মগরাজ – ৪৫

অধ্যায় পঁয়তাল্লিশ – বর্তমান সময়

পিবিআই ব্যুরো, চট্টগ্রাম

‘তাহলে সম্পূর্ণ ব্যাপারটা কী দাঁড়াল?’ টেবিলের অন্যপাশে উপবিষ্ট মানুষটা সরাসরি শারিয়ারের দিকে তাকিয়ে আছে। তার দৃষ্টিটাকে কঠোরও বলা যাবে না, আবার খুব বেশি বন্ধুত্বপূর্ণ বলারও কোনো উপায় নেই। ‘আপনি এবং আপনার টিমের কাছ থেকে আমরা পরিপূর্ণ ব্যাখ্যা আশা করছি, এটা তো আপনি বুঝতে পারছেন, বলেই সে একটা হাত তুলল। ‘কারণ স্বল্প সময়ের ভেতরে অনেক কিছু ঘটে গেছে যেগুলোর কোনো ব্যাখ্যা নেই। আরেকটা কথা, আপনি এখন যা বলবেন এর ওপরে নির্ভর করবে আপনার ও আপনার টিমের ক্যারিয়ার। মিস রুম্পা ও আপনার অফিস আমাদের কাছে একটা বিস্তারিত রিপোর্ট পাঠিয়েছে কিন্তু সেটা যথেষ্ট নয়। আমরা টিম লিডার হিসেবে আপনার কাছ থেকে সরাসরি ব্যাখ্যা আশা করছি।’

শারিয়ার নিজের ব্লেজারটাকে টেনে ঠিক করে উঠে দাঁড়াল। টেবিলের চারপাশে বসা সবাইকে দেখে নিল একবার। এখানে তার টিমের সবাই তো আছেই। এমনকি সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারাও অনেকেই উপস্থিত আছে, উপস্থিত আছে ওদের ঢাকা অফিস থেকে আসা বেশ কয়েকজন অফিসার। জংলাটিলা থেকে আসার পর দুদিন পার হয়েছে। আজকে ফরমালি কেসের পুরো রিপোর্ট বয়ান করতে হবে ওকে।

‘আমি আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার একজন অফিসার হিসেবে প্রথমেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি গত কয়েকদিনে বারবার অথরিটি ও আইনের আওতার বাইরে গিয়ে কাজ করার জন্য,’ কথার শেষ অংশটুকু বলার সময়ে ভুবনের দিকে চোখ পড়ল ওর। ভুবনের মুখে হাসি নেই কিন্তু শারিয়ারের ভদ্ৰ কথা শুনে চোখ দুটো হাসছে তার। শারিয়ারও সামান্য চোখ মটকে কথা চালিয়ে যেতে লাগল।

আমি জানি অনেক কিছুই এখনো ঘোলাটে হয়ে আছে জটিল এই কেসে। বিশেষ করে এই কেসের একেবারে শুরু থেকে আমার ও আমার টিমের অনেক অ্যাকশন হয়তো অথরিটির কাছে পরিষ্কার নয়,’ বলে শারিয়ার নিজের টিমের সবাইকে দেখিয়ে বলে উঠল। ‘আমার অলোচনা শুরু করার আগে আমি প্রথমেই একটা কথা পরিষ্কার বলে নেই, আমরা গত কয়েকদিনে যা বলেছি বা করেছি একজন টিম লিডার হিসেবে সবকিছুর দায়িত্ব আমি নিজের কাঁধে তুলে নিচ্ছি। অথরিটির কাছে আমার অনুরোধ থাকবে, আমার টিমের কারো যেন কোনো ধরনের সমস্যা না হয়।’

‘মিস্টার শারিয়ার, আপনি কেসটা বয়ান করুন প্লিজ।’

‘এই কেসের যেখান থেকে শুরু সেই ডক্টর আবদেলের থেকেই শুরু করতে হবে সমস্ত ব্যাপারটা বোঝাতে গেলে। ডক্টর আবদেল তার বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারের এক পর্যায়ে ভারতবর্ষের অসমাপ্ত ইতিহাস নিয়ে কাজ শুরু করেন এবং ভারতবর্ষের নির্দিষ্ট সময়ের ইতিহাসের একটা বিরাট ব্যাপার আবিষ্কার করেন। আজ থেকে প্রায় চারশ বছর আগে সম্রাট শাহ সুজার সঙ্গে জড়িত সেই রহস্য সমাধান করতে গিয়ে তিনি অনেক বড়ো কিছু আবিষ্কার করে বসেন। সেটা কী আমরা কেউই জানি না। জিনিসগুলো যেহেতু আর খুঁজে পাওয়া যায়নি তাই আমি সেটা নিয়ে আর মন্তব্য করব না। তবে এটুকু বলতে পারি আমাদের এক্সপার্টরা এটা নিয়ে ইতোমধ্যেই কাজ শুরু করে দিয়েছে।

‘তো যাই হোক, ডক্টর আবদেলের এই কাজের সহকারী ছিল দুজন। একজন তার পার্টনার ডক্টর ইফতেখার আবদুল্লাহ। যার ট্রেস আমরা এখনো পাইনি। আরেকজন তারই সেক্রেটারি ডক্টর গুলশান, যাকে আমরা এতদিন ডক্টর শশীর ভুয়া পরিচয়ে চিনে এসেছি। ডক্টর আবদেলের সঙ্গে এই মেয়েটাও তার ব্যাপারে অনেক কিছুই জানত কিন্তু একটা সময় ডক্টর আবদেল সম্ভবত আবিষ্কার করেন এই মেয়েটার সঙ্গে উনি জড়িয়েছেন ঠিকই কিন্তু এই মেয়ের আসলে তার প্রতি কোনো টান নেই। এই মেয়ের সমস্ত টান তার আবিষ্কারের প্রতি। এই মেয়ের নিয়ত ভালো নয়। তাই তিনি এই মেয়ের পিছু ছাড়ানোর জন্য চলে আসেন বঙ্গদেশে। তার ধারণা ছিল নিজের দেশ, নিজের মাটি, নিজের মানুষেরা তার আবিষ্কার লুফে নেবে।

‘বাংলাদেশের অথরিটিকে উনি প্রস্তাব দেন যেন গোপনে তাকে এই ব্যাপারে হেল্প করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশের অথরিটি তাকে এই ব্যাপারে কোনো সাহায্য করেনি, উলটো তার লাইসেন্স নিয়ে সমস্যা হয়। যে কারণে রেগে গিয়ে উনি নিজেই বিশ্বের বড়ো বড়ো বেশ কয়েকটা অ্যান্টিক চোরাচালানি সংগঠনের কাছ থেকে হেল্প নেন। এখানে উনি একটা বিরাট মাইন্ড গেম খেলেন। নেক্রপলিস এবং রেলিক নামে দুটো বড়ো প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে আলাদা আলাদাভাবে রিসোর্স নিয়ে উনি নিজের গবেষণা চালিয়ে যান। আসলে উনি আগেই জানতেন, এদের কাউকেই উনি কিছু দিবেন না। ওরা ভাবছিল ডক্টর আবদেলকে তারা ব্যবহার করছে। আসলে তাদের নিয়ে খেলতে শুরু করেন ডক্টর আবদেল। একদিকে ওদের চাপ বাড়ছিল আবার ডক্টরেট শেষ করে তার অসম বয়সের প্রেমিকা গুলশানও তার খোঁজ করতে লেগেছিল। এমন একটা সময় ডক্টর আবদেল স্রেফ পৃথিবীর বুক থেকে হারিয়ে যান। উনি সেই বাড়ির বেইজমেন্টে লুকিয়ে নিজের গবেষণা চালিয়ে যান এবং সফল হওয়ার পর সেগুলোকে নিয়ে নানা ট্রিক্স সাজাতে থাকেন। তার কাজ যখন প্রায় শেষ তখন এক পর্যায়ে উনি নিজের মেয়ে ডক্টর শশীকে চিঠি লিখেন। কিন্তু যখন তিনি এই চিঠি পাঠান তখন তার নিজের মেয়ে ডক্টর শশী মিশরে একটা এক্সকভেশনের কাজে সব নেটওয়ার্কের বাইরে। এই সময়ে সেটা গিয়ে পড়ে এই নকল শশী মানে গুলশানের কাছে। এই মেয়ে এতদিন ধরে এটাই খুঁজছিল। গুলশান আগে থেকেই জানত একটা সময় আসবে যখন তাকে ভুয়া পরিচয়ে ডক্টর আবদেরের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করতে হবে। কাজেই সে আগে থেকেই ডক্টর আবদেলের মেয়ের নামেই নিজের ভুয়া আইডি, পাসপোর্ট, সোশাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট বানিয়ে রেখেছিল, যাতে প্রয়োজনে সেগুলো ব্যবহার করতে পারে। তো ডক্টর আবদেলের চিঠি হাতিয়ে সে নিজের নাম পরিচয় লুকিয়ে ভুয়া আইডি পাসপোর্ট নিয়ে ডক্টর শশী সেজে বাংলাদেশে আসে এবং সম্ভবত তখনই রেলিক এবং নেক্রপলিসের নজরে পড়ে যায়। যখন ডক্টর আবদেলের চিঠিতে তার বাড়ির সামনে উপস্থিত থাকার কথা ছিল তার মেয়ে শশীর, তার অনেক আগেই গুলশান সেখানে গিয়ে ডক্টর আবদেলের ডেরা খুঁজে বার করে সেখানে হানা দিয়ে তার লকেট চুরি করে পালাতে থাকে। তার পিছু নিতে গিয়ে ডক্টর আবদেল গাড়ি চাপায় মারা পড়ে। গুলশান যখন ডক্টর আবদেলের ওখানে যাচ্ছিল ওই সময় তাকে অনুসরণ করে হুয়ানের লোকেরা। গুলশান ওদের ছাড়িয়ে ফেলে। কিন্তু নেক্রপলিস অর্থাৎ মিস্টার ইউয়ের লোকেরা ঠিকই তাকে কবজা করে। কিন্তু ওই সময় পুলিশ চলে আসাতে তারা রাস্তা দিয়ে না গিয়ে পেছনের পুকুর দিয়ে ডকইয়ার্ডে চলে যায়। নেক্রপলিসের পক্ষ থেকে ওখানকার ইউনিয়নের শ্রমিকদের ঘুস দিয়ে গুলশানকে ওখানে আটকে রাখার ব্যবস্থা করে মিস্টার ইউ।’

‘তার মানে গুলশান যখন সেদিন রাতে ডক্টর আবদেলের ওখানে যায় সেখানে দুটো গ্রুপই তাকে অনুসরণ করে ধরার চেষ্টা করছিল?’ এক প্রতিনিধি জানতে চাইল।

‘অনেকটা তাই, স্যার। এই ব্যাপারে আমার রিপোর্টে বিস্তারিত লেখা আছে। তবে আমি সংক্ষেপে বলছি। একদিকে নেক্রপলিস তাকে বন্দি করে, কিন্তু ওরা ঠিক তাকে নিয়ে মুভও করতে পারছিল না। আবার বুঝতেও পারছিল না এই মেয়েকে তারা কীভাবে কাজে লাগাবে। অন্যদিকে হুয়ান সব হারিয়ে পাগল হয়ে ওঠে। আবার ডক্টর আবদেলের মৃত্যু সংবাদে সে উন্মাদে রূপ নেয়। কিছু করতে না পেরে সে একবার তার ডেরায় হানা দেয়ার প্লান করে, না পেরে তার লাশ চুরি করার চেষ্টা করে। সেখানেও না পেরে সে আমাকে কিডন্যাপ করার চেষ্টা করে। সেখানেও আমার আর ভুবনের ভেতরে গণ্ডগোল লাগিয়ে ভেজাল লাগাতে সে চেয়েছিল সে ডক্টরের ডেরায় হানা দিতে চায়। ওখানে ব্যর্থ হয় এবং এরপরের কিছু ব্যাপার তো সবাই জানেন,’ বলে সে টানা বলে গেল কীভাবে ব্লু বের করে ডক্টর শশীকে কোথায় বন্দি করে রাখা হয়েছে বের করল। শশী কীভাবে ওদের ধোঁকা দিতে চাইছিল এসব বলে গেল টানা। একটানা কথা বলে শারিয়ার থামল।

‘আর সেই ডক্টর আবদেলের গবেষণার বিয়ষটা?’

‘ডক্টর আবদেলের বিয়য়টা আমি এখনো ঠিক বুঝতে পারছি না। সে এতগুলো বছর ধরে যা করল সেগুলোকে এভাবে হারিয়ে যেতে দেবার কথা নয়। তবে এখান থেকে আমরা একটা ব্যাপার বুঝতে পেরেছি, সে যা সাজিয়ে রেখেছিল সেগুলো সবই ছিল ধোঁকার প্রলেপ লাগানো। সম্ভাব্য অনুসন্ধানকারীদের ধোঁকা দেওয়ার জন্য। তবে এসব সমাধান করতে চাইলে আমাদের কিছু কাজ করতে হবে। প্রথমত, রাজদ্রোহী কী বের করতে হবে। এর সঙ্গে আমাদের এক্সপার্টদের দিয়ে ডক্টর আবদেলের সেই গবেষণার চিত্রটা আরো বিশদ নিরীক্ষা করাতে হবে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যেটা সেটা ডক্টর আবদেলের পার্টনার ইফতেখার আবদুল্লাহকে খুঁজে বের করতে হবে। একমাত্র তবেই এই কেসের পুরো সমাধান সম্ভব,’ বলেই সে যোগ করল, ‘আমাদের এক্সপার্টরা এটা বুঝতে পেরেছে রাজদ্রোহীতেই আছে ডক্টর আবদেলের হেঁয়ালির সমাধান।’

এরপর একে একে আরো প্রশ্ন ও উত্তর চলার পর মিটিং শেষ করে বাইরে এসে শারিয়ার একটা সিগারেট ধরাল। করিডরে দাঁড়িয়ে টানতে টানতে সে হাঁটতে লাগল। রুম্পা পেছনে থেকে ডেকে উঠল। ‘মিস্টার শারিয়ার, আপনার সঙ্গে আমার বোঝপড়া কিন্তু বাকি,’ মৃদু হেসে বলে উঠল সে।

শারিয়ার সিগারেট জোরে টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলে উঠল, ম্যাডাম, কেসের কাজও এখনো বাকি। কাজেই নো চিন্তা। আসলে আপনাকে আমার সরি বলা উচিত,’ শরিয়ার হেসে উঠে তাকিয়ে রইল তার দিকে।

রুম্পা হেসে উঠল। ‘যদি কিছু মনে না করেন আমি এই কেসের পরবর্তী ধাপে আপনাদের সঙ্গে কাজ করতে চাই। আর ঢাকা থেকে পাশা স্যার রাজদ্রোহীর নামে যে জিনিসটা পাওয়া গেছে সেটা নিয়ে গবেষণা করতে ও ডক্টর আবদেলের পার্টনারকে খুঁজে বের করতে পরবর্তীতে কাজ করার জন্য ময়মনসিংহ থেকে একজন অফিসার আসছে এবং সবাইকে নিয়ে মিস্টার তানভীরের নেতৃত্বে টিম আলফা’ নামে একটা দল বানানো হচ্ছে। পাশাপাশি এই টিম বাংলাদেশে নেক্রপলিস ও রেলিকের অ্যাক্টিভিটি প্রিভেন্ট করা নিয়েও কাজ করবে। আমি এই টিমের সঙ্গে থাকতে চাই।’

শারিয়ার মাথা নাড়ল। ‘আমি চেষ্টা করব। তবে আমার একটা অনুরোধ আছে, সম্ভব হলে আমি ডক্টর শশী,’ বলেই সে জিভ কাটল। ‘মানে ডক্টর গুলশানের সঙ্গে আলাপ করতে চাই।’

‘অবশ্যই,’ বলে রুম্পা তার একজন অফিসারের সঙ্গে গাড়িতে করে ওকে পাঠিয়ে দিল সেই কাস্টডিতে যেখানে গুলশানকে বন্দি করে রাখা হয়েছে।

***

যেখানে গুলশানকে রাখা হয়েছে সেটা ঠিক নিয়মিত সেল বা জেলখানা নয়। থানার ভেতরে যেসব সেল বা কয়েদখানা থাকে সেগুলোতে বন্দিদের চব্বিশ ঘণ্টার বেশি রাখার নিয়ম নেই। এই সেলটা বিশেষ অপরাধীদের জন্য আলাদাভাবে বানানো এবং বিশেষ অপরাধীদের রাখার জন্যই ব্যবস্থা করে রাখা। সাধারণ সেল থেকে অনেক উন্নত এবং পরিচ্ছন্ন। কিন্তু বেলা শেষে জেলখানা জেলখানাই, আর কয়েদি কয়েদিই।

গুলশানকে দেখেও তাই মনে হলো শারিয়ারের। সেলটা পরিচ্ছন্ন হলেও সেটাতে থাকা গুলশানকে দেখে খুব বেশি খুশি মনে হলো না। এই কদিনে তার ওজন কমেছে বেশ অনেকটা, চোখের কোণে কালিও দেখা গেল। ওকে দেখতে পেয়ে যেন খুশিই হলো এমনভাবে খানিকটা হেসে উঠল সে। শারিয়ারও একগাল হেসে এগিয়ে গেল ওর দিকে। জেলখানার বিশেষ ধূসর রঙের পোশাকে তাকে দেখতে খুবই অদ্ভুত লাগছে।

সেলের গরাদের দিকে এগিয়ে গিয়ে মৃদু হেসে শারিয়ার বলে উঠল, ‘আমি সরি,’ বলে সে পকেটে হাত ঢোকাল। সেলের ভেতরে একটা বিছানার মতো জায়গায় শুয়ে ছিল গুলশান। শারিয়ারকে আসতে দেখে উঠে বসেছিল সে ওটাতে। ওকে সরি বলতে দেখে এগিয়ে গেল গরাদের দিকে। দুই কাঁধ ঝাঁকিয়ে অদ্ভুত একটা ভঙ্গি করে সে বলে উঠল, ‘সরি, তো মনে হয় বলা উচিত আমার। তুমি কেন সরি বলছো?’

শারিয়ারের একটা হাত এখনো পকেটে ঢোকানো। অন্যহাতের একটা আঙুল তুলে সে বলে উঠল, ‘সরি বললাম কারণ সেদিন আমি একটু বেশিই রুড ব্যবহার করে ফেলেছিলাম,’ বলে সে আরেক দফা হেসে যোগ করল। ‘সে-জন্য ঘুসও নিয়ে এসেছি,’ এবার পকেট থেকে অন্য হাতটা বের করে আনল সে। তাকে এক প্যাকেট সিগারেট। ‘জলদি নাও, যদিও কাজটা কোনোমতেই আইনসমৃদ্ধ হচ্ছে না কিন্তু তবুও বন্ধু বলে কথা,’ বলে সে প্যাকেটটা গরাদের ফাঁক দিয়ে এগিয়ে দিল গুলশানের দিকে। কিন্তু মেয়েটা প্যাকেটটা ওর হাত থেকে না নিয়ে তাকিয়ে রইল ওর চোখের দিকে। ‘এখন আমাকে বন্ধু ভাবার মতো ভাবালুতা দেখানোর কারণটা জানতে পারি?’ বলে সে খপ করে টান দিয়ে প্যাকেটটা নিয়ে নিল। সেটা থেকে একটা সিগারেট বের করে ঠোঁটে লাগিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচালো। শারিয়ার একটা ম্যাচ বক্স এগিয়ে দিল তার দিকে। সেটা থেকে একটা কাঠি বের করে সিগারেটে আগুন দিয়ে ম্যাচটা ওর দিকে ছুঁড়ে দিল সে। ‘আমার প্রশ্নের জবাব পাইনি আমি। একজন ক্রিমিনালের জন্য এত ফেভারের কারণ জানতে হবে আমার।’

শারিয়ার গরাদে হেলান দিল। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সে বলে উঠল, ‘দেখো শশী,’ বলেই সে নিজেকে শুধরে নিল। ‘সরি, গুলশান। আসলে তুমি যা করেছ সেটাকে প্রতিরোধ করাটা আমার ডিউটি ছিল। আর আমি সেটা করেছিও কিন্তু তারপর আমি অনেক ভেবেছি, কেন জানি মনের গহিন কোণে তোমার কাজের জন্য আমি কোনো অপরাধবোধ খুঁজে পাইনি। আসলে, ব্যাপারটা বোঝানো আমার পক্ষে সম্ভব না,’ বলে সে কাঁধ ঝাঁকাল। ‘আমি ব্যাপারটাকে যেভাবে ভাবছি, তোমার কাজ তুমি করেছ, আর আমার কাজ আমি করেছি, এই জায়গাতে দুজনার কনফ্লিক্ট আমাদের একজনকে গারদের এপাশে অন্যজনকে অন্যপাশে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। কিন্তু কেন জানি আমি তোমার কষ্টটা অনুভব করতে পারছি। তুমি একটা স্বপ্নের পেছনে ধাওয়া করেছ। আর সে-জন্য তুমি যা করার করেছ। কাজেই…’

শারিয়ার গুলশানের দিকে ফিরে আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলকিন্তু সে দেখতে পেল মেয়েটার চোখে পানি। ‘আবদেল…’ বলে সে নিজেকে খানিকটা সামলে নেয়ার চেষ্টা করল। ‘আবদেল আর আমার সম্পর্কটা আসলে, কী বলব। কখন কীভাবে গুরু-শিষ্য থেকে প্রেমিক-প্রেমিকা হয়ে গেলাম সেটা আমরা দুজনার কেউই ধরতে পারিনি। আমি তার কাছ থেকে শিখেছি, স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছি। কিন্তু একটা সময় এসে আমরা দুজনেই বুঝতে পারছিলাম কিছু একটা যেন ঠিক মিলছে না আমাদের দুজনার মাঝে। যতই আমরা পরস্পর থেকে দূরে সরে যাচ্ছিলাম ততই আমি ডেসপারেট হয়ে উঠছিলাম তার কাছাকাছি যাওয়ার জন্য। বিশেষ করে আমি জানতাম সে এখানে কী নিয়ে কাজ করছে। আমি জানতাম তার এই আবিষ্কার অনেক কিছুই বদলে দেবে, আর তাই আমি আরো অনেক বেশি ডেসপারেট হয়ে উঠছিলাম। আর আবদেলও বুঝতে পারছিল আমি লোভী হয়ে উঠেছি। শুধু সম্পদের জন্য নয়, আবিষ্কারের নেশাও পেয়ে বসেছে আমাকে আর তাই,’ বলে সে মৃদু স্বরে যোগ করল। ‘আবদেল সবসময় বলত, ‘ফলো ইয়োর হার্ট’ আর আমি বলতাম হৃদয়ের কাছাকাছি,’ বলে তার মুখ থেকে সিগারেটে ধোঁয়া আর দীর্ঘ নিশ্বাস একসঙ্গে বেরিয়ে এলো। ‘এখন তো সবই শেষ হলো।’

‘সেদিন রাতে…’

‘শশীর কাছে যে চিঠিটা পৌঁছেছিল সেটা আমার হাতে পড়ার পেছনে একটা কারণ ছিল,’ গুলশান খানিকটা বিরতি দিয়ে বলে উঠল। শশী মানে আবদেলের মেয়ে গেছিল দীর্ঘ সময়ের জন্য সাইটে কাজ করতে। আমি জানতাম আবদেল যদি কখনো কারো সঙ্গে যোগাযোগ করে তবে সেটা হবে শশী। আর তাই শশীর ওপরে নজর রাখা ছিল আমার। চিঠিটা বেনামে গেলেও আমি ঠিকই বুঝতে পারি সেটা আবদেলই পাঠিয়েছে এবং সেটাকে হস্তগত করার পর খুলেই আমি খুশি হয়ে উঠি। পরিকল্পনা আগেই করা ছিল আমার। তুমি ঠিকই ধরেছিলে, এমনকি শশীর নামে সব ভুয়া ডকুমেন্টেশনও করা ছিল যাতে আমি যখন চাই, শশীর নাম নিয়ে আবদেলের খোঁজে বেরিয়ে পড়তে পারি। কারণ আমি জানতাম একমাত্র এভাবেই আমি আবদেলের সবচেয়ে কাছাকাছি পৌছাতে পারব। আর একটা সময় সেটা সত্যিও প্রমাণিত হতে শুরু করে। আমি বাংলাদেশে পৌছে ভুয়া পরিচয়ে খোঁজখবর করতে শুরু করি। কারণ আবদেল চিঠিতে কোথায় দেখা করবে জানালেও তার পরিচয়টা পিন পয়েন্ট করেনি। এমনকি সেও এটা জানত যে, যতই সাবধানতা অবলম্বন করুক না কেন এই চিঠি অন্য কারও হাতে পড়ে যেতেই পারে। তাই আমি এসে খোঁজ-খবর করতে শুরু করি…’

‘…এবং সম্ভবত তখুনই তুমি হুয়ান আর মিস্টার ইউয়ের লোকদের চোখে পড়ে যাও,’ শারিয়ার বলে উঠল।

‘ঠিক, আমি বুঝতে পারছিলাম বিভিন্ন গ্রুপের লোকদের চোখে পড়ে গেছি। তাই সতর্কতাও অবলম্বন করতে শুরু করি। কিন্তু হুয়ানের লোকদের পিছু ছাড়াতে পারলেও মিস্টার ইউয়ের প্রফেশনালদের পারিনি। ওরা ঠিকই আমাকে অনুসরণ করে পৌঁছে যায় আবদেলের বাসার সামনে, গুলশনের গলায় আফসোসে সুর।

‘তারপর ওইখানে কী হয় ওইদিন?’

‘আমি নির্দিষ্ট সময়ের আগেই পৌছে যাই জায়গামতো। আমি জানতাম আবদেল যদিও তার ঠিকানা পিন পয়েন্ট করেনি কিন্তু সে ঠিকই ওই জায়গার আশেপাশেই আছে। তার সঙ্গে দীর্ঘদিন থাকার ও কাজ করার ফলে তার অনেককিছুই আমি বুঝতাম। জায়গামতো যেতেই শুরু হয় বৃষ্টি। তারপরও আমি ঠিকই চারপাশটা রেকি করে সেই বেইজমেন্টে গিয়ে পৌঁছাই। ওর কামরাতে ঢুকে লকেটটা সবে হাতে তুলেছি হঠাৎ আমাকে দেখে ফেলে। কেন জানি আমি পালাতে শুরু করি। আর সে আমার পিছু নেয়।’

‘ব্যাপারটা তো উলটা হওয়ার কথা ছিল, শারিয়ার আরেকটা সিগারেট বের করে ঠোঁটে লাগিয়ে ওটা ধরিয়ে এগিয়ে দিল গুলশানের দিকে। ‘তুমি না তার পিছু নিয়ে বেড়িয়েছো এতদিন।’

‘হ্যাঁ, তাই হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু মুহূর্তের ভেতরে কী জানি কী হয়ে গেল,’ গুলশান সিগারেটটা হাতে নিয়ে তাতে টান দিয়ে আনমনেই একবার কাঁধ ঝাঁকাল। যার জন্য এত অপেক্ষা, যাকে খুঁজে বের করার জন্য এত এত আয়োজন তাকে দেখার পরে কেন জানি নিজেকে সামলাতে পারলাম না। এভাবে চুরি করে আবদেলের সামনে পড়তেই কী যে হয়ে গেল। সোজা উলটো ঘুরে দৌড়াতে শুরু করলাম…’ গুলশানের ফুসফুসের ভেতর থেকে আফসোসের দীর্ঘশ্বাস আর সিগারেটের ধোঁয়া দুটোই একসঙ্গে বেরিয়ে আসছে। ‘এরপরে বাকিটা তো তোমরা সবাই জানোই…’

‘কিন্তু আমার একটা কথা ছিল,’ শারিয়ার হেলান দেওয়া থেকে সোজা হয়ে দাঁড়াল। ‘যে জিনিসের জন্য, মানে যে আবিষ্কারের জন্য এত আয়োজন, ডক্টর আবদেল কী সেটা আসলে খুঁজেই পায়নি?’

‘অবশ্যই সে খুঁজে পেয়েছে…’

‘কিন্তু তাহলে এত গোল ঘুরিয়ে তবে…’

‘সে খুঁজে পেয়েছে দেখেই সবাইকে ধোঁকা দেয়ার জন্য এত আয়োজন করে রেখেছে। সে যা আবিষ্কার করেছে তা অবশ্যই আছে সবার চোখের সামনেই আছে। কিন্তু সেটা বের করাটা এখন অসম্ভব একটা ব্যাপার হবে।’

‘কোনো সাজেশন আছে?’ শারিয়ার আনমনেই জানতে চাইল।

গুলশান ওর দিকে চোখ তুলে তাকাল। তারপর হাতের সিগারেটটা নিচে ফেলে দিয়ে বেশ জোরেই হেসে উঠল। ‘স্রেফ সিগারেট খাইয়ে এত দামি ব্লু বের করতে চাও, অফিসার? এই জন্যই তবে তোমার এখানে আগমন?’

‘হা-হা,’ গুলশানের কথা শুনে হেসে উঠল শারিয়ার। ‘না সে-জন্য নয়। বন্ধুত্বের জন্য এখানে আগমন,’ বলে সে সরাসরি তাকাল গুলশানের চোখের দিকে। ‘হতে পারে তুমি আইনের চোখে অপরাধী কিন্তু এরমানে এই না যে আমাদের ভেতরে বন্ধুত্ব হতে পারবে না,’ বলে সে গরাদের ফাঁক দিয়ে নিজের ডান হাতটা হ্যান্ড শেইকের ভঙ্গিতে এগিয়ে দিল গুলশানের দিকে। ‘ফ্রেন্ড?’

গুলশান মৃদু হেসে সেটা ধরে সামান্য ঝাঁকি দিল। ‘ফ্রেন্ড।’

‘তবে বিদায় এখন। আমি আবার আসব,’ বলে শারিয়ার পেছন ফিরে হাঁটতে শুরু করতেই পেছন থেকে গুলশান কথা বলে উঠল।

‘প্রথম কথা, আবদেলের এই রহস্যের সমাধান করতে হলে তোমাদের তার পার্টনার ডক্টর আবদুল্লাহকে খুঁজে বার করতে হবে। এছাড়াও আরেকটা ব্যাপার আছে। আবদেল সবসময় বলত, ‘ফলো ইউর হার্ট’। সে যা আবিষ্কার করেছিল সেটা পেতে হলে শুধু ব্লু-ক্যালকুলেশন আর অ্যাকশনে কাজ হবে না, নিজের হৃদয় কী বলে সেটাও শুনতে হবে।’

ঘাড় ঘুরিয়ে না তাকালেও গুলশানের কথা শুনে মৃদু হেসে উঠল শারিয়ার।

‘আগের কথাটা আমার বন্ধুকে বললাম। এবার অফিসার শারিয়ারকে বলছি; ডক্টর আবদেলের রহস্যের সমাধান করতে হবে তোমাদের। রাজদ্রোহীর রহস্যকে বুঝতে হবে। আবারও বলছি খুঁজে বের করতে হবে আবদেলের অ্যাকাডেমিক পার্টনারকে।’

পেছন ফেরা অবস্থাতেই মৃদু কাঁধ ঝাঁকিয়ে বাইরের দিকে রওনা দিল শারিয়ার।

***

কাস্টডির বাইরে বেরিয়ে সে দেখল বাইরে সন্ধের অন্ধকার নেমে আসছে। আর তার ভেতরে মুখে বত্রিশ ভোল্টের হাসি লটকে ভুবন দাঁড়িয়ে আছে। ‘কী বস, তবে কী এখান থেকেই বিদায়?’

শারিয়ার এগিয়ে এসে তার পিঠে একটা হাত রাখল। ‘শোন বিদায় তো দূরে, তোর সঙ্গে অনেক কাজ আছে,’ বলে সে হাঁটতে হাঁটতে ঢাকায় গঠিত হতে যাওয়া স্পেশাল টিমের ব্যাপারটা বলল এবং সে যে তাকে ওটাকে ইনক্লুড করতে চায় সেটাও জানাল।

‘আরে এটা তো বিরাট একটা ব্যাপার। ওই সিকিউরিটি কোম্পানির ফালতু কাজের বদলে তোমাদের স্পেশাল টিমে কাজ করব, আমার জন্য অনেক বড়ো পাওয়া,’ বলেই সে হেসে উঠে যোগ করল, ‘আগে দুটো বিড়ি দাও, বস।’

‘কাজও দিলাম আমি। বিড়িও খাওয়াব আমি,’ আফসোসের সঙ্গে মাথা নাড়ল শারিয়ার। দুজনে দুটো সিগারেট ধরিয়ে টানতে টানতে ভুবন বলে উঠল। ‘বস কাজ যে করবে শুরু করব, কোথা থেকে? রাজদ্রোহীর রহস্যের তো কোনো আগামাথা বোঝা যাচ্ছে না…’ ইচ্ছে করেই বাক্যটা শেষ করল না সে।

শারিয়ার চিন্তিত মুখে তাকে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তার আগেই সে একটু আগে গুলশানের বলা কথাটা বিড়বিড় করে বলে উঠল, ‘ফলো ইয়োর হার্ট,’ বলেই বিড়িটা ফেলে দিয়ে সে বলে উঠল, ‘ভুবন চল তো, সে আবার অফিসের ভেতরে চলে এলো। ভেতরে এসে অফিস রুমে ঢুকে দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসারের কাছে জানতে চাইল, ‘আচ্ছা, ভেতরে গুলশান নামে যে বন্দি আছে, তার জিনিসপত্র কোথায় রাখা আছে?’ দায়িত্বে থাকা অফিসার ওদের দুজনকে দেখে নিয়ে বলে উঠল, ‘কিন্তু সেটার জন্য তো স্পেশাল পারমিশন লাগবে।’

এরপরের আধাঘণ্টায় অফিসারকে রুম্পার সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেয়ার পর সে সেল নম্বর মিলিয়ে গুলশানের জিনিসপত্র বের করে দিল ওদেরকে।

শারিয়ার বাক্সটা ঘাঁটতে শুরু করল।

‘বস, কী করছো বলো তো?’

‘এক মিনিট,’ ঘাঁটতে ঘাঁটতে সে ডক্টর আবদেলের ওখান থেকে শশীর আনা লকেটটা বের করে আনল। ওটাকে উলটেপালটে দেখতে দেখতেই ওটার এক জায়গায় চাপ দিতেই ওটার ছোট্ট একটা অংশ খুলে গিয়ে ভেতর থেকে বের হয়ে এলো মোড়ানো পুরনো এক টুকরো চামড়ার মতো কাগজ, সেটার ভেতর থেকে বের হলো ছোট্ট একটা মাইক্রোচিপ।

‘ফলো ইয়োর হার্ট, হৃদয়ের কাছাকাছি,’ বলে সে মাথা নাড়ল। ‘পিওর জিনিয়াস,’ বলেই সে হেসে উঠল ভুবনের দিকে তাকিয়ে।

ভুবন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। দুই পা এগিয়ে গিয়ে খুশির অতিশয্যে তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল শারিয়ার। ‘বুঝতে পারছিস ব্যাপারটা?’

‘হচ্ছেটা কী বলো তো বস?’ ভুবন অবাক হয়ে জানতে চাইল।

চিপটাকে চোখের সামনে তুলে ধরতে ধরতে শারিয়ার বলে উঠল, ‘ডক্টর আবদেলের রাজদ্রোহীর ব্লু,’ বলে সে চিপটাকে পকেটে রেখে দিল। তারপর জিনিসগুলো আগের মতো গুছিয়ে রেখে বাক্সটা অফিসারের কাছে জমা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো দুজনে।

ভুবন অনেক কিছু বলতে যাচ্ছিল তার আগেই শারিয়ার তার পিঠের ওপরে একটা হাত রাখল। ‘বুঝিয়ে বলছি। ডক্টর আবদেলকে আসলে আমরা যাতটা বুদ্ধিমান ভেবেছিলাম উনি তার চেয়েও অনেক বেশি বুদ্ধিমান ছিলেন। উনি লোকচক্ষুর অন্তরালে যাওয়ার পর দীর্ঘ সময় ধরে গবেষণা করে যা আবিষ্কার করলেন উনি জানতেন চাইলেও বা না চাইলেও এটা ভুল লোকের হাতে পড়বেই। তাই সম্ভবত উনি উনার প্রকৃত আবিষ্কার এবং এর সমস্ত ক্লু ঢুকিয়ে ফেলেন এই চিপের ভেতরে। আর অন্যদিকে সে সম্ভাব্য শত্রুদের জন্য একে একে ফাঁদ পাততে শুরু করেন দেয়ালচিত্র থেকে শুরু করে সবখানে।

‘মানে আমরা গত কয়েকদিন ধরে যা অনুসরণ করেছি সবই বোকামি ছিল? মাথা চুলকাতে চুলকাতে ভুবন বলে উঠল।

‘হা-হা,’ শারিয়ার মৃদু হেসে উঠল। ‘সে আর বলতে। তো উনি একদিকে চিপটা সাজালেন, অন্যদিকে পুরো হোক্স সাজালেন সম্ভাব্য শত্রুদের ধোঁকা দেয়ার জন্য। উনি সেই অনুযায়ী ভুয়া চিঠিও পাঠালেন তার মেয়ের কাছে। উনি জানতেন এই চিঠি ভুল লোকের হাতে পড়বেই। আর সবাই তাই মনোযোগ দেবে চিঠির দিকে, লকেটের দিকে নয়। আর মূল জিনিসটা যেহেতু লকেটের ভেতরেই ছিল কাজেই সেটার ব্লু দিলেন উনি ভিন্নভাবে। উনার ইচ্ছে ছিল লকেটটা সরাসরি মেয়ের হাতে তুলে দিবেন, কিন্তু সেটা আর পারেননি…’

‘ফলো ইয়োর হার্ট,’ বলেই তালি দিয়ে উঠল ভুবন। নিজের ডান হাতটা মুঠো করে বুকে ধুপ ধুপ করল দুবার। ‘ফলো ইয়োর হার্ট কথাটায় আসলেই আক্ষরিক অর্থের হৃদয়ের সবচেয়ে কাছাকাছি থাকা লকেটটাকেই বুঝিয়েছেন উনি, শালা কী সাংঘাতিক। আর আমরা কি না…’

‘আফসোস করিস না,’ বলে শারিয়ার তার দিকে একটা সিগারেট এগিয়ে দিল। ‘সিগারেট খা, আর কাজের প্রস্তুতি নিতে হবে অনেক।’

‘এখন কী করবে?’ সিগারেট ধরাতে ধরাতে ভুবন জানতে চাইল।

ঢাকায় গিয়ে তানভীরকে টিম সাজাতে হেল্প করতে হবে,’ বলে পকেটে টোকা মারল। ‘এই চিপে কী আছে সেটা বের করতে হবে। আর রাজদ্রোহী আসলে কী? এই কেস বা এই চিপের সঙ্গে এর সম্বন্ধ কী খুঁজে বের করতে হবে,’ বলে সে নিজের হাতের সিগারেটটা তাক করল ভুবনের দিকে। সবচেয়ে বড়ো কথা রেলিক আর নেক্রপলিসের দুজনকে ধরেছি আমরা।’

‘হুয়ান আর মিস্টার ইউ।’

‘এদের দুজনার উপস্থিতি এবং ধরা পড়া প্রমাণ করে এরা সরাসরি আমাদের দেশে অপারেট করতে শুরু করেছে। কাজেই এদের সঙ্গে এবার সরাসরি সংঘাত শুরু হয়ে যাবে আমাদের। বিশেষ করে এদের আগে আমাদের খুঁজে বের করতে হবে মিস্টার আবদেলের পার্টনারকে।’

‘ওরে বাবারে বাবারে। তোমার কাহিনি তো দেখি সিনেমা না টিভি সিরিজের মতো লম্বা হচ্ছে।’

‘হা-হা, সিরিজই শুরু হতে যাচ্ছে সামনে,’ বলে সে একটা হাত রাখল ভুবনের কাঁধে। ‘আমি জীবনে খুব বেশি বই পড়িনি ভুবন, কিন্তু কেন জানি আজ নাইন-টেনে থাকতে পড়া একটা বইয়ের কথা খুব মনে পড়ছে।

‘কোনটা বস?’

রাত নেমে আসছে, হাজার বছরের পুরনো রাত,’ বলেই হেসে উঠল দুজনে একসঙ্গে। দুজনে হেঁটে এগোতে লাগল রাস্তা ধরে। হাজার বছরের পুরনো রাত নেমে আসছে বন্দর নগরী চট্টগ্রামের বুকে।

অতীত
আকরাম বেগের কাছারিবাড়ি, চট্টগ্রাম

আকরাম বেগের চোখের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে কিরান। ‘আপনার কাছে আমার অনেককিছু জানবার আছে এটা কী আপনি বুঝতে পারতাছেন?

আকরাম বেগ গড়গড়ায় টান দিতে দিতে একবার কিরানকে দেখল, তারপর ওর সঙ্গে থাকা গোমেজ, বেদু, পট্টবর্ধন এবং পদ্ম। সেই সঙ্গে ওদের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা পদ্মের বাহিনীর কয়েকজনের দিকে ফিরে দেখল। তারপর মৃদু হেসে উঠল। ‘তুমি কী জানতে চাও আমি জানি, কিন্তু তুমার জানতে চাইবার অধিকার যেমন আছে ঠিক একইভাবে কতোটুক বলব সেই অধিকারও আমার আছে।’

কিরান আপনাতেই একবার তার দুইপাশে থাকা নিজের লোকদের দিকে দেখে নিল। জংলাটিলাতে সিলভেরাকে নিয়ে তালেব তৈমূর লাফ দেবার পর বেশ কয়েকদিন পার হয়ে গেছে। এই কয়দিনে ঘটে গেছে অনেক ঘটনা। আরাকান বাহিনী অনেকটাই পিছিয়ে গেছে সিলভেরার মৃত্যু সংবাদ শোনার পর। সেই সঙ্গে চট্টগ্রামে আরাকানিদের ভেতরে শুরু হয়েছে নানা ধরনের গুঞ্জন। চারপাশের পরিস্থিতি উত্তপ্ত। এর ভেতরেই কিরান আর পদ্মের বাহিনী মিলে জংলাটিলার চারপাশের পানিতে অনেক খোঁজখুঁজি করে সিলভেরার লাশ পেলেও কোথাও পায়নি তালেব তৈমূরের লাশ। পেছন দিকে পাহারায় থাকা সিলভেরার জাহাজটাকেও ওরা আর খুঁজে বের করতে পারেনি। পরিস্থিতি খানিকটা শান্ত হওয়ার পর ওরা রাতের আঁধারে লুকিয়ে এসেছে আকরাম বেগের সঙ্গে দেখা করতে।

‘আপনারে সবটাই বলতে হবে, চাচাজান। আপনি শুরু থেইকা সবই জানতেন। কিন্তু আমার কাছে অনেক কিছুই লুকাইছেন, এমনকি তোমরাও, শেষ কথাটা সে নিজের হাত তুলে পট্টবর্ধন আর পদ্মকে দেখাল।

আরও উত্তেজিত হয়ে সে আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল। তার আগেই আকরাম বেগ উঠে দাঁড়িয়ে এগিয়ে এলো ওর দিকে। কিরানের হাতটা একহাতে নামিয়ে দিল সে। ‘কিরান, তুমি চাঁটগাওয়ের ব্যবসায়ীগো লাইগা অনেক কিছু করছো, এমনকি দক্ষিণের মানুষগো লাইগাও। সিলভেরার মরণের পরে ওগো শক্তি কিছুটা হইলেও কমব। আর দক্ষিণের সাগর জলদস্যু মুক্ত করতে নতুন ব্যবস্থা হইতাছে, সেইটাও বলতাছি। কিন্তু তার আগে শোনো আসলে হইছিল কী,’ এটুকু বলে সে আবার চেয়ারে বসে গড়গড়ার নলটা মুখে নিয়ে নিল। চিন্তিত ভঙ্গিতে গড়গড়ায় দুবার টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলে উঠল, ‘কিছু বিষয় তুমগো জানার অধিকার আছে। ম্রোহঙে সম্রাট শাহ সুজার পরিবারে হামলার পর ম্রোহঙের কাছের জঙ্গল থেইকা তৈমূর যখন পলায় তখন ওইখানে জাহাজ ছিল আসলে দুইটা। একটা ছোটো আর একটা বড়ো। ছোটো জাহাজটা ছিল হালকা পালের দ্রুত গতির। ওই জাহাজটা নিয়া আরাকানিরা বেড়ে দেয়ার অনেক আগেই তৈমূর চট্টগ্রামে চইলা আসে। আর অন্য বড়ো জাহাজটা সন্দ্বীপ জংলাটিলা এলাকায় ঘুরতে থাকে, যেইটারে সবাই অনুসরণ করছে।’

‘শাহ সুজার সম্পদ আসলে কোনোটাতে ছিল?’ কিরান ভ্রু কুঁচকে জানতে চাইল।

‘তুমার এই প্রশ্নের জবাব আমি পরে দেব,’ কিরানের দিকে একটা আঙুল তুলে কথাটা বলে আকরাম বেগ আবারও গড়গড়ায় দু-বার টান দিল। তৈমূর চট্টগ্রামে আইসা আমার লগে দেখা কইরা জানায় তার কাছে একটা পরিকল্পনা আছে। শাহ সুজারে সে বাঁচাইতে পারে নাই। কিন্তু দক্ষিণের সাগরে সিলভেরা আর আরাকানিদের ত্রাশ থেইকা মুক্ত করতে চাইলে এইটা একটা বিরাট সুযোগ। কারণ ওরা জানে তৈমূর জাহাজে কইরা শাহ সুজার সম্পদ লসুইয়া পলাইতাছে, কাজেই সিলাভেরা আর আরাকানিরা এর পিছে লাগবই। এই সুযোগে ওগোরে জংলাটিলা এলাকায় টাইনা নিয়া খতম করতে অইবে। কিন্তু তার জন্য দরকার হবে অনেক প্রস্তুতি আর একজন শক্ত লোক,’ বলে সে চোখ তুলে তাকাল কিরানের দিকে। ‘এই সময়েই তুমার আগমন কাহিনিতে। সমস্ত ঘটনা সাজানো অইছে তোমারে সামনে রাইখা, কিন্তু সবসময়ই তোমগো লগে ছিল তালেব তৈমূর। পেছনের কলকাঠি আসলে সবই হেয়ই নাড়ছে,’ বলে সে একটু থামল। তারপর গড়গড়ার নলটা নমিয়ে রেখে উঠে এলো।

‘আর সম্পদের কথা যদি কও, তবে একটা কথা কই,’ বলে সে কিরান তো বটেই বাকি সবার দিকে দেখল একবার করে। শাহ সুজার লগে কখনোই কোনো সম্পদ ছিল না। শাহ সুজা খুব সামান্য চলার মতো সম্পদ নিয়া আরাকান গেছিল। কারণ মক্কা গিয়া সাধারণ মানুষের মতো জীবন-যাপন করবার ইচ্ছা আছিল তার। হের লগে কোনো সম্পদ কখনোই ছিল না।’

আকরাম বেগের শেষ কথাটা শুনে সবাই চমকে উঠল। ‘তারমানে মোঘলগো যে বিরাট সম্পদের কথা প্রচলিত আছে সেইটা…’

‘সবই আছে। এই বাঙাল মুলুকেই আছে,’ বলে আকরাম বেগ চোখ নামাল। ‘শাহ সুজা দিল্লি যাওয়ার বহু আগেই সেই সম্পদ তোমার বাপের হাতে তুইলা দিয়া বলছিল এমনভাবে এইটারে লুকায়া রাখতে, এমনভাবে রক্ষা করতে, যাতে কোনোদিন এই সম্পদ বাঙলার মানুষের কাজে লাগে। সে আরেক রাজদ্রোহীর কাহিনি। একমাত্র তোমার বাপে জানত সেই সম্পদ কই আছে। সম্ভবত তোমার বাপের মৃত্যুর লগে ওই সম্পদের হদিসও হারায়া গেছে,’ আফসোসের সঙ্গে মাথা নাড়ল আকরাম বেগ।

‘আপনের কথা আমি পুরাপুরি বিশ্বাস করি না,’ কিরান কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আকরাম বেগের দিকে। ‘এত প্রাণহানি এত মৃত্যু, এত আয়োজন কুনোদিনই স্রেফ সিলভেরারে মারা লাইগা হইতে পারি না। আমার বাপুরে আমি ভালো কইরা চিনি। সে কোনোদিনই……

‘শোন তালেব তৈমূরের পোলা তালেব কিরান, কিছু জিনিস না জানাই উত্তম,’ বলে সে কিরানের দিকে আরেক ধাপ এগিয়ে এলো। তৈমূর যা চাইছিল তা হইছে, দক্ষিণের সাগর থেইকা একটা ত্রাস কমছে, আরাকানিরা একটা শিক্ষা পাইছে, যদিও কবি আলাওল আবারও তাগে হাতে ধরা পাইড়া গেছে। তাও, তুমি ঋণ মুক্ত হইছো। হইছো না?’

কিরান চুপ।

‘তার চেয়েও বড়ো কথা তুমি জীবনের নতুন উদ্যম খুঁইজা পাইছো। কাজেই এইটারে কাজে লাগানোর চেষ্টা করো,’ বলে সে সবার দিকে দেখল। ‘দিল্লি থেইকা খবর আসছে বাঙাল মুলুকে পা রাখতাছে দিল্লির সুলতানের খাস লোক সুবাদার শায়েস্তা খাঁ। সে বাঙাল মুলুকরে পরিষ্কার করবার উদ্দেশ্য নিয়া রওনা দিতাছে। হের অনেক উদ্দেশ্যের মধ্যে একটা হইলো দক্ষিণের জলদস্যুগোরে নিকেশ করা। আমি তুমগোরে বলতাছি, তুমরা এ অঞ্চলের পানি সবচেয়ে ভালো চিনো। আমরা বিরাট দল বানাইতাছি, আমগোর লগে যোগ দেও তুমরা,’ বলে সে কিরানের দিকে ফিরে বলে উঠল, ‘আরেকটা কথা মনে রাখবা, কিছু সত্যের খোঁজ না করাই উত্তম। কিছু সত্যের খোঁজ করার চেষ্টা করবা না। কিছু সত্য সবার আড়ালে থাকাই ভালো। যা বললাম বুঝো, আমারে তুমগো সিদ্ধান্ত জানাও।’

আকরাম বেগের থেকে বিদেয় নিয়ে ওরা বাইরে বেরিয়ে এলো। ‘কী মনে হয়, সবার মতামত কী?

‘আমি আছি জাহাজি, আমার দল তো আর নাই, আমার লগে যারা আছে হেগোরে নিয়া আমি শায়েস্তা খাঁর দলে যোগ দেব,’ কিরানের চোখের দিকে তাকিয়ে পদ্ম বলে উঠল।

কিরান নিজের দলের লোকদের দিকে তাকাল। সবাই মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানাল। কিরান হাসিমুখে ফিরে তাকাল পদ্মের দিকে। কিরান রাজি হওয়াতে তার চোখেও খুশির ঝিলিক। বুকের সঙ্গে ঝোলানো বাপুর দেওয়া লকেটটা চেপে ধরে কিরান বিড়বিড় করে উঠল, ‘বুকের বলই সবচেয়ে বড়ো বল,’ কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গেই ভ্রু কুঁচকে উঠল ওর। একটু আগে আকরাম বেগের কথাটা মনে পড়ে গেল। তালেব তৈমূরের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে গেছে তার লুকিয়ে রাখা সম্পদ। কিরান আনমনেই মাথা নাড়ল। বাপু এইটা কোনোদিনই হইতে দিতে পারে না, বলেই সে টান দিয়ে লকেটটা খুলে আনল গলা থেকে। নিবিড়ভাবে দেখতে দেখতেই লকেটের একটা জায়গাতে চাপ দিতেই ওটা খুলে গেল, ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো একটা মোড়ানো চামড়ার কাগজের মতো। জিনিসটা চোখের সামনে তুলে ধরলে সে।

ওর পাশ থেকে পদ্ম বিড়বিড় করে বলে উঠল। ‘শাহ সুজার সম্পদের হদিস।’

‘এইটা আমাদেরকে রক্ষা করতে হবে,’ বলে কিরান জিনিসটাকে মুঠোর ভেতরে নিয়ে নিল। নিজের লোকদের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, ‘জীবনের বিনিময়ে হলেও এই সম্পদ আমাদের হয় রক্ষা করতে হবে, আর না হয় লুকায়াই রাখতে হবে, আর না হয় মানুষের কাছে লাগাইতে হবে।’

‘সামনেই আমগো বিরাট যুদ্ধ অপক্ষো করতাছে। কাজেই তিনটার কোনোটাই যদি না পারি আমরা তবে,’ ওদের ভেতর থেকে পট্টবর্ধন বলে উঠল। ‘এমন ব্যবস্থা করতে হবে যেন আমরা না পারলেও আমগোর ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এইটা খুঁইজা বাইর করতে পারে।’

‘সেই ব্যবস্থা আমগোরেই করতে হবে,’ বলে কিরান মৃদু থামল। সম্পদের হদিস তো পাইলাম কিন্তু একটা হিসাব কিছুতেই মিলল না। ‘এত আয়োজন, এত খরচ, এত লোকবল ক্ষয় কীসের জন্য কী হইলো? স্রেফ সিলভেরারে মারার লাইগা? নাকি এই সম্পদ যাতে শত্রুর হাতে না পড়ে হের লাইগ্গা? নাকি অন্য কিছু? আকরাম বেগ কোনো সত্যের কথা কইলে যেইটা লুকায়া থাকাই ভালো?’

‘জাহাজি, আমরা হয়তো সেই সত্য কোনোদিনই জানতে পারব না,’ বলে পদ্ম কাঁধ ঝাঁকাল। ‘কিংবা কে জানে সেই সত্য হয়তো আমগো না জানাই শ্রেয়।’

পদ্মের গভীর কালো চোখের দিকে তাকিয়ে সামান্য মাথা নাড়ল কিরান।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *