মগরাজ – ১৯

অধ্যায় ঊনিশ – সময়: ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দ

দক্ষিণ উপকূলের সমুদ্র, চট্টগ্রাম

গোলন্দাজ রঙ্গন মল্লিক ওরফে যাকে সবাই গোলন্দাজ বলে ডাকে সে ছিল মোঘল জাহাজ বাহিনীর সেরা কামাঞ্চি। গোলন্দাজ মল্লিককে বুঝতে হলে আগে কামাঞ্চি এবং বাঙ্গাল মুলুকে নৌবাহিনীর ব্যাপারটা বোঝা খুবই জরুরি। এই মুলুকে পর্তুগিজদের আগমন অনেক আগে হলেও তারা এদেশে বাণিজ্য ঘাঁটি নির্মাণ করতে পারেনি। এই সুযোগটা তারা পায় হুসেন শাহী বংশের সর্বশেষ শাসক মাহমুদ শাহের আমলে। মাহমুদ শাহ নিজের ভাইয়ের ছেলে আলাউদ্দিনকে হত্যা করে সিংহাসনে আরোহণ করে। কিন্তু সে ছিল অযোগ্য শাসক। আফগান আক্রমণ থেকে নিজেকে বাঁচাতে প্রথম পর্তুগিজদেরকে চট্টগ্রাম ও সপ্তগ্রামে বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করার অনুমতি দেয়। এরপরে সুলতানি আমল, বারো ভূঁইয়াদের সঙ্গে মোঘলদের সংঘাত এবং বন্ধুত্ব থেকে শুরু করে শাসনামলে দিল্লি আর বাঙলার উত্থান আর পতনের সময়ে পর্তুগিজরা দিন-দিন শুধু নিজেদের শক্তি আর সামর্থ্য বৃদ্ধিই করতে থাকে। সেই সঙ্গে বাড়তে থাকে উপকূলীয় এলাকায় এদের সীমাহীন অত্যাচারের মাত্রা। একসময় খুবই অত্যাবশ্যকীয়ভাবে সম্রাট শাহজাহানের সঙ্গে পর্তুগিজদের গণ্ডগোল বাঁধে। যে কারণে সম্রাট অনুধাবন করেন এদের সঙ্গে লড়তে হলে মোঘলদেরও সমরূপ একটা বাহিনী থাকাটা অত্যন্ত জরুরি।

মোঘলরা সর্বত্র স্থলব্যাপী অত্যন্ত শক্তিশালী হলেও নৌযুদ্ধে তাদের পারদর্শিতা প্রায় শূন্যের কোঠায়। আর তাই সম্রাট শাহজাহান প্রথমবারের মতো ঘোষণা দেন: সুবাদার কাশিম খানের নেতৃত্বে হুগলির পর্তুগিজদের দমন করার জন্য শক্তিশালী নৌবাহিনী গড়ে তোলা হবে। আর সেই বাহিনীতেই স্থান হয় ঘরছাড়া কিরানের। একদিকে ও ছিল অত্যন্ত সাহসী, শারীরিকভাবে দারুণ শক্তিশালী ও দুর্দান্ত নেতা। আর সেই সঙ্গে নৌবিদ্যায় অল্প সময়ে অসাধারণ পারদর্শিতা দেখানোর কারণে খুব সহজেই নিজেই একটা বাহিনীর প্রথম হয়ে ওঠে। তবে ওদের বাহিনীতে একটা কমতি ছিল, ভালো গোলন্দাল বা কামাঞ্চি ছিল না ওদের। কামাঞ্চি হলো যারা জাহাজের যুদ্ধে কামান চালাতে পারে। পানির যুদ্ধ হোক আর ডাঙ্গার যুদ্ধ, কামানের ওপরে অনেক কিছুই নির্ভর করে। আর তাই উভয়ক্ষেত্রের যুদ্ধেই ভালো কামাঞ্চির কোনো বিকল্প নেই। কাশিম খানের নেতৃত্বে হুগলি থেকে বিতারণের সময় কিরানের বাহিনীতে এক রত্নের সমাগম ঘটে।

মানুষটা ছিল গোলন্দাজ রঙ্গন মল্লিক। রঙ্গন মল্লিকের বাপ ছিল লবণ চাষি। নুনের ভিটা নামক জায়গাতে পারিবারিকভাবেই তাদের লবণের ঘের ছিল,

কিন্তু ছোটোবেলা থেকে কোনোদিনই রঙ্গন মল্লিক পারিবারিক ব্যবসার দিকে মনোযোগ দেয়নি। বরং তার নেশা ছিল অন্য দিকে। আর তাই খুব ছোটোবেলাতেই ঘর ছেড়ে দিল্লিতে গিয়ে এক অস্ত্র কারখানায় শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজ করতে শুরু করে সে। সেখানেই সে ধীরে ধীরে কামানের গোলা বানাতে বানাতে হয়ে ওঠে দক্ষ কামাঞ্চি, তার ডাকনাম হয়ে যায় গোলন্দাজ। কিন্তু ছোটো জাতের হওয়ার কারণে কোনোদিনই প্রথম সারিতে আসতে পারেনি সেনাবাহিনীতে। তারপরে একসময় সে জানতে পারে হুগলির যুদ্ধের জন্য লোক নেওয়া হচ্ছে। ব্যস, ভিড়ে যায় কিরানের দলে।

তিন বছর সে কিরানের দলে ছিল। তার ব্যাপারে বলা হয়, সে কামান চালিয়ে প্রজাপতির ডানা দুইভাগ করে ফেলতে পারে। কিন্তু হুগলির ঘটনার পর কিরানের বাহিনী যখন সিলভেরার বাহিনীর কাছে পরাজিত হয় সেই পরাজয়ের জন্য অনেকেই সরাসরি দায়ী করে রঙ্গন মল্লিককে, বিশেষ করে দ্বিতীয় কাপ্তান পট্টবর্ধন। এর পেছনে কারণও ছিল। কিন্তু সেই ঘটনার পর গোলন্দাজের সঙ্গে কিরানের আর দেখা হয়নি। আজ এত বছর পর সে এসেছে গোলন্দাজকে বাঁচাতে সেই সঙ্গে তাকে নিজের বাহিনীতে আরেকবারের জন্য শামিল করতে।

‘অর কটুক দূরে?’ কিরান আকাশের দিকে তাকিয়ে সময় বোঝার চেষ্টা করছে। সবে মাত্র সন্ধে হয়েছে। রাত গভীর না হলে চাঁদ-তারা দিয়ে সময় আর দিক-নির্দেশনা করা খুবই দুরূহ একটা ব্যাপার।

‘আর বেশি দূরে নাই, ওস্তাদ,’ জোরে বৈঠা চালাতে চালাতে বেদু বলে উঠল ‘এহান দিয় ঢুইক্কা আরেকটু সময় নিয়া আমরা খালপাড়ে নামব। তারপর হেয়ান থেইকা পায়ে হাইট্টা…’

‘বুঝছি, জলদি কর,’ বলে সে গোমেজের দিকে ফিরে ইশারা করল। ‘গোমেজ আমরা যহন যাব তহন তুই নাওয়ে থাকবি। এই ব্যাটার দিকে খেয়াল রাখবি। এহন জলদি বৈঠা চালা,’ বলে কিরান দেখতে পেল সামনে অন্ধকারের ভেতরে উঁচু ঢিপির মতো মাটির পাড় দেখা যাচ্ছে। আরেকটু এগোতেই কিরান হাঁটু পানিতে নেমে পড়ল। নেমেই নৌকোটাকে টেনে নিয়ে যেতে লাগল পাড়ের দিকে। ওর গায়ের কাপড় একবার ভিজেছে তারপর শুকিয়েছে। এরপরে আবারও ভিজছে। এখন পিস্তলটাকে সাবধানে সামলে রেখেছে এবার যাতে না ভিজে। কিরান আর বেদু নৌকাটাকে গোমেজের দায়িত্বে রেখে এসে গায়ে মাথায় কাপড় চড়িয়ে দ্রুত পা চালাল রঙ্গনের পরিবার যেখানে বাস করে সেদিকে। ‘বেদু, তোর কি মনে অয় আমরা পারব হাম্মাদগো আগে সেদিকে যাইতে?’

বেদু পায়ের গতি একবিন্দু না কমিয়ে প্রায় দৌড়াতে দৌড়াতে বলে উঠল, ‘চেষ্টা করতে তো কুনো দোষ দেহি না। জোরে পা চালাও, ওস্তাদ।’

জলা আর জঙ্গলের ভেতর দিয়ে পা চালাতে চালাতে আরো মাইলখানেক এগিয়ে কিরান আর বেদু থেমে গেল, অদূরেই গ্রামের একপাশ থেকে বলকে বলকে কালো ধোঁয়া উড়তে দেখে। সর্বনাশ, ওস্তাদ। আমরা মনে অয় দেরি কইরা ফালাইছি।’

‘কুনো দেরি অয় নাই। যেই পর্যন্ত শ্বাস সেই পর্যন্ত আঁশ,’ বলে কিরান এক হাতে নিজের পিস্তলটা বের করে অন্যহাতে শক্ত করে চেপে ধরল বেদুর হাত, তারপর দৌড়াতে শুরু করল যেদিকে আগুন দেখা যাচ্ছে সেদিকে।

গ্রামের একপাশে খড়ের গাঁদার পাশ দিয়ে বাড়ির চৌহদ্দির ভেতরে প্রবেশ করে কিরান দেখতে পেল পাকা উঠানের একপাশে লবণ স্তূপ করে রাখা। যুদ্ধের ময়দান থেকে ফেরার পর রঙ্গন পুরোপুরি, পারিবারিক লবণ ব্যবসায় মনোযোগ দিয়েছে। বাড়ির চৌহদ্দির ভেতরে ঢুকেও কিরান আর বেদু তেমন কাউকে দেখতে পেল না। কিন্তু মানুষজনের গলার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে আশপাশেই।

‘আমার মনে অয় অগোরে ঘাটের দিকে লয়া গেছে,’ বেদু বলে উঠল। কিরান তার কথা শুনে মৃদু মাথা নাড়ল। তারও প্রায় একইরকম মনে হচ্ছে। ‘চল সেদিকেই যাইতে হবে।

দুজনে মিলে সেদিকে রওয়ানা দেবে হঠাৎ কিরান বেদুর একটা হাত চেপে ধরল, ‘শোন, আমরা একটা ভুল করতাছি,’ বলে সে থেমে গেল পা চালাতে গিয়েও। বেদু অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে কিরানের দিকে। যখন সবকিছু দ্রুত করা দরকার এমন সময় মানুষটা কিনা দাঁড়িয়ে গেল।

কিরান একটা আঙুল তুলল বেদুর দিকে ফিরে। ‘আমাগো এইখানে আসার পেছনে মূল উদ্দেশ্য কী?’

‘গোলন্দাজরে খুঁইজা…’

‘বাইর করা, ঠিক? হার্মাদগো লগে লড়াই কইরা তো সুবিধা করতে পারব না,’ বলে সে বেদুর হাত ধরে জোরে টান দিল। ‘তারমানে আমগো সবার পিছে নাই লাইগ্গা কিংবা হুদাই ঘুরাঘুরি না কইরা এহন উচিত যেই কামে আসছি সেটাইতে লাগা। সে কি এহনো মুক্ত আছে? লুকায়া আছে? নাকি ওগো হাতে ধরা পড়ছে? আগে সেইটা জানতে হবে। তারপর সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে। কারণ যদিও আমগো পৌঁছাইতে খানিকটা দেরি অই গেছে কিন্তু আমার বিশ্বাস হার্মাদরাও আমগো খুব আগে এহানে পৌঁছাইতে পারে নাই। তুই কি গোলন্দাজের বাড়ি চিনোস?’

বেদু মাথা চুলকাতে চুলকাতে আধো অন্ধকার আবার আরো অগ্নি প্রজ্জ্বলিত গ্রামের দিকে ফিরে তাকাল। ভেবে নিয়ে সে ফিরে তাকাল অন্য বাড়িগুলোর দিকে তারপর কিরানকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠল, ‘চলো ওস্তাদ, আমি পারব হের বাড়ি বাইর করতে। আগে এহানে একবার খেলা দেখাইতে আইছিলাম,’ বলে ওরা দুজনেই আধো অন্ধকারের ভেতরেই দৌড়াতে শুরু করল। দু-তিনটে বাড়ি পার হয়ে ওরা চলে এলো গ্রামের কিনারায়। অন্য দিক থেকে মানুষজনের চিৎকার, পলায়ন, আহাজারি আর হার্মাদ দস্যুদের উল্লসিত হাসির শব্দ ভেসে আসছে।

আরো কয়েকটা বাড়ি পার হয়ে এলো ওরা। বলতে গেলে প্রায় গ্রামের শেষ প্রান্তে চলে এসেছে ওরা। কিরান একটু অস্থির হয়ে উঠল। সে বেদুর ওপরে পুরোপুরি ভরসা রাখতে পারছে না। কারণ এর আগে স্রেফ একবার এখানে আসা ছেলেটা আদৌ গোলন্দাজের বাড়ি বের করতে পারবে কি না। এদিকে সময়ের একটু এদিক-ওদিক হয়ে গেলেই সর্বনাশ হয়ে যাবে। হয়তো বা সর্বনাশ আসলে ইতোমধ্যেই হয়ে গেছে, কে জানে। ‘বেদু…’

‘ওস্তাদ পরায় চইলা আইছি,’ বলে সে একটা হাত তুলল। গ্রামের কোনার দিকে বিরাট আকারের একটা বাড়ি দেখা যাচ্ছে আবছাভাবে। ওটার পর থেকে খোলা সমতল ভূমি। ‘ওই যে ওদিক থেইক্কা আরেট্টু পর থাইক্কা লবণের ঘের শুরু। চলো চলো,’ বেদুর কথা শেষ হতেই দুজনেই পায়ের গতি আরো বাড়িয়ে দিল।

এতক্ষণ যে-বাড়িগুলো ওরা পার হয়ে এসেছে বেশিরভাগই মাটির আর না হয় ছনের কিন্তু এখন যে-বাড়িটার কাছাকাছি ওরা চলে এসেছে সেটা আগেরগুলোর তুলনায় অনেক উন্নত মানের। কিরান অনুমান করল, এই গ্রামে লবণ চাষের মূল পরিবারই সম্ভবত গোলন্দাজদের পরিবার।

বাড়ির বেড়ার কাছাকাছি পৌঁছে ভেতরে দিকে উঁকি দিয়ে দেখল বাড়ির সমস্ত জিনিসপত্র বাড়ির উঠানে জড়ো করা হয়েছে। সেই সঙ্গে ভেতরের লোকজনকে জড়ো করা হয়েছে উঠানে। ওরা উঁকি দিয়েই দেখতে পেল লোকজনের ওপরে শপাং শপাং চাবুক চালানো হচ্ছে। সেই সঙ্গে আহাজারিতে ভরে উঠেছে চারপাশ। দেখতে দেখতেই বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হলো।

আগুন ধরিয়েই লোকজনকে গরু-ছাগলের পালের মতো খেদিয়ে নিয়ে যেতে শুরু করল বাইরের দিকে। কিরানের চোখ হন্যে হয়ে খুঁজছে গোলন্দাজকে। কিন্তু ভিড়ের ভেতরে কোথাও দেখতে পেল না ওকে। ‘ব্যাপার কী, গোলন্দাজ কই? তোর চোখে পড়ছে নাকি?’

বেদু কিছু না বলে মাথা নাড়ল। ‘ওস্তাদ আমগো সামনের দিকে যাইতে অইবো, না অইলে হেরে বাইর করন যাইবে না। কারণ আমার মনে অয় হেরে আগেই বাইরে লয়া গেছে।’

এক মুহূর্ত ভাবল কিরান। ‘তাইলে অন্য পাশ দিয়ে ঘুরতে হবে,’ বলে ও বেদুকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠল। ‘চল, বিপদ দেখলে সোজা উলটা ঘুইরা দৌড় দিবি। মনে রাহিস গোলন্দাজরে বাঁচাইতে গিয়া নিজে মরলে চলবে না। এমনকি যদি আমরা গোলন্দাজরে খুঁইজ্জা বাইর করতে পারি তয় ওরে নিয়া সুজা উলটাদিকের জঙ্গলে ঢুইক্কা জলার দিকে রওনা দিবো যেহানে নৌকাড়া বান্দা আছে। একবার জঙ্গলে ঢুকতে পারলে কিংবা জলায় নামতে পারলে ওরা চাইলেও আর আমগো ধরতে পারব না।’

বেদু সম্মতিসূচক মাথা নাড়তেই ওরা রওনা দিল বাড়ির দিকে। বাড়িটাতে আগুন লাগানো হয়েছে কিন্তু আগুন এখনো পুরোপুরি ধরতে শুরু করেনি। বরং আগুনের হাত থেকে বাঁচতে সবাই সরে গেছে সামনের দিকে। হার্মাদরা পাইকারি হারে চাবুক মারতে মারতে সবাইকে উঠান থেকে সরিয়ে বাড়ির বাইরের দিকে নিয়ে যেতে শুরু করেছে। কিরান আর বেদু উলটো ঘুরে বাড়ির পেছন দিকে চলে এলো। তারপর সাবধানে আগুনের আঁচ বাঁচিয়ে প্রবেশ করল বাড়ির আঙ্গিনার ভেতরে। যেদিকে সবাইকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে কিরান সেদিকে এগোতে যাচ্ছিল বেদু হঠাৎ আলতো গলায় ওকে ডাক দিল। বাড়ির এক কোণের দিকে বেশ কিছু দেশি অস্ত্র পড়ে আছে। বেদু দেখে নিয়ে একটা বড়ো রাম দা তুলে নিল।

‘ওইটা আমারে দে,’ বলে কিরান একটা বড়ো তেল চকচকে লাঠি দেখাল। নিজেকে সামলে বেদু লাঠিটা ওর দিকে ছুঁড়ে দিল। দুজনেই বাড়ির উঠান পেরিয়ে সন্তর্পণে চলে এলো বাড়ির বাইরের দিকে। ছোটো একটা কলাগাছের ঝাড়ের আড়াল থেকে উঁকি দিয়ে দেখল বাড়ি থেকে বের করা মানুষগুলোকে সারি দিয়ে দাঁড় করানো হয়েছে। একজন হাতে কামারের হাপরের সামনে থেকে নামানো গনগনে লাল লোহার শিক হাতে নিয়ে সেটা দিয়ে মানুষগুলোর হাত ফুটো করে দিচ্ছে। আর চার-পাঁচজন হতেই তাদের একে একে প্রবেশ করানো হচ্ছে লম্বা বাঁশের কঞ্চির ভেতরে। এরপরে এদেরকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে সামনের দিকে। এদের এখন নিয়ে তোলা হবে জাহাজের খোলের ভেতরে। যেখানে পশু পাখির মতো ফেলে রাখা হবে কোনো দাসবাজারে না নেওয়া পর্যন্ত। খোলের ভেতরে চাল ছিটিয়ে দেওয়া হবে খাবার জন্য। না থাকে পয়োনিষ্কাশনের কোনো ব্যবস্থা, না থাকবে অন্য কোনো সুবিধা। সেই সঙ্গে কোনো সমস্যা হলেই গণহারে চালানো হবে চাবুক। তবে হ্যাঁ আরেকটা ব্যাপার ঘটবে। খোলের ভেতরে ঢোকানোর আগে আলাদা করা হবে মেয়েদেরকে। তারপর গণহারে চলবে ধর্ষণ। এরপরে তাদের ঢোকানো হবে খোলের ভেতরে।

এভাবে গরুর পালের মতো লোকগুলোকে তাড়িয়ে নিয়ে যেতে দেখে মনে- মনে খানিকটা শঙ্কিত বোধ করল কিরান। গোলন্দাজকে এখনো দেখতে পায়নি সে। ওকে কি মেরে ফেলা হলো? নাহ, নিজেকেই প্রবোধ দিল সে। ওকে মেরে ফেলার কোনো কারণ নেই। ওকে বরং কাজে লাগাতে চাইলে জীবিত এবং সুস্থ রাখতে হবে। তবে হ্যাঁ, ওকে যদি জাহাজে তুলে ফেলা হয়ে থাকে তবে উদ্ধারের আশা ত্যাগ করতে হবে।

‘বেদু, সামনে চল,’ বলে বেদুকে নিয়ে এগোতে থাকা লোকগুলোকে সমান্তরালে রেখে ওরা দ্রুত বেগে এগিয়ে চলল সামনের দিকে। পানির ধারার প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছে এমন সময়ে বেদু হঠাৎ কিরানের হাত চেপে ধরল। সঙ্গে সঙ্গে যেদিকে ইশারা করল বেদু সেদিকে ফিরে তাকাতেই কিরাণ দেখতে পেল গ্রামের কিনারার দিকে যেখান থেকে সরু খালের মতো বেরিয়ে গেছে, সেখানে বেঁধে রাখা সারি সারি নৌকা। কিরান অনুমান করল এই নৌকাগুলোতে করেই হার্মাদরা এসেছে। ধরে নেওয়া লোকগুলোকে সারি দিয়ে সেই নৌকাগুলোতে তোলার আগে রাখা হচ্ছে পানির কিনারায়। সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে নেতৃস্থানীয় কয়েকজন দস্যু। তাদের পোশাক দেখেই অনুধাবন করা যায় এরা অন্যদের থেকে আলাদা। চামড়ার পোশাক পরা বিরাটাকায় দাড়িওয়ালা এক দস্যুর পায়ের কাছে মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসিয়ে রাখা হয়েছে সাদা পাঞ্জাবি আর ধুতি পরা একজন মানুষকে। রক্তাক্ত চোখে-মুখে মানুষটা অসহায়ভাবে তাকিয়ে আছে গরু-ছাগলের মতো সারি দিয়ে রাখা মানুষগুলোর দিকে।

‘গোলন্দাজ,’ আপনাতেই বলে উঠল কিরান। গোলন্দাজকে দেখতে পেয়ে একদিকে স্বস্তি বোধ করছে সে কিন্তু অন্যদিকে আতঙ্কের সঙ্গে অনুধাবন করল যেভাবে ওকে ঘিরে রেখেছে সব দস্যুরা ওখান থেকে তাকে উদ্ধার করে আনা অসম্ভব একটা ব্যাপার।

‘ওইটারে চিনছো?’ ইশারায় সামনের দিকে দেখাল বেদু।

‘হুমম, গঞ্জালেস, সিলভেরার ডাইন হাত, রাগে কড়মড় করে বলে উঠল কিরান। সিলভেরার দলের প্রধানদের সে ভালোভাবেই মনে রেখেছে।

‘না, ওস্তাদ,’ আনমনে মাথা নাড়ল বেদু। ‘তুমি যেইটা কথা কইতাছো সেইটা না। ‘ওইটা যার লগে কথা কইতাছে, ওইডারে ভালা কইরা খেয়াল করো। হারামজাদা শ্যামাশঙ্কর।’

বেদুর মুখে নামটা শুনে অবাক হয়ে ওদের দিকে ফিরে তাকাল কিরান। গোলন্দাজকে দেখতে পাওয়া মাত্রই ওর নজর ছিল শুধু ওর দিকেই। শ্যামাশঙ্কর নামটা কানে যেতেই সচকিত হয়ে উঠল কিরান। ভালোভাবে খেয়াল করে দেখল গঞ্জালেস যার সঙ্গে কথা বলছে সে সাদা চামড়ার কেউ নয়, বরং এদেশীয় একজন। শুধু এই দুজনেই নয় দস্যুদের একটা অংশ এদেশীয়।

‘তারমানে আকরাম বেগের কাছে যা শুনছিলাম তা ভুল না,’ রাগে কিড়মিড় করে বলে উঠল কিরান। শ্যামাশঙ্কর মগ দস্যু, সে রোসাঙ্গের রাজার কেমন জানি ভাই হয় বলে জানে কিরান। ‘পর্তুগিজগো লগে আসলেই হাত মিলাইছে আরাকানি মগেরা। কিন্তু কথা অইলো এহন কী করা?’

ভেতরে ভেতরে কিরান অস্থির হয়ে উঠেছে। এতক্ষণ ধরে লোকগুলোকে এখানে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছিল সম্ভবত ওদেরকে ওঠানোর জন্য। এদের একবার ওঠাতে শুরু করলে অর কিছুই করার থাকবে না।

রাগ-হতাশা আর অস্থিরতায় যে খড়ের গাদাটার আড়াল থেকে উঁকি দিয়ে দেখছিল সেটার গায়ে হেলান দিল কিরান। কী করবে কিছুই বুঝতে পারছে না ও। হঠাৎ খড়ের গায়ে হাত দিতেই বিদ্যুৎ চমকের মতো মাথায় এলো ধারণাটা। ও কান পেতে শোনার চেষ্টা করছে একটা বিশেষ শব্দ। মানুষের আহাজারি, দস্যুদের উন্মাদ হাসি আর আগুনে পোড়ার শব্দ ভেদ করে শোনা যাচ্ছে বিশেষ একটা শব্দ মনে মনে হেসে উঠল কিরান, এটা কাজে লাগানো যায়।

‘বেদু, আমার মাথায় একটা বুদ্ধি আসছে,’ বলে সে হেসে উঠল মন দিয়ে শোন।’

***

বেদু এই মুহূর্তে ঠিক বুঝতে পারছে না কিরান আসলে ওকে দিক নির্দেশনা বলতে কী বুঝিয়েছে। কিরানের বুদ্ধিটা খুব সহজ আর কাজে লাগার সম্ভাবনা বলতে গেলে প্রায় শতভাগ, শুধু যদি দিক নির্দেশনাটা ঠিক রাখা যায়। কিন্তু এটা সে বুঝতে পারছে, কিরান যা করতে বলছে সেটাই ঠিক। বেশি চিন্তা না করে সে কাজে লেগে পড়ল।

প্রথমেই সে খড়ের গাদা থেকে সাবধানে টান দিয়ে বেশ কিছু খড় আলগা করে ফেলল। তারপর সবগুলোকে পাকিয়ে লম্বা করে মশালের মতো বানাল। তিনটে এরকম খড়ের মশাল বানাতে খুব বেশি হলে মিনিট কয়েক সময় লাগল ওর। তারপর তিনটাকেই হাতে নিয়ে দৌড়ে এলো দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকা বাড়িটার কাছে। বাড়ির কাছে এসে তিনটেরই মাথায় আগুন ধরিয়ে ওগুলোকে সে তিনটে খড়ের গাদার দিকে ছুড়ে দিল।

কিছুক্ষণের ভেতরেই তিনটা গাদাই দাউ দাউ করে জ্বলতে লাগল। যদিও চারপাশে জ্বলতে থাকা আগুনের ভেতরে এগুলোকে আলাদা করে তেমনভাবে লক্ষ করার কোনো কারণ নেই। তাই কেউ লক্ষ করলও না। দস্যুরা বেশিরভাগই পানির কাছাকাছি অপেক্ষা করছে নৌকাগুলোকে প্রস্তুত করে বন্দি ওঠানোর জন্য। মানুষগুলোকে ওঠাতে একটু ঝামেলা হচ্ছে। কারণ ওরা ধরতে এসেছিল গুটি কয়েকজনকে। কিন্তু ধরে নিয়ে যাচ্ছে পুরো একটা গ্রাম। এতে ভালোই সওদা হবে। আর যারা ধরা পড়েছে ওরা অপেক্ষা করছে নিজেদের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের জন্য। এমন সময় হঠাৎ কিছু একটা ছুটে আসার শব্দে সচকিত হয়ে উঠল সবাই।

এমনকি গাদাগুলোতে আগুন লাগিয়ে প্রায় নিশ্চিন্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে ছিল বেদু। সে আসলে জানত না কিরান কী করতে যাচ্ছে। কিন্তু হঠাৎ যে বাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল ওরা, গ্রামের শেষ প্রান্তে একটা গোলা ঘরের মতো, সেটার আরেকটা অংশে আগুন ধরে গেল। বেদু বুঝতে পারল এই আগুনটাও ধরানো হয়েছে, আর কাজটা কিরানেরই। কিন্তু সে এটা বুঝতে পারল না, কেন ধরানো হলো এই আগুন। আর এতে করে খুব একটা লাভই বা হবে কী?

কিন্তু কয়েক মুহূর্ত পরেই তীব্র আর্তনাদ আর পায়ের নিচের মাটি কেঁপে উঠতেই সে অবাক হয়ে গেল। তার অবাক হওয়ার পালা বাকি ছিল। হঠাৎ যেদিকে সে খড়ের গাদাগুলোতে আগুন লাগিয়েছে তার বিপরীত দিকের গোলাঘরের মতো জায়গাটার খোলা দরজা দিয়ে বিস্ফোরণের মতোই বেরিয়ে এলো একদল বিশালাকায় প্রাণি। উন্মাদের মতো উত্তাল বেগে ছুটতে থাকা প্রাণিগুলোর দিকে প্রথমে উন্মাদের দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল বেদু। তারপর তার মুখে ফুটে উঠল হাসি। এবার সে বুঝতে পেরেছে কিরানের পরিকল্পনা আসলে কী।

ওরা যখন অসহায়ের মতো খড়ের গাদার আড়াল থেকে পানির তীরের দৃশ্য অবলোকন করছে এমন সময় কিরান প্রথম শুনতে পায় বদ্ধ কোনো জায়গাতে একদল প্রাণি উন্মাদের মতো চিৎকার করছে। সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারে, যে- বাড়িটার সামনে ওরা দাঁড়িয়ে আছে সেটা আসলে গ্রামের একটা আস্তাবল। এখানে সবার গরু-ষাঁড় আর মহিষগুলোকে রাখা হয়। হার্মাদরা নগদ হিসেবে বিশ্বাস করে। ওরা লুট করে শুধু অর্থ আর মানুষ। এসব গবাদি প্রাণি যত মূল্যবানই হোক এদের নিয়ে তাদের কোনো মাথা ব্যথা নেই। তাই তারা এসবে হাত দেয়নি। ওদিকে বাইরে আগুনের হলকা টের পেয়ে আস্তাবলের ভেতরে অস্থির হয়ে উঠেছে প্রাণিগুলো, তখনই সে চিন্তা করে, শুধু রঙ্গন নয় চাইলে বন্দি সবাইকে মুক্ত করার একটা সুযোগ এসে যেতে পারে। আর সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী সে বেদুকে খড়ের গাদায় আগুন লাগিয়ে নিজে চলে যায় আস্তাবলের পেছন দিকে। সেখানে আস্তাবলের পেছনে আগুন লাগায় সে প্রথমে, তারপর খুলে দেয় আস্তাবলের মূল দরজাগুলো। সঙ্গে সঙ্গে আগুনে আতঙ্কে অস্থির হয়ে থাকা প্রাণিগুলো দিগ্বিদিক হারিয়ে পাগলের মতো ছুটতে শুরু করে যেদিকে খড়ের গাদাগুলোকে আগুন লাগানো হয়েছে সেদিকে। কারণ ওদিকে ছাড়া ওদের সামনে আর কোনো পথ নেই।

বিশালাকায় প্রাণিগুলো প্রাণ ভয়ে সমুদ্রের স্রোতের মতোই আগুনে খড়ের গাদাগুলোর ওপরে গিয়ে আছড়ে পড়ল। ওগুলোকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে আগুনে গাদাগুলোকে নিয়েই দৌড়াতে লাগল উন্মাদের মতো। জলের পাড়ে যারাই দাঁড়িয়ে ছিল তার প্রথমে দেখল আগুনে খড়ের গাদাগুলো এগিয়ে আসছে ওদের দিকে। কিন্তু ওরা সেই ভয় পুরোপুরি তাড়ানোর আগেই দেখল ওগুলোকে নিয়ে ওদের ওপরে আছড়ে পড়ল একদল উন্মত্ত প্রাণি। প্রস্তুত হওয়ার আগেই ওদের অনেককে গুঁতিয়ে দিয়ে বেশ কিছু প্রাণি নেমে পড়ল পানিতে। কিছু আবার ধাক্কা দিয়ে গুঁতিয়ে পথ করে নিতে লাগল। মুহূর্তের ভেতরে দস্যুদের দলটা ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল একে অপর থেকে। ভয়ের চোটে দিগ্বিদিক হারিয়ে ছুটতে শুরু করে অনেকেই লাফিয়ে পড়ল পানিতে। বন্দিরা নিজেদের মুক্ত পেয়ে ছুটতে শুরু করল কেউ গ্রামের দিকে, আবার কেউ কেউ লাফিয়ে পড়ল পানিতে।

শেষ প্রাণিটাকে আস্তাবল থেকে বের করে দিয়ে কিরান লাফিয়ে উঠে বসল ছুটন্ত একটা ষাঁড়ের পিঠের ওপরে। হাতে বেরিয়ে এসেছে বিরাট আকারের সেই লাঠিটা। ছুটন্ত ষাঁড়টা আস্তাবলের বাইরে আসতেই সে বেদুর উদ্দেশে চিৎকার করে উঠল।

যে লোক বাঘের খেলা দেখায় তার জন্য এসব ষাঁড় আর মহিষ কোনো বিষয়ই না। সেও কিরানের মতো লাফিয়ে উঠে বসল একটা মহিষের পিঠের ওপরে। একহাতে ওটার শিং ধরে অন্যহাতে বিরাট রামদাটা নিয়ে ছুটে চলল দস্যুদের উদ্দেশে।

দস্যুরাও প্রথমে একেবারেই ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়লেও ওরা নিজেদের খানিকটা সামলে নিয়েছে ততক্ষণে। অনেকেই অস্ত্র বের করে ছুটন্ত প্রাণিগুলোর উদ্দেশে গুলি ছুঁড়তে শুরু করেছে। একবার গুলি করে আবারও বন্দুক ঠিক করতে থাকা এক দস্যুর খুলি বিস্ফোরিত হলো কিরানের লাঠির আঘাতে। আরেক দস্যু নিজের হাত হারাল বেদুর রামদার কোপে। দুজনেই ছুটতে ছুটতে এক জায়গায় দেখতে পেল শিকল পরানো সাদা পোশাকের একজনকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে তিন দস্যু। বেদুকে সাবধান করে দিয়ে কিরান লাফিয়ে নেমে পড়ল ষাঁড়টার ওপর থেকে, মাথার ওপরে লাঠি ঘোরাতে ঘোরাতে সে যমদূতের মতো উপস্থিত হলো ওদের চারজনের সামনে। প্রথমজন সতর্ক হওয়ার আগেই তার হাতের বন্দুক উড়ে গেল ওর লাঠির আঘাতে। দ্বিতীয়জন পিস্তল তুলল ওকে উদ্দেশ্য করে। কিন্তু গোলন্দাজ পাশ থেকে চেপে ধরল তার হাত। তৃতীয় জন হাসতে হাসতে নিজের বন্দুক তুলাল কিরানকে গুলি করার জন্য কিন্তু আচমকা সে দেখতে পেল কনুইয়ের নিচ থেকে তার হাতটা নাই হয়ে গেল। সেখান থেকে স্রেফ ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরুচ্ছে। সে যখন নিশ্চিত গুলি করতে যাচ্ছে কিরানকে ঠিক তখুনি বেদুর রামদার এক কোপে হাত নাই হয়ে গেছে তার।

প্রথম দস্যু বন্দুক হারিয়ে নিজের ছোরা বের করতে যাচ্ছিল, তার মস্তক বরাবর লাঠি চালাল কিরান। তারপর তিনজনে মিলে দ্বিতীয়জনকে কাবু করতেই দেখতে পেল ভীষণ অবাক চোখে গোলন্দাজ তাকিয়ে আছে ওদের দিকে। ‘কিরান, তুমি?’ তার চোখের বিস্ময় বাঁধ মানছে না।

কিরান একটানে তাকে সোজা করে দাঁড় করিয়ে দিয়ে তার শিকলবন্দি দুই হাত সমান তুলে ধরে বেদুর দিকে তাকিয়ে ইশারা করল, ‘বেদু।’

বেদু মাথার ওপরে রামদা তুলে সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে কোপ মারল শিকলে। একবার, দুবার, তিনবারের কোপে শিকল মুক্ত হলো গোলন্দাজ রঙ্গন।

‘জলদি চল, পলাইতে হবে,’ তার জামার এক প্রান্ত চেপে ধরে কিরান বলে উঠল। ইতোমধ্যেই ওরা জলা-জঙ্গলার দিকে দৌড়াতে শুরু করেছে।

‘আমার মানুষগো রাইখা…’

কিরান সমস্ত শক্তি দিয়ে রঙ্গনের জামা চেপে ধরে টানতে শুরু করল, হারামজাদা, গাউরামি পরে করিস, আগে পলাইতে হবে,’ বলে সে রঙ্গনের পাঞ্জাবি চেপে ধরে টানতে লাগল। তিনজনেই প্রাণপণে দৌড়াতে দৌড়াতে জঙ্গলের ভেতরে ঢুকে পড়ল।

‘ওস্তাদ, কেউ আমগো পিছু নিছে,’ বেদু বলে উঠল। কিরান পেছনে তাকিয়ে দেখল জঙ্গলের ভেতরে মশালের আলো দেখতে পাচ্ছে ওরা। ‘জলদি দৌড়া। গোলন্দাজ তুই খালের দিকের পথ দেহা,’ বলে আরো গতি বাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করল ওরা। কিন্তু বাজ পড়ার মতো শব্দে কানের পাশ দিয়ে বুলেট ছুটে যেতে শুরু করেছে। নিচা হ, নিচা অইয়া দৌড়া, কিরান অনুধাবন করতে পারছে কারা ওদের পিছু নিতে পারে।

ব্যাপারটা বোঝা অতো কঠিন কিছু না। দস্যুরা এই গ্রামে এসেছিল সম্ভবত গোলন্দাজকে ধরে নিয়ে যেতে। কিন্তু এরই মধ্যে হঠাৎ এমন গণ্ডগোল লেগে যাওয়াতে গোল বেঁধে গেছিল। কিন্তু গঞ্জালেস যেই মুহূর্তে দেখতে পেল গোলন্দাজ নেই সে বুঝতে পারল তাকে ছাড়ানোর জন্য এই গণ্ডগোলটা ইচ্ছে করেই লাগানো হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে কোনদিকে ওরা পালাতে পারে সেটা অনুমান করে ওরা পিছু নিতে শুরু করেছে ওদের। অথবা গোলন্দাজকে উদ্ধার করার সময়ে গঞ্জালেস বা শ্যামাশঙ্করের লোকেরা ওদেরকে দেখেছে। ওরা পৌঁছাতে পৌছাতে কিরানরা গোলন্দাজকে নিয়ে সটকে পড়েছে। কিন্তু ততক্ষণে ওরা পিছু নিতে শুরু করেছে।

‘বেদু-গোলন্দাজ জলদি পা চালা,’ কথাটা শেষও করতে পারল না সে। তার আগেই আবারও এক গুচ্ছ বুলেট ছুটে এলো। মাটিতে শুয়ে পড়ল তিনজনই। তারপর যত দ্রুত সম্ভব হামাগুড়ি দিয়ে এগোতে শুরু করল। ‘সামনে জলা আছে কিরান, আমরা অইখানেই,’ বলেই গোলন্দাজ ইশারা করে সেদিকে হামাগুড়ি দিতে লাগল ওদের দিকে। কিন্তু সেদিকে এগোনোর আগেই একেবারেই কাছে পায়ের শব্দ পাওয়া গেল। ‘দৌড়া, আর উপায় নাই,’ বলে কিরান উঠে দাঁড়িয়ে বাকিদের নিয়ে দৌড় দিল প্রাণপণে। লুকোচুড়ির সময় শেষ। এখন পালাতে হবে। সামনেই আর কিছুদূর পরেই পানির ধারা দেখা যাচ্ছে।

ওরা উঠে দাঁড়াতেই আবারও গুলি বৃষ্টি ভেসে এলো। পানির কাছাকাছি পৌঁছে গেছে এমন সময় কিরানকে কেউ যেন হাতের পেছন থেকে ধাক্কা মারল। গুলির ধাক্কায় পানিতে পড়ে গেল ও। পড়তে পড়তে দেখতে পেল বেদু আর গোলন্দাজও লাফ দিয়েছে পানিতে। পানিতে পড়েই কনুইয়ের কাছে তীব্র জ্বালা করে উঠল ওর। হাতটা নাড়তে গিয়ে নাড়তে পারল না কিরান। এক হাতে সাঁতরাতে গিয়ে ডুবে যাচ্ছিল কেউ ওর পা ধরে টান মারল তারপর নিয়ে চলল একপাশে। ওপর থেকে ছপছপ রকমের অদ্ভুত শব্দ ভেসে আসছে। আসলে কেউ গুলি করছে পানিতে। কিরানকে টেনে নিয়ে ছায়াটা সরে এলো একপাশে। খালপাড়ের ঝুঁকে থাকা গাছের শিকড়-বাকড়ের আড়ালে লুকিয়ে দম নিতে লাগল তিনজনেই। কিরান হাতে ধরে দেখল ওর বাঁহাতের কনুইয়ের কাছে রক্ত। মনে হয় সিসা লেগেছে।

আর কিছু চিন্তা না করে শিকড়ে হেলান দিয়ে বসে রইল ও। খালের পাড় থেকে দস্যুদের উত্তেজিত চিৎকার ভেসে আসছে। ওরা চুপচাপ পড়ে রইল যতক্ষণ পর্যন্ত দস্যুদের চিৎকার, চেঁচামেচি আর উন্মাদনা কমে না আসে। দস্যুরা একে অপরকে দোষারোপ করে পানিতে আরো গুলি ছুড়ে একসময় ক্ষান্ত দিল। তারপর ধীরে ধীরে তারা রওনা দিল যেদিক থেকে এসেছে সেদিকে। ওরা পড়ে রইল ওখানেই। কোনো কথা নেই। স্রেফ চুপচাপ নিশ্বাস নিতে লাগল।

আর কতক্ষণ ওভাবে পড়ে থাকত কে জানে। কিন্তু জঙ্গল-জলার ভেতর থেকে একটা বৈঠার ছপাৎ শব্দ ভেসে এলো। সেই সঙ্গে কেউ একজন শিস বাজাচ্ছে যেন।

কিরান কোনোমতে বলে উঠল, ‘গোমেজ,’ বলে সে পানিতে নিজেকে ভাসিয়ে দিয়ে সাঁতরাতে লাগল সেদিকে। ওরা নৌকার কাছাকাছি পৌঁছাতেই গোমেজ ওদের টেনে তুলে নিল একে একে। সে নীরব দৃষ্টিতে জানতে চাইল ওখানে আসলে হচ্ছেটা কি। কিন্তু কেউ তাকে কোনো জবাব দিল না। বরং নৌকায় ওঠার পর জ্বলন্ত গ্রামের দিকে তাকিয়ে রইল সবাই। আর সেদিকে তাকিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ল গোলন্দাজ রঙ্গন মল্লিক।

আফসোসের সঙ্গে মাথা নাড়ল কিরান। গোলন্দাজকে হয়তো উদ্ধার করে আনতে পেরেছে ওরা। কিন্তু বাঁচাতে পারেনি তার গ্রামটাকে। ক্রন্দনরত গোলন্দাজের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে নৌকা ছাড়তে ইশারা করল গোমেজের দিকে তাকিয়ে। ওদের মূল অভিযান শুরু করতে হলে জলদি পৌঁছাতে হবে খন্ডালের গুহায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *