মগরাজ – ২০

অধ্যায় বিশ – বর্তমান সময় পতেঙ্গা

এলাকা, চট্টগ্রাম

কোকের ঠান্ডা ক্যানটাতে চুমুক দিতে দিতে শারিয়ারের মনে হতে লাগল এর চেয়ে সুস্বাদু কোনো জিনিস জীবনে কোনোদিন পান করেনি সে। চেনা জিনিসের স্বাদ পরিস্থিতি আর প্রেক্ষাপটের ভিন্নতায় এমনভাবে বদলে যেতে পারে সেটা কল্পনার অতীত একটা ব্যাপার। ক্যানটাতে আরেকবার চুমুক দিয়ে সে ডান হাতে ধরা ডানহিল সিগারেটে আরেকটা টান দিল। ও চেয়ারে হেলান দিয়ে পায়ের ওপরে আরেকটা পা তুলে দিল। কিন্তু কোক আর সিগারেটের দুর্দান্ত কম্বিনেশনের কারণে জীবনটা অনেক বেশি মধুময় মনে হচ্ছে ওর। যদিও পরিবেশ পরিস্থিতি অনুযায়ী সেরকম মনে হওয়ার কোনো কারণ নেই

শারিয়ার এখন বসে আছে গতরাতে যে-বাড়ির বেইজমেন্টে এত কাণ্ড হয়ে গেছে সেই বাড়ির ডাইনিং রুমে। গত রাতের সেই বিস্ফোরণের পোড়া গন্ধ আর ধোঁয়ার ফ্লেভার এমনকি এখান থেকেও পরিষ্কার টের পাওয়া যাচ্ছে। গতরাতের ওই বিস্ফোরণের ফলে অনেকক্ষণ ও ভুবন কিংবা মোর্শেদ কেউই ওখান থেকে নড়তে পারেনি। বিস্ফোরণটা ঘটার বেশ কিছুক্ষণ পর ধীরে ধীরে ওরা ডাইনিং রুমে উঠে আসে বেইজমেন্ট থেকে। ডাইনিং রুমে ঢোকার পর একদল পুলিশের সঙ্গে ওদের মোলাকাত হয়। প্রথমেই ভুবন আর মোর্শেদ নিজেদের ব্যাজ দেখিয়ে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে। মোর্শেদই ওদের প্রথম জানায় সেই ওদেরকে এখানে ডেকেছিল ব্যাকআপ হিসেবে। টহল পুলিশের দলটা এখানে এসে পরিস্থিতি বুঝে নিয়ে পুলিশ হেডকোয়ার্টারের সঙ্গে যোগোযোগ করে। শারিয়ারও ওদের মাধ্যমে ঢাকা পিবিআই অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ করে। এরপর কিছুক্ষণের ভেতরে পুলিশের বড়ো ফোর্স, অ্যাম্বুলেন্স সিবিআই পিবিআই সিডিআইয়ের লোকেদের পদচারণে ভরে যায় পুরো বাড়ি। মোর্শেদ আর গার্ডে থাকা অজ্ঞান পুলিশ অফিসারকে অ্যাম্বুলেন্সে করে নিয়ে যায়। ভুবন আর শারিয়ার প্রাথমিক চিকিৎসা নেয়। পিবিআই আর তাদের ফরেনসিকের লোকেরা নিচে গিয়ে কাজ শুরু করে আর ওরা ওপরে ডাইনিং রুমে এসে অপেক্ষা করতে থাকে।

যদিও শারিয়ার বেশ শান্ত মুখে বসে আছে, কিন্তু ভেতরে ভেতরে অস্থিরতার একটা জটিল মেঘ ছেয়ে ফেলেছে ওর মনটা। শারিয়ার এখনো বুঝতে পারছে না কেসটায় কতটা বেশি ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু এটা বুঝতে পারছে ক্ষতিটা পূরণ করা অনেক কঠিন হয়ে যাবে। এমনকি ওর কাজ তো বটেই, ওর চাকরি নিয়েও টান পড়ে যেতে পারে। ওর নিজের একটার পর একটা ভুল আর বোকার মতো সিদ্ধান্তের কারণেই আজ এই পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে। ওর পারফরমেন্স তো বটেই এমনকি কেসটারও সম্ভবত বারোটা বেজে গেছে। গতরাতের বিস্ফোরণের পর যখন হেড অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ করে তখন স্রেফ ডিউটি অফিসার বাদে কেউই আর রাতের বেলা অফিসে ছিল না। তবে বিস্তারিত রিপোর্ট করার পর সে জানায় সকালের প্রথম প্রহরেই অফিশিয়াল রিপোর্ট জানানো হবে ঊর্ধ্বতন কর্তাদের, আর সেটা শুনে তারা পরবর্তী করণীয় জানাবেন। শারিয়ার সেই অপেক্ষাতেই আছে এখন।

পাশ থেকে মৃদু কাশি শুনে ফিরে তাকাল শারিয়ার। ভুবন ছেলেটা চোখে-মুখে পানি ছিটিয়ে ফিরে এসেছে। ওর পাশে একটা চেয়ার টেনে বসে পড়ল। ‘বস, কিছু মনে না করলে কাল রাত থেকে তো অনেক কিছুই করে ফেলেছি। এখন বেয়াদবি না নিলে,’ বলে সে শারিয়ারের সিগারেটটার দিকে ইশারা করল। ছেলেটার ইশারা দেখে শারিয়ার হেসে উঠল। কিছু না বলে ছেঁড়া ব্লেজারের পকেট থেকে নিজের ডানহিলের প্যাকেটটা বের করে এগিয়ে দিল ভুবনের দিকে।

প্যাকেটটা দেখে ভুবন ছেলেটা হেসে উঠল। শারিয়ার খেয়াল করল ছেলেটার চেহারা মঙ্গলয়েড, মানে একটু চায়নিজ ধাঁচের হলেও দেখতে বেশ সুদর্শন ছেলেটা। বেশ লম্বা হালকাপাতলা শক্তিশালী গঠন। শারিয়ারের গত রাতের মারামারির ঘটনা মনে পড়ে গেল। এই ছেলের ট্রেনিং বিশ্বসেরা। তা না হলে কোনোমতেই এতটা টক্কর দিতে পারত না সে।

ভুবন ছেলেটা হেসে উঠে ডানহিলের প্যাকেট থেকে একটা লম্বা সিগোরেট বের করে নাকের কাছে নিয়ে ঘ্রাণ নিয়ে শারিয়ারের এগিয়ে দেওয়া লাইটার দিয়ে ধরাল। আহা রে, প্যাকেটটা চাপ খেয়ে দামি সিগারেটগুলো চ্যাপ্টা হয়ে গেছে। একটা ব্যাপার বুঝলাম না বস, সরকার তোমাদের যে বেতন দেয় তাতে তুমি ডানহিল অ্যাফোর্ড করো কীভাবে?’ বলে সে জিভ কেটে বলে উঠল। ‘অহ হো, তোমাকে তো আবার তুমি বলে ফেললাম।’

শারিয়ার হেসে উঠল ছেলেটার কথার ধরন শুনে। ‘সরকারের বেতনে তো আমি চলি না,’ বলে সে নিজের সিগারেটটাতে শেষ টান দিয়ে ওটাকে মাটিতে ফেলে পিষে দিল পায়ের নিচে। ‘আমার মনে হয় আমাদের ফর্মালি পরিচয় হওয়া দরকার,’ বলে ও নিজের হাতটা বাড়িয়ে দিল হ্যান্ডশেইকের ভঙ্গিতে। ‘আমি শারহান শারিয়ার স্পোশাল ইনভেস্টিগেশন অফিসার, স্পেশাল ব্রাঞ্চ, পিবিআই।’

‘শাহরিয়ার?’ প্রশ্নের ভঙ্গিতে জানতে চাইল ছেলেটা। সিগারেটটাকে ঠোঁটের কোনে আটকে নিজের ডান হাতটা এগিয়ে দিল শারিয়ারের দিকে।

জীবনে অসংখ্যবার শোনা প্রশ্নটা আবারও শুনতে পাবে এতে শারিয়ারের কোনোই অবাক লাগল না। ‘নাহ, শারিয়ার আমার নাম। শাহরিয়ার না।’

ভুবন ছেলেটা এখনো ওর হাতটা ধরে আছে। ‘শারিয়ার, শারিয়ার,’ সে আনমনে দুবার বলে উঠল ওর নামটা। ‘মানে আরব্য রজনীর সেই সম্রাট শারিয়ার? ঠিক বলেছি?’

শারিয়ার সত্যিকার অর্থেই অত্যন্ত অবাক হলো। কারণ নিজের এই জীবনে শারিয়ার আর শাহরিয়ার নিয়ে দ্বিধা হলেও ওর নামের প্রকৃত উৎসটা এখন পর্যন্ত এত দ্রুত কেউই ধরতে পারেনি। ‘একদম ঠিক, আরব্য রজনীর সেই সম্রাট শারিয়ারের নামেই আমার নাম রাখা হয়েছে শারিয়ার। তুমি জানলে কীভাবে?’

ছেলেটা হেসে উঠল, ‘সে অন্য গল্প। আগে আমার নিজের পরিচয়টা তো দিয়ে নেই। আমি ভুবন শর্মা। এক্স মিলিটারি, এক্স ফ্রিল্যান্স স্পেশাল প্যারা কমান্ডো ও লং রেঞ্জ শুটিং এক্সপার্ট, বর্তমানে স্রেফ একজন সিকিউরিটি গার্ড,’ বলতে বলতেই ছেলেটার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো একটা দীর্ঘ-নিশ্বাস। শারিয়ার অনুমান করল নিজের প্রফেশনাল জীবনের কথা বলতে গিয়ে বেরিয়ে আসা এই দীর্ঘ-নিশ্বাস প্রমাণ করে এই নিয়ে তার ভেতরে অনেক তিক্ত স্মৃতি জড়িয়ে আছে।

‘স্নাইপার থেকে একেবারে সিকিউরিটি গার্ড?’ প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে জানতে চাইল শারিয়ার। তারপর নিজের মুখের ক্ষতগুলো দেখিয়ে জানতে চাইল ‘স্রেফ?’ বলে হা- হা করে হেসে উঠল ও। ওর সঙ্গে ভুবনও হেসে উঠল। ‘তাহলে এখানে কীভাবে?’

ভুবনের মুখ দিয়ে আবারও দীর্ঘ-নিশ্বাস বেরিয়ে এলো। ‘সে অনেক লম্বা গল্প, বললাম তো। তবে আমি এই মুহূর্তে টেম্পোরারি হিসেবে আবারও ফোর্সে জয়েন করেছি পাশা স্যারের অনুরোধে,’ বলে সে কাঁধ ঝাঁকাল। ‘বলতে পারো নির্দেশে কারণ স্যারের অনুরোধ মানেই আমার জন্য নির্দেশ।’

ছেলেটার জবাব শুনে শারিয়ার একটু অবাক হলেও মনে মনে সেও বলে উঠল ওর জন্যও তাই। ‘কাল রাতের জন্য সরি।’

‘সরি আসলে আমার বলা উচিত,’ বলে ছেলেটা কাঁধ ঝাঁকাল। ‘কিন্তু বস, আমি একটা ব্যাপার বুঝতে পারলাম না, কাল রাতে আসলে হলোটা কী? এই বালের কেসে এখন পর্যন্ত আসলে হচ্ছেটা কী? আমি জানতাম এই কেসটার শুরু শুধুই মাত্র একটা হিট অ্যান্ড রানের ঘটনা দিয়ে। কিন্তু কাজে নেমে দেখতে পাচ্ছি বড়ো বড়ো সংস্থাগুলোর ইনভলভমেন্ট, আন্তর্জাতিক খুনি, টেক এক্সপার্টদের সমাগম,’ বলে অসহায় একটা ভাব করল সে। ‘এর মাঝখানে আমাদের ছেড়ে দেওয়া হলো। না ধরতে পারছি লেজ, না বুঝতে পারছি মাথা। এভাবে কীভাবে কাজ করব? কাল রাতে তো আরেকটু হলে নিজেরাই নিজেদের মেরে ফেলতে বসেছিলাম।’

‘আসলে এখানে…’ যে ব্যাপারটা শারিয়ার অনুধাবন করছে সেটা ভুবনকে খুলে বলতে যাচ্ছিল তার আগেই বাইরে একাধিক পায়ের শব্দে সচকিত হয়ে উঠল দুজনে। শারিয়ারের দিকে তাকিয়ে আছে ভুবন প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে। শারিয়ার কিছু বলে ওঠার আগেই রুমে প্রবেশ করল আট-দশজনের একটা দল। তাদের সর্বাগ্রে স্যুট পরিহিত একজন মহিলা। ভেতরে ঢুকেই সে একবার পরিস্থিতি দেখে নিল। ছেঁড়াফাটা পোশাক পরা কালিঝুলি মাখা ভুবন আর শারিয়ারের দিকে এমনভাবে তাকাল যেন দুটো ছুঁচো দেখছে। তারপর নিজের টিমের একজনের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, ‘টমি, তুমি যাও ফরেনসিকের আপডেট দেখো। আমি ফরেনসিকের সমস্ত ডেটার ডিজিটাইজড ভার্সন চাই দুপুরের ভেতরে। বোঝা গেছে?’ থ্রি- কোয়ার্টার পরা পেটকা কিসিমের ক্যাপ পরা ছেলেটা তার পেটের চেয়েও মোটা একটা ব্যাকপ্যাক নিয়ে রওনা করল বেইজমেন্টের দিকে।

সুমন আপনি, আবারও পুরো সাইটটা ঠিক মতো সিল করা হয়েছে কি না চেক করুন। আমি পুরো স্পেস কমপ্যাক্ট চাই আগামী এক ঘণ্টার ভেতরে। শুধু ফরেনসিক বাদে অন্য সবাইকে আমি এর বাইরে দেখতে চাই। সেই সঙ্গে আগামী এক ঘণ্টার ভেতরেই সিকিউরিটি থেকে শুরু করে সমস্ত স্পেস আমাদের নিয়ন্ত্রণে চাই। বোঝা গেছে?’

অফিসার গোছের দেখতে সুমন লোকটা একবার ওদের দিকে দেখে নিয়ে নিজের টিমের পাঁচজনকে নিয়ে চলে গেল বাইরের দিকে। ‘তোমরা আমার সঙ্গে এসো,’ বলে সে এতক্ষণে এগিয়ে এলো শারিয়ার আর ভুবন যেখানে বসে আছে সেদিকে। ওদের দিকে হিলের খটাখট শব্দ তুলে সে এগিয়ে আসতেই তার পেছনে থাকা একজন অফিসার সামনে এসে একটা চেয়ার টেনে দিল তাকে। স্টেজে র‍্যাম্প করতে থাকা মডেলরা ঠিক যেভাবে হাঁটে অনেকটা সে-ভঙ্গিতে হেঁটে এসে বেসিক ইন্সটিঙ্কট সিনেমার শ্যারন স্টোনের মতো বসে পড়ল সে ওদের সামনে।

বসার সঙ্গে সঙ্গে শারিয়ার ভালোভাবে খেয়াল করে সে নিজেকে শুধরে নিল। এটা মহিলা নয় মেয়ে। বয়সে এই মেয়ে তার চেয়ে বড়ো তো হবেই না পারলে ছোটো হবে। কিছু না বলে সে তাকিয়ে রইল মেয়েটার দিকে।

মেয়েটা একবার ওকে দেখল তারপর ভুবনের দিকে তাকাল, তারপর আবারও ফিরে তাকাল শারিয়ারের দিকে। ‘আপনি নিশ্চয়ই স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন অফিসার শারহান শারিয়ার?’ বলে সে ভুবনের দিকে ফিরে জানতে চাইল, ‘এবং আপনি স্পেশাল রিক্রুটমেন্ট হিসেবে কাজ করা অফিসার ভুবন শর্মা?’ বলে সে ওদের উত্তরের অপেক্ষা না করে সে নিজের পনিটেইল দুলিয়ে বলে উঠল, ‘আমি রুম্পা, রুম্পা তালুকদার, স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন অফিসার, পিবিআই চট্টগ্রাম ব্যুরো, শারিয়ার ঠিক ধরতে পারল না মেয়েটা ইচ্ছে করেই স্পেশাল অফিসারের ব্যাপারটা একটু চিবিয়ে চিবিয়ে বলল কি? নাকি ওরই শুনতে ভুল হলো। তবে যেটাই হোক না কেন শারিয়ার এটা বুঝতে পারল মেয়েটা ওর মতো একই র‍্যাংকের অফিসার। কিন্তু এই ব্যাপারটাকে এতটা চিবিয়ে বলার কারণ কী?

মেয়েটা অবশ্য তখনো বলে চলেছে, ‘স্পেশাল অফিসার শারিয়ার, আপনাকে অফিশিয়ালি কিছু সিদ্ধান্ত জানানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে আমাকে। প্রথম সিদ্ধান্ত, এই কেসের সমস্ত দায়িত্ব থেকে আপনাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে এবং এই কেস এখন থেকে আমার অধীনেই পরিচালিত হবে। আপনি চাইলে এই মুহূর্তে এখান থেকে ঢাকার জন্য রওনা করতে পারেন। কিংবা আগ্রাবাদে আমাদের পিবিআইয়ের একটা স্পেশাল গেস্ট হাউস আছে। চাইলে সেখানে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে বিশ্রাম নিয়ে তারপর বিদায় হতে পারেন। আর উই ক্লিয়ার, অফিসার?’

যেন খুব মজার কোনো কৌতুক শুনছে এমন ভঙ্গিতে শারিয়ার তাকিয়ে আছে মেয়েটার দিকে। তার কথা শেষ হওয়ার পরও সে কোনো জবাব দিল না। বরং খুব ধীরে-সুস্থে সে পকেট থেকে ডানহিলের প্যাকেটটা আবারও বের করল তারপর সেটা থেকে একটা সিগারেট বের করে ঠোঁটে নিয়ে আগুন দিতে দিতে বলে উঠল, ‘স্যুটটা কেন?’

‘সরি?’ মেয়েটা একটু তাজ্জব হয়ে গেছে শারিয়ারের প্রশ্নটা শুনে। সে অবাক হয়ে প্রশ্নটা করে নিজের লোক দুজনকে দেখে নিয়ে বলে উঠল, ‘আপনি আমাকে বলছেন?’

‘জি,’ বলে শারিয়ার মুখ দিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে সিগারেট ধরা হাতের আঙুলটা মেয়েটার দিকে তাক করে বলে উঠল, ‘সময়টা শীতকাল ঠিক আছে। কিন্তু পরিস্থিতি এমন না যে এত সকালবেলা আপনাকে এভাবে টাই-টুইসহ স্যুট পরতে হবে।’

‘দেখুন মিস্টার শাহরিয়ার…’

‘নামটা শারিয়ার,’ শারিয়ার তাকে শুধরে দিল। ‘শাহরিয়ার নয়…’

‘মিস্টার হোয়াটএভার। আমি আপনাকে সাবধান করে দিচ্ছি আপনি আমার পরসোনাল কোনো বিষয় নিয়ে…’

‘ব্যাপারটা আসলে ব্যক্তিত্বের,’ বলে সে নিজেকে একটু এগিয়ে নিয়ে গেল মেয়েটার দিকে। ‘তাই না?’ শারিয়ার সরাসরি তাকিয়ে আছে মেয়েটার পিঙ্গল রঙের চোখের দিকে। ‘আরো বিশদ বলতে গেলে ব্যক্তিত্ব এবং কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার। আর এ কারণেই স্যুট, যদি আমি ভুল বলে না থাকি। আপনি…’

‘মিস্টার শারিয়ার, আপনি সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছেন। আমি স্রেফ আমার প্রফশেনাল ডিউটি পালন করছি, কাজেই…’

‘সীমার কথাই যদি বলেন তবে একটা কথা বলি। এই কেস আমার অধীনেই পরিচালিত হবে। আর সেটাকে পরিচালনা করার জন্যই আমি ঢাকা থেকে এসেছি। যে-পর্যন্ত আমার সরাসরি কর্তৃপক্ষ হাবিব আনোয়ার পাশা স্যার কিংবা আমার নিজের হেড অফিস থেকে আমাকে কিছু জানানো না হয় ততক্ষণ পর্যন্ত আমি এখান থেকে এক পাও নড়ছি না। কাজেই খবরদার আমার ওপরে খবরদারি করার চেষ্টা করবেন না, মিস হোয়াটএভার। ভালো চাইলে আপনি আপনার এই আহামরি চেহারা আর নিজের লোকদেরকে নিয়ে আমাকে যদি সাহায্য করতে পারেন করেন, না পারলে ভাগেন। ইজ দ্যাট আন্ডারস্টুড?’ শেষের কথাগুলো শারিয়ার বলতে গেলে প্রায় ধমকের সুরে বলে উঠল।

ওর সামনে বসা স্পেশাল অফিসার মেয়েটার চেহারা দেখে মনে হচ্ছে যেন তার চেহারা লাল হতে হতে বোমার মতো বিস্ফোরিত হবে। সে একটা আঙুল তুলে শারিয়ারের দিকে তাক করল তারপর দুবার কথা বলার জন্য মুখ খুলল কিন্তু কথা বেরুল না মুখ দিয়ে। তার পরিবর্তে রাগের হলকা বেরিয়ে আসছে যেন।

মেয়েটা রাগের সঙ্গে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তার আগেই ভুবন এগিয়ে এলো সামনের দিকে। ‘আমার মনে হয় এখানে একটু ভুল বোঝাবুঝি হচ্ছে। আমাদের আসলে…’ ভুবন কথা শেষ করতে পারল না। তার আগেই শারিয়ারের মোবাইলটা বাজতে লাগল। শারিয়ার বেশ চমকে উঠেছে, ভুবনের কথা থেমে গেছে, আর মেয়েটা তাকিয়ে আছে সেই আগ্নেয়গিরির দৃষ্টিতে। তার পেছনে দাঁড়ানো অফিসার দুজন একে অপরের দিকে মুখ চাওয়াচাওয়ি করল।

শারিয়ার ফোনটা পকেট থেকে বের করে চোখের সামনে তুলে দেখল ফোনটার ফাটা স্ক্রিনের ফাঁক দিয়ে ওর ঢাকা অফিসের নম্বর দেখা যাচ্ছে। মেয়েটার আগ্নেগিরির মতো চেহারায় সামান্য ফাটল দেখা দিল। তারপর সেখানে ধীরে ধীরে ফুটে উঠল কৌতুকের হাসি। যেন সে বলতে চাইছে, ফোনটা রিসিভ করুন হিরো। কিন্ত সে কিছু বলার আগেই শারিয়ার কলটা রিসিভ করে কানে লাগাল মোবাইলটা।

যদিও জানত কে কথা বলবে তবুও এই অবস্থায় হাবিব আনোয়ার পাশার ভারী গলাটা শুনে বুকের ভেতরটা কেমন জানি কেঁপে উঠল ওর। শারিয়ার, এই জন্য আমি তোমাকে চট্টগ্রামে পাঠিয়েছিলাম?’ কোনো সম্বোধন নয়, কোনো খোঁজখবর চাওয়া নয়, কিছুই নয়। এমনকি কোনো জোর গলায় ধমক পর্যন্ত নয়। শারিয়ার যে কোনো পরিস্থিতির জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে রেখেছিল কিন্তু হাবিব আনোয়ার পাশার আবেগি গলা শুনে ওর ভেতরটা সত্যিকার অর্থেই কেঁপে উঠল ওর। ‘স্যার…’

‘তুমি কি জানো এই কেসটাকে লোকাল পুলিশ আর সিবিআইয়ের হাত থেকে আমাদের হাতে নিতে কী পরিমাণ কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে আমার? তুমি কি জানো এই কেসটা কেন আমি আমাদের হাতে নিয়েছি?’

শারিয়ার চুপ, ওর মাথায় কিছু খেলছে।

‘আমি কতটা আশা নিয়ে আর সাহস করে তোমার ওপরে, স্রেফ তোমার ওপরে ভরসা করে পুরো দায়িত্ব তুলে দিয়েছিলাম। আর তুমি কী করলে…’ পাশা স্যারের গলার উত্তাপ ধীরে ধীরে বাড়ছে।

‘স্যার, আই ক্যান এক্সপ্লেইন…’

‘হোয়াই, শারিয়ার?’ বলে প্রায় আর্তনাদ করে উঠল। ‘কেন আমি তোমার ব্যাখ্যা শুনব, শারিয়ার? যেখানে ব্যাখ্যা নয় বরং কাজে লাগানোর জন্য আমি তোমাকে পাঠিয়েছিলাম। আমি তোমাকে পাঠিয়েছিলাম কারণ তুমি অ্যাকশনের মানুষ। কিন্তু সেই অ্যাকশন যদি এরকম হয় যে সব হারিয়ে এমনকি কেসের প্রধান ব্লুগুলোই হারিয়ে বসে থাকো তবে এখানে ব্যাখ্যা শুনে কী হবে, শারিয়ার?’

ফোনের ওপারে-এপারে দুপাশেই নীরবতা। শারিয়ার একবার আড়চোখে দেখে নিল ভুবনকে সেই সঙ্গে তার সামনের মানুষগুলোকে। সবাই বুঝতে পারছে কথোপকথনটা কোনদিকে যাচ্ছে।

‘তুমি এত চমৎকার একটা ট্রেনিং থেকে এসে একের পর এক গুবলেট করেই যাচ্ছ। গ্রো আপ বয়। এটা আমাদের জন্য এমন একটা কেস হতে পারত যেটা আমি নতুন যে ডিপার্টমেন্টটা খুলতে যাচ্ছি সেটার জন্য সবচেয়ে বড়ো উদাহরণ হতে পারত। হ্যাঁ, উদাহরণ এখনো হয়েছে সেটা উলটোদিক থেকে। আল্লার ওয়াস্তে তুমি আমাকে মাফ করো…’

‘স্যার, আমার জন্য আপনার কী নির্দেশনা?’ পাশা স্যারের সঙ্গে এই কথোপকথনটা আর নিতে পারছে না শারিয়ার। তাই কথা শেষ করতে চাচ্ছে সে। আর তাছাড়া সিদ্ধান্ত কী হবে ইতোমধ্যেই বুঝে ফেলেছে ও।

‘কেসটা এই মুহূর্তে আর আমার হাতে নেই। এর সঙ্গে অনেক ব্যাপার জড়িয়ে গেছে। সবকিছু একেবারে লেজেগোবরে হয়ে গেছে। অথরিটি চাচ্ছে এটাকে লোকাল অফিস ইনচার্জ রুম্পার হাতে তুলে দিতে। আমিও অ্যাগ্রি করেছি আর তাই রুম্পা যেভাবে বলে সেভাবেই তুমি অ্যাক্ট করবে। বোঝা গেছে, শারিয়ার?’

‘জি, স্যার,’ বলে ও আড়চোখে রুম্পার দিকে দেখল। মেয়েটার চোখে বিজয়ের নীরব হাসি। ‘মিস রুম্পা যেভাবে বলবে সেভাবেই আমি অ্যাক্ট করব,’ কথা শেষ করে মোবাইলটা নামিয়ে রেখে ও দেখল ভুবন খুব দুঃখী চেহারা নিয়ে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। রুম্পার চোখে নীরব বিজয় আর তার পেছনের দুজনের চেহারা কোনো বিশেষ ভাব নেই।

মোবাইল নামিয়ে রেখে ঠান্ডা গলায় কথা বলে উঠল শারিয়ার। ‘মিস রুম্পা, আপনি নিশ্চয়ই অনুধাবন করতে পেরেছেন পাশা স্যারের সঙ্গে আমার কথোপকথন,’ বলে সে কাঁধ ঝাঁকাল। আপনি যা বলবেন সেটাই আমার জন্য নির্দেশনা।’

‘আপনাকে এই কেস থেকে ডিসচার্জ করা হলো। এই কেসের জন্য আপনার সার্ভিস আর প্রয়োজন নেই, অফিসার,’ বেশ আত্মতৃপ্তি ভরা গলায় কথাটা বলে বাকিদের দিকে তাকিয়ে মৃদু একটা হাসি দিল স্পেশাল অফিসার রুম্পা তালুকদার।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *