মমতাজ-দুহিতা জাহানারা – ৭

মহতাব বাগের মাথার ওপরে নির্মল আকাশ। সেই আকাশের গায়ে সন্ধ্যা না হতেই একখণ্ড চাঁদ উঁকি দিতে শুরু করেছে। যেদিকে তাকাই শুভ্র ফুলের শোভা! বহুদিন পরে মহতাব-বার্গে এসেছি। তাই এত শ্বেত শোভার অকৃপণতায় বিমুগ্ধ হই। এই বাগের একটি ফুলও অন্য রঙের নেই।

আমার হাতে গজমতির পাতা। সেই পাতায় রয়েছে রাজার হস্তাক্ষর। আজই পেয়েছি আমি চিঠিখানি। রাজার এক অতিবিশ্বস্ত অনুচর পৌঁছে দিয়ে গিয়েছে। খুবই ছোট চিঠিখানি। তবু যেন তার মধ্যে অনেক কিছু লুকানো রয়েছে। যত পড়ি, ততই নতুন নতুন অর্থ বের হয়—ততই বুক উদ্বেলিত হয়ে ওঠে। সেদিনের সেই চিরস্মরণীয় সন্ধ্যার মতো একটা আবেশ অনুভব করি। বুকের ভেতরে চেপে ধরি পত্রখানি।

মুহূর্তের জন্য ভুলে যাই, আমি বর্তমান যুগের কোনও নারী। ভুলে যাই শাহানশাহ্ শাহজাহানের কন্যা আমি। মনে হয় আমি যেন অতীতদিনের সমরখন্দের তৈমুরের কোনও দুহিতা। আমার ইচ্ছা পূরণে সংস্র অশ্ব পর্বত-শিলা প্রকম্পিত করে দিগ্বিদিক ধাবিত হয় রাজ্যের সীমার বাইরে কোনও শস্যশ্যমলা দেশের দিকে। আমায় সন্তুষ্ট করার জন্যে শত শত বীর তরুণ ছুরিকাঘাতে নিজেদের বক্ষ ক্ষতবিক্ষত করে। আর আমি স্বর্গীয় কানিবুল উদ্যানের গুলবাহার দেখতে দেখতে সে সব কথা ভেবে মনে মনে হাসি। আমি জানি আমার প্রিয়তম কে, আমার হৃদয়ের তক্ত-তাউসে কার স্থায়ী আসন। সে আর কেউ নয়—বুন্দেলা ছত্রশাল।

চমক ভাঙে। চিন্তার অসংলগ্নতায় লজ্জিত হই। প্রতি নারীই এমন অবস্থায় বোধহয় এইরকম চিন্তা করে। বাস্তবজগৎকে সে কিছুতেই মেনে নিতে পারে না। নইলে শাহানশাহ্ শাহজাহান নন্দিনী হয়েও কেন আমি কানিবুল উদ্যানের স্বপ্ন দেখলাম। বাদশাহ্ তো তৈমুর-বংশের মধ্যে সব চাইতে ঐশ্বর্যশালী। তাজমহল নির্মাণের কথা অতীতে কেউ চিন্তা করতে পেরেছে কি? তবু—এ সবই রূঢ় বাস্তব। সুদূর সমরখন্দের অতীত দিনের স্বপ্ন মেশানো নেই তাতে।

রাজা লিখেছে শেষে : বিন্ধ্যাচলের পরপারে যে দিগন্তরেখা সেখান থেকে উঠে আসছে এক সর্বনাশা ঝড়। জানি না, শাহানশাহ্ সামলাতে পারবেন কিনা

আমিও বুঝতে পারি। দিল্লি অরক্ষিত। ঝড়ের গতিবেগ রোধ করতে হলে যে সাবধানতা, যে যোগ্যতা প্রয়োজন দিল্লিতে তার নিদারুণ অভাব। তার পরিবর্তে এখানে একদল লোক ঘরের ভিত দুর্বল করে তুলতে তৎপর হয়েছে—সামান্য ঝড়েই যাতে ধসে পড়ে। বাদশাহকে বলে ফল হয়নি। তিনি দারার ওপর অতিরিক্ত নির্ভর করতে শুরু করেছেন। অথচ তিনিই এক সময়ে আমাকে বলেছিলেন, জন্মের কয়েকদিন পরে দারার ললাটে তিনি জয়তিলকের পরিবর্তে দেখেছিলেন পরাজয়ের মসিরেখা। জ্যেষ্ঠপুত্রের এই দুর্ভাগ্যের চিহ্ন মমতাজের চোখে জল এনে দিয়েছিল। ভারী গলায় তিনি বাদশাহকে বলেছিলেন—মুঘল-বংশের গৌরব-সূর্য সম্ভবত অস্তমিত হল। তোমাকে আমি সুখী করতে পারলাম না।

আরও অনেক কথাই নিশ্চয় হয়েছে, পিতা হয়ে যা তিনি আমাকে বলতে পারেননি। কিন্তু আজ সম্ভবত সব তিনি ভুলে গিয়েছেন। কিংবা ভুলে যাবার ভান করেছেন। কারণ দারার প্রতি স্নেহ তাঁর অন্ধ। তাঁর শেষ রক্তবিন্দু থাকতে সাধের ময়ূরাসন অন্য কোনও পুত্রকে ছেড়ে দেবেন না। অথচ অতি দ্রুত অশক্ত হয়ে পড়ছেন তিনি। দুর্ভাবনার সঙ্গে শেষ বয়সের অমিতাচার তাঁকে এই অবস্থায় এনে ফেলেছে। তাঁর রক্তের মধ্যে ঘুমন্ত যৌবনের নেশা হঠাৎ শেষবারের মতো জেগে উঠে তাঁর আয়ুকে নিঃশেষ করে দিচ্ছে। বুঝতে পেরেও বড় একটা বাধা দিতে পারি না। মেয়ে হয়ে সেটা সম্ভব নয়। বুঝতে তিনিও পারেন। তাঁর কোনও কোনও অঙ্গ এক এক সময় অবশ হয়ে যায়। ভীত হয়ে আমাকে ডেকে পাঠান তিনি। অসহায়ের মতো তাঁর হাতখানা বাড়িয়ে দিয়ে বলেন—দেখতো জাহানারা, আপেলের সুঘ্রাণ পাওয়া যাচ্ছে কি? শুনে চোখে জল আসে আমার। এ অবস্থায় কোন্ পিতাই বড় ছেলের ওপর সবকিছু ছেড়ে দিতে না চায়।

.

মহতাব-বাগে সন্ধ্যা হয়। চাঁদ আরও ওপর দিকে ওঠে। চাঁদের আলোয় সাদা ফুলগুলি একাকার—তাদের পৃথক অস্তিত্ব লোপ পেয়েছে।

হঠাৎ একটু দূরে মৃদু পদশব্দ। স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ি। শব্দ এগিয়ে আসে। গাছের আড়ালে যাই।

একজন স্ত্রীলোক। মুখের বোরখা তার মাথার ওপরে তোলা। তবু চিনতে পারি না দূর থেকে। বুকের ভেতরে চাপা উত্তেজনা অনুভব করি। হারেমের কেউ নয়। কোনও নাজীরও নয়। নাজীরদের পরিচ্ছদ এত মূল্যবান হয় না।

আমি ভীত হই। আবার হয়তো কোনও নারকীয় দৃশ্যের সৃষ্টি করা হবে আমার সাধের মহতাব-বাগে। কিছু ঘটবার আগেই পালাতে হবে। নহরী-বেহেস্ত-এ খলিলুল্লা খাঁয়ের বেগমের ঘটনার পর থেকে সব সময়ই আমি ভয়ে ভয়ে থাকি।

স্ত্রীলোকটি আমার খুব কাছেই তৃণের ওপর বসে পড়ে। এবারে তাকে চিনতে পারি। শায়েস্তা খাঁয়ের বেগম। মহতাব-বাগে তার উপস্থিতির কী কারণ ঘটল বুঝতে পারি না। কানে যা আসে তাও কি তবে সত্যি? বাগের মধ্যে এরা সব আসেই বা কী ভাবে? কঠোর শাস্তি দিতে হবে প্রহরীদের। নইলে ওদের অর্থের লোভ কমবে না। আজ আমি একে যেভাবে দেখছি, দুদিন পরে আমাকেও এর চাইতে খারাপ অবস্থায় কেউ দেখবে কিনা ঠিক কি? তখন রাজা থাকবে। কী লজ্জা। আড়াল থেকে কেউ সব কিছু দেখছে কল্পনা করলেও আত্মহত্যার ইচ্ছে জাগে।

শায়েস্তা খাঁয়ের বেগমকে প্রহরীরা হয়তো বাধা দিতে সাহস পায়নি। কোনও বড় আমির-ওমরাহের বেগম এসব বাগিচায় আসতে পারে না। তারা সাধারণত যায় শালিমার-বাগে। আজকের ব্যাপারে বাদশাহের কোনও সম্মতি নেই তো? বেগমের চঞ্চলতা এবং চারদিকে অস্থির চাহনি দেখে সেই রকমই যেন মনে হয়।

আবার পদশব্দ।

এবারে শায়েস্তা খাঁ। মুখের কুটিল হাসিতে তার ঘৃণা ঝরে। বেগম আঁতকে ওঠে,–তুমি!

—হ্যাঁ, আমি। কত সাধ করে তোমায় শাদি করেছিলাম মনে আছে তো।

বেগম কথা বলে না।

—ঘরের খেয়ে তুমি বাইরে মজা লুটবে, তাই কি সহ্য করতে পারি?

—বাজে কথা বলো না।

চাপা গলায় চেঁচিয়ে ওঠে অতবড় পুরুষটি,—চোপ রহ। তোমার মতলব বুঝতে আমার দেরি হয় না। আমি খলিলুল্লা খাঁয়ের মতো নিরেট নই।

—বলছ কী তুমি?

—ঠিকই বলছি। বাদশাহের ঠাণ্ডা দেহে যেটুকু উত্তাপ অবশিষ্ট রয়েছে, তুমি তাই উপভোগ করতে এসেছ। তাঁর ছেলের বয়সি আমি—অথচ আমার ফুটন্ত যৌবনে তোমার অরুচি ধরেছে। আমার যে তক্ত-তাউস নেই। তাই না বেগম?

—খাঁ সাহেব, বাদশাহ্ বৃদ্ধ।

—হ্যাঁ, বৃদ্ধ তো বটেই। তাই আমার বিশেষ ভয় নেই।

—তোমার সঙ্গে কথা বলতে আমার ঘৃণা হয়।

—তোমার দিকে চাইতেও আমার মাথায় আগুন জ্বলে।

আড়ালে দাঁড়িয়ে আমার পা কাঁপে। খাঁ-সাহেবের কথাকে আমি অবিশ্বাস করতে পারি না। নহরী-বেহেস্ত-এর ঘটনার পর সবকিছু ঘটাই সম্ভব।

বেগম মাটি ছেড়ে সোজা উঠে দাঁড়ায়। খাঁ-সাহেবের দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টি হেনে বলে,–কেন, এসেছ তুমি?

—তোমার হাত ধরে ঘরে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে নয়। খলিলুল্লা খাঁয়ের মতো আমার বুকের মধ্যে আশ্রয় দেবার জন্যেও নয়।

বেগম হেসে ওঠে। নিজের হাতের ওপর মাথার বেণীকে আছড়াতে আছড়াতে বলে, ওসব বড় বড় কথা ঘরে গিয়ে বলো। এটা মহতাব-বাগ। এখানে তেমন কিছু করলে খাঁ-সাহেবের অমন সুন্দর মাথাটি ঘাসের ওপর গড়িয়ে পড়ে সাদা মহতাব-বাগকে একটু লাল করে দেবে মাত্র।

শায়েস্তা খাঁ মোলায়েম স্বরে বলে,—আকাশে কী সুন্দর চাঁদ উঠেছে দেখেছো? পাঁচ দিন আগে ঈদ শেষ হয়েছে। আবার ঈদ আসবে। ঈদের পরে মহতাব-বাগের এ-দৃশ্য আরও কত বছর দেখতে পাওয়া যাবে কে জানে!

আমি বিস্মিত হই শায়েস্তা খাঁয়ের কথা বলার ভঙ্গিতে। বেগমও কম বিস্মিত নয়। সে নিশ্চয় ভেবেছে খাঁ-সাহেব ভীত। কিন্তু আমি ভালভাবে চিনি তাকে। সহজে ভীত হবার পাত্র সে নয়।

সহসা কোষ থেকে তলোয়ার টেনে বার করে শায়েস্তা খাঁ। চাঁদের কিরণে খাঁটি ইস্পাত ঝলসে ওঠে। শূন্যে বার-দুই ঘুরিয়ে সে বলে ওঠে,—কিন্তু বেগম সাহেবা, আল্লার কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নিয়ে তোমাকে জানাই, এর পরের আর কোনও ঈদই দেখার সৌভাগ্য হবে না তোমার। কালকের চাঁদটি কেমন উঠবে তাও দেখবে না।

বেগম আর্তনাদ করে ওঠে।

চোখের সামনে একজন নারীকে হত্যা করা হবে। কয়েক মুহূর্ত বাকি। কী করব ভেবে পাই না। নারীহত্যাকারীদের আমি ঘেন্না করি। অথচ শায়েস্তা খাঁকে আমি শ্রদ্ধা করি তাঁর বিদ্যা বুদ্ধি আর সাহসের জন্যে।

সামনে এগিয়ে যাই। ধীরে ধীরে বলি,—খাঁ-সাহেব কি তাঁর বেগমকে নির্জনে অস্ত্রবিদ্যা শিক্ষা দিচ্ছেন?

কেঁপে ওঠে পুরুষের দেহ। আমাকে সসম্মানে কুর্নিশ করে হেসে খাঁ সাহেব বলে,–ঠিকই ধরেছেন বাদশাহ-বেগম

—কিন্তু এ উদ্যান শুধু হারেমের জন্যে। আপনার বেগম এলেন কী করে? আর আপনিই বা এলেন কেমনভাবে?

—অপরাধ হয়েছে বাদশাহ্-বেগম। শাস্তি দিন। আমার ধারণা ছিল সন্ধ্যার পর সাধারণত উদ্যানে কেউ থাকেন না।

—আপনাদের অবগতির জন্য জানানো হচ্ছে সারারাতও এখানে কেউ থাকতে পারে। সবকিছু নির্ভর করে শাহজাদী আর বেগমের মর্জির ওপর।

—ঠিক বলেছেন। এখনি চলে যাচ্ছি।

—প্রহরীরা আপনাদের দেখে ছেড়ে দিলেও আসার চেষ্টা করবেন না ভবিষ্যতে। শায়েস্তা খাঁ চলে যায়। তাকে অনুসরণ করে তার বেগম। শুধু আমার জন্যে সে বেঁচে গেল। বেঁচে গেল সারা জীবনের জন্যে হয়তো। কারণ খাঁ-সাহেব যত ঘৃণাই করুক না কেন তাকে, চতুর হলে তলোয়ারের খেল আর দেখাবে না তার ওপর।

.

যা আশঙ্কা করেছিলাম, শেষে তাই হল। বাদশাহ্ শয্যা নিলেন। স্পষ্ট শুনতে পেলাম, ভারতের চারদিক থেকে উঠেছে অস্ত্রের ঝনঝনানি। রোশনারা অতিমাত্রায় ব্যস্ত। খবর পেলাম মীরজুমলা আর আমিন খাঁয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখছে সে। আওরঙজেব প্রায় প্রতিদিনের খবরই পাচ্ছে বোধ হয়। ওদিকে গুজরাটে মুরাদের মতো ভালমানুষও রণহুঙ্কার ছেড়েছে। সুজা তো তৈরি। বাংলাদেশ অনেক দূরে। তাই সে চঞ্চল।

এই অবস্থায় রাজার অভাব অতিমাত্রায় অনুভব করি। আজ যদি সে আমার পাশে থাকত, কোনও কিছুতেই বিচলিত হতাম না। দারাশুকো দায়িত্বের সমস্ত বোঝা একা বইতে পারবে কিনা জানি না। সে এখন বাদশাহের সব ক্ষমতাই পেয়েছে—শুধু ময়ূরাসন ছাড়া। হস্তীযুদ্ধের আদেশও সে দিচ্ছে—যে আদেশ বাদশাহ্ ছাড়া আর কেউ দিতে পারে না। আত্মতৃপ্তিতে দারা ভরপুর। রানাদিলের সামনে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরে সে গর্বিত। কিন্তু এ গর্ব যে কতটা ক্ষণভঙ্গুর, তার মতো বিদ্যান লোক জেনেও, হৃদয় দিয়ে অনুভব করার চেষ্টা করছে না। বরাবরের কল্পনা-বিলাসী সে। কল্পনার ঘাড়ে চেপে আরও কতদূর অগ্রসর হবে কে জানে।

দারার হুকুম মেনে চলতে আমির-ওমরাহদের মধ্যে স্পষ্ট বিরক্তির চিহ্ন ফুটে ওঠে। খুবই অশুভ লক্ষণ। এ সমস্ত মীরজুমলার কৌশল। ধীরে ধীরে সে কুটনীতির বিষ প্রয়োগ করেছে সবার মনে। দারা বিধর্মী—সে কাফের। এর চাইতে ভাল অস্ত্র আর হতে পারে না।

সব বুঝি। অথচ বিশেষ কিছু করতে পারি না। বাদশাহের মনে বজ্র আর কুসুমের মেলামেশা। দারার মনে শুধুই কুসুম। বজ্রের সাক্ষাৎ পাওয়া কঠিন।

মীরজুমলা। পারস্য থেকে এসেছিল একদিন। গোলকুণ্ডার পথে জুতো বিক্রি করত। পাকে-চক্রে শেষে একদিন দরবারে স্থান পেল! প্রথম দিনেই লোকটিকে আমার ভাল লাগেনি। বাদশাহকে সাবধান করে দিলাম। তিনি শুধু কান দিয়ে শুনলেন। কারণ মমতাজ বেগমের পর অনেক দিন অতিবাহিত হয়েছিল তখন! তাই আমার পরামর্শ আর আমার কথার মধ্যে তখন হয়তো মমতাজের ছায়া পাননি। একদিন দেখলাম তিনি মীরজুমলাকে দুর্লভ সম্মানে ভূষিত করলেন। উপাধি দিলেন ‘মুয়াজুম খাঁ’। সেদিন আমি সত্যিই বিষাদে অভিভূত হয়েছিলাম।

আজ সেই মুয়াজুম খাঁ বিষদাঁত দেখাতে শুরু করেছে। তাঁর পুত্র আমিন খাঁও গোখরোর বাচ্চার মতো কিবিল করছে। অদৃষ্টের পরিহাস ছাড়া আর কী বলব একে?

নানান্ চিন্তায় ভারাক্রান্ত মনে পিতার শয্যার পাশে গিয়ে দাঁড়াই। তিনি তাঁর ডান হাতখানা বাড়িয়ে দেন। আমি বুঝতে পারি কেন তিনি বাড়িয়ে দিলেন হাতখানা। আজকাল অনেক সময় মুখে কিছুই বলেন না।

আমি ঘ্রাণ নিয়ে বলি—আছে বাবা। প্রথম দিনের মতোই আপেলের গন্ধ। একটুও কমেনি।

মুখ তার উজ্জ্বল হয়ে ওঠে,—তবে মরব না, কী বলিস?

আমি সায় দিই।

বহুক্ষণ অসাড় হয়ে পড়ে থাকেন তিনি। কোনও কথা বলেন না। আমি তাঁর শয্যার পাশে বসে তাঁর মুখের দিকে চেয়ে থাকি। সে মুখে প্রতিমুহূর্তে অভিব্যক্তির পরিবর্তন। তাঁর মন কাজ করে চলেছে অবিরত—তারই প্রতিচ্ছবি।

শেষে এক সময়ে নিজেই বলে ওঠেন,—ইয়া তক্ত, ইয়া তাবুত

চমকে উঠি আমি। বলি,—হঠাৎ একথা বললেন, কেন?

মৃদু হাসেন তিনি। বলেন,—আমি যেন স্বপ্ন দেখছিলাম জাহানারা, আমার চার ছেলে ময়ূরাসনের সম্মুখে সাংঘাতিক এক যুদ্ধে লিপ্ত। যুদ্ধ করতে করতে মাঝে মাঝে উন্মাদের মতো চেঁচিয়ে উঠছে—ইয়া তক্ত, ইয়া তাবুত। সে যে কী ভীষণ যুদ্ধ না দেখলে কল্পনা করা যায় না। আমার বুক ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছিল। এক এক জনের গায়ে আঘাত লাগছিল, আর আমার বুক থেকে রক্ত ঝরছিল। চেঁচিয়ে বলতে গেলাম,—তোরা থাম্। তোদের আমি ভাগ করে দিচ্ছি। ভারতবর্ষ খণ্ডিত হোক, কিন্তু তোরা বেঁচে থাক। তোরা যে মমতাজের ছেলে। শুনল না। কেউ শুনল না। একই ভাবে চেঁচিয়ে উঠল,–হয় সিংহাসন, নয় মৃত্যু। জাহানারা আমি কী করব বলতে পারিস? তোর মা হলে কী করত, বলত?

বাদশাহ্ হাঁপাতে থাকেন। তাঁর সারা গা ঘামে ভিজে ওঠে। আমি মুখ নিচু করে ভাবতে থাকি।

—চুপ করে রইলি কেন জাহানারা?

—বাবা, দেশকে খণ্ডিত করার পক্ষপাতী আমি নই। তার চেয়ে বরং মমতাজ বেগমের তিন পুত্রের দেহ ক্ষতবিক্ষত হোক।

চোখ দুটো বড় হয়ে ওঠে বাদশাহের। যেন বিশ্বাস করতে পারেন না কথাগুলো আমিই বললাম।

—তুই—শেষে এই কথা বললি?

—হ্যাঁ বাবা। ওদের চেয়ে দেশ বড়। এ কথা কি অস্বীকার করা যায়? ভারতবর্ষে বহু বংশ রাজত্ব করে গিয়েছে। সবারই এক ছেলে ছিল না। কিন্তু ভাইদের মধ্যে মনোমালিন্য না ঘটেও একজনই সিংহাসনে বসেছে, এ বিরল নয়। তোমার ছেলেদের সে শিক্ষা হয়নি—তুমি দাওনি। তার জন্যে সারা দেশ ভুগতে পারে না। আত্মকেন্দ্রিক না হয়ে শুধু স্বপ্ন না দেখে, ওদের মধ্যে যদি ছেলেবেলা থেকে ভ্রাতৃপ্রীতি জাগিয়ে তুলতে পারতে তবে স্বপ্ন সত্যি হবার কিছুমাত্র সম্ভাবনাও থাকত না। কিন্তু তুমি তা পারোনি। আজ এই শুধু আফশোস করতে পার—আর কিছু নয়।

বাদশাহ্ স্তব্ধ। দেখে মনে হয় আমার কথাগুলো চার দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে খেয়ে বারবার তাঁর কানের মধ্যে প্রবেশ করছে। তিনি অস্থির হয়ে ওঠেন। চোখের পাতা ভিজে ওঠে তাঁর। শেষে ধীরে ধীরে বলেন,—তুই বড় নিষ্ঠুর জাহানারা। এমনভাবে সত্যি কথা কখনো বলতে হয়? আমি যে অসুস্থ।

—তোমাকে ছুঁয়ে শপথ করছি বাবা, তোমার জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত একদিনের তরেও নিজের ইচ্ছেতে তোমাকে ছেড়ে থাকব না। কিন্তু আমার যা সত্যি বলে মনে হবে, তাই বলতে দিও আমাকে। মিথ্যে বাক্য আমাকে দিয়ে বলিও না।

—তাই বলিস! কিন্তু দেখিস, আমার যেন খুব আঘাত না লাগে। যদি বুঝিস আঘাত পাবো, খুব আঘাত পাবো, তবে না হয় চুপ করে থাকিস।

ঠিক সেই সময়ে কোনওরকম খবর না দিয়ে নজরৎ খাঁ কক্ষের ভেতরে প্রবেশ করে। রাগে আর সঙ্কোচে আমি লাল হয়ে উঠি বুঝতে পারি। কারণ পিতার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কথা বলার সময় দারার উপস্থিতিও আমি সহ্য করতে পারি না। বাদশাহের সুবিধার জন্যে অসুস্থ হবার পর তাঁকে বাইরের দিকের এই কক্ষটিতে রাখা হয়েছে, যাতে আমির-ওমরাহেরা খবরাখবর পৌঁছে দিতে পারে কিংবা নিজেরা এসে বাদশাহের পরামর্শ নিয়ে যেতে পারে। কিন্তু তাদের ওপর নির্দেশ রয়েছে দেখা করার আগে অন্তত আগমনবার্তা জানাতে। নজরৎ খাঁ সে নির্দেশ মানেনি।

দু পা এগিয়ে এসে বিগলিত স্বরে সে বলে,—মাফ্ করবেন বাদশাহ্ বেগম। আমি ভেবেছিলাম বাদশাহ্ একা রয়েছেন।

বাদশাহের ভ্রু কুঞ্চিত হয়। তিনি বলেন—কোনও জরুরি খবর আছে নজরৎ?

—হ্যাঁ জাহাঁপনা। শাহজাদা সুজা দু-একদিনের মধ্যেই বাঙলা ছেড়ে এগিয়ে আসবেন।

উত্তেজিত স্বরে বাদশাহ্ বলেন—এ খবর নতুন নয়। আমি জানি সে আসছে। তার ব্যবস্থাও করেছি।

নজরৎ খাঁ যেন হতবাক্। শৃগালের মতো খল হলেও আমার চোখকে সে ফাঁকি দিতে পারবে না।

—আপনি জানেন? আমি ভেবেছিলাম —

কক্ষ ছেড়ে বাইরে গিয়ে দাঁড়াই আমি। ওর উপস্থিতি সহ্য করতে পারি না। কিন্তু সেই মুহূর্তেই বাইরে আসে সে। এত তাড়াতাড়ি আসবে বুঝতে পারিনি। আমাকে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে।

—বাদশাহ্-বেগম।

—বাদশাহের সঙ্গে আপনার কথা শেষ হয়েছে?

—হ্যাঁ। কিন্তু আপনি এমনভাবে কথা বলছেন কেন?

যতটা সম্ভব ভদ্র হবার চেষ্টা করে বলি,—এর চেয়ে ভালভাবে কথা বলবার মতো মনের অবস্থা আমার নেই খাঁ-সাহেব। পিতা অসুস্থ। চারিদিকের সংবাদও আপনার অজানা নয়।

—আমি আছি বাদশাহ্-বেগম। প্রাণ দিয়ে আপনার আর পিতার সম্মান রক্ষা করব। তাঁর মনে যে ইচ্ছাই থাকুক, সে ইচ্ছা পূরণের জন্যে আমি জীবন দেব।

—আপনারাই বাদশাহের ভরসাস্থল!

—কিন্তু একটি প্রার্থনা।

কী প্রার্থনা তা আমি জানি। তাই তাড়াতাড়ি বলি,—অন্য সময় কথা হবে। এখন আমি বড় ব্যস্ত।

নজরৎ সহসা নতজানু হয়ে আমার পায়ের ওপর দুটো হাত রেখে বলে,—ফিরিয়ে দিও না জাহানারা। কতদিন আমি অপেক্ষা করে আছি। আমি যে মানুষ।

প্রহরারত খোজা এই পরিস্থিতি থেকে আমাকে উদ্ধার করে। সে নিয়মমাফিক ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে। নজরৎ উঠে দাঁড়ায়।

—জাহানারা।

—আপনি তো জানেন খাঁ-সাহেব, এভাবে কথা বললে আমি বিরক্ত হই।

—বিরক্ত? ও। কিন্তু ছত্রাশাল যদি একথা বলত?

—তাহলে আমি কী করতাম, সে কথা দেখছি আপনার জানা আছে। শুধু শুধু প্রশ্ন করছেন কেন তবে?

—বেশ। মনে থাকে যেন বাদশাহ্-বেগম

—বাদশাহ্-বেগমের সঙ্গে কীভাবে কথা বলতে হয় তা কি জোর করে শিখিয়ে দিতে হবে খাঁ সাহেব?

কুর্নিশ করে দ্রুত চলে যায় নজরৎ। সেদিক পানে চেয়ে বুঝতে পারি দারাশুকোর একজন পরাক্রমশালী শত্রু বাড়ল। কিন্তু উপায় নেই।

পরদিন প্রাতেই আমার সবচাইতে প্রিয় এবং শিক্ষিত কপোতটিকে তার ঘর থেকে বের করি। গায়ে হাত বুলিয়ে দিই। গালের সঙ্গে গাল ঠেকাই। তারপর তার পায়ে একটি ছোট্ট চিঠি বেঁধে প্রথম সূর্যের আলোয় একটি মিনারের পাশ থেকে যমুনার দিকে উড়িয়ে দিই। চিঠিতে লেখা ছিল : তোমার জিনিসটিকে যে সবাই ছিনিয়ে নিতে চায় রাজা। তুমি নিশ্চিন্তে বসে আছো? খুব তাড়াতাড়ি এসো। বড় বিপদ।

এই দুর্দিনে দারা আর এক কাণ্ড করে বসল।

দিল্লির বাজারে প্রতি বছরই পশ্চিম দেশের স্ত্রী-পুরুষের চালান হয়। সে সময়ে বাজারে আমির-ওমরাহদের ভিড় বাড়ে। মুসলমান নারীরা পর্দানশীন। নইলে, আমি হলফ করে বলতে পারি, নারীদের ভিড়ও কম হত না। অমন দুধে-আলতা রঙের রক্তমাংসের মানুষকে শুধু মোহরের বদলে সারাজীবন নিজের করে নেবার আদিম প্রবৃত্তি সবার মনেই সুড়সুড়ি দেয়। দুর্ভাগ্য নারীদের। তেমনি সৌভাগ্য আমির-ওমরাহ্ আর শাহজাদাদের। প্রায় প্রত্যেকের অন্তঃপুরে সে দেশের যুবতীরা ঘর আলো করা রঙ নিয়ে বর্তমান। সুজার তো নেশাই ছিল ক্রীতদাসী ক্রয় করা। কিন্তু দারার ওসব বাতিক ছিল না।

সেই দারা একদিন বাজার থেকে নিয়ে এল একজনকে। হারেমের প্রবেশ পথে নাদিরা পথ রোধ করে দাঁড়ায়। সে সময়ে আমিও ছিলাম নাদিরার পাশে।

দারা থতমত খেয়ে প্রশ্ন করে,এ কী করছ নাদিরা?

—রানাদিল্ হারেমে স্থান পাওয়ায় তোমার স্পর্ধা বেড়েছে। নাদিরার নাসারন্ধ্র স্ফীত হয়ে ওঠে। দারার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে আগে কখনো দেখিনি তাকে। কল্পনাও করিনি এ রকম দৃশ্য। একটু অবাক হই। আবার ভাবি বয়স যত বাড়ে, নারীর লজ্জা সংকোচ আর সৌন্দর্য ধীরে ধীরে ঝরে পড়তে থাকে। এতে অবাক্ হবার কিছু নেই। নাদিরা মানবী। দুই পুত্র আর এক কন্যার মা সে। সহ্যের একটা সীমা আছে তার। হয়তো সে আগের মতোই লজ্জাশীলা থাকতে পারত—কিন্তু দারার অবিবেচনা তাকে থাকতে দিচ্ছে না।

নাদিরার দিকে চেয়ে অসহিষ্ণু স্বরে দারা বলে ওঠে, আঃ, তোমার ছেলেমানুষি গেল না। এ তো বেগম হতে যাচ্ছে না। এ যে ক্রীতদাসী।

দুঃখের হাসি হেসে নাদিরা বলে,—অমন অনেক আগুন-রঙের ক্রীতদাসী হারেমে আগুন জ্বালিয়েছে শাহজাদা। তাছাড়া, তোমাকে যে আগের মতো বিশ্বাসও করতে পারি না।

—তাই বলে নাজীর হিসেবেও ঠাঁই পাবে না হারেমে?

—না।

দারা মিনতি-ভরা দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে বলে,—বাদশাহ্-বেগম, হারেমের কর্ত্রী নাদিরা হল কবে থেকে?

—এ ক্ষেত্রে নাদিরার ইচ্ছাই, আমার ইচ্ছা দারা।

দারার মুখে হতাশা ফুটে ওঠে।

—তোমার লজ্জা হয় না দারা? দেশের দিকে একবার তাকিয়ে দেখো কখনো? সুজার মতো শৌখীন মানুষও ধেয়ে আসছে দিল্লির দিকে। তোমার নিজের পুত্র গিয়েছে তাকে বাধা দিতে। আর তুমি? উপযুক্ত পুত্রের পিতা হয়ে কী করছ? ছি ছি! তুমি পণ্ডিত, তুমি চিন্তাশীল, তুমি দাতা—তোমার গুণের অন্ত নেই। অথচ কিছুদিন থেকে বড় বেশি আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠেছ। যদি দৃষ্টিকে সামান্য একটু বাইরের দিকে মেলে দিতে তাহলে ক্রীতদাসের বাজারে গিয়ে ভিনদেশি সুন্দরীদের হাত ধরে টানাটানি করতে না।

—কিন্তু —

—কোনও ‘কিন্তু’ নয়। আমার কথা তুমি অস্বীকার করতে পার? নীরবে দাঁড়িয়ে থাকে দারা। নাদিরার দিকে ঘুরে দাঁড়াই আমি। ইচ্ছা করে যতটা পারি নাসিকা কুঞ্চিত করি। তারপর বলি,—নাদিরা, এই বিদেশিনীকেও হারেমে ঠাঁই দাও। দেখিয়ে দাও পুরুষেরা হীন আত্মকেন্দ্রিক হলেও নারী তা নয়। নারীর ভালবাসা দেহসর্বস্ব নয়। একদিন আসবেই যখন দারা নিজের ভুল বুঝতে পারবে। সেদিন পৃথিবীর সব নারীকে ছেড়ে তোমার এই পা-দুখানির সামনে লুটিয়ে পড়বে।

পাষাণ-প্রতিমার মতো নাদিরা দাঁড়িয়ে থাকে।

প্রশ্ন করি,–রাজি আছো নাদিরা?

দীর্ঘশ্বাস ফেলে খুব আস্তে আস্তে সে বলে,—হ্যাঁ। আমারই ভুল হয়েছিল বাদশাহ্ বেগম। ভুলে গিয়েছিলাম দুর্ভাগ্যবশত আমি মুঘল-শাহজাদার বেগম হয়েছি।

দারার মুখের সব রক্তটুকু অন্তর্হিত হয়। সে বোবার মতো চেয়ে থাকে তার সব চাইতে পুরাতন বেগমের দিকে।

—দাঁড়িয়ে আছো কেন দারা? নিয়ে যাও তোমার নতুন বেগমকে

—থাক্ জাহানারা। একে না হয় বাইরেই কোথাও রেখে আসি।

—না। বাইরে রেখে এসে এই দুর্দিনে সব সময় সেখানে বসে ওর রূপসুধা পান করা চলবে না। যা কিছু করতে চাও হারেমে করো। কারণ তুমি হতভাগ্য বাদশাহের জ্যেষ্ঠপুত্র। স্নেহান্ধ বাদশাহ্ সময়ে-অসময়ে তোমার উপস্থিতি কামনা করেন।

দারা তার ঠোঁট কামড়ে ধরে প্রশ্ন করে, –আমি কি সত্যিই এতটা নীচে নেমে গিয়েছি জাহানারা?

—আমি সামান্য নারী দারা। যা বলি, হয়তো ভাবাবেগে বলি। আমার কথার মূল্য কতটুকু? সময়ে সব কিছুরই বিচার হবে। তবে তখন আমরা কেউ-ই থাকব না। কিন্তু এটুকু বলতে পারি, নাদিরার মতো বেগম পেয়ে যে পুরুষ অন্য নারীকে বেগমের মর্যাদা দেবার জন্যে ছট্‌ফট্ করে সে পণ্ডিত হলেও মূর্খ। সে উদার হলেও হীন। আমি বলছি না, যে পুরুষ হয়ে শাহজাদা হয়ে, তুমি আজীবন শুধু নাদিরার আশেপাশে ঘুরে ঘুরে মর। তবে একটু কৌশলী হলে নাদিরার সম্মান অটুট রেখেও তোমার উৎকট প্রবৃত্তির তুষ্টিসাধন করতে পারতে। রানাদিলের সময় একথা আমার মনে হয়নি। কারণ তার চোখে দেখেছি তোমার প্রতি এক গভীর প্রেমের জ্যোতি। কিন্তু একে দেখে আমি সন্তুষ্ট হতে পারছি না। নাদিরাও হয়তো সন্তুষ্ট হতে পারেনি। তাই এবারে কান্নায় ভেঙে না পড়ে রুখে দাঁড়িয়েছে। এই বিদেশিনী ঘর সাজাবার সামগ্রী। ভুলেও ভেবো না, এ কোনওদিন একান্তভাবে তোমার হবে। যেখানে শক্তি, যেখানে মধু, সেখানেই ছুটে যাবে এ। এর কাছে হৃদয়ের মূল্য কানাকড়িও নয়।

—এইটুকু দেখেই এত কথা বলে দিতে পারলে?

—আমিও নারী দারা। নারীকে চিনতে একটি মুহূর্তই যথেষ্ট। নিয়ে যাও হারেমে। যথেষ্ট সময় নষ্ট হয়েছে।

—কী নাম দেব?

—উদীপুরী বেগম।

—এ তো কথা বলতে পারে না।

—সে ব্যবস্থা আমি করছি। প্রেম-নিবেদনের ভাষাটা অন্তত যাতে তাড়াতাড়ি রপ্ত করতে পারে সেদিকে নজর রাখব।

নাদিরা বিদ্রুপের হাসি হেসে ওঠে। দারার মুখখানা লাল হয়ে যায়। সে তাড়াতাড়ি উদীপুরী বেগমকে নিয়ে ভেতরে চলে যায়। নাদিরা সেদিকে ফাঁকা দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে।

পুরুষেরা সত্যই অদ্ভুত! কিন্তু আমার রাজা? ছত্রশাল? সে অদ্ভুত নয়—অপূর্ব!

আমার বয়স হয়েছে। নিশ্চয়ই হয়েছে। পিতার বার্ধক্য দেখে বুঝতে পারি আমার বয়স হয়েছে। দাদার মুখের আবছা রেখা দেখে বুঝতে পারি আমার বয়স হয়েছে। আর বুঝতে পারি, সাম্প্রতিক ঘটনার জন্যে। দারার পুত্র সুলেমানশুকো এক বিরাট সৈন্যদলের নায়ক। সেদিনের ছেলে সুলেমান। যাকে দুধ খাওয়াতে না পারলে নাদিরার স্তনজোড়া টনটন করত। ভাবতে আনন্দ হয়। আবার সংকোচে স্বীকার করছি, ভয় হয়। রাজার সঙ্গে কতটুকু মিশেছি আমি? এর মধ্যেই সে যদি আমাকে পেয়ে মহতাব-বাগের সন্ধ্যার মতো উন্মত্ত হয়ে ওঠে, তবে কীসের আনন্দ? সে আমাকে ভালবাসে, চিরকাল বাসবে। কিন্তু সে যদি আমাকে পেয়ে পাগল না হয়, তবে যে লজ্জায় মরে যাব। সুলেমান আজ সেনাপতি, সে আজ প্রায় যুবক। আমি আর নিজেকে কীভাবে যুবতী বলে ভাবি।

আরশির সামনে দাঁড়ালে বুঝতে পারি, যৌবন যেন স্থায়ীভাবে বাসা বেঁধেছে আমার দেহে। কিন্তু তবু কি একটু স্থূলাঙ্গী মনে হয় না নিজেকে? কোমর কি আগের মতোই সরু। জানি না। জানার জন্যে তীক্ষ্ণ নজর রাখতে ভয় হয়। রোশনারা বলতে পারত। কিন্তু তাকে এ-ব্যাপারে প্রশ্ন করা যায় না। আমি যে বাদশাহ্-বেগম। আমার সম্মান আকাশ-ছোঁয়া। তাই মনে মনে জ্বলে পুড়ে মরি।

শুধু নাজীরকে ডেকে নির্দেশ দিই রুটি আমি একখানার বেশি খাব না। গোস্ত খাব নামমাত্র আমার খাবার প্রধানত মেওয়াখানা থেকে আসবে। শরীরের ওজন কমাতেই হবে। রোশনারা ঈষৎ স্থূল হয়েছে। সে শরীরের দিকে বিশেষ নজর দিতে পারছে না। তার নজর এখন দক্ষিণ ভারতের দিকে। আওরঙজেব যদি আমার ভাই না হত তবে রোশনারাকে দূর করে দিতাম।

রোশনারার পরামর্শে আমিন খাঁ রটিয়েছে শাহানশাহ্ শাহজাহান মৃত। রাজধানীর অনেকেই কথাটা বিশ্বাস করতে শুরু করেছে। তাদের ধারণা দারাশুকো বাদশাহের মৃত্যু সংবাদ গোপন রেখেছে। কারণ, প্রকাশ পেলে তক্ত-তাউস নিয়ে রক্তারক্তি হবে। সবার বুক কাঁপে। একটা সাংঘাতিক কিছু আসন্ন।

ঠিক সেই সময়ে এক সন্ধ্যাবেলায় বাদশাহ্ ডেকে বলেন,–আয় তো জাহানারা তুলে ধরত আমাকে।

তাড়াতাড়ি কাছে গিয়ে বলি,—তুমি পারবে না বাবা।

—পারব না? আমি পারব না? ভুলে যাসনে আমি শাহানশাহ্ শাহজাহান। আমি ইচ্ছে করলে সব পারি। আয়।

পিতার ধমকে ভীত হই। তাঁর কণ্ঠস্বরে এ দৃঢ়তা বহু বছর শুনিনি। ভুলেই গিয়েছিলাম। স্মৃতিতে ভেসে ওঠে আমার ছেলেবেলার কথা। তখন বাদশাহের প্রতিটি কথাতেই ছিল ঠিক এইরকম জোর। মুখে ছিল তাঁর সংকল্পের দৃঢ়তা। আজও দেখলাম সেই দৃঢ়তার ছাপ

হাকিম বলেছে, চুপচাপ শুয়ে থাকতে। নড়লে ক্ষতি হতে পারে। অথচ আমি তাঁর গায়ে হাত দিতেই তিনি আমার কাঁধের ওপর বাঁ-হাতখানা ফেলে দিয়ে বলেন,—পারবি তো?

—চেষ্টা করি।

—হ্যাঁ। তাই কর। ছেলেদের হাতের পুতুল হতে পারব না। শাহানশাহ্ শাহজাহান ছেলেদের হাতের পুতুল! হাঃ হাঃ হাঃ।

চমকে উঠি।

—ওকি, কেঁপে উঠলি কেন? আমি পাগল হইনি। ঠিক উঠব আজ। দেশের সবার সামনে গিয়ে দাঁড়াব। তারা দেখবে, আমি মরিনি। বেঁচে আছি। তাদের মতোই বেঁচে আছি।

এরপরে এক আশ্চর্য ঘটনা ঘটল। আমার ওপর সামান্য ভর দিয়ে সত্যিই তিনি উঠে দাঁড়ালেন। আমি কথা বলতে পারি না। আনন্দে বিস্ময়ে আমি মূক! বাদশাহ্ও নবজীবন পেয়ে খুশিতে বিহ্বল।

ঠিক সেই সময় দ্বারা প্রবেশ করে ঝড়ের বেগে। কিন্তু বাদশাহের দিকে নজর পড়তেই সে থেমে যায়। পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকে।

বাদশাহের মুখে মৃদু হাসি। তিনি একবার আমার দিকে, একবার দারার দিকে চেয়ে—শেষে আমাকে ছেড়ে দিয়ে ধীরে ধীরে দারার দিকে এগিয়ে যান।

দারা ছুটে এসে তাঁকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ওঠে। সেই মুহূর্তে যদি ভারতের সবাই উপস্থিত থেকে দৃশ্যটি দেখত, তাহলে বিশ্বাস করত যে দারাই একমাত্র পুত্র যে ময়ূরাসনের চেয়ে বাদশাহ্ শাহজাহানকে বেশি ভালবাসে। শত দুর্বলতা আর অক্ষমতা সত্ত্বেও কেন যে বাদশাহের স্নেহের প্রধান ধারা তার উপর বর্ষিত হয় এই মুহূর্তে আমি পরিপূর্ণভাবে হৃদয়ঙ্গম করলাম। আমার চোখে জল আসে। কতক্ষণ পার হয় জানি না। দারা একসময়ে বাদশাহকে ধরে এনে শয্যার ওপর বসিয়ে দেয়। তাঁর পায়ের কাছে সে নতজানু হয়ে বলে,—আওরঙজেব এগিয়ে আসছে।

আসুক। আমি যখন সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছি তখন হাজার আওরঙজেব এলেও ধুলোর মতো উড়ে যাবে।

—আপনি কি পারবেন? দারা প্রশ্ন করে।

—এখনো অবিশ্বাস?

—না। কিন্তু কঠিন পরিশ্রমে যদি আবার অসুস্থ হয়ে পড়েন? তার চেয়ে আপনি চলে-ফিরে বেড়ান, এই যথেষ্ট। লোকে তো জানল আপনি সুস্থ আছেন

—না। আমার কথার নড়চড় হবে না। পরশু রওনা হব আগ্রার পথে।

দারা আর আমি পরস্পরের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকি। কিন্তু কোনও প্রতিবাদ করতে পারি না। সে সাহস আমাদের হয় না।

.

আকুল প্রতীক্ষায় থেকে শেষে হতাশ হলাম। আমার চিঠির উত্তর পেলাম না রাজার কাছ থেকে। আমার প্রিয় কপোতটিও আর ফিরে এল না। দুর্ভাবনা হল। হয়তো পথের মধ্যে কপোতটির মৃত্যু হয়েছে। হয়তো ঝড়ের মধ্যে পড়ে নিজেকে বাঁচাতে পারেনি। কিংবা কঠিন দায়িত্বের বোঝা নিয়ে যাবার সময় তৃষ্ণা পেলেও জল খায়নি। বুকের ছাতি ফেটে মরেছে। চিঠিখানা বেহাত হলে কোনও ভয় নেই। নীচে নাম লিখিনি। ওপরে সম্বোধন করিনি কাউকে। রাজা আমার হাতের লেখা চেনে। সে আমার কপোতটিকেও চেনে।

আশঙ্কা হয়, রাজার কোনও অমঙ্গল হয়নি তো? নজরৎ খাঁ যেভাবে সেদিন বিদায় নিল, তারপরে সবকিছু হওয়াই সম্ভব। রাজা দুর্বল না। নিজেকে রক্ষা করার মতো পর্যাপ্ত শক্তি তার রয়েছে। তবু হীন ষড়যন্ত্রের কাছে তার মতো বিরাট হৃদয়ের পুরুষ প্রায়ই পরাস্ত হয়। ইতিহাসের পাতায় এমন নজিরের অভাব নেই।

অস্থির হয়ে ওঠে মন। ভেতরটা কেমন আনচান করে।

সেই অবস্থাতেই দিল্লি ত্যাগ করি। যাবার আগে হায়াত্বক্স-বাগ আর মহতাব-বাগের দিকে সজল নয়নে চাই। আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে এখানে। অথচ যখন প্রথম এসেছিলাম, তখন কোনও স্মৃতিই ছিল না এদের বুকে।

জীবনের পরবর্তী অধ্যায়ে কী লেখা আছে জানি না। জানতে চাই না। শুধু একটি প্রার্থনা আমার আল্লার কাছে—রাজা যেন সুস্থ থাকে। সে যেন দীর্ঘজীবী হয়। আর একটিবার যেন অন্তত সে আমার জীবনে উদিত হয়ে আমার দেহমনের সব শৃঙ্খলা ভেঙে দিয়ে যায়। আর কিছুই চাই না।

পথিমধ্যে খলিলুল্লা খাঁ আর শায়েস্তা খাঁ বার বার বাদশাহের সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করে। তারা চিন্তাক্লিষ্ট—তারা উদ্বেগাকুল।

তাদের এই উদ্বেগের কারণ আমি আন্দাজ করতে পারি কিন্তু বাদশাহকে বলতে পারি না। তিনি হয়তো আমার কথা বিশ্বাস করবেন না। তাই উভয় খাঁ-সাহেবকে বাদশাহের কাছ থেকে দূরে রাখার যে সহজ উপায় তাই আমি বেছে নিলাম। বাদশাহের পাশে তাঁর শকটের মধ্যে গিয়ে বসলাম। ছট্‌ফট্ করে মরুক ওরা।

কিন্তু আমার সব সাবধানতা বিফলে গেল। ওরা অন্য পথ নিল। বাদশাহের কাছে ভিড়তে না পেরে দারাকে গিয়ে ধরল। তাকে বোঝাল বীরত্ব প্রকাশের এবং প্রজাদের শ্রদ্ধা আকর্ষণের এমন সুযোগ সে আর পাবে না। বাদশাহকে আওরঙজেবের বিরুদ্ধে অভিযানে না পাঠিয়ে তার নিজেরই যাওয়া উচিত। দারা তাই বুঝল। খলিলুল্লা খাঁ আর শায়েস্তা খাঁয়ের মতো চির পরিচিত গুণী লোকদেরও যে অনেক সময়ে অবিশ্বাস করতে হয় একথা তাকে বোঝাতে পারলাম না। অনেক চেষ্টা করেও পারলাম না আমি।

তাই এক সন্ধ্যায় বাদশাহের শিবিরে এল সে। আমি জানতাম সে আসবে—তাই আগে থেকেই উপস্থিত ছিলাম।

আমাকে দেখে দারা একটু অসন্তুষ্ট হল। হোক। নিজের যতটুকু সামর্থ্য আছে আমি কাজে লাগাব। কিন্তু দারাও দেখলাম বেশ চতুর হয়ে উঠেছে। হাসিমুখে সে এমন কথার উত্থাপন করল যে আমি থ হয়ে গেলাম।

সে বলল,—জাহানারার একটা ব্যবস্থা করতে হয় এবারে।

বাদশাহ্ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তার দিকে তাকান।

দারা বলে,—সারা জীবন একে মুঘল-হারেমে বাদশাহ-বেগম করে রেখে লাভ নেই। এতে সম্মান আছে প্রচুর, কিন্তু শান্তি নেই।

—কী করে বুঝলে? বাদশাহ্ প্রশ্ন করেন।

—খুবই স্বাভাবিক। কেউ এভাবে ছন্নছাড়া জীবন কাটাতে পারে না। এ যেন বালির ওপর প্রাসাদ গড়া। জাহানারার একটা স্থিতি হওয়া প্রয়োজন।

—কী রকম?

—সারা পৃথিবীতে একটি মানুষকে পেলে ও সব কিছু ফেলে হিন্দুদের মতো হিমালয়ে গিয়েও থাকতে পারে।

—তাই নাকি? কে সে ভাগ্যবানটি? বাদশাহের কণ্ঠস্বরে রসিকতা। যদিও আমার বুক কাঁপে।

—বুন্দীরাজ ছত্রশাল।

বাদশাহের শয্যার একপাশে আমি বসে পড়ি। দারা আমাকে নিশ্চেষ্ট করার শ্রেষ্ঠ অস্ত্র নিক্ষেপ করেছে।

বাদশাহ্ কিছুক্ষণ গম্ভীর হয়ে থাকেন। আমি তাঁর দিকে চাইতে পারি না। দারার কথাকে তিনি কীভাবে নিলেন আমি জানি না। শেষে তিনি বলেন,—জাহানারার নির্বাচনের তারিফ করতে হয়। একথা আমি কখনো ভাবিনি।

—আপনার মত আছে?

—আছে। হিন্দু বলে প্রশ্ন করছ তো? হোক হিন্দু। হিন্দুদের সঙ্গে মুঘলবংশের সম্বন্ধ এই প্রথম নয়। অনেক দিয়েছে জাহানারা। যদি সত্যই সে ছত্রশালকে পেতে চায়, আমি সব ব্যবস্থা করে দেব।

আমি কেঁদে ফেলি।

আমার কান্নার দিকে চেয়ে বাদশাহ্ বলেন—এতদিন বলিসনি কেন জাহানারা? এতে সঙ্কোচের কী আছে!

কোনও কথা বলতে পারি না। চোখের সামনে ভেসে ওঠে রাজার সুন্দর মুখ আর সুঠাম দেহ। আমি যেন আর সহ্য করতে পারি না। এতখানি নির্লিপ্ত হবার পর একটু একা থাকতে চাই—একা ভাবতে চাই। দারা বাদশাহের কাছে কোন্ কথা উত্থাপন করবে জেনেও আমি তাঁর শিবির ছেড়ে নিজের শিবিরে চলে আসি। আমি নারী।

একান্তে বসে বসে দারার প্রতি শ্রদ্ধায় আমার মন ভরে ওঠে। যদিও তাকে অশ্রদ্ধা করার মতো কোনো কারণই নেই। সে বিরাট পণ্ডিত—সারা হিন্দুস্থানে তার মতো সব ধর্মের প্রতি দখল বোধ হয় কারও নেই। সে হিন্দুধর্মের শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ উপনিষদের অনুবাদ করে ‘রাফিজী’—বিধর্মী আখ্যা মাথা পেতে নিয়েছে। যার ফলে এত ভাল হয়েও সে অধিকাংশ আমির-ওমরাহের চক্ষুশূল। তার সঙ্কলিত ‘সর-ই আসবার’ এক অপূর্ব গ্রন্থ। এমনকী সে খ্রিস্টধর্ম নিয়েও গভীর পড়াশুনা করেছে। আজকাল তাকে যেন সেই দিকেই বেশি ঝুঁকতে দেখি। শুধু পণ্ডিত নয়—সে শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা। কোথায় লাগে মুরাদ। কোথায় লাগে আওরঙজেব আর সুজা। যদি বীরত্বের পরীক্ষা হয়—যদি সম্মুখ যুদ্ধ হয়, তবে দারার বীরত্ব সবাইকে ছাপিয়ে যাবে।

কিন্তু দারা সরল। তার মনে ময়লা নেই, নীচতা নেই, দীনতা নেই। স্বভাবতই সে সবাইকে বিশ্বাস করে। শুধু এই একটি কারণে আমি তাকে সবার চেয়ে দুর্বল বলে ভাবি। এই কারণেই আমার এত ভয় হয়। তাই আমি ওকে সুযোগ পেলেই তিরস্কার করি। নইলে সে তিরস্কারের ঊর্ধ্বে। নাদিরা অবধি একথা জানে। রানাদিকে তাই সে বুকে টেনে নিয়েছে। উদীপুরী বেগমের মতো মেকি-হৃদয়ের সুন্দরীকেও সে দারার সম্মুখে কখনো অবহেলা করে না।

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *