মমতাজ-দুহিতা জাহানারা – ১০

১০

ভেবেছিলাম আর লিখব না। একঘেয়ে দিনযাপনের গ্লানি মনের সব সজীবতা যেন নষ্ট করে দিয়েছে। আওরঙজেব বিদায় নেবার পর থেকেই মনে হতে লাগল, আর কেন? সব তো শেষ হয়ে এল। এবার পিতাপুত্রীর জীবন শেষ হলেই আওরঙজেব নিশ্চিন্ত হতে পারে। আমাদের জন্যে তক্ত-তাউসে বসেও তার সুখ নেই। আমাদের অজ্ঞাতে গোয়ালিয়র দুর্গের মতো যদি এখানেও খাদ্যের মধ্যে বিষ মিশিয়ে দিত, বেশ হত।

বিষ সে দেয়নি বটে, কিন্তু বিষ ছাড়াই দিনে দিনে মন আমার বিষিয়ে উঠছিল। জীবনের সব কিছুর মূল্য হারিয়ে ফেলায় এক হাঁ করা শূন্যতা আমাকে গ্রাস করছিল। এতদিন ধরে নিজের খেয়ালে যা লিখেছি সব ভুয়ো—সব মিথ্যে বলে প্রতীয়মান হল। তাই নিদ্রাহীন রজনীর শেষ প্রহরে পিতার উপহারের কিতাব দুটি নিয়ে বাইরে বের হয়ে আসি। লেখার শুরু থেকে একটা একটা করে পাতা ছিঁড়ে উড়িয়ে দিতে থাকি নীচের দিকে। যাক, সব যাক। চোখ দুটো জলে ভরে আসে। পিতার সেই বহুদিন আগের সন্ধ্যাবেলার মুখখানা মনে পড়ে যায়। কত আশা করেই না সেদিন আমাদের দুই বোনের হাতে কিতাব দুখানি তুলে দিয়েছিলেন তিনি। ভবিষ্যতের কত সুখ-কল্পনাই না করেছিলেন। আজ ভাবি, সেদিন যদি তিনি তাঁর নিজের ভবিষ্যৎ আবছাভাবেও দেখতে পেতেন তবে কখনই তাঁর কর্মব্যস্ত সময় থেকে কয়েক মুহূর্ত চুরি করে নিয়ে অত আগ্রহভরে কিতাব দুটি দিতে আসতেন না আমাদের। তাঁর কল্পনা ব্যর্থ হয়েছে। আমার কল্পনাও ব্যর্থ হয়েছে। এই ব্যর্থতা-ভরা রচনা রেখে লাভ কী? যাক্—সব যাক্ আওরঙজেব আর রোশনারার হাতে এ দুটি পড়বার আগেই শেষ হয়ে যাক্। তারা দেখতে পেলে অট্টহাস্য করে উঠবে। রোশনারা হয়তো খানাপিনার আয়োজনই করে বসবে এই উপলক্ষে।

ছিঁড়ে ছিঁড়ে ফেলতে থাকি পাতাগুলোকে এক এক করে। নিজের দেহ থেকে যেন এক এক টুকরো মাংস ছিঁড়ে ফেলছি। বিষণ্ণভাবে পাতাগুলো ঘুরপাক খেতে খেতে নীচের দিকে পড়তে থাকে। চেয়ে চেয়ে দেখি আমি। পাতাগুলো বিশেষ আপত্তি করেনি। টানতেই খুলে এসেছে। তারাও বুঝতে পেরেছে তাদের সর্বাঙ্গের কালো আঁচড়ের ব্যর্থতা। স্রষ্টার ব্যর্থতায় তারা ব্যর্থ। তবু এতদিনের মায়া কাটাতে বোধ হয় কষ্ট হচ্ছিল। তাই দু-একখানি পাতা মাঝে মাঝে দক্ষিণের দমকা বাতাসে ফিরে এসে আমার গায়ে লেপটে যাচ্ছিল। এমনি একটি পাতা তুলে নিয়ে খেয়ালের বশে চোখের সামনে তুলে ধরতে দেখি মায়ের কথা লেখা রয়েছে তাতে। যে মুহূর্তের কথা লেখা রয়েছে, সেই মুহূর্তটি চোখের সামনে ভেসে ওঠে।

বুকের ভেতরে হু হু করে উঠল। কী করলাম আমি? এমন কত মধুর কত অমূল্য মুহূর্ত যে ধরা পড়েছে আমার লেখায়। আর তো ফিরে পাবো না।

—শাহাজাদী!

—কে কোয়েল?

—হ্যাঁ শাহজাদী। অঙ্গুরিবাগ থেকে আপনার জন্যে একগুচ্ছ ফুল এনেছি। খুঁজতে খুঁজতে এখানে এলাম। একি শাহাজাদী, আপনি কাঁদছেন?

—কোয়েল সব নষ্ট করে ফেলেছি।

—কী নষ্ট করলেন?

—এই দেখ কোয়েল।

—প্রথম কিতাবটি দেখাই। দ্বিতীয়টি অক্ষতই ছিল।

—এ কী করলেন শাহজাদী। এ যে আপনার অনেকদিনের সঙ্গী। সেই কবে আমি হারেম ছেড়েছিলাম, তারও কত আগে দেখেছি। প্রায় অর্ধেক পাতাই যে ছিঁড়ে ফেলেছেন! ছি ছি! কোথায় ফেললেন? পুড়িয়ে ফেলেননি তো?

আঙুল দিয়ে নীচের দিকে দেখিয়ে দিই। সেখানে ঘাসের উপর যেন এক ঝাঁক বুনো পায়রা উড়ে এসে বসেছে।

—ইস্! আমি এখনি গিয়ে কুড়িয়ে আনছি। কিন্তু শিশিরে যদি সব অস্পষ্ট হয়ে যায়? ঘাসের ওপর যে সারারাতের শিশির জমে রয়েছে শাহজাদী।

—তবু তুমি যাও কোয়েল। দেখো, যদি ওদের বাঁচাতে পারো।

—তার আগে ও দুটি দিন তো। আপনার কাছে আর রাখব না। যখন দরকার হয় চেয়ে নেবেন।

—তাই ভাল, তোমার কাছেই থাক।

কোয়েল নীচে চলে যায়।

কিছু পরে পাতাগুলো কুড়িয়ে এনে সযত্নে জোড়া লাগায়। আমি ভয়ে চাইতে পারি না। হয়তো অনেক পাতা নষ্ট হয়েছে-অনেক লেখা অস্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। কোয়েলকে প্রশ্ন করতেও সাহস হয় না। সেও নিজে থেকে কিছু বলে না। প্রথম কিতাবখানি তার কাছে, দ্বিতীয়টি আমাকে ফিরিয়ে দেয়। কিন্তু তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখে।

.

আওরঙজেব জানে, বিদ্রূপ আর তুচ্ছতা নিয়ে যে ক্ষমার কথ। পিতা উচ্চারণ করেছেন—সে ক্ষমা ক্ষমা নয়। সে জানে উত্তরাধিকার সূত্রে সে ময়ূরাসনের অধিকার পায়নি। পেয়েছে এক ঘোরতম পাপের পথে, এক সর্বনাশা অভিশাপের মধ্যে দিয়ে। নিশ্চিন্ত হতে পারিনি তাই। আমাকে ইতিমধ্যে অনেক পত্র দিয়েছে সে। কিন্তু সব পত্রেই ঘুরে ফিরে এক কথা—পিতার অন্তরের কথা জানতে চায় সে। একটি পত্রেরও জবাব আমি দিইনি। জবাব দিতে ঘৃণা বোধ হয়েছে। জ্ঞানের আলোকের মধ্যে দিয়ে যে ইসলাম ধর্ম বিকশিত হয়ে উঠতে পারত, সেই ইসলাম ধর্মের ওপর সে চাপিয়ে দিয়েছে এক দুরপনেয় কলঙ্ক। অন্তরে অন্তরে সে বুঝতে পেরেছে তার অন্যায়। তাই সে কম্পিত। সে কম্পন তার প্রতিটি বাক্যে—সে কম্পন তার প্রতিটি কার্যে। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এ-কম্পন থেকে তার নিষ্কৃতি নেই।

ইতিমধ্যেই নিজের লোককেও অবিশ্বাস করতে শুরু করেছে সে। তাই এত দিন যে শাস্তি অন্যের জন্যে তোলা ছিল, সে শাস্তি নিজের পরিবারের ওপরই বর্ষিত হতে শুরু হয়েছে। মহম্মদ সম্প্রতি কারারুদ্ধ হয়েছে।

প্রাসাদের শিখরে দাঁড়িয়ে আর্তস্বরে চিৎকার করে উঠি-আওরঙজেব, তোমাকে আমি ক্ষমা করব। তোমার সব অন্যায় আমি ভুলে যাব ভাই। শুধু একটি শর্ত। এই সর্বনাশা পথ থেকে ফিরে এসো।

—শাহজাদী।

—কোয়েল? তুমি কি ছায়ার মতো সব সময়ই আমার কাছে থাকো কোয়েল?

—আর যে জায়গা নেই আমার।

—কোয়েল আমি কিন্তু পাগল হইনি। এই নির্জনে চেঁচিয়ে উঠেছিলাম বটে। কিন্তু আমার মাথা ঠিক রয়েছে।

—আমি জানি শাহজাদী। আমিও যে অমন কথা বলি একলা একলা।

—কোয়েল! এই দেশের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে কখনো ভেবেছ কি?

—অতখানি বড় জিনিস ভাববার শক্তি কোথায় আমার শাহজাদী। নিজের ক্ষুদ্র স্বার্থ নিয়েই যে ব্যস্ত থাকি।

—তুমি একথা বললে আমি বিশ্বাস করব না। দেশ সম্বন্ধে কি কোনও দুর্ভাবনাই হয় না তোমার?

—স্পষ্ট করেই তবে বলি শাহজাদী, কোনও দুর্ভাবনাই হয় না।

—সম্ভব বটে। তুমি হিন্দু। মুসলমান ধর্মের ভেতরে গ্লানি ঢুকলে তোমার মন কেনইবা কাতর হবে।

—কিন্তু আপনি তো ধর্ম সম্বন্ধে প্রশ্ন করেননি! আপনি প্রশ্ন করেছিলেন দেশ সম্বন্ধে।

—ধর্ম আর দেশ যে এখানে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। আওরঙজেবের ধর্মবোধ দেশের হিন্দু প্রজাদের শান্তি নষ্ট করবে। তার ফল কতখানি মারাত্মক তা কী জান না।

—আমি তাও ভেবে দেখেছি শাহজাদী। কিন্তু নিজে থেকেই এক অদ্ভুত সমাধান খুঁজে নিয়েছি। সে সমাধান কারও মনঃপূত না হলেও আমি তাতে তুষ্ট।

—কী সে সমাধান?

—শাহজাদী! অনন্তকালের পটভূমিকায় ফেলে বিচার করলে আওরঙজেব বলুন আর মুঘলবংশ বলুন সবই তো তুচ্ছ। এই জগৎ এক অসাধারণ গতি নিয়ে কোনও নির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে যেন ছুটে চলেছে। সেই লক্ষ্যে পৌঁছলেই তার পরিপূর্ণতা লাভ। এই লক্ষ্যে যাবার জন্যে যে গতি, সেই গতির ফলে সংঘর্ষের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ দেখা দেবেই। আওরঙজেবের মতো এক একজনের উত্থান সেই সংঘর্ষের সৃষ্টি করে। এর ফল হয়তো ভালই। গতির শক্তি বৃদ্ধি হয়।

হতবাক হয়ে কোয়েলের দিকে চেয়ে থাকি নিষ্পলক দৃষ্টিতে। তাকে আমার চেয়ে অনেক উঁচু বলে মনে হয়। ধীরে ধীরে বলি,—তুমি দার্শনিক কোয়েল।

—লজ্জা দেবেন না শাহজাদী। দার্শনিক কাকে বলে আমি জানি না, তবে আমি হিন্দু। সান্ত্বনা লাভের আশায় অসম্ভব কিছু ভেবে নিতে আমাদের বাধে না। সান্ত্বনা পাইও তাতে।

কথা বলতে বলতে নীচে নামতেই একজন খোজা এগিয়ে এসে কুর্নিশ করে। চমকে উঠি তাকে দেখে। বহুদিন আগে রোশনারার কক্ষের সামনে প্রহরী নিযুক্ত থাকত সে। রোশনারাকে একবার তার সঙ্গে শিশমহলে দেখেছিলাম। আর আমি দেখেছিলাম এক স্বপ্ন। খোজার বয়স বেড়েছে, কিন্তু চিনতে বিন্দুমাত্র ভুল হয় না। নামটিও মনে এসে যায়। শোভান।

শোভান বলে,—একজন আমির আপনার সাথে দেখা করতে চান!

—কী নাম?

—তিনি বললেন, আপনি তাঁকে চেনেন। তাই নাম জানালেন না।

রাগ হয়। সেই সঙ্গে একটু কৌতূহলও হয়। যাবার জন্যে পা বাড়িয়েও থেমে যাই। খোজাকে প্রশ্ন করি, তুমি কতদিন এখানে আছো?

—আজ থেকে।

—এর আগে কোথাও ছিলে?

—রোশনারা বেগম আমিন খাঁয়ের সঙ্গে রেখেছিলেন।

মুহূর্তে সব বুঝতে পারি। এককালে খোজাটির প্রতি অনিচ্ছা সত্ত্বেও এক পক্ষপাতিত্ব ছিল। রাজধানী পরিবর্তনের সময়ে তাকে দিল্লিতে নিয়ে যেতে চেয়েছিলাম। রোশনারা বাধা দিয়েছিল। বলেছিল, পুরোনো লজ্জাকে দিল্লিতে বয়ে নিয়ে যাবার দরকার নেই। তার যুক্তি আমি সহজেই মেনে নিয়েছিলাম। তখন ভুলেও ভাবতে পারিনি যে খোজাটি তারই দলের লোক।

আজ একে দেখে আমার ঘৃণা হয়। মুখ ফিরিয়ে নিয়ে তিনটি কক্ষ পার হতেই দেখতে পাই সেই বিরাট সুপরিচিত লোকটিকে। দাঁড়িয়ে পড়ি।

কিন্তু সে এগিয়ে আসে। বিনীতভাবে অভিবাদন করে আমার সামনে দাঁড়ায়। ওড়নার আড়ালে আমার ভ্রূকুঞ্চিত হয়ে ওঠে। আবার কী উদ্দেশ্য নিয়ে আসতে পারে নজরৎ খাঁ? যৌবনে তো এখন আমার ভাটার টান। প্রতিপত্তি নিঃশেষিত।

—খাঁ সাহেবের আগমনের কারণ জানতে পারি কি?

একটু যেন অবাক হয় নজরৎ খাঁ। আমার কণ্ঠস্বরে হয়তো পূর্বের গাম্ভীর্য, সে আশা করেনি। সে বলে,—আপনি কী সত্যিই অনুমান করতে পারেননি?

—না।

—আজ আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন আমার ক্ষমতা।

—হ্যাঁ।

—আপনি বুঝতে পেরেছেন শুধু বাগাড়ম্বর ছাড়া ছত্রশালের আর কিছুই ছিল না। যুদ্ধে নেমে তাই বেশিক্ষণ দাঁড়াতে পারল না। অত যারা সংগীত নিয়ে মাথা ঘামায় তারা যুদ্ধ করতে পারে না।

—খাঁ সাহেব কী মৃতকে উপদেশ দিচ্ছেন?

—না। আপনাকে বলছি। কারণ আপনি সরল বিশ্বাসে এক অপদার্থের ওপর আপনার স্বর্গীয় প্রেম ঢেলে দিয়েছিলেন।

ইচ্ছে হচ্ছিল সেই মুহূর্তে শয়তানকে ঘর থেকে বের করে দিই। কিন্তু তা করলাম না। এ জীবনে আর কিছু শিক্ষা হোক আর না হোক ধৈর্য আর সহিষ্ণুতার শিক্ষা হয়েছে। বলি, –বাঃ, আপনিও দেখছি শিল্পী হয়ে উঠেছেন। চমৎকার কথা বলছেন।

—জাহানারা, আর বিদ্রূপ করো না। প্রৌঢ়ত্ব ধীরে ধীরে আমাকে গ্রাস করছে। তবু তোমাকে ভুলতে পারিনি। কবরে গিয়েও ভুলতে পারব না। জাহানারা, আজ আমি জানি তুমি বন্দি। কোনও ক্ষমতাই তোমার নেই। তবু ছুটে এসেছি। অনেক ক্ষমতার অধিকারী হয়েও তোমাকে নিতে এসেছি।

হেসে উঠি আমি। সশব্দে হেসে উঠি। নজরৎ খাঁ হাঁ করে চেয়ে থাকে।

—এই যে ওড়না দেখছেন খাঁ সাহেব, যা দিয়ে মুখ ঢেকে রেখেছি, এটি ছত্রশাল উপহার দিয়েছিল। আমার মসলিন ভেদ করে যে অপূর্ব কাঁচুলি উঁকি দিচ্ছে, এটিও ছত্রশালের দয়ার দান। আর আমার দেহ? তার কথা নাইবা শুনলেন খাঁ সাহেব?

—তুমি এখনো—

—হ্যাঁ। এখনো। সেই কবরে যাবার যে কথা বললেন আপনি, ওটি আপনার বেলায় মন ভোলাবার কৌশলমাত্র। আমার বেলায় খাঁটি সত্যি। আপনি বহুদিনের এক পুরোনো প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য জিদের বশে এখানে এসেছেন আজ। ভুল করেছেন।

—আমার কথায় আপনি রাজি নন?

—এতক্ষণ কথা বলতে পেরেছেন, এই তো আপনার সৌভাগ্য। এবারে চলে যান। দেরি

করলে বের করে দেওয়া হবে।

অট্টহাসি হেসে ওঠে নজরৎ খাঁ। মুখে পৈশাচিক কুটিলতা আর প্রতিহিংসার ঘৃণ্য ছাপ। সে বলে,—আপনি সামান্য একজন বন্দি। আপনার মুখে এসব কথা ধৃষ্টতা মাত্র। আপনি জানেন না—এখানকার প্রহরীরা আমারই অঙ্গুলি হেলনে পরিচালিত হয়।

—আর তাদের মধ্যে অনেকেই বেশ ভালভাবেই জানে, এখনো যদি আমি আওরঙজেবকে বলি, দুশমন নজরৎ খাঁয়ের ফাঁসি দাও, সেই মুহূর্তে তোমার গলায় সেই অতি-পিচ্ছিল দড়ি পরিয়ে দেবার হুকুম দেবে সে। আর একটা কথা শুনে রাখবে নজরৎ, আমি আওরঙজেবের বন্দি নই। বিশ্বাস না হয়, তাকেই জিজ্ঞাসা করবে? যাও এখন, দূর হয়ে যাও শয়তান।

মুখ লাল করে দরজার দিকে এগিয়ে যায় নজরৎ। ঠিক সেই মুহূর্তে এক অদৃশ্য স্থান থেকে কোয়েল খিলখিল করে হেসে ওঠে। নজরৎ ছুটতে শুরু করে।

দিন যায়।

মাস যায়।

বছর যায়।

কত বছর কেটে গেল, খেয়াল থাকে না। শুধু একদিন নজরে পড়ে আমার সামনে একগোছা সাদা চুল। যৌবন গেল। যাবেই তো। যৌবনকে কী ধরে রাখা যায়? এতদিন ভাবতাম, যৌবন বিদায় নিলে পাগল হব। এখন দেখছি সে চলে যাওয়ায় নিশ্চিন্ত হলাম। রোশনারার মাথায়ও এমন দু-এক গুচ্ছ শুভ্রকেশ নিশ্চয়ই মিলবে। দিল্লিতে আছে সে। সুখেই আছে হয়তো! সুখে থাক। সবাই সুখে থাক। পৃথিবী যেন স্থায়ী সুখের আলয় হয়ে ওঠে।

ওই তাজমহল। ওর মাথার ওপরে একখণ্ড গাঢ় মেঘ। তারই ছায়া পড়েছে সৌধের গায়ে। এই মেঘটুকু ঝরেও পড়তে পারে ওখানে। তপ্ত প্রস্তর শীতল হবে। তাজমহল শুধু স্মৃতি—আর কিছু নয়। ওই কক্ষে জরাজীর্ণ অবস্থায় যিনি রক্তমাংসের দেহখানা এখনো বজায় রেখেছেন, তিনিও স্মৃতি। ওঁর ভেতর যেটুকু প্রাণের স্পন্দন রয়েছে, কান পেতে শুনলে তাজমহলেরও সেটুকু স্পন্দন ধরা পড়বে।

যা ছিল তার কিছুই নেই। আমি নিজেও কী নিজের স্মৃতি নই? কোথায় সেই বাদশাহ্-বেগম, যার প্রতাপে এককালে দিল্লির হারেম কাঁপত। নেই। সে নেই। হারিয়ে গিয়েছে। শুধু পাথরের সৌধে পরিণত হতে বাকি আছে তার আর শাহজাহানের। শাহজাহানের সাধের রক্তবর্ণের সমাধি আর শেষ হয়ে ওঠেনি তাজমহলের অপর পারে। কোথায় তাঁর স্থান হবে জানি না। সবই নির্ভর করছে নবীন গৌরবর্ণ বাদশাহ ‘আলমগীরের’ ইচ্ছার ওপর।

কিন্তু আমি চাই না আমার দেহের ওপর পর্বতপ্রমাণ পাষাণসৌধ। আমি চাই সবুজ ঘাস আমার এই বহু প্রতীক্ষার সার্থক দেহখানিকে ঢেকে রাখুক। প্রস্তরের তাপ আমার এ-দেহ সহ্য করতে পারবে না—যত অর্থই ব্যয় হোক তাতে। ছত্রশালের দেহখানা কোথায় হারিয়ে গিয়েছে জানি না। শুধু এটুকু জানি, তার দেহাবশেষ তৃণগুল্মের সঙ্গেই জড়াজড়ি করে মাটিতে মিশে গিয়েছে। আমার বেলাতেও তাই চাই। যদি ক্ষমতা থাকত, সামুগড় প্রান্তরের কোনও এক স্থানে আমাকে ফেলে রেখে আসার নির্দেশ দিতাম। কিন্তু তা সম্ভব নয়। আমি বাদশাহ্-বেগম নই—আমি তার স্মৃতি।

বাইরে ছায়া পড়ে। কোয়েল এসেছে। সে ছাড়া আর কেউ নেই। সবাই চলে গিয়েছে। আমার ভবিষ্যৎ নষ্ট হয়েছে বলে তাদের তো হয়নি। তারা সুপারিশ করে আগ্রা থেকে দিল্লিতে বদলি হয়েছে। পরিবর্তে এসেছে কয়েকজন বৃদ্ধা, অক্ষম নাজীর। কোনও কাজ তাদের দিয়ে করানো সম্ভব নয়।

—শাহজাদী। বাদশাহের দাওয়াই খাবার সময় হয়েছে।

—ও। চল কোয়েল। আচ্ছা কোয়েল, একটা কাজ করতে পারবে?

—বলুন।

—আমি যখন থাকব না তখন আওরঙজেবের হাতে এক টুকরো লেখা দিতে পারবে?

—কার লেখা?

—আমার। আমি লিখে দেব। আমার সমাধিতে সেটুকু যদি ও উৎকীর্ণ করার অনুমতি দেয়-

—কিন্তু আপনিই কি আগে যাবেন?

—তা বটে। তুমিও তো আগে যেতে পারো। তোমার কথা আমার মনে হয়নি কোয়েল।

—তা হোক। আপনি আমাকে দেবেন। আমি ব্যবস্থা করব।

—আচ্ছা কোয়েল, তোমার শিল্পীকে তো দাহ করা হয়েছিল।

—হ্যাঁ শাহজাদী।

—তারপর তুমি কী করলে?

—দেহাবশেষ নদীতে বিসর্জন দেওয়া হয়েছিল। আমি হাতে করে নিয়ে এসেছিলাম কিছু।

—কী করলে সেটুকু?

—বাড়ির আঙিনায় মাটির নীচে শিল্পীরই গড়া একটি পাত্র করে রেখেছি। ওপরে লাগিয়েছি একটি শিউলি গাছ।

—সুন্দর। আমারও অমন হলে বেশ হত কোয়েল।

—শাহজাদী!

—শিল্পীও আমার মূর্তি গড়ে গেলে বেশ হত, তাই না?

—হ্যাঁ শাহজাদী! তারও কোনও ক্ষোভ থাকত না।

—আমি তার সঙ্গে ঠিক দেখা করতাম কোয়েল। তখনও ছত্রশালকে দেখিনি। শিল্পী আমার জীবনের প্রথম পুরুষ। তবু তোমার কথা শুনে বিদায়ের সময়ও দেখা করতে পারিনি। তুমি বলেছিলে, চাঁদ কি মাটিতে নেমে আসতে পারে? পারে কোয়েল, নিশ্চয়ই পারে। তুমি বিশ্বাস করো, পারে।

—আমি এখন বিশ্বাস করি শাহজাদী। তখন আমার বয়স কম ছিল। অনেক কিছুই বুঝতাম না।

—কোয়েল!

—বলুন শাহজাদী!

—তোমার মুখে বয়সের রেখা পড়েছে। আমারও পড়েছে, তাই না?

—না শাহজাদী। কোনও রেখা পড়েনি। তবে বয়স হয়েছে বোঝা যায়।

—এখন ছত্রশাল যদি হঠাৎ এসে দেখত, মুখ ফিরিয়ে নিত?

—তা কি হয় শাহজাদী? আপনি যে তাঁর আপন। তাঁর আত্মার সঙ্গে আপনার আত্মার সম্পর্ক। –আমি তা জানি কোয়েল, আমি তা জানি। তবু একথা তোমার মুখে শুনতে সাধ হল। শুনতে বড় ভাল লাগে।

ধীরে ধীরে উঠে গিয়ে পিতার কক্ষে প্রবেশ করি। শয্যার ওপর ভূতপূর্ব শাহানশাহ্ শাহজাহানের স্মৃতি। নীরব। নিস্পন্দ। দাওয়াই নিয়ে তাঁর মুখের ওপর ঝুঁকে ডাকি,—বাবা।

কয়েকবার ডাকার পরে তাঁর চেতনা হয়। যেন কতদূর থেকে আস্তে আস্তে বলেন—কে? মমতাজ?

—আমি। জাহানারা

—জাহানারা।

—বাবা!

অর্ধচেতন অবস্থায় হাত উলটে তিনি বলেন,—নেই।

—কী নেই বাবা?

দুর্বল কণ্ঠেও আনন্দের রেশ ধ্বনিত হয়। বলেন—আপেল।

—কোন আপেল বাবা?

—সেই? কে যেন দিয়েছিল।

আজকাল এমন সব কথা তিনি বলেন। তাই মৃদু গলায় বলি,—আমি এনে দেব বাবা।

—না। আর আসবে না। বাঁচলাম। মমতাজ বড় কাঁদছিল।

হঠাৎ খেয়াল হয়, পিতার হাতের আপেলের সুঘ্রাণ নেওয়া হয়নি বহুদিন। হাতখানা নাকের সামনে নিতেই বুক কেঁপে ওঠে। যেন মৃত্যুর গন্ধ ভেসে উঠেছে হাতে। আমার হাত থেকে তাঁর হাতখানা খসে পড়ে।

এবারে তিনি ঝাপসা দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে বলেন,—নেই। আমি জানতাম। মমতাজ কাঁদতে কাঁদতে বলে গেল,—নেই।

—তোমার আনন্দ হচ্ছে বাবা?

—হ্যাঁরে, তোর হচ্ছে না?

—তোমার কথা ভেবে আনন্দই হচ্ছে। কিন্তু আমি কী করব?

পিতার রোগপাণ্ডুর মুখেও যেন বিষাদের ছায়া নেমে আসে। একটু পরে অতি কষ্টে বলেন, —ছত্রশালের কথা এখনো ভাবিস জাহানারা?

—হ্যাঁ বাবা। সব সময়।

—তাই ভাবিস। শান্তি পাবি। আর প্রার্থনা করিস আল্লার কাছে।

একটু ছটফট করেন তিনি। দাওয়াই খাইয়ে দিই। তারপর বলি,—তুমি কথা বোলো না বাবা।

—শোন জাহানারা। আয়, কাছে আয়। একেবারে মুখের সামনে কান নিয়ে আয়। -বলো বাবা!

—তোকে অনেক-অনেক আগে কিতাব দিয়েছিলাম। মনে আছে?

—হ্যাঁ বাবা!

—লিখতিস?

—হ্যাঁ লিখতাম।

—আমার মাঝে মাঝে বড় ইচ্ছে হত শুনতে। কিন্তু তুই নিজের কত কথা লিখেছিস ভেবে কিছু বলতাম না।

—সে কিতাব এখনো আছে বাবা। এখনো লিখি। রোশনারার খানাও তো আমি নিয়েছিলাম। আর মাত্র তিন-চার পাতা বাকি।

পিতার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। বলেন,–তোকে আমার চিনতে ভুল হয়েছিল, জাহানারা। তুই তো ঠিক আমার মেয়ে নস, তুই মমতাজের মেয়ে। তোকে চিনতে পারিনি।

—ওসব কথা থাক বাবা।

—কী লিখেছিস, জাহানারা?

—সব। যা দেখেছি—যা ভেবেছি, সব। তবে একটা ঘটনা কিতাব থেকে বাদ দিতে হবে বাবা। আজই বাদ দিয়ে দেব।

—কোন ঘটনা?

—খলিলুল্লা খাঁয়ের বেগমের সঙ্গে তোমাকে নহরী-বেহেস্ত-এ দেখেছিলাম।

—না, না। বাদ দিস না। খুব ভাল করেছিস লিখে। দোষগুণ মিলিয়েই তা মানুষ। কত দোষ থাকে মানুষের মধ্যে। তবু কোনও কোনও মানুষের এমন একটা গুণ বড় হয়ে ওঠে, যার ফলে তার অন্য দোষ ঢাকা পড়ে যায়।

—তুমি আর কথা বোলো না বাবা। তোমার শ্বাস নিতে খুব কষ্ট হচ্ছে।

—আর একটু। কতদিন আমরা এখানে আছি জাহানারা?

—কোয়েল বলে, সাত বছর হতে চলল।

—সাত বছর! অনেকদিন। তুই বরং গোপনে আওরঙজেবকে একটা চিঠি লিখে দে। শত হলেও মুখল-বংশের ধারা তারই মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হবে। লিখে দে—আমি দেখা করতে চাই। আর, আর সে এলে মণিমাণিক্যগুলো দিয়ে দিস। বেচারার ঘুম হচ্ছে না।

—দেব বাবা। তুমি চুপ করো।

পিতা মুখখানা বিকৃত করে চুপ করেন। আমি চলে যাই ঘর ছেড়ে। আমি থাকলে ঝোঁকের মাথায় বড় বেশি কথা বলেন।

.

আওরঙজেব এসে পৌঁছবার আগেই সব শেষ হয়ে যায়।

পত্রখানা ঠিক সময়েই লিখেছিলাম। তবু আওরঙজেব শেষ সময়ে শয্যাপার্শ্বে উপস্থিত হতে পারেনি। নবীন বাদশাহের সঙ্গে ভূতপূর্ব বাদশাহের শেষ সাক্ষাৎ হল না। পিতার অন্তিম ইচ্ছা অপূর্ণই থেকে গেল।

শবযাত্রার ব্যবস্থা করব কি না ভাবি। কোথায় সমাধিস্থ করা হবে, তাও ভাবি। এমন সময়ে এক অশ্বারোহী খবর আনে আওরঙজেব আসছে।

অপেক্ষা করি তার জন্যে শবদেহের পাশে। বহুমূল্য আতরে সিঞ্চিত করি তাঁর শয্যা। আর পিতার মণিমাণিক্যের পেটিকা থেকে তাঁর অতিপ্রিয় কতগুলি মণি একটি সুবর্ণনির্মিত কৌটায় করে তাঁর পাশে রাখি।

আওরঙজেব এসে উপস্থিত হয়! অন্তিম শয়ানে শায়িত শাহানশাহ্ শাহজাহান। বাদশাহ আলমগীর তাঁর সামনে কিছুক্ষণ অবনত মস্তকে দাঁড়িয়ে থাকে। মুহূর্তের জন্যে হয়তো তার মধ্যে এক ভাবাবেগের সৃষ্টি হয়েছে। তার চোখের সামনে দিয়ে হয়তো অতি দ্রুত ভেসে চলেছে অতীতের অনেক স্মৃতি।

কক্ষে আর কেউ নেই। সবাই অপেক্ষা করছে বাইরে।

আমি কর্তব্যমুক্ত। পৃথিবীতে আমার আর কিছুই করার নেই। আগেও কখনো কিছু করতে পারিনি। তবু শাহানশাহ্ শাহজাহানের পাশে পাশে থেকে তাঁকে যদি সামান্য সাহায্যও করতে পেরে থাকি, যদি তাঁকে সামান্য শান্তিও দিতে পেরে থাকি সেইটুকুই যথেষ্ট। আল্লা হয়তো তার চেয়ে বেশি কিছু করার জন্যে আমাকে পাঠাননি।

আওরঙজেব হঠাৎ নিজেকে ছিনিয়ে নেয় পিতার কাছ থেকে। সে আমার সামনে এসে দাঁড়ায়।

—জাহানারা।

আমি মুখ তুলি।

—বাবার কাছে যে অমূল্য রত্নরাজি ছিল সেগুলো নিশ্চয়ই তুমি নিয়েছ?

—হ্যাঁ।

—কিন্তু জানো, সেগুলোর ওপর তোমার অধিকার বিন্দুমাত্রও নেই।

আমার ওষ্ঠ কেঁপে ওঠে ওর কথায়। অতিকষ্টে অশ্রু সংবরণ করে বলি,—আমি তো নিইনি আওরঙজেব, আমি রেখেছি। বাবা তোমাকে দেবার জন্যে আমার কাছে গচ্ছিত রেখে গিয়েছেন। তুমি তো মৃত্যুর আগে পৌঁছতে পারোনি!

—কোথায় সেগুলো?

—এখনি চাও আওরঙজেব?

—হ্যাঁ।

আমি ধীরে ধীরে কক্ষের এক গুপ্তস্থান থেকে পেটিকাটি এনে আওরঙজেবের সামনে রাখি। আমার পা কাঁপছিল, আমার হাত কাঁপছিল। আমি নিজেকে সামলাতে পারছিলাম না ওর মনের দৈন্য দেখে। তবু শক্তভাবে দাঁড়িয়ে থাকি।

চেয়ে দেখি মৃত পিতার শবদেহের পাশে তাঁরই একমাত্র জীবিত পুত্র কীরকম আকুল হয়ে পেটিকা হাতড়াতে থাকে।

—কয়টি জিনিস পাচ্ছি না জাহানারা। বাবার প্রিয় জিনিসগুলোই নেই। তুমি আমার সঙ্গে তামাশা করছ?

শবদেহের পাশে দেখিয়ে বলি,–দেখতো ওগুলো কী না?

ওগুলো শাহানশাহ্ শাহজাহানের প্রিয় ছিল। তাই তাঁর সঙ্গেই দিয়েছিলাম।

আওরঙজেব তাড়াতাড়ি সুবর্ণনির্মিত কৌটাটি তুলে নিয়ে খুলে ফেলে। ভেতর থেকে নানান বর্ণের জ্যোতি বার হয়। সে আমার দিকে যেন অবাক হয়ে চায়। কেন অবাক হল বুঝি না।

অনেক পরে কম্পিত স্বরে বলে,—এগুলো তুমি ওঁর সঙ্গে পাঠাচ্ছিলে জাহানারা?

—হ্যাঁ আওরঙজেব। আমার ভুল হয়েছিল। উনি তো মৃত।

—তোমার নিজের কোনও লোভ নেই?

—সে কি আওরঙজেব। আমার লোভ থাকবে কেন?

—এগুলো যে অমুল্য।

—ও, অমূল্য। ভালই হল তুমি এসে। নইলে মাটির নীচে নষ্ট হত।

আওরঙজেব তার দুটো হাত আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে আবার পেছনে টেনে নেয়। কী যেন ভাবে সে।

কিছুক্ষণ পরে বলে,—তুমি আমাকে সোজাসুজি কখনো তিরস্কার করোনি জাহানারা। হয়তো তিরস্কারই করোনি। যা শুনেছি সবই রোশনারার বানানো কথা। তবু আর একটি কাজ আমি করব, যার জন্যে তোমার কাছে ক্ষমা চেয়ে রাখছি। জাহানারা, তোমার কাছে আমার চরিত্রের কিছুই লুকনো থাকতে পারে না জানি। তোমার বুদ্ধি ক্ষুরধার। তুমি জানো বাদশাহীতে আমার প্রলোভন, ধর্মের ওপর প্রলোভনের চেয়ে অনেকগুণ বেশি। আমার বাদশাহী বিপন্ন হোক আমি তা চাই না। তাই পিতার শবদেহ পেছনের প্রাচীর ভেঙে নিঃশব্দে নিয়ে যাওয়া হবে। কারণ তাঁর মৃতদেহ সবাই দেখলে আমার বিরুদ্ধে ভয়াবহ বিদ্রোহ ঘটতে পারে। তার পরিণামে অনেক কিছুই হতে পারে।

আমি চুপ করে থাকি।

—কথা বলো জাহানারা।

—তোমার যা অভিরুচি।

—আমি মমতাজ বেগমের পাশেই তাঁর সমাধির ব্যবস্থা করেছি!

আমার চোখ দুটি সজল হয়ে ওঠে। ধীরে ধীরে বলি,– তোমার কাছে আমি কৃতজ্ঞ আওরঙজেব।

.

মমতাজ বেগম এতদিন ছটফট করে এখন সুখে নিদ্রা যাচ্ছেন। বহুদিন পরে প্রিয়তমকে পেয়ে তিনি নিশ্চিন্ত। আর কিছুই তিনি চান না। অনেক কিছু তিনি চেয়েছিলেন—কিন্তু না পাওয়ার বেদনা বার বার তাকে আঘাত করেছে। তাই সব চাইতে যা কাম্য সেটুকু পেয়েই তিনি ঘুমিয়ে পড়েছেন। একটু দূরেই, দুর্ভাগ্যের রিক্ত ললাট নিয়ে যে পুত্র তাদের জন্মগ্রহণ করেছিল, তার মস্তক প্রোথিত রয়েছে। তিনি সে কথাও ভুলেছেন। যাকে নিয়ে জীবন শুরু, তাকে নিয়েই শেষ! মাঝখানের সবকিছু মায়া—প্রপঞ্চ। সূর্যের আলো পড়ে তাজমহল তাই হাসছে। তাজমহল আর কাঁদবে না কখনো

হতভাগী জাহানারার কথাও কি মমতাজের মনে নেই? পিতা বলেছিলেন আমি তো তাঁরই মেয়ে। আমি মমতাজ-দুহিতা জাহানারা।

না, মনে নেই। শুধু মমতাজের কেন, সেদিন অবধি যাঁকে আগলে রেখেছি সেই বাদশাহেরও মনে নেই। কিন্তু

হ্যাঁ, তার ঠিক মনে আছে। সে আমার জন্যে অপেক্ষা করছে। তার দেহের পাশে আমার দেহের স্থান হবে না জানি। কিন্তু সেই শেষ বিচারের দিনে আমার পাশে এসে সে দাঁড়াবেই। সে আমার—সে শুধু আমার।

প্রাসাদের বাইরে কলরব। দিল্লি যাবার আয়োজন চলছে। আওরঙজেব আমার জন্য বাইরে অপেক্ষা করছে। আমাকে আবার দিল্লিতে নিয়ে যাবে সে। সব কিছু প্রস্তুত।

বদ্ধ কক্ষে শুধু আমি আর কোয়েল। আমি আমার দ্বিতীয় কিতাবের শেষ পৃষ্ঠায় দ্রুত লেখনী চালিয়ে যাচ্ছি। আজই শেষ।

জেসমিন প্রাসাদের এই প্রকোষ্ঠে আলোর চেয়ে অন্ধকার বেশি। তবু তারই মধ্যে আমি লিখে চলেছি।

কোয়েল পাশে এসে দাঁড়ায়।

—দাঁড়াও কোয়েল। আর একটু বাকি।

—আপনার সেই লেখাটি বাদশাহ আলমগীরের হাতে দিয়েছি।

—কোন লেখাটি?

—যেটি আপনার সমাধিতে উৎকীর্ণ করতে বলেছেন। আমি পড়েছি। বহুদিন পরে যারা আপনার সমাধির পাশে এসে দাঁড়াবে তারা যে চোখের জল না ফেলে পারবে না। অত করুণ ভাবে কি লিখতে হয় শাহজাদী?

কোয়েল কেঁদে ফেলে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে। আমি নিশ্চেষ্ট হয়ে বসে তার কান্না দেখি। কাউকে তো কাঁদাতে চাইনি আমি।

কোয়েল নিজেকে সামলে নিয়ে আপন মনে লেখাটি বলে চলে :

‘তৃণগুচ্ছ ছাড়া আর কোনও আস্তরণ করো না আমার সমাধির ওপর। অবনমিতার সমাধিটুকু ঢেকে রাখুক শুধু তৃণ।’

কোয়েল আবার চোখের জল ফেলে। কেন সে কাঁদে আমি বুঝি না। যে তৃণ আমার রাজাকে ঢেকে রেখেছে, সেই তৃণই যে আমার পরম কাম্য।

—শাহজাদী! বাদশাহ্ আলমগীর সেটি পড়ে অবাক্ হয়ে আমার দিকে চাইলেন। তারপরে সযত্নে রেখে দিলেন।

—ও! তোমার কাছে আমি কৃতজ্ঞতা জানাব না কোয়েল। তাতে তুমি খুব ছোট হয়ে যাবে। আমি শাহজাদী বটে, কিন্তু নারী হিসেবে আমি তোমার চেয়ে অনেক নীচে। আশীর্বাদ করো যেন শেষদিন পর্যন্ত আমি রাজার কথা ভাবতে পারি। তার কথা ভাবতে ভাবতেই যেন আমার আয়ু ফুরিয়ে যায়।

—শাহজাদী, আপনি হিন্দু হলে বলতাম, পরজন্মে তিনি আপনারই অপেক্ষায় রয়েছেন। আমার চোখে আনন্দের বান আসে। লিখতে পারছি না। তবু লিখতে হবে। প্রতিটি কথা লিখতে হবে। এই কয়টি কথাই শেষ কথা।

—কোয়েল। তুমি বাংলায় ফিরে যাচ্ছ। শিউলি গাছের গোড়ায় জল ঢেলে তোমার দিন কাটবে। শেষে একদিন তুমিও ওখানকার নদীর জলে গিয়ে মিশবে। তুমি কত সুখী। তোমাকে আমার হিংসে হচ্ছে কোয়েল।

কোয়েল চোখের জল মুছে কিতাব দুখানার জন্য হাত বাড়িয়ে বলে,—দিন শাহজাদী।

তাকে বলেছি, গোপনে জেসমিন প্রাসাদের এক শিলাতলে কিতাব দুখানা লুকিয়ে রাখবে সে। এমনভাবে লুকিয়ে রাখবে যাতে বাদশাহ আলমগীর থাকতে ও দুটির সন্ধান না পায় এই আমার শেষ সম্বল—বাদশাহের কোষাগারের সমস্ত রত্নের চেয়েও এর মূল্য আমার কাছে অনেক বেশি। এতে মা রয়েছেন, ভাইরা রয়েছে—আর রয়েছে রাজা ছত্রশাল। এ জিনিস কী আওরঙজেবের লাল হাতে অর্পণ করতে পারি? সে যে বিষ দেবে একে। না, না—

বাইরে দরওয়াজায় ধাক্কা শুনি। সঙ্গে সঙ্গে আওরঙজেবের কণ্ঠস্বর। ডাকছে সে আমাকে। বুক কেঁপে ওঠে। আর লেখাও যাচ্ছে না। ঘর অন্ধকার। কোয়েলের মুখ অস্পষ্ট। সূর্য অস্তমিত। এবার আগ্রা ছেড়ে যাবার সময় কেউ আর বাধা দেবে না। মা-বাবা কেউ না। নূরজাহান? দারা? নাদিরা? কেউ না। সুলেমান—সিপার? তারাও নয়। কেউ নেই। একা আমি।

তবে আমি চলি।

—নাও কোয়েল। চুপ করে লুকিয়ে ওই গোপন পথ দিয়ে চলে যাও। কেউ যেন দেখতে না পায়। যাও। ওরা এখুনি দরওয়াজা ভেঙে ফেলবে। যাও কোয়েল। আমার সর্বস্ব তোমায় দিলাম। ওভাবে দাঁড়িয়ে চোখের জল ফেলো না আর। চুপি চুপি ওই পথে চলে যাও। কেউ চেনে না ও পথ। আওরঙজেবও নয়।

***

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *