মগরাজ – পূর্বকথা

পূর্বকথা – সময়: ১৬৬১ খ্রিস্টাব্দ

তুলপাধলা গ্রাম, ত্রিপুরা রাজ্য

পশ্চিম দিগন্তে হেলতে থাকা সূর্যের তীর্যক আলোতে সোনালি কার্পেটের মতো ঝকঝক করছে মাইলের পর মাইল বিস্তৃত গমখেত। আর কিছুটা সময় পার হলেই পাহাড়ের আড়ালে ঝপ করে মুখ লুকাবে পড়ন্ত সূর্যটা। গোধূলি আর বিকেলের দড়ি টানাটানি শেষ না হতেই হুট করে নেমে আসবে পাহাড়ি সন্ধ্যা। আর ঠিক সে- সময়েরই অপেক্ষা করছে ত্রিপুরা রাজ্যের ছোট্ট গ্রাম তুলপাধলার বাসিন্দারা।

তুলপাধলা গ্রামটা ত্রিপুরা রাজ্যের একেবারে শেষ কিনারায় ধলার পাহাড় নামে সাদাটে ধূসর এক বিরাট পাহাড়ের কোল ঘেঁষে বয়ে যাওয়া তুলপা নদীর ঠিক কূলেই অবস্থিত। কবি-সাহিত্যিকদের ভাষায় বলতে গেলে ধূসর পাহাড় আর স্বচ্ছ নদীর পানির ঠিক মিলনস্থলেই অবস্থিত গ্রামটা। এ কারণেই কিনা কে জানে, পাহাড় আর নদীর নাম মিলিয়েই গ্রামের নাম হয়েছে তুলপাধলা। এই নামের উৎপত্তি সঠিকভাবে না জানলেও গ্রামের বাসিন্দারা এটা মানে যে, তুলাপধলা গ্রাম দেবতাদের সরাসরি আশীর্বাদপ্রাপ্ত। কারণ পুরো ত্রিপুরা রাজ্যে সর্বদা পানির যে প্রকট সমস্যা লেগে থাকে তার ছিটেফোঁটাও নেই এই গ্রামে। পানির সমস্যা না থাকার কারণেই বিগত কয়েক শতক ধরে তুলপা নদীসংলগ্ন বিস্তৃত এলাকায় গড়ে উঠেছে এই এলাকার সবচেয়ে বড়ো গম আর যব চাষের ক্ষেত্র।

তুলপাধলার আশপাশের এলাকাতে ফলানো গম আর যবের চাহিদা ছড়িয়ে পড়েছে সমস্ত ত্রিপুরা ও মনিপুর রাজ্যজুড়ে। এমনকি এই এলাকার যবের চাহিদা ত্রিপুরা রাজ্য ছাড়িয়ে বিস্তৃতি ঘটতে শুরু করেছে সেই সুদূর হিন্দুস্তান পর্যন্ত। হিন্দুস্তানের বহু এলাকাতেই যবের ছাতুর একমাত্র উৎস ত্রিপুরা রাজ্যে উৎপাদিত যব। এ কারণেই তুলপাধলাকে বলা হয়ে থাকে সরাসরি স্রষ্টার আর্শীবাদপ্রাপ্ত। এমনকি ত্রিপুরা রাজ্যের রাজাও এমনটাই মনে করেন। যে কারণে রাজার বিশেষ বিবেচনার অধীনে থাকে এই এলাকা। ত্রিপুরার অন্যান্য এলাকা যেখানে স্থানীয় শাসকের অধীনে শাসিত হয়ে থাকে সেখানে তুলপাধলা শাসিত হয় সরাসরি রাজার অধীনে। এমনকি প্রতি বছরের নির্দিষ্ট একটা সময় রাজা নিজে একবারের জন্য হলেও সশরীরে ভ্রমণ করতে আসেন বৃহত্তর তুলপাধলা রাজ্যে। ধলার পাহাড়সংলগ্ন নদীর পাড়ে রাজার থাকার জন্য বিরাট রাজবাড়ি নির্মাণ করা আছে। রাজার সান্নিধ্য পেয়ে তুলপাধলার লোকেরাও অত্যন্ত সুখী। বছরের যেই সময়টায় রাজা বেড়াতে আসেন সেই সময়টাতে তুলপাধলা এলাকাতে উৎসব-আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। এছাড়া বছরের বাকি সময়টা তুলপা নদীর নিস্তরঙ্গ জলের মতোই শান্তভাবে প্রবাহিত হতে থাকে তুলপাধলা এলাকার মানুষের জীবন। তবে নিস্তরঙ্গ এই জীবনে মাঝে মাঝে আলোড়ন বয়ে যায় ছোটো-বড়ো নানা ঘটনায়। ঠিক সে-রকমই একটা ঘটনা বেশ কিছুদিন ধরে ঘটে চলেছে তুলপাধলা গ্রামে।

ভালোর সঙ্গে যেমন মন্দ, আলোর সঙ্গে যেমন অন্ধকার, ঠিক তেমনি আশীর্বাদের সঙ্গে যোগ হয় ছোটোখাটো কিছু অভিশাপ। সমৃদ্ধির সঙ্গে তুলপাধলা গ্রামের প্রবহমান জীবনেরও এরকম একটা ছোট্ট অভিশাপ আছে। আর সেটা হলো তাদের বিনোদন ব্যবস্থার অভাব। বছরের ছয়টি ঋতুর ভেতরে তিনটের সময় ফসলের কাজে তারা সাংঘাতিক ব্যস্ত থাকে। ফসল ফলানো থেকে শুরু করে ফসল রপ্তানির জন্য গুদামজাত করা পর্যন্ত সময়াটাতে উদয়াস্ত অমানুষিক পরিশ্রম করতে হয় তাদের। ঘরের নারী-পুরুষ থেকে শুরু করে কখনো কখনো ছোটো বাচ্চা এমনকি বৃদ্ধদেরও কাজে লেগে যেতে হয় বাধ্য হয়ে। একেবারে অথর্ব না হলে এ- সময়টাতে পরিশ্রম করতে সমর্থ এমন প্রত্যেকটা মানুষকেই কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়।

কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় অন্য তিন ঋতুতে, মানে বছরের বাকি সময়টাতে। এই সময়টাতে বলতে গেলে তাদের কোনো কাজই থাকে না। একেবারে আলসে হয়ে শুয়ে-বসে সময় কাটাতে কাটাতে জীবন একঘেয়ে আর পানসে হয়ে যায় তাদের।

তবে গত কয়েকমাস ধরে তাদের এই পানসে জীবনেই দেখা দিয়েছে ভিন্ন এক উত্তেজনা। এমন এক উত্তেজনা, এমন এক ভিন্ন বিনোদন যার খোঁজ এর আগে কখনো পায়নি তুলপাধলা গ্রামের লোকেরা। উত্তেজনার কারণ আর কিছুই না তাদের এলাকায় আগত এক সন্ত, যাকে দরবেশও বলা চলে। এই সন্তকে তারা নাম দিয়েছে গল্প বলিয়ে সন্ত। গল্প বলার প্রথা তাদের পাশের মনিপুর রাজ্য আর বাঙ্গাল মুলুকে খুবই পরিচিত আর বিনোদনের অন্যতম প্রধান এক মাধ্যম হলেও তাদের ত্রিপুরা এলাকায় এটার প্রচলন খুবই কম, বলতে গেলে নেই-ই। একারণেই গল্প বলিয়ে সন্তের তুলপাধলাতে আগমনের ব্যাপারটা খুবই আকর্ষণীয়, অন্তত গ্রামের লোকজনের কাছে তো বটেই।

সময়টা তখন সবে শীতকাল শেষ হয়েছে। শীতের ঠান্ডা বাতাস ধীরে ধীরে পাহাড়ি টানে বদলে গিয়ে স্ব-আনন্দে ঘোষণা করছে বসন্তের আগমন ধ্বনি। এ- সময়টা গ্রামীণ জীবনের সবচেয়ে আনন্দের সময়। কারণ শীতের সঙ্গে শেষ হয়ে যায় ফসলের কাজ। একবার ফসল গোলাঘরে তোলার পর অফুরন্ত সময় তাদের হাতে। এই সময়টাতে ফসল রপ্তানি আর গুদামজাত করার পর একদিকে হাতে থাকে অর্থ, অন্যদিকে অফুরন্ত সময়। এর সঙ্গে যোগ হয় বসন্তের বার্ষিক উৎসবের সময়। সবমিলিয়ে এই সময়টা এমন এক সময়, যখন জীবন সবচেয়ে বেশি সুন্দর হয়ে ওঠে তুলপা গ্রামের মানুষের কাছে। কিন্তু এই বছর ব্যতিক্রম দেখা দেয় সবকিছুতে।

এর পেছনে কারণ হলো রাজার অনুপস্থিতি। বছরের যেই সময়টার জন্য সবচেয়ে বেশি অপেক্ষা করে থাকে রাজ্যের প্রজারা এ বছর সেই সময়টাতেই দেখা দিয়েছে রাজার সমস্যা। প্রকৃতপক্ষে রাজার সমস্যা বা ব্যস্ততা যা-ই হোক না কেন সেটা আসলে দেখা দিয়েছে আরো অনেক আগেই। কিন্তু ব্যস্ততার জের ধরে অবশেষে রাজা ফরমান পাঠান, এ বছর সে তুলপাধলার উৎসবে যোগ দিতে পারবেন না। এর পেছনের কারণটাও অজানা ছিল না তুলাপাবাসীর। যদিও তারা নিজেদের গ্রাম ফসল আর এলাকার বাইরের খুব একটা খবর রাখে না তবুও খুব ভাসা-ভাসাভাবে তারা জানত দিল্লির সালতানাতে মোঘল বাদশাদের উত্থান – পতনের ধাক্কা সুদূর দিল্লি থেকে এসে লেগেছে এই ত্রিপুরা পর্যন্ত। আর সেই ধাক্কার জের ধরেই ত্রিপুরার রাজা ঝামেলার কারণে যোগ দিতে পারেনি তাদের বার্ষিক উৎসবে।

রাজার অনুপস্থিতিতে মনে কষ্ট থাকলেও সময় তো আর বসে থাকে না। তাই রাজাবিহীন উৎসবই পালন করতে হয়েছে এবার। তবে উৎসবের সময়টা খারাপ কাটেনি তুলপাবাসীর। কিন্তু উৎসব শেষ হবার পর তারা যখন ভাবছে ফসলের কাজ শুরু হতে তাদের অপেক্ষা করতে হবে আরো দীর্ঘ কয়টা মাস, এমন সময় তাদের তুলপা গ্রামের নিস্তরঙ্গ জীবনে দেখা দেয় নতুন এক উত্তেজনা।

যেদিন ঘটনাটা ঘটেছিল সেদিনটাও পরিষ্কার মনে আছে তুলপাবাসীর। আর দশটা দিনের মতোই সেদিনও খুব স্বাভাবিকভাবে শুরু হয়েছিল তাদের দিন। মহিলারা ঘরকন্না করছিল, শিশুরা খেলছিল, আর পুরুষরা বটতলার আলসে ছায়ায় বসে হুকোর গড়গড়া হাতে নিয়ে নাক-মুখ দিয়ে ধোঁয়া উদ্‌গিরণ করতে করতে গবেষণা করছিল একে অপরের হাঁড়ির খবর নিয়ে। এমন সময় তুলপা এলাকায় প্রবেশ পথের দূরের রাস্তায় ধুলো উড়তে দেখে সবাই সচকিত হয়ে ওঠে। মহিলারা গোল করে পাকাতে থাকা গোবরের কাঁদি থেকে মুখ তুলে ফিরে তাকায় সেদিকে, পুরুষরা উদ্‌গিরণ করতে থাকা ধোঁয়া মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে সরিয়ে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দূরের পথে।

ভৌগোলিক কারণেই তুলপা গ্রামটার অবস্থান এমন যে এলাকায় প্রবেশ করতে হলে লম্বা যে-পথটা পাড়ি দিয়ে আসতে হবে সেটা গ্রামের অবস্থান থেকে অনেক দূর থেকেই চোখে পড়ে। একে তো সেদিন হাটবার নয় তার ওপরে ওই পথে কেউ আসছে মানেই সে বহুদূরের যাত্রী। সবাই উৎসুক হয়ে অচেনা আগন্তুকের আগমনের প্রতীক্ষা করতে করতে একসময় দেখতে পায়, একজন নয় দুজন অচেনা ঘোড়সওয়ার প্রবল বেগে ঘোড়া ছুটিয়ে গ্রামে প্রবেশ করে। গ্রামে প্রবেশ করেই তারা জানতে চায় রাজার বাসভবনের দায়িত্বে কে নিয়োজিত আছে।

সঙ্গে সঙ্গে খোঁজ পড়ে যায় মোহন তরফদারের। মোহন তরফদার হলো তুলপাধলাতে রাজার বিশেষ বাসভবন কাম রাজমহালের দায়িত্বে নিয়োজিত দারোয়ান কাম মালী কাম পরিচ্ছন্নকর্মী কাম রাখওয়ালা। মোহনের পূর্বপুরুষদের মনিপুরে আখচাষের ব্যবসা ছিল। পাহাড়ি ঢালে নদীর ভাঙনে নিজেদের চাষের জমিজমাসহ সব হারিয়ে তার পরিবার ত্রিপুরা রাজ্যে স্থানান্তরিত হয়ে এসেছিল। মোহনের পরদাদার বাপ ত্রিপুরার রাজার বিশেষ সেবক হিসেবে নিয়োজিত থেকে রাজার অনুগ্রহ লাভের পর থেকে তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় তুলপাধলা গ্রামে রাজার বাসভবনের সেবক হিসেবে। সেই থেকে তারা রাজার বিশেষ অনুগ্রহের পাত্র।

তো ঘোড়সওয়ারি আগন্তুক যখন গ্রামে প্রবেশ করে মোহন তখন সকালের জলখাবার সেরে হুঁকোতে তামুক সাজাচ্ছিল। তার খোঁজ পড়তেই তামুক হুঁকো সব ফেলে সে রাজার দূতের কাছে দৌড়ে যায়। এরপর আগন্তুকদের নিয়ে রাজার বাসভবনে সেই যে প্রবেশ করে আর তাদের খবর নেই। রাজার একজন দূত সেদিন বিকেলেই গ্রাম থেকে প্রস্থান করে। কিন্তু গ্রামবাসীরা কিছুতেই জানতে পারে না, হঠাৎ তাদের আগমনের হেতু কী। দূত প্রস্থান করার পরও মোহনের কোনো খবর পাওয়া যায় না। একে তো রাজামশাই এই বছর উৎসবে যোগ দেননি তার ওপরে আবার কথা নেই বার্তা নেই, কোনো আগাম খবর নেই, হঠাৎ গ্রামে রাজার দূতের আগমন, গ্রামবাসীদের নিস্তরঙ্গ জীবনে এর চেয়ে মুখরোচক বিষয় আর কী হতে পারে। চলতে থাকে নানা জল্পনা-কল্পনা।

কিন্তু কোনোটাই ফলপ্রসূ হয় না।

গ্রামবাসীদের মুখে মুখে কল্পনার পাখা চড়তে থাকে। কিন্তু সে-সময় তারা জানত না যে, গল্প তখনো শুরুই হয়নি।

রাজার দুই দূতের একজন বিদায় নিয়েছে যখন তখন তিনদিন পার হয়ে গেছে। এই তিন দিনে রাজার অপর বিশেষ দূতকে নিয়ে মোহন ঘুরে বেড়ায় তুলপাগ্রামের এখানে-ওখানে। অবশেষে সে বাকি দুইদিন কাটাল রাজার বসবাসের বাড়ি মানে রাজমহলা আর গ্রাম থেকে বেশ অনেকটা তফাতে একেবারে ধলার পাহাড় আর নদীর কূলঘেঁষে থাকা চমৎকার নিরিবিলি আর শান্ত এক টুকরো জমি পরিদর্শন করে। বেশ কিছু মাপজোখ করে বেড়াল সে কয়েকদিন। কয়েকদিন জমি পরিদর্শনের পর প্রস্থান করল রাজার দুই দূতের দ্বিতীয়জন।

এর কিছুদিন পরেই হঠাৎ গ্রামের পাশে তেপান্তরের পথে আবারও দেখা দেয় ধুলো। প্রথমে একটা, তারপর দুটো, তারপর বেশ অনেকগুলো। মানে বিরাট কোনো যাত্রীবাহিনী আসছে। উৎসুক গ্রামবাসীদের ভিড় জমে উঠতে সময় লাগে না। কিন্তু তাদের ভিড় ভেদ করে তিরের মতো সামনে এগিয়ে যায় মোহন। সে তার সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে এগিয়ে গিয়ে বরণ করে নিয়ে আসে বিশেষ বাহিনীকে। মোহনের সঙ্গে গ্রামে প্রবেশ করা বিশেষ বাহিনীকে দেখে চোখ কপালে ওঠে গ্রামবাসীর। বাহিনীই বটে তবে কোনো মানুষের বাহিনী নয়; জিনিসপত্রের বিরাট বহর প্রবেশ করে গ্রামের প্রবেশপথ দিয়ে। একে একে আটটা বড়ো বড়ো ঘোড়ায় টানা মালবাহী গাড়ি গ্রামে প্রবেশ করে গিয়ে থামে যেখানে রাজার দূতেরা মাপজোখ করেছে সেই জায়গার কাছাকাছি। প্রায় সারাদিন লেগে যায় তাদের জিনিসপত্র নামিয়ে অস্থায়ী ছাউনি নির্মাণ করে সেগুলোকে জায়গামতো রাখতে। রাতে বিশ্রাম নিয়ে পরদিন গ্রামবাসী জেগে ওঠার আগেই প্রস্থান করে তারা। এরপরের দিন গ্রামে প্রবেশ করে একদল নির্মাণ-শ্রমিক। জোরেসোরে কাজ শুরু হয় সেই জমিতে।

এবার গ্রামবাসীদের মনের কল্পনা শুধু পাখনাই মেলে না, বরং পাখনার সঙ্গে তারা একে একে জুড়ে দিতে থাকে ছোটো ছোটো পাখি থেকে শুরু করে হাতি ঘোড়া, এমনকি ড্রাগন পর্যন্ত। কেউ বলে ওখানে বাঁধ নির্মাণ করা হচ্ছে তুলপা নদীর পানির স্রোত ঠেকানোর জন্য, কেউ বলে ওখানে দুর্গ নির্মাণ করা হবে। কেউ আবার বলে ওখান দিয়ে আসলে পরিখা খোঁড়া হচ্ছে পাশের রাজ্য আক্রমণের জন্য। কিন্তু এত জল্পনা-কল্পনার কেন্দ্রে যে-মানুষটা, যে সব জানে সেই মোহন কিন্তু একেবারে চুপ। পেটে বোমা মেরেও তার মুখ দিয়ে একটা কথাও কেউ বের করতে পারেনি। তাকে প্রশ্ন করলে স্রেফ একটাই জবাব পাওয়া যায়, ‘অপেক্ষা করো সব জানতে পারবে।’ গ্রামবাসীরা প্রথমে অধৈর্য হয়, তারপর অপেক্ষা করে! তারপর আবারও অধৈর্য হয়ে যখন অস্থির হয়ে ওঠার দ্বারপ্রান্তে তখন একদিন গ্রামের মোড়ল গ্রামবাসীদের সবাইকে ডেকে নিয়ে বসে বটতলায়।

আগে বলা হয়নি, তুলপা গ্রামের যে-প্রান্তে রাজমহলা তার বিপরীত দিকে ধলার পাহাড় আর তুলপা নদীসংলগ্ন গ্রামের কৌণিক প্রান্তে একটা বিরাট বট গাছ আছে। সেটা কত পুরনো কেউই জানে না। এই বটগাছের নিচে বসেই তুলপা গ্রামের সমস্ত আয়োজন থেকে শুরু করে পঞ্চায়েতের সমাবেশ পর্যন্ত সব করা হয়ে থাকে। তো গ্রামের মোড়ল গ্রামের সবাইকে ডেকে রীতিমতো ঘোষণার সুরেই জানায় যে, রাজার কাছ থেকে বিশেষ ফরমান এসেছে, তার একজন অতিথি আসছে যে এখন থেকে তুলপাধলা গ্রামেই বসবাস করবে, তার জন্যই ওই জমিতে নির্মাণ করা হচ্ছে এক বিশেষ বাড়ি। এবার গ্রামবাসীদের জল্পনা নতুন পথে মোড় নেয়। শুরু হয় রাজার এই বিশেষ অতিথিকে নিয়ে আলোচনা। কেউ বলে রাজার অতিথি নাকি বিরাট জাদুকর, কেউ বলে বিরাট দরবেশ। এমনকি ধর্মপ্রচারক-বৈদ্য কোনোটাই বাদ যায় না। আবার এমন আলোচনাও চলে যে, রাজার অতিথি আসলে ভয়ংকর কোনো রোগে আক্রান্ত এ-কারণেই এই অখ্যাত গ্রামের এক প্রান্তে এসে বসবাস করতে চাইছে সে।

গ্রামবাসীদের আলোচনা চলতে চলতেই শেষ হয়ে আসতে থাকে পাহাড়ের কোলে নির্মাণাধীন বাড়ির কাজ। বাড়ির কাজ সম্পন্ন হওয়ার পর গ্রামবাসীরা একটু হতাশই হয়। রাজার বিশেষ অতিথির বাড়ি শুনে তারা ভেবেছিল না জানি কী বাড়ি বানানো হবে, কিন্তু বাড়ি নির্মাণ হওয়ার পর দেখা গেল খুবই সাধারণ একটা বাড়ি বানানো হয়েছে। গ্রামবাসীরা যেমন বাড়িতে থাকে হয়তো তার চেয়ে অনেক ভালো, তবে আহামরি কিছুই নয়। বাড়ির কাজ সমাপ্ত হওয়ার কয়েকদিনের ভেতরেই গ্রামে পা রাখে রাজার বিশেষ অতিথি।

এবার গ্রামবাসীদের একেবারে হতাশ হতে হয় না। রাজার অতিথি রাজার মতোই। লম্বা-চওড়া বিরাট আকৃতির সুদর্শন দাড়িওয়ালা মানুষটা গ্রামে পা রাখে, বলতে গেলে একাই। তাকে বহন করেও নিয়ে আসে একটা মাত্র গাড়ি। সঙ্গে কয়েকজন কাজের লোক ছাড়া তেমন কেউ নেই। এমনকি নেই তেমন কোনো পাহারাদার। রাজার অতিথি গ্রামে পা রেখে সরাসরি চলে যায় তার জন্য নির্মাণাধীন বাড়িতে। ওখানেই বসবাস করতে শুরু করে সে।

ধীরে ধীরে গ্রামবাসীদের জল্পনা-কল্পনার মাত্রা কমে আসতে থাকে। কারণ রাজার অতিথি একেবারেই নির্ঝঞ্ঝাট জীবনযাপন করতে থাকে নিজের বাড়িতে। তার কিংবা তার সঙ্গের লোকজনের কোনো উচ্চবাচ্য নেই। গ্রাম থেকেই তার লোকের খাবার সংগ্রহ করে। কিছুদিন পার হয়ে যাওয়ার পরও অতিথিকে নিজের বাড়ি কিংবা এর আশপাশে ছাড়া কেউই বাইরে বের হতে দেখেনি। তবে তার কাজের লোকেরা খাবারসহ প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সংগ্রহ করতে করতে ধীরে ধীরে মিশে যেতে থাকে গ্রামের লোকজনের সঙ্গে। আর অতিথির কাজের লোকদের থেকেই গ্রামবাসীরা অতিথির সত্যিকারের পরিচয় সম্পর্কে জানতে পারে। রাজার অতিথি আসলে একজন দরবেশ যাকে স্থানীয় ভাষায় সন্ত বলা হয়ে থাকে।

গ্রামের লোকজন রাজার অতিথির উপস্থিতি মেনে নিয়েই স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যায়। রাজার অতিথি আর তার লোকেরাও নিজেদের উপস্থিতির তেমন কোনো জানান না দিয়েই নিস্তরঙ্গভাবে জীবন যাপন করতে থাকে। প্রথম কিছুদিন নিজের বাড়ির অভ্যন্তরে কাটালেও রাজার অতিথি ধীরে ধীরে সময়ের সঙ্গে বাড়ি থেকে বের হতে শুরু করে। কখনও খুব ভোরে আবার কখনো সে নিজের মতোই অলস বিকেলে একা একা হেঁটে বেড়ায় ধলার পাহাড়ের পাদদেশে, আবার কখনো তুলপা নদীর তীরে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা নদীর পানির দিকে তাকিয়ে থাকে। কখনো তাকে দেখা যেতে থাকে নদীর তীরে বসে নিজের মতো নানা ধরনের দস্তাবেজ নিয়ে পড়ে থাকতে।

তুলপা নদীর পানির মতো নিস্তরঙ্গ বয়ে যেতে থাকে গ্রামবাসীদের জীবন। রাজার অতিথিকে নিয়ে কিছুদিন সময় ভালোই কেটেছে তাদের। এখন আবার ফসলের কাজ শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত লম্বা সময় কাটানোর অপেক্ষা। এমন সময়

একদিনের ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা আবারও উত্তেজনার সঞ্চার করে তাদের স্বাভাবিক জীবনে। কিন্তু এবারের উত্তেজনার কারণটা বেশ খুশির। হঠাৎই গ্রামের মোড়ল ঘোষণা দিয়ে জানায়, রাজার অতিথি, যাকে তারা এত দিনে সন্ত বলে ডাকতে শুরু করেছে সে নাকি গ্রামবাসীদের সামনে পুথি পাঠ করে শোনাবে। পুথি ব্যাপারটা বাঙ্গাল মুলুকসহ আশপাশের বিভিন্ন এলাকাতে বেশ জনপ্রিয় হলেও ত্রিপুরায় অতটা জনপ্রিয় নয়। তাই মোড়লের ঘোষণা শুনে সবাই বেশ উত্তেজিত হয়ে ওঠে। বহু জল্পনা-কল্পনার পর অবশেষে আসে সেই দিন যেদিন সন্ত তাদের পুথির গল্প শোনাবে। কোনো এক সুন্দর চাঁদনি রাতে সন্ধের খাওয়া শেষ করে মোড়লের নির্দেশনা অনুযায়ী গ্রামবাসীরা একত্রিত হয় তুলপা নদীর তীরের সেই বটতলায়।

গ্রামবাসীরা একত্রিত হওয়ার কিছুক্ষণ পরেই রাজার অতিথি নিজের একান্ত কাছের দুজন মানুষকে নিয়ে হাজির হয় বটতলায়। এই প্রথমবারের মতো গ্রামবাসীরা সন্তকে সামনাসামনি দেখতে পায়। মানুষটার চেহারা অবশ্য দেখার মতো। বেশ লম্বা-চওড়া মানুষ, ফরসা গায়ের রং। মুখে লম্বা দাড়ি আর মাথার লম্বা কোঁকড়ানো চুল ঝুঁটি করে পেছনে বাঁধা। মাথায় আরব দেশীয়দের মতো কালো টুপি। বটতলায় পৌছে সে খুব একটা ভণিতা না করে বসে যায় স্বীয় পুথির দস্তাবেজ সাজিয়ে। সবার অনুমতি নিয়ে সুললিত কণ্ঠে পড়তে শুরু করে সে।

প্রায় ঘণ্টাখানেকের মতো সময় একটানা সে পড়ে যেতে থাকে এক দুর্ধর্ষ যোদ্ধার কাহিনি। আফগান আর চৈনিক বংশোদ্ভূত সাহসী যোদ্ধা কীভাবে উত্তর থেকে এসে নিজের বাহিনী নিয়ে দখল করে নিতে থাকে একের পর এক রাজ্য সেই গল্প। যোদ্ধার সাহসিকতা, হিংস্রতার মোড়কের ভেতরে তার সংবেদনশীল দুঃখী জীবনসহ সবই উঠে আসতে থাকে সন্তের গল্পে। মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনে যেতে থাকে গ্রামবাসীরা। সন্ত যেদিন গল্প পড়তে শুরু করে সেদিনই গ্রামবাসীরা অনুধাবন করতে পারল তাদের জীবনে বড়ো একটা পরিবর্তন সূচিত হতে চলেছে। কিছু একটা যেন বদলে যেতে বসেছে। সামনে তারই আভাস যেন তারা দেখতে পায় সেদিন।

আর বাস্তবেও যেন তেমনটাই ঘটে। পরবর্তী কয়েক মাসে তারা প্রথমে উপভোগ করতে থাকে সন্তের গল্প, তারপর আচ্ছন্ন হতে শুরু করে তার গল্পের আবহে। তারপর ধীরে ধীরে নেশার মতো আক্রান্ত হয়ে যায় সন্তের গল্পর মোহে। সপ্তাহের নির্দিষ্ট একটি দিন সন্ত সেই বটতলায় বসে নিজের সুললিত কণ্ঠে পড়ে যেতে থাকে অসাধারণ সব গল্প। ঠান্ডা থাক, গরম থাক, ঝড় থাক আর বাদল থাক-নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট সময়ে গ্রামবাসীরা সবাই উপস্থিত হয়ে যায় গল্প শোনার জন্য।

সন্তের গল্প বলার ধরন থেকে শুরু করে তার গল্পের বিষয়বস্তুতেও যেন রকম ফেরের কোনো অভাব নেই। যদিও তার প্রায় সব গল্পই আবর্তিত হতে থাকে রাজা, রাজপরিবার আর রাজ্যের বড়ো বড়ো বিষয় নিয়ে। ব্যতিক্রম কেবল সেখানে নয়। ব্যতিক্রম তার গল্পের বিষয়বস্তুতে। কখনো তার গল্পের বিষয়বস্তু যুদ্ধ, কখনও তার গল্প একজন ক্ষমতাবান পিতার অসহায়ত্বের, যে-পিতা নিজের সন্তানকে সুস্থ করে তুলতে নিজের জীবন বিসর্জন দিতে প্রস্তুত। আবার কখনো তার গল্পের বিষয়বস্তু পাগলাটে এক সম্রাট যে কিনা সব হারিয়েও আবার ঘুরে দাঁড়িয়ে সব হাসিল করতে সমর্থ হয় কিন্তু পরাজিত হয় পাঠাগারের সিঁড়ির কাছে। এমন ধারায় একের পর এক বলে যেতে থাকে সব রাজরাজা আর তাদের জীবনের অদেখা সব কাহিনি।

তুলপাধলার মানুষেরা অত্যন্ত সাধারণ মানুষ। এসব মানুষ দুনিয়ার কোনো খবর রাখে না। দুনিয়ার খবর রাখার চাইতে নিজেদের ফসলের খবর রাখতেই তারা বেশি পছন্দ করে কিন্তু এই সন্তের গল্প যেন তাদের জীবনে ভিন্ন এক মাত্ৰা নিয়ে এসেছে। নিয়ে এসেছে ভিন্ন এক আনন্দ, যে আনন্দের খোঁজ তারা এর আগে কখনো পায়নি। রাজা আর রাজ্য বলতে তাদের চিন্তাভাবনা সীমাবদ্ধ ছিল একটি নির্দিষ্ট গণ্ডিতে। রাজা বলতে তারা আজ অবধি দেখে এসেছে শুধু ত্রিপুরার রাজাকে।

সন্তের গল্পের মাধ্যমে তাদের সামনে খুলে গেছে এমন এক ভুবন যে ভুবনে প্রতিফলিত হতে দেখছে একেবারেই ভিন্ন এক রাজা-রানি আর তাদের রাজকীয় জীবন। যে-জীবনেও সাধারণ দশজন মানুষের মতোই সমস্যা আছে। তাদেরও রয়েছে হাসি আনন্দ, দুঃখ-বেদনা আর আর দশজন পিতা-মাতা কিংবা সন্তানের মতোই আহাজারি। পার্থক্য শুধু, তাদের এসব কিছুই মোড়ানো থাকে রাজকীয় আদলে। রাজপরিবারের মানুষরাও যে আর দশজন মানুষের মতোই—এটা কখনো তুলপাবাসীরা ভেবেও দেখেনি। আর এ কারণেই তারা আরো বেশি করে ভালোবেসে ফেলতে থাকে সন্ত আর তার গল্পগুলোকে।

শুরু থেকেই তারা সন্তের গল্প বিমুগ্ধ হয়ে শুনে আসছে। কিন্তু গত কয়েকদিন ধরে সে যে গল্প বলে চলছে সেটা যেন গ্রামের মানুষের মনের ভেতরে এক ভিন্ন মাত্রায় প্রবাহিত হয়ে চলেছে। এটাও এক রাজার গল্প। তবে আগেরগুলোর মতো যেন নয়। এ যেন ভিন্ন এক যুবরাজের গল্প। যে যুবরাজ নিজের রাজ্য না পেয়ে জীবন উৎসর্গ করেছে দূরের এক রাজ্যের মানুষদের জন্য। আর এ কারণে যুবরাজের প্রজা না হয়েও প্রজার চেয়ে বেশি ভালোবেসে ফেলেছে তারা যুবরাজকে। যুবরাজের জীবন ভালোই কাটছিল। সব সুখ আর শান্তি তো আর চিরস্থায়ী নয় তাই এই যুবরাজের জীবনেও ঘটনার প্রবাহ নিয়ে এলো সম্পূর্ণ ভিন্ন এক মোড়, যে মোড় বদলে দিল তাকে। আর এই বদলে যাওয়াই সর্বনাশের সূচনা করল তার জীবনে।

হঠাৎই রাজ্যের রাজা মানে যুবরাজের পিতা অসুস্থ হয়ে পড়ে। নিজের বাকি ভাইদের মতো সেও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। তবে নিজের বাবার সুস্থতা নিয়ে নয় বরং কীভাবে রাজ্য দখল করবে সেই চিন্তায়। সুস্থ-স্বাভাবিক প্রজা অন্তঃপ্রাণ একজন মানুষ ক্ষমতার লোভে পরিণত হয় এক ক্ষমতালোভী পিশাচে। আর এখানেই ঘটে তার জীবনের সবচেয়ে বড়ো অধঃপতন। আর এই অধঃপতনের মূল্যই তাকে চুকাতে হয়। প্রজাঅন্তঃপ্রাণ যুবরাজ রাজ্য আর রাজ্যের প্রজাদের কথা ভুলে গিয়ে ক্ষমতা দখলের জন্য লড়াইয়ে লিপ্ত হয় ভাইদের সঙ্গে। তারপর একে একে সব যুদ্ধে পরাজিত হতে শুরু করে সে। পরাজিত হতে হতে এমন অবস্থা দেখা দেয় যে, তাকে পরিবার-পরিজন নিয়ে বাধ্য হয়ে আশ্রয় নিতে হয় ভিন্ন এক রাজার দেশে।

এমনিতেই সন্তের গল্প গ্রামবাসীদের কাছে নেশার মতো। তার ওপরে সন্ত এমন দরদ দিয়ে যুবরাজের গল্প বর্ণনা করেছিল যে, পরাজিত যুবরাজের পলায়নের কথা গ্রামবাসীরা তন্ময় হয়ে শুনছিল। কিন্তু গল্পের এই পর্যায়ে এসে হঠাৎ থেমে গেল সে। চোখ তুলে তাকাল গ্রামবাসীদের দিকে।

সবাই উদগ্রীব হয়ে রইল, পরাজিত রাজার কী হলো সেটা জানতে কিন্তু কেউ কোনো প্রশ্ন করল না। বরং সবাই নিশ্চুপ হয়ে তাকিয়ে রইল সন্তের দিকে। শীতের রাতে বটগাছের নিচে জ্বালানো হয়েছে বিরাট অগ্নিকুণ্ড। সেই আগুনের লালচে আলোয় গ্রামবাসীরা দেখল তাদের সন্তু গল্প বলতে বলতে এতটাই ডুবে গেছে গল্পের ভেতরে যে তারও চোখের পানি গড়িয়ে পড়ছে গাল বেয়ে। ভেজা চোখেই সুললিত কণ্ঠে আবারও সে বলতে শুরু করল পরাজিত যুবরাজ মানে রাজার গল্প।

কিন্তু এবার আর পুথিতে চোখ নেই তার। দৃষ্টি চলে গেছে বিরাট অগ্নিকুণ্ডের দিকে। আগুনের আলোয় যেন গল্পের মতোই প্রজ্জ্বলিত হয়ে উঠেছে তার চোখজোড়া।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *