মগরাজ – শেষ কথা

শেষ কথা

তুলপাধলা গ্রামে রাত গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে।

গল্পকারের গল্প বলা শেষ হতেই একে একে সরে পড়তে শুরু করল গ্রামবাসীরা। গল্পকার স্থাণুর মতোই বসে রইল তার জায়গায়। একে একে সবাই চলে গেলেও তার খাস ভৃত্যরা রয়ে গেছে তার পাশেই। গল্পকারকে নীরবে বসে থাকতে দেখে একে একে পরস্পরের দিকে চোখাচোখি করল তারা। কিন্তু তারা তো আর জানে না গল্পকার আজ গল্প বলতে বলতে গল্পের অনেক গভীরে চলে গেছিল। এতটাই গভীরে যে তার স্মৃতির অতল গহ্বরে লুকিয়ে থাকা গোপন অন্তরালে এতটাই নাড়া পড়ে গেছে যে, সে ভেতরে ভেতরে অত্যন্ত বিচলিত বোধ করতে শুরু করেছে।

‘হুজুর, ঘরে যাবেন না?’ আরো অনেকক্ষণ পর আর থাকতে না পেরে গল্পকারের ভৃত্যদের একজন মৃদু স্বরে জানতে চাইল। ভৃত্যের বয়ানে যেন হুঁশ ফিরে এলো গল্পকারের। একহাতে নিজের ভেজা চোখ মুছে সে ফিরে তাকাল ওদের দিকে। তারপর যেন হঠাৎ করেই ঘুম থেকে উঠেছে এমনভাবে বলে উঠল, ‘চলো, চলো। রাত গভীর হতে চলেছে।’

নিজের লোকদের নিয়ে বাড়িতে ফিরে এসে রাতের আহার সেরে গল্পকার বেরিয়ে এলো বাড়ির পেছনের আঙিনায়। এখান থেকে তুলপা নদী আর ধলার পাহাড়ের একাংশ চোখে পড়ে। সেই পাহাড় আর নদীর সঙ্গমস্থলে চাঁদের আলো পড়ে অপার্থিব সুন্দর এক দৃশ্যের অবতারণা হয়েছে। সেদিকে তাকিয়ে অস্থির মনটা খানিকটা শান্ত হয়ে এলো গল্পকারের।

‘জীবনের প্রকৃত অর্থ আসলে কী, প্রিয় বন্ধু?’ পেছন থেকে ভেসে আসা গলাটা শুনে গল্পকারের চমকে ওঠা উচিত ছিল। উচিত ছিল আবেগে আক্রান্ত হওয়া। উচিত ছিল অতীত স্মৃতির এক সমুদ্রে অবগাহন করা, কিন্তু কোনোটাই হলো না তার ভেতরে। কারণ সে জানত একদিন না একদিন এই কণ্ঠটা সে শুনতে পাবে, তার বেঁচে থাকার পেছনে এটাও একটা বড়ো কারণ ছিল। খুব সাবধানে সে পেছন ফিরে তাকাল। অন্ধকারের ভেতর থেকে চাঁদের আলোতে বেরিয়ে এলো আদি ও অকৃত্রিম তালেব তৈমূর।

শ্লথ পদক্ষেপ আর অশ্রুসিক্ত চোখে পৃথিবীতে বেঁচে থাকা নিজের শেষ বন্ধুটির দিকে এগিয়ে গেল গল্পকার। দুই আবেগ আক্রান্ত বন্ধুর ভেজা দৃষ্টি এক সঙ্গে হলো। দুজনেই বহুকিছু হারিয়ে আজ একসঙ্গে হয়েছে এই তুলপাধলাতে, রাত্রির দ্বিপ্রহরের চাঁদের আলোতে। তালেব তৈমূরের কাছে যেতেই তার কাঁধ থেকে অবশ হয়ে ঝুলতে থাকা ডান হাতটা দেখতে পেল গল্পকার। সেদিন সিলভেরাকে নিয়ে পাহাড় থেকে লাফিয়ে পড়ার সময়ে আঘাতের চোটে স্থায়ীভাবে অকেজো হয়ে গেছে হাতটা। সেটাকে আলতো করে ধরল গল্পকার।

আর গল্পকারের চোখের দিকে তাকিয়ে ভেজা চোখেই মৃদু হেসে নিজের মাথাটাকে সামান্য ঝুঁকিয়ে অক্ষত বাম হাতে সালাম করার ভঙ্গিতে কপালে ঠেকিয়ে সে বলে উঠল, ‘জাঁহাপনা শাহ সুজা, সালাম আপনাকে।’

তালেব তৈমূরের হাতটাকে এক ঝাপটায় সরিয়ে দিয়ে তাকে নিজের বুকের সঙ্গে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল প্রয়াত-পরাজিত-নির্বাসিত স্বঘোষিত সম্রাট, বাংলার প্রাক্তন সুবাদার ও বর্তমান গল্পকার শাহ সুজা। ‘প্রিয় বন্ধু, আমি জানতাম একদিন তুমি আসবেই,’ বলে বুকের সঙ্গে চেপে ধরেই রাখল ধরেই রাখল।

আবেগের স্রোতটা খানিকটা থিতু হতেই দুজনের আলাপচারিতা জমে উঠল ম্রোহঙের জঙ্গল থেকে সেদিন শাহ সুজা শুধু নিজে পালায়নি। সে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল সম্রাট শাহ সুজাকে। প্রথম যে ছোটো জাহাজটা চট্টগ্রামে পৌঁছায় সেটাতে তার সঙ্গেই ছিল শাহ সুজা। শাহ সুজাকে প্রথমে চট্টগ্রামে লুকিয়ে রাখা হয়। তারপর তাদের বন্ধুসম ত্রিপুরার রাজার সহায়তায় পাঠিয়ে দেওয়া হয় ত্রিপুরার অখ্যাত গ্রাম তুলপা ধলাতে। যদিও ম্রোহঙের জঙ্গলে সম্রাটের আংটি তার ছেলের হাতে পরিয়ে দিয়ে এসেছিল ওরা। যেটার খণ্ড-বিখণ্ড লাশ দেখে সবাই ভেবেছে মারা গেছেন সম্রাট। কিন্তু তালেব তৈমূর জানত শাহ সুজাকে বেশিদিন এভাবে লুকিয়ে রাখা যাবে না। একটা সময় এই খবর ছড়াতে শুরু করবে, যদি না সবার দৃষ্টি অন্যদিকে ফেরানো যায়। এই সময়ে তার মাথায় আসে এমন এক পরিকল্পনা যাতে সবদিক সামলানো সম্ভব।

আকরাম বেগ আর চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মিলে ওরা পরিকল্পনা সাজায় একটা দল গঠন করার যেটা প্রথম বড়ো জাহাজের পিছু নেওয়া আরাকান আর সিলভেরার বাহিনীকে বিনাশ করবে। পুরো পরিকল্পনাটাকে এমন একটা রূপ দেয়া হয় যাতে মনে হয় আরকান থেকে শাহ সুজার সম্পদ নিয়ে পালিয়েছে একটা জাহাজ, যেটার দায়িত্বে আছে তালেব তৈমূর। এই খবর রটিয়ে দেয়ার পর তার পিছু নেয় আরকানি আর সিলভেরার বাহিনী। আর তাদের নিকেশ করতে গঠন করা হয় কিরানের বাহিনী।

তালেব তৈমূর আর আকরাম বেগরা মিলে ভুয়া খবর ছড়িয়ে কিরানের এই বাহিনী গঠনের মূল উদ্দেশ্য ছিল দক্ষিনের সমুদ্রে এমন এক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা যাতে, শাহ সুজার বেঁচে থাকার সম্ভাবনা নিয়ে কেউ ভাবারও সুযোগ না পায়। সেই সঙ্গে চট্টগ্রামে লুকিয়ে রাখা সম্রাটকে সবার দৃষ্টির অন্তরালে সহজেই পাঠিয়ে ত্রিপুরার তুলপাধলাতে সরিয়ে যায়।

‘শুধু আমাকে বাঁচানোর জন্য এগুলো প্রাণের বলিদান দেয়ার কী কোনো প্রয়োজন ছিল?’ শাহ সুজা অনেকটা আবেগের বশেই জানতে চাইল।

তালেব তৈমূর উঠে দাঁড়িয়ে জলধারার দিকে এগিয়ে গেল খানিকটা। ‘আমি বাঙাল মুলুকের মানুষ। ওখানেই জন্ম ওখানেই বেড়ে ওঠা। আমার সুজলা সুফলা সবুজে ঘেরা মাতৃভূমিকে কেউই কখনো ভালোবাসেনি, বেনিয়ার মতো শুধু ব্যবহার করেছে। সেই মাতৃভূমিকে কেউ যদি ভালোবেসে সত্যিকার অর্থে মানুষের জন্য কিছু করে থাকে সেটা একমাত্র তুমি, শাহ সুজা। তাই বন্ধু হিসেবে তোমাকে বাঁচানোটা আমার কর্তব্য ছিল। আর তাছাড়া আমাদের জন্য এটা একটা সুযোগ ছিল, দক্ষিণ সমুদ্রকে সিলভেরার কবল থেকে খানিকটা হলেও রক্ষা করার, সেই সঙ্গে আরাকানিদের একটা শিক্ষা দেয়ার। সব চেয়ে বড়ো কথা চট্টগ্রামকে আরাকানিদের হাত থেকে উদ্ধার করার পথে একধাপ এগিয়ে গেল সবাই। আমার পরিকল্পনায় কোনো খুঁত ছিল না বন্ধু। কিছু জায়গায় ভুল হয়েছে, উলটো-পালটা হয়েছে, জংলাটিলায় সিলভেরার ফাঁদটা আমি বুঝতে পারিনি। এরকম ছোটোখাটো আরো কিছু ভুল হয়েছে। কিন্তু বেলা শেষে যা করতে চেয়েছিলাম, তা হয়েছে।’

‘এমনকি তোমার ছেলে কিরান…’

‘এটা ওর জন্যই দরকার ছিল। যে পথে সে হাঁটছিল তাতে ধ্বংস তার অনিবার্য ছিল। এই ঘটনার ফলে সে ঋণমুক্ত হয়েছে, সেই সঙ্গে নিজেকে আবারো পুরনো রূপে ফিরে পেয়েছে। নিজেকে সে নিজে রক্ষা করতে পেরেছে, তারচেয়ে বড়ো কথা…’ বলে সে ফিরে এলো শাহ সুজার কাছে। ‘সবাই জানে মোঘলদের বিরাট সম্পদ ছিল তোমার কাছে। কিন্তু যে রাজদ্রোহীর রহস্য আমরা বাংলার মাটির গভীরে পুঁতে রেখেছি তাতে সম্পদের চেয়েও যে অনেক বড়ো শক্তি লুকিয়ে আছে সেটা তো কেউ জানে না। এ এমন এক শক্তি, এমন এক অস্ত্র…’ বলে দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়ল তালেব তৈমূর। ‘আমি আশা করি কিরান আর ওর লোকেরা রাজদ্রোহীর এই রহস্য হয় লুকিয়ে রাখতে পারবে পরবর্তী প্রজন্মের জন্যে আর না হয় সঠিক লোকের হাতে তুলে দিতে পারবে। আমি শুধু আশা করতে পারি।’

আবার দীর্ঘ-নিশ্বাস ছেড়ে সে যোগ করল, ‘যাক গে, দিল্লি থেকে শায়েস্তা খাঁ আসছে, বড়ো শক্ত লোক। আমার বিশ্বাস, সেই একমাত্র ঢাকাকে ঠিক করতে পারবে, পারবে দক্ষিণের সমুদ্রকে দস্যুমুক্ত করতে,’ এটুক বলে সে থেমে যোগ করল। ‘তবে আমি আর এসবে নেই। বাকি জীবন আমি শান্তিতে কাটাতে চাই।’

সম্রাট সুজা এক দীর্ঘ-নিশ্বাস ছাড়ল। ‘আমার আর কিছুতেই কোনো আগ্রহ নেই বন্ধু। আমার পরিবারকে আমি বাঁচাতে পারিনি। নিজের ছেলে আর মেয়েটাকে পর্যন্ত…’ এটুকু বলতেই গলা বুজে এলো তার।

তালেব তৈমূর ফিরে এসে দুই হাত ধরে ফেলল তার বন্ধুর। ‘একটু আগে আমি জানতে চাইছিলাম না, জীবনের মানে কী? জীবনের মানে কী জানো বন্ধু জীবনের মানে শুধুই বেঁচে থাকা নয়। জীবনের মানে রাজা-রানি-সাম্রাজ্যের মতো বড়ো বড়ো ব্যাপারগুলো সামলানো নয়। জীবনের মানে মানুষের মাঝে গল্প বলে সাধারণ মানুষকে বিনোদন দিতে পারা, জীবনের মানে এই তুলপাধলার রাতের দ্বিপ্রহরে দুই বন্ধু মিলে গল্পে মেতে ওঠা। এগুলোই জীবনের মানে বন্ধু। জীবনের ছোটো ছোটো ব্যাপারগুলোই জীবনের প্রকৃত মানে বহন করে। জীবন মানেই সব হারিয়ে আবার নতুন করে বাঁচতে শেখা।’

তালেব তৈমূর এটুকু বলতেই সম্রাট সুজা ভেজা চোখেই হেসে উঠল। দুই বন্ধু একে অপরকে অশ্রুভেজা চোখে জড়িয়ে ধরে হাসতে থাকল। তাদের মাথার ওপরে চাঁদ উঠেছে মাঝ আকাশে।

রাত নেমে আসছে তুলপাধলা গ্রামের বুকে।

হাজার নয়, লক্ষ বছরের পুরনো রাত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *