মমতাজ-দুহিতা জাহানারা – ২

সে রাত্রে এক অদ্ভুত শব্দ স্বপ্ন দেখলাম। এ স্বপ্নের কথা কাউকে বলা যায় না। অথচ না বললে চলবে না। রোশনারার কাছে আমি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, কিতাব দুখানায় প্রতিটি অক্ষর সত্যি লিখব-মিথ্যের নামগন্ধ থাকবে না তাতে।

কিন্তু বলতে গিয়ে কান গরম হয়ে উঠছে। নিজের অস্তিত্বে নিজেরই লজ্জা হচ্ছে। পৃথিবীতে আমি ছাড়া দ্বিতীয় প্রাণী যদি আর না থাকত তবু স্বপ্নের বিবরণ নিজের কানকে শুনিয়ে উচ্চারণ করতে পারতাম না। ছি ছি।

রোশনারার কাছে আমি মনে মনে অপরাধী হলাম। প্রমাণ হয়ে গেল, তাতে আমাতে কোনও তফাত নেই, জেগে উঠেই সব স্বপ্নের মতো একেও উড়িয়ে দিতে পারলে বিবেকের এ-দংশন সহ্য করতে হত না। কিন্তু তা তো পারিনি।

ভোর রাতে স্বপ্ন টুটে গেল। মৃদু সমীরণে রজনিগন্ধার লুপ্তপ্রায় সুবাস। চোখ মেলেই শেখ ইবন্-উল-আরাবীর মতো শক্তি লাভের জন্যে আল্লার কাছে সজল নয়নে আকুতি জানালাম। শেখ ইবন্ চিন্তাশক্তি দ্বারা স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করার দুর্লভ রহস্য জানতেন।

বলব সেই লজ্জার কথা? বলেই ফেলি। হাজার হলেও মুখ ফুটে তো বলতে হচ্ছে না। লেখা আর বলা এক কথা নয়।

দেখলাম শিশমহলের ওপরে দাঁড়িয়ে আবু সাইদের প্রেমের গান এক সময় আমাকে আকুল করে তুলল। সামলাতে পারলাম না নিজেকে। সবার অলক্ষ্যে বের হয়ে পড়লাম প্রাসাদের ঘেরা প্রাচীরের বাইরে। সংগীতের সুর ভেসে আসছে তখনো প্রান্তরের দিক থেকে। সেদিক পানে চলতে শুরু করি। আমার গাছের ওড়না পথের ধুলোয় লুটোতে লুটোতে চলে। দেখলাম, তবু তুলে নেবার শক্তি হল না নিজের হাতে। সংগীত আমার দেহমনকে অবশ করেছে। আমার নিজের বলতে কিছুই নেই। এ পথে যমুনার তীর বেয়ে গেলেই তো হিন্দুদের তীর্থস্থান বৃন্দাবন আমি জানি বৃন্দাবনের সেই শ্রীকৃষ্ণের কাহিনী। জানি, রাধিকা, আর তাঁর অভিসারের কথা। সেই পথেই হয়তো কোনও এক সুদূর অতীতে অভিসারে চলেছিলেন তিনি। আজ আমিও চলেছি এক অচেনা দুর্গম পথে। আমার নায়ক কে?

আবছা অন্ধকার নেমে এসেছে পৃথিবীতে। আমি এগিয়ে যাই। শেষে একসময় দূর থেকে দেখতে পাই তাকে। আমার বুক নেচে ওঠে। ধীরে ধীরে উপস্থিত হই গায়কের একেবারে পাশটিতে।

কিন্তু একী! এ যে রোশনারা কর্তৃক বিতাড়িত খোজা। এত মিষ্টি তার গলা? উদাস স্বরে চলেছে সে। কোনওদিকে দৃষ্টি নেই তার। চোখ বেয়ে অবিরল ধারে অশ্রু ঝরে পড়ছে। তার অতি সুন্দর মুখখানা ব্যথায় থমথমে। প্রাণের দরদ দিয়ে সে গেয়ে চলেছে।

সহসা সন্দেহ হল মনে। সত্যিই কি খোজা? খোজা কি এমন দরদ দিয়ে গাইতে পারে? ধীরে ধীরে তার গা ঘেঁষে দাঁড়াই। আমার গায়ের খুশবু পেয়ে সে যেন সংবিৎ ফিরে পায়। সে বুঝতে পারে শেষে। আমার দিকে চেয়ে তার সর্বশরীর থরথর করে কেঁপে ওঠে। সে বিহ্বল।

ধীরে ধীরে ডাকি—শোভান।

—শাহজাদী।

—এ কি তোমার মনের কথা?

শোভানের মুখ নিচু হয়। অনেকক্ষণ পরে সে মুখ তোলে। ধীর গম্ভীর স্বরে বলে, হ্যাঁ শাহজাদী।

—কিন্তু কী করে সম্ভব?

—আঁধারে শোভানের মুখ অস্পষ্ট। কিন্তু তার অশ্রুপূর্ণ চোখদুটি স্থির সরোবরের মতো টল্ করছিল। সেই চোখের দৃষ্টি কয়েক দণ্ড আমার চোখের সঙ্গে জট পাকিয়ে যায়।

—আমি খোজা নই শাহজাদী।

—তবে?

—আমি পুরুষ।

—পুলক-শিহরন প্রবাহিত হয় আমার শরীরের সমস্ত শিরা-উপশিরায়। তার সুঠাম দেহের ওপর হাত রেখে বলি—সত্যি বলছ তুমি?

—হ্যাঁ। আপনি এসে দাঁড়িয়েছেন আমার পাশে—এ যেমন সত্যি। এই দিনকে এতদিন স্বপ্ন বলে ভাবতাম।

—শোভান। তবে তুমি —

—হ্যাঁ। কত কৌশলে খোজা বলে নিজের পরিচয় দিয়ে হারেমে থাকার অধিকার পেয়েছিলাম।

—কিন্তু কেন? কেন এই প্রবঞ্চনা? তুমি কি জানো না এর শাস্তি কত ভয়ঙ্কর?

—জানি।

তবে?

—তুর্কি-বেগমের প্রাসাদের উদ্যানে এক সন্ধ্যায় যাকে হঠাৎ দেখে ফেলেছিলাম, তাকে যে না দেখে থাকার কথা কল্পনাও করতে পারি না শাহজাদী। তাই প্রবঞ্চনার আশ্রয় নিতে হল। আমি জানি–ধরা পড়ব আমি। মৃত্যুদণ্ড হবে। তবু খেদ থাকবে না।

—কাকে দেখেছিলে শোভান?

সে চুপ করে থাকে। পাথরের মতো স্থির তার বলিষ্ঠ দেহখানি। চেয়ে থাকি আমি সেইদিকে কয়েক মুহূর্ত। অন্তরে আমার অদমনীয় কৌতূহল। অথচ তার স্তব্ধতার দিকে চেয়ে আবার প্রশ্ন করতে মন সায় দেয় না। সে যেন কোনও ইবাদতখানায় বসে আল্লার কাছে প্রার্থনারত।

দীর্ঘ সময় পার হয়ে যায়।

শেষে আমিই শুরু করি।

শিশমহলে তোমার সঙ্গে রোশনারার ব্যবহারের আমি একমাত্র সাক্ষী।

ভীত হয় শোভান। আমিও তাই চাই। আমার মনের গভীর অন্ধকারে হিংসার বীজে কে যেন জলসেচন করেছে। সে বীজ ফেটে অঙ্কুর বের হয়েছে। সে অঙ্কুর আলোর জন্যে ছট্‌ফট্ করে মাটি ভেদ করে ওপরে উঠতে চায়।

—রোশনারার ব্যবহারে আমি লজ্জিত। কিন্তু যার জন্যে এতখানি দুঃসাহসী হলে তুমি, তাকে পেয়ে কি তোমার স্বপ্নসৌধ চুরমার হয়ে গেল শোভান?

শোভান কী যেন বলার চেষ্টা করে। আমি থামিয়ে দিই। আমি নিষ্ঠুর। আঘাতের পর আঘাত হেনে ওর হৃদয়কে রক্তাক্ত করে তুলব।

—কোনও বৈলক্ষণ্য দেখলাম না শোভান তোমার দেহে কিংবা মনে রোশনারার পরশে। ঠিক যেন সত্যিকারের খোজা। কেন শোভান? কেন এমন ব্যবহার করলে? সবই তো পেয়েছিলে। স্বপ্নকে সার্থক করে তুললে না কেন?

—শাহজাদী। অতি কষ্টে মুখ খোলে শোভান।

—তুমি কি শুধু মন চাও? আমাকে তাই বিশ্বাস করতে হবে?

আর্তনাদ করে ওঠে শোভান। সে আর্তনাদ আকাশ চিরে, বাতাস চিরে কীসের পানে যেন ধাওয়া করে। খুশি হই আমি। খুব খুশি হই।

—তেমনভাবে ভাবলে রোশনারার চপেটাঘাত কি খুব অন্যায় হয়েছে শোভান? ভাঙা গলায় শোভান বলে ওঠে,—সব ভুল। সব ভুল শাহজাদী। আপনি ভুল বুঝেছেন।

—ভুল?

শোভান ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়। আমার পানে চায়। সে দৃষ্টিতে কীসের যেন ব্যাকুলতা। সেই ব্যাকুলতা-ভরা চাহনি দিয়ে আমার দৃষ্টিকে বন্দি করে রেখে সে বলে,—আপনার বোনকে আমি তুর্কি-বেগমের উদ্যানে দেখিনি।

—কাকে দেখেছিলে তবে?

—তোমাকে, তোমাকে জাহানারা। আমাকে ধরিয়ে দাও। মৃত্যুদণ্ড দাও। তবু বলব তোমাকে দেখেছিলাম। তারই জন্যে এত প্রবঞ্চনা—তারই জন্যে এত গোপনীয়তা। আর শুধু তারই জন্যে রোশনারার স্পর্শে আমার পৌরুষ গলে পড়েনি।

চতুর্দিকে আমার যেন সব শূন্য হয়ে যায়। আমার পাশে কিছু নেই! আমার পায়ের নীচে কিছু নেই, কোনওদিকে কিছু নেই। আশ্রয়ের জন্যে আকুল হয়ে হাত বাড়াই। আশ্রয় মেলে। শোভানের বক্ষের নিবিড়তা।

এবারে আমার কান্নার পালা।

ঘুম ভেঙে যায়।

ব্যাকুল হয়ে আল্লাকে ডাকি। শেখ-ইবন্-উল-আরাবীর শক্তি আমাকে দাও আল্লা। আমি স্বপ্নকে সার্থক করে তুলি।

.

দূরে যমুনার কুলে বাইশ হাজার কর্মরত শ্রমিকের কোলাহল বকুল গাছের ভ্রমর-গুঞ্জনের মতো প্রতিদিন কানে ভেসে আসে। এই গুঞ্জন আমার মনকে এক অবর্ণনীয় বিষাদে ভারাক্রান্ত করে তোলে। নিজের ভাইবোনেদের তখন বড়ই আপন বলে মনে হয়। দুর্বিনীত রোশনারার ওপর তখন আর রাগ করতে পারি না। মোল্লাশালের তত্ত্বাবধানে শিক্ষিত শুষ্ক-হৃদয় আওরঙজেবের প্রতি করুণা জাগে। দুই বছর আগে দক্ষিণ-ভারতের শাসনকর্তা হয়ে গিয়েছে সে। কতই বা বয়স ছিল তখন। আমি জানি, বাদশাহ্ ইচ্ছে করেই তাকে দূরে সরিয়ে দিয়েছেন। মুখে সবাই তার দোষারোপ করে। সে অন্য ভাইদের মতো সহজ সরল নয়। কিন্তু এর জন্যে কি সে দায়ী? বাবার ভাগ্যের ওপর আল্লার কৃপাদৃষ্টি বর্ষণের জন্যেই যেন তার মনকে কোরবানি দেওয়া হয়েছে। সে-মনকে ফিরে পাবার বাসনা জাগতে পারে। পেলে আনন্দিত হবে সবাই। কিন্তু না পেলে আওরঙজেবকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। তাই বিশেষ করে বাবা যখন তার সমালোচনা করেন হারেমের বেগমদের সামনে তখন মাঝে মাঝে মনে বড় ব্যথা পাই। ব্যথা পাই যমুনাকুলের বাইশ হাজার কর্মীর কর্মের কলরব কানে আসে বলে।

এখনো স্পষ্ট মনে পড়ে, বাবা যখন বাদশাহ্ জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে, শেষে দাক্ষিণাত্যে পালিয়ে গিয়ে ক্ষমা চেয়ে পাঠালেন তখন নিজের সততার নিদর্শনস্বরূপ দারাশুকো আর আওরঙজেবকে রাজধানীতে পাঠিয়েছিলেন। তাঁর সেই ভুলেরই মাসুল গুণতে হচ্ছে আজ। দারার কিছুটা বয়স হয়েছিল তখন। সে শিক্ষা পেয়েছিল যথেষ্ট তার আগেই। কিন্তু আওরঙজেবের তখন কচি বয়স। শিক্ষার হাতেখড়ি হয় সেই বয়সে। যেবার মমতাজ বেগম জেসমিন প্রাসাদে নূরজাহানের সঙ্গে সৌজন্যমূলক সাক্ষাৎ করতে গিয়েছিলেন, সেবার নূরজাহান নিজের মুখে স্বীকার করেছেন যে আওরঙজেবের শিক্ষায় বাধা সৃষ্টি করার কোনও চেষ্টা থেকেই তিনি বিরত হননি। এমনকী সে যাতে অমানুষ হয়ে ওঠে তার পাকাপোক্ত ব্যবস্থাও তিনি করে ফেলেছিলেন। আজ নূরজাহান সে সব দিনের কথা বলতে গিয়ে জেসমিন প্রাসাদের পাষাণের ওপর যত চোখের জলই ফেলুন না কেন, সে জলের ধারা তাঁর নিজের হাতে ছোপ দেওয়া আওরঙজেবের হৃদয়ের কালিমা কিছুতেই ধুয়ে সাফ্ করে দিতে পারবে না। তবু হয়তো পারা যেত। কিন্তু দারা বলে, মোল্লাশালের নীরস শিক্ষা সে পথেও অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। দারা নাকি বাদশাকে অনেক বুঝিয়েছিল যে আওরঙজেবের জন্যে একজন প্রকৃত জ্ঞানী শিক্ষাগুরু নিয়োগের জন্যে, বাদশাহ্, শোনেননি। কেন যেন ওকে তিনি দেখতে পারেন না। আমির ওমরাহেরা বলাবলি করে, এসবের কারণ আওরঙজেবের ক্ষুরধার বুদ্ধি। হারেমের বেগমরা ফিসফিস করে বলে, আওরঙজেবের অপরূপ রূপই এর কারণ। পুত্রের প্রতি পিতার অবচেতন মনের ঈর্ষা। জানি না কোটি সত্যি, কোটি মিথ্যা। কিংবা কোনওটাই সত্যি কি না। শুধু কষ্ট হয়। কষ্ট হয় যুমনাকুলের কলরব, গুঞ্জনের মতো ভেসে আসে বলে। সে গুঞ্জন মনে করিয়ে দেয় আমরা কটি ভাইবোন যে মায়ের গর্ভে জন্মেছি, তিনি আমাদের ছেড়ে বেহেস্তের পথে বহুদূর এগিয়ে গিয়েছেন। আমরা মা-হারা। সেই মায়ের সমাধির ওপর বাদশাহ্ শাহজাহানের আদেশে দিনের পর দিন তিলে তিলে গড়ে উঠছে তিলোত্তমা।

বোগদাদ, আরব, সিংহল আর মিশর থেকে মহামূল্য স্ফটিক স্বচ্ছ প্রস্তররাজি এনে স্তূপীকৃত করা হয়েছে। পৃথিবীর অদ্বিতীয় হর্ম্য নির্মাণের অদম্য বাসনায় বাদশাহ্ পাগল। নির্মাণে তো নয় যেন রচনা। শিল্পীরা দিনের পর দিন এক একটি ছত্র রচনা করে চলেছে কবিতায়। এ যেন আবু সাইদ আর নাসীর-ই-খসরুর অপূর্ব সমন্বয়—প্রেম আর আধ্যাত্মিকতার মিলনক্ষেত্র।

তাজমহলের প্রধান শিল্পী ইসা-মামুদ-ইফেদি। তিনি এক প্রতিভাবান যুবকের কথা বাদশাহ্ কে বলেছিলেন। সেই যুবকের সাক্ষাৎ পেলাম একদিন পিতার সঙ্গে গিয়ে

যুবক তন্ময় ছিল। আমাদের উপস্থিতি টের পায়নি। নক্শা ছেড়ে সে একটি পাথর খোদাই-এ মনোনিবেশ করে। তবু খেয়াল করে না।

বাদশাহ্ সহসা প্রশ্ন করেন,—তাজমহলের নক্শার পরিবর্তন করছ?

কিছুমাত্র সচকিত হয় না যুবক! আমাদের দিকে না চেয়েই স্বাভাবিক গলায় জবাব দেয়, – হ্যাঁ।

—কার হুকুমে?

এবারে যুবক বাদশাহ্রের দিকে চায়। কিন্তু তার পোশাক দেখেও চিনতে পারে না। বলে, —ইসা-মামুদ-ইফেদি আমাকে সে স্বাধীনতা দিয়েছেন।

তাঁর নক্শা অনুযায়ী কাজ হলে কোনও অসুবিধে হত?

তিনি খুবই উঁচুদরের শিল্পী। তবে আমার এই পরিবর্তনে তিনি অনুমতি দিয়েছেন। আপনি বাদশাহ্?

—হ্যাঁ।

যুবক আচমকা লাফিয়ে উঠে অভিবাদন করে। রীতিমতো অপ্রস্তুত হয় সে। অবগুণ্ঠনের অন্তরালে আমি হেসে ফেলি।

এরপর প্রতিদিন তাজমহলে গিয়ে বাদশাহ্ শিল্পীর পাশে দাঁড়িয়েছেন। বিস্মিত দৃষ্টিতে তার বেহেস্ত-ছোঁয়া দৃষ্টির দিকে চেয়ে থেকেছেন। কোনও কথা বলেননি তাকে। কথা বললে তার স্বপ্ন ভেঙে যাবে—সে বাস্তব জগতে ফিরে আসবে। বাদশাহ্ তা চান না। কত সময় শিল্পী তাঁকে ‘সিজদা’ করেনি—উঠে দাঁড়ায়নি। এমনকী কথা পর্যন্ত বলেনি। অথচ বাদশাহ্রের মুখে তার কোনও প্রতিক্রিয়া দেখতে পাইনি আমি।

তবু একটি জিনিস আমার নজর এড়ায় না। শিল্পীর প্রতি ভুলেও কখনো শ্রদ্ধা প্রকাশ করতে দেখেনি তাঁকে। প্রধান শিল্পী ইসা-মামুদের প্রতিও নয়।

বাদশাহ্ পুরুষ। তাঁর বাস্তববুদ্ধি প্রখর। তিনি জানেন, আজ থেকে অনেক বছর পরে প্রকৃতি যদি করুণা করে তাজমহলকে বাঁচিয়ে রাখে, তখন ইসা-মামুদ কিংবা অন্য শিল্পীকে সবাই ভুলবে। শাহনশাহ্ শাহজাহানের কথা কেউ ভুলতে পারবে না। প্রতিদিন পিতার তাজমহল পরিদর্শনের সময় তাঁর নিত্য-সঙ্গী হিসাবে আমার সব আনন্দের মধ্যে এইটুকুই শুধু দুঃখ।

ইসা-মামুদের এই তরুণ সহকারীর মনের কথা জানবার অদম্য কৌতূহল হয় আমার। দিনের পর দিন চেষ্টা করেও সে কৌতূহলকে সংযত করতে ব্যর্থ হই।

শেষে দুঃসাহসী হয়ে উঠি। আমার পরম বিশ্বস্ত নাজীর কোয়েলের কাছে একদিন তার অতি সাধারণ একপ্রস্থ পরিচ্ছদ চেয়ে বসি। কোয়েল কিছুক্ষণ হাঁ করে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। কী দেখে সেই জানে। শেষে উঠে গিয়ে কিছুক্ষণ পরে নিয়ে আসে পোশাক।

—এ যে হিন্দুর পোশাক কোয়েল।

—আমি মুসলমান কবে হলাম শাহজাদী!

—হিন্দুর পোশাকে তোমাকে তো দেখিনি কখনো।

—হারেমের বাইরে নগরীর রাজপথে আমি নাজীর নই। সেখানে আমি হিন্দু রমণী। রাজপুত।

—কিন্তু এ পোশাকে যে চলবে না।

একদণ্ড স্থির হয়ে থেকে কোয়েল প্রশ্ন করে,—শাহজাদী, অপরাধ না নিলে জানতে পারি কি কেন আপনার এ খেয়াল হল?

কোয়েলকে গোপন ইচ্ছার কথাটা জানাতে আপত্তি ছিল না কারণ তাকেই সঙ্গী হিসাবে নিতে হবে। বললাম তাকে সব কিছু খুলে। যদিও বাদশাহ্রে মনোভাবের কথা জানতে দিলাম না।

কোয়েলের মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা দেয়। বলে, বড় বেশি ঝুঁকি নিচ্ছেন শাহজাদী।

—জানি।

—না গেলেই ভাল করতেন।

—আমি যাব।

আমার দৃঢ়তা দেখে কোয়েল চুপ করে থেকে শেষে বলে,–এ পোশাকেই যান তবে।

—কেন?

—রাজপুত রমণী মুসলমানদের মতো অতটা পর্দানসীন নয়। অন্য পুরুষের সঙ্গে কথা বলার সুবিধা হবে আপনার

আমার মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। কোয়েলের বুদ্ধির তারিফ না করে পারি না। কিন্তু পরক্ষণেই নিরাশ হই। এ-বেশে হারেম থেকে বাইরে যাওয়ার অনেক বিপদ। কারণ হারেমে এ-বেশে কেউ ঘুরে বেড়ায় না।

কোয়েল আমার মনোভাব বুঝতে পেরে বলে ওঠে,—আপনি হতাশ হবেন না শাহজাদী। ওড়নাটা গায়ে জড়িয়ে চলে গেলে কেউ বুঝতে পারবে না। তবে আজকের দিবানিদ্রার মোহটুকু ছাড়তে হবে আপনাকে। দুপুরেই আসল সময়। সবাই ঘুমিয়ে থাকবে। পেছনের দরওয়াজার প্রহরীকে শুধু বশ করা।

—কী করে বশ করব?

কোয়েল বুড়ো আঙুলের সঙ্গে তর্জনী ছুঁইয়ে হাসিমুখে ইশারায় জানায়—টাকা।

সারা ভারতের সর্বকালের সব চাইতে ঐশ্বর্যশালী বাদশাহের নন্দিনী হয়ে নিজের হারেম থেকে চুপিসারে বের হবার জন্যে নিজেরই এক প্রহরীকে ঘুষ দিতে আমার গজদন্তের পেটরা খুলে কয়েকটি স্বর্ণমুদ্রা কোয়েলের হাতে তুলে দিই। জানি অন্যায় করছি—খুবই অন্যায় করছি। কিন্তু উপায় নেই।

নিজের হাতে আমাকে রাজপুত রমণীর বেশে সাজিয়ে দেয় কোয়েল। আগ্রহ ভরে পরে ফেলি আমি। আমাদের পোশাকের সঙ্গে ওদের পোশাকের কত মিল, আবার কত অমিল। পোশাকের অমসৃণতা আমার ত্বক প্রথমটা সহজভাবে নিতে পারেনি। একটু জ্বালা ধরায়। কিন্তু আমার ইচ্ছার প্রবলতা সে জ্বালাটুকুর কথা ভুলিয়ে দেয়। সহজ হয়ে আরশির সামনে গিয়ে নিজের নতুন রূপ দেখে হেসে ফেলি। কোয়েলও কাছাকাছি কোথাও দাঁড়িয়ে হাসছে ভেবে মুখ ফেরাই।

কোয়েল গম্ভীর। আমার দিকে তার চোখ ছিল না। গবাক্ষের বাইরে রৌদ্রোজ্জ্বল আকাশের দিকে ব্যথাভরা দৃষ্টিতে চেয়েছিল সে।

—কী হল কোয়েল? হাসছ না?

চমকে ফিরে দাঁড়িয়ে মুখে জোর-করা হাসি টেনে সে বলে,–এই তো হাসছি শাহজাদী। বেশ মানিয়েছে।

—আমাকে কি এতই বোকা ভাব তুমি?

—সে কি শাহজাদী! কোয়েলের কথায় অপার বিস্ময়।

—আমি ভুলছি না। বলো, কেন তুমি গম্ভীর। কী ভাবছ তুমি?

—আমাদের কি ভাবনার অন্ত আছে শাহজাদী? সে-সব কথা না-ই বা শুনলেন।

—না, বলো। আমার গলায় আদেশের সুর।

বেশ কিছুক্ষণ কাটে। তবু কোয়েল চুপ করে থাকে। তার মাথা নিচু। বুঝতে পারি, যে কথাই হোক, বলার ইচ্ছে ছিল না তার। শুধু আমার আদেশ বলেই বলবে। প্রস্তুত হচ্ছে তার জন্যে মনে মনে।

আমার দিকে সোজা দৃষ্টি ফেলে কোয়েল বলে,–এই পোশাক ছিল আমার বোনের শাহজাদী। এটি পরতে গিয়ে আপনার কত অস্বস্তি। অথচ আমার বোন প্রাণভরে পরতে চাইত না। তার সব চাইতে ভাল পোশাক ছিল ওটি। বাড়ির কেউ ওতে হাত দিলে সে কীভাবে যেন টের পেত। যেখানেই থাকুক ছুটে আসত হন্তদন্ত হয়ে। মা রাগ করতেন কত। ঠাকুমা হেসে বলতেন, পাগলি। বিয়ে হলেই ঠিক হয়ে যাবে। ওর বাপও ঠিক অমনটি ছিল। ঠাকুর্দার তরোয়াল ছিল তার প্রাণ। কেউ হাত দিতে পারত না। শেষে তরোয়ালই তার কাল হল।

—বোনটি কোথায়? বিয়ে হয়েছে কতদিন?

—বিয়ে তার হয়নি শাহজাদী

—তবে কোথায় সে?

কোয়েল রৌদ্রোজ্জ্বল আকাশের দিকে আর একবার চেয়ে আঙুল দিয়ে দেখায়। আমার গায়ের মধ্যে শিউরে ওঠে। পোশাকটিকে ভারী বোঝা বলে মনে হয়। ছেড়ে ফেলতে পারলে বাঁচি। চেঁচিয়ে উঠি,—কী করে অমন হল?

—যমুনায় নাইতে গিয়েছিল বন্ধুদের নিয়ে। সবাই ফিরে এল, ও এল না।

—আমায় আগে বলনি কেন? পরতাম না তোমার বোনের জিনিস।

—সে কি শাহজাদী!

—তার স্মৃতি বিজড়িত জিনিসটি না আনলেই পারতে কোয়েল। তাছাড়া তার যখন এত মায়া ছিল এটির ওপর।

—সে বেঁচে থাকলে, আপনি পরবেন জানলে ছুটে এসে দিয়ে যেত। আপনি তো একবার মাত্র ব্যবহার করবেন। আবার তুলে রেখে দেব। একটি স্মৃতির জায়গায় দুটি স্মৃতি জড়িয়ে থাকবে ওটির সঙ্গে।

তবু মনের ভেতরে একটা দ্বিধা থাকে। সে দ্বিধা নিয়ে দুপুর হতেই কক্ষ থেকে বের হই। কোয়েল আগে আগে চলে। সব দিক ভাল করে দেখে শুনে নিয়ে সে ইশারা করে, আর আমি একটু একটু করে এগিয়ে যাই। কক্ষের পর কক্ষ পার হই। নিস্তব্ধ সব! ঘুমন্ত পুরী। শুধু খোজাদের ভারী পায়ের মশমশ শব্দ এদিক-ওদিক থেকে ভেসে আসে। হারেমের নাজীরদের আড্ডাখানা থেকে চাপা কথা আর কুৎসিত হাসির মিলিত আওয়াজ শুনতে পাই। এ সময়ে তাদেরও বিশ্রাম কোয়েলের মুখে শুনেছি, তারা এ সময়ে নিজের নিজের বেগমদের কেচ্ছার কথা আলোচনা করে নারকীয় আনন্দ উপভোগ করে।

দরজার প্রহরী দূর থেকে আমাকে আর কোয়েলকে দেখে মুচকি হেসে দূরে সরে যায়। প্রাসাদের বাইরে পা দিয়ে তবে নিশ্চিন্ত হই।

শিল্পী এখনও পাথরের ওপর নিপুণ হাতে সূক্ষ্ম খোদাই-এর কাজ করে চলেছিল একমনে। কোয়েলকে একটু দূরে অপেক্ষা করতে বলে আমি তার পেছনে গিয়ে দাঁড়াই। দেখতে পায় না আমাকে। অমনভাবে যদি আরও বহুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকি আমি তবু দেখতে পাবে না সে। সে তন্ময়—মনের রসকে রূপ দিচ্ছে। সৃষ্টির উন্মাদনা তার শিরায়-উপশিরায়। আমি সেই অপূর্ব সৃষ্টি অবাক্ বিস্ময়ে নিরীক্ষণ করি। মায়ের সমাধি-সৌধ পরিশেষে কী রূপ নেবে, পৃথিবীর শুধু দুজন মানুষ তা জানে। সে দুজনের একজন আমার সামনে। ভাবতেও ভাল লাগে।

আমি জানি প্রস্তরখণ্ডের ওপর ওই সূক্ষ্ম খোদাই-এর কাজ শেষ হলে শিল্পী সেটি অন্যান্য ভাস্করের সামনে রেখে নির্দেশ দেবে ওটি দেখে প্রয়োজনমতো দৈর্ঘ্য-প্রস্থের প্রস্তরে খোদাই করতে। সেই খোদাই করা প্রস্তরখণ্ডগুলি সযত্নে দড়ি দিয়ে তুলে হর্মের একটি স্থানে স্থাপন করা হবে। শিল্পী জানে কোথায় হবে তাদের স্থান। কারণ ইসা-মামুদের প্রিয় সহকারী সে।

শিল্পী ঘামছিল। সূর্যরশ্মির প্রখরতা ততটা না থাকলেও সে ঘামছিল। অতিরিক্ত একাগ্রতা মস্তিষ্ক ও দেহে যে চাপের সৃষ্টি করে তাতেও মানুষ ঘামে। শিল্পীর কামিজ ভিজে উঠেছিল। তার কানের পাশ বেয়ে ঘাম পড়ছিল পাথরের ওপর। ওড়না দিয়ে ওর মুখ মুছিয়ে দিতে ইচ্ছে হল আমার। এত বড় একটা কাজ যার পরিচালনায় এগিয়ে চলেছে তাকে বড় অসহায় বলে মনে হল। ঠিক একটি ছোট্ট শিশুর মতো—যে শুধু খেলতেই জানে, নিজের ভালমন্দ বোঝে না।

এক সময় সে হঠাৎ কাজ থামায়। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নানান্ ভাবে দেখে পাথরের ওপর নিজের কাজ। পরিতৃপ্তির শ্বাস ফেলে। তারপর হঠাৎ মুখ ঘুরিয়ে একেবারে কাছটিতে আমাকে দেখে অবাক হয়।

—কে তুমি?

মাথার ওড়না ফেলে দিয়ে মৃদু হেসে বলি,—আমি

শিল্পী আমার দিকে চেয়ে থাকে। চোখের পলক পড়ে না তার। তার চাহনির আদি অন্তের হদিস মেলে না। বহুদূর থেকে যেন সে চেয়ে রয়েছে। যেন বহু যোজন দূর থেকে পৃথিবীর ওপর দৃষ্টি ফেলেছে চাঁদ। আমি লজ্জিত হই না। আমার মনে হয় এটাই যেন সব চাইতে স্বাভাবিক। আমি তৃপ্ত হই।

—কী সুন্দর! শিল্পীর কথা অস্ফুট।

—পাথর রয়েছে আপনার। আমার একটা মূর্তি গড়বেন?

চঞ্চল হয়ে ওঠে শিল্পী। মুখে তার আনন্দের উচ্ছ্বাস। চোখ দুটি তার উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। কিন্তু এক মুহূর্ত পরেই একটা হতাশা তাকে আচ্ছন্ন করে। সে ধীরে ধীরে অস্বীকার করে।

—কেন?

—অনেক সময়ের দরকার। অত সময় তো তুমি দিতে পারবে না আমায়।

—কত সময়ের দরকার?

—অনেক—অনেক। তুমি পারবে না।

—যদি পারি।

—গম্ভীর হয় শিল্পী। ধীরে ধীরে বলে,– পারবে না। আমার কাছে তুমি আজীবন থাকতে পারবে?

—আজীবন?

—হ্যাঁ। তোমাকে দেখে আমার তাই মনে হচ্ছে। তার আগে কি মূর্তিতে প্রাণ-প্রতিষ্ঠা করতে পারব? এ রূপের যে অন্ত নেই।

চুপ করে থাকি। শিল্পী একটাও মিথ্যে কথা বলছে না জানি। মনেপ্রাণে সে যা বিশ্বাস করে তাই বলছে। তার হতাশা ভাব কেটে যায়। সাময়িক একটা প্রলোভন থেকে সে নিজেকে ছিনিয়ে নেয়। স্বাভাবিক উদাসীনতা ফিরে পায় সে।

—বড় ঘেমেছেন আপনি।

—ও, তাই নাকি? তাই তো।

ওড়নাটা ওর হাতে দিয়ে বলি,—মুছে ফেলুন।

বাধ্য ছেলের মতো সে ওড়নার একপ্রান্ত দিয়ে মুখ মুছে ফেলে সেটি ফিরিয়ে দেয় আমাকে। আড় চোখে একটু দূরে দণ্ডায়মান কোয়েলকে দেখি। ওড়নাটিও তার বোনেরই। মৃত বোনের জিনিসের ব্যবহার দেখে তার মধ্যে কোনও বৈলক্ষণ্য উপস্থিত হয়েছে বলে বোধ হল না। সে যেন একটু খুশি।

আমি শাহানশাহ্ শাহজাহানের কন্যা জাহানারা। জীবনে নিজের কোনো কাজ বড় একটা করেছি বলে মনে হয় না। অথচ শিল্পীর রোদে-পোড়া মুখের নতুন জমে-ওঠা ঘামের দিকে চেয়ে বলে ফেলি,—হাওয়া করি?

—না। সেকি? না। থতমত খায় সে।

আমিও লজ্জা পাই। ছি ছি। ওড়না দিয়ে হাওয়া করা কোয়েলও ঠিক সাধারণভাবে নিত না। একটু হলেই শাহজাদীর সম্মান ধুলোয় লুটিয়ে দিতাম।

কর্মব্যস্ত শ্রমিকের নজর পড়েছে আমার ওপর। কাজের ভানে বড় বেশি ঘোরাঘুরি করতে শুরু করেছে আমাদের আশেপাশে। অথচ ঠিক যেখানে শিল্পী বসে রয়েছে সেখানে শিল্পকার্যের নমুনা সংগ্রহ করা ছাড়া তাদের উপস্থিতির প্রয়োজনই নেই! যেটুকু আছে, তাতে এত শ্রমিকের আনাগোনা বড় বেশি দৃষ্টিকটু।

সংকুচিত হই আমি। ঘাম-মোছা ওড়না মাথার উপর আবার টেনে দিই।

—তুমি এলে কী করে এখানে? মেয়েদের তো এখানে আসতে মানা।

তবু ভাল, শিল্পীরও নজরে পড়েছে তার অধীনস্থদের উগ্র কৌতূহল।

ভাঙা, অকেজো টুকরো-পাথর স্তূপীকৃত করা রয়েছে একদিকে। কয়েকজন লোক তার থেকে বেছে সংগ্রহ করছে নিজেদের পছন্দমতো। সেইদিকে দেখিয়ে বলি,—কয়েক টুকরো নিতে এসেছিলাম।

—সাংঘাতিক।

—কেন?

—আমার খেয়াল ছিল না। নইলে তোমাকে দেখামাত্র বের করে দিতাম এখান থেকে। –সত্যিই আসতে নেই মেয়েদের?

—না।

—কী হয় এলে?

শিল্পী সংকুচিত হয়ে বলে,—তুমি বুঝবে না।

—বলুন না।

একটু ইতস্তত করে সে। শেষে বলে, কত পুরুষ এখানে। বাইশ হাজার। কত দূর দেশ থেকে এখানে এসে কাজ করছে, পরিবারের কাছ-ছাড়া হয়ে! তাই।

—কী তাই?

—জানি না, চলো তোমাকে বাইরে রেখে আসি।

—আপনিও তো দূর দেশের লোক।

—কী করে জানলে?

—জানতে অসুবিধে আছে নাকি। চেহারা দেখলে বোঝা যায় না?

—ঠিক বলেছ। কিন্তু আমি ঠিক—

হেসে উঠি।

—হাসলে যে?

—এমনি। আচ্ছা এখানে কখনো কোনও স্ত্রীলোক আসেনি?

—না।

—একজনও নয়?

—না।

—একজনও?

শিল্পীর ললাটের রেখা কুঞ্চিত হয়। যমুনার জলের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে ওঠে—একজন আসেন।

—কে তিনি?

—শাহজাদী জাহানারা

—তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন?

—পাগল নাকি? তিনি কি তোমার মতো রাজপুত? তাছাড়া আমার মতো সামান্য লোকের সঙ্গে কথা বলবেন কেন?

—তাঁকে দেখেননি?

—না।

—খুব সুন্দরী নিশ্চয়—তাই না?

—হয়তো তাই। কিন্তু তোমার মতো কখনই নয়।

—আমি সুন্দরী?

—জানো না? আরশিতে মুখ দেখো না বুঝি? শিল্পীর স্বরে অভিমানের আভাস।

আমি কিছু বলতে পারি না। বুকের ভেতর কেঁপে ওঠে। পুরুষের অভিমান-ভরা কথা কখনো শুনিনি। এই প্রথম শুনলাম। শিল্পীর এই ছোট উক্তিটি আমর হৃদয়ের এক অজ্ঞাত তন্ত্রীতে ঝংকার তোলে। সে ঝংকার আর থামতে চায় না। শিল্পীর মুখের দিকে চাইতে পারি না আমি। চাইলে দুর্বলতা ধরা পড়ে যাবে আমার। নারী হলেও আমি শাহজাহান-দুহিতা জাহানারা। অসামান্য প্রতিভাবান এই স্রষ্টার আর যাই থাক সিংহাসন নেই। সিংহাসন না থাকলে, জগতের চোখে, জাহানারার হৃদয়ের শতাংশের একাংশ পাওয়ার যোগ্যতাও তার নেই।

শিল্পীর সঙ্গে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাই! কোয়েলের অস্তিত্ব অনুভব করি। সে আমাদের অনুসরণ করছে। প্রবল ইচ্ছে হয় তার সঙ্গে শিল্পীর পরিচয় করিয়ে দিতে। রূপসী না হলেও অসুন্দর নয় সে। শিল্পী তাকে পেয়ে তৃপ্ত হবে না? যদি তৃপ্ত হত, আমার নিজস্ব কোষাগারের সঞ্চিত সব দিয়ে দিতাম ওদের।

যমুনার ধার দিয়ে অনেকটা এগিয়ে আসি, বাইশ হাজার শ্রমিকের আওতার বাইরে। এতক্ষণে আসল প্রশ্ন করি তাকে,–এত যে পরিশ্রম করেন আপনি—কীসের জন্যে? টাকা?

—টাকা? না। টাকা হবে কেন?

—তবে?

—আনন্দ।

—পরিশ্রম করে আনন্দ?

—না। সৃষ্টির।

—আপনার এ সৃষ্টির মূল্য দেবে কে?

—সমস্ত পৃথিবী। কবি কাব্য লেখেন—মূল্য কে দেয়?

ভাবতে সময় নিই। শেষে বলি,—কাব্যে কবির পরিচয় থাকে। তাই তিনি অমর হন। কিন্তু আপনার কি অমর হবার সাধ নেই?

থমকে দাঁড়ায় শিল্পী। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে বলে,– কে তুমি?

—সাধারণ এক রাজপুতের মেয়ে।

—তুমি সাধারণ নও। তুমি বুদ্ধিমতী, তুমি বিদূষী, তুমি অসামান্যা রূপবতী। কে তুমি?

—সত্যি সাধারণ আমি। লেখাপড়া শিখেছিলাম কিছু।

উদাস স্বরে শিল্পী বলে,—অমর হবার সাধ কার না থাকে। সবাই কি হতে পারে? অমর না হতে পারি, সৃষ্টি তো রইল।

—হ্যাঁ, শুধু সৃষ্টিই থাকবে। শাহানশাহের নামকে ছাপিয়ে আপনার নাম কোনওদিন ও কলারসিকদের কানে পৌঁছবে না।

—কে তুমি?

—বলেছি তো।

—বিশ্বাস হয় না।

—না হোক। আমার কথাটা কিন্তু বিশ্বাস করবেন।

—তা করি। কিন্তু অত ভাবার সময় নেই, আর তো বেশি বাকি নেই। তার পরে এসো। দুজনে বসে ভাবা যাবে।

—আর আসব না।

—জানতাম।

—কী জানতেন?

—তোমার মতো মেয়ে দুবার আসে না।

শিল্পীর উদাসীনতায় বিস্মিত হই। শুধু তিনবার জানতে চাইল কে আমি। ব্যস্। জবাব পেল না। কৌতূহলও রইল না। অদ্ভুত।

হেসে বলি,—এবার আমি যাই।

শিল্পী কথা বলে না। নিদারুণ বিষণ্ণতা তার মুখখানাকে ছেয়ে ফেলেছে। সে চুপ করে থাকে।

আমার হাসি থেমে যায়। মাথা নিচু করে বলি,—যাব?

—এসো।

এক-পা এক-পা করে কিছুদূর এগিয়ে যাই। শিল্পী তেমনি দাঁড়িয়ে থাকে। বার বার পেছন ফিরে দেখি আমি। কোয়েল তার কাছ দিয়ে চলে আসে, তবু সে লক্ষ করে না।

হঠাৎ সে ডেকে ওঠে,—একটু শুনবে? অল্প একটু।

কোয়েল থমকে দাঁড়িয়ে যায়। আমি কোয়েলের পাশ দিয়ে তার কাছে যাই। কোয়েল বড় বড় চোখে চেয়ে ছিল। সেদিকে চেয়ে আমি হাসতে চেষ্টা করি। পারি না। শিল্পীর ডাক আমার কাছে আল্লার নির্দেশ মনে হয়।

শিল্পীর সামনে গিয়ে দাঁড়াই। চোখ সজল তার। রুদ্ধ আবেগে বক্ষ স্ফীত। কথা বলতে পারে না সে বহুক্ষণ। শেষে অতি কষ্টে বলে,—আমি তোমার নাম জানি না। জানতে চাই না। কোথায় থাকো তাও জানব না। কারণ জানি তুমি সাধারণ কোথাও থাকো না। হয়তো এভাবে তোমার সঙ্গে কথা বলা আমার পক্ষে খুবই অন্যায় তবু—

সে থেমে যায়। অন্যদিকে মুখ ফেরায়। আমি অপেক্ষা করি।

—তোমার মূর্তি গড়ে দিতে বলেছিলে। আমি গড়ব। এখানকার কাজ শেষ করে আমি গড়ব। এই আগ্রাতেই কোথাও সে মূর্তি স্থাপন করে দিয়ে চলে যাব আমি। তুমি দেখো। কিন্তু গড়তে হলে যে ভালভাবে দেখে নিতে হবে তোমায়। মনের মধ্যে তোমার মূর্তি আজীবন স্পষ্ট হয়েই থাকবে। তবু আর একবার ভালো করে দেখে নিতে চাই। আপত্তি কোরো না। করবে না তো?

আমি দাঁড়িয়ে থাকি। শিল্পী: চেয়ে চেয়ে দেখে। যেন কত যুগ চলে যায় দেখতে দেখতে—কত জল বয়ে যায় যমুনার বক্ষ দিয়ে। তবু সে দেখার শেষ নেই। আমার মাথাটি ধীরে ধীরে সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে। অশ্রুপূর্ণ হয়ে ওঠে চোখ দুটি। বড় বড় দু ফোঁটা জল গাল বেয়ে মাটিতে ঝরে পড়ে। কিছুমাত্র লজ্জিত না হয়ে ওড়না দিয়ে মুছে ফেলে সামনে চেয়ে দেখি সে তখন টলতে টলতে এগিয়ে চলেছে সমাপ্তপ্রায় স্মৃতিসৌধের দিকে।

পেছন থেকে আলগোছে আমার হাত চেপে ধরে কোয়েল। সে বুঝতে পেরেছিল আমি শিল্পীর দিকে পা বাড়িয়ে ছিলাম।

—কোয়েল? তোমারও চোখে জল?

—স্বর্গীয় কিছু দেখলে চোখের জল সামলাতে পারি না।

—কোয়েল, হারেমে ফিরে গিয়ে তোমার ওড়নাটি আগে নিও। তোমার বোন, আর আমি ছাড়াও আর একটি স্মৃতি এর সঙ্গে জড়িয়ে গেল। তুমি তো দেখেছ।

হ্যাঁ শাহজাদী। এ ওড়না এই অবস্থাতেই আমি তুলে রেখে দেব সযত্নে! বহুদিন পরেও এর ওই মলিন অংশটুকু অক্ষয় হয়ে থাকবে।

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *