মমতাজ-দুহিতা জাহানারা – ১

মনে পড়ে সেই বিশেষ দিনটির কথা। তুর্কি বেগমের শ্বেত হর্মের ছায়া পড়েছিল প্রাসাদের সামনের স্বচ্ছ সরোবরে। জুম্মা মসজিদের বুলন্দ দরওয়াজার মাথা সূর্যের শেষ আলোয় রাঙা হয়ে উঠেছিল। প্রাসাদের ক্ষুদ্র গুলিস্থানে খেলা করছিলাম আমি আর আমার ছোট বোন রোশনারা।

কতই বা বয়স হবে তখন? যৌবন তখন ঠিক এক কদম দূরে দাঁড়িয়ে রুদ্ধশ্বাসে প্রতীক্ষা করছে। বসন্তের হাওয়া, ফুলের গন্ধ আর পাখির গান নাম-না জানা এক স্বপ্নপুরীর ইঙ্গিত শুরু করেছে মাত্র। স্পষ্ট ধারণা করতে পারি না কিছুই। মন চঞ্চল তাই। রোশনারা আমার চেয়েও চঞ্চল। কথায় কথায় তার মুখের ত্বকের নীচে সারা শরীরে রক্ত এসে নৃত্য করে। সে এক ব্যথাভরা পুলকে ঘাসের গালিচার ওপর শুয়ে গড়াগড়ি দেয়। তাকে দেখে আমারও শরীরে কেমন যেন একটা শিহরন জাগে—বুঝতে পারি না। রোশনারার মতো আমারও গড়িয়ে পড়তে ইচ্ছে হয়। কিংবা গুল-আবাস বৃক্ষের কাণ্ডের ওপর নিজের দেহটিকে এলিয়ে দিতে বাসনা জাগে। কিন্তু পারি না। মনে হয়, এইভাবে আনন্দ প্রকাশের মধ্যে কোথাও যেন এক রুচি-বিকৃতি লুকিয়ে রয়েছে।

খেলতে খেলতে একসময় রোশনারা ছুটে আসে আমার পাশটিতে। সরোবরের অপর পারের দিকে আঙুল উঁচিয়ে দেখায়। চেয়ে দেখি এক রাজপুরুষ ধীর পদক্ষেপে হেঁটে চলেছেন অনির্দিষ্টভাবে। বোধ হয় বায়ু সেবন করছেন।

রোশনারার চোখের তারা দুটি উজ্জ্বল। কানের কাছে মুখ এনে উত্তপ্ত নিশ্বাস ফেলে মৃদুস্বরে বলল,—কী সুন্দর। তাই না?

কেন যেন আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। তাড়াতাড়ি বলে উঠি,—জানি না। যা।

—ইস্। রোশনারা আমার চিবুক ধরে নাড়া দিয়ে হরিণীর মতো লাফাতে লাফাতে গুলমিন্দা গাছের পাশে বসে পড়ে। ফুলের গায়ে গাল ঠেকায়।

ঠিক সেই সময়ে সেখানে প্রবেশ করেন আমাদের পিতা—শাহানশাহ্ শাহজাহান। মুখে তাঁর স্মিত হাসি। হাতে তার দুখানি সুদৃশ্য মোটা কিতাব।

আমরা সোজা হয়ে বসি।

তিনি দুজনার মুখের দিকে চেয়ে বলেন,—এ দুটি কেন এনেছি জানো? তোমাদের দুজনকে দেব বলে।

কৌতূহল দমন করতে পারি না। বলে উঠি,—কার লেখা বাবা?

—কারও নয়। এমন সুন্দর বাঁধাই, অথচ ভেতরে রয়েছে সাদা পাতা। তোমরা লেখাপড়া শিখেছ। তোমাদের হাতের লেখায় এ দুটি একদিন সুন্দরভাবে ভরে উঠবে।

আনন্দ চেপে রাখতে পারি না। বলে উঠি,—কী লিখব বাবা?

—যা খুশি। তবে আমার মনে হয় আত্মকাহিনী লেখাই সব চাইতে ভাল। তৈমুর বংশের সেদিকে একটা জন্মগত কুশলতা আছে। এখনকার দিনের ঘটনাবলি যেন স্থান পায় তোমাদের লেখায়। শুধু নিজের সুখদুঃখের কাহিনী লিখে কী লাভ?

কিতাব দুখানি আমাদের দুজনার হাতে দিয়ে বাদশাহ্ ধীরে ধীরে গুলিস্থান থেকে বার হয়ে প্রাসাদের দিকে চলে যান। তাঁর শরীরের আতরের খুশবু ফুলের গন্ধকে ছাপিয়ে অনেকক্ষণ ধরে হাওয়ায় ভাসতে থাকে।

কিতাব পেয়ে আমি অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম।

হঠাৎ চমকে উঠি, চেয়ে দেখি রোশনারা রাগে কাঁপছে। তার নাসারন্ধ্র ফুলে ফুলে উঠছে। তার কিতাবটিকে সে ছুড়ে ফেলে দিয়েছে ঘাসের ওপর।

—রোশনারা? তুই ফেলে দিলি?

—আমি সব জানি, সব বুঝি।

—কী বুঝিস তুই। পিতার স্নেহের উপহারকে এভাবে অবহেলা করার ব্যথা বুকে নিয়েও বিস্মিত হয়ে শুধাই।

—চেষ্টা করলে তুমিও বুঝবে।

বিরক্ত হই। বয়স তো হল ওর মাত্র চোদ্দো বছর। এর মধ্যেই যেন একটা বন্যভাব প্রভাব বিস্তার করছে ওর স্বভাবে।

বলি,—হেঁয়ালি ছাড়। কেন এভাবে ছুড়ে ফেললি?

—একটু আগে সরোবরের ওপারে যে রাজপুরুষকে দেখলাম, ওঁকে আগেও দেখেছি। খুব সুন্দর দেখতে। কোথাকার যেন রাজা। ও একদিন দেওয়ান-ই খাসে আসছিল। লুকিয়ে লুকিয়ে চেয়ে দেখছিলাম আমি। হঠাৎ পেছন থেকে হেসে উঠেছিল আওরঙজেব। কাছে এসে কী বলল জানিস?

—কী বলল?

—বলল, সবাইকে এমন দেখে দেখেই স্বাদ মেটাতে হবে শাহজাদী। শাদি আর তোমাদের হবে না।

—তার মানে?

—বাদশাহ্ আকবরের নির্দেশ। মুঘল শাহজাদীরা থাকবে চিরকুমারী।

রোশনারার কাছে নতুন হলেও, নতুন কথা নয়। হারেমের সবাই জানে। আমিও জানি। বিষণ্ন ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে ছিল রোশনারা। সে-ভঙ্গির দিকে দৃষ্টি ফেলে আমার নিজের ভবিষ্যৎও যেন জীবনে প্রথম স্পষ্ট দেখতে পাই। গুলিস্তানের ফুলের গন্ধ তাই ফিকে বলে বোধ হয়। সরোবরের স্বচ্ছ জল ঘোলাটে দেখায়। তুর্কী-বেগমের শুভ্র প্রাসাদ ম্লান।

মনের বিক্ষিপ্ত চিন্তাকে সংযত করে বলি,—তাই বলে কিতাবখানাকে ওভাবে ফেলে দিলি? জ্বলে ওঠে রোশনারা। চেঁচিয়ে বলে,—চালাকি। বাদশাহের চালাকি। নিজেরা সব কিছু করবেন, আর আমরা হারেমে বন্দি হয়ে থেকে নাজীরের (দাসী) মুখ দেখে দেখে জীবন কাটিয়ে দেব, তোফা!

—ছিঃ রোশনারা। ওভাবে বলতে নেই।

—বলব। একশোবার বলব। হাজারবার—। রোশনারা ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে।

ওর পিঠের ওপর হাত রাখি, মনের খেদ ওর অমূলক নয়। সান্ত্বনা দেবার ভাষা নেই, ওর কথা শুনে নিজেও যে সান্ত্বনা খুঁজে পাই না। যে-যৌবন সূর্যাস্তের পূর্বে এক কদম দূরে থমকে দাঁড়িয়েছিল, সূর্যাস্তের সঙ্গে সে আমাদের দেহ-মনকে অধিকার করে বসে। কৈশোরের চাপল্য জীবন থেকে চিরবিদায় নিল।

সবুজ ঘাসের খাঁজে খাঁজে অন্ধকার জমে আরও গাঢ় করে তুলেছে। তারই ওপর রোশনারার কিতাবখানি একদলা কালো রক্তের মতো পড়ে থাকে।

মুঘল-শাহজাদীর আত্মকাহিনী। লিখতে বসলে হয়তো তা ব্যর্থ যৌবনের বিলাপ হয়ে ফুটে উঠবে। তবু লিখব। পিতার ইচ্ছা অপূর্ণ রাখব না। ভবিষ্যতের মানুষ আমার জীবনীতে যৌবনের ক্রন্দন শোনে শুনুক—কিন্তু সেই সঙ্গে আরও কিছু লাভ করে যেন কৃতার্থ হয়।

অদূরে প্রাসাদের অসংখ্য রোশনাই জ্বলে ওঠে। একটু পরেই দেওয়ান-ই-খাসের পাশের বারান্দা দিয়ে নর্তকীদের আনাগোনা শুরু হবে, তাদের ঝুমুরের শব্দে আগ্রার প্রাসাদ উচ্চকিত হবে।

রোশনারাকে ধীরে ধীরে নাড়া দিয়ে বলি,—ওহ্! সন্ধে হল।

—না।

—বাবার ওপর রাগ করিস কেন? নির্দেশটা বাদশাহ্ আকবরের।

—তাই বলে সেটা চালু থাকবে?

—থাকবে কি না কে বলতে পারে! তেমন দিন তো আসেনি।

—আসবে।

হেসে ফেলি,—আগে আসুক!

রোশনারা তবু বসে থাকে মুখ গুঁজে।

—উঠবি না? বড় দেরিতে রাগ করলি কিন্তু। আওরঙজেব তো কবেই কথাটা বলেছিল। এতদিন কিছু মনে হয়নি?

রোশনারা মুখ তোলে। আমার দিকে সোজা দৃষ্টি ফেলে বলে ওঠে,—না। কথাটা শুধু কান দিয়ে শুনেছিলাম। মনের মধ্যে যায়নি। কিন্তু আজ—

—আজ কী?

—ওকে আবার দেখেই বুঝলাম, কী ভীষণ নির্দেশ। আমি পারব না। কিছুতেই পারব না। স্তব্ধ হয়ে যাই।

গুলিস্তানের সবটাই অন্ধকার হয়ে ওঠে। গাছপালা আর চেনা যায় না। আন্দাজে রোশনারার কিতাব তুলে নিয়ে এসে বলি,—এটি তবে আমিই নিলাম।

—নে। বাবার বাধ্য মেয়ে তুই। তোকেই দিলাম। কিন্তু প্রতিজ্ঞা কর, যা লিখবি সব যেন সত্যি হয়। মিথ্যের ছিটেফোঁটাও যেন না থাকে তোর লেখায়।

—বেশ প্রতিজ্ঞা করলাম।

.

গুলিস্তান থেকে প্রাসাদে আসি। রোশনারার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তাড়াতাড়ি মায়ের শয়নকক্ষের দিকে চলতে শুরু করি। মনে যখন জাগে সন্দেহ, সংশয়ের দোলায় যখন দুলতে থাকে মন, তখনই মা যেন তাঁর সমস্ত সত্তা দিয়ে আমাকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করেন। তাঁর কাছে একবার গিয়ে দাঁড়াতে পারলে আমার সব সংশয়, সব অতৃপ্তি তামাকুর সাদা ধোঁয়ার মতো মুহূর্তে অনন্ত আকাশে মিলিয়ে যায়। মা আমার সংযম আর শান্তি, ধৈর্য আর সৌন্দর্যের প্রতিমূর্তি, এতগুলি সন্তানের জননী হয়েও তাঁর রূপের দরিয়ায় কিছুমাত্র ভাটা পড়েনি, শুধু গালের সেই রক্তিমাভা এখন আর তেমন দেখা যায় না। মুখখানি যেন সাদা মোম দিয়ে তৈরি। তাঁর ওই অপূর্ব ছন্দের দেহখানাই মোমের মতো মসৃণ আর শুভ্র।

হাকিম বলেছে রক্তাল্পতা দেখা দিয়েছে মায়ের শরীরে। বাদশাহের সেজন্যে দুশ্চিন্তার অবধি নেই। তাঁর সারাদিনের হাসিমাখা মুখের ওপরেও কীসের যেন ছায়া লেগে থাকে। তাঁর আদেশে নাজীররা আঙুরের নির্যাস নিয়ে হাজারবার ছোটাছুটি করে। খাওয়ার জন্যে সাধে মাকে। মা হাসেন। পিতার ব্যস্ততা বসে বসে উপভোগ করেন তিনি।

মায়ের প্রতি বাদশাহের এই অনুরাগ প্রথম দর্শনের পর থেকেই, সে গল্প শুনেছি হারেমের বৃদ্ধা নাজীর শাহজাদীদের মুখে। পিতামহ জাহাঙ্গীর তখন মসনদে। নওরোজ উপলক্ষে সে সময়ে দেশের সেরা সুন্দরীদের বাজার বসত প্রাসাদের আঙিনায়। সেই রকম এক বাজারে একটি ছোট্ট বিপণি খুলে বসেছিলেন এক অমাত্যের ঘরনি নাম তাঁর আরজমন্দ বানু। অন্যান্য শাহজাদাদের সঙ্গে আমার পিতাও সেই বাজারে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। জিনিস কেনাকাটা গৌণ মুখ্য হল রূপসীদের রূপসুধা পান। চলতে চলতে হঠাৎ তাঁর পা-দুটো একটি দোকানের সামনে এসে আপনা থেকে থেমে যায়। বিমোহিত দৃষ্টিতে তিনি চেয়ে থাকেন। আরজমন্দ বানু আলো করে বসে রয়েছেন সেখানে। কিন্তু কী কিনবেন শাহজাদা। দোকানের সব জিনিসই যে বিক্রি হয়ে গিয়েছে। অমন রূপসীর দোকানে কি কিছু পড়ে থাকে? তবু রয়েছে। শুধু একতাল মিছরি কতই বা দাম হবে সেই মিছরির। তবু শাহজাদা এগিয়ে যান কম্প্র-কক্ষে। রূপসী সচকিত হয়ে ওঠেন। শাহজাদা মিছরি চেয়ে বসতেই তিনি তাড়াতাড়ি সবটা তুলে দেন তাঁর হাতে। হাতে হাত ঠেকে যায়। দুজনারই হৃৎপিণ্ডের গতি দ্রুত। মিছরি নিয়ে গলার বহুমূল্য হার ছড়া খুলে দিয়ে মন চেয়ে বসেন দুঃসাহসী শাহজাদা।

আরজমন্দ বানুর ভাগ্য ভাল যে খবরটা ছড়িয়ে পড়তেই তাঁর স্বামী তাঁকে পরিত্যাগ করেন। নইলে হিন্দুস্থানের ইতিহাসে মমতাজ বেগমের নাম কেউ শুনতে পেত না। শাহানশাহ্ শাহজাহানের স্বভাব তাঁর পিতার মতো নয়। নারীর জন্যে তিনি ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হতেন না কখনোই।

অনেক কক্ষ পার হয়ে এগিয়ে যাই খা-আব-বাগ বা স্বপ্নপুরীতে। এককালে বাদশাহ্ আকবরের শয়নকক্ষ ছিল এটি। এখন মা যেখানে রয়েছেন, শাহানশাহের অনুরোধে। কক্ষটি ঠিক হারেমের অন্য কক্ষের মতো আব্রু-ওয়ালা নয়। প্রচুর আলো বাতাসের আনাগোনা এখানে।

বহুমূল্য কিংখাবের ওড়না গায়ে জড়িয়ে, হাতে একগুচ্ছ গুলদাউদা নিয়ে মা হয়তো বাদশাহের প্রতীক্ষায় ছিলেন। পর্দা সরিয়ে ঘরে ঢুকতে তিনি হাসি মুখে উঠে দাঁড়িয়ে আমাকে দেখে থেমে যান।

—এ সময়ে কেন জাহানারা? কিছু ঘটেছে?

লজ্জিত হই। সঙ্কুচিত হই। ঘাড় নেড়ে বলি,—কিছু হয়নি মা।

—তবে।

—আজ সারাদিন তোমাকে দেখিনি তাই।

—হেসে ফেলেন মা। কাছে ডাকেন। পাশে বসিয়ে বলেন,—এবারে সত্যি কথাটা বলতো? আমাকে এত ভালবাসিস কবে থেকে? শুধু দেখা করার জন্যে এই সময়ে খা-আব-বাগে চলে এলি? জাহানারা, আমাকে কি আবার নতুন করে তোদের চিনতে হবে?

মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে হয়। মাকে ভালবাসি একথা সত্যি। কিন্তু সে ভালবাসার সীমারেখা জানা আছে তাঁর। অকারণে তাঁর কাছে মন-গড়া কৈফিয়ত দিয়ে লাভ নেই। তাই সোজাসুজি সবকিছু বলব বলে স্থির করি।

—মা।

—বল্ জাহানারা।

—মুঘল শাহ্তাদের শাদি হয় না?

—একথা আজ জানলি?

—না। বরাবরই জানি। তবে রোশনারা এ-নিয়ম মানবে না।

—না মানুক। আমি তাই চাই।

বিস্মিত হই। বলি,—কিন্তু বাদশাহ্ বাধা দেবেন না?

—বংশগত একটা সংস্কার তাঁর মনে রয়েছে বটে। তবে তিনি অনেকটা উদার বলেই মনে হয়।

—কী করে বুঝলে?

—এতদিন রয়েছি তাঁর সঙ্গে, মন চিনব না? শোন্ জাহানারা, মুঘল শাহজাদীর সন্তান সিংহাসন দাবি করে পরিবারের বিপদ ডেকে আনবে বলে ভয় ছিল আকবর শাহের। কিন্তু সে বিপদ কি থেমে আছে?

—না।

মা মিষ্টি হেসে বলেন, দারা, সুজা, আওরঙজেব আর মুরাদও বড় হয়ে নিজেদের মধ্যে হানাহানি করতে পারে। এদের সঙ্গে তোর আর রোশনারার তিন-চারটে ছেলে যোগ দিলে এমন কিছু এসে যাবে না।

—তুমি তাহলে রোশনারার পক্ষে?

—হ্যাঁ রে। তোর পক্ষেও। শাহানশাহ্ আমার স্বাস্থ্যের জন্যে যেরকম উঠে পড়ে লেগেছেন, আল্লার কৃপায় যদি কিছুদিন টিকে যাই, তোদের শাদি দেখে যাব।

নাচমহলে নৃত্য শুরু হয়েছে। দূরাগত সঙ্গীদের মতো এতগুলি কক্ষ পার হয়েও সে নৃত্যের ছন্দময় ঝংকার শোনা যায়। বাতায়নের বাইরের আকাশ তারকাখচিত। ঈদের চাঁদের মতো একফালি চাঁদ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে পৃথিবীর দিকে। মায়ের মুখে বেহেস্ত-এর হাসির ছোঁয়াচ।

মা বলেন,—আকবরশাহ্ আর এক মস্ত ভুল করেছিলেন। মুঘল শাহজাদীদের কুমারী রাখার সিদ্ধান্ত নেবার সময় তাদের দৈনিক আহারের একটা ফিরিস্তিও তৈরি করে দেওয়া উচিত ছিল।

—কেন মা?

—কোপ্তা, কোর্মা, কাবাব আর শরাব খেয়ে কুমারী থাকতে গেলে পাগলই হতে হয়। অন্য পথ নেই। এসব জিনিসের এমনই গুণ। সেরকম ঘটনা ঘটেনি তা নয়। চোখ মেলে হারেমে ঘুরলে এখনো হয়তো দেখতে পাবি। হিন্দু বিধবাদের যে খাবার, মুঘল কুমারীদেরও সেই খাবারের বিধান দিয়ে যাওয়া উচিত ছিল আকবর শাহের।

মায়ের কথার অর্থ পুরোপুরি ধরতে না পারলেও তাঁর চিন্তার গভীরতা দেখে মুগ্ধ হই। প্রাসাদের এক কোণে পড়ে থেকেও তিনি অনেক কিছু ভাবেন। বাদশাহের উচিত ছিল আজকে আমাদের দুই বোনের হাতে যেমন কিতাব তুলে দিয়েছেন, তার চেয়েও মোটা একটা কিতাব মায়ের হাতে তুলে দেওয়া। একটি অমূল্য সম্পদ লাভ করতে পারত জগৎবাসী।

একজন রূপসী নাজীর স্বর্ণখচিত পাত্র হাতে নিয়ে প্রবেশ করে।

—আবার নিয়ে এসেছ? মায়ের মুখে বিরক্তি।

—খেয়ে নাও মা

—কত আর খাব। আমার কী মনে হয় জানিস? আমার ভেতরে আগুন ধরেছে। অত কিছু করেও তাই শরীরে আর আগের সজীবতা ফিরে পাই না।

মায়ের ভারী কোমর আর স্ফীত উদরের দিকে চেয়ে বড় কষ্ট হয়। আমাকে নিয়ে যে দুর্ভোগের শুরু, আজ ষোলো বছর পরেও সে দুর্ভোগে ছেদ পড়ল না। আওরঙজেব পর্যন্ত প্রতি বছরই তিনি নিজের জীবনকে বিপদগ্রস্ত করে পৃথিবীতে তাঁর সবচাইতে আপনজন বাদশাহকে একটি করে সন্তান উপহার দিয়েছেন। তারপরে এই ধারাবাহিকতা ছিন্ন হলেও একেবারে থেমে যায়নি। প্রথম বয়সে উপহার দেবার সময় বাঁধভাঙা আনন্দই হয়তো মুখ্য বলে প্রতিভাত হত, কিন্তু এখন যেন ক্লান্তিটাই বড় হয়ে ধরা পড়ে চোখে।

—অমন হাঁ করে কী দেখছিস জাহানারা?

মুখখানিকে ঘুরিয়ে নিয়ে বলি, কিছু না।

মা হাসেন। বলেন—আমার কাছে তুই ছোটই আছিস। তবু বয়স হয়েছে তোর। অনেক কিছুই বুঝতে পারিস।

মমতাজ বেগমের মোমের মতো সাদা মুখে রক্তের ঢেউ দেখা যায়। লজ্জা পেলেন নাকি তিনি নব-যৌবনা কন্যার মনোভাব বুঝতে পেরে?

তাঁর গলা জড়িয়ে ধরে ডাকি,—মা।

মুহূর্তে তাঁর চোখের ভাষা পালটে যায়। অগাধ স্নেহধারা বেয়ে পড়ে সে চোখের দৃষ্টিতে। আমার গালের সঙ্গে নিজের গাল চেপে ধরে বলেন,—কীরে জাহানারা?

—মা, এবারে কী হবে?

—বোন।

—কী করে বুঝলে?

—মন ডেকে বলছে।

—আমি কিন্তু মা তোমার প্রথম মেয়ে।

—জানি রে। তোর ওপর আমার পক্ষপাতিত্ব সেজন্যে একটু বেশিই বোধ হয়। বাদশাহ্রও।

মেয়েদের ওপর নবাব-বাদশাহ্রদের টান থাকে নাকি?

—বোধ হয় থাকে না। কিন্তু তোর বেলায় রয়েছে। সেদিক দিয়ে বিচার করলে তুই ভাগ্যবতী। বাদশাহ্ অবশ্যি এর অন্য কারণ দেখান।

মা চুপ করে থাকেন। মুখের ভাব দেখে মনে হয় বেফাঁস কিছু বলে ফেলে অপ্রস্তুতে পড়েছেন। শেষে তাঁর মুক্তাপাতির মতো দাঁতগুলো একটু একটু দেখা যায় আবার। তিনি বলেন, তুই তো বেশ বড়ই হয়েছিস। তোকে বলতে আর বাধা কী?

—বলো।

—বাদশাহ্ বলেন, তাঁর সব ছেলেমেয়েদের মধ্যে তোর সঙ্গেই নাকি আমার আশ্চর্য মিল রয়েছে। সত্যি মা? মায়ের কথা শুনে আমার খুব আনন্দ হয়। পৃথিবী বিখ্যাত রূপসী মমতাজ বেগমের রূপের ধারে কাছে পৌঁছতে পারা যে কোনও রমণীর পক্ষেই মস্ত গর্বের।

বাদশাহ্ হয়তো এখনি এসে পড়বেন। আমাকে দেখে বিরক্তও হতে পারেন। উঠে পড়ি।

—চললি?

—হ্যাঁ না।

তাঁর মুখখানি হঠাৎ এক অকথিত ব্যথায় ভরে যায়। তাঁর দু নয়নের প্রসিদ্ধ পল্লব ছাপিয়ে অশ্রু বের হয়।

—মা, তুমি কাঁদছ?

—শোন্ জাহানারা। একটা কথা কাউকে বলিনি। তোর বাবাকেও নয়। আমার মনে হয় কী জানিস? এবার আমি আর বাঁচব না।

ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠেন মা। কক্ষের বাইরে কর্তব্যরত যে নাজীর ছিল কান্নার আওয়াজ শুনে সে ছুটে আসতে যায়। হাত উঁচিয়ে ইঙ্গিতে তাকে বাইরে অপেক্ষা করতে বলে দু হাতে মাকে জড়িয়ে ধরি।

—ছি মা। কেঁদো না অমন করে। তোমার শরীর খারাপ হয়েছে। তাই আজেবাজে চিন্তা তোমার মাথায় আসে। এবার থেকে সব সময় আমি তোমার কাছে থাকব।

ধীরে ধীরে শান্ত হন মা। শেষে বলেন,—আমি ঠিকই বলেছি। দেখিস, তোর বাবার কানে কথাটা না যায়। ভীষণ দুঃখ পাবে। শাহানশাহ্ হলেও আসলে ও কবি। তাই অল্পে যেমন ওর সুখ, দুঃখও তেমনি অতি অল্পেই।

আমি স্তব্ধ হয়ে যাই। বাবার সম্বন্ধে মা কখনো এভাবে আমাকে বলেননি।

মা আবার বলেন,–তোকে আজ এত কথা বলার প্রয়োজন হত না, যদি নিশ্চিত জানতাম এ-যাত্রা আমি বেঁচে উঠব। বাদশাহকে আমি ছাড়া কেউ চিনতে পারেনি। পারবেও না কেউ কোনওদিন চিনতে। ও ঠিক সাধারণ মানুষ নয়। তুই যেন চিনতে ভুল করিস না।

হারেমের বিভিন্ন কক্ষ থেকে মাঝে মাঝে উৎকট চিৎকার শোনা যায়। মা ছাড়া আরও যে সমস্ত বেগম রয়েছেন শাহানশাহের প্রতিদিন ঠিক এমনি সময়ে শরাব পান করে তাঁরা মাতলামি শুরু করেন। কারণ তাঁরা জানেন এমনি সময়েই বাদশাহ্ হারেমে আসেন এবং তাঁদের উপেক্ষা করে মমতাজ বেগমের কক্ষে প্রবেশ করেন। কিন্তু এত করেও বাদশাহের করুণা আকর্ষণ করতে পারেননি তাঁরা। খুব কমই তাঁদের কক্ষে রাত কাটান পিতা। এক মাসের মধ্যে বড় জোর সাতটা দিন তাঁরা ভাগাভাগি করে বাদশাহকে কাছে পান। বাকি দিনগুলি মায়ের নিজস্ব।

মনে মনে ঘৃণা করেন বাদশাহ্ তাঁর অন্যান্য বেগমদের—তাদের মাতলামিকে। বিখ্যাত শরাব-পায়ী জাহাঙ্গীরের আপ্রাণ প্রচেষ্টা সত্ত্বেও চব্বিশ বছরের আগে কোনওদিন মদ স্পর্শ করেননি পিতা। বাদশাহ্ জাহাঙ্গীর তাই তাঁকে দু চোখে দেখতে পারতেন না। তবে ইদানীং মাঝে মাঝে শরাবের পাত্র মুখে তুলতে হয় তাঁকে। কঠোর পরিশ্রম আর মানসিক দুশ্চিন্তায় এটা হাকিমি দাওয়াই। বাইরে কর্তব্যরত প্রহরীদের সতর্ক অভিবাদনের আওয়াজ পাই। বাদশাহ্ আসছেন। আরও কিছু কথা ছিল মায়ের সঙ্গে। বলা হল না। অন্য দরওয়াজা দিয়ে বাইরে চলে আসি।

.

ঠিক দুদিন পরে ঘটে গেল ঘটনাটা। এত তাড়াতাড়ি ঘটবে স্বপ্নেও ভাবিনি।

ফুটফুটে সুন্দর একটি মেয়ের জন্ম দিলেন মা ভোরের বেলায়। বাদশাহ খবর পেয়ে ঘুম চোখে ছুটে এসে মেয়েটির দিকে হাত বাড়িয়ে দিতে মা ম্লান হেসে বলেন,—এদের সবাইকে দেখো।

চমকে ওঠেন বাদশাহ্। বলেন,—তুমি একথা বললে কেন?

—এমনি।

বাদশাহ্ কেমন যেন বিমর্ষ হয়ে যান। নবজাত কন্যাকে স্পর্শ না করেই উঠে দাঁড়ান। ধীরে ধীরে মায়ের শিয়রে এসে তাঁর কপালের উত্তাপ দেখেন। তারপর নিষ্পলক দৃষ্টিতে একভাবে মায়ের মুখের দিকে চেয়ে থাকেন। ক্লান্ত মায়ের চোখদুটো তখন বন্ধ ছিল।

বাবা সন্তর্পণে আমার কাছে এগিয়ে এসে বলেন,—তুমি এখান থেকে যেও না জাহানারা।

—আমি এখানেই থাকব বাবা।

—প্রয়োজন হলেই আমাকে ডেকে পাঠিও।

আমি সম্মতি জানাই।

বাদশাহ্ চলে যান, হয়তো হাকিমের সঙ্গে পরামর্শ করতে। হাকিম আগেই বলেছেন, ভয়ের বিশেষ কারণ নেই। যেটুকু দুর্বলতা রয়েছে মায়ের, তার জন্যে দাওয়াই-এর ব্যবস্থা তিনি করেছেন। বিপদের সম্ভাবনা নেই বলে তিনি প্রসূতির ঘরে না থেকে পাশের ঘরে রয়েছেন।

নিস্তব্ধ কক্ষে আমি একা বসে। কিছু দূরে মা শায়িতা। খুব ধীরে তাঁর শ্বাস পড়ে। আমার ছোট্ট বোনটি মাঝে মাঝে কেঁদে ওঠে। একজন অভিজ্ঞ নাজীর এসে তাকে কোলে তুলে নিয়ে

শান্ত করে আবার রেখে যায়।

সকাল কাটে। দুপুর হয়। অন্যান্য কক্ষে শাহজাদী আর বেগমেরা দিবানিদ্রায় মগ্ন।

হঠাৎ একসময়ে দেখি মা ছট্‌ফট্ করছেন। তাঁর চোখ দুটো বড় বড়। ছুটে তাঁর পাশে গিয়ে বলি,—মা অমন করছ কেন?

হাঁপাতে হাঁপাতে মা কোনওমতে বলেন—ওঁকে ডাক জাহানারা! শিগগির।

ভীতবিহ্বল দৃষ্টিতে চেয়ে দেখি মায়ের শুভ্র শয্যা রক্তাক্ত।

নাজীরকে কাছে বসিয়ে বাদশাহকে ডাকতে আমি পাগলের মতো ছুটি। নিজেকে বড় অসহায় বলে বোধ হয়।

দরবার কক্ষে ছিলেন বাদশাহ্। তাঁর কাছে খবর পৌঁছে দিতেই তিনি দৌড়ে আসেন।

হাকিমকে নিয়ে আমরা দুজনে মায়ের কক্ষে প্রবেশ করি। চেয়ে দেখি মায়ের চোখ নিমীলিত—মুখ শান্ত। যে নাজীরকে বসিয়ে রেখে গিয়েছিলাম সে কাঁদছে।

হাকিম গিয়ে মায়ের ডান হাত সযত্নে তুলে নিয়ে পরীক্ষা করেন। অনেকক্ষণ ধরে পরীক্ষা করেন। শেষে ছেড়ে দিয়ে দু হাতে নিজের মুখ ঢাকেন।

আমার পায়ের নীচের পাথরের মেঝে যেন সরে যায়। টলতে থাকি। ঠিক সেই সময়ে পিতার আকাশ ফাটানো চিৎকার শুনিমমতাজ!

অবোধ শিশুর মতো কঠিন পাষাণের ওপর বসে পড়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠেন শাহানশাহ্ শাহজাহান।

পিতার এ ক্রন্দন শুনলেন হাকিম, শুনল এক অতি সামান্যা নাজীর। আর শুনলাম আমি। তাঁরা সেই মুহূর্তেই পিতাকে চিনে নিল। তাঁর হৃদয়কে চিনল।

সামনে শয্যার ওপর মায়ের মৃতদেহ। ভূতলে বাবা কেঁদে ভাসান। আমি বাবার পাশেই বসি, তাঁকে ধরে রাখি। মা যে আদেশ দিয়ে গেছেন। মায়ের শেষ আদেশ আমি জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত পালন করব। তিনি বেহেস্ত থেকে দেখে নিশ্চিন্ত হবেন।

.

মৃত্যু।

জিনিসটি কত স্বাভাবিক, অথচ কত অস্বাভাবিক। মৃত্যু ছাড়া অন্য কোনও দ্বিতীয় পরিণতি পৃথিবীর প্রথম দিন থেকে আজ পর্যন্ত কোনও জীবজন্তু কীটপতঙ্গ গাছপালার হয়েছে কি? অথচ এত জেনেও প্রতিটি ক্ষেত্রে আমরা আকুল হই, ব্যাকুল হই। আমরা অবিরাম অশ্রু বিসর্জন করি।

মায়ের দেহ যমুনার তীরে সমাহিত করার সময় আমরা ভাই-বোনেরা কাঁদলাম—এক সঙ্গে কাঁদলাম। সেইদিনই আমরা শেষবারের মতো অনুভব করলাম আমরা পরস্পরের কত আপন। বাদশাহের কান্না থেমে গিয়েছিল। আরাবল্লীর মতো স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে তিনি মৌলবাদীদের সমস্বরে উচ্চারিত কোর-আনের পুণ্য বাণী শুনতে থাকেন। তার ঘন কৃষ্ণবর্ণ শ্মশ্রুর অধিকাংশই রূপালী জরির মতো চক্‌চক্ করছিল। মুরাদ একবার সেদিকে তাকিয়ে আরো জোরে কেঁদে ওঠে। সে সবার ছোট। বাবা যে কোনওদিন বৃদ্ধ হতে পারেন এ ধারণা তার ছিল না। তবু হয়তো সহ্য হত তার। কিন্তু একদিন আগে যাঁর চেহারার মধ্যে বার্ধক্যের লেশমাত্র চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যেত না, একদিন পরেই তাঁর এ কী পরিবর্তন!

সমাধিক্ষেত্র থেকে ফিরে আসি। মায়ের কক্ষে প্রবেশ করি। সব ফাঁকা। বুকের ভেতরটা আবার ডুকরে কেঁদে ওঠে।

বাইরে পর্দার কাছে কে যেন এসে থেমে যায়। হয়তো দারা কিংবা মুরাদ। লুকিয়ে পড়ে দরওয়াজার আড়ালে। হয়তো কাঁদতে চায়। বুকের ব্যথা নিঃশেষ করে দিয়ে কাঁদতে চায় মায়ের শূন্য শয্যার ওপর মুখ রেখে। কাঁদুক। প্রাণভরে কাঁদুক।

কিন্তু একী! বাবা!

ধীরে ধীরে তিনি এগিয়ে যান শয্যার পাশে। ভূতলে হাঁটু-ভেঙে বসে শয্যার ওপর রিক্ত বাহু দুখানা বিছিয়ে দিয়ে স্পষ্ট অনুচ্চস্বরে বললেন—চলে গেলে তুমি মমতাজ! কী নিয়ে আমি থাকব?

বিছানায় মুখ ঘষতে ঘষতে কাঁদতে থাকেন তিনি।

—এমন তো কথা ছিল না। তুমিই বলেছিলে একই দিনে একই মুহূর্তে আমরা পৃথিবী থেকে বিদায় নেব। জীবনে যেমন ছাড়াছাড়ি হইনি, মৃত্যুর পরও হবো না। তবে কেন চলে গেলে? কোনওরকম সতর্ক না করে দিয়ে এভাবে কেন ফাঁকি দিলে?

আমি আর সহ্য করতে পারি না, দরওয়াজার আড়াল থেকে বার হয়ে এসে ধীরে ধীরে বাদশাহের পেছনে গিয়ে দাঁড়াই। তাঁর কাঁধ স্পর্শ করে ডাকি,—বাবা!

বাদশাহের সমস্ত শরীর থরথর করে কেঁপে ওঠে। তিনি পেছন ফিরে আমাকে দেখেন। তাঁর মুখে তখন কী আঁকা ছিল ভাষায় বর্ণনা করতে পারব না।

—বাবা, মা আমাকে রেখে গিয়েছেন!

—তোকে, রেখে গিয়েছে?

—হ্যাঁ বাবা। তিনি জানতেন, তিনি আর বাঁচবেন না। তোমাকে বললে তুমি কষ্ট পাবে, তাই বলেননি। আমাকে নির্দেশ দিয়ে গিয়েছেন তোমাকে দেখার জন্যে। আমি নাকি তাঁরই মতো দেখতে?

বাবা বিদ্যুৎগতিতে উঠে দাঁড়িয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরেন—হ্যাঁ জাহানারা। তুই তোর মায়ের মতোই দেখতে। তোর স্বভাবও তোর মায়ের মতো। কিন্তু—। না থাক।

সহসা আমাকে ছেড়ে দেন তিনি। মুখের দিকে একদৃষ্টে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকেন। তাঁর বিমর্ষ ভাব অনেক কম বলে মনে হয়। সমব্যথী পেয়েছেন তিনি। মায়ের শয্যার দিকে আর একবার তাকান তিনি। ঘরের প্রতিটি জিনিস খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেন। শেষে গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলেন।

আমি ধীরে ধীরে বলি, –বাবা, মা তোমাকে ছেড়ে যাননি। তোমার জন্য অপেক্ষা করছেন। তুমি তোমার কর্তব্য শেষ করে তাঁর সঙ্গে গিয়ে মিললে তিনি সুখী হবেন। তুমি যে পুরুষ।

উত্তেজনায় বাবার মুখমণ্ডল রক্তিম হয়ে ওঠে। সজোরে আমার কাঁধ চেপে ধরে বলেন—সত্যি

করে বল্ জাহানারা, একথা বলতে তোর মা শিখিয়ে দিয়েছে?

চুপ করে থাকি। কী বললে বাবা সুখী হবেন চিন্তা করি। শেষে বলি,—হ্যাঁ বাবা —আমি জানতাম হুবহু তোর মায়ের কথা কী ভাবে তুই বলবি? তোর মায়ের কথাই আমি রাখব জাহানারা। আমার কর্তব্য আমি করব।

বাবা চলে গেলে আমি সচকিতে চার দেওয়ালের দিকে দৃষ্টি বুলিয়ে নিই। কোথায় মা? অনুভব করছি তিনি আছেন, অথচ দেখতে পাচ্ছি না। অস্ফুট স্বরে ডাকি—মা!

সাড়া নেই।

—মা গো! দেখা দাও আর না দাও, তোমার কথাগুলো এভাবে আমার মুখে জুটিয়ে দিও। নইলে বাবাকে যে সামলাতে পারব না।

শিশমহল। প্রাসাদের এক দুর্নিবার আকর্ষণস্থল এই শিশমহল। মায়ের মৃত্যুর পর তিন বছর পার হয়েছে। সেই থেকে জায়গাটি অব্যবহৃত পড়ে থাকে। বাদশাহ্ ভুলেও আর যান না ও পথে। আমি শুধু মাঝে মাঝে গিয়ে দাঁড়াই। চারদিকে রঙিন কাচে ঘেরা কক্ষটি। সূর্যের আলো হাজার রঙে রঙিন হয়ে কক্ষের ভেতরে এসে পড়ে এক লোভনীয় স্বপ্নজাল বিস্তার করে। এখান থেকে নগরীর দৃশ্য মনোরম। এখানে বসে থাকতে থাকতে একসময় আমার সর্বাঙ্গ আনচান করে ওঠে। মনে হয়, সবই রয়েছে অথচ কী যেন নেই। আয়োজন সম্পূর্ণ, অথচ কীসের অভাবে সব যেন ব্যর্থ হয়ে যায় দিনের পর দিন। সে ব্যর্থতার লজ্জা আমারই। শিশমহলের ঠিকরে-পড়া রঙগুলি আমার সর্বাঙ্গকে রঙিন করে দিয়ে কীসের অপেক্ষায় উদগ্রীব হয়ে থেকে শেষে যেন আমাকেই ব্যঙ্গ করে ওঠে। ছুটে পালিয়ে আসি সেখান থেকে। কিন্তু ফিরে যাই আবার পরদিনই। না গিয়ে পারি না।

শেষ-বেলার সূর্য প্রতিদিনই শিশমহলকে শরাবে চুবিয়ে রাখে। নেশা কাটে না। কিছুদিন থেকে এ নেশা আমাকে পেয়ে বসেছে।

এমনি একদিন। প্রতিদিনের মতো কক্ষের পর কক্ষ পার হয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলাম শিশমহলের দিকে। কাছাকাছি এসে সহসা যেন মনে হল শিশমহল নির্জন নয়। থমকে দাঁড়িয়ে পড়ি।

একদৃষ্টে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকার পর শিশমহলের দেওয়ালের ভেতরে কারও ছায়া ভেসে উঠল। তবে কি মা? না না, আট সন্তানের জননী মমতাজ বেগমের অনেক দায়িত্ব। সমাধির বন্দিজীবন যদি তাঁর ভাল না লাগে, তবু তিনি শিশমহলে আসতে যাবেন না। বাদশাহের পাশে পাশে থাকবেন তিনি।

অন্য এক আশঙ্কায় বুক কেঁপে ওঠে। মায়ের মুখে শোনার পর থেকে হারেমের বয়স্কা শাহজাদী, আমার পিতৃসা যে কয়জন রয়েছেন, তাঁদের প্রতি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেখে এসেছি। মা সত্যি কথাই বলেছিলেন। এঁরা কেউ-ই ঠিক স্বাভাবিক নন। বয়স হয়েছে, অথচ গাম্ভীর্যের অন্তরালে একটা কুৎসিত কিছু তাঁদের মনকে সব সময়ই নাড়া দেয়। তাঁদের কথাবার্তা আর ব্যবহারের মধ্যে সেগুলি মাঝে মাঝে প্রকট হয়ে ওঠে। তাঁদেরই কেউ কি শিশমহলের নির্জনতায় গিয়ে অস্বাভাবিক জীবনের জ্বালা জুড়াবার ফিকিরে ঘুরছেন? আত্মহত্যা করবার অমন আদর্শ স্থান তো একটিও নেই হারেমে। ইচ্ছে করলে লাফিয়ে পড়া যেতে পারে ওপর থেকে। কিংবা দড়ি নিয়েও ঝুলে পড়া যেতে পারে। একদলা আফিমও দুর্লভ নয় মুঘল-হারেমে।

ওই আবার। স্পষ্ট এক নারীমূর্তির ছায়া। পাগলের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে। ত্রস্তে যে পথে এসেছিলাম সে পথে ছুটে যাই। জানাতে হবে কাউকে। অন্তত কোনও নাজীর কিংবা কোনও খোজাকে। তাদের কাউকে সঙ্গে না নিয়ে এলে অবস্থা আয়ত্তে আনা সম্ভব হবে না হয়তো।

কিছুদুর ছুটে নিজের উত্তেজনায় নিজেই সঙ্কুচিত হই। সামান্য জিনিসটিকে আতস কাচের মধ্যে দিয়ে দেখছি ভেবে নিজেকে ধমক দিই। হয়তো কিছুই নয়। আমার মতো কেউ শিশমহলে গিয়ে শোভা উপভোগ করছে মাত্র।

আবার এগিয়ে যাই। এবারে দৃঢ় পদক্ষেপে।

একটি জানালা খোলা ছিল শিশমহলের। ধীরে ধীরে সেখানে গিয়ে উঁকি দিই। ভেতরের দৃশ্য দেখে আমার শরীরের রক্ত হিম হয়ে যায়।

কোনও পিতৃত্বসা নয়। রোশনারা। হ্যাঁ রোশনারা সে। একলা নয়। হারেমে তার ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে অল্পবয়সি সুন্দর খোজা—সেও রয়েছে। আমার বোন রোশনারা—শাহানশাহ্ শাহজাহান-নন্দিনী রোশনারা বসে রয়েছে খোজার কোলের ওপর। হঠাৎ কী যেন মনে হয়। বিষধর সর্পিনীর মতো রোশনারা ছিকে তার কোল থেকে নেমে পড়ে। ভীষণভাবে চপেটাঘাত করে তার দুই গালে। তারপর পদাঘাত করে তাকে।

বিহ্বল দৃষ্টিতে খোজাটি একবার তার দিকে চায়। শাহজাদীর ক্রোধের কারণ সে অনুধাবন করতে পারে না। শেষে শান্তভাবে মাথা নিচু করে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। তার মুখের পানে চেয়ে দেখি এই নাটকীয় ঘটনা তার দেহ-মনে বিন্দুমাত্র চাঞ্চল্য সৃষ্টি করতে পারেনি। বরং একটা শঙ্কার ছাপ—শাহজাদীকে সে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। ব্যথা অনুভব করি তার জন্য। ব্যথা অনুভব করি সমস্ত খোজাকুলের জন্য। এমন চমৎকার স্বাস্থ্য নিয়েও তারা একাকী। পৃথিবীর রূপ-রস-গন্ধের দুয়ার তাদের কাছে চিরদিনের জন্য অর্গল-বন্ধ।

খুব নিচু গলায় ডাকি—রোশনারা।

—কে? আঁতকে ওঠে রোশনারা।

—আমি।

জানালার কাছে এক-পা, এক-পা করে এগিয়ে আসে সে। ফাঁকা দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে বলে—তুমি, তুমি দেখেছো?

—হ্যাঁ।

দরজা দিয়ে বাইরে বের হয়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে শিশুর মতো কাঁদতে থাকে আমার বোন।

—তুই এ কী করলি রোশনারা? ওরা কি পুরুষ? পুরুষ হলে বেগমমহলে কি ওদের ঠাঁই হত?

—ওরা যে এমন তা জানতাম না।

—ছি ছি।

—ভবিষ্যৎ অন্ধকার বলে মনে হয় দিদি।

—ভুল। ভবিষ্যৎকে ইচ্ছে করলে উজ্জ্বল করে গড়ে তুলতে পারিস।

—স্বপ্নের কথা বলছ?

—না, স্বপ্ন নয়। মায়ের মৃত্যুর আগে তাঁর সঙ্গে আমার কথা হয়েছিল। তিনি শাহজাদীদের চিরকুমারী রাখার পক্ষপাতী ছিলেন না।

—মা মৃত।

—তাঁর মনোভাব বাদশাহ্ নিশ্চয়ই জেনেছেন।

—জেনেও লাভ নেই।

—কেন?

—বাদশাহের অতটা হিম্মত হবে না। চিরাচরিত প্রথা মেনে চলতেই তিনি অভ্যস্ত। নতুন কিছু ভেঙে গড়ার মতো বলিষ্ঠ তিনি নন।

—এ কথা তুই বলতে পারলি তাঁর সম্বন্ধে।

—পারলাম। কারণ আছে তার। আওরঙজেব চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে।

—আওরঙজেব দেখছি তোর পরামর্শদাতা হয়ে উঠেছে।

—ঠাট্টা করতে পার। কিন্তু ভাইদের মধ্যে সে ছাড়া আর কাউকে তো মানুষ বলে ভাবতে পারি না। প্রাসাদে থেকেও একমাত্র তাকেই দেখি, সমস্ত ভোগ বিলাসিতা থেকে নিজেকে যতটা সম্ভব দূরে সরিয়ে রেখেছে। অন্যান্য ভাইরা বিলাসিতায় মত্ত, আর ও মৌলবীর কাছে নিয়মিত শিক্ষা নিতে চলেছে। ও খাঁটি মুসলমান

—হুঁ মোল্লাশালের শিক্ষায় শিক্ষিত বটে। আর দারা? সে আওরঙজেবের চেয়ে অনেক বেশি শিক্ষিত, অনেক জ্ঞানী।

—কিন্তু সে মুসলমান নয়। সে আকবর শাহের ভেজাল ধর্মের প্রতীক।

—দেখ্‌ রোশনারা, আমি জানি এত কথা বলার কিংবা বোঝবার বয়স তোর হয়নি। এখন থেকেই তুই অন্যের হাতের পুতুল হয়ে পড়েছিস। সাবধান হ’। অন্যে যেভাবে সুতো নাড়াবে সেভাবে নাচিস না।

—আমি জানি আওরঙজেবকে তোমরা কেউ দেখতে পারো না।

—পারি। সে-ও আমার ভাই। কিন্তু তার স্বভাবের কতকগুলো জিনিস আমার ঠিক ভাল লাগে না। হয়তো বয়স হবার সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে সে শুধরে নেবে।

—না শুধরোলেই আমি খুশি হব। শুনছি রাজকার্যে নামার সঙ্গে সঙ্গেই বাবা তাকে দক্ষিণ ভারতের ভার দিয়ে পাঠাবেন। ভালই করবেন। নিজের মতো থাকতে পারবে সে।

—কিন্তু বাদশাহকে আওরঙজেব দুর্বল ভাবল কী করে?

—তাঁর এতদিনের কার্যকলাপ বিচার করে। সে বলে, প্রথম জীবনে বিদ্রোহ ছাড়া বাবা আর কিছুই করেননি। তিনি আকবরশাহ্ আর জাহাঙ্গীরের সারা জীবনের পরিশ্রমের মধুটুকু পান করে চলেছেন।

আওরঙজেবের ধৃষ্টতায় হতবাক্ হই। উনিশ বছর বয়স না হতেই বাদশাহের সমালোচনা করে সে। রোশনারার কথার জবাব অবধি দিতে পারি না। আমি জানি, শাহানশাহ্ শাহজাহান শান্তিপ্রিয় হলেও দুর্বল মোটেই নন। স্থায়ীভাবে তিনি অনেক বিদ্রোহ দমন করেছেন। তাঁর উদার মন বিশ্বাসের দ্বারা দেশের আমীর ওমরাহদের হৃদয় জয় করতে সক্ষম হয়েছে, যার ফলে দেশের কোথাও কোনও অশান্তির ছিটেফোঁটা দেখা যায় না। আওরঙজেবের হয়তো ধারণা—অবিশ্বাস আর যুদ্ধই বলিষ্ঠতার পরিচয়। আল্লার কৃপাই বলতে হবে যে সে বাদশাহের জ্যেষ্ঠ পুত্র নয়—জ্যেষ্ঠ পুত্র দারাশুকো।

—রোশনারা, বাদশাহ্ দুর্বল কি না ইতিহাস তার বিচার করবে। তবে এটুকু তোকে বলতে পারি, যে-ভাবে তুই নিজের পরিতৃপ্তির পথ খুঁজতে শুরু করেছিস, জানতে পারলে, সমস্ত দুর্বলতা সত্ত্বেও তিনি তোকে ক্ষমা করবেন না।

—জানি। তবু জেনে রোখো দিদি, প্রতিনিয়ত আমি এই একই চেষ্টা করে যাব।

শিশমহলের বাইরে দাঁড়িয়ে দিগন্তের দিকে চেয়ে রোশনারা বুক ভরে হাওয়া টেনে নেয়। আমার মুখের দিকে বহুক্ষণ চেয়ে থাকে সে। অন্তরে আমার কোন্ ভাবনা তোলপাড় করছে, হয়তো তা অনুধাবনের চেষ্টা করে। এক সময়ে তার কচি মুখে মৃদু হাসি ফোটে। আমার বুকের ওপর একখানা হাত রেখে বলে, দিদি, অন্ধকার ঘরে একা শুয়ে হা-হুতাশ করার জন্যে মানুষের জন্ম হয়নি। তার জন্মের এক বিরাট সার্থকতা রয়েছে।

চমকে উঠি আমি তার কথায়।

রোশনারা শিশমহল ছেড়ে চপল পদক্ষেপে ছুটতে ছুটতে অদৃশ্য হয়ে যায়। তবু আমি তার গমনের পথে চেয়ে থাকি। কথাগুলি যেন সে বলল না। বলল এক অদৃশ্য শক্তি,—নিয়তির মতো যা অমোঘ।

দূরে—প্রাসাদ পার হয়ে কোনও প্রান্তরের মধ্যে মিষ্টি গলায় কে যেন গেয়ে উঠল আবু সাইদের গান। সে গান দোলা লাগায় আমার মনে। একাকী দাঁড়িয়ে আমি শুনি, কান পেতে শুনি।

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *