মমতাজ-দুহিতা জাহানারা – ৫

সংগীতের রস জীবনে প্রথম আস্বাদন করি। এতদিন যাকে সংগীত বলে ভাবতাম সবই ঠুনকো বোধ হয়। মুগ্ধ ভক্তের মতো বসেছিল দারা রাজার সম্মুখে। তার চোখে জলের আভাস।

সংগীত শেষ হবার পরও একটা স্তব্ধতা বিরাজ করে। সুর ভেসে বেড়ায় অনেকক্ষণ।

শেষে দারা উঠে দাঁড়ায়। আমার কাছে এসে বলে,—ছত্রশালের সঙ্গে আজই দেখা করবে জাহানারা?

—হ্যাঁ। অঙ্গুরিবাগে পৌঁছে দিও।

দারা হেসে বলে,—ভুলে যেও না ছত্রশাল হিন্দু।

—তুমি ভুলে যেও না দারা, মুঘল-হারেমেও অনেক হিন্দু রমণী এসেছেন।

—ভুলে যেও না ছত্রশাল বিবাহিত!

—তুমি ভুলে যেও না দারা, শাহজাহানের মমতাজ ছাড়াও অন্য বেগম আছেন।

ভুলে যেও না জাহানারা, নজরৎ খাঁয়ের মতো শক্তিশালী আমিরকে হারালে বাদশাহ্ দুর্বল হয়ে পড়তে পারেন।

—তুমিও ভুলে যেও না দারা, ছত্রশাল নজরৎ-এর চেয়ে কম শক্তিশালী নন।

এতক্ষণ মুচকি হেসে, এবারে জোরে হেসে উঠে দারা বলে,–বেশ, শেষ রক্ষা হলে হয়।

আমি একটু গম্ভীর হই। নজরৎ সব খবরই পাবে। সে সহ্য করবে না। ভায়ে ভায়ে দিনে দিনে যে সম্পর্ক গড়ে উঠেছে তা মোটেই প্রীতির নয়। সুজা বাংলাদেশ থেকে মাঝে মাঝে লোক পাঠিয়ে এখানকার হাল-চাল জেনে নেয়। আওরঙ্গজেবের লোক তো হামেশাই আসে। সে সময়ে রোশনারা খুব ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আওরঙ্গজেবের প্রভাব থেকে তাকে মুক্ত করতে পারিনি। এই সমস্ত সূক্ষ্ম দ্বন্দ্বের ভেতরে অসন্তুষ্ট নজরৎ দরবারে থাকলে বাদশাহ্ আর দারার ক্ষতি ছাড়া অন্য কিছু হতে পারে না। কিন্তু রাজনীতির ওপরেও আর একটি জিনিস রয়েছে—যুক্তিতর্ক ভেসে যায় যেখানে।

—তুমি যদি নারী হতে দারা, তুমি কী করতে? ছত্রশালকে এখান থেকে বিদায় দিতে পারতে? বল, তোমার ওপর নির্ভর করছি।

বেশ কিছু সময় ভেবে নেয় দারা। তারপর বলে,—আমি অন্য কিছু করার কথা ভাবতে পারতাম না। নারী না হয়েও যে মজে গিয়েছি।

এবারে আমার হাসির পালা—তবে?

—আমি ওঁকে অঙ্গুরিবাগে পৌঁছে দিচ্ছি। কিন্তু বাইরে আনার ব্যবস্থা তুমি করবে। খোঁজাদের মুখোমুখি যেন না হন উনি।

—সে চিন্তা আমার।

তাড়াতাড়ি নিজের কক্ষের দিকে ছুটি। ভাল করে সাজতে হবে। যত ভাল করে পারি শরীরের সমস্ত অংশ আতরের গন্ধে ভরিয়ে দিতে হবে। রাজাকে মুগ্ধ করতে হবে। রাজাকে বন্দি করতে হবে। এমনভাবে বন্দি করতে হবে যাতে নিজের রাজ্যে বসেও দরবারে আসার জন্যে মন তার ছটফট করে।

আজ লিখতে বসে বহুদিন পূর্বের এক সন্ধ্যার ছবি স্পষ্ট মনের মধ্যে ভেসে উঠছে। সে ছবির স্মৃতি যেমন মধুর, তেমনি বিষাদময়। দুখানি কিতাব আমাকে আর রোশনারাকে উপহার দিয়েছিলেন, পিতা। রাগে ঘৃণায় ছুড়ে ফেলে দিয়েছিল রোশনারা তার কিতাব। সযত্নে গুলিস্তানের তৃণের ওপর থেকে আমি সেটি তুলে নিয়েছিলাম। কথা দিয়েছিলাম রোশনারাকে, সত্যি কথা লিখব আমি কিতাবে। কথা রেখেছি আমি। যা সত্যি বলে উপলব্ধি করেছি, তাই লিখেছি। অনেক কিছুই বাদ গিয়েছে জানি, কিন্তু উপায় নেই। সব কথা লেখা যায় না।

অবচেতন মনের কোথাও হয়তো রোশনারার প্রতি ছিটেফোঁটা কৃতজ্ঞতা অনুভব করেছি তার কিতাবখানা দেবার জন্যে। তাই হয়তো তার ছবি স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়েনি আমার লেখায় ভালই হয়েছে। সে আমার বোন। মুমতাজ বেগমের গর্ভে তার জন্ম। শুধু শুধু কেন এক ছোপ কালি মাখিয়ে দিই তার মুখে। তাছাড়া আমি লিখছি নিজের কথা। এর মধ্যে রোশনারা আপনা হতে যতটুকু আসে আসুক। চেষ্টা করে আমি আনতে যাব না। কাউকেই আনব না। আনতে গেলে আমার এই রচনা হয়তো ঐতিহাসিক দলিলের গুরুত্ব পেয়ে বসবে। আমি তা চাই না। আমি চাই, ভবিষ্যতের কেউ যদি মুঘল-বংশের গৌরব আর অফুরন্ত ঐশ্বর্যের কথা শুনে বিস্ময়াবিষ্ট হয়, আমার কাহিনি পড়ে সে যেন সেই সঙ্গে একটি দীর্ঘশ্বাসও ফেলে। মুঘল-বাদশাহ্রদের হারেম যে বেহেস্ত হয়, সে যেন মর্মে মর্মে তা অনুভব করে নিজের ক্ষুদ্র কুটিরে বসে শান্তি পায়।

দ্বিতীয় কিতাবে লিখতে বসেছি। কিন্তু কলম যেন কিছুতেই আঁচড় কাটতে চায় না। চলতে চায় না লেখনী। ভেবেছিলাম শুরু করব আমার রাজার সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের ঘটনা নিয়ে। কিন্তু তা পারছি কই? কিতাবখানি সম্ভবত অশুভ মুহূর্তে খুলে বসেছি।

আজ সকালে খবর এল নূরজাহানের বুকের স্পন্দন চিরতরে থেমে গিয়েছে। নাজীর এসে খবরটি দেবার সঙ্গে সঙ্গে ছুটে গেলাম বাদশাহের কাছে। কিন্তু তিনি বড় ব্যস্ত। কয়েকদিনের মধ্যেই আমাদের ছেলেবেলার স্মৃতি-জড়ানো আগ্রার এই প্রাসাদ ছেড়ে চলে যেতে হবে। চিরকালের মতো যেতে হবে। দিল্লি রওনা হব আমরা। আর কখনো এখানে এসে এই অতি মধুর অতি পরিচিত জায়গাগুলি দেখবার সুযোগ হবে কিনা জানি না।

বাদশাহকে নূরজাহানের মৃত্যুসংবাদ জানাতেই তিনি গম্ভীর হয়ে বললেন,–তোমাকে কে বললে?

—হারেমেই খবর পেলাম।

—সব ব্যবস্থা হয়েছে। তুমি ভেবো না।

—কখন যাব?

—কোথায়?

—জেসমিন প্রাসাদে?

—তুমি? না, তুমি না। শুধু দারা।

—আপনি?

—আমিও না।

—বাবা, মস্ত অপরাধ করতে চলেছেন।

—জানি জাহানারা। নূরজাহান বেগম যতদিন জীবিত ছিলেন ততদিনই শুধু আমর শত্রু ছিলেন।

—তাও ঠিক নয়।

বাদশাহ্ চকিত দৃষ্টি ফেলেন আমার দিকে।

—মৃত্যুর আগে মা গিয়েছেন তাঁর কাছে। আমিও গিয়েছি পরে। তাঁর অদ্ভুত পরিবর্তন হয়েছিল। আমার হিতৈষী ছিলেন তিনি।

—হুঁ।

মায়ের কথা বলার পরই নিজের কথা বলায় তাঁর মুখ বন্ধ রইল।

—আজ এ সময়ে—

—না জাহানারা। বাদশাহ্ হতে হলে প্রতি ক্ষেত্রে মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি অনুযায়ী চলা যায় না।

—কিন্তু মৃত্যুটি যে মানুষের স্বাভাবিক পরিসমাপ্তি, বাবা!

—তবু। হারেমে যাও জাহানারা।

চলে আসার জন্য প্রস্তুত হই। তিনি ডেকে নিয়ে বলেন,– চোখের জল মুছে ফেলো।

হতাশ হই। নূরজাহানের মুখখানা বার বার মনে পড়ে। সে মুখ এখন প্রশান্ত, সে আঁখি এখন নিমীলিত। বাদশাহ্ জাহাঙ্গীরের স্মৃতি তাঁর মনকে আর দোলা দিতে পারে না।

নিজের কক্ষে গিয়ে অঙ্গুরিবাগের দিকে চেয়ে থাকি। ওই গুলআশরফী ফুলের পাশে সেদিন রাজাকে কত কথা শুনিয়েছিলাম। নির্বাক হয়ে শুনেছিল রাজা। হয়তো বাচাল ভাবছিল আমাকে। একজন পরপুরুষের সামনে ওভাবে কেউ বলতে পারে না। ভাবুক বাচাল। তার পরের ঘটনা তো প্রমাণ করে দিয়েছিল ছত্রশাল আমার বন্দি। আজীবন আমার বন্দি।

সেদিনের সেই ঘটনার পর ভেবেছিলাম বুঝিবা সমস্ত মুঘল সাম্রাজ্যেরই সুদিন এল। নিজের ভরপুর হৃদয় নিয়ে সব-কিছুকেই অপূর্ব বলে মনে হচ্ছিল। কিন্তু সে যে কত বড় ভুল, নূরজাহান বেগমের মৃত্যু তার প্রমাণ দিচ্ছে। কেন যেন মনে হচ্ছে, আরও আছে—আরও অনেক বাকি আছে। এক ঘোরতম দুঃসময় যেন এগিয়ে আসছে ধীর-নিশ্চিত পদক্ষেপে। দিল্লিতে রাজধানী স্থানান্তর, নূরজাহানের মৃত্যু, বাবার মনোভাব সেই ভয়ঙ্কর দিনেরই ইঙ্গিত দিচ্ছে মাত্র। জানি না, এ আমার কল্পনা কিনা—অলস মনের উদ্ভট কল্পনা। তাই যেন হয় আল্লা।

.

আগ্রার দিন শেষ হয়ে এল।

দুদিন পরে ঘুম থেকে চোখ মেলে এই আগ্রাকে আর দেখতে পাব না। স্মৃতিতে স্থান পাবে শুধু। ওই অঙ্গুরিবাগ, জানলা খুললে যার শত শত ফুলের গন্ধ ছুটে এসে মনকে মাতিয়ে তোলে, যার অপূর্ব বৃক্ষরাজি আর তৃণগালিচা তৈমুরলঙের রাজধানী সমরখন্দ-এর ‘কানিবুল’ উদ্যানের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, দুদিন পরে তা স্মৃতির গর্ভে স্থান পাবে। অঙ্গুরিবাগ হবে অতীতের জিনিস। বাদশাহ্ স্থান ত্যাগ করলে এ উদ্যান নষ্ট হবে।

ওই যে শিশমহল। দিল্লিতেও হয়তো শিশমহল তৈরি হয়েছে। কিন্তু স্মৃতিহীন সে মহলের আভিজাত্যহীন চাকচিক্য মনকে এমনভাবে দোলা দেবে না কখনো। বাদশাহ্ আকবরের সাধের দশ-পঁচিশীর অস্তিত্ব সেখানে থাকবে না। আর থাকবে না তাঁর খা-আব-বাগ কক্ষ। খা-আব-বাগের কথা মনে হতেই বুকের ভেতরে কেঁদে ওঠে। মা থাকতেন সেখানে।

শেষবারের মতো কক্ষটি দেখার জন্যে ঘর ছেড়ে বের হই। এই সন্ধ্যায় আর কেউ তার আশেপাশে থেকে আমার ভাবাবেগে বাধাসৃষ্টি করবে না নিশ্চয়। শুধু আর একজন মাত্র থাকতে পারেন সেখানে। স্বয়ং বাদশাহ্। আগে অনেকবার দেখেছি। কিন্তু আজ তাঁরও থাকার সম্ভাবনা বিশেষ নেই। কারণ আজকাল যেন তিনি তাঁর অতি প্রিয় মমতাজ বেগমের কথা ভুলে গিয়েছেন। আগের মতো আর ঘন ঘন তাজমহলের দিকে চেয়ে থাকেন না। নিজের অজ্ঞাতে চোখের কোণে আর অশ্রুও দেখা যায় না তাঁর। তাঁর সম্বন্ধে অনেক কথাই অনেকের মুখে শুনি, কিন্তু বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় না। হারেমে কত কথাই তো রটে। আমাকে কেন্দ্র করে যে, জঘন্য অপবাদটি রটেছিল, তাও তো এই হারেম থেকেই। তবু অনেক সময়ই বাদশাহের দিকে চেয়ে থাকি আর অবাক হই তাঁর পরিবর্তন দেখে। আগ্রা ছেড়ে যাবার জন্যে তিনি অতিমাত্রায় ব্যস্ত হয়েছেন।

মায়ের ঘরের পর্দা এখনো ঝুলে থাকে আগের মতোই। সেই পর্দা উঠিয়ে আস্তে আস্তে পা বাড়াই। আগের মতো ঝাড়ের আলো আর এখন ঘরকে আলোকিত করে না। কোনও বৃদ্ধা নাজীর শুধু একটি করে বাতি রেখে যায় ঘরের মাঝখানে প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলায়। যে বাতি হয়তো বেশিক্ষণ জ্বলেও না। আজও বাতি জ্বলছিল—হয়তো শেষ বাতি। শাহানশাহ্ শাহজাহানের উপস্থিতিতেই যখন এ-দশা, তিনি চলে গেলে যে কী হবে সহজেই অনুমান করা যায়। চোখ দুটো জ্বালা করে, অশ্রু জমা হয়।

মায়ের অনেক স্মৃতিই মনে পড়ছিল। শেষ দিনে এই গালিচায় বসে পড়ে শিশুর মতো কেঁদেছিলেন বাদশাহ্। আর আজ?

দেয়ালে টাঙানো পর্দার আড়ালে মায়ের তবির রয়েছে। সে হাসি মুখখানি ফুটে উঠবে পর্দা সরালেই। কিন্তু না, এখন নয়। ঘর ছেড়ে যাবার সময় মায়ের কাছ থেকে বিদায় চেয়ে নেব। দিল্লিতে তাঁর এ তবির যাবে না। বাদশাহের হুকুম। এমন অদ্ভুত হুকুম কেন যে তিনি দিলেন জানি না। দারা এ সবের একটা কারণ আবিষ্কার করেছে। সেটা কতখানি সত্যি বোঝা কঠিন।

সে বলে, মায়ের কথা বাদশাহ্ কিছুতেই ভুলতে পারেন না। ভুলতে পারেন না বলেই তাঁর শেষ কয়েক গুচ্ছ কাঁচা চুল দ্রুত সাদা হয়ে যাচ্ছে। তিনি কোনও কাজে মন বসাতে পারেন না। বিবেকের কাছে সব সময়েই অপরাধী থাকেন। তাই আগ্রা ছেড়ে যাবার জন্যে পাগল হয়েছেন। মমতাজ বেগমের কথা জোর করে ভুলে যেতে চাইছেন তিনি। তাই তাঁর এই কঠোরতা। তবির অবধি নিয়ে যেতে দেবেন না দিল্লিতে।

দূরে চন্দ্রকিরণ স্নাত তাজমহল। শিল্পীর সৃষ্টি তাজমহল। সে শিল্পী এখন কী করছে? কোয়েলের কোলে মাথা রেখে হয়তো শুধু কেঁদে চলেছে তার অজ্ঞাত গ্রামের কুটিরে। সেখানেও চাঁদ উঠেছে।

মায়ের সমাধির পাশে এতক্ষণ নিশ্চয়ই কোরানের পুণ্যবাণী সুর করে পাঠ করা হচ্ছে। কিন্তু শুনছেন কি তিনি? তাঁর প্রিয়জনেরা তাঁকে ছেড়ে যে চলে যাচ্ছে। তিনি স্থির হতে পারছেন না। আজ তিনি কি সেখানে রয়েছেন? না না। আজ তিনি এখানে।

সহসা দমকা হাওয়া জানলা দিয়ে ঘরে ঢোকে। দরওয়াজার পর্দা প্রচণ্ড ভাবে দুলে ওঠে। মায়ের তবিরের পর্দা ওপর দিকে উঠে কীসের সঙ্গে যেন উৎকটভাবে আটকে যায়। ভেসে ওঠে তাঁর দেহ, মুখ অবয়ব।

বাতি নিভে যায়। অন্ধকার।

কানের কাছে কে যেন ফিসফিস করে বলে ওঠে,—চলে যেও না জাহানারা।

কে? মা? নূরজাহান?

কে? গুলরুখ?

চিৎকার করে উঠি,—না না। আমি যেতে চাই না। আমি চাই না যেতে।

চারদিক থেকে যেন হাওয়ায় কথা বলে,–যেও না, যেও না।

—না না গুলরুখ। আমি যেতে চাই না। বাদশাহ্—তিনিই সব কিছুর মূলে।

ছুটতে থাকি। কোনদিকে দরজা? যেদিকে ছুটি সেদিকেই দেয়ালে বাধা পাই। একি হল? ওই তো পর্দা। শাঁ শাঁ করে আবার দমকা হাওয়ায় তাড়া করে। পর্দাগুলো আমার পায়ের সঙ্গে জড়িয়ে যায়—বেঁধে ফেলে আমাকে। পড়ে যাই আমি।

জ্ঞান হতে বাদশাহের উদ্বেগ-কাতর মুখ চোখে পড়ে। হাসার চেষ্টা করি।

—ভাল বোধ করছ জাহানারা?

—হ্যাঁ।

—কী হয়েছিল?

—কিছু না।

পিতা মুখ নিচু করেন। কী যেন ভাবেন। শেষে বলেন,—আমি এখানে না এলে কতক্ষণ পড়ে থাকতে ঠিক নেই।

—আমি ভেবেছিলাম আপনি আর আসেন না এখানে।

বাদশাহ্ বিচলিত হন। বলেন,—আসি জাহানারা। সবাই তোমরা আমাকে যা ভাবতে শুরু করেছ আমি ঠিক তা নই।

—ক্ষমা করবেন বাবা।

তাঁর চোখে জল দেখি। মায়ের তবিরের পর্দা তখন আর উঠে নেই। স্বাভাবিকভাবেই ঝুলছে।

বাতিটি জ্বলছে। বোধহয় বাদশাহ্ জ্বালিয়ে দিয়েছেন।

তিনি আবার প্রশ্ন করেন—কী হয়েছিল জাহানারা?

—কিছু নয়, বাবা।

—আমি জানি।

—কী জানেন?

—সে তোমাকে ভালবাসত খুব। আর আমাকে।

—কী বলছেন বাবা!

—সত্যি কথা বলছি। এই বাতিটা যেমন সত্যি, ঠিক তেমনি!

—আপনি এ সবে বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন?

—না করলে যে উপায় নেই। মনে হয় ও আমাদের একেবারে ছেড়ে গিয়েছে কী করে তা সহ্য করা যায় বল তো?

স্তব্ধ হয়ে থাকি।

বাদশাহ গম্ভীর স্বরে বলেন,—তবে আর বিশ্বাস করব না। মমতাজ কোনওদিন পৃথিবীতে ছিল, ভুলে যাব সেকথা। তাই তো দিল্লি যাচ্ছি। তাই ওর তসবির এখানেই পড়ে থাকবে। অবাক হয়ে পিতার মুখের দিকে চেয়ে থাকি। তিনি অনেকক্ষণ আপন মনে ভাবেন। শেষে বলেন—চলো তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসি।

মেয়ে হয়েও তাঁর সঙ্গে হারেমের দিকে যেতে সংকোচ হয়। তাই বলি,—আমি একাই যাবো বাবা।

দাঁড়িয়ে পড়েন তিনি। ভ্রূ কুঞ্চিত হয় তাঁর। তারপর বলেন,—ও, আচ্ছা। হারেম বড় নোংরা জায়গা, তাই না জাহানারা?

—হ্যাঁ বাবা।

—তাই তো হারেমে যাই না। তোমার মা বেহেস্ত থেকে ছিট্‌কে এসে ছিলেন। চিন্তান্বিত হয়ে তিনি অন্যপথে প্রস্থান করেন।

.

দিল্লির পথে রওনা হই সদলে। চোখে আমার জল! রোশনারার মুখে হাসি, মন চঞ্চল। নতুন জায়গার দুর্নিবার আকর্ষণ তাকে পেয়ে বসেছে। তার দৃষ্টি সামনে। গাড়ির সামনের দিকে সে বসেছে। আমার দৃষ্টি পেছনে। আমি দেখছি কেমন ধীরে ধীরে তাজমহলের মিনারগুলি একসময়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। তার গম্বুজ আস্তে আস্তে কেমন ম্লান হয়ে আসছে। বার বার অবাধ্য চোখদুটোকে মুছে ফেলি।

আমার ছোট বোনের মুখে অসহায় ভাব। তার দৃষ্টি সামনেও নয়, পেছনেও নয়। সে চেয়ে রয়েছে ওপরের দিকে। যৌবনের রেখা ধীরে ধীরে ফুটে উঠেছে তার মুখে, বুকে, নিতম্বে সে হয়তো ভাবছে দিল্লিতেও এমন সূর্য ওঠে কিনা, দিল্লির আকাশে রাতে চাঁদের আলো ঝলমল করে কি না। বড় অবহেলার মধ্যে মানুষ হয়েছে। শাহজাদী হিসাবে অনেক কিছুই সে জানে না, যা তার জানা উচিত ছিল।

আমাদের সামনের গাড়িতে রয়েছে দারা আর নাদিরা। নাদিরার ছোট ছেলে সিপারও রয়েছে তার কাছে। বড় ছেলে সুলেমান শুকো বাদশাহের গাড়িতে একেবারে সামনে। জাহাঙ্গীর যে গাড়িখানা উপহার পেয়েছিলেন সাগরপারের রাজার কাছ থেকে, তাই চড়ে বাদশাহ্ চলেছেন। পেছনে আরও কতশত গাড়ি। তাতে রয়েছে আমির-ওমরাহদের পরিবার। আরও পেছনে রয়েছে রসদ। অশ্বারোহী সৈন্যদলকে দুভাগে ভাগ করা হয়েছে। একভাগ এগিয়ে গিয়েছে পথকে নিরাপদ করতে, অন্যদল রয়েছে পেছনে। তারও পেছনে রয়েছে হস্তি।

চলতে চলতে কখনো আমরা যমুনা নদীর পাশে চলে আসছি, আবার কখনো দূরে সরে যাচ্ছি!

কল্পনা করতে বেশ লাগে, আমরা যেন বিরাট এক হজযাত্রীর দল। মক্কায় গিয়ে আমাদের যাত্রা শেষ। দূরে যেন দিগন্ত বিস্তৃত মরুভূমি! মাঝে মাঝে তার পান্থপাদদের গাছ আর মরূদ্যান! ওই মরুভূমি-পথে যাত্রা শুরু করে শেষদিকে আমরা আমাদের পাদুকা আর মস্তকের আবরণ খুলে ফেলব। ভক্তিনম্র চিত্তে আমাদের পরমপবিত্র তীর্থস্থানের দিকে অগ্রসর হব। পদতল প্রচণ্ড উত্তাপে আহত হবে। মস্তকের উপর অসহ্য রৌদ্র। তবু বিচলিত হব না আমরা। মহম্মদের শুভ্র বস্ত্র শোভাযাত্রা করে নিয়ে যাবার যে আর দেরি নেই। সে বস্ত্র স্পর্শ করতেই হবে। নইলে হজে এসে পরিপূর্ণ পরিতৃপ্তি লাভ করব না।

—এই!

চমকে উঠি। দেখি রোশনারা ডাকছে।

—অত কী ভাবিস বলতো? তবু যদি বুঝতাম —

—সন্ধে যে হয়ে এল রোশনারা।

—হ্যাঁ। নামবি না?

তাই তো। আমাদের গাড়ি থেমে রয়েছে। ওদিকে শিবির ফেলা হচ্ছে। শতলোক কর্মব্যস্ত। সে সন্ধ্যায় পাশের কোন গ্রাম থেকে এক জ্যোতিষী বাদশাহের দর্শনপ্রার্থী হন। জ্যোতিষীদের বাদশাহ্ কখনো ফিরিয়ে দেন না। শিবিরের ভেতরে ডেকে আনা হয় তাঁকে। আমারও ডাক পড়ে। নিজের তাঁবু থেকে বার হয়ে জাল-ঘেরা পথে বাদশাহের পাশে গিয়ে দাঁড়াই। জ্যোতিষী তখন হস্তবিচারে ব্যস্ত।

ধীরে ধীরে তাঁর মুখ গম্ভীর হয়। কপালে চিন্তার রেখা পড়ে।

—কী দেখলেন?

—দেখছি আপনার অন্ধকারময় ভবিষ্যৎ।

আমার মুখ রক্তশূন্য। বাদশাহ্ও হতবাক্। এমন স্পষ্টভাষায় তাঁর সামনে কেউ কখনো কথা বলে না।

বলে উঠি,—বাদশাহ্ হলেই ভবিষ্যৎ সব সময় উজ্জ্বল হয় না।

—তা মানি, কিন্তু এই হস্তের অধিকারীর ভাগ্যে রয়েছে অশেষ অপমান।

বাদশাহ্ রীতিমতো বিচলিত হন। আমার রাগ হয় জ্যোতিষীর ওপর। উত্তেজিত স্বরে বলি, —কোন স্বার্থান্বেষী আপনাকে পাঠিয়েছে? আপনি কি ভাবছেন এসব বলে বাদশাহের মনোবল ভেঙে দিতে পারবেন?

শান্ত হাসি হেসে তিনি উত্তর দেন,–না মা তা ভাবিনি। আমি বাদশাহের হিতৈষী। তিনি যাতে তাঁর বিপদের কথা আগে থাকতে জেনে নিজেকে প্রস্তুত করতে পারেন সে ব্যবস্থা করে যাব।

—কী ব্যবস্থা করবেন?

জ্যোতিষী আমার দিকে উজ্জ্বল দৃষ্টি ফেলেন। তাঁর ভ্রূ-জোড়া কুঞ্চিত হয়। তিনি বলেন, —সব বলছি। কিন্তু তোমার ভবিষ্যৎ জানো কি?

—না।

আশ্চর্য। বাদশাহের সঙ্গে তোমার ভবিষ্যৎ একই সূত্রে গাঁথা। আপনি ভাগ্যবান জাহাঁপনা, এমন কন্যা পেয়েছেন।

পিতা হাসেন। আমাকে কাছে টেনে নিয়ে আমার পিঠে হাত রেখে বলেন,—আমি জানি। কিন্তু আমার ভবিষ্যৎ স্পষ্ট করে বললেন না।

—কেউ যদি আপনাকে নিহত করে সিংহাসনে বসতো বাদশাহ্ আমি কিছু বলতাম না। কারণ এমন ঘটনা হামেশাই ঘটে। কিন্তু বেঁচে থেকে আপনাকে তিলে তিলে দুর্ভোগ ভোগ করতে হবে।

—আরও স্পষ্ট করে বলুন।

—না। আর নয়।

জ্যোতিষী তাঁর ঝুলি থেকে দুটি সুন্দর কাশ্মীরি আপেল বার করে বাদশাহের দিকে বাড়িয়ে বলেন,—এ দুটি ধরুন জাহাঁপনা!

পিতা দু হাতে ধরেন।

—এবারে আপনার কন্যাকে দিয়ে দিন।

আমি আপেল দুটি পিতার হাত থেকে নিই

—জাহাঁপনা, আপনার হাতে দেখুন সুমিষ্ট ফলের সুবাস। এই সুঘ্রাণ আপনার হাতে লেগে থাকবে। শত ধুলেও যাবে না। আতরে নষ্ট হবে না। কিন্তু যেদিন দেখবেন এর গন্ধ ক্ষীণ বলে মনে হচ্ছে সেদিন বুঝবেন আপনার অপমানের দিন খুবই নিকটে। আর যেদিন দেখবেন কোনও গন্ধই নেই, সেদিন বুঝবেন মৃত্যু অতি সন্নিকট। আমাদের কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে জ্যোতিষী সহসা উঠে বিদায় নেন। বাধা দিতে পারি না।

বাদশাহ্ স্তম্ভিত। তাঁকে বড় ক্লান্ত দেখায়। দিল্লীতে গিয়ে নতুন উদ্যমে দেশ-শাসনের সব উত্তেজনা যেন মুহূর্তে অন্তর্হিত হয় তাঁর মধ্য থেকে।

শাহানশাহ্ শাহজাহান শূন্যদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে অসহায়ের মতো আমার দিকে দু হাত বাড়িয়ে বলেন,–দেখ তো জাহানারা আপেলের গন্ধ আছে তো?

—হ্যাঁ বাবা আছে। আপনি ভয় পাচ্ছেন কেন? আমিও তো আপনার সঙ্গে আছি।

—তা আছিস বটে। তা আছিস।

বাদশাকে বড় বেশি বৃদ্ধ বলে মনে হয় হঠাৎ। কষ্ট হয় খুব। আমি ধীরে ধীরে তাঁর মাথায় হাত বুলিয়ে দিই।

—জাহানারা, কালই আগ্রায় লোক পাঠাবো।

—কেন বাবা?

—তাজমহলের বিপরীত দিকে যমুনার অপর পারে আমার সমাধিস্থল নির্মিত হবে।

—ছি বাবা।

—ছি, নারে। এখন তৈরি না হলে পরে আর সময় পাবো না। কী রঙের হবে জানিস?

—না।

—লাল। এপারে সাদা আর ওপারে লাল। যেন স্বর্গ আর মর্ত্য। তাজমহল থেকে একটি কৃষ্ণবর্ণ সেতু বের হয়ে নদীর ওপর দিয়ে আমার সমাধিস্থলের সঙ্গে যুক্ত হবে। এই সেতুটি যেন মৃত্যু, আমাকে আর তাকে এক করে দেবে। বেশ হবে

—হ্যাঁ বাবা। কিন্তু এত ব্যস্ত হয়ে লাভ কী? দিল্লি গিয়ে লোক পাঠালেই চলবে।

—যদি দেরি হয়ে যায়?

—একটুও দেরি হবে না।

আবার হাত বাড়িয়ে দিয়ে তিনি বলেন,—দেখ তো গন্ধটা আছে কিনা?

জ্যোতিষীর ওপর ক্রোধে আমার সর্বাঙ্গ জ্বালা করে। ইচ্ছে হয় অশ্বারোহী পাঠিয়ে তাকে ধরে এনে মৃত্যুদণ্ড দিই।

বাদশাহ্ কি শেষে উন্মাদ হয়ে যাবেন? নিজের হাতের ঘ্রাণ নিজে নিয়েও হয়তো বিশ্বাস হয় না তাঁর। দিনে-রাতে নিদ্রায়-জাগরণে আমার কাছে ছুটে আসবেন।

—ঠিক তেমনই রয়েছে, বাবা। মনে হচ্ছে চিরকালই এ-গন্ধ থাকবে।

—তাই কি কখনো হয়? মানুষ অমর হতে পারে না। তবু মানুষ নির্ভাবনায় থাকে। কারণ সে তার ভবিষ্যৎ জানতে পারে না। যদি জানত, কী সর্বনাশই না হত।

শিবিরের বাইরে অন্ধকার হয়ে আসে। উন্মুক্ত প্রান্তরের অপর সীমা থেকে ঝড়ের মতো হাওয়া ছুটে এসে বালিরাশি উড়িয়ে দিয়ে চলে যায়। কিছু দূরে সৈন্যদলের হৈ-হুল্লোড়। অশ্বের ছটফটানি আর হ্রেস্বা রব অতি স্বাভাবিক প্রবৃত্তির ইঙ্গিত দিচ্ছে। আমি অন্যমনস্ক হয়ে ভাবি যদি দিল্লিতে গিয়ে দেখি ছত্রশাল সেখানে হাজির, তবে আনন্দে হয়তো আমি মরেই যাব।

—জাহানারা।

অল্প সময়ের মধ্যেই বড় বেশি অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম। বাদশাহের ডাকে তার মুখের কাছে ঝুঁকে পড়ি।

—জাহানারা, হারেমকে এখন কে শক্ত হাতে চালনা করে, আমি জানি। তোমার মায়ের মৃত্যুর পর ধীরে ধীরে যে তুমি তাঁর স্থান দখল করেছ, সে কথা কেউ না বললেও বুঝতে দেরি হয় না।

—কিন্তু আমি তা চাই না।

—না চাইলেও অনেক জিনিস আপনা হতেই ঘাড়ে এসে পড়ে। তার মূল কারণ বুদ্ধি আর ব্যক্তিত্ব। আওরঙজেব ছাড়া তোমার সমকক্ষ আমার ছেলেমেয়েদের মধ্যে কেউ নেই।

—আপনি আমাকে একটু বেশি স্নেহ করেন।

—না। স্নেহের আধিক্যে আমার বিচার-বুদ্ধি এক্ষেত্রে অন্তত আচ্ছন্ন হয়নি। জাহানারা, এতদিন যা অনিচ্ছা সত্ত্বেও করে এসেছ, দিল্লিতে গিয়ে তাই হবে তোমার প্রথম কর্তব্য। নতুন জায়গায় শক্ত হাতে যদি লাগাম না ধর তবে অনেকেই ছিটকে যাবে। দিল্লির হারেম অনেক বেগমের মাথা খারাপ করে দেবে।

—এত সুন্দর?

—হ্যাঁ। সেজন্যই বলছি জাহানারা, ওখানে পৌঁছেই তোমার নানান্ কাজ। শুধু হারেম নয়—বাইরেরও।

কেন? দারা?

—দারার পাশে তুমি না থাকলে সে মসনদে বেশিদিন টিকতে পারবে না। এক্ষেত্রে আকবরের নির্দেশ অন্তত কাজে লেগেছে।

আমার বুকের মধ্যে কেঁপে ওঠে। রাজার মুখখানা চোখের সামনে ভাসে। অতি কষ্টে দীর্ঘশ্বাস রোধ করি।

—জাহানারা, খলিলুল্লা খাঁয়ের শিবির কি অনেক দূরে?

কিছুদিন থেকে লক্ষ করছি খলিলুল্লা খাঁ সম্বন্ধে তিনি বড় বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছেন। মাঝে মাঝে তাঁকে তিনি কাজে পাঠান আগ্রা থেকে দূরে। অর্থও দিচ্ছেন তাঁকে প্রচুর। এসবের কারণ হারেমে বসে পাওয়া যায় না। কিন্তু একদিন খলিলুল্লা খাঁয়ের বেগমকে হারেমে দেখে আমার তীব্র কৌতূহল হয়েছিল। তাকে প্রশ্ন করেছিলাম, হারেমে আসার কারণ সম্বন্ধে। সে জবাব দিতে পারেনি। মুখ চোখ লাল হয়ে উঠেছিল তার। যাবার সময় শুধু বলেছিল,—শাহজাদী, মমতাজ বেগমের মৃত্যুর পর আর কোনও বেগমই বুঝি বাদশাহকে শান্তি দিতে পারছেন না?

কিছু বলতে পারিনি সেদিন তাকে।

আগ্রা ছেড়ে আসার আগের দিন বাদশাহ্ খলিলুল্লা খাঁকে সুরাটে পাঠাতে চেয়েছিলেন। অসুস্থতার অজুহাতে এড়িয়ে গিয়েছেন তিনি। তাঁর এই চালাকি বাদশাহ্ বোধহয় বুঝতে পেরেছিলেন। কারণ তাঁর চোখেমুখে দেখেছি ক্রোধের অভিব্যক্তি।

বাদশাহের প্রশ্নের উত্তরে বলি,—তাঁদের শকট আমাদের অনেক পেছনে ছিল।

গম্ভীর হন পিতা। একটা চাপা উত্তেজনা মুখময় ছড়িয়ে পড়ে তাঁর। বাদশাহের শকট থেকে নিজের শকট অনেক দূরে রাখাও কি খলিলুল্লার চালাকি?

বাইরে গাঢ় অন্ধকার। ধীরে ধীরে পিতার শিবির থেকে চলে আসি। ইচ্ছে ছিল রোশনারার কাছে গিয়ে কিছু সময় গল্প করে কাটাই। কিন্তু এ সময়ে তার কাছে যেতে ভরসা হয় না। কী অবস্থায় দেখব ঠিক নেই। ওদিকে নাদিরার শিবিরও স্তব্ধ। একটু দূরে পদশব্দ। চেয়ে দেখি সুলেমান শুকো ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বেশ বড় হয়ে উঠেছে এর মধ্যে। আওরঙজেবের ছেলেটাও নিশ্চয় এত বড় হয়েছে। কখনো দেখিনি তাকে। আগ্রার সংস্পর্শ থেকে আওরঙজেব তার সমস্ত পরিবারকে সযত্নে দূরে সরিয়ে রাখে। বোধহয় সে ভাবে, যে তার ছেলেরা হবে ভবিষ্যতের বাদশাহ্। এ ভাবনার একটি ইতিহাস আছে। আগে বলেছি কি না মনে নেই। কোনও এক ফকির একবার বলেছিল বাদশাহকে যে তাঁর সর্বাপেক্ষা গৌরবর্ণ পুত্রই হবে তাঁর উত্তরাধিকারী। কথাটা সেদিন আওরঙজেবের মনের মধ্যে গেঁথে গিয়েছিল। সে-ই সব চাইতে গৌরবর্ণ।

—কে? সুলেমান চিৎকার করে উঠে।

—আমি। দেখে ফেলেছ?

—কাছে এগিয়ে আসে সে। হেসে বলে,—দেখব না? আমি যে পাহারা দিচ্ছি।

—কেন? পাহারা দেবার লোকের অভাব হল না কি যে তোমাকে পাহারা দিতে হচ্ছে।

—এ সব অচেনা জায়গায় তাদের ওপর নির্ভর করা যায় না কি? মেয়েরা কিছু বোঝে না। খুব আমোদ লাগে তার কথা শুনে। বলি,—ঠিক বলেছ।

—কোন্ দিকে যাচ্ছ?

—বুঝতে পারছি না সুলেমান। বল তো কোথায় যাই?

—কোথাও গিয়ে কাজ নেই। নিজের শিবিরে গিয়ে বিশ্রাম কর।

—একথা বললে কেন?

সুলেমান হেসে ওঠে। রোশনারার শিবিরের দিকে ইঙ্গিত করে বলে,—ওখানে খুব জমেছে।

—ছিঃ সুলেমান! তোমার এখনো এমন কিছু বয়স হয়নি যে ওভাবে কথা বলবে। গম্ভীর হয় সে। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে—না বলতে পারলেই সুখী হতাম। সে চলে যায়। ভাবি সত্যিই সুলেমান বড় হয়ে উঠেছে। দারার বিবাহের দিনের কথা একের পর এক চোখের সামনে ভেসে ওঠে। নাদিরার ব্রীড়া সঙ্কুচিত মুখভাব বড়ই সুন্দর লাগছিল দেখতে। তখন সে কিশোরী।

.

শাহানশাহ্ শাহজাহানের সখের রাজধানী দিল্লি-প্রান্তে এসে উপস্থিত হই। দূরে রক্তবর্ণ ‘কিল্লাই মুবারকের’ মাথায় বৃহৎ গম্বুজ অপূর্ব লাগছিল দেখতে। বড় গম্বুজের পাশে ছোট সাতটি মিনার কিল্লাই মুবারককে এক অভূতপূর্ব আভিজাত্য দান করেছে।

অধৈর্য হই ওখানে গিয়ে পৌঁছবার জন্যে। শকটগুলি যেন তাদের গতি শ্লথ করেছে। রোশনারা ছটফট্ করতে করতে অস্ফুটস্বরে গালাগালি দিয়ে ওঠে।

—ওতে লাভ হবে না রোশনারা। শকটের গতি একটুও কমেনি। তোর মনের গতি বেড়েছে।

—অপদার্থ সব।

হাসি আমি। বয়স রোশনারার কম হল না। অথচ এখনো আগের মতোই। ছোট বোনটি কিন্তু নির্বিকার। আশা, উদ্যম, কৌতূহল—কিছুই যেন নেই তার।

ছোট বোনকে ঠেলা দিয়ে বলি,—কিরে চুপচাপ কেন? আনন্দ হচ্ছে না তোর?

—হুঁ।

—শুধু হুঁ। জানিস ওখানকার হারেম আর বেহেস্ত একই।

—তাই আবার হয় নাকি?

—হয় না মানে? সারা ভারতের অধীশ্বর, ইচ্ছে করলে কী না হতে পারে?

অবাক হয়ে ওর মুখের দিকে চাই। এমন সংযত আর নিশ্চিত মতামত প্রকাশ করতে এ-বয়সে মুঘল হারেমের কোনও মেয়েকে দেখিনি। একে গুজরাটে মুরাদের কাছে পাঠাতে হবে। মুরাদ হল এই সব নিরাশাবাদীদের মহৌষধ। কাউকে না হাসাতে পারলে সুড়সুড়ি দিয়ে হাসাবে তাতেও না হলে তরবারির খোঁচা দিয়ে হাসাতে চেষ্টা করবে।

আমার মনোভাব অনুমান করতে পেরে মৃদু হেসে বোনটি বলে,–ভারতের অধীশ্বর মমতাজ বেগমকে বাঁচাতে পেরেছিলেন?

বুঝতে পারি কোথায় ব্যথা ওর। আজ যদি মমতাজ বেগম বেঁচে থাকতেন তাহলে এই অবহেলা আর নিরানন্দ সহ্য করতে হত না তাকে। আমাদের মতোই হাসতে পারত, খেলতে পারত।

বড় কষ্ট হয় আমার। ওর মাথায় হাত রেখে বলি,–ঠিকই বলেছিস। ওই ওপরে যিনি রয়েছেন সবাই ওঁর হাতের পুতুল।

শকটগুলির হঠাৎ একের পর এক থেমে যায়। এবার সত্যিই আমি বিরক্ত হই। বাদশাহ্ যেন আমাদের ধৈর্যের পরীক্ষা নিচ্ছেন। এ সময়ে এমনভাবে গতিরুদ্ধ করার কোনও অর্থ হয় না।

সুলেমান সামনে থেকে ঘোড়ায় চড়ে দারার দিকে যাচ্ছিল। থামাই তাকে।

—কী ব্যাপার সুলেমান?

—বাদশাহ্ বলে দিলেন যমুনার তীরে খিজরী দ্বার দিয়ে প্রবেশ করতে।

—বেশ তো। উনি সামনে আছেন। উনি যেদিকে যাবেন আমরাও তাই যাব। তার জন্য এভাবে থেমে যাওয়া কেন?

—তবু সবাইকে একবার বলে দিতে বললেন।

—বলে এসো।

রোশনারা দাঁতে দাঁত ঘষে। তার মুখমণ্ডল রক্তবর্ণ।

আমি বলি,–দেখিস, আর রাগিস না। টুসটুস করে গড়াবে এবার।

—ঠাট্টা করার সময় অসময় আছে।

—এটাই সময়। বেশ লাগছে দেখতে তোকে।

আমার ছোট বোন মুখে ওড়না চাপা দিয়ে নিঃশব্দে হেসে ওঠে। তার দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টি হেনে রোশনারা গুম হয়ে থাকে।

একটু পরেই শকটশ্রেণি চলতে শুরু করে!

নতুন রাজধানী দিল্লি।

নতুন জায়গায় এসেছি। নতুন প্রাসাদের আশ্চর্য শিল্পকার্য দেখে স্তম্ভিত হয়েছি। ছোট্ট বালিকার মতো রোশনারার পাশে পাশে ঘুরে বেড়িয়েছি হায়াৎবাগে, মহতাববাগে। ফুল ছিঁড়েছি—ছড়িয়েছি। তৃণের ওপর গড়াগড়ি দিয়েছি। মতিমহলের ভিতরে গিয়ে দাঁড়িয়ে কী করব ভেবে পাইনি। রঙমহলের নির্জন কক্ষে উপস্থিত হয়ে নিজেকে মনে হয়েছে স্বর্গের অপ্সরী। সেখানে পায়ের কাছ দিয়ে বয়ে চলেছে নহরী-বেহেস্ত। কোনও প্রকোষ্ঠের ভেতর দিয়ে এভাবে মন্দাকিনী বিনিন্দিত প্রবাহিত বয়ে যেতে পারে, না দেখলে বিশ্বাস করতাম না। নানান্ বর্ণের আলো প্রতিফলিত হচ্ছে তাতে। সব দেখে রোশনারা পাগল হয়েছে। ছোট্ট বোনটি পর্যন্ত উচ্ছ্বসিত।

কিন্তু আমি?

আনন্দ আমারও হয়েছে। ওরা যেভাবে আনন্দ প্রকাশ করেছে, আমিও তা করেছি। কিন্তু ওদের মতো নিজেকে হারিয়ে ফেলতে পারছি কই? বুকের ভেতর কোথায় যেন কাঁটা বিঁধে রয়েছে। সব আনন্দ একটা নির্দিষ্ট সীমা অতিক্রম করতে চাইলেই খচ্ করে বেঁধে। বড় ব্যথা পাই তখন। বড় খারাপ লাগে। মনে হয়, যা দেখেছি সবই যেন বাইরের—মনের সঙ্গে তার কোনও সম্পর্কই নেই।

মাকে ফেলে এসেছি আগ্রায়। সেইদিন সন্ধ্যায় আমাকে ধরে রাখার জন্যে নিশ্চয়ই তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন। কথার ছলে পিতা যে কথা বলে ছিলেন তা বিশ্বাস করতেই ইচ্ছে হয়। মা সেদিন আমাকে ধরে রাখতে পারেন নি। পারা সম্ভব নয়। নূরজাহান বেগমও হয়তো সমাধির নীচে থেকে অশ্রুজল ফেলেছিলেন—তাঁর শেষ প্রিয়জন কাছ ছাড়া হল বলে।

তবু সহ্য হত, তবু সব ভুলে যেতে পারতাম—যদি সে আসত। দিল্লির দেওয়ান-ই-আমের একটি আসন আলো করার জন্যে সে কখনো আসেনি। হয়তো ভুলে গিয়েছে আমাকে। নিজের রানি, নিজের সন্তানের স্নেহভালবাসার গণ্ডির মধ্যে সে আপনহারা। সেখান থেকে ছিট্‌কে এসে সেবারে আগ্রায় সামান্য একটু উত্তেজনার মোহে হয়তো অঙ্গুরিবাগে আমার দিকে অমন মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়েছিল, অমন মধুর কথা বলে আমার মন হরণ করে চলে গিয়েছিল। এখন আর ওসব কথা মনে নেই।

একলা ধীরে ধীরে কিল্লার শীর্ষে উঠে সাতমিনারের একটা পাশে গিয়ে দাঁড়াই। পাশেই যমুনার জল, তাতে গম্বুজ আর মিনারগুলি স্পষ্ট প্রতিবিম্বিত। উত্তর-পূর্ব দিকে শেরশাহ-পুত্র-সুলেমানের সেলিমগড়ের দুর্গ মাথা উঁচু করে এখনো সাবধান করে দিচ্ছে শক্তিশালী মুঘল বাদশাকে।

আবার যমুনার দিকে দৃষ্টি ফেরাই। এই বারিরাশি এগিয়ে যেতে যেতে আগ্রার তাজমহলের পাশে গিয়ে উপস্থিত হবে। আমার মনের ব্যথা কি মায়ের হৃদয় স্পর্শ করবে না? তিনি কি অস্থির হবেন না তখন? নিশ্চয়ই হবেন। শেষ বিচারের দিনে আল্লার কাছে তাঁর প্রথম প্রার্থনা হবে নিজের পুত্র-কন্যাদের জন্যে তাঁর মতো কোনও মা-ই যেন মানসিক যন্ত্রণা ভোগ না করে।

আমার বিশ্বাস, আমার মা তাঁর প্রিয়জনদের জন্যে অবিরত অশ্রু বিসর্জন করে চলেছেন। তাই চাঁদনি রাতে যখন সমস্ত পৃথিবী হাসে তখন তাঁর সমাধির দিকে চাইলে মনে হয় এক ফোঁটা অশ্রুজল যেন পৃথিবীর বুকের এক একান্ত কোণে টল্ করছে।

বুন্দেলা ছত্রশাল। আমার এত যে ভাবনা, এত যে ব্যথাতুর কল্পনা—সব কিছুই তুমি মুছে দিতে পারতে যদি আর একবার শুধু আমার সামনে এসে দাঁড়াতে! আর একবার শুধু আমার গা ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করে বলতে যে সত্যিই তুমি আমাকে ভালবাস।

কিন্তু এলে না তুমি। এই যমুনার ওপর দিয়ে কত কিস্তি যাতায়াত করছে, কত আমির ওমরাহের কিস্তি ঘাটে এসে ভিড়ছে। কিন্তু কই, তুমি তো এলে না।

হঠাৎ আমার চিন্তা ধাক্কা খায়। তীরে এসে একটি কিস্তি লাগে। তার থেকে নজরৎ লাফ দিয়ে মাটিতে নামে। একটু দূরে হলেও চিনতে পারি তাকে। সে একবার কিল্লার ওপর চোখ বুলিয়ে নেয়। তারপর খিজরীর দরওয়াজার দিকে যায়।

এখনো আশা ছাড়েনি নজরৎ। দারা এখনো নজরৎ সম্বন্ধে নতুন করে ভাবতে বলে আমাকে। সে তো জানে না, এতে ভাবনা-চিন্তার ঠাঁই নেই। মুহূর্তেই এ সব ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়।

—জাহানারা!

চমকে উঠি। বাদশাহের কণ্ঠস্বর। কিল্লার উপরে এই নির্জন স্থানে যে আমি এসেছি এ কথা তাঁকে কে বলল? তবে কি আমার গতিবিধির ওপর অলক্ষে কেউ দৃষ্টি রাখছে? কিন্তু কেন? নিজের হারেমে এভাবে নজরবন্দি হবার কী কারণ থাকতে পারে?

—বাদশাহ্ এগিয়ে আসেন।

—একলা কী করছ জাহানারা?

—এমনি। নতুন জায়গায় এসে আগ্রার কথা মনে পড়ে।

—আমারও। কিন্তু তোমাকে একটু বেশি বিচলিত দেখছি কদিন থেকে। তাই তোমার নাজীরকে বলেছি তোমার ওপর দৃষ্টি রাখতে।

সব স্পষ্ট হয়। কিন্তু তবু এ সাবধানতার সংগত কারণ খুঁজে পাই না।

—অবাক্ হলে তো?

—সত্যিই অবাক হয়েছি বাদশাহ্।

—আকবরশাহ্ যখন ফতেপুর সিক্রিতে চলে যান, তখন এক শাহজাদী তোমারই মতো বিমর্ষ হয়ে পড়েন। শেষে ওপর থেকে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন। জানি না তৈমুরের রক্তে এ-নেশা ছিল কি না। তোমার মধ্যে যদি এ-নেশা চাড়া দিয়ে ওঠে!

—দিক না। মুঘল-শাহজাদীরা সংখ্যায় কমে গেলে কারও কিছু এসে যাবে না। বরং অনেক জটিলতা থেকে অনেকে মুক্তি পাবে।

স্নেহের হাসি হেসে বাদশাহ্ বলেন—তোমার দুঃখ আমি বুঝি জাহানারা। তোমরা নিজের পথে চলো, আমি বাধা দেব না।

পিতার কথায় বিন্দুমাত্র সান্ত্বনা পাই না। তিনি নিরপেক্ষ। বহুদিনের একটা প্রথাকে ভাঙতে হলে একমাত্র বাদশাহ্ই উদ্যোগী হয়ে ভাঙতে পারেন। কিন্তু তিনি উদ্যোগী হতে চান না। বহু আগে রোশনারা শাদির প্রস্তাব করলে দারার মুখেই বাদশাহর মনোভাব জানতে পেরেছিলাম। তবু চুপ করে থাকি।

—শোন জাহানারা। আমি বৃদ্ধ হয়ে পড়ছি ধীরে ধীরে। ভেতরে বাইরে এক বিরাট সংঘাতের দিন এগিয়ে আসছে। এ সময়ে তোমাকে আমার বিশেষ প্রয়োজন। শুধু হারেম সামলাতে নয়, দরবারের অনেক ব্যাপারেই তোমার মতামত আমার জানা দরকার।

বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করি—আমার মতামত?

—হ্যাঁ, তোমার বুদ্ধিতে আমার আস্থা রয়েছে। আগেও সেকথা বলেছি।

—বাবা ভুলে যাবেন না আমি পুরুষ নই

—ভুলিনি। তবু এমন অনেক গুণ তোমার মধ্যে রয়েছে, পুরুষের মধ্যেও যা দুর্লভ।

মনে মনে আল্লার কাছে প্রার্থনা করি, আমি চাই না পুরুষের গুণ। বিন্দুমাত্রও চাই না। অণুতে অণুতে নারী হতে চাই। প্রতিটি অণু দিয়ে যাতে আমি রাজাকে অনুভব করতে পারি। পিতা তাঁর কথার জের টেনে বলেন—তাই আজ তোমাকে আমি নতুন উপাধি দিচ্ছি। আজ থেকে তুমি ‘বাদশাহ্-বেগম জাহানারা’।

সমস্ত শরীরের রক্ত একসঙ্গে মাথায় এসে ধাক্কা খায়। মাথা ঘুরে ওঠে আমার। তবে বুঝি ছত্রশাল আমার ভেতর পুরুষালী ভাব দেখে বিরক্ত হয়ে ফিরে গিয়েছে—আর আসছে না। অতিকষ্টে মাথা নুইয়ে অভিবাদন করে বলি—আপনার আদেশ শিরোধার্য বাদশাহ্।

—শোন বাদশাহ্-বেগম, তোমার সুরাট রাষ্ট্রের শাসনকর্তা এবার থেকে তুমি নিজেই নিযুক্ত করবে। সেখানকার রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব থেকেও আমি এই মুহূর্তে মুক্ত হচ্ছি। আর—

বাদশাহ্ তাঁর হাতের হস্তীদত্ত নির্মিত পেটিকা আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলেন–এর মধ্যে রয়েছে আমার পাঞ্জা। এটি তোমার তত্ত্বাবধানে রইল।

আমি অস্থির হই। নিষ্কৃতিলাভের শেষ চেষ্টায় চিৎকার করে বলে উঠি,—এত সব দায়িত্ব আমার মাথায় চাপিয়ে দিলেন বাদশাহ্ কিন্তু আমার দায়িত্ব? আমার দায়িত্ব কে নেবে?

পাষাণমূর্তির মতো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন বাদশাহ্। অনেকক্ষণ পরে খুব ধীর গলায় বলেন,—সেটিও তোমার ওপর।

—তা কি পারব?

—হ্যাঁ পারবে। বাবর পারেননি। আকবর পারেননি। আমি পারছি না।

বুঝলাম কীসের ইঙ্গিত দিলেন পিতা। পুরুষের মতোই অবাধ স্বাধীনতা দিলেন জীবনকে উপভোগ করার। অথচ নিজের কন্যাকে সেকথা স্পষ্ট করে হয়তো বলতে পারলেন না। তিনি বুঝলেন না দেহটাই সব নয়। ভালভাবে জেনেও তিনি বুঝলেন না। দেহটাই যদি সব হত মায়ের মৃত্যুর পর তাঁর জন্যে আকুল না হয়ে অন্য বেগমদের কাছে ছুটতেন। হারেমে বেগমের অভাব হয়নি কখনো। দেহই যদি সব হত তাহলে যমুনার তীরে তাজমহল শোভা পেত না। দেহই যদি সব হত তাহলে রোশনারা এখনো জ্বলেপুড়ে মরত না। সে বরাবরই স্বাধীন। পুরুষের কাছে দেহটার প্রাধান্য কত বেশি জানি না, তবে নারী চায় ধর্মসিদ্ধ আইনসিদ্ধ একটা নিশ্চিন্ত ভাব। রোশনারা যদি নিজের ঘর পেত তবে তার চেহারায় স্বভাবের অতখানি উষ্ণতা থাকত কি?

—তোমার মুখ দেখে মনে হচ্ছে আমাকে তুমি ভুল বুঝেছ বাদশাহ্ বেগম। অত নীচ আমি নই। আমি শুধু এইটুকুই বলতে চাইছি, তোমার যাতে তৃপ্তি তুমি তাই করতে পার। কিন্তু তোমার কর্ম যে তোমার রুচির ওপর নির্ভর করবে এ দৃঢ়বিশ্বাস আমার আছে।

বাদশাহের এ উক্তি না শুনলে সত্যিই তাঁকে ছোট বলে ভাবতাম। মনে মনে স্বস্তি অনুভব করি। তবু অবাধ স্বাধীনতা তিনি যখন আমায় দিয়েছেন, তখন তাঁকে আমার সন্ধানী দৃষ্টির প্রথম পরিচয় দেবার লোভ সামলাতে পারি না। এখানে আসার পর থেকেই লক্ষ করছি, দরবারে শায়েস্তা খাঁ, নজরৎ খাঁ, মীরজুমলা, আমীন খাঁ সবাই হাজির হচ্ছে অথচ খলিলুল্লা খাঁয়ের আসনটি খালি পড়ে থাকে। গোপনে খবর নিয়ে জেনেছি তিনি সুস্থ আছেন এবং নিয়মিত তাঁকে নগরীর রাস্তায় দেখা যায়।

বাদশাহের দিকে সোজা দৃষ্টি ফেলে বলি,—খলিলুল্লা খাঁয়ের কাছ থেকে কোনও কৈফিয়ত তলব করেছেন কি?

পিতার শরীরের কম্পন আমার দৃষ্টি এড়ায় না। তিনি ঢোক গিলে আমার দিকে চেয়ে বলেন, —কেন বলতো?

—নতুন জায়গায় এসে এভাবে দরবারে অনুপস্থিত থাকা অমার্জনীয় অপরাধ।

—হয়তো সে অসুস্থ।

—না। আর আপনি জানেন সেকথা।

—জাহানারা!

—বাদশাহ্, তাঁর প্রতি আপনার এই দুর্বলতার কি কোনও বিশেষ কারণ আছে? আগ্রা থেকে আসার পথে তাঁর ব্যবহারে আপনাকে রাগান্বিত হতে দেখেছি। এখন তো দেখি না।

নিজের দেহকে সোজা রাখবার জন্যেই যেন মিনারের গায়ে হেলান দেন। যমুনার স্রোতের দিকে নিষ্পলক চেয়ে থাকেন। শেষে বলেন-জাহানারা, অতটা বুদ্ধিমতী হয়ো না। তুমি নিজেই দুঃখ পাবে।

—আমার বুদ্ধি সম্বন্ধে যখন একবার সচেতন করে দিয়েছেন, তখন তাকে আবার থাবা দিয়ে চেপে দেবার চেষ্টা করবেন না। আমি স্বাধীন।

তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে আমার আপাদমস্তক দেখে নিয়ে কোনও কথা না বলেই তিনি স্থান ত্যাগ করেন। আমি ভাবতে বসি।

বাদশাহ্-বেগম উপাধি দেবার পর মুহূর্তেই তাঁকে এভাবে আঘাত না দিলেও পারতাম।

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *