মগরাজ – ২৮

অধ্যায় আটাশ – সময়: ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দ

সন্দ্বীপ, চট্টগ্রাম

বিকেলের সূর্যের লালিমা দিগন্তরেখার কাছে হারিয়ে গেছে অনেক আগেই। সন্ধের রূপরেখা সবেমাত্র দিগন্তের লালিমাকে বাড়িয়ে বাড়িয়ে রাতের প্রথম প্রহরের দিকে এগোতে শুরু করেছে। এরই মধ্যে তিনটে কোষা নৌকা নীরবে এগিয়ে চলেছে চলেছে সন্দ্বীপের দক্ষিণপূর্ব প্রান্তের দিকে।

দক্ষিণ উপকূলীয় এলাকার সবচেয়ে বড়ো দ্বীপ, সন্দ্বীপ। সবচেয়ে বড়ো লবণ চাষ ও ব্যবসার ক্ষেত্র, সবচেয়ে বড়ো জাহাজ মেরামতির কারখানা থেকে শুরু করে এর পরিচয়ের কোনো শেষ নেই। তবে সব ছাপিয়ে এখন সন্দ্বীপের সবচেয়ে বড়ো পরিচয় একেবারে পোর্ট গ্রান্ডে থেকে শুরু করে উত্তর-দক্ষিণ সব দিক তো বটেই মগ, আরাকান পর্তুগিজ থেকে শুরু করে দেশীয় সব জলদস্যুর সবচেয়ে বড়ো আখড়া এই সন্দ্বীপ। শ্রীপুরের রাজা কেদাররায়ের হাত ধরে ব্যবসায়িক কেন্দ্ৰ হিসেবে যে দ্বীপের প্রতিষ্ঠা, তারপর কার্ভালহো থেকে শুরু করে সিবাস্টিয়ান গঞ্জালেস টিবাওয়ের শাসন সন্দ্বীপকে করে তুলেছে দক্ষিণ উপকূলের জলদস্যুদের সবচেয়ে বড়ো মিলনকেন্দ্র। দক্ষিণের সমুদ্রে জলদস্যুদের স্বর্গ।

সন্দ্বীপে পাওয়া যায় না এমন কিছু নেই। দ্বীপের পশ্চিম তীরে রয়েছে জাহাজ নোঙর করার ব্যবস্থা আর সেখান থেকে কাছেই জাহাজ নির্মাণ থেকে শুরু করে জাহাজ মেরামতির ব্যবস্থা। বিশেষ করে দীর্ঘদিন সমুদ্রে থাকার পর জীর্ণশীর্ণ জাহাজ ঠিক করার ব্যবস্থা যেমন আছে, ঠিক তেমনি দীর্ঘ দিন পানির ওপরে থেকে জাহাজে থাকা মানুষগুলোর শরীর আর মন দুটো ঠিক করা পর্যন্ত সবই চলে এই দ্বীপে। জোগাড়যন্ত্র, বিনোদন থেকে শুরু করে থাকা-খাওয়া তো বটেই এই দ্বীপে সবচেয়ে বেশি চলে যেটা সেটা হলো খবর।

দিল্লি থেকে শুরু করে জাভার সমুদ্র পর্যন্ত। পোর্ট গ্রান্ডে থেকে শুরু করে হুগলীর বাজার পর্যন্ত, কে কোথায় কখন কী করছে। কে কোন সমুদ্রে কয়টা জাহাজ লুট করল। কে কোন গ্রামে হানা দিল। মসলিনের কারবারিরা চট্টগ্রামে কী করছে, রোসাঙ্গের বাজারের হাল-হকিকত, হুগলীর শ্যামদাশের ঘোড়া, আর বোম্বাইয়ের শাসকেরা কী ঘটাচ্ছে, সবই জানতে পারা যায় এই সন্দ্বীপে। এখানে সবাই আসে- যায়, ব্যবসা করে, জীবন উপভোগ করে খবর জানে, তারপর নিজের পথে পা বাড়ায়। এই হলো সন্দ্বীপের জীবন। আর তাই দক্ষিণের সমুদ্রের সবচেয়ে বড়ো ঘটনার খবর জানার জন্য কিরানদের এখানে আসতে হবে, এ তো জানা কথা।

কিরান জানত আগে হোক কিংবা পরে সন্দ্বীপে ওকে আসতেই হতো। আর এ-জন্যই সে সন্দ্বীপে পৌঁছানোর জন্য নিয়মিত পানির পথ মানে ঘাট ব্যবহার না করে দ্বীপে পৌঁছানোর জন্য বেছে নিয়েছে দক্ষিণ পূর্ব দিক। এতে করে হয়তো মোহনা থেকে সমুদ্রপথে দ্বীপে পৌঁছানোর জন্য ভাটার স্রোতের মোকাবেলা করতে হবে। কিন্তু নির্বিঘ্নে পৌঁছানোর জন্য এর চেয়ে বেশি সুবিধা সে আর কোথাও পেত না। আর স্রোতের ব্যাপারটা সে তেমন আমলে নিচ্ছে না। এর পেছনে একটা বড়ো কারণ হলো তার সঙ্গে নিয়ে আসা কোষা নৌকোগুলো অত্যন্ত মজবুত আর ওর দাঁড়িরাও দক্ষ।

অন্ধকারের ভেতরে তাকিয়ে কিরান দেখতে পেল ওদের তিনটে কোষা নৌকা স্রোতের উলটো বেগ ঠেলে বেশ তরতরিয়েই এগিয়ে চলেছে দ্বীপের দিকে। সমুদ্রের বুক থেকে অতিকায় কোনো জন্তুর মতো দ্বীপটা মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। ওদের নৌকাগুলো দ্বীপের কাছাকাছি হাঁটু পানিতে পৌঁছাতেই কিরান লাফিয়ে নেমে এলো। কিরান লাফিয়ে নামতেই একে একে সবাই নেমে পড়ল নৌকো থেকে। বালিময় তীরভূমিতে নৌকাগুলো টেনে নিয়ে এলো বেশ খানিকটা ওপরে। পানির ধারা থেকে সরে এসে প্রথমেই কিরান দাঁড়িদেরকে নিদের্শ দিল নৌকাগুলোকে সাবধানে পাহারা দিয়ে রাখতে। সেই সঙ্গে যেকোনো সময়ে দ্রুত পানিতে ভাসানোর মতো প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে। দাঁড়িদের নির্দেশনা দেওয়া শেষ হতেই সে ফিরে তাকাল নিজের লোকেদের দিকে।

প্রতিদলে চার-পাঁচজন করে তিনটা দলে ভাগ হয়ে ওরা এগোবে সামনের দিকে। প্রথম দলনেতা হিসেবে আছে গোলন্দাজ। কালো পোশাকে তাকে দেখাচ্ছে অনেকটা ব্যবসায়ীদের মতো। পোশাকের নিচেই খাটো তলোয়ার আর পিঠে বন্দুক প্রস্তুত আছে। পিঠের লম্বা বন্দুকটাকে চাদর দিয়ে এমনভাবে মাথাসহ মুড়িয়েছে সে, দেখে ওটার অস্তিত্ব বোঝার উপায় নেই। অনেক দিন পরে গোলন্দাজকে তার স্বরূপে দেখে ভালো লাগল কিরানের। নিজের গ্রাম আর পারিবারিক ব্যবসা হারিয়ে মানুষটা অনেকটাই ভেঙে পড়েছিল। প্রথম দলে গোলন্দাজের সঙ্গে আছে বৈঠা আর বিল্লাল। সেই সঙ্গে একজন লাঠিয়াল। দ্বিতীয় দলে আছে লাঠিয়ালদের সর্দার তুলারাম। তার সঙ্গে আছে বেদু। আর তৃতীয় দলে আছে কিরান নিজে। ওর সঙ্গে থাকবে গোমেজ আর দুজন লাঠিয়াল।

নিজের লোকেদের দিকে তাকিয়ে কিরান জানতে চাইল, ‘সবার নিজ নিজ গন্তব্য মনে আছে তো?’ সবাই মাথা নাড়তেই সে আবারও বলে উঠল, ‘তারপরেও আমি আরেকবার বইলা দিই। ‘প্রথম দলের গোলন্দাজ তুমি যাবা বিল্লালের ওস্তাদের কাছে। হের কাছ থেইকা কথা বাইর করতে হবে,’ কথাটা বলে সে গোলন্দাজের দিকে তাকিয়ে চোখে বিশেষ একটা ইশারা করল। এটা বিল্লাল কিংবা বৈঠা দেখতে পেল না। এই ইশারাটা করার পেছনে কারণ হলো বিল্লালের ওস্তাদ খুব একটা সুবিধের লোক না। যে লোক সন্দ্বীপের মতো দ্বীপে খবর বেচাকেনা করে তার সুবিধার হওয়ার কোনো কারণও নেই। কাজেই তার ব্যাপারে সাবধান হওয়ার জন্যই এই ইশারা।

‘এরপরে তুলারাম, তুমি,’ বলে বেদু আর তুলারামের দিকে তাকাল। ‘তোমরা যাবা বাজার এলাকার দিকে। আমি নিশ্চিত শুঁড়িখানা, চণ্ডখানা আর বাজারে ঘুরলে কিছু না কিছু কানে আসবই। আর সবশেষে আমি যাব আকরাম চাচার খবরির লগে দেহা করতে। সবাই বুঝছো?’ তার প্রশ্নের জবাবে সবাই মাথা নাড়তেই কিরান বলে উঠল, ‘সবাই সাবধানে থাকবা। মনে রাখবা, আমরা এইহানে আইছি ব্যবসায়ী আড়তদার আর জাহাজির ছদ্মবেশে। এইখানে এইরহম লোকের আনগোনাই সবচেয়ে বেশি। কাজেই আমগো যে খুব বেশি ভয় আছে তা না। তারপরেও সবাই সাবধান। সবাই অস্ত্র প্রস্তুত রাখবা, বিপদের লাইগা। কিন্তু ভুলেও বাইর করবা না। অস্ত্র যেমন সহজে বাইর করবা না, কাউরে আঘাত করবা না, আবার একবার কাউরে আঘাত করলে সেইটা এমনভাবে করবা যেন দ্বিতীয় আঘাত আর করতে না অয়। মনে থাকব?’

সবাই সমস্বরে নিচু স্বরে সম্মতি জানাল।

‘আর যদি কুনো বিপদ অয়। তয় ভুলেও নিজের কাউরে পিছে ফালায় আসবা না। প্রয়োজনে জীবন দিবা কিন্তু সঙ্গী ফালায়া আসা চলবে না। আমরা আগামী দুই থেইকা তিন ঘণ্টার ভেতরে আবার সবাই এইখানে ফেরতে আসব। চলো কামে নামি,’ বলে কিরান নিজের লোকদের উদ্দেশ্যে হাঁক ছেড়ে বালিময় সৈকত ধরে হাঁটতে শুরু করল মূল দ্বীপের দিকে।

জনসমাগম এলাকার কাছাকাছি এসে তিনটে দলে ভাগ হয়ে তিনদিকে রওনা দিল ওরা। গোমেজ আর লাঠিয়াল দুজনকে নিয়ে পায়ে হাঁটা সরু রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে বাজার এলাকার ভেতরের দিকে প্রবেশ করল ওরা। ‘গোমেজ,’ কিরান গোমেজের দিকে তাকিয়ে কোমরবন্ধনী থেকে আকরাম বেগের দেওয়া থলেটা বের করে মুঠোর ভেতরে নিয়ে নিল। আকরাম বেগ শক্ত নিদের্শনা দিয়ে বলে দিয়েছে সন্দ্বীপে পৌছানোর আগে যেন কিরান থলেটা না খোলে। সেই সঙ্গে এও নির্দেশনা ছিল এটা খোলার আগে ওকে আড়ত এলাকার একটা নির্দিষ্ট জায়গায় পৌছে সেখানে সফরউদ্দিন নামে একজনকে খুঁজে বের করতে হবে। নিজের সঙ্গে আসা দুই লাঠিয়ালকে সাবধান থাকতে বলে গোমেজকে ইশারা করল ও। ওরা বাজার এলাকায় ঢুকতে যাচ্ছে এখান থেকে বাজারের দিকে না গিয়ে ওরা যাবে আড়ত মানে মজুতদারির এলাকার দিকে। সেখানে গিয়ে নির্দিষ্ট মানুষটাকে বের করতে হবে।

‘গোমেজ সাবধান, মনুষ্য এলাকায় ঢুকবার যাইতাছি আমরা,’ বলে হাত দিয়ে পোশাকের আড়ালে থাকা গোমেজের মোটা গদাটাকে আরো ভালোভাবে আড়াল করে দিল কিরান। তারপর দুই লাঠিয়ালের দিকে ফিরে বলে উঠল, ‘তুমি ভিখু আর তুমি মধু তাই না?’ কালো চাপদাড়ি ভিখু আর মোটা গোঁফ মধুকে সম্বোধন করে বলে উঠল কিরান। ‘শোন, তোমরা নিজেগো লাঠি সামলাই রাইখো। আর মনে রাইখো, এহানে আমরা জাভা থাইক্কা আসা ব্যবসায়ী। আর তোমরা আমার দেহরক্ষী। মনে থাকব?’ দুজনেই মাথা নাড়তেই কিরান বলে উঠল, ‘ঠিক আছে। আর যত বিপদই আসুক আর যাই হোক আমার নির্দেশ ছাড়া কিছু করবা না। চলো,’ বলে সে তিনজনকে নিয়ে বাজার এলাকায় প্রবেশ করল।

বিকেল পার হয়ে সন্ধে সবেমাত্র শুরু হয়েছে। লোকমুখে অনেক কথা শুনলেও সন্দ্বীপে এর আগে কিরান এসেছিল মাত্র একবার। সে শুনেছে সন্দ্বীপ হলো অত্র মলুকে এমন এক জায়গা যেখানে সব ধরনের, সব রঙের, সব জাতির সব শ্রেণির মানুষ পাওয়া যায়। প্রচলিত সমাজের নিয়মকানুন এখানে কাজ করে না। এখানে জাতিগত ভেদাভেদ নেই, সমাজের কোনো স্তর নেই। এখানে শ্রেণিবৈষম্য নির্ধারিত হয় পুরোপুরি পেশি শক্তি আর অর্থ দিয়ে। এখানে ক্ষমতার মূলমন্ত্র একটাই। শক্তি অথবা অর্থ।

যদিও আগে শুনেছিল তবুও নিজ চোখে দেখে খানিকটা অবাক হলো যে, অন্য সব জায়গায় যেখানে সন্ধে নামতেই দিনের কারবার শেষ হয়ে থাকে, এখানে সন্ধে নামতেই জীবনের স্রোত যেন সবে বইতে শুরু করেছে। এভাবে সন্ধে থেকে আয়োজন শুরু হয়, চলে মাঝরাত পর্যন্ত। বাজারের মূল এলাকা দিয়ে ওরা ধীরে ধীরে এগোতে শুরু করল আড়তদারির এলাকার দিকে। আড়তদারির দিকে এসে আবার ওরা দেখল এখানে হিসেব উলটো। এখানে বাজার এলাকার তুলনায় ভিড় একেবারেই কম। সন্ধে নামতেই বেশিরভাগ আড়তই বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে অথবা বন্ধ করতে উদ্যোগী হচ্ছে আড়তদারিরা। এখানে কাজ শুরু হয় খুব ভোরে। বিশেষ করে, জাহাজে মাল ওঠানো-নামানো যত ভোরে করা যায় তত ভালো। আর তাই এখানে সন্দ্বীপের অন্য জায়গার হিসেব খাটে না। কিরানরা হাঁটতে হাঁটতে আড়তদারির এলাকার একপ্রান্তে চলে এলো। তারপর ধীরে ধীরে ঠিকানা মিলিয়ে নির্দিষ্ট এলাকায় এসে খোঁজ নিতে লাগল এখানে পানের মজুতদার সফরউদ্দিন কে আছে।

ওরা খোঁজ করতে করতে একজনকে জিজ্ঞেস করে সবে হাঁটতে শুরু করেছে পেছন থেকে শিসের শব্দে চমকে উঠল কিরান। মাথায় চাদর আর গায়ে লাল রঙের কুর্তা পরা মানুষটাকে হঠাৎ দেখার ঝলকে কিরান ফিরিঙ্গি বলে ভুল করত আরেকটু হলে। কিন্তু পরক্ষণে ভালোভাবে দেখে বুঝতে পারল পরনের কাপড় ভিন্ন হলেও যে মানুষটা পরে আছে সে একেবারেই এ দেশীয় মাল। মাথায় এলোমেলো ঝাঁকড়া চুল আর হাতে ছোটো একটা লাঠি। কিরানদের দেখে এক গাল হাসি দিয়ে বলে উঠল, ‘আমি সফরউদ্দিন আড়তে কাম করি। আপনেগো লই যাইতে পারি যদি এট্টু,’ বলে সে কথা শেষ না করে বিগলিত হাসি দিল।

কিরান কিছু না বলে মাথা নেড়ে সায় জানাল। লোকটা ওদেরকে গলির ভেতরের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। পেছন থেকে লোকটার লাল কুর্তা টেনে ধরে কাপড়ের ভেতর থেকেই কিরান ওর ড্যাগারটা দিয়ে লোকটার পাঁজরের একপাশে সামান্য খোঁচা দিল। ‘জায়গামতো নিবি, নাইলে জায়গামতো ঢুকায়া দিবো এইটা।’

লোকটা এতক্ষণ কিরানকে বিগলিত দৃষ্টিতে দেখছিল। এবার খানিকটা ভয়ে দৃষ্টিতে ফিরে তাকাল কিরানের দিকে। তারপরে মাথা নেড়ে বলে উঠল, ‘জি হুজুর।’ কিরান মাথা নেড়ে এগোতে বলল। কিরান খুব ভালোভাবেই জানে এইসব এলাকায় এসব আধখেচরা লোকেরা ঘুরে বেড়ায় এবং সুযোগ পেলে হয় নিজেরাই… আর না হলে অন্য দলের হাতে এদেরকে তুলে দিয়ে দুই পয়সা কামানোর ধান্ধায় থাকে। কাজেই কোনো ঝুঁকি নেওয়া যাবে না।

লোকটা ওদের নিয়ে দুটো গলি পার হয়ে চলে এলো তুলনামূলক ছোটো একটা ঘরের সামনে। ওটার সামনে এসে জোরে একটা শিস বাজাতেই ভেতর থেকে ডাক এলো। ‘হুজুর ভেতরে আছে,’ বলে সে কিরানের দিকে তাকিয়ে রইল। কিরান তার দিকে এটা রূপার মুদ্রা ছুড়ে দিতেই সেটা লুফে নিয়ে আরেক দফা বিগলিত হাসি দিয়ে বিদেয় নিল সে।

কিরান দলের বাকিদের পেছনে থাকতে বলে ভেতরে প্রবেশ করল। আড়ত বললেও আসলে ওটাও এক ধরনের দোকানই। বাইরে থেকে যতটা ছোটো মনে হয়, ভেতরটা অতটাও ছোটো নয়। কিরান ভেতরে প্রবেশ করতেই নাকে এসে লাগল বিচিত্র এক গন্ধ। দুই পাশে রাখা ছোটো ছোটো বস্তার স্তূপের মতো জিনিসগুলোর ভেতর থেকে আসছে এই বিচিত্র সুগন্ধ। গোমেজ কাছে গিয়ে একটা বস্তার কাছে নাক নিয়ে ঘ্রাণ নিতে লাগল। কিরান তাকে ধমক দিয়ে ভেতরে আসতে বলল।

‘ফিরিঙ্গিরে ধমকায়া লাভ কী জাহাজি, কিরানরা ভেতরে ঢুকে দেখল চারপাশে সাজানো নানা ধরনের ছোটো-বড়ো বস্তা আর মালামালের মতো ছোটো একটা জলচৌকি রাখা। সেটার ওপরে ছোটো একটা কাঠের চৌপায়া আর ওপরে রাখা তেলের প্রদীপ, একটা পানের বাটা আর জলচৌকির চারপাশে পাতা খেজুর পাতার মাদুর। গলার স্বরটা শোনা গেল। কিন্তু ভেতরে মানুষ দেখা গেল না কোনো। আপনাতেই নিজের পোশাকের ভেতরে ড্যাগারের হাতলে কিরানের হাতের আঙুলগুলো শক্ত হয়ে উঠল।

কিরান মৃদু কাশি দিল মানুষটার সন্ধানে। কিন্তু কাউকেই দেখা গেল না। সে আবারও কাশি দিতে যাচ্ছিল কিন্তু তার অগেই জলচৌকির অন্যপাশ থেকে ছোটোখাটো একটা মূর্তি প্রকট হলো এপাশে। কিরান দেখল ছোটো ধুতি আর ছোটো পাঞ্জাবি পরা ছোটো সাইজের একজন মানুষ যেন গড়িয়ে উঠে এলো জলচৌকির ওপরে। তারপর ওপরে উঠে বেশ আয়েশ করে হেলান দিয়ে বসল সে বালিশে। হেলান দিয়ে তারপর অদৃশ্য কারো উদ্দেশে হাতের ইশারা করল সে। ‘বলছিলাম তোমার সঙ্গের ফিরিঙ্গিরে ধমক দিয়ে লাভ কী?’ কিরান অবাক হলো লোকটার কথা শুনে। ‘এই গন্ধ পারস্য থেকে শুরু করে চীন দেশ পর্যন্ত মানুষরে পাগল বানায়া রাখে আর ও তো…’ বলে সে কিরানকে ইশারা করল পেতে রাখা মাদুরে বসার জন্য। ‘তালেব তৈমূরের পোলা তালেব কিরান, সুন্দর কইরা বসো। হাত-পা ছড়ায়া বসো,’ সে ইশারায় কিরানের ড্যাগার ধরে রাখা হাতটা দেখাল। ‘গলির চিপায় যারে ধমক দিসো হেইগুলা এহানে চলবে না। তুমি কামের পোলা, বোঝার বুদ্ধি আছে আশা করি।’ মানুষটা এইটুক বলতেই কামরার দুদিক থেকে দুজনে প্রবেশ করল কামরার ভেতরে।

একজনের হাতে গড়গড়া। সেটা সে সাজিয়ে দিল মানুষটার সামনে। আর অন্যজন ছোটো ছোটো পাত্রে করে বাহারি পান সাজিয়ে দিয়ে গেল ওদের সামনে। ইশরারায় ওদেরকে পান নিতে বলল মানুষটা। ‘নাও, তৈমূরের ছেলে। তোমার বাপের কল্যাণের জন্য হলেও একটা পান নাও,’ বলে সে মৃদু হেসে উঠল। তুমি হয়তো ভাবতাছো, আমি তোমার বাপরে এভাবে নাম ধইরা ডাকছি,’ গড়াগড়ায় টান দিতে দিতে হেসে উঠল সে। ‘তবে শুনে রাখো, আমারে দেখতে যত কম দেহায় বয়স আসলে অত কম না আমার। এখন বলো, আমি কী করতে পারি তোমার জন্য?’

কিরান দেখল ওর সঙ্গে আসা লাঠিয়াল দুজনে পান তুলে নিয়ে বেশ আয়েশের সঙ্গে চিবুচ্ছে। সুন্দর একটা গন্ধ পেল সে। তবে গোমেজের কোনো বিকার নেই। সে দুই হাত ভাঁজ করে বসে আছে। মুখে কোনো ভাব নেই। কিরান পাত্র থেকে একটা পান তুলে হাতে নিল। কিন্তু মুখে দিল না সে। সফরউদ্দিন দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, ‘আপনার কাছে আমাকে আকরাম বেগ পাঠাইছে। আপনে তারে তো চিনেন?

সফরউদ্দিন মৃদু হেসে উঠল। ‘তারপর কও, ভাতিজা…’।

‘এইটা দিতে বলছে সে আমারে আপনার কাছে,’ বলে সে কোমর থেকে ভাঁজ করা চামড়ার পুঁটলিটা এগিয়ে দিল তার দিকে। সফরউদ্দিন সেটা হাতে নিয়ে সাবধানে বাঁধনটা খুলে ফেলল। এক নজর জিনিসটা দেখে নিয়ে সেটা আবারও আগের মতো মুড়িয়ে বেঁধে ফেলল সুতো দিয়ে। ‘তুমি কি আমার কাছে শুধু এই কামের লাইগ্গাই আসছো?’ কিরান মুখে কিছু না বলে স্রেফ মাথা ঝাঁকাল। ওর জবাব শুনে সফরউদ্দিন আবারও আপনমনে খানিকটা হেসে উঠল। ‘আমি একটু হতাশ অইলাম আকরামের ওপরে। আমি ভাবছিলাম… যাক গা। কাম যোগ্য লোকের হাতে পড়ছে এতেই আমি খুশি।’ বলে সে গড়গড়ায় দুটো টান দিল। ‘তুমার কাম এক লহমেই হয়ে যাবে। আমার লোকেরা তুমারে দিয়ে আসবে ওইখানে।’

‘আপনাকে ধন্যবাদ,’ কিরান উঠে দাঁড়াতে যাচ্ছিল।

‘উমম উমম,’ হাতের ইশারায় ওকে বসতে বলল সে। ‘তুমি কিন্তু পানটা খাও নাই, ভাতিজা,’ বলে সে কিরানের হাতের দিকে দেখাল। ‘আমার পান কিন্তুক মক্কা থেইক্কা শুরু কইরা পুরা দুনিয়াতে বিখ্যাত। এই যে সব বস্তা-পেঁটরা দেখতাছো এইগুলা সব পান-মসলা। সুমাত্রা, আন্দামান, রোসাঙ্গ, জাভা থেইক্কা শুরু কইরা পুরা দুনিয়া থেইক্কা আসে। তারপর আবার সব চইলা যায়…’ কথা শেষ না করে গড়গড়ায় টান দিল সে। ‘তুমার আগ্রহ অইতাছে না ভাতিজা, এই কাঁচা পান দুনিয়ার সবখানে যায় কীভাবে জানার জন্য?’

কিরান বিরক্তির সঙ্গে গোমেজকে দেখল একবার। এই লোক এত কথা বলতে শুরু করেছে কেন। গোমেজের কাছ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে সে সফরউদ্দিনের দিকে তাকিয়ে দেখল লোকটা ওর দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। যাক গা ভাতিজা, তুমি কামে আসছো। এসব আজাইরা প্যাচালে বিরক্ত অইতাছো বুঝবার পারছি। এই শুন,’ বলে সে ডাক দিতেই দুজন লোক এসে হাজির হলো। ওদের মৃদু স্বরে কাজ বুঝিয়ে দিতেই বেরিয়ে গেল লোক দুজন। ‘ওরা বাইরে আছে। তোমরা বাইর অইলেই ওরা তুমগো জায়গামতো নিয়া যাব। তয় যাওয়ার আগে তোমারে দুইটা কথা কই। সাদা চোখে যা দেখবো বুঝবা সেইটাই সব না। আর যা করতে যাইতেছো সেটার লাইগ্গা জাহাজ, অস্ত্র, মানুষ, গোলাবারুদ অনেক জরুরি। কিন্তু সবচেয়ে জরুরি কী জানো, নিজের মনের জোর। অনেক অনেক মনের জোর লাগব তোমার ভাতিজা। বুকের বলই সবচেয়ে বড়ো বল,’ নিজের একটা হাত মুঠো করে বুকের কাছে চেপে ধরে বলে উঠল সে। কিরান একটু চমকে উঠে লোকটার দিকে তাকিয়ে রইলো। কয়েক মুহূর্ত তার দিকে তাকিয়ে থেকে বাইরে বেরিয়ে আসতেই লোক দুজন ওদেরকে ইশারা করল পেছনে এগোতে। কিরান পানটা মুখে পুরে এগোতে শুরু করল। লোকটা ভুল বলেনি পানটা আসলেই সুস্বাদু।

সফরউদ্দিনের লোক দুজন ওদেরকে নিয়ে এ-গলি ও-গলি ঘুরে একটা পাকা বাড়ির সামনে নিয়ে এলো। তারপর কিরানকে জানাল, মালিক তাদের এখানেই দিয়ে যেতে বলেছে। ভেতরে গিয়ে ওকে আছিয়া নামে একজনের সঙ্গে কথা বলতে হবে।

কিরান ভেবেছিল লোকগুলো ওদের জায়গামতো নিয়ে এলে দুটো মুদ্ৰা বকশিশ দেবে। কিন্তু সেটা না করে হাঁ করে তাকিয়ে রইল ওদের যেখানে নিয়ে এসেছে সেই বাড়ির দিকে। নানা ধরনের নানা বর্ণের মেয়েরা সাজগোজ করে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে। কিরান মনে-মনে আঁতকে উঠল।

সর্বনাশ! এরা তো দেখি ওদেরকে গণিকালয়ে নিয়ে এসেছে।

***

কিরানদের কাছ থেকে আলাদা হয়ে যেতেই গোলন্দাজ তার লোকদের দেখল একবার। এদের ভেতরে সে বৈঠাকে চেনে শুধু। তাও এই লোকটা যখন তার সঙ্গে জাহাজে কাজ করত সে ছিল প্রধান কামাঞ্চি আর এই লোকটা ছিল সাধারণ এক লস্কর, যে কিনা জাহাজে ফুটফরমাইশ খাটে। তাই তার সঙ্গে সখ্যতা থাকার প্রশ্নই আসে না। তবু যেহেতু কিরানের দলের লোক খানিকটা ভরসা আছে এর ওপরে। কিন্তু অন্য লোকটা যাকে বিল্লাল নামে চেনে সবাই ওই লোকটাকে গোলন্দাজের খুব একটা সুবিধার মনে হচ্ছে না। কারণ একে দেখে কেন জানি অতিরিক্ত চতুর মনে হচ্ছে। ওদের সঙ্গে আছে দুজন লাঠিয়াল।

গোলন্দাজ ভয় পাওয়ার মতো মানুষ নয়। মাত্র তেরো বছর বয়সে ঘর ছেড়ে কাজে নেমেছিল সে। কতবার পাড়ি দিয়েছে সমুদ্র। সেই যে নোনা পানির নেশা তাকে পেয়ে বসেছিল সে থেকে আর ছাড়েনি। এরপরে একেবারে যৌবনের শেষ প্রান্তে এসে বাড়ি ফিরেছে সে। আজ থেকে কয়েক বছর আগে সিলভেরার বাহিনীর সঙ্গে যা ঘটেছিল তাতে দুর্ভাগ্য তো ছিলই মাঝে মাঝে গোলন্দাজের মনে হয় ওই ঘটনাটা তার কারণেই ঘটেছিল। ভুল আসলে সবারই ছিল। বিশেষ করে তাদের কাপ্তান কিরানের। জোশের বসে সে সিলভেরার বাহিনীকে অনেক নিচু করে দেখেছিল। কিন্তু সেটার ফল পেতে হয়েছে সবাইকে। যদিও কিরানের দলের অনেকেরই অভিমত আসলে যা ঘটেছিল সেটার জন্য দায়ভার অনেকটা গোলন্দাজের ছিল। কারণ যুদ্ধের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা সময়ে গোলন্দাজ ভয়ে কামান ছেড়ে তার বাহিনী নিয়ে পিছু হটেছিল। আর একারণেই সিলভেরার বাহিনী তাদের নৌবহরের একটা অংশ উড়িয়ে দিতে পেরেছিল। যদিও জনসম্মুখে এই কথাটা গোলন্দাজ কোনোদিনই স্বীকার করেনি। নিজের দল নিয়ে পেছনে পড়ার যুক্তি হিসেবে সে বলেছিল যে, তার লোকেদের নিরাপত্তা আগে দেখেছে সে, সে- কারণেই পিছিয়ে গিয়েছিল সে। যুক্তি হিসেবে কথাটা ঠিক আছে। কিন্তু নিজের মনের গহিনে সে জানে যদি তার লোকদের নিয়ে আরেকটু সাহস করে নিজের অবস্থানটা না ছাড়ত, তাহলে তারা প্রাণে না বাঁচলেও কিরানের বাহিনীকে পরাজিত হতে হতো না। অন্তত পরাজয়টা এতটা গ্লানিকর হতো না।

এই কারণে কিরানের ওপরে গোলন্দাজের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। এই ব্যাপারটা একমাত্র কিরান জানত কিন্তু সে কাউকেই বলেনি। যদিও সবাই গোলন্দাজকে দোষারোপ করেছে। কিন্তু এ-থেকে সবসময় তাকে ফিরিয়ে রেখেছে কিরান। সে নিজের ওপরে সব দায়ভার নিয়েছে। তার দলের কারো ওপরে আঁচ আসতে দেয়নি। ওই ঘটনার পর গোলন্দাজ প্রথমে বাড়ি ফিরে যেতে চায়নি। কারণ অল্প বয়সে বাড়ি ছাড়ার পর পূর্ণ বয়সে আবারও বাড়ি ফিরে গিয়ে নিজের প্রায় অচেনা হয়ে যাওয়া পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে নতুন করে সব মানিয়ে নিতে পারবে কিনা যথেষ্ট সন্দেহ ছিল। তার ওপরে আবার ভেতরে বহন করে নিয়ে যাচ্ছে বিরাট এক ক্ষত। কিন্তু বাড়ির লোকদের সঙ্গে মানিয়ে নিতে তেমন একটা কষ্ট হয়নি তার। তারপর ধীরে ধীরে আবারও সব গড়ে তুলেছে। আজ এক লহমায় আবারও হারিয়ে গেছে সব। কিন্তু পুরস্কার হিসেবে ফিরে এসেছে পুরনো সেই জীবন।

হাঁটতে হাঁটতে নিজের ভাবনার জগতে হারিয়ে যেতে বসেছিল গোলন্দাজ হঠাৎ পাশ থেকে বৈঠার ডাক শুনে সে বর্তমানে ফিরে এলো। ‘হুজুর, এট্টু শুনেন না,’ বলে সে গোলন্দাজকে টেনে একটু পিছিয়ে আনল। লাঠিয়াল দুজনকে বিল্লালের সঙ্গে এগোতে বলে গোলন্দাজ খানিকটা পিছিয়ে এলো বৈঠার কাছাকাছি। ‘বলো, কী অইছে?’

‘হুজুর, এই বিল্লাল শেঠ কিন্তু খুব সুবিধার লোক না,’ বলে সে সামনে আগে- আগে হাঁটতে থাকা বিল্লাল শেঠকে দেখাল। ‘ওস্তাদ কিরানরে হেয় বাঘের মতোন ডরায় কিন্তু অন্য কেউরে পাত্তাই দেয় না। আর হের যে গুরু হেয় কিন্তু আরো খারাপ, সফদর শেঠ। হের কামই অইলো খবর কেনাবেচা করা। আমগো…’

‘সাবধান থাকতে হবে,’ বৈঠার বাক্যটা শেষ করল গোলন্দাজ নিজে। বলে সে বৈঠার কাঁধে একটা চাপড় মারল। বৈঠা তাকে যা বলল, কিরান এই তথ্য আরো অনেক আগেই তাকেও দিয়েছে এবং সাবধান থাকার কথা বলে দিয়েছে। গোলন্দাজ নিজে পোশাকের ভেতরে একটা ছুরি রেখেছে। সেই সঙ্গে তার পিঠের ওপরে একটা গুলি ভরা বন্দুক প্রস্তুত। মনে মনে ভাবল বিল্লাল শেঠ যত বড়ো তালেবরই হোক না কেন এইবার ফাইজলামি করলে তার খবর আছে। পায়ে পায়ে সে সামনে এগিয়ে গেল। বিল্লাল শেঠ বেশ খুশি মনে হাঁটছে। তার পাশে এসে বিল্লাল শেঠের কাঁধে একটা হাত রাখল গোলন্দাজ।

‘আরে শেঠ, এক লগে কাম করতাছি। আমগো তো ঠিকমতো আলাপই অইলো না,’ হঠাৎ গোলন্দাজের এই আচরণ দেখে বিল্লাল শেঠের চোখ কপালে ওঠার জোগাড় হলো, যদিও সে জানে কিরানের দলে জাত-পাত-ধর্ম এগুলো কোনো বিষয় না। কিন্তু তবু উঁচু জাতের একজন হিন্দু যে নিচু জাতের নিজের ধর্মের কারো সঙ্গেই কথা বলার কথাই না, স্পর্শ করা তো দূরে থাক, সে কিনা তার মতো একজন মুসলমানের কাঁধে হাত রেখে কথা বলছে। ব্যাপারটা অবিশ্বাস্যই বটে। সে প্রায় বিনয়ে বিগলিত হয়ে বলে উঠল, ‘জি হুজুর, আপনের অনেক নাম শুনছি সবার কাছে। আপনের নাকি কামানে বিরাট হাত…’ বলে সে গোলন্দাজের প্রশংসা করেই চলল। বাজার এলাকা থেকে ওরা যাবে হাম্মামখানার দিকে।

হাম্মামখানা ব্যাপারটা কিঞ্চিত অদ্ভুত আর অবাক করার মতো। কারণ হাম্মামখানার প্রকৃত উৎস মধ্যপ্রাচ্যের দিকে’। এই অঞ্চলে হাম্মামখানার তেমন একটা প্রচলন নেই। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্য ঘুরে হজ করে আসা হাজি সফদর পাটোয়ারির ব্যাপারটাকে ভিন্ন একটা মাত্রা দিয়েছে এই সন্দ্বীপকে। এই এলাকায় সে একমাত্র হাম্মামখানা মানে গোসলখানা খুলে রেখেছে দ্বীপের এক প্রান্তে। ব্যাপারটা অদ্ভুত লাগতে পারে এই কারণে যে, মধ্যপ্রাচ্যে যেখানে পানির তীব্র অভাব সেখানে শহরের কেন্দ্রে গোসলের ব্যবস্থা একটা বিরাট রাজসিক এবং প্রয়োজনীয় ব্যাপার। কিন্তু পানি বিধৌত এই অঞ্চলে এটার গুরুত্ব আসলে কতটুকু। কিংবা চাহিদাই বা কতটুকু। সফদর পাটোয়ারি যখন ব্যাপারটা খুলল তখন সবাই হাসাহাসি করেছে। কিন্তু পরে দেখা গেল ধীরে ধীরে জমে উঠতে শুরু করল তার হাম্মামখানা। এর পেছনে কারণ হলো এখানে গোসলের সুব্যবস্থা তো আছেই সেই সঙ্গে আছে পানিতে গলা পর্যন্ত ডুবিয়ে গড়াগড়া টানার ব্যবস্থা, গোসলের আগে তেল মালিশের ব্যবস্থা, পানিতে আধডোবা হয়ে চণ্ডু টানতে টানতে পাশা কিংবা শতরঞ্জি খেলার ব্যবস্থাও আছে। এখন অবস্থা এমন হয়েছে যে, সফদর শেঠের হাম্মামখানায় গোসল করতে রীতিমতো লাইন লেগে যায়। সকাল, দুপুর কী সন্ধে। আর এসবের পেছনে সফদর শেঠের মূল উদ্দেশ্য হলো, এখানে লোক সমাগমের সুযোগে সব খবর চলে আসে তার কাছে। এর বাইরে তার টিকটিকি জাসুস আর খবরিরা তো পুরো এলাকায় ছড়িয়ে আছেই। আর তাই গণ্যমান্য মহল থেকে শুরু করে সবখানে তার গোসলখানা আর খবরের চাহিদার কোনো তুলনাই নেই। বিল্লাল শেঠও তার এরকমই খবরিদের একজন যে কিনা তাকে রামু আর রাউজান এলাকার কোথায় কী হচ্ছে সব খবর এনে দেয়।

এসবই আগে শুনেছে গোলন্দাজ। আর তাই বাজার এলাকা ছাড়িয়ে খানিকটা সরে আসতেই রংমহলের মতো দেখতে আলোকিত সুসজ্জিত হাম্মামখানাটা দেখে সে দূর থেকেই খুব সহজেই বুঝতে পারল এটাই সফদর শেঠের হাম্মামখানা। ‘দেখছেন ওস্তাদের কারবার! করছেডা কী?’ গোলন্দাজের সঙ্গে গল্প করতে করতেই বিল্লাল শেঠ খুশির সুরে বলে উঠল কথাটা।

গোলন্দাজ একটু অবাক হয়ে দেখছে। সে ভাবেনি এই মরা দ্বীপের একপ্রান্তে এরকম আলোকিত আয়োজন থাকবে। তবে হাম্মামখানার প্রাঙ্গণে কোনো মানুষ দেখা গেল না। ‘কী ব্যাপার, মানুষ কই?’ সে কৌতূহলী সুরে জানতে চাইল।

‘আরে এই সইন্ধ্যা বেলা কী আর মাইনষের গুসলের সময়! এহন অইলো ওস্তাদের বিশেষ কামের সময়। তাই বিশেষ লোকজন ছাড়া এহন কেউ থাকব না, এইডাই স্বাভাবিক। আর হেয় জানে আমরা আসব কাজেই…’ বলে সে ওদেরকে পথ দেখিয়ে হাম্মামখানার প্রাঙ্গণে নিয়ে এলো। ওরা ছোটো উঠানের মতো জায়গাটা পার হয়ে হাম্মামখানার পানির চৌবাচ্চার মতো জায়গাটা পার হয়ে এলো। এখান থেকে সারি সারি খোপের মতো জায়গায় গোসলের সুব্যবস্থা আছে। সব কিছু সাজানো-গোছানো। কিন্তু একটা কাকপক্ষীও দেখা গেল না কোনো দিকে।

রঙ্গন মল্লিক সবাইকে সাবধান থাকতে বলে বিল্লাল শেঠকে পথ দেখাতে বলল। একেবারে বিরান প্রান্তরের নির্জনতা দেখে বিল্লাল শেঠও মনে হয় একটু ঘাবড়ে গেছে। সে ওদেরকে নিয়ে সারিসারি খোপ পার হয়ে এক কোণে কামরার দিকে এগিয়ে গেল। ওটার দরজার কাছে গিয়ে মৃদু স্বরে সফদর শেঠকে ডাক দিল।

পায়ে পায়ে দরজা ঠেলে সাবধানে সেদিকে এগিয়ে গেল গোলন্দাজ আর বৈঠা। ওদের ঠিক পেছনেই লাঠিয়াল দুজন। ভেতরে ঢুকে দেখল ভেতরে বেশ বড়ো একটা কামরা। ভেতরে দেয়ালের একপাশে মশাল থেকে আলো আসছে। মেঝেতে পাতা শতরঞ্জির ওপরে সুগন্ধি তেলের বাতি, তার ঠিক পাশেই সুরাপাত্র আর পানপাত্র। কিন্তু ভেতরে কোনো মানুষ নেই।

‘কী রে, কী ব্যাপার?’ গোলন্দাজ খানিকটা হতভম্ভ হয়ে কামরার মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে থাকা বিল্লাল শেঠের দিকে এগিয়ে কড়া সুরে জানতে চাইল। ‘তোর ওস্তাদ কই? তুই না বলছিলি আমরা আসতেছি এটা সে জানে। সে গেল কই?

বিল্লাল শেঠকে খানিকটা বোকা দেখাচ্ছে, সে রঙ্গন মল্লিকের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল। ‘বুঝতেসি না তো। হের তো,’ বলে সে কামরা থেকে বের হওয়ার দুটো দরজা দেখাল। ‘আমি এক কাজ করি হেরে…’ সে কথা শেষ করার আগেই রঙ্গন মল্লিক বিল্লাল শেঠের কুর্তার একপাশে চেপে ধরে তাকে ঠেসে ধরল দেয়ালের সঙ্গে। তারপর পোশাকের ভেতর থেকে ছুরিটা বের করে সেটা ঠেকাল বিল্লাল শেঠের গলার কাছে। ‘বিল্লাল শেঠ, আমি খালি কামান না, ছুরি আরো ভালো চালাইতে পারি, দেখতে চাস?’

বিল্লাল শেঠ কুঁইকুঁই করতে শুরু করেছে গোলন্দাজের ফাঁস থেকে বের হওয়ার জন্য। হঠাৎ কামরার অন্য দিক থেকে বৈঠা ডেকে উঠল ওদেরকে। কাছে গিয়ে গোলন্দাজ দেখল লাঠিয়াল দুজন আর বৈঠা দাঁড়িয়ে আছে কামরাটাতে রাখা পর্দার অন্যপাশে। তিনজনেই সতর্ক। ওদেরকে দেখেই বৈঠা বলে উঠল, ‘হুজুর দেহেন।’

গোলন্দাজ উঁকি দিয়ে দেখল আড়ালের অন্যপাশে একটা বড়ো সিন্দুক, সেটার পাশেই মাটিতে পড়ে আছে মধ্যবয়স্ক একজন মানুষের গলাকাটা দেহ। গোলন্দাজ সঙ্গে সঙ্গে পিঠের ওপর থেকে টান দিয়ে বন্দুকটা বের করে আনল। বিল্লাল শেঠ এগিয়ে যেতেই তাকে প্রশ্ন করল, ‘এইটাই কী সফদর?’ বিল্লাল দ্রুত মাথা ঝাঁকিয়ে হ্যাঁ-সূচক জবাব দিল। তারপর কাঁদো কাঁদো গলায় বলে উঠল, ‘ওস্তাদ রে…’

তার ঠোঁটের ওপরে আঙুল রেখে চুপ থাকতে বলল গোলন্দাজ রঙ্গন মল্লিক। তার ধারণা যে বা যারা সফদর শেঠকে খুন করেছে তারা এখানেই আছে এখনো। সে নিজের অস্ত্র সামনে ধরে বৈঠা আর লাঠিয়াল দুজনকে চোখের ইশারায় সতর্ক করে আড়ালের ওপাশের দরজাটা দেখাল। একটু আগেই মৃদু আওয়াজ ভেসে এসেছে ওখান থেকে। কেউ আছে ওই কামরায়।

***

দুজনেই তারা দুজনকে একটু পরপর সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখছে। প্রতিটি মানুষের জীবনের বর্তমান অবস্থানকে সংজ্ঞায়িত করে তার সামাজিক এবং অর্থনৈতিক অবস্থান। আর সেই অবস্থানকে মজবুত কিংবা দুর্বল করে তার ধর্মীয় বিশ্বাস এবং মূল্যবোধ। প্রচলিত হিন্দু সমাজে শুধু অর্থ থাকলেই সবকিছু করা সম্ভব নয় জাতপাতের কারণে। তবে এই বিশ্বাস এবং অবস্থান ধীরে ধীরে বদলে যেতে শুরু করেছে সমাজের বিভিন্ন স্তরে। তবে শত কিংবা হাজারো বছর ধরে রক্তের ভেতরে লালন এবং ধারণ করে আসা ব্যাপার কি আর চাইলেই বদলে ফেলা যায়? তবে সমাজের ও ধর্মের ওপরের স্তরের মানুষদের নিচের স্তরের প্রতি আবার নিচের স্তরের মানুষদের ওপরের স্তরের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির ভেতরে একটা অবধারিত ছন্দ বিরাজমান থাকে, সেটা ভালো হোক কিংবা মন্দ হোক, সেখানে একটা সংজ্ঞায়িত ব্যাপার থাকে। কিন্তু যখনই সমাজের একই স্তরের মানুষদের ভেতরে সমান পরিমাণ ক্ষমতা কিংবা অবস্থানগত বিষয় বিরাজ করে তখন চিত্রটা খানিকটা হলেও বদলে যায়। ব্যাপারটা ঘটে দুইভাবে, খুব ভালোভাবে, আর না হয় সন্দেহের ভিত্তিতে।

এই মুহূর্তে লাঠিয়াল বাহিনীর সর্দার তুলারাম আর বাজিকর বেদুর ভেতরে ঠিক দ্বিতীয় ব্যাপারটাই ঘটছে। তারা দুজনেই সমাজের একই স্তর থেকে উঠে আসা মানুষ। এদের কারো পূর্বপুরুষই সমাজে ধর্মীয় কিংবা সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত অবস্থানে ছিল না। কিন্তু বেদুর জন্য মোঘল বাহিনীর অন্তর্গত হওয়া কিংবা তুলারামের জন্য আকরাম বেগের মতো একজন মুসলিমের অধীনে একটা লাঠিয়াল বাহিনীর সর্দার হিসেবে নিজের অবস্থান শক্ত করার ফলে যেটা হয়েছে দুজনেই নিজের সামাজিক স্তর ভেদ করে উঠে এসেছে পূর্বপুরুষদের চাইতে একটু হলেও মুক্ত অবস্থানে। ফলে এই দুজন মানুষ যখন পরস্পরের সাহচর্যে এসেছে সমধর্মী চুম্বক যেমন বিপরীত প্রতিক্রিয়া ঘটায়, এরাও পরস্পরের থেকে ঠিক তেমনি বিপরীতধর্মী নেতিবাচক বিক্রিয়া ঘটাচ্ছে।

কিরানদের কাছ থেকে আলাদা হয়ে প্রথম গোলন্দাজের দলটা চলে যায় সোজা বাজারের রাস্তা বরাবর। অন্যদিকে কিরান আর ওর দল আড়তদারির দিকে বিদেয় নিতেই ওরা আলাদা হয়ে মূল বাজারের পথে হাঁটতে শুরু করে। ওদের দলে আছে তুলারাম, বেদু আর সঙ্গে দুজন লাঠিয়াল।

কিরান যখন দলগুলোকে সাজায় একটা দলে সে নেতা আর অন্য দলে গোলন্দাজকে নেতা করেছে। কিন্তু এই দলটা যেহেতু মূল বাজারের ভেতরে অবস্থান করবে কাজেই এদের ভেতরে কোনো নেতা রাখা হয়নি। চারজনকেই পরানো হয়েছে সাধারণ দেহরক্ষী কিংবা লাঠিয়ালের পোশাক। তাদের ভাবটা এমন যে, তারা এসেছে একজন মালিকের সঙ্গে, মালিক তাদেরকে রেখে গেছে রঙ্গশালায়। আর তারা এখন ঘুরে বেড়াচ্ছে নিজের মতো। বেদু নিজের সঙ্গে নিয়েছে একটা মোটা গদা, সেটাকে সে পোশাকের ভেতরে লুকিয়ে রেখেছে, সেই সঙ্গে তার ধুতির ভেতরে গোঁজা আছে একটা লম্বা মাথা বাঁকা আরাকানি ছুরি। সে তুলারামের দিকে তাকিয়ে দেখল তুলারামের হাতে তেল চকচকে লাঠিটা তো আছেই, তার সঙ্গে তলোয়ারও আছে। বড়ো নয়, খাটো তলোয়ার। আর তুলারামের সঙ্গে যে দুজন, তাদের ভেতরে অন্তত একজনের সঙ্গে একটা বন্দুক লুকানো আছে।

বেদু তুলারামের দিকে একটু পর পর সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। আবার সে অন্যদিকে তাকালে অনুভব করতে পারছে তুলারামও তাকে একই দৃষ্টিতে অবলোকন করছে। এর পেছনে কারণ সেই হাজার বছরের সামাজিক অবস্থানগত দ্বন্দ্ব। কিরানরা আলাদা হয়ে যেতেই ওরা আরেকটু সামনে এগোতেই বেদু মৃদু শিসের সঙ্গে তুলারামকে কাছে ডাকল।

‘আমরা এইহান থনে কোন দিকে যাবো?’ সে গলার স্বর যতটা সম্ভব ভারী করে প্রশ্নটা করার চেষ্টা করল। তুলারামের ওপরে খানিকটা কর্তৃত্ব দেখানোর ইচ্ছে। কিন্তু তুলারাম তাকে পাত্তাই দিল না। সে একবার বেদুকে দেখে নিয়ে নিজের কোমর থেকে একটা থলের মতো বের করে তা থেকে খানকিটা খইনি বের করে নিজের ঠোঁটের নিচে গুঁজে দিল। বেদু তাজ্জব হয়ে তাকিয়ে রইল তার দিকে। তারপর রাগের সঙ্গে জানতে চাইল, ‘কতা জিগাইলাম জবাব দিলা না, লেঠেল?’

তুলারাম হাত নেড়ে আবারও তার কোমরে থলিটা রেখে দিল। তারপর মাটিতে থুতু ফেলে ধীরে সুস্থে জবাব দিল। ‘তুমিই কও তামশাকর, বিভিন্ন ধরনের খেলা দেখিয়ে জীবিকা অর্জন করে যারা তাদের এই নামে ডাকা হয়, খানিকটা নিচু করে অবশ্য।

তুলারামের জবাব শুনে বেদু খানিকটা বেজার হলো। তাকে তামশাকর বলাতে সে রাগ অনুভব করছে ভেতরে ভেতরে। আবার দলটাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্বও তাকেই দিয়েছে, ব্যাপারটা ভেবে একটু ভালোও লাগল তার। ঠিক আছে লেঠেল, তুমি যখন কইতাছো তাইলে আমরা আগে সোজা বাজারে ঢুকব। সেখানে ঢুইকা আগে খোঁজখবর করব, তারপর ওইখানে কিছু না পাইলে আমরা অন্যদিকে যাব। বুঝছো?’ বলে সে তুলারামের দিকে তাকিয়ে রইল। লোকটার প্রতিক্রিয়া বোঝার চেষ্টা করছে।

তুলারাম ঠিকমতো তার কথা শোনেওনি। সে কথা বলছিল নিজের দলের একজনের সঙ্গে। বেদুর কথা শেষ হবার পরও সে কথা বলেই যেতে লাগল। বেদু কথা শেষ করে দেখল লোকটা কোনো জবাব দিচ্ছে না। সে মৃদু কাশি দিল। তার কাশি শুনে তুলারাম তার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে উঠল, তারপর বলল, ঠিক আছে, ঠিক আছে, চলো,’ বলে সে একটা হাত সামনের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে পথ দেখাতে বলল। বেদু চিন্তিত মুখে মানুষটার দিকে তাকিয়ে রইল। লোকটা কী তাকে সম্মান দেখাচ্ছে নাকি তাকে নিয়ে মজা করার চেষ্টা করছে সে বোঝার চেষ্টা করল। কিন্তু বুঝতে না পেরে পা চালাল সামনের দিকে। হাঁটতে হাঁটতে মনে মনে ভাবল ব্যাটা যদি তালেবরি করে ওর মুখটা সে ভেঙে দেবে।

পুরো দলটা পা চালিয়ে চলে এলো বাজার এলাকার মূল রাস্তায়। সন্দ্বীপের এই বাজারটা গড়ে উঠেছে দুই ধরনের চাহিদাকে মাথায় রেখে। প্রথম, যারা এখানে স্থায়ীভাবে থাকে তাদের চাহিদার জোগান… যাদের ভেতরে আছে নিয়মিত বাসিন্দা, অনেক স্থানীয় ও পর্তুগিজ পরিবার। এরপরে আছে খাবার ঘর, থাকার জায়গা, পানশালা, গণিকালয় এসব। আবার বাজারের একটা বড়ো অংশ গড়ে উঠেছে এই বাজার থেকে চারিপাশের বিভিন্ন রাজ্যে সমুদ্রপথে বাণিজ্যের জন্য যেসব জিনিস রপ্তানি কিংবা আমদানি করা হয় সেসবের কথা ভেবে। মূলত দ্বিতীয় ব্যবসাটাই এখানে প্রধান। আর তাই বাজারটাও গড়ে উঠেছে সেভাবেই নানা জিনিসের ধরন অনুযায়ী আলাদা আলাদা অংশে।

বাজারের নিত্য প্রয়োজনীয় অংশ যেসব জায়গায় বিক্রি হয় সেদিক দিয়ে ওরা বাজার এলাকায় প্রবেশ করল। চাল, ডাল থেকে শুরু করে গম ইত্যাদি একদিকে বিক্রি হয়, এরপরেই কাঁচামাল আর মাছ-গোশত এসব জিনিসের দোকান।

যেখানে ভারতবর্ষের বেশির ভাগ জায়গাতেই কেনাবেচা হয় সকালে, সেখানে সন্দ্বীপের হিসেব একেবারেই আলাদা। সন্ধে নামার কারণেই হোক আর যেকারণেই হোক বাজার এলাকা এই মুহূর্তে সরগরম। ওরা বাজারের ছোটো ছোটো এলাকাগুলো পার হয়ে চলে এলো মসলা বিক্রির জায়গায়। এখানে না এলে বৈশ্বিক বাজারে ভারতবর্ষের মসলার যে বিপুল চাহিদা সেটা বোঝার কোনো উপায়ই নেই। পুরো বিশ্বের মূল ব্যবসায়িক উপদানগুলোর অন্যতম একটি হলো মসলা। আর এই মসলার বেশিরভাগ যোগানদানকারীই হলো ভারতবর্ষ। আর ভরতবর্ষের মসলার বাজার আগে পুরোটা নিয়ন্ত্রণ করত আরবের লোকেরা। তারা ভারতবর্ষ থেকে মসলা কিনে নিয়ে যেত মধ্যপ্রাচ্যে। সেখান থেকে ইতালির ভেনিসে। সেখানে চড়া দামে সেগুলো বিক্রি করত ইউরোপিয় বণিকদের কাছে। এর ফলে ভারতবর্ষের সমুদ্রবন্দর থেকে শুরু করে মধ্যপ্রাচ্য, এমনকি ইউরোপ পর্যন্ত সমুদ্রপথও নিয়ন্ত্রণ করত তারাই। পুরো বিশ্বের ব্যবসায়িক মহলে তাদেরই ছিল একচ্ছত্র আধিপত্য। কিন্তু এই প্রেক্ষাপটটা বদলে যেতে শুরু করে ইউরোপিয় বণিকরা ভারতবর্ষে আসার জলপথ আবিষ্কারের পর থেকে। ভাস্কো দা গামা কালিকটে নামার পর থেকে প্রায় দুইশ বছরের রক্তক্ষয়ী ইতিহাসের মাধ্যমে মসলার বৈশ্বিক এই বাজার এখন অনেকটাই ইউরোপিয়দের দখলে। আর তাই ভারতের বড়ো বাজার মানেই মসলা, আর মসলা মানেই বিদেশি খরিদ্দার। আর বাজারের মসলার অংশটাও সেরকমই হয়, কিন্তু ওখানে ঘণ্টাখানেকের ওপরে ঘোরাঘুরি করেও তেমন কিছুই পেল না ওরা। তবে বাজারের হঠাৎ এই সরগরম হয়ে ওঠার কারণটা জানতে পারল। আজ রাতে নাকি বাজারে ফাঁসির মঞ্চে একজনকে ফাঁসি দেওয়া হবে। সেটা দেখার জন্য সবাই জলদি বাজার বন্ধ করে সেখানে যাওয়ার তাড়ায় আছে।

একটু পরেই তুলরাম বেদু আর তার লোকেদের ইশারা করল অন্যদিকে সরে যেতে। ওরা সরতে সরতে তুলারাম আবারও মাটিতে থুতু ফেলে বলে উঠল, ‘কী মিয়া, কই আনলা? কিছুই তো হুনতাছি না। খালি কিনা আর বেচা, বেচা আর কিনা।’

‘ওই মিয়া এইহানে কী সবাই তুমারে খবর দিওনের লাইগ্গা বইসা আছে নাহি?’ বেদু খেঁকিয়ে উঠল। তুলারাম তাকে কর্তৃত্ব দেওয়ার পেছনে তার দুরভিসন্ধি কিছুটা হলেও বুঝতে পারছে সে। দোষারোপ করা।

‘আরে চেতো ক্যান?’ তুলারাম হাস্যরসের সঙ্গে বলে উঠল। ‘আমি আরো ভাবলাম, তুমি কামেল লোক, দুনিয়াসুদ্ধা তামশা দেহায়া বেড়াও তাই তুমার হিসাবই আলাদা,’ বলে সে নিজের লোক দুজনার দিকে তাকিয়ে হেসে উঠল। বেদু রাগের সঙ্গে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তার আগেই তুলারাম নিজের দুই হাত তুলল সম্পর্কের ভঙ্গিতে তারপর বলে উঠল, ‘আরে চেইতো না। চলো, আমি তুমগোরো এক জায়গায় লয়া যাই। আমি নিশ্চিত সেইখানে গেলে আমরা কিছু না কিছু জানতে পারবই,’ বলে সে ইশারা করল সামনে এগোনোর জন্য। বেদু কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেল। আসলেও তো ওরা এখনো তেমন কিছু বের করতে পারেনি। কাজেই যদি তুলারামের পন্থায় কাজ হয় তবে সমস্যা কোথায়। সে চুপচাপ তাকে অনুসরণ করতে শুরু করল।

ওরা বাজার এলাকার একপাশে চলে এলো। এখানে বণিক থেকে শুরু করে ব্যবসায়ীদের জন্য থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা আছে। বাজারের এক কোণে সাদা চুনকাম করা একটা ছোটো ঘরের মতো দেখে তুলারাম সবাইকে ইশারা করে সেটার ভেতরে ঢুকে পড়ল। বেদু চূড়ান্ত বিরক্ত হয়ে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার কথা শোনার মতো কেউই নেই। বাকিরাও ভেতরে ঢুকে গেছে। বেদু তাদের পিছু ঢুকে দেখল ভেতরে এলাহি কারবার চলছে। সে দেখল, তুলারাম ছোটো ঘরটা পার হয়ে অন্যপাশে চলে গেলে। সেখানে ছোটো ছোটো খাটিয়া পাতা। তাতে বসে লোকজন গল্প করছে আর ধোঁয়া টানছে।

‘চণ্ড খানা!’ বেদু অবাক হয়ে বলে উঠল

‘এক্কেরে ঠিক, তামশা মিয়া,’ ওর পাশ থেকে তুলারাম বলে উঠল। ‘আমগো যেসব খবর দেওয়ার হেগুলার লাইগ্গা এর চেয়ে ভালা আর কিছু অইতেই পারে না,’ বলে ওরা দুটো খাটিয়া টেনে নিয়ে মুখোমুখি বসে গেল। কাকে বলতেই সে ছোটো ছোটো গড়গড়ায় করে চণ্ডু সাজিয়ে দিয়ে গেল ওদেরকে। বেদু মনোযোগ দিয়ে জিনিস দেখছে। তুলারাম হেসে উঠল। ‘কি মিয়া, টানবা নাকি?’

বেদু কিছু না বলে চুপচাপ রইল। তার একেবারে ইচ্ছে যে হচ্ছে না তা নয়। কিন্তু টানলে আবার কী না কী হয় ভেসে সে বিরত রইল। বেদু জিনিসটাকে দেখছে, তুলারাম তাকে টিপ্পনী কেটে কিছু এটা বলতে যাচ্ছিল তার আগেই ওদের সঙ্গে থাকা দুই লাঠিয়ালের একজন তুলারামকে হাতের ইশারায় কিছু একটা বলল বেদুও তাকিয়ে আছে ওদের দিকে। তুলারাম মনোযোগ দিয়ে শুনতে লাগল।

ওদের পেছনেই দুই চণ্ডুখোর আলাপ করছে। খুব কান পেতে যে শুনতে হবে তা নয়। কারণ তেমন রাখঢাক নেই। বেশ জোর গলায় আলোচনা চলছে ওদের ভেতরে। বিষয়টা হলো আজ বাজারের ফাঁসির মঞ্চে কারো ফাঁসি দেওয়া হবে। বেদু তুলারামের দিকে ফিরে ইশারা করল, তুলারাম কাঁধ ঝাঁকাল। সে ইচ্ছে করেই খাটিয়াটাকে টেনে নিল খানিকটা ওদের দিকে। কিন্তু আসলে সেটা না করলেও চলত। কারণ লোকগুলা খোলাখুলিই আলাপ করছে। কে নাকি ধরা পড়েছ সন্দ্বীপের বাজার এলাকায়। আজ ফাঁসির মঞ্চে, রাতের বেলাতেই তাকে ফাঁসি দেওয়া হবে।

তুলারামকে চণ্ডু দিয়ে গেছিল যে ছেলেটা তাকে ডাক দিয়ে গল্প করার ছলেই বিষয়টা জানতে চাইল। ছেলেটা উত্তরে যা জানাল তাতে মাথা গরম হয়ে উঠল ওদের। সন্দ্বীপের বাজার এলাকার হাম্মামখানার মালিক ছিল সফদর পাটোয়ারী নামে এক লোক। তার ওখান থেকে দ্বীপের শাসক পর্তুগিজ আর আরাকানিরা কাকে নাকি ধরে এনেছে। তার ফাঁসি দেওয়া হবে আজ। সবাই সেটা দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছে।

লোকগুলোর বক্তব্য পুরোটা শুনে বেদুর কান গরম হয়ে উঠল। সে তুলারামের দিকে ফিরতেই দেখল তুলারামের মুখও শুকিয়ে গেছে। ওদের সঙ্গে আসা কেউ কী তবে ধরা পড়ে গেল।

তাদেরই ফাঁসি দেওয়া হবে নাকি?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *