মগরাজ – ৩২

অধ্যায় বত্রিশ – সময়: ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দ

সন্দ্বীপ, দক্ষিণ উপকূল এলাকা

মেয়ে মানুষের জগৎ থেকে কিরানের দূরত্ব আজকের নয়, বহু পুরনো। সত্যি কথা হলো দূরত্ব নয়, আসলে ওই জগতে কোনোদিন ঢোকারই সুযোগ হয়নি ওর। তার ওপরে সমুদ্রে জীবন কাটানো, এরপরে সেখানে সব হারানোর পরের চারটা বছর কোন দিকে দিয়ে গেছে টেরই পায়নি। আর তাই মেয়েদের কাছাকাছি হওয়া কিংবা সংসার করার চিন্তা-ভাবনা এসব আর কোনোদিন মাথায়ই আসেনি। তবে মেয়ে মানুষের ব্যাপারে সে অজ্ঞ কিংবা বোকা নয়। চোখের সামনে যে মেয়েটাকে সে দেখতে পাচ্ছে কিংবা বলা চলে মেয়েদের যে দলটাকে সে দেখতে পাচ্ছে সেটা একেবারেই অদ্ভুত একটা দল।

পদ্মরানির দস্যু দলের কথা সে শুনেছিল লোকমুখে। সে শুনেছিল দক্ষিণের সমুদ্রে নাকি নারীদের একটা দস্যুদল ঘুরে বেড়ায়। এরা নাকি ঠিক যেমন নিষ্ঠুর তেমনি যুদ্ধবাজ। আর অস্ত্র চালনায় দক্ষ। কিন্তু এই দলটার অস্তিত্ব আদৌ আছে কি না এ-ব্যাপারে সে কোনোদিন কোনো সঠিক তথ্য পায়নি। সমাজের কাছে এই দলটার ব্যাপারে সবার ধারণা অনেকটাই ওরকম। আর তাই এরকম একটা গুরুত্বপূর্ণ সময়ে এরকম একটা দলের মুখোমুখি হবে তাও আবার আকরাম বেগের মতো একজন মানুষের দেখানো পথে সেটা সে ভাবতেই পারছে না।

বিশেষ করে চোখের সামনে যে মেয়েটাকে সে দেখতে পাচ্ছে এরকম কোনো মেয়েমানুষ হতে পারে তার কোনো ধারণাই ছিল না। বিশেষ করে সন্ধের সময়ে গণিকালয়ের আঙিনাতে দেখা মেয়েটা আর এই মেয়ের ভেতরে আকাশ আর পাতালের পার্থক্য। ‘কিছু সময় আগে আপনেই ছিলেন না ওইখানে?’ বলে সে ইশারায় আঙিনাটা দেখাল।

‘আমি অনেক সময়েই অনেক জায়গায় থাকতে পারি। এইটা কুনো বিষয় না, মেয়েটা একেবারে সটান হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কিরানের সামনে। দুই পা ফাঁক করা, এক হাত কোমরে রাখা কিরান অনুমান করল মেয়েটার কোমরে অস্ত্র রাখা আছে। শুধু অস্ত্র না, কিরান খেয়াল করে দেখল দলের সব মেয়েই ছেলেদের পোশাক পরনে, প্রত্যেকের পোশাক কালো এবং প্রত্যেকের সঙ্গেই অস্ত্র। কিরান সবচেয়ে বেশি অবাক হলো মেয়েগুলোর শারীরিক ভঙ্গি দাঁড়ানো আর নড়াচড়ার ধরন দেখে। মেয়েরা এভাবে দাঁড়ায় না, এভাবে কথা বলে না। এরা একেবারেই অন্যরকম।

যেমন, ওর সামনে এই মুহূর্তে যে মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে সে দুই পা ফাঁক করে এমনভাবে দাঁড়িয়ে আছে যেন দুনিয়ার কিছুই পরোয়া করে না। ‘আমি ঠিক বুঝতে পারতাছি না। তুমরা এইখানে এইবাবে তুমগো লগে বাবা মানে তালেব কিরান অথবা আকরাম চাচার সম্পর্ক কী?’ কিরান একবার ওদের দিকে দেখে নিল। ওদেরকে একেবারে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে দলটা। কিরান জানে যদিও কারো হাতে এই মুহূর্তে অস্ত্র নেই কিন্তু প্রয়োজনে মুহূর্তের ভেতরেই এরা অস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে দ্বিধা করবে না।

‘শোন, তৈমূর চাচার পোলা তালেব কিরান,’ ওর সামনে দাঁড়ানো মেয়েটা নিজের বাদামি চোখজোড়া যেন তিরের মতো তাক করে রেখেছে কিরানের ওপরে। ঠিক তিরের মতোই সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করছে আর বাণের মতো ছুটে আসছে মুখের কথা। ‘তুমি তোমার বাপেরে কটুক চিনতা আমি জানি না। কিন্তু তুমার বাপের অনেকগুলা চেহারা আছিল। যাকগা সেইটা বিষয় না। এই যে তুমি আমার সামনে খাড়ায়া আছ, কথা কইতাছো, এইটা একমাত্র তুমার বাপের কারণে পারতাছো। নাইলে এতক্ষণে…’

পেছন থেকে কেউ একজন বলে উঠল, ‘পদ্ম, কামের কথা বল। বেলা অনেক চইলা গেছে।’

দস্যুদলের মেয়েটার নাম পদ্ম। এই মেয়ের নামেই কী তবে দলটার নাম দস্যু পদ্মরানির দল। প্রশ্নটা কিরানের মুখে চলে এলেও সে জিজ্ঞেস করল না। বরং মাঠের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, ‘তুমরা কী বলতে চাইতেছো ঠিকঠাক বলো।’

মেয়েটা একবার তার দলের অন্যদের দিকে দেখে নিয়ে বলে উঠল, ‘তুমার বাপের লাইগ্গা আমরা কথা দিসিলাম তুমারে সাহাইয্য করব। কিন্তু সত্য কথা অইলো একটা বিরাট ফ্যাঁকরা অই গেছে।’

কিরান একট হাত তুলল সামনের দিকে। ‘দেখো অত কথা জানি না। আমি স্রেফ আকরাম চাচার কারণে এইখানে আসছি। আমি জানি না বাপু। কিংবা আকরাম চাচার লগে তুমগো কী সম্পর্ক আমি জানতে চাই-ও না। এই দুনিয়ার লগেও তুমগো কী সম্পর্ক সেইটা আমার জানার আগ্রহও নাই, আমার আগহ একটাই। আমি বাপুর ব্যাপারে জানতে চাই। বাবা কোথায় আছে আর সিলভেরা কই আছে,’ কিরানের গলায় পুরনো জোর ফিরে আসছে।

‘বাহ পুলায় তো দেহি কথা ভালাই জানে,’ পদ্মের পেছন থেকে একজন এগিয়ে এলো সামনের দিকে। মহিলা বিশালাকায় দেখতে। প্রায় কিরানের সমানই লম্বা সে, কিন্তু চওড়ায় ওর দ্বিগুণ হবে। কিরানের সামনে এসে মুখের আবরণ সরাতেই কিরান দেখে রুক্ষ একটা চেহারা। আর চোখের নিচ থেকে শুরু করে বাম কানের গোড়া পর্যন্ত লম্বা একটা কাটা দাগ চোহারাটাকে আরো রুক্ষ করে তুলেছে। ‘এই পুলা, কথা যত বড়ো কইলজা অত বড়োনি?’

মাসি আমি কথা বলতাছি,’ মহিলাকে সামনে থেকে সরিয়ে দিয়ে পদ্ম আবারও এগিয়ে এলো সামনের দিকে। ‘দেখো জাহাজি, আমরা তুমারে সাহায্য করতে চাই দেইখাই এইখানে আসছি আমরা। কিন্তু হের লাইগা আগে বিশ্বাস করতে অইবে।’

‘দস্যুগরে আবার বিশ্বাস কীসের?’ কিরানের পেছন থেকে একজন লাঠিয়াল বলে উঠল। কিরান একটা হাত তুলে থামিয়ে দিল তাকে।

‘বলো, ব্যাপার কী?’

‘দেখো, আগেই বলছিলাম তুমার বাপের কাছে ঋণ আছে আমগো। তাই তারে কথা দিসিলাম তাকে সাহায্য করব। কিন্তু সেই অনুযায়ী একটা আমানত রাইখা গেছিল সে আমগো কাছে। আসলে ঠিক বলতে গেলে আমগো কাছে না। আমগো আরেকজনের কাছে। কিন্তু সেইটা আমরা রক্ষা করতে পারি নাই।’

‘আমি আরো ভাঙায়া বলতাছি,’ পেছন থেকে আরেক দস্যু মহিলা সামনের দিকে এগিয়ে এলো। ‘রোসাঙ্গ থেইকা যখন তুমার বাপে পলায় হের ঘরে ছিল আরাকানের রাজার এক সভা কবি। হেয় তুমার বাপের খাস বন্ধু আছিল। হের কাছেই তুমার বাপুর সব খবর আছে। তুমার বাপে তো জাহাজ নিয়া সইরা পড়ল। তার আগে এই কবিরে সে সন্দ্বীপের পাটোয়ারির কাছে রাইখা যায়। শর্ত ছিল সে তুমগোরে তৈমূর কোন দিকে যাবে সেই ব্যাপারে সব জানাবে, আর তুমরা তাকে মক্কার বা ওইদিকের কোনো জাহাজে উঠায়া দিবা। কিন্তু সে সন্দ্বীপে আইসা আইটকা গেছিল। আমগোরে তুমার বাপে নির্দেশ করছিল হেরে কুনোমতে তুমার হাতে দিতে। সেইটাই আমগো নিয়ত আছিল কিন্তু এর আগেই রোসাঙ্গের লোক সব টের পাইয়া যায়। হেরে ধইরা লই গেছে। আইজ তার ফাঁসি হবে সুলতানের বাজারে।’

মানে হইলো,’ কিরান এখনো পুরো ব্যাপারটা ধরতে পারছে। ‘বাপু আর তার লোকেরা কোথায় আছে, কোন দিকে গেছে এইটা একমাত্র এই কবি জানে, আর সেই কবির আজ ফাঁসি?’

‘একদম ঠিক। কারণ আমরা এইটা জানি তুমার বাপে সন্দ্বীপ আসছিল। কিন্তু আমরা এইটা কেউই জানি না, এইখান থনে তুমার বাপ কুন দিকে গেছে। সিলভেরা হের পিছু নিয়া কোন দিকে গেছে। এইটা জানে একমাত্র ওই কবি,’ পদ্মের গলায় আকুতি।

‘খালি তাই না?’ তৃতীয় সেই মহিলা দস্যু যোগ করল। ‘তুমি যদি তুমার বাপের ব্যাপারে তথ্য জানতে চাও মানে তারে বাঁচাইতে চাও তবে তুমার আগে অই কবিরে বাঁচাইতে হবে।’

‘হায় খোদা,’ দীর্ঘ এক নিশ্বাস নিয়ে কিরান বলে উঠল। ‘সেইটা কীভাবে সম্ভব? আমার সঙ্গে আছে তিনজন। এইখানে আমার আরো লোক আছে। কিন্তু হেরা কই আছে আমি জানি না। কাজেই …’

‘সম্ভব,’ পদ্ম বলে উঠল। ‘তুমার সঙ্গে লোক আছে। আমগো লোক আছে। আমরা তুমারে সাহায্য করব। তার চেয়ে বড়ো কথা আমার একটা পরিকল্পনা আছে। এখন কও।

কিরান কিছু বলার আগেই বাজারের দিক থেকে ভেসে এলো অদ্ভুত এক শব্দ। ঢাকের শব্দের মতো শোনাচ্ছে শব্দটা। কিরান ভালো করেই জানে এই শব্দ। কাউকে ফাঁসি দেওয়ার আগে আরাকানিরা এ-ধরনের ঢাক বাজায়।

‘জাহাজি, জলদি করতে অইবো, আমি কী বলি মন দিয়া শোন।’

***

যতটা না মন দিয়ে শুনছে তার চেয়ে অনেক বেশি আগ্রহের সঙ্গে তারা প্রায় সবাই সামনের দিকে তাকিয়ে আছে দেখার জন্য। গোলন্দাজ আর তার দলের বাকি চারজন এই মুহূর্তে উপস্থিত সুলতানের বাজারের কেন্দ্রের দিকে। সুলতানের বাজারের গঠনটা খুবই অদ্ভুত। একেকটা অংশ এখানে একেকটা গলির মতো লম্বা হয়ে এগিয়েছে একদিকে। যেমন মসলা একটা গলি ধরে, কাঁচাবাজার একটা গলি ধরে। আর এরকম সাতটা গলি এসে মিশেছে বাজারের ঠিক কেন্দ্রের মধ্যে, যেখানে গোল করে একটা চত্বরের কাছে। সেই চত্বরে যখন কোনো বড়ো ঘটনার আয়োজন করা হয় তখন সেখানে বসানো হয় একটা বড়ো মঞ্চের মতো। সেই মঞ্চের ওপরে উঠে বড়ো দুটো ঢাক বসানো হয়েছে। সেগুলো দুজন মুশকো পালোয়ান ধুমসে ঢাক বাজাচ্ছে।

‘এইটা অইলো ফাঁসি দিওনের আগে মৃত্যুদণ্ডের ঘোষণা,’ গোলন্দাজের পাশ থেকে বিল্লাল শেঠ বলে উঠল। পাটোয়ারির হাম্মামখানায় যখন তারা জানতে পারে যে কবিকে বাজারের মঞ্চে ফাঁসি দেওয়া হবে তখন প্রথমে ওরা ভেবেছিল কিরানের দলকে খবর দেবে। কিন্তু সেটা না করে তারা শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নেয় সোজা সেখানে চলে যাবে যেখানে ফাঁসি দেওয়া হবে। এরপর সম্ভব হলে তাই করার চেষ্টা করবে ফাঁসি থামাতে। এর পেছনে রঙ্গন মল্লিকের সূক্ষ্ম একটা বুদ্ধি আছে। কারণ সে এটা বুঝতে পারছে যেখানেই হোক কিরান কিংবা তার অন্য লোকেরা ঠিকই বের করে ফেলবে এখানে কাকে ফাঁসি দেওয়া হবে। রঙ্গনের ধারণা ওরাও কোনো না কোনোভাবে সেটা ঠেকানোর জন্য এখানে চলে আসবে।

গোলন্দাজ আর তার সঙ্গে বাকিরা এই মুহূর্তে অবস্থান করছে ফাঁসি যেখানে দেওয়া হবে সেই মঞ্চ থেকে কয়েকশ গজ দূরে। এটাও গোলন্দাজেরই পরিকল্পনা। আগে ওরা পরিস্থিতি বুঝবে, তারপর চেষ্টা করবে সব সামাল দেওয়ার। আর সেকারণেই তারা চেষ্টা করছে খানিকটা দূরত্ব বজায় রেখে সাহায্য করার। রঙ্গন তার সঙ্গে বৈঠা আর বিল্লাল শেঠকে রেখেছে একপাশে আর লাঠিয়াল দুজনকে রেখেছে অন্যপাশে। সে একবার অন্যদের দিকে তাকিয়ে ইশারা করল।

তারা প্রস্তুত হতে হতেই বাজারে একদিকের গলি দিয়ে প্রবেশ করল দ্বীপের প্রহরীদের একটা দল। ‘আসতেছে ফাঁসির আসামি।’ দলের অগ্রভাবে দুজন ঢুলি, তারা ঢোল বাজাতে বাজাতে এগিয়ে আসছে। তাদের ঠিক পেছনেই দুজন পাহারাদার। পাহারাদার দুজনার মাঝখানে মুখে কালো কাপড়, ছেঁড়া ফতুয়া পরা হাত বাঁধা একজন মানুষ। তার মুখমণ্ডল কালো কাপড়ে ঢাকা। তাদের পেছনে কালো ঘোড়া দেখা গেল। সেগুলোতে করে গণ্যমান্য ব্যক্তিরা আসছে।

এদের ভেতরে একজনকে দেখে সঙ্গে সঙ্গে চিনতে পারল গোলন্দাজ, রোসাঙ্গের রাজার খাস লোক। এই লোকটাই ওদের গ্রামে অভিযান চালানোর সময় নেতৃত্ব দিচ্ছিল। গোলন্দাজের পুরো গ্রাম তছনছ করার জন্য এই লোকই দায়ী। গোলন্দাজের গা জ্বলে উঠল লোকটাকে দেখে। কিন্তু এই মুহূর্তে কিছু করার নেই। বরং সে খানিকটা সচকিত হয়ে উঠল, এই ব্যাটা না আবার ওকে দেখে চিনে ফেলে। লোকটার ঘোড়া প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছে। আরেকটু এগোলেই ওদের দেখতে পাবে। আর কোনো কারণে যদি লোকটা এদিকে তাকায় তবেই সৰ্বনাশ হয়ে যাবে। সরাসরি সে দেখতে পাবে গোলন্দাজকে।

গোলন্দাজ এমন পোশাক পরে আছে যে চাইলেই চট করে মুখটা ঢেকে ফেলা সম্ভব নয়। আবার এরকম বাজারের মধ্যে হঠাৎ মুখ ঢেকে রাখাটাও সন্দেহজনক। দেখা যাবে মুখ ঢেকে রাখার কারণেই তার দিকে দৃষ্টি পড়ে যেতে পারে। মুহূর্তের জন্য দ্বিধার ভেতরে পড়ে গেলেও গোলন্দাজ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল, কী করতে হবে। প্রথমেই চট করে খানিকটা নিচু হয়ে গেল সে। এতে করে ভিড়ের ভেতরে তাকে নজরে পড়ার সম্ভাবনা খানিকটা কমে গেল। তারপর ভিড় ঠেলে পিছিয়ে গেল দুইপা। ভিড়ের ভেতরে উলটো ঘুরে হাঁটতে গেলে নজরে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। তাই এই পন্থা। কয়েক পা পিছিয়ে এসে সে বসে পড়ল একটা বন্ধ দোকানের চৌকাঠের ওপরে। দম নিতে লাগল বড়ো করে। আরেকটু হলেই ধরা পড়ে যাচ্ছিল। হয়তো কিছুই হতো না, তারপরও একটা ঝুঁকি ঠিকই ছিল। কিন্তু এখন বড়ো ভাবনার বিষয় হলো, এখানে কী করবে। কীভাবে ঠেকাবে এই লোকগুলোকে, কীভাবেই বা উদ্ধার করবে সেই লোকটাকে। কিরান সঙ্গে থাকলে একটা উপায় বের করতে পরত। কিন্তু এখন উপায় কী।

যে বন্ধ দোকানটার সামনে বসে আছে ওটার চৌকাঠের ওপরে একপাশে স্তূপ করে রাখা আছে নানা ধরনের দড়িদড়া। দড়িগুলোর দিকে তাকিয়ে গোলন্দাজের মাথায় খেলে গেল ধারণাটা। পিঠের ওপরে সে অনুভব করল বন্দুকটাকে। একটা উপায় মাথায় এসেছে। কিন্তু এর জন্য লোকবল আরেকটু ভালো হলে ভালো হতো। কিন্তু উপায় কী? চট করে উঠে দাঁড়িয়ে সে ফিরে এলো নিজের লোকদের কাছে। হাতের ইশারায় বৈঠা, বিল্লাল শেঠ আর লাঠিয়াল দুজনকে সে বলে দিল কী করতে হবে। ওরা খানিকটা আপত্তি জানাতে যাচ্ছিল কিন্তু ওদের ভিড়ের ভেতরে একজনকে দেখে বৈঠা চেঁচিয়ে উঠল। তার দেখাদেখি গোলন্দাজও সেদিকে ফিরে তাকাল।

প্রথমে কিছুই দেখতে পেল না সে। তারপর ভালোভাবে খেয়াল করে দেখল ওদের থেকে খানিকটা দূরে ভিড়ের ভেতরে আরেকটা দল দাঁড়িয়ে আছে। প্ৰথম দেখায় চট করে চিনতে না পারলেও খেয়াল করলেই দলের মূল লোকটাকে দেখতে পেল সে। ‘তুলারাম,’ আনমনেই মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল ওর।

‘খালি তুলারাম না, বেদু আর আগো লগের লাঠালরাও আছে,’ খুশি খুশি গলায় বলে উঠল বৈঠা।

‘এক্ষণ যা, আগোরে ডাইকা নিয়া আয় এহানে,’ বৈঠাকে নির্দেশ দেওয়ার আগেই সে রওনা দিতে যাচ্ছিল, গোলন্দাজ আবারও তাকে ঠেকাল। ‘শুন, এহানে না। আগোরে নিয়া পিছে আয়,’ বলে সে বৈঠাকে পাঠিয়ে দিল ওদের দিকে। তারপর নিজের সঙ্গের তিনজনকে নিয়ে রওনা দিল দোকানের পেছন দিকে। ভিড় ঠেলে ওরা ওখানে পৌঁছানোর একটু পরেই বৈঠা, বেদু, তুলারাম আর ওদের সঙ্গের দুজন লঠিয়াল চলে এলো দোকানের পেছনে। ওদের কাছ থেকে ওরা জানতে পারল ওরা বাজারে ঘুরতে ঘুরতে চণ্ডখানায় জানতে পারে এখানে একজনের ফাঁসি দেওয়া হবে যে কিনা রোসাঙ্গ থেকে আসছে। তাই ওরাও মনে করছে কোনোভাবে যদি ঠেকানো যায় বিষয়টা তাই চলে আসছে এখানে।

গোলন্দাজ ওদেরকে দেখে খুশি হয়ে উঠল। কারণ সে যা করতে যাচ্ছিল তাতে ওদের লোকবল দরকার ছিল। আর ওরা আসাতে খানিকটা হলেও লোকবল বৃদ্ধি পেয়েছে যে কারণে এখন পরিকল্পনাটা বাস্তবায়ন করার সম্ভাবনা বেড়ে গেছে বহুগুণ। ‘শোন, আমরা সবাই এখানে বুঝতে পারছি যারে ফাঁসি দেওয়া অইতাছে তারে আমগো দরকার। তার ফাঁসি ঠেকাইতেই হবে যেহেতু কিরানরে পাইতেছি না কাজেই আমগোরই চেষ্টা করতে হবে,’ বলে সে নিজের পিঠের ওপর থেকে বন্দুকটা বের করে আনল। সবাইকে সেটা দেখিয়ে বলে উঠল, যা করতে চাইতেছি সেটাতে ঝুঁকি আছে কিন্তু কাম হওয়ার সম্ভাবনাও আছে। আমি কী কই ভালোভাবে শুনো। কারণ সময় খুবই কম,’ এইটুকু বলে সে সবাইকে নিজের পরিকল্পনা খুলে বলে প্রত্যেককে যার যার কাজ বুঝিয়ে দিয়ে তুলারামকে তদারকির দায়িত্ব দিয়ে দ্রুত বিদেয় করে দিল। সবাই চলে যেতেই সে দোকানের পেছনের অন্ধকার জায়গাটা ভালোভাবে দিখে নিল, কেউ আছে কি না।

একেবারে শুনশান। কোনো মানুষের ছায়াও নেই। সবাই যার যার মতো ফাঁসি দেখতে গেছে। গোলন্দাজ আশেপাশে দেখে নিয়ে হাতের বন্দুকটাকে আবারও পিঠের ওপরে ঝুলিয়ে নিলো, তারপর দোকানের পেছনে মাটির দেয়ালের মতো উঁচু জায়গাটাতে চড়ে বসলো। সেখানে একটা গাছের ডাল ঝুঁকে দিয়ে সেটা থেকে লাফিয়ে চড়ে বসলো গাছের ডালে। সেখান থেকে ধীরে ধীরে একটার পর একটা ডাল বেয়ে চলে এলো বেশ উঁচুতে। সেখানে একটা ডালের দুই পাশে দুই পা রেখে হেলান দিয়ে বসল গাছের মূল কাণ্ডের ওপরে।

বসে হাঁপাতে লাগল সে। একসময় এসব কাজ ডালভাত ছিল, এখন বয়স বেড়েছে গত কয়েক বছরের আরামদায়ক জীবনের কারণে শরীর অনেকটাই ঢিলে হয়ে গেছে, তবু অভ্যাস বলে একটা ব্যাপার আছে। আর সেটার কারণেই সে এখনো আগের মতোই ঝুঁকি নেবার নেশাটা রয়ে গেছে। গাছে উঠতে উঠতে সে ভয় পাচ্ছিল যে, দেরি হয়ে গেল কি না। কিন্তু গাছে উঠে ভালোভাবে সামনে তাকিয়ে দেখল, আয়োজন প্রায় শেষের দিকে হলেও ফাঁসি এখনো হয়নি। সে ভালোভাবে শরীরটাকে সেট করে নিয়ে পিঠের ওপর থেকে বন্দুকটাকে নামিয়ে ভালোভাবে পরীক্ষা করে নিল। কারণ বন্দুকে গুলি ভরা আছে একটাই। আর একবারই গুলি করার সুযোগ আছে। কারণ একবার গুলি না লাগাতে পারলে আবারও কোমরের থলে থেকে সিসা বের করে সেটা বন্দুকে ভরতে হবে। বারুদের পুরিয়া দিয়ে সেটাকে ঠেসে ভরে লোড করে তাক করতে করতে গুলি করার সুযোগ সে আর পাবে না। কাজেই একবারই সুযোগ।

গোলন্দাজ জানে না তার লোকেরা এখনো জায়গামতো পৌঁছাতে পেরেছে কিনা। সে জানে না কিরানেরা কোথায় আছে। সে একমাত্র নজরে রেখেছে ফাঁসির মঞ্চ আর সেখানে উপবিষ্ট মানুষদের দিকে। মঞ্চের ওপরে একটা চারকোনা কাঠের চৌকাঠের মতো। সেটার সঙ্গে ঝোলানো হয়েছে একটা মোটা দড়ি। আর সেই দড়িতে ঝোলানোর জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে মানুষটাকে। গোলন্দাজ বন্দুক তাক করল। মানুষটাকে ফাঁসির মঞ্চের নিয়ে তার গলায় পরিয়ে দেওয়া হলো দড়ির ফাঁসটা।

গোলন্দাজ বন্দুকের ওপরে নিশানা ঠিক করে বন্দুকের নিশানা করার দুটো বিন্দুকে নিয়ে এলো একটা নির্দিষ্ট বিন্দুতে। আর সেটা নিশানা করছে ঠিক ফাঁসির দড়িটার ওপরে। দড়িটা মানুষের নড়াচড়ায় সামান্য নড়ছে। গোলন্দাজ দুই হাত আরো শক্ত করে বন্দুকটাকে আরো শক্ত করে চেপে ধরল কাঁধের সঙ্গে। মুহূর্তের জন্য একটাবার নিশানা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে দেখে নিল জল্লাদকে। এখানে ফাঁসি দেওয়ার নিয়ম হলো, ফাঁসির আসামিকে দাঁড় করানো হয়েছে একটা টুলের ওপরে। সেই টুলটা একটা দড়ি দিয়ে বাঁধা। যারা ফাঁসির নির্দেশ দেবে তারা ইশারা করতেই জল্লাদ দড়িতে টান দিতেই টুলটা সরে যাবে, আর লোকটা ঝুলে পড়বে।

জল্লাদ লোকটা শরীরটাকে ঝুঁকিয়ে টুল সরানোর দড়িটা টানটান করে ধরে রেখেছে। ইশারা করামাত্রই সে দড়িটা টেনে দেবে আর ঝুলে পড়বে লোকটা। গোলন্দাজ তাকিয়ে আছে ফাঁসির দড়িটার দিকে। ওটা টানটান হতেই সে টেনে দেবে ঘোড়া।

কোথায় যেন বিকট শব্দ হলো। সেই সঙ্গে দূর থেকে শব্দ না পেলেও মানুষের চিৎকার ঠিক কানে এলো তার। কিন্তু তাকানোর উপায় নেই। সে দৃষ্টি স্থির রাখল সেকেন্ডের মধ্যে দড়িটা টানটান হয়ে গেল আর গোলন্দাজ বন্দুকের ঘোড়া টেনে দিল। বিকট শব্দে গুলিটা ছুটে যেতেই গোলন্দাজ চোখ তুলে দেখল গুলিটা দড়িতে লাগেনি।

কিন্তু ব্যাপারটা পুরোপুরি অনুধাবন করার আগেই একসঙ্গে ঘটতে শুরু করল অনেকগুলো ঘটনা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *