মগরাজ – ৫

অধ্যায় পাঁচ – সময়: ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দ

খণ্ডলার মাঠ, রামু, চট্টগ্রাম

এই ভয়াবহ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাবার উপায় কী, ভাবছে তালেব কিরান।

নিজের ধূর্ত মস্তিষ্ক থেকে কোন জবাব না পেয়ে সরাসরি মাথার ওপর থেকে উত্তাপ ছড়াতে থাকা গনগনে সূর্যটার দিকে আনমনেই একবার চোখ তুলে তাকাল সে। মাত্র দিনের শুরু হতই সূর্যটা এভাবে শত্রুর মতো উত্তাপ ছড়াতে শুরু করবে কে জানত। তবে যতটা না সূর্যকে তার শত্রু মনে হচ্ছে তার চেয়ে অনেক বেশি শত্রু মনে হচ্ছে ছাউনির নিচে বসে থাকা লোকগুলোর ভেতরে আবছাভাবে চোখে পড়া সুবাদার আকরাম শেঠকে। এই লোকটা না থাকলে সে এভাবে মাঠের মধ্যে গনগনে সূর্যের নিচে দাঁড়িয়ে থেকে দস্তকের কাজ না করে ছাউনির নিচে বসে আরাম করে আরকের গেলাসে চুমুক দিতে দিতে লড়াই পরখ করতে পারত। তবে এটাও ঠিক যে, এই লোকটা না থাকলে লড়াই উপভোগ তো দূরে থাক, কোনো লড়াই হতোই না আজ এখানে। বিশেষ করে আরাকানরাজের বিশেষ নিষেধাজ্ঞার পর তো প্রশ্নই ওঠে না।

লড়াইয়ের ফাঁকে বিরতির সময়ে মাঠের যেখানে লড়াই হচ্ছে তার এক কোনায় দাঁড়িয়ে কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই কিরান আনমনেই এবার ঠোঁট চাটল। পিপাসার চোটে মনে হচ্ছে যেন ছাতি ফেটে যাবে, ইতোমধ্যেই পাণ্ডুর বর্ণ ধারণ করেছে ঠোঁট। আশপাশে তাকিয়ে একবার দেখল মাঠের একপাশে ভিড়ের ভেতরে সবার মাথা ছাড়িয়ে গোমেজ দাঁড়িয়ে আছে দুই হাতে বিরাট দুটো বল্লম নিয়ে। গোমেজকে ওখানে দাঁড়িয়ে থাকার নির্দেশ দিয়েছে ও-ই। কারণ মুখে মুখে যতই বাহাদুরি করুক না কেন নিজের শারীরিক শক্তি আর সামর্থ নিয়ে আসলে ও নিজেই নিশ্চিত নয়। বছরের পর বছর ধরে অনিয়মিত আর অনিশ্চিত জীবন যাপন তার শরীরকে দুর্বল করেছে। এক বাক্যে বলতে গেলে ওর নিজের ভেতরে আগের সেই কিরানের কতটুকু অবশিষ্ট আছে সে নিজেই জানে না।

পুরনো দিনের কথা মনে হতেই কেমন একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো কিরানের বুকের ভেতর থেকে। ইদানীং এই ব্যাপারটা প্রায়ই হয়, পুরনো দিনের কথা মনে হলেই বুকটা কেমন জানি খালি খালি মনে হয় ওর। নিজেকে মনে হয় অতীতে বসবাস করা একজন মানুষ। সমুদ্রের বুকে ঘটা সেদিনের সেই দুর্ঘটনার পর থেকে যেন ওর জীবন থেমে আছে ওখানেই। ভবিষ্যৎ তো নে-ই, বর্তমান জীবনটাও প্রতিমুহূর্তে কেমন জানি ফিকে হয়ে চলেছে ওর কাছে।

টুপ করে একটা ঘামের ফোঁটা ভ্রু থেকে গড়িয়ে পড়ে চোখে জ্বালা ধরিয়ে দিতেই এক হাতে কপালের ঘাম মুছে ফিরে তাকাল মাঠের কিনারার দিকে ব্যাপার কী, এত সময় লাগছে কেন? ডান হাতে ধরে থাকা বিরাট লাঠিটার এক প্রান্ত জোরে মাটিতে ঠেলে দিতেই একটা পাশ গেঁথে গেল ওখানে। লাঠিটাকে নামিয়ে রেখে মাথা থেকে তিনকোনা দস্তগিরের টুপিটা খুলে নিয়ে মাথার ঘামে ভেজা চুলগুলোকে একটু পাট করে আবারও টুপিটা পরে নিল ও। কিরানের পায়ে চামড়ার খোলের জুতো, তার ওপরে ঢোলা পাজামা আর গায়ে বাহারি কাফতান। কোমরে কোমর বন্ধনীটা কষে বেঁধে নিতে নিতে নিজের বাহারি পোশাকের কারণে নিজেকেই গালাগালি করল ও। কে জানত এভাবে মাঠে নামতে হবে। একটা সময় দস্তক হিসেবে মাঠে নামাটা ওর জন্য সবচেয়ে আনন্দের কাজ। আর এখন লড়াইয়ের ময়দানে উতরানোর চেয়ে কঠিন কাজ আর কিছুই মনে হয় না।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ফাটল ধরেছে মনের গহিন কোণে। আর সেই ফাটলের প্রতিফলন ঘটতে শুরু করেছে শরীরে। পলকা জোয়ালের মতো পাতলা কোমর ভারী হয়েছে, আর চওড়া শক্তিশালী দুকাঁধ যেন জীবনের বোঝা বহন করতে গিয়ে নুয়ে চলেছে নিচের দিকে।

‘হউপ,’ করে একটা চিৎকারে সঙ্গে সঙ্গে সচকিত হয়ে উঠল কিরান। যাক অবশেষে আবারও খেলা শুরু হতে চলেছে। লাঠিটাকে আবারও হাতে তুলে নিল কিরান। চোখ কুঁচকে তাকাল মাঠের অপর প্রান্তে থাকা অন্য দস্তকের দিকে। ওকে তাকাতে দেখে অন্যপ্রান্তে থাকা দস্তক লাঠি নেড়ে ইশারায় বোঝাল, সে প্রস্তুত। হাতে ধরা বিরাট লাঠিটাকে মাথার ওপরে দুইপাক ঘুরিয়ে এনে জোরে সামনের মাটিতে বাড়ি মারল কিরান। এই ইশারাতেই ও বুঝিয়ে দিল ময়দান প্রস্তুত। এবার লড়াই শুরু হতে পারে।

লাঠি বাগিয়ে লড়াই শুরুর ঘোষণা দিয়ে আনমনেই একবার গোমেজকে দেখে নিয়ে কিরান আড়চোখে ফিরে তাকাল ছাউনির নিচে বসে থাকা বাজিকরদের দিকে। বিশেষ করে আপনাতেই ওর দৃষ্টি চলে গেল ময়দানের সবচেয়ে বড়ো বাজিকর আমজাদ শেঠের ওপর। লোকটা মাঠের দিকে তাকিয়ে নেই। সে তাকিয়ে আছে সোজা কিরানের দিকে। এমনকি কিরান ফিরে তাকানোর পরও সে দৃষ্টি সরিয়ে নিল না। তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি যাচাই করছে কিরানের প্রতিটি নড়াচড়া।

আমজাদ শেঠের ওপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে কিরান ফিরে তাকাল মাঠের দিকে। ময়দান প্রস্তুতের ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে ময়দানের কেন্দ্র থেকে একটা পতাকা নড়ে উঠল। ময়দানের দুপ্রান্তে দেখা দিল দুটো বিরাট আকারের ষাঁড়। দুটোকেই একদল লোক দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখেছে। এত দূর থেকেও ষাঁড় দুটোর খুরের আঘাতে সৃষ্টি হওয়া কম্পন পরিষ্কার টের পেল কিরান। বুকের ভেতরটা কেন জানি কেঁপে উঠল ওর। উচ্ছ্বসিত জনতার হর্ষধ্বনিতে কেঁপে উঠল চারপাশ।

গ্রামবাংলার প্রাচীন কাল থেকে চলে আসা ষাঁড়ের লড়াই যে অন্তত একবার জীবনে না দেখেছে সে কল্পনাও করতে পারবে না এর উত্তেজনার মাত্রা। বিশেষ করে বছরের যে-সময়টাতে ফসল তোলা হয় এরপরে সেই ফসলের মাঠে ষাঁড়ের লড়াই বাংলার বহু পুরনো খেলাগুলোর একটি। এই খেলাটা আবার বৃহত্তর চাটগাঁ এলাকায় উদ্যাপন করা হয় বিশেষভাবে।

ফসল ওঠানোর পর বছরের এই সময়টাতে আরাকানরাজ শাসিত চট্টগ্রামের এই এলাকাটাতে আয়োজন করা হয় হপ্তাব্যাপী মেলার। আর মেলার শেষদিনে হয় এই বিরাট ষাঁড়ের লড়াইয়ের আয়োজন। যে আয়োজনে এলাকার বড়ো বড়ো ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে সবাই যেমন বছরের সবচেয়ে বড়ো বাজি ধরে অন্যদিকে আবার সারা বছর ধরে প্রস্তুতি নেওয়া বাজিকরেরা অত্র এলাকার সবচেয়ে বড়ো আর শক্তিশালী ষাঁড়গুলোকে লড়াইয়ে নামায়। সারাদিনে একটার পর একটা লড়াই চলতে থাকে। সবচেয়ে বড়ো লড়াইটা হয় সবার শেষে। সবচেয়ে বড়ো বাজিটাও হয় সেই লড়াইতেই। তবে নিয়ম হলো, সেই লড়াইয়ে যে ষাঁড় হেরে যাবে সেটাকে জবাই করে বিরাট আকারে ভোজ দেওয়া হবে। আর সেই ভোজের সঙ্গেই এক বছরের জন্য সমাপ্ত হয় এই বিরাট আয়োজন।

গত তিন বছর ধরেই এই লড়াইয়ে সবচেয়ে বড়ো বাজিগুলোর একটা থাকে কিরানের। কিন্তু এবারের মতো এতটা বাজে অবস্থা ছিল না এর আগে। কারণ গেল বছর আরাকানরাজ আর মোঘল লড়াইয়ে সব হারিয়ে নিজের যা কিছু অবশিষ্ট ছিল সেগুলোকে এক করে, সেই সঙ্গে এক বস্তা অর্থ ঋণ করে এবারের সবচেয়ে বড়ো বাজিটা কিরান ধরেছে এবারের সবচেয়ে বড়ো ষাঁড় সুলতানের ওপরে। সুলতানকে মাঠেও নামাচ্ছে সে নিজে। সবশেষ লড়াইটা হবে কিরানের নামানো ষাঁড় সুলতান আর আরেক ব্যবসায়ির ষাঁড় কালাচাঁদের ভেতরে। কিন্তু কিরানের এখন সন্দেহ কালাচাঁদের আসল মালিক সম্ভবত আমজাদ শেঠ। কিন্তু এই ব্যাটা ওকে দস্তক হিসেবে মাঠে নামতে বলল কেন বুঝতে পারছে না ও। ভেতরে ভেতরে কিছু একটা হচ্ছে অবশ্যই।

ভাবতে ভাবতেই মাঠের কেন্দ্রের দিকে ফিরে তাকাল কিরান। ওর থেকে গজ পঞ্চাশেক সামনে শুরু হতে যাচ্ছে দিনের পঞ্চম লড়াই। এর আগে চারটা লড়াই হয়ে গেছে। কোনোটাতেই খুব বেশি বাজে কিছু হয়নি। ষাঁড়ের লড়াইয়ের একটা অদ্ভুত ব্যাপার হলো; এই খেলায় মাঠে উপস্থিত থাকে ষাঁড়ের দুই মালিক। আর দুজন দস্তক। দস্তকদের ভূমিকা লড়াইয়ের মাঠে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ লড়াইয়ের মাঠে দস্তকরাই পুরো লড়াই নিয়ন্ত্রণ করে। তবে দস্তকদের আরেকটা বড়ো ভূমিকা থাকে। সেটা হলো পরাজিত ষাঁড় যখন হেরে গিয়ে দিগবিদিক পালাতে শুরু করে এই ষাঁড়টাকে সামলাতে হয় মূলত দস্তকদেরই। তা-না হলে মৃত্যু সুনিশ্চিত। কারণ ষাঁড়ের লড়াইয়ের মাঠে কোনো কিনারা বা বাউন্ডারি থাকে না। মানুষজন গোল হয়ে দাঁড়িয়েই এই বাউন্ডারি তৈরি করে। পরাজিত ষাঁড় যখন ছুটতে শুরু করে তখন সে অন্ধের মতো ছুটে যায় এই মনুষ্য দেয়ালের দিকে। দস্তক যদি পরাজিত ষাঁড়কে থামাতে না পারে তবে এক বা একাধিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটবেই ঘটবে।

খটাস করে কাঠের সঙ্গে কাঠের সংঘর্ষের শব্দের সঙ্গে শুরু হয়ে গেল দুই ষাঁড়ের লড়াই। ষাঁড়ের লড়াই অন্যান্য প্রাণির লড়াইয়ের মতো নয়। অন্যান্য প্রাণি লড়াই করে সমস্ত শরীর দিয়ে। বঙ্গদেশীয় ষাঁড় লড়াই করে শুধু মাথা আর শিং দিয়ে। লড়াই শুরু হতেই দুই ষাঁড় পরস্পরের দিকে শিং বাগিয়ে তেড়ে গেল। মাথার সঙ্গে মাথার সংঘর্ষ অনেকটা কাঠের সঙ্গে কাঠের সংঘর্ষের মতোই। দুই ষাঁড় এক হতেই উচ্ছ্বসিত জনতার হর্ষধ্বনিতে কেঁপে উঠল খণ্ডালের ময়দান। লাঠি হাতে খুব সাবধানে নজর রেখে চলল কিরান। কিন্তু অযাচিত কিছু হলো না। কারণ লড়াইটা অনেকটা একপেশেই হয়ে চলল। ত্রিপুরার ষাঁড়ের সঙ্গে দক্ষিণবাংলার ষাঁড় বেশিক্ষণ যুঝতে পারল না। মাথায় মাথায় লড়াই যখন তুঙ্গে ত্রিপুরার ষাঁড় আচমকা একপাশ থেকে বঙ্গদেশীয় ষাঁড়ের গলার পাশে শিং বসিয়ে দিতেই বঙ্গদেশীয় ষাঁড় হাঁটু ভেঙে বসে পড়ল মাটিতে।

সঙ্গে সঙ্গে দুইপাশ থেকে ঝড়ের বেগে এগিয়ে গেল দুই দস্তক। লম্বা বাঁশের লাঠি দিয়ে টেনে আলাদা করে ফেলা হলো দুই ষাঁড়কে। মালিক আর তার লোকেরা এসে টেনে সরিয়ে নিয়ে গেল দুই ষাঁড়কে। দুই ষাঁড়েই শরীর-স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে দেখা হবে। এখন যদি সব ঠিক থাকে তবে ভালো না হলে অসুস্থ পরাজিত ষাঁড়কে উপযুক্ত টাকা দিয়ে ভোজের জন্য কিনে নেবে লড়াই কর্তৃপক্ষ।

ময়দান খালি হতেই জোর আওয়াজের সঙ্গে বেজে উঠল তীক্ষ্ণ একটা বাঁশির আওয়াজের মতো আওয়াজ। ময়দানের সবচেয়ে বড়ো লড়াইয়ের ঘোষণা। কিরান ভিড়ের দিকে তাকিয়ে দেখল গোমেজ নেই কোথাও। আনমনেই মাথা নাড়ল সে। যেহেতু সে দস্তকের ভূমিকা পালন করছে কাজেই তার হয়ে তার কাছের একজন লড়াইয়ের ষাঁড়কে ময়দানে নামাবে। কিরান ফিরে তাকিয়ে দেখল ছাউনির নিচে বড়োরা সবাই উঠে দাঁড়িয়েছে। এর ভেতরে আমজাদ শেঠকেও দেখল ও। তার মনিপুরি ষাঁড় কালাচাঁদ আর কিরানের উত্তর ভারতীয় সাদা ষাঁড় সুলতানের মধ্যে বছরের সেরা লড়াইটা অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে।

জনতার হর্ষধ্বনির সঙ্গে কিরান দেখতে পেল ময়দানের একদিক থেকে কালাচাঁদকে টানতে টানতে মাঠে নিয়ে ঢুকল চারজন। প্রজ্জ্বলিত সূর্যের আলোয় চকচক করতে থাকা পাহাড়ের মতো আকৃতির কালাচাঁদকে দেখে কিরানের বুকের ভেতরটা আবারও কেঁপে উঠল। সুলতান পারবে তো এই পাহাড়ের সঙ্গে লড়াই করে পেরে উঠতে। কারণ সুলতানের ওপরেই নির্ভর করছে ওর পুরো জীবন। নিজের সর্বস্ব বাজি ধরেছে ও সুলতানের ওপরে। দেখতে দেখতেই বিশালদেহী গোমেজ সঙ্গে আরো দুজনকে নিয়ে টানতে টানতে ধবধবে সাদা ষাঁড় সুলতানকে নিয়ে ময়দানে প্রাবেশ করল। উত্তেজিত জনতা আবারও হর্ষধ্বনি করে উঠল। দুই ষাঁড়কে মুখোমুখি করতেই ময়দানে প্রবেশ করল তৃতীয় আরেক দস্তক। তৃতীয় দস্তকের ভূমিকা সম্পর্কে পুরোপুরি অবগত কিরান। সে নিজে যেহেতু একদিকে দস্তক তার ওপর ষাঁড়েরও বাজিকর তাই এই তৃতীয় দস্তকের কাজ হলো খেলায় সমতা বজায় রাখা। যাতে করে কিরান বাজিকর হিসেবে খেলায় একপেশে কিছু করতে না পারে।

ময়দানের মাঝখানে দুই ষাঁড়কে কেন্দ্র করে একশ গজ দূরত্বে দাঁড়িয়ে তিন দস্তক পরস্পরের দিকে তাকিয়ে ইশারা করতেই তৃতীয় দস্তক মাথার ওপরে লাঠি তুলে সেটাকে সশব্দে নামিয়ে আনল মাটিতে। লাঠিটা মাটিতে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই দুই ষাঁড়কে আলগা করে দিল দুই পক্ষের লোকজন। সঙ্গে সঙ্গেই দুই দানব ছুটে গেল পরস্পরের দিকে। সাধারণত ষাঁড়ের লড়াই শুরু হয় মাথায় মাথায় কিন্তু দুই দানব পরস্পরের দিকে এগিয়ে যেতেই দৌড়রত অবস্থায় কালাচাঁদকে একপাশ থেকে মাথা দিয়ে বাড়ি মারল সুলতান।

একদিকে তীব্র বেগে দৌড়, তার ওপরে প্রচণ্ড বাড়ির ধাক্কা সামলাতে হিমশিম খেয়ে গেল কালাচাঁদ। তীব্র ধাক্কায় একপাশে সরে গেল সে। কিরান উত্তেজনায় লাফিয়ে উঠল। এখন যদি সুলতান পাশ থেকে একটা শিং খালি বসিয়ে দিতে পারে…

কিন্তু ওর চিন্তা মনেই রয়ে গেল। মুহূর্তের ভেতরে নিজেকে সামলে নিয়ে ঘুরে দাঁড়াল কালাচাঁদ। মাথা নিচু করে তেড়ে গেল সুলতানের দিকে। দুই ষাঁড়ের মাথায় মাথায় সংঘর্ষে যেন পাথরের সঙ্গে পাথর ঠোকাঠুকির মতো শব্দ হলো। দুই ষাঁড়ের একত্রিত হওয়ার চেয়ে জনতার উচ্ছ্বাসধ্বনি যেন পাগল করে ফেলছে পুরো খণ্ডলার ময়দান। পরবর্তী বেশ কিছুক্ষণ দুই ষাঁড়ই পরস্পরের সঙ্গে আক্ষরিক অর্থেই বুনো জন্তুর মতোই লড়ে চলল। দুই দানবের কেউই কাউকে ন্যূনতম ছাড়ও দিচ্ছে না, আবার কাউকে এতটুকু হটাতেও পারছে না। খুরের সঙ্গে খুরের আঘাতে বালুমাটি উড়ে চলেছে। শিঙের সঙ্গে শিঙে আর চামড়ার সংঘর্ষে টুকরো চামড়া আর রক্ত ছিটকে পড়ছে কিন্তু কেউ কাউকেই কাবু করতে পারছে না।

এর মধ্যে দুই বার ষাঁড় দুটোকে আলগা করে দেওয়া হয়েছে। তৃতীয়বারের মতো দুটোই পরস্পরের দিকে এগিয়ে যেতেই সুলতানের বাড়ি খেয়ে দ্বিতীয়বারের মতো ভূপতিত হলো কালাচাঁদ। খুশিতে চিৎকার করে উঠল কিরান। উত্তেজিত জনতা যেন পাগল হয়ে যাচ্ছে। কিরানের চোখ চিকচিক করে উঠছে খুশিতে। কারণ পরিস্থিতির বিবেচনায় ও দিব্যদৃষ্টিতে সুলতানের বিজয় দেখতে পাচ্ছে। ও ফিরে তাকাল মাঠের একদিকে, একটু আগে যেখানে গোমেজকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছে। নিজের বিশাল বুকের ওপরে ভিম দুই বাহু ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে থাকা গোমেজের বত্রিশটা দাঁত পরিষ্কার দেখতে পেল কিরান। গোমেজ থেকে ওর দৃষ্টি চলে গেল ছাউনির দিকে যেখানে সব বাজিকরেরা অপেক্ষা করছে। ছাউনির দিকে পুরোপুরি ফিরে তাকানোর আগেই জনতার বিস্ময়ধ্বনি শুনে আপনাতেই কিরানের দৃষ্টি ফিরে এলো মাঠের দিকে।

মাঠের দিকে তাকাতেই বুঝতে পারল লড়াইয়ের যবনিকাপাত হতে চলেছে। কারণ কালচাঁদ নিজের বিশাল দেহ নিয়ে সুলতানের ধাক্কায় যে পতিত হয়েছে আর উঠে দাঁড়ানোর ক্ষমতা নেই তার। আধবসা অবস্থাতেই সে নিজের মাথা আর শিং উঁচু করে সুলতানকে বুঝতে চেষ্টা করছে কিন্তু খুব একটা সুবিধে করে উঠতে পারছে না। কালাচাদকে শেষবারের মতো এক ধাক্কা দিয়ে অনেকটা পিছিয়ে এলো সুলতান। কিরান অনুমান করল এটাই লড়াইয়ের চূড়ান্ত পরিণতি হতে যাচ্ছে। জনতার উচ্ছ্বসিত চিৎকার শোনা গেল। খানিকটা পিছিয়ে এসে খুরের আঘাতে ধুলো উড়িয়ে ঝড়ের বেগে কালাচাঁদের দিকে ছুটে গেল সুলতান। শেষবারের মতো নিজের শিঙের আঘাতে চূড়ান্ত পরাজয়ের দিকে ঠেলে দেবে প্রতিদ্বন্দ্বীকে।

সুলতান প্রায় কালাচাঁদের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে, হঠাৎ নিজের শেষ শক্তিটুকু দিয়ে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল কালাচাঁদ। সুলতানও প্রায় পৌছে গেছে, কালাচাঁদও উঠে দাঁড়িয়েছে ফলে সুলতানের হিসেবে গড়মিল হয়ে গেল। যেখানে আঘাত করতে চেয়েছিল সেখানে না লেগে উলটো কালাচাঁদের শিঙের আঘাতে তার মাথার একপাশ বেঁকে গেল। কালাচাঁদের একটা শিং সুলতানের খুলিতে লেগে পিছলে গিয়ে আঘাত করল সুলতানের এক চোখে। সুলতানের তীব্র আর্তনাদে কেঁপে উঠল খণ্ডলার ময়দান।

‘ইয়া খোদা,’ আপনাতেই বেরিয়ে গেল কিরানের মুখ দিয়ে। উত্তেজনার চোটে দুই পা সামনে এগিয়ে গেল ও।

রক্তাক্ত চোখ নিয়ে পাগলের মতো পিছিয়ে গেছে সুলতান। প্রতিদ্বন্দ্বিকে খানিকটা কাবু দেখে সর্বশক্তিতে এগিয়ে এসে নিজের মাথার একপাশ দিয়ে বাড়ি মারল কালাচাঁদ। একদিকে রক্তাক্ত চোখ তার ওপরে শক্তিশালী আঘাতে দিগ্বিদিক হারিয়ে পাগলের মতো উলটো ছুটতে শুরু করল সুলতান।

চূড়ান্ত পরাজয় হয়েছে সুলতানের। জিততে জিততেও হেরে গেছে সে। কারণ হাজার বছরের পুরনো নিয়ম, লড়াইয়ের মাঠে একবার যে ষাঁড় উলটো ছুটতে শুরু করে সেই ষাঁড় হয়তো আর কখনোই লড়াইয়ের ময়দানে ফিরতে পারে না। সুলতান তো পরাজিত হয়নি, পরাজিত হয়েছে কিরান।

সব হারানোর বেদনায় কিরানের মনে হলো মাটিতে বসে পড়ে কিন্তু তা হওয়ার উপায় নেই। কারণ পরাজিত আহত সুলতান ছুটে আসছে ওর দিকেই। যদি সরাসরি ওর দিকে নাও ছুটে আসে তবুও মানব দেয়ালের মতো দাঁড়িয়ে থাকা ভিড়ের দিকে ছুটে যাবে উন্মত্ত সুলতান। দস্তক হিসেবে সেটা কিছুতেই হতে দিতে পারে না কিরান।

বুক ভরে দম নিয়ে পা স্থির করে লাঠি উঁচিয়ে দাঁড়াল কিরান। জীবনে এই কাজ বহুবার করেছে ও, জানে কি করতে হবে। কিন্তু বহুবছরের অনভ্যস্ততায় হাত মৃদু কাঁপছে ওর। কিন্তু ভুল করল না ও। সুলতান গজ পঞ্চাশের মতো দূরে থাকতেই লাঠি উঁচিয়ে সর্বশক্তিতে মাটিতে বাড়ি মারল কিরান। পলায়নরত পাগলা ষাঁড়কে নিয়ন্ত্রণে আনার এটা একটা কার্যকরী উপায়। মাটিতে বাড়ি মারলে ষাঁড় বিভ্রান্ত হয়ে যায়, ফলে গতি কমে আসে তার। এই সময়ের ভেতরে সব দস্তকেরা মিলে চারপাশ থেকে মাটিতে একের পর এক বাড়ি দিয়ে আরো বেশি বিভ্রান্ত করে তোলে উন্মত্ত ষাঁড়কে। এই সুযোগে বাকিরা এসে দড়ি পরিয়ে দেয়।

সুলতান ছুটে আসতেই মাটিতে বাড়ি মারল কিরান। প্রথম বাড়িটা বেশি জোরে হলো না। কিন্তু আবারও বাড়ি মারল ও। খুব স্বাভাবিকভাবে মাটিতে কম্পন টের পাওয়ামাত্র ষাঁড়ের গতি কমে আসার কথা। কিন্তু নিজের একটা চোখ হারিয়ে পুরোপুরি উন্মত্ত হয়ে গেছে সুলতান। তার মধ্যে থামার কোনো লক্ষণই দেখা গেল না। মাটিতে বাড়ি দিয়ে কাজ না হওয়াতে কিরান দেখল ছুটে আসছে উন্মত্ত দানব, আড়চোখে অবলোকন করল অন্য দস্তকেরা ছুটে আসছে কিন্তু তারা বহুদূরে। তারা পৌছাতে পৌছাতে ও কিছু না করলে হয় ও মরবে, আর না হয় দানব ছুটে যাবে জনতার দিকে।

একহাতে কোমর থেকে কোমর বন্ধনীটা টেনে বের করে অন্যহাতে লাঠি বাগিয়ে ধরল কিরান। ছুটন্ত সুলতানের প্রথম আঘাতটা লাঠির ওপর দিয়ে যেতেই ওটা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে ছিটকে পড়ল একপাশে। সুলতান প্রায় চলে এসেছে কিরানের কাছে, কোমর বন্ধনীর কাপড়টা খুলে ছুড়ে মারল ও সুলতানের চোখে। কিন্তু দুই চোখ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরও থামল না উন্মত্ত দানব। প্রায় চলে আসা সুলতানকে একপাশে রেখে খানিকটা সরে এলো কিরান। তারপর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় শেষ চেষ্টা হিসেবে লাফিয়ে সুলতানের একটা শিং চেপে ধরে নিজেকে তুলে ফেলল সুলতানের পিঠে। জনতার ক্ষতি না করে সুলতানকে থামানোর শেষ চেষ্টা এটা।

ছুটন্ত ষাঁড়ের পিঠে চড়া যেকোনো উন্মত্ত ঢেউয়ের পিঠে চড়ার চেয়েও ভয়ংকর। বিশেষ করে সে ষাঁড় যদি আপনাকে ফেলে দিতে চায়। সুলতানের পিঠে গ্যাট হয়ে বসে কিরান শক্ত হাতে ধরে আছে তার শিং। একটু এদিক সেদিক হলেই মরতে হবে। চোখ তুলে দেখল দিগ্বিদিক ছুটতে থাকা মানুষের ভিড়টা আর বড়োজোর শখানেক গজ দূরে হবে। এরইমধ্যে এই দানবকে থামাতে না পারলে ও তো যাবেই সঙ্গে আরো কজন মরবে কে জানে।

কিরান নিজেকে একটু স্থির করেই আরো শক্ত করে দুইহাতে চেপে ধরল সুলতানের শিং। কিন্তু দানবের ভেতরে এতটুকু প্রতিক্রিয়া নেই। নিজের শরীরের নিচে শক্তিশালী দানবটার দুর্দান্ত শক্তি টের পাচ্ছে কিরান। আবারও শিং চেপে ধরে একপাশে ঠেলে দিল ও। না থামলেও শিঙের ওপরে চাপ খেয়ে একপাশে খানিকটা ঘুরে গেল সুলতান। এবার সোজা ছুটতে শুরু করল সেই ছাউনির দিকে। আতঙ্কের সঙ্গে চিৎকার করে পালাচ্ছে লোকজন। আর বিশ গজ যেতে পারলেই পিষ্ট হবে মানুষ। হঠাৎ ধাপ করে কিছু একটা এসে লাগল সুলতানের একেবারে ঘাড়ের কাছে। সঙ্গে সঙ্গে যেন দেয়ালের সঙ্গে বাড়ি খেয়ে গতি খানিকটা কমে এলো দানবের। হঠাৎ থেমে যাওয়াতে সুলতানের মাথা ছাড়িয়ে সামনের মাটিতে ছিটকে পড়ল কিরান।

মাটিতে পড়ে মনে হলো মেরুদণ্ড ভেঙে গেছে ওর। কিন্তু জানের ভয় বড়ো ভয়। ব্যথা অগ্রাহ্য করে একলাফে উঠে দাঁড়াল ও। সুলতান যেন মদ খেয়ে মাতাল হয়ে গেছে। অনেকটা মাতালের মতোই টলছে সে। ঘাড়ের একপাশে বিঁধে আছে লম্বা একটা বল্লম। আবারও ধাপ করে শব্দ হতেই দেখল আরেকটা বল্লম গিয়ে লাগল সুলতানের মাথায়। এবার একেবারে থেমে গিয়ে মাটিতে হাঁটু ভেঙে বসে পড়ল ষাঁড়টা।

বল্লমের উৎসের দিকে তাকাতেই কিরান দেখল গোমেজ। মনে মনে ও ভাবল তাই তো বলি এত শক্তি কার যার বল্লমের আঘাতে এরকম দানব থেমে যায়। স্বস্তির সঙ্গে আবারও মাটিতে শুয়ে পড়ল কিরান। শরীরের ব্যথা আর মনের ব্যথা এক করে হিসেব করার চেষ্টা করছে কতটা ক্ষতি হয়েছে ওর।

কিরানের ওপরে একজন মানুষের ছায়া এসে পড়ল। কেউ একজন হাত বাড়িয়ে দিয়েছে ওকে ওঠানোর জন্য। হাতটা ধরে উঠে দাঁড়িয়ে রোদ আড়াল করে তাকাতেই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল ও। রাজপোশাক পরা আরাকান সেনাকে চিনতে না পারার কোনো কারণ নেই। হাত বাড়িয়ে দেওয়া লোকটার পেছনে সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একদল সৈনিক। কিরান অনুমান করল সর্বনাশের চূড়ান্ত হয়েছে।

ওর সামনে উপবিষ্ট আরাকান সেনা তড়বড় করে কিছু বলছে। যেগুলোর অর্থ করলে দাঁড়ায় রাজার নির্দেশ অমান্য করে ষাঁড়ের খেলা চালানো ও বাজি ধরার অপরাধে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে ওকে। এসব কথা কানে যাচ্ছে না ওর। কেউ একজন দড়ি দিয়ে বাঁধতে শুরু করেছে ওর হাত। কিরান ফিরে তাকাল ছাউনির দিকে। একেবারে খালি ওটা। ছাউনির পাশে আরেকদল সৈনিকের মাঝে বন্দি গোমেজকে দেখতে পেল ও। কিন্তু চারপাশের গ্রেপ্তার আর গণ্ডগোলের ভেতরে ও খেয়াল করে দেখলো ছাউনিতে উপবিষ্ট বাজিকরেরা কেউই নেই আশপাশে।

এরকম বাজে পরিস্থিতিতেও কীসের যেন ঠিক হিসেব মিলছে না কিরানের। হাতে আর কোমরে দড়ি বাঁধা শেষ হতেই কেউ একজন টানতে শুরু করতেই কিরানের আবারও মনে হলো, টাকা-পয়সা-নিজের কেনা ষাঁড় সব তো গেছেই, মান-সম্মানটা বাকি ছিল, এবার আরাকানরাজের বন্দি হিসেবে ওটারও দফা-রফা হবে।

সব হারানোর চাপা বেদনা আপনাতেই ওর বুকের গভীর থেকে বেরিয়ে এলো দীর্ঘ নিশ্বাস হয়ে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *