঁপিয়ে দিয়েছেন—যার ফলে তাজমহলের স্বর্গীয় রূপকে উপভোগ করার নয়নও আমার নষ্ট হতে বসেছে। আমার জায়গায়, এই বাতায়নের পাশে দাঁড়িয়ে পৃথিবীর যে কোনও নারী এসে যদি আজ তাজমহলের শোভা অবলোকন করত, তবে সে নিশ্চয়ই বিস্ময়াবিষ্ট হত। তাজমহল তার কাছে প্রতিভাত হত সমুদ্রের গভীরতা থেকে অতি কষ্টে সঞ্চয় করে আনা একটি মহামূল্য প্রবালের মতো। অথচ—

—শাহজাদী।

—কেন কোয়েল?

—কাল দেওয়ান-ই-খাসের ঝরোকায় আপনাকে যেতে হবে। দরবার বসার সাথে সাথেই।

—কেন? কোয়েলের কথা শুনে অবাক হই। দরবারে কখন যেতে হবে সে নির্দেশ আসে বাদশাহের কাছ থেকে। চিত্তাকর্ষক কিছু থাকলে বাদশাহ্ নিজেই ডেকে আমাদের দু বোনকে বলে দেন। কিন্তু আজ কিছুই তো বলেননি।

—কাল শিল্পী আসবে দরবারে। কোয়েলের মুখে স্বচ্ছ হাসি ফুটে ওঠে।

—শিল্পী?

—হ্যাঁ। তাজমহলের শিল্পী। ইসা-মামুদের সহকারী। বাদশাহ্ পুরস্কৃত করবেন তাকে।

—আমি তো জানি না। তোমাকে কে বললে?

কোয়েলের মুখ সহসা রাঙা হয়ে ওঠে। কক্ষের অপস্রিয়মাণ আলোতেও সে রঙ ধরা পড়ে। সে চুপ করে থাকে।

—চুপ করলে কেন?

থতমত খেয়ে কোয়েল বলে,—সে বলেছে।

—সে? মানে, শিল্পী নিজে?

কোয়েল মাথা নিচু করে থাকে। এতক্ষণে তার মন আমার কাছে দিনের আলোর মতো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ছুটে গিয়ে তার সামনে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে উঠি,–কোয়েল। ঝরঝর করে জল গড়িয়ে পড়ে তার দু’চোখ বেয়ে। আমি স্তম্ভিত হয়ে তার কান্নার দিকে চেয়ে থাকি।

কতক্ষণ কেটে যায় খেয়াল থাকে না! শেষে কোয়েল চোখের জল মুছে ফেলে। আমার পানে চেয়ে বলে,—শাহজাদী, হাত বাড়িয়ে সে কি চাঁদ ধরতে পারত? পারত না। চাঁদও কি অত নীচে নামতে পারত? তাই বোধহয় আমার মনে স্পর্ধা জেগেছিল। কিন্তু লাভ হয়নি কিছু। সে এখনো চাঁদের স্বপ্নই দেখে। সে যে শিল্পী।

আমার বুকের ভেতরে কেঁপে ওঠে। ভয়ে? হ্যাঁ ভয়ে। কোয়েলের কথা শুনে যে তীব্র আনন্দে আমি অভিভূত, সেই, আনন্দের চিহ্ন আমার চোখে-মুখে ফুটে ওঠার ভয়। ধরা পড়ে যাব কোয়েলের কাছে—যেমন সে ধরা পড়েছে আমার কাছে।

কিন্তু বলতে গেলেই কণ্ঠস্বর কেঁপে উঠবে। তাই সময় নিয়ে নির্বিকারভাবে বলি,—কতদিনের ঘনিষ্ঠতা তোমার সঙ্গে কোয়েল?

—সেদিনের পর থেকেই। কিন্তু ঘনিষ্ঠতা তো নয়। একা একা কাজ করে সে তার ঘরে বসে। আমি আপনার কাছ থেকে ছুটি নিয়ে একটু সাহায্য করে আসি। সেবা করার আনন্দ পাই।

—কোয়েল?

—শাহজাদী। -কী লাভ?

—জানি না।

—তবে?

—শুধু আনন্দ।

—এ আনন্দ চিরস্থায়ী হবে?

—না, সে আমার দিকে ফিরেও চায়নি প্রথমে।

—এখন?

চায়। তবে আমার জন্যে আমার দিকে তাকায় না। তাকে প্রলোভন দেখিয়েছি। তাই আজকাল যখনই যাই, ব্যগ্র চোখে চেয়ে থাকে। আমার দিকে নয়—আমার পেছনে।

—কেন?

—যার মূর্তি তৈরির জন্যে পাথর কেটে প্রস্তুত হচ্ছে সে, তাকে শুধু আর একবার নয়ন ভরে দেখবে বলে। আমি কথা দিয়েছিলাম দেখাব।

আমার মুখের রঙের পরিবর্তন হয়েছে বুঝতে পারি, তবু কিছু করতে পারি না। শুধু মুখখানা ঘুরিয়ে গবাক্ষপথে প্রায়ান্ধকার আকাশের দিকে চেয়ে থাকি। সূর্য ডুবে গিয়েছে অনেকক্ষণ

—শাহজাদী। আমি জানি, আমি অন্যায় করেছি। এইভাবে সরল শিল্পীকে প্রলোভিত করাতে আমার অন্তরের হীনতা প্রকাশ পেয়েছে। কিন্তু পারলাম না—কিছুতেই পারলাম না।

আস্তে আস্তে বলি,—আমি হলেও হয়তো পারতাম না কোয়েল।

আমার কথায় কোয়েলের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল কিনা দেখার চেষ্টা করি না। তবে তাকে বলতে শুনি,—কিন্তু আপনাকে না দেখাতে পারলে যে সে আমায় ঘৃণা করবে।

—যখন তুমি বুঝবে সে ঘৃণা করতে শুরু করেছে, আমাকে বোলো।

একটা দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শুনি। নিষ্কৃতির নিঃশ্বাস।

চাপা নূপুরের ধ্বনি কানে ভেসে আসে। ‘দশ-পঁচিশী’তে নাচের আসর বসেছে। বাদশাহ্ নিশ্চয় উপস্থিত হয়েছেন সেখানে। নূরজাহান দীর্ঘায়ু হোন।

হঠাৎ খেয়াল হয়, আসল প্রশ্নই করা হয়নি কোয়েলকে। বলি,—শিল্পী তো প্রাপ্য পেয়েছেন। তবে কেন আবার বাদশাহ্ পুরস্কৃত করবেন তাঁকে।

—শিল্পীও অবাক্ হয়েছে তাই।

অবাক আমিও কম হই না। শিল্পীকে তার যে প্রাপ্য দেওয়া—সে অঙ্ক সামান্য নয়। এর পরেও আবার বিশেষভাবে পুরস্কৃত করার চিন্তা কেন যে করছেন বাদশাহ্ বুঝি না। হয়তো তাজমহলের সৌন্দর্য দেখে বার বার মুগ্ধ হয়ে তাঁর ধারণা জন্মেছে শিল্পী যোগ্য পুরস্কার পায়নি। কিংবা আমি একটি পাষাণ-ফলকে ইসা-মামুদের নামের নীচে শিল্পীর নাম খোদিত করে তাজমহলের কোনও প্রাচীরের গায়ে প্রোথিত করার যে প্রস্তাব করেছিলাম সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে তাঁর অনুশোচনা হয়েছে। তাই শিল্পীর দু হাত স্বর্ণমুদ্রায় ভরিয়ে দিয়ে অমরত্বের দাবি থেকে কৌশলে সরিয়ে দিতে চান।

অভিমান হয়। বাদশাহ্ যখন সব কিছু গোপন রেখেছেন আমার কাছে, আমিই বা কেন নিজে থেকে তাঁর কাছে আবদার করব? কাল দেওয়ান-ই-খাসে যাবার কথা তো একবারও বলেননি তিনি। অথচ সামান্য কোনও কৌতূহলোদ্দীপক ঘটনা ঘটলেই তিনি আমাকে দরবারে ঝরোকায় হাজির থাকতে বলেন।

কথায় কথায় আমার চোখ ফেটে জল গড়ায় না। নইলে হয়তো কাঁদতে বসতাম। ভারাক্রান্ত মনকে হালকা করার জন্যে ছটফট করতে থাকি। শেষে নাদিরা বেগমের কথা মনে হয়। দারাশুকো আগ্রায় অনুপস্থিত দুদিন থেকে। নাদিরা একা রয়েছে। খুবই নম্র স্বভাবের মেয়েটি। বড় ভাল লাগে। যখন তার সাদি হয় তখন উপহার হিসাবে প্রাপ্ত সামাগ্রীর প্রদর্শনীর ভার আমার ওপর ছিল। আমীর-ওমরাহ্ সে সব জিনিস দেখে চোখের পাতা ফেলতে পারেননি। নাদিরা দারার যোগ্য বেগমই বটে। বরং দারার চেয়ে তার গুণ বেশিই বলব। সব গুণ থাকা সত্ত্বেও দারা জেদী–একটু অলসও যেন। কিন্তু নাদিরা অতুলনীয়।

ঘর থেকে বের হয়ে তার কক্ষের দিকে রওনা হই। কোয়েল আমাকে অনুসরণ করছিল। ইঙ্গিতে মানা করে দিই। সুন্দরী নাদিরা যেদিন হারেমে আসে সেদিন সব আনন্দের মধ্যে একটা আঘাত আমার হৃদয়কে প্রচণ্ডভাবে ধাক্কা দিয়েছিল। সেদিন আবার উপলব্ধি করেছিলাম আমার নিজের জীবনের নিদারুণ ব্যর্থতা। বাদশাহ্ বিবাহের সব কিছু ভার আমার ওপর ছেড়ে দিয়ে হয়তো ভেবেছিলেন, উৎসবের আনন্দ কোলাহলের মধ্যে নিজের সম্বন্ধে ভাববার অবসর পাব না। ভুল ভেবেছিলেন তিনি। নাদিরার হাত ধরে তার নিজের কক্ষে পৌঁছে দিয়ে সবার অলক্ষ্যে রোশনারার ঘরে গিয়ে উপস্থিত হয়েছিলাম। অমন আনন্দের দিনে সে ছাড়া আমার সমব্যথী কেউ ছিল না পৃথিবীতে।

প্রাসাদে সেদিন কোটি কোটি চিরাগদানির উজ্জ্বল আলো। অথচ রোশনারার ঘর প্রায়ান্ধকার। তবু সেই ক্ষীণ আলোয় রোশনারার হাতের ছুরিকা ঝলসে ওঠে। আমি থমকে দাঁড়িয়ে পড়ি। চেয়ে দেখি সে পাগলের মতো তার শয্যায় তাকিয়ার ওপর ক্রমাগত ছোরা বসিয়ে চলেছে।

—তাকিয়াটি বাদশাহ্ আকবরের নির্দেশ নয় রোশনারা। ওকে ফাঁসিয়ে লাভ নেই। চমকে থেমে যায় সে। পরিশ্রমে তার মুখে আর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছিল। গম্ভীর হয়ে বলেছিল, —ধার পরীক্ষা করছি। নিজের বুকে চালাবো।

একেবারে কাছে গিয়ে দাঁড়াই। তার বাঁ-হাত নিজের হাতে তুলে নিয়ে বলি,—এই যে হীরের আংটি, এটিই তো যথেষ্ট।

—না।

—কেন?

—বুকের রক্ত চাপ চাপ হয়ে জমে থাকবে পাষাণের ওপর। বাদশাহ্ আসবেন, এসে দেখবেন, শাহ্তাদীদেরও দেহে রক্ত আছে। কত অফুরন্ত রক্ত। নাদিরা আর মমতাজের চেয়ে বেশিই। আরও উষ্ণ।

—ছি। রোশনারা।

ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে সে। আমার বুকে মুখ রেখে সমানে কেঁদে চলে। নিজের শরীরের জ্বলুনি অন্তর্হিত হয়। তাকে সান্ত্বনা দেবার ভাষা খুঁজে মরি। পাই না। ভাবি, ভবিষ্যতে রোশনারা যত অন্যায়ই করুক সব কিছুর মূল কারণ একটি। তার কত অন্যায় অসহ্য বোধ হবে। কত অন্যায় অমঙ্গল ডেকে আনবে—মুখে সমালোচনা করব। অথচ মনে মনে তাকে ক্ষমা না করে পারব না।

বাঁধ ভাঙা পুরোনো চিন্তাস্রোতের মধ্যে হাবুডুবু খেতে খেতে একসময় খেয়াল হয় নাদিরার ঘরের ভেতরে এসে দাঁড়িয়েছি।

গভীর মনোযোগ সহকারে নাদিরা কী যেন দেখছিল। আমার উপস্থিতি প্রথমটা খেয়াল করেনি। দেখতে পেয়ে ছুটে আসে সে। একটু অপ্রস্তুত।

হেসে বলে,—এই দ্বিতীয়বার।

—গুনে দেখো এই দুদিনই দারাশুকো আগ্রা ছেড়েছে সম্ভবত।

লজ্জায় নাদিরা অধোবদন হয়। তার এই লজ্জা, মেয়ে হয়েও আমরা ভাল লাগে।

শেষে বলে,—মিথ্যে কথা বলেননি আপনি। আমি বুঝিয়ে পারি না। ও যেন দিন দিন ভুলে যাচ্ছে বাদশাহের বড় ছেলে ও। বড় বেশি ভাবুক হয়ে পড়েছে। ফলে ভাবুকের আলস্যও পেয়ে বসেছে ওকে।

—কী দেখছিলে অত মন দিয়ে?

—তবির?

—তবির? তুমি না মুঘল-বংশের বেগম? তুমি না মুসলমান?

নাদিরার মুখ পাংশু হয়ে যায়। সে অসহায়ভাবে চেয়ে থাকে। আমার ধমকের অন্তরালে তারল্যের রেশ সে বুঝতে পারে না। হেসে ফেলি আমি। তবু সে হাসতে পারে না। একই ভাবে চেয়ে থাকে। তার চিবুক ধরে নাড়া দিই।

—দারাশুকোর বেগম ঠাট্টাও বোঝে না।

—আমার অন্যায় হয়েছে।

—কিছু হয়নি। কই দেখি কার তবির?

নাদিরা ভয়ে ভয়ে সুন্দর কয়েকটি ছবি তুলে এনে দেখায়।

—বেশ হাত তো? কে এঁকেছে?

—দারা।

—কী বললে?

—সত্যি।

অবাক হই আমার ভাইটির প্রতিভা দেখে। এই সব সূক্ষ্ম কাজের প্রতিভা দেখে। আবার ভয়ও হয়। এ-জাতীয় পুরুষ সার্থক বাদশাহ্ হতে পারে না। দারা অবশ্য বীর—দক্ষ যোদ্ধা সে। তবু প্রতিভা তাকে কোন্ পথে টেনে নিয়ে যাবে শেষ পর্যন্ত কে বলতে পারে? যদি এ-দিকেই মন দেয়, আমার দুঃখ থাকবে না। কিন্তু মসনদের প্রলোভন আর প্রতিভার চাহিদা যদি তার চিত্তকে ক্ষতবিক্ষত করে তবে তার ভবিষ্যৎ বড়ই দুঃখের।

দারাকে ঠিক পথে নিয়ে যেতে চেষ্টা করবে নাদিরা।

—কোটা ঠিক পথ?

—জানি না। নির্বাচনের ভার তোমার।

নাদিরা অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে শেষে আস্তে আস্তে মাথা নাড়ে। কী বুঝল সেই জানে।

.

পরদিন শত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও দরবারে যাবার মুখে বাদশাহের সামনে না দাঁড়িয়ে পারি না। সারারাত ছট্‌ফট্ করেছি। কৌতূহল একদণ্ড আমাকে নিশ্চিন্তে ঘুমোতে দেয়নি। শিল্পীকে পুরস্কার দেবার আড়ালে প্রচ্ছন্ন কোনও ইনসাফের ব্যবস্থা হয়েছে কি না কে বলতে পারে? দরবারের কার্যরীতি বড়ই বিচিত্র। বাদশাহের কন্যা হয়েও এক একটি ঘটনা আমাকে চমকিত করেছে। বাদশাহও চমকিত হয়েছেন হয়তো। কারণ অনেক বিচারের গতি বাদশাহের অনিচ্ছায় আমীর-ওমরাহের প্রভাবে পড়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন পথ নেয়। রাজনীতিতে প্রভাবশালী পুরুষদের কথা বাধ্য হয়েই মানতে হয় অনেক সময়। শুনেছি, আকবার বাদশাহ্ কারও কথা শুনতেন না। কথাটির মধ্যে সত্য থাকলেও, সবটুকু নয়। পদে পদে যুদ্ধের আশঙ্কাকে কোনও বাদশাহ্ই মেনে নিতে চান না। যুদ্ধ ভালবাসলেও যুদ্ধের নেশা আকবরের ছিল না। যুদ্ধের নেশা যাদের থাকে দেশকে গড়তে পারে না তারা।

বাদশাহ্ শাহজাহান আমাকে সামনে দেখে দাঁড়িয়ে পড়েন। মুখের দিকে চান। তাঁর এক এক সময়ের দৃষ্টি আমাকে বড় বেশি লজ্জা দেয়। সে দৃষ্টি আমি ঠিক চিনতে পারি না। হঠাৎ আমার দিকে চাইলেই অমন দেখা যায়। এতে তিনিও কম অপ্রস্তুত হন না।

—কী খবর জাহানারা?

—আজ দরবারে বিশেষ কিছু আছে কি?

—না।

অভিমানের সময় নেই। আমাকেও গিয়ে দাঁড়াতে হবে ঝরোকার পেছনে।

—তাজমহলের সেই শিল্পী নাকি আসবে?

—ও। হ্যাঁ। আমার হিতৈষীরা বলছিলেন তাকে আরও কিছু টাকা দেওয়া দরকার।

—কেন?

—তাঁরা চান না শিল্পী তার জীবনে দ্বিতীয় কোনও তাজমহল তৈরি করুক।

—সে কি? তার মানে?

—তাজমহলই যেন তার শেষ সৃষ্টি হয়।

ক্রোধে আমার গা কাঁপতে থাকে। আমীর-ওমরাহেরা যা বলে বলুক। কিন্তু বাদশাহের এই অবহেলা অসহ্য। মানুষটির কাজকে প্রশংসা করেও মানুষকে সম্মান জানাতে পারলেন না।

উত্তেজিত হই। খুবই উত্তেজিত হই। বলি,—শাহনশাহ্ শাহজাহান ছাড়া তাজমহল তৈরির অর্থ জোগানো আর কারও পক্ষে কি সম্ভব? শিল্পী কোথায় পাবে সেই অর্থ, যার ফলে দ্বিতীয় একটি তাজমহলের গম্বুজ দিগন্তের রেখায় শোভা পাবে।

—আমি সে-কথা বলেছিলাম। ওঁরা বলেন, মসনদ একটি জল-বুদ্। যে কোনও মুহূর্তে ফেটে গিয়ে তলিয়ে দিতে পারে। নতুন বুদ্বুদের ওপর নতুন লোক এসে ওই শিল্পীকে ডেকে এনে আরও বিস্ময়কর কিছু তৈরি করতে পারে।

বুঝলাম অমরত্বের মোহে অন্ধ হয়েছেন বাদশাহ্। প্রথমে উদ্দেশ্য ছিল নিজের প্রিয়তমা বেগমকে অমর করা, এখন সেই সঙ্গে নিজেকেও জড়িয়ে ফেলেছেন। মুক্তির পথ তিনি খুঁজে পাবেন না। তবু শেষ চেষ্টা হিসাবে আমার বক্তব্য বাদশাহের কানে ছুড়ে দিই,—তেমন অঘটন যদি ঘটে তবে টাকা নিয়ে শিল্পী যে কথা দিয়ে যাবে সে কথা পালন করতে বাধা থাকবে কি?

বাদশাহ্ জবাব খুঁজে পান না। তাঁর ললাটে চিন্তার রেখা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। শেষে তাড়াতাড়ি শেষ অস্ত্র ছাড়েন,–এটা রাজনীতি জাহানারা। অনেক সময় নিজেকে অন্যের ইচ্ছায় সমর্থন না করলে রাজকার্যে জটিলতা দেখা দেয়। একজন শিল্পীর ভবিষ্যৎ চিন্তা করতে গিয়ে সে জটিলতা নাইবা সৃষ্টি করলাম।

বাদশাহ্ চলে যান

রাগে ক্ষোভে চোখের জল ফেলতে ফেলতে আমি ঝরোকার আড়াল গিয়ে দাঁড়াই। দেখতে হবে। আগাগোড়া সব কিছু দেখতে হবে। জানতে হবে বাদশাহের প্রকৃত মনোভাব

একটু পরে কোয়েলও এসে আমার পেছনে দাঁড়ায়। তার মুখে কিছু কিছু স্বেদ; কোয়েল ঠিক সাধারণ বুদ্ধির মেয়ে নয়। সে-ও বুঝতে পেরেছে শিল্পীকে প্রচুর এনাম দেবার পেছনে রয়েছে কোনও গূঢ় উদ্দেশ্য। তাই তার মুখে চাপা আনন্দের রক্তিমাভার পরিবর্তে অনিশ্চয়তার বিন্দু বিন্দু ঘাম।

দরবারে প্রতিদিনের ওমরাহের দল রয়েছে। নতুন লোকের মধ্যে দেখলাম তাজমহলের ভারপ্রাপ্ত শিল্পী ইসা-মামুদ-ইফেদী আর দেখলাম ওস্তাদ হামিদ খাঁকে। লোকটি নাকি ইতিমধ্যে বেশ নাম করেছে ইমারত তৈরির ব্যাপারে। সম্প্রতি বাদশাহ্ দিল্লিতে রাজধানী স্থানান্তরের বিষয়ে চিন্তা করছেন। সে ব্যাপারে উৎসাহ যুগিয়ে চলেছে এই হামিদ খাঁ।

হামিদ খাঁর নাকি মনে মনে বাসনা আর একটি বিস্ময় সৃষ্টি করবে সে। জানি না দিল্লির প্রাসাদের জন্যে বাদশাহ্ কত খরচ করবেন।

কিন্তু শিল্পী কই?

কোয়েলের দিকে চাই। দেখি সে তন্ময় হয়ে দরবারের শেষ প্রান্তে চেয়ে রয়েছে তার দৃষ্টিকে অনুসরণ করে দেখতে পাই শিল্পীকে। বসে রয়েছে সে। কেমন যেন সঙ্কুচিত সে। শুধু তার চাহনি অবাক্ বিস্ময়ে দরবারের এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে। দেওয়ান-ই-খাসে এই প্রথম এল বোধ হয়।

বাদশাহ্ শিল্পীকে ডাকতে বলেন।

এগিয়ে আসে সে এক-পা এক-পা করে। সে বুঝতে পারছে না কীভাবে দাঁড়াতে হয় বাদশাহের সামনে। ইচ্ছে হয়, গিয়ে তাকে শিখিয়ে দিই। কিন্তু কোয়েল পেছনে। আমার মনের ইচ্ছেও সে হয়তো জেনে ফেলবে। তার ধারণা, চাঁদ কখনো পৃথিবীতে নেমে আসতে পারে না।

কোনওরকমে বাদশাহকে কুর্নিশ করে শিল্পী দাঁড়ায়। তার পা কাঁপে। অথচ এই শিল্পীই কোনওরকম সম্মান না দেখিয়ে বাদশাহের সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে কথা বলেছে তাজমহলের আঙিনায়। ভাবি, সত্যিই অদ্ভুত এরা। না না, অদ্ভুত নয় অপূর্ব, ওর পায়ের কাঁপুনি থামিয়ে দিতে ইচ্ছে হয়। পা ধরে—। না না-কোয়েল রয়েছে পেছনে। পিতা গম্ভীর স্বরে বলেন, –তোমার কাজে আমরা, বিশেষ করে আমি খুব খুশি হয়েছি। তাই তোমার যা পাওনা তুমি পেয়েছ, তার উপরও পঞ্চ সহস্র সুবর্ণ-মুদ্রা এনাম দেব বলে মনস্থ করেছি।

শিল্পী বিহ্বল দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। সে জানত যে সে পুরস্কার পাবে। কিন্তু তার পরিমাণ যে এতটা কল্পনাও করেনি সে।

কোয়েল কেঁদে ওঠে। বুঝতে পারি পাঁচ হাজার সুবর্ণ-মুদ্রার মূল্য যে কতখানি, শিল্পী না জানলেও অনুমান করতে পারে। তাই শিল্পীর চোখ শুষ্ক, অথচ কোয়েল কেঁদে মরে।

কিন্তু তার দিকে চাইবার মতো মনের অবস্থা আমার নয়। আমি জানি এরপর কী হবে। বুক কাঁপে আমার।

রত্নাগারের অধ্যক্ষ বেবাদল খাঁ একটি সুদৃশ্য গজদন্ত-নির্মিত ভারী পেটিকা একজন প্রহরীর মাথায় চাপিয়ে শিল্পীর দিকে এগিয়ে আসে।

হঠাৎ হামিদ খাঁ চেঁচিয়ে ওঠে—কিন্তু জাহাঁপনা—

বাদশাহ হাত উঁচিয়ে তাকে থামিয়ে দেন। তাঁর চোখে মুখে বিরক্তির ছাপ, ধীরে ধীরে বলেন, —কিন্তু এনাম নেবার আগে একটি প্রতিজ্ঞা করতে হবে তোমায়।

কোয়েলের মুখ দিয়ে বিস্ময়ের অস্ফুট শব্দ বের হয়। শিল্পীও স্তব্ধ

—তোমাকে প্রতিজ্ঞা করতে হবে তাজমহলের মতো শিল্প-সৃষ্টি ভবিষ্যতে তুমি আর কখনো করতে পারবে না।

এবারে ইসা-মামুদ বলে ওঠে—তাহলে আমাকেও সেই প্রতিজ্ঞা করতে হয় জাহাঁপনা।

—না। তুমি আমার দরবারের লোক। শিল্পী বাইরের।

এই প্রথম শিল্পীর পায়ের কাঁপুনি থামে। তার মুখে এক ঝলক হাসি ভেসে ওঠে। তাকে বলতে শুনি-আপনি ছাড়া এ জগতে আর কে এ-কাজ করার সামর্থ্য রাখে? ভবিষ্যতে আপনার যদি এরকম কোনও ইচ্ছে হয়?

—হবে না।

বাদশাহের কথায় শিল্পী কী জবাব দেবে আমি অনুমান করতে পারি। তারপরে গজদন্তের পেটিকা প্রহরীর মাথায় চাপিয়ে সে দরবার ত্যাগ করবে। কিন্তু সে কোনও জবাব দেয় না। তাকে চিন্তান্বিত দেখি।

সামান্য কয়েকটি মুহূর্ত। অথচ মনে হয়—বহু যুগ। শিল্পী বাদশাহের দিকে সোজা দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ম্লান হেসে বলে,—আমি কোনও প্রতিজ্ঞা করব না জাহাঁপনা।

পিতার মুখে কি ক্রোধ? না বিস্ময়?

—পঞ্চ সহস্র সুবর্ণমুদ্রার কথা ভুলে যাওনি তো?

ইসা-মামুদ উঠে দাঁড়িয়ে গম্ভীর স্বরে বলে,–না বাদশাহ্ ভুলে না গিয়েই সে আপনার কথার জবাব দিয়েছে। যে মুহূর্তে সে প্রতিজ্ঞা করবে সেই মুহূর্তে তার শিল্পী-মন কঠিন শৃঙ্খলে বাঁধা পড়বে। ও জানে, তাজমহল নির্মাণের সুযোগ কোনওদিনই ওর আসবে না তবু শৃঙ্খলিত শিল্পী-মন নিয়ে তার কোনও সৃষ্টিতেই বেহেস্ত-এর পরশ থাকবে না।

বাদশাহের মুখে খুশির ঝলক। এইটুকু দেখবার জন্যেই আজ আমি দরবারে উঁকি দিতে এসেছি। মনের বোঝা আমার নেমে যায়।

যুবক-শিল্পীর চোখে জল। ইসা-মামুদের উদ্দেশে সে সশ্রদ্ধ অভিবাদন জানায়। দরবারে নিয়ম অনুযায়ী বাদশাহ ছাড়া কাউকে সম্মান জানানো অবমাননাকর। তবু সবাই উপেক্ষা করে আজ। শিল্পী ভাঙা ভাঙা গলায় বলে,—আপনি নিজে জানেন আমাদের মনের কথা জাঁহাপনা। আপনিও যে আমাদের দলে। আমাকে আপনি পরীক্ষা করছিলেন।

একজন ওমরাহ বলে,—এনাম ওকে দেবেন না জাহাঁপনা

ঘুরে দাঁড়ায় যুবক তার দিকে। বলে,–এনাম আমি পেয়েছি দোস্ত। কয়েকজন ওমরাহ এক সঙ্গে বলে,না পাওনি।

দৃঢ়স্বরে শিল্পী বলে,—পেয়েছি।

ওমরাহেরা উৎকণ্ঠিত হয়ে বাদশাহের দিকে চায়। তিনি যুবককে বলেন—তুমি যেতে পার।

—এনাম? কয়েকজন প্রশ্ন করে।

—নেবে না। বাদশাহ্ গম্ভীর।

—নেবে না? সমস্ত দরবার একসঙ্গে কথা বলে ওঠে।

শিল্পী ততক্ষণে দরওয়াজার দিকে অনেকটা এগিয়ে গিয়েছে।

কোয়েল কেঁদে ওঠে।

—দুবারের কান্নাই কি আনন্দের কোয়েল?

নিজেকে সামলে নিয়ে উত্তর দেয় সে,—হ্যাঁ শাহজাদী। কিন্তু এবারের আনন্দ আর ধরে রাখতে পারছি না।

আবার বুঝলাম, কোয়েল সাধারণ মেয়ে নয়।

সেইদিনই সন্ধ্যায় আমার কক্ষে প্রবেশ করে কোয়েল এক অস্বাভাবিক বিবর্ণ মুখে। চমকে উঠি আমি।

—কী হয়েছে কোয়েল?

সে কথা বলে না। শুধু চেয়ে থাকে। তার চাহনিতে কোনও ভাষা নেই।

—কোয়েল?

বৃথা। দরবারের পর আমার কাছ থেকে ছুটি চেয়েছিল সে দুপুরবেলাটুকু। জানতাম, কোথায় যাবে। ছুটি দিয়েছিলাম তাই। অপেক্ষা করছিলাম তার আনন্দোজ্জ্বল মুখখানা দেখব বলে। কিন্তু একি? এমন কী দুর্ঘটনা ঘটেছে, যা কোয়েলের মতো স্থির মস্তিষ্কের মেয়েকেও এতখানি বিচলিত করেছে?

—রোশনারা আবার অপমান করেছে কোয়েল?

কথা বলে না তবু। কাছে গিয়ে শরীর স্পর্শ করতেই সে পড়ে যায়। জ্ঞান হারায়। প্রথমে আমি দিশেহারা হই। তারপর শাহজাদী হয়ে নাজীরের মাথায় ব্যজন করি। বহুক্ষণ পরে জ্ঞান ফিরে আসে কোয়েলের। চোখ বড় বড় করে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে। তারপর কান্নায় ভেঙে পড়ে। অমন বুক ভাঙা কান্না জীবনে শুধু একবার শুনেছিলাম—মায়ের মৃত্যুর দিনে।

তবে কি! কিন্তু সে যে অসম্ভব। এর মধ্যে শিল্পীর এমন কী হতে পারে?

শান্ত হয় কোয়েল। তারপর সামান্য কয়টি কথায় যে সাঙ্ঘাতিক খবর সে বলে, তাতে আমি নিজেকে সামলাতে পারি না। আমিও কাঁদি। ওর মতোই কাঁদি।

সাঙ্ঘাতিক। কেঁপে কেঁপে ওঠে আমার হৃদয়। এমন জঘন্য পাপী আমারই পিতার সাম্রাজ্যে বাস করে—এই আগ্রাতেই। ধিক্।

তার চেয়ে শিল্পীর প্রাণটুকু নিলেই পারত। আফসোস থাকত না তার। আমাদের দুঃখ এত অসহনীয় হত না।

বৃদ্ধাঙ্গুলি কেটে দিয়ে গেল শিল্পীর! পিশাচ তারা। তাই শিল্পকার্যে তন্ময় শিল্পীকে পাঁচ-সাত জনে একসঙ্গে আক্রমণ করে অমন সর্বনাশ করে গেল। মন বেঁচে থাকল ওর। চোখও জেগে রইল। অথচ হাত দিয়ে স্বপ্নকে রূপ দেবার উপায় রইল না।

কিছু সময়ের জন্যে ক্রোধও যেন আমাকে ত্যাগ করে যায়। হতাশা আর অশ্রুজল ছাড়া আর কিছুই থাকে না। কিন্তু আমি শাহজাদী জাহানারা। ধীরে ধীরে প্রতিহিংসা জাগে মনে। এক উদগ্র প্রতিহিংসা। তড়িৎবেগে উঠে আমি উন্মত্তের মতো সেদিকে যাই।

কোনওরকম খবর না দিয়ে ঝড়ের মতো ঢুকে পড়ি ‘দশ-পঁচিশী’তে। নূপুরের আওয়াজ স্তব্ধ হয়। নর্তকীদের চপল পা স্থাণুর মতো গালিচায় আটকে যায়। সচকিত হয়ে বাদশাহ্ মুখ তুলে আমাকে দেখেন।

—কেন এসেছ? বাদশাহের কণ্ঠস্বরে চাপা ক্রোধ।

সে ক্রোধে বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে আমি বলি,—গুরুতর কারণ ঘটেছে বলেই এসেছি। তাছাড়া আমি জানি শাহানশাহ্ শাহজাহান সুরাপান করে কখনো বেসামাল হন না।

নর্তকীদের ভয়-চকিত দৃষ্টি আমার দিকে নিবদ্ধ। তারা হয়তো কল্পনাই করতে পারেনি বাদশাকে কেউ এভাবে কথা বলতে পারে-সে বাদশাহের যত আপন লোকই হোক না কেন বাদশাহ্ও হয়তো চমকে ওঠেন আমার কথা শুনে। এমন কথা জীবনে তিনি প্রথম শুনলেন আমার মুখে।

কিন্তু অতশত দেখবার মতো মনের অবস্থা আমার ছিল না। আমি চাই প্রতিহিংসা—নিষ্ঠুরতম প্রতিহিংসা।

বাদশাহকে দেখে মনে হয় তাঁর ক্রোধ অনেকটা অন্তর্হিত হয়েছে। পরিবর্তে একটা কৌতূহল জেগেছে মনে। তবু গম্ভীর হয়ে বলেন,—কিন্তু তোমার জীবন তো যেতে পারত প্রহরীদের হাতে। জানো না আমার আদেশ?

—জানি; কিন্তু ‘দশ-পঁচিশী’র প্রহরীরা যে আমারই নিযুক্ত। তারা জানে এখানকার এই সান্ধ্য আসরের মূলে আমি।

হয়তো আমার মধ্যে এক অদেখা বেয়াড়াপনার সাক্ষাৎ পেলেন তিনি। তাই একটু চুপ করে থেকে বলেন,—কেন এসেছ?

—সবার সামনে বলতে পারব না।

নর্তকীরা নিঃশব্দে স্থান ত্যাগ করে। কক্ষের মধ্যে স্তব্ধতা বিরাজ করে। নীচের দিকে চেয়ে থাকি। ‘দশ-পঁচিশী’র নানা বর্ণের চতুষ্কোণ ঘরগুলি শোভা পায় মেঝেতে

—বলো জাহানারা।

আমি খুলে বলি সব। বলতে বলতে আমার বুকের মধ্যে বাষ্প জমে। সে বাষ্প অশ্রুর আকারে যে কোনও মুহূর্তে চোখ বেয়ে ধারা হয়ে নামতে পারে। তবু থামি না। বলে যাই—

নীরবে বাদশাহ্ শুনে যান। আমার বক্তব্য একসময় শেষ হয়। তবু তিনি নীরব। একটা সংশয়ের ছায়া আমার মনের মধ্যে উঁকি দেয়। তবে কি শাহজাহানও এই ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রের মধ্যে রয়েছেন? আমার উপস্থিতিতে প্রকাশ্যে শিল্পীকে শাস্তি না দিতে পেরে তিনি এ ভাবে তার ভবিষ্যতের সমস্ত সৃষ্টির সম্ভাবনা বিনষ্ট করে দিলেন। না না, তাও কি হতে পারে? এ আমি কী ভাবছি?

হঠাৎ বাদশাহের চক্ষুদ্বয় রক্তবর্ণ হয়ে ওঠে। তাঁর হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়। তিনি কাঁপতে থাকেন। বিলাসী শাহজাহানের এই ভয়ংকর রূপ আমি আগে কখনো দেখিনি। সামনের সুরার পাত্রটি ছুড়ে ফেলেন তিনি। ভেঙে খান্ খান্ হয়ে যায় সেটি। তারপর উঠে দাঁড়ান। নিজের অদম্য রোষবহ্নিকে সংযত করার আপ্রাণ চেষ্টা করে তিনি বলেন,—মানুষ এত হীন হতে পরে আমি ভাবিনি জাহানারা। অপরাধীকে আমি শাস্তি দেব—কঠোরতম শাস্তি দেব।

বাদশাহ্ ‘দশ-পঁচিশী’ কক্ষ থেকে বার হয়ে দেওয়ান-ই খাসের দিকে দ্রুত চলে যান। কোনও প্রহরীর মাধ্যমে আদেশ পাঠিয়ে বাদশাহ্ ব্যবস্থা অবলম্বনের ঝুঁকি নিলেন না। তিনি নিজেই গেলেন। কার কাছে গেলেন আমি জানি। আর এও জানি, এ সময়ে দেওয়ান-ই-খাসে কেউ না থাকুক সে অন্তত একা বসে রয়েছে। বল্কের আমির নজরৎ খাঁ। নতুন স্থান পেয়েছে দরবারে। বয়সেও নবীন। বীর যোদ্ধা বলে সুখ্যাতি আছে শুনেছি। যোদ্ধা তো বটেই—চেহারা দেখলেই বোঝা যায়। অমন পেশীবহুল দেহ আর শক্ত গড়ন আমার ভাইদের মধ্যে মুরাদ ছাড়া কারও নেই।

বাদশাহ্ নজরৎ খাঁকে অল্পদিনেই বড় বেশি বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন। না করেও উপায় নেই। কিসে মন ভেজে পিতার, সব যেন তার নখদর্পণে। এত বেশি গলিয়ে দিয়েছে সে বাদশাকে যে সেদিন দারার অনুপস্থিতিতে তিনি হঠাৎ নজরৎ খাঁকে পাঠিয়ে দিলেন ঝরোকার কাছে। কোনও একটি স্ত্রীলোকের বিচারের ব্যাপারে আমার মতামত জানতে চেয়েছিলেন বাদশাহ্। প্রথমে রীতিমত বিস্মিত হয়েছিলাম আমি—চিন্তিতও। তারপর নিজের মর্যাদা অনুযায়ী আমার মতামত নজরৎকে জানিয়ে দিয়েছিলাম।

আজ এই গোপন কাজটির ভার তিনি নিঃসন্দেহে ওরই ওপর দেবেন। জানি, সুষ্ঠুভাবে পালন করবে নজরৎ বাদশাহের আদেশ। কাল থেকে পৃথিবীর বুক শিল্পীর আক্রমণকারী বিচরণ করে বেড়াবে না। একদিনেই প্রকৃত আক্রমণকারীকে খুঁজে বের করা যাবে।

দীর্ঘশ্বাস ফেলি। শত হলেও একটা নরহত্যা। আর আমি নারী। নজরৎ খাঁ তার বুকখানা ফুলিয়ে কাল দেওয়ান-ই-খাসে এসে দাঁড়াবে। তার চোরা-চাহনি ঘন ঘন ঝরোকায় প্রতিহত হয়ে ফিরে যাবে। কদিন থেকেই এমন হচ্ছে। নিজের সম্বন্ধে তার খুবই উঁচু ধারণা। সে ধারণা অবিশ্যি অমূলক নয়। অমন সুপুরুষ বীর ওমরাহ আঙুলে গোনা যায়। কিন্তু সে যা ভেবে বসে রয়েছে সেটি ভুল। আমি তাকে পছন্দ করতে পারিনি।

ভারাক্রান্ত মনে ধীরে ধীরে নিজের কক্ষে প্রবেশ করি। কক্ষের এককোণে কোয়েল তখনো দাঁড়িয়ে। আমার পায়ের শব্দে ফিরে তাকায়। চেয়ে দেখি গালে তার শুষ্ক জলের রেখা।

আমার দিকে এগিয়ে আসে সে। আমি জানি কী ব্যথা তার বুকে। ভালবাসা না পেয়েও নিজে ভালবেসে মরেছে। আর যাকে ভালবাসে তার জীবনের সব চাইতে দুর্দিন আজ। দ্বিতীয় তাজমহল পৃথিবীর বুকে আর কোনওদিনই মাথা তুলে দাঁড়াবে না। যুগের পর যুগ যাবে, কালের গ্রাস থেকে যদি আজকের তাজমহল রক্ষা পায় তবে শুধু এটিকে দেখেই সারা পৃথিবীর মানুষকে তুষ্ট থাকতে হবে।

—কোয়েল?

—শাহজাদী!

—তারা শাস্তি পাবে।

—কারা শাহজাদী?

—যারা এ কাজ করেছে।

—কী লাভ?

তাই তো। কী লাভ! যা হবার তা হয়ে গিয়েছে। এখন আর কোনও কিছুতেই কোনও ফলই হবে না। শিল্পীর নষ্ট আঙুল আর জোড়া লাগবে না। কোয়েলের হতাশা এখন লাভ-লোকসানের বাইরে।

কিন্তু আমি কোয়েল নই। আমি জানি, অপরাধীকে শাস্তি পেতেই হবে। নইলে জগতের প্রতিটি শিল্পীই চিরকাল প্রতিভাহীন উচ্চাকাঙ্ক্ষীদের কাছ থেকে এইভাবে নির্যাতন সয়ে যাবে। শাস্তির একটি উদাহরণ অন্তত রাখা চাই ভবিষ্যতের মানুষের সম্মুখে।

কিন্তু উদাহরণ তো থাকবে না। নিঃশব্দে সবকিছু শেষ হয়ে যাবে। কাক-চিলও জানতে পারবে না কীভাবে অপরাধীর মৃত্যু হল। অপরাধী যে সাধারণ ব্যক্তি নয় এটুকু সবাই বুঝেছে নইলে নজরৎ খাঁয়ের ওপর তাকে শাস্তি দেবার ভার পড়ত না। যদি তার শব খুঁজে পাওয়া যায়, লোকে জানবে আততায়ীর হস্তে নিহত হয়েছে সে। ইতিহাসে এই শাস্তির কথা লেখা থাকবে না। লেখা থাকবে শুধু আমার এই একান্ত আপনার কিতাবটিতে, বাবা যা দিয়েছেন আমাকে। কিন্তু এ কিতাব আমার মৃত্যুর পর কতদিন অস্তিত্ব বজায় রাখতে পারবে জানি না।

—কোয়েল?

—শাহজাদী!

—সেই মূর্তি কতখানি গড়া হয়েছিল?

—মনে মনে সবটাই গড়েছিল। কিন্তু পাথরে খোদাই-এর কাজ সবে শুরু করেছিল। ইচ্ছে ছিল খুব ধীরে ধীরে এগিয়ে যাবে—মূর্তির প্রতিটি অণু থেকে যাতে সৌন্দর্য ঝরে পড়ে। হল না। তার সাধের তিলোত্তমা গড়া হল না।

হঠাৎ এক অমঙ্গল আশঙ্কায় আমার বুক কেঁপে ওঠে। কোয়েলের মনে সে আশঙ্কা হয়তো স্থান পায়নি এখনো। তাড়াতাড়ি বলে উঠি,–সে আত্মহত্যা করবে না তো কোয়েল?

—জানি না। তবে আজ করবে না। আজ তার কোনও বোধ শক্তিই নেই। হয়তো পাগল হয়ে যাবে শেষে।

শয্যার ওপর গিয়ে বসি। নিজেকে বড় ক্লান্ত মনে হয়। এমন অবসাদ অনুভব করেছিলাম শুধু মায়ের মৃত্যুর রাত্রে। নবজাত বোনের কান্না শুনেও সেদিন দেখতে যাবার শক্তি ছিল না। সেদিনের পর থেকে খুব কমই গিয়েছি বোনের কাছে। কেন যেন মনে হত মায়ের মৃত্যুর জন্যে সে দায়ী। সে মনোভাবের গোড়ায় কুসংস্কার কাজ করে জানি। তবু সে সংস্কার থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারিনি। নাজীরদের কোলে কোলেই মানুষ হল ছোট বোনটি। আজ সে সুন্দর ফুটফুটে একটি মেয়ে বড় শান্ত বড় ধীর। মাঝে মাঝে সঙ্কোচে আমার ঘরের সামনে এসে দাঁড়ায়। হাতে ধরে ভিতরে নিয়ে গিয়ে বসাই। আদর করি। বুঝতে পারি, দিনের পর দিন একটু একটু করে আমার মনের কাছে চলে আসছে সে। শত হলেও সে আমাদের চেয়েও হতভাগী।

নানান চিন্তা একসঙ্গে আমার মাথার ভিতরে জট পাকিয়ে আমাকে অন্যমনস্ক করে তুলছিল। পালঙ্কের বাজু ধরে ফাঁকা দৃষ্টিতে চেয়েছিলাম বাইরে। আকাশে চাঁদ ছিল না। শুধু তারা। সে তারাও পাতলা মেঘে মাঝে মাঝে ঢাকা পড়ছিল। হঠাৎ একসময় মনে হয় বহুদূর থেকে কে যেন আমায় ডাকছে।

কোয়েল। কোয়েলই ডাকছে। একেবারে আমার পাশে দাঁড়িয়ে ডাকছে। কিন্তু তার গলার স্বর খুবই চাপা।

—বলো কোয়েল।

—আমায় বিদায় দিন।

—আমিও সেকথা ভাবছিলাম। ওর কাছে তো কেউ থাকবে না। রাতে তুমিই গিয়ে থাকো।

—শুধু রাতের জন্যে নয়। চিরদিনের জন্যেই যাচ্ছি।

কোয়েল চলে যেতে চায়? চিরদিনের জন্যে? কোয়েল ছাড়া আমার নিজের অস্তিত্বের কথাও যে আজকাল ভাবতে পারি না। অসহায়ের মতো চেয়ে থাকি।

—অনুমতি দিন শাহজাদী। কোয়েলের কণ্ঠস্বরে আকুতি।

—বাধা দিচ্ছি না কোয়েল। তুমি যাও।

‘সিজদা’ করে সোজা হয়ে দাঁড়ায় সে। তারপর হঠাৎ নাজীরের সমস্ত দূরত্ব মুহূর্তে ধুলিসাৎ করে দিয়ে আমার উরুর ওপর মুখ রেখে কেঁদে ফেলে। আমার চোখও শুকনো রাখতে পারি না। কোয়েল শুধু সাধারণ একজন বাঁদী নয়, সে আমার বন্ধু। সে আমার পরামর্শদাতা। তার অভাব অনেকদিন অনুভূত হবে—যতদিন নতুন অবস্থার সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে না পারব।

ধীরে ধীরে মাথা তোলে সে। বলে,—জীবনে কেউ যেন আমার এ অবস্থায় ও না পড়ে। দুদিকেই দুর্নিবার আকর্ষণ। কোন একটা ছেড়ে দেওয়াই চূড়ান্ত বেদনার।

—কোয়েল? শিল্পী কি কখনও জানতে পারবে, কার মূর্তি সে গড়তে চেয়েছিল?

—হ্যাঁ। তবে যতদিন আগ্রায় থাকবে ততদিন নয়। আগ্রা থেকে দূরে-বহুদুরে, বাংলার সেই নিভৃত পল্লিতে তার নিজের গৃহে যখন সে ফিরে যাবে, শুধু তখনই অবস্থা বুঝে তাকে বলব সব কথা। তখন বলব, তার জীবনের একমাত্র নারীর কথা।

—তুমি যাবে?

—হ্যাঁ শাহজাদী। আমি ওর সঙ্গেই যাব। ওকে দেখবার আর কেউ নেই।

মুগ্ধ দৃষ্টিতে কোয়েলের নতুন রূপের দিকে চেয়ে থাকি। আল্লার কাছে আমার কৃতজ্ঞতার অন্ত নেই। মুঘল-বাদশাহের হারেমে জন্মেও এই রূপ দেখার দৃষ্টি আমার কাছ থেকে কেড়ে নেননি।

—যাই শাহজাদী। যতদিন ওর আয়ু রয়েছে, ওর কাছেই থাকব; আয়ু ফুরালেও ওখানকার মাটি আঁকড়ে পড়ে থাকব। তবে কখনও যদি ওই দূরতম অঞ্চলেও আপনার দুর্দিনের কথা ভেসে যায়, ঠিক চলে আসব। আপনার পাশে এসে দাঁড়াবো। আপনি হয়তো তখন চিনতে পারবেন না আমাকে। তবু আসব।

আমার জবাব শোনবার আগেই সে দরওয়াজার দিকে চলে যায়। শুধু আড়ালে যাবার পূর্বে একবার দাঁড়িয়ে মুখ ঘুরিয়ে সে আমাকে দেখে নেয়। পরক্ষণেই জোর করে নিজের দেহটিকে বের করে নিয়ে যায়।

চলে গেল কোয়েল। আর ফিরবে না।

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *