মগরাজ – ৪১

অধ্যায় একচল্লিশ – সময়: ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দ

মগদোষীদের গ্রাম, জংলাটিলা, দক্ষিণের সমুদ্র

পানি কী কখনো মানুষকে আগুনের অনুভূতি দিতে পারে? প্রশ্নটা শুনতে অদ্ভুত শোনালেও যদি কখনো আপনার শ্বাসনালী দিয়ে পানি ঢুকে যায় তাহলেই বুঝতে পারবেন পানি কী আদৌ জ্বলন্ত অনুভূতি দিতে পারে কী পারে না। ফুসফুসের ভেতরে একবার ভুল পথে পানি ঢুকে গেলেই মনে হবে ভেতরে আগুন ধরে গেছে।

কিরানও ঠিক সেই একই আগুনের অনুভূতি নিয়ে কাশতে কাশতে সোজা হয়ে বসল। প্রথমেই মুখ থেকে উগলে দিল একরাশ নোনা পানি। সেটা উগড়ে দিয়েও শান্ত হলো না। কাশতেই থাকল। কেউ একজন তার ওপরে ঝুঁকে ছিল কিন্তু তাকে সোজা হয়ে বসতে দেখে সরে গেছিল মানুষটা। এবার কাশতে দেখে আবার কাছে এসে পিঠের ওপরে দুটো থাপ্পড় মারল জোরে জোরে। কিরান আরো খানিকটা নোনা পানি উগড়ে দিতেই কাশির বেগ খানিকটা কমে এলো।

জ্ঞান ফেরার পর প্রথমবারের মতো অনুভব করল কোথায় আছে সে। স্রোতের মতো ভেসে এলো একটু আগের স্মৃতি। সেই সঙ্গে মনে পড়ে গেল কী ঘটেছিল তার সঙ্গে। মুখ তুলে ঝট করে আশেপাশে তাকাল সে, কারা আছে চারপাশে অন্ধকারের ভেতরে বুঝতে না পেরে অন্ধের মতো হাত পা চালাল চারপাশে।

কেউ একজন পেছন থেকে টেনে ধরে দাঁড় করিয়ে দিল তাকে। কিরান আধবসা অবস্থাতেই চিৎকার করে উঠল। করতেই থাকল।

‘জাহাজি, তুমি ঠিক আছ,’ কেউ একজন জোর জানতে চাইল কিরানের পাশ থেকে। তুমি ঠিক আছ জাহাজি, এখানে তোমার কোনো শত্রু নেই।

কিরান আবারও মাটিতে বসে পড়েছে হাঁটু গেড়ে নিজের জাহাজ নিজের সঙ্গীদেরকে হারানোর স্মৃতি মনে পড়তেই সে আবারও চিৎকার করে কেঁদে উঠল। তার চারপাশে দাঁড়ানো নারী যোদ্ধারা কিরানের অবস্থা দেখে একে অপরের দিকে ইশারা বিনিময় করল। পদ্ম এগিয়ে গেল কিরানের দিকে। তুমি ঠিকই আছ, জাহাজি। আহত হইলেও তেমন কোনো ক্ষতি হয় নাই।’

‘আমার জাহাজ, আমার লোকেরা, সবাই,’ কিরান কিছুতেই স্থির হতে পারছে না। নিজের দুই হাত ঘষছে সে বুকের সঙ্গে। ছোটো বাচ্চারা ভয় পেলে কিংবা ব্যথা পেলে যেভাবে ঘসে অনেকটা তেমনভাবে। ‘আবারও হাইরা গেলাম আমি। আবার বোকার মতো আমার আবেগ, আমার বোকামির মাশুল দিতে হইল আমার মানুষগরে। সবাইকে মরতে হইল আবারও আমার কারণে,’ কিরানের গলায় হাহাকার।

‘এটা নাও,’ বলে পদ্ম একা আরকের বোতল এগিয়ে দিল কিরানের দিকে। সে একবার নিজের সঙ্গীদের দিকে দেখে নিল। সবাই উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছে। পদ্ম একবার সামনের সমুদ্রের দিকেও দেখে নিল। সেখানে তেমন কোনো নড়াচড়া নেই এই মুহূর্তে কিন্তু যেকোনো কিছু একটা ঘটে যেতে পারে। তার দলের একজন ইশারা বিনিময় করল। ওদের যত দ্রুত সম্ভব সরে পড়তে হবে এখান থেকে

‘জাহাজি, এইটা গলায় ঢাইলা দাও, ভালো লাগব,’ পদ্ম বোতলটা কিরানের হাতে ধরিয়ে দিয়ে নিজে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল কিরানের পাশে। ‘জাহাজি, তুমি হয়তো বিশ্বাস করবা না, কিন্তু আমি জানি তোমার এহন কেমন লাগতাছে। সব হারানোর যন্ত্রণা আমার চায়া ভালো কেউই জানে না,’ শেষ কথাটা বলতেই কেন জানি পদ্মের চোখে ভেসে উঠল নিজের ছেলের চেহারাটা। বহুবছর ছেলের কথা মনে পড়েনি তার। এখন কেন মনে পড়ল কে জানে। এত বছরে তার ছেলেটা হয়তো অনেক বড়ো হয়ে গেছে, কিন্তু মনের চোখে সে তার ছেলেকে এখনো আগের মতো ছোটোই দেখতে পায়।

কিরান বোবার মতো বোতলটা নিয়ে গলায় ঢেলে দিল আগুনে তরল। খানিকটা কেশে উঠে বোতল মুখে লাগিয়ে ঢোক গিলল।

পদ্ম দেখল কিরানের ভেজা শরীর আর মুখের এখান-ওখান থেকে রক্ত চুইয়ে পড়ছে। মানুষটাকে এখান থেকে সরানো দরকার। কিন্তু তার আগে দরকার তার মনোবল ফিরিয়ে আনা। পদ্ম বোতলটা কিরানের হাত থেকে নিয়ে নিজেও গলায় ঢেলে দিল দু ঢোক। ‘জাহাজি, তুমি হাইরা গেছো ঠিকই। কিন্তু এখনো সব শেষ হয় নাই। এখনো তোমার জন্য সুযোগ আছে আবারও সব ঠিক করার।’

কিরান কোনো কথা না বলে তাকিয়ে আছে পদ্মের দিকে। ‘আমি যা বলছি ঠিকই বলছি, পদ্ম আবারও কথা বলে উঠল। সে সামনের সমুদ্রের দিকে দেখিয়ে বলে উঠল, ‘শত্রু এহনো সামনের সমুদ্রে বিদ্যমান। ওগোর সঙ্গে আমাগো লড়াই আসন্ন। তুমি চাইলেই আমগো সঙ্গে যোগ দিতে পারো।’

‘মানে?’ এই প্রথমবারের মতো কিরানের মনে হলো সে কোথায় আছে জানা দরকার। এই নারী দস্যু কী বলছে বোঝা দরকার। এক হাতেই নিজের মুখের কাটা জায়গাটা চেপে ধরল সে। ওখান থেকে আবারও রক্ত বেরুচ্ছে। বুকের পাশে যেখানে সিলভেরা আঘাত করেছিল সেখানটায় চিনচিন করছে। পাঁজরের হাড় ভেঙে গেছে কিনা কে জানে এই প্রথমবারের মতো কিরানের মনে হলো, তার জানা দরকার সে কোথায় আছে, তার সঙ্গীরা কোথায় আছে, আদৌ যদি তারা বেঁচে থাকে। ‘আমরা আছি কোথায়? তোমরা আমারে খুঁইজা পাইলা কই? আমার সঙ্গী আর জাহাজ…?’ কিরানের একের পর এক প্রশ্ন শুনে হেসে উঠল পদ্ম। সে আড়চোখে একবার নিজের বাকি সঙ্গীদেরকে দেখল।

‘বুঝতে পারছি জাহাজি, তোমার অনেক প্রশ্ন, আমি একে একে উত্তর দিই। তবে তার আগে আমগো এহান থেকে সরে পড়া দরকার। তুমি কী হাঁটতে পারবা?’ কিরান বসা থেকে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। পড়তে নিয়েও সে আবার সোজা হয়ে গেল। শরীরের নানা জায়গাতে অসহ্য ব্যথা থাকলেও হাত-পা নেড়ে বুঝতে পারল কোথাও হাড় ভাঙেনি।

‘চলো এগোতে এগোতে কথা বলি,’ পদ্ম কিরানের পাশাপাশি হাঁটতে শুরু করেছে। বাকিরা দুইপাশে সারি দিয়ে এগোচ্ছে ওদের সঙ্গে। কিরান দেখল এরা নারী যোদ্ধা হলেও এদের ভেতরে শৃঙ্খলা সাংঘাতিক। অন্ধকারের ভেতরে খানিকটা এগিয়ে ওরা পাথুরে ধাপ বেয়ে উঠতে শুরু করল। কিরান অবাক হয়ে দেখল ওরা পাহাড়ি ঢালে হাতে কেটে বসানো পাথরে ধাপ বেয়ে পাহাড়ের ওপরে দিকে উঠতে শুরু করেছে। ওপরের দিকে উঠতে গিয়ে কিরানের পা টানতে লাগল।

‘তুমি ঠিক আছ, জাহাজি?’ কিরানের টানতে থাকা পায়ের দিকে তাকিয়ে পদ্ম প্রশ্ন করল। কিরান মাথা নেড়ে জানাল, সে ঠিক আছে।

‘ঠিক থাকলে তো ভালোই। কারণ আমি যা বলতে যাইতাছি সেইটা বুঝতে হইলে তোমার ঠিক থাকাটা অত্যন্ত জরুরি।’

‘আমার লোকেরা, মানে আমার সঙ্গে যারা ছিল তারা…’

‘সব জানতে পারবা, তার আগে শোনো আমি কী বলি। মনোযোগ দিয়া শুনবা। কারণ পরে আবার বলতে পারব না। বলার মতো সময়ও পাব না। কাজেই মন দিয়ে শোনো। এখানে কী হইতাছে তুমি কিছুই জানো না। পুরো খেলা বুঝতে হইলে তোমারে আমার কথা শুনতে হইবে ভালোভাবে। তুমি তো সন্দ্বীপ থেকে এখানে আসছো তোমার বাপুর জাহাজ উদ্ধার করার জন্য, তাই না?’

কিরান কিছু না বলে তকিয়ে রইল মেয়েটার দিকে। সামান্য মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল শুধু।

‘তাহলে তোমারে জানাইতে বাধ্য হইতাছি যে, তোমার বাপু এই জংলাটিলা এলাকায় নাই। মানে যে জাহাজ সন্দ্বীপ থেকে রওনা দিছিল, যেটারে অনুসরণ কইরা সিলভেরা এহানে আসছে, আর সিলভেরাকে অনুসরণ কইরা তুমি এহানে আসছো তারে উদ্ধার করতে, সেই জাহাজে তোমার বাপু ছিলই না। সবাই যা ধারণা করছিল তা আসলে ভুল। রোসাঙ্গে যখন সম্রাট সুজাকে হত্যা করা হয় তহন সেইখান থেইকা সে একটা জাহাজ নিয়ে সরে পড়েছিল ঠিকই। কিন্তু সবাই যেমন জানে সেই জাহাজ রোসাঙ্গের রাজা মগ আর পর্তুগিজদের ঘেরের ভেতরে আটকা পড়ছিল, এই তথ্য ভুল। ওরা ঘের তৈরি করার আগেই তোমার বাপুর জাহাজ চইলা আসছিল এই জংলাটিলাতে। এইখানে সে আমাগো কাছে সম্রাট সুজার ওইখান থেইকা নিয়ে আসা জাহাজের সব জিনিস গচ্ছিত রাইখা যায় এবং আমারে কিছু নির্দেশনাও দিয়া যায়। যেটা অনুসরণ করেই আমি তোমাকে সন্দ্বীপে কবিকে উদ্ধার করার জন্যই রওনা দিয়েছিলম।’

‘এর মানে কী?’ কিরান ওপরে উঠতে উঠতে থেমে গেল। ‘বাপু আগেই এখানে আসছিল। এইখান থেইকা সে কই গেছে?’

‘সরাসরি সেইটা জানতে না পারলেও এইটা পরিষ্কার যে, সে এইখান থেকে চাঁটগায়ে যায়। সেখানে আকরাম বেগসহ বাকিদের সে কিছু নির্দেশন দেয় যাতে তারা তোমাকে নিয়োগ দিতে পারে। আর তুমি সিলভেরারে শেষ কইরা জিনিসগুলোর উদ্ধার করে বাঙাল মুলুকে সরায়ে নিতে পারো। কিন্তু এরপরে সে কই গেছে কেউই জানে না।’

‘কারণ কী এইসব করার পেছনে? আর সেই জাহাজটাই-বা কই? তার চেয়ে বড়ো কথা তোমার সঙ্গে বাপুর সম্পর্ক কী? যে সে তোমাকে এই বিপুল ধনরাশি দিয়ে গেল আর তুমিই বা সেগুলোকে রক্ষা করলা কেন?’

‘শোনো জাহাজি,’ পদ্মের গলায় কোনো ভাব নেই। সে একটানা বলে চলেছে। তুমি হয়তো জানো না আমরা কারা। হয়তো দস্যু হিসেবে আমাদের নাম শুনেছো আমরা সবাই মগদোষী। মগদোষী চিন তো?’ বলে সে কিরানের দিকে তাকিয়ে রইল, কিরানও তাকিয়ে আছে। ‘তোমার বাপরে আমিও বাপু ডাকি কারণ সে নিজে আমারে নিজের মেয়ে মনে করত। তোমার বাপু আমার মতো অনেক মেয়েরে পথের ধার থেইকা তুইলা আইনা বাঁচার আশ্রয় দিছে। যে কারণে তোমার বাপু আমগো কাছে অনন্য। সে মরতে বললে আমরা সেইটাও করতে রাজি। আর সম্পদ তো অনেক হালকা বিষয়।’

‘তুমি আমাকে খুঁইজা পাইলা কই?’

‘তোমরা সন্দ্বীপ থেইকা রওনা দেয়ার খানিক পরেই আমরা রওনা দিই কিন্তু তোমগোর অনেক আগেই জংলাটিলায় পৌছাই কারণ আমরা সংক্ষিপ্ত একটা পথ দিয়া চলাচল করি। যাই হোক, আমরা জানতাম সিলভেরা আর তোমগো বাহিনী এখানেই এক হইবে। সেই অপেক্ষাতেই ছিলাম। অনেকটা কইতে পারো। তোমগো বাহিনী আর সিলভেরার বাহিনীরে এই জায়গাতে এক করার পরিকল্পনাটা তোমার বাপুরই ছিল। আমরাও সেইটা জানতাম। কিন্তু তোমরা যে এইভাবে ধরা খাইয়া যাবা আমরা কেউই ভাবিনি। পরিকল্পনা ছিল এই জায়গাতে সিলভেরারে শেষ করতে পারলে তুমগো কাছে তোমার বাপুর রাইখা যাওয়া সম্পদ তুইলা দিলে আমাগো মুক্তি। কিন্তু তুমরা এইভাবে সিলভেরার ফাঁদের ভেতরে আইসা পড়বা কে ভাবছিল। যাই হোক, তোমগো জাহাজগুলা একে একে সিলভেরার লোকেরা ধ্বংস কইরা যখন খানিকটা দূরে সইরা পড়তে শুরু করে আমরা অন্ধকারের সুযোগ নিয়া নৌকায় কইরা যতজনরে পারছি উদ্ধার করছি। তোমগো অনেকেই আছে ওপরে আমাগো গ্রাম মানে দুর্গে। তোমার সঙ্গীগোর ভেতরে অনেকেই বাঁইচা গেছে, অনেকেই মরছে। যারা বাঁইচা গেছে, মনে যাগো আমরা উদ্ধার করতে পরছি তারা ওপরে আছে। তবে তোমগো তিনটা জাহাজের ভেতরে দুইটা জাহাজই গেছে। অন্য একটা জাহাজ পলাইতে পারছে। তবে তার চেয়েও খারাপ খবর আছে, জাহাজি।’

ওরা প্রায় পাহাড়ের ওপরে পৌঁছে গেছে। হঠাৎ থেমে গেল পদ্ম। ‘আমরা এখন যেখানে আছি সেখানে ঢোকার রাস্তা তো তুমি চিনোই। এইহানে পেছন দিয়া পলাবার রাস্তা আছে। সামনের রাস্তাতে সিলভেরার লোকেরা জাহাজ নিয়ে পাহারা দিতাছে আর পেছনে যেখানে আমগো জাহাজটা ছিল সেইখানটাও দখল করছে সিলভেরার লোকেরা। ওরা এইটাও খুব ভালা কইরাই জানে যে তালেব তৈমূরের সব সম্পদ আমগো এইখানেই আছে। কিন্তু আমরা জংলাটিলাতেই আছি এইটা ওরা জানে। কিন্তু ঠিক কোন জায়গাতে আছি সেইটা ওরা মনে হয় জানে না। কিন্তু বাইর করতে বেশি সময় লাগব না। আর বাইর করা মাত্রই যেকোনো সময় আমগো ওপরে আক্রমণ চালাবে।’

কিরানসহ বাকিদেরকে নিয়ে পদ্মরা চলে এলো পাহাড়ি সিঁড়ির একেবারে শেষ ধাপে। কিরান অবাক হয়ে দেখল ওপরে পাহাড়ের গায়ের সঙ্গে মিলিয়ে একটা ছোটো দুর্গ। সেটার প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে আছে ওরা। পাহাড়ের ওপর থেকে পুরো জংলাটিলা এলাকা আর সামনের সমুদ্র পুরোটাই দেখা যায়। সেদিকে মুখ করে দেয়ালের সঙ্গের প্রাঙ্গণে অনেকগুলো কামান। আর সেগুলোর সঙ্গে পাহারা দিচ্ছে নারী প্রহরীরা। ‘দস্যু পদ্মরানির মগদোষীদের গ্রামে তোমারে স্বাগতম জাহাজি,’ বলে পদ্ম নিজেও হেসে উঠল। আর তার সঙ্গে হেসে উঠল বাকিরাও। কিন্তু কিরান হাসার অবস্থায় নেই। সে ছুটে গেল প্রাঙ্গণের খোলা অংশের দিকে। সেখানে এপাশে বসে আছে পানি থেকে উদ্ধার হওয়া ওর লোকেরা। কিরান ছুটে গিয়ে প্রথমেই দেখতে পেল বেদু আর গোমেজকে। শক্ত হাতে জড়িয়ে ধরল সে দুজনকেই। কিরানকে দেখে গোমেজের হাসি আর বাঁধ মানছে না।

‘ওস্তাদ, তুমি বাঁইচা আছ?’

‘বাকিরা কই?’ কিরান জানতে চাইল। প্রাঙ্গণের ওখানে যারা আছে সবার দিকে চোখ বুলিয়ে নিল সে। ‘গোলন্দাজ কই?’

‘গোলন্দাজ রঙ্গন মল্লিক একেবারে জাহাজের সামনেই আছিল। সিলভেরার লুকানো বাহিনী যখন আমগোর ওপরে আক্রমণ চালায় সবার অবস্থা তখন খুব কাহিল একের পর এক আক্রমণে বিপর্যস্ত। যে যেদিক পারছে ছিটকা পড়ছে কিন্তু গোলন্দাজ তার জায়গা থেইকা এক চুলও নড়ে নাই। এমনকি সিলভেরার বাহিনীর গোলার আঘাতে উইড়া যাবার সময় সে মুখে হাসি নিয়া কামানে গোলা ভরতেছিলো। এরপর জাহাজের সামনের অংশসহ উইড়া যায় সে। জাহাজও ডুইবা যায় একটু পরে। আমগো জাহাজের প্রায় তেমন কেউই বাঁচে নাই। যারা গোলার আঘাতে মরছে হেরা তো গেছেই, আর যারা পানিতে পড়ছিল হেগোরে—’ কথা শেষ করল না সে। ‘গোমেজ তোমারে নিয়া লাফ দিতেই আমিও পানিতে পইড়া যাই। আমি প্রথম ডাঙ্গাত উঠলে পদ্মরা নিয়া আসে আমারে। পরে গোমেজ আসে। সবশেষে আসলা তুমি।

‘কোন জাহাজটা পলাইতে পারছে?’ কিরান গম্ভীর মুখে জানতে চাইল।

‘পট্টবর্ধনেরটা,’ শুনে কিরান মাথা নাড়ল। মনে মনে ও জানত। এই সরু পানিতে কেউ পালাতে পারলে একমাত্র সে-ই পারবে। তারমানে তার জাহাজে যারা ছিল মানে বিল্লাল শেঠ, বৈঠা ওরা হয়তো নিরাপদ আছে।

‘আর তুলারামের জাহাজ?’

‘ওরা সবাই মরছে,’ আফসোসের সঙ্গে মাথা নাড়তে নাড়তে বলে উঠল বেদু। কিরান আবারও হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল মাটিতে। কষ্টে বুকটা ফেটে যাচ্ছে ওর। কোনোমতে মাথা তুলে ভেজা চোখে তাকিয়ে সে জানতে চাইল। ‘রহমত চাচা, সেই পতিত লোকটা আর কবি?

‘কবি আলাওল হেগো হাতে ধরা পড়ছে। রহমত চাচা অর পতিত লোকটা পট্টবর্ধনের জাহাজে আছিল। ওরা মনে অয় বাঁইচা গেছে।’

কিরান দুই হাতে মুখ ঢেকে বসে রইল। কতক্ষণ বসে ছিল নিজেও জানে না। হঠাৎ সোজা হয়ে দাঁড়াল। পদ্মসহ বাকিদের কাছে এগিয়ে এসে সে জানতে চাইল, ‘সিলভেরার কয়টা জাহাজ আছে এইখানে? ওর লগে কারা কারা আছে, সব জানতে চাই। সেই সঙ্গে আমার এই জায়গার একটা নকশা লাগব। আর লাগব তুমগো সব মানুষের হিসেব থেইকা শুরু কইরা অস্ত্রের হিসাব।’

পদ্ম কিছু না বলে তাকিয়ে রইল তার দিকে। ‘কী করতে চাও, জাহাজি?’

‘তুমিই না বলছিলা ওরা যেকোনো সময় আক্রমণ চালাইতে পারে।’

‘তারা আক্রমণ চালাবই, যেইমাত্র ওরা বুঝতে পারব আমরা ঠিক কোন জায়গাতে আছি, সঙ্গে সঙ্গে আক্রমণ করব। তবে সকালের আগে পারব বইলা মনে হয় না। একবার আমগোর অবস্থান খুইজা পাইলে স্রেফ সকালের অপেক্ষা,’ পদ্ম তার নিজের বাহিনীর দিকে ইশার করল সমর্থনের আশায়। সবাই মাথা নেড়ে সায় জানাল।

‘আমিও তাই মনে করি, সকালের আগে ওরা আক্রমণ করব না। চাইলেও পারব না আসলে,’ অনেকটা আনমনেই বলে উঠল কিরান। ‘আমার একটা পরিকল্পনা আছে। আমি জানি না কতটুক কী করা সম্ভব হবে কিন্তু এইরকম যুদ্ধে আমি আগেও অংশগ্রহণ করছি, কাজেই জানি কী করতে হবে। আমি চাই আমরা সেই পরিকল্পা অনুযায়ী প্রতিরোধ করি। বাঁচা-মরা পরে। যদি সঠিকভাবে পরিকল্পনা করতে পারি তবে একটা উপায় বাইর হইবোই।’

‘তুমি, জাহাজি, এত পরিকল্পনা আর লোক লস্কর লয়া নিজের জাহাজ বাঁচাইতে পারলা না। আমগো লাইগা কী করবা?’ পদ্মের পাশ থেকে বিশালদেহী সেই মহিলা বলে উঠল।

কিরান আনমনেই মাথা নাড়ল। ‘তুমগো লাইগ্গা না যতটা, তারচায়া বেশি নিজের লাইগ্গা। নিজের লুক যারা আছে তাগো লাইগা। এই ঠিক যতই তুমগো লড়াই বলি এইটা আসলে আমার লড়াই,’ বলে সে পদ্মের দিকে এগিয়ে গেল দুই পা। ‘বাপু সবসময়ই বলত, বুকের বলই সবচেয়ে বড়ো বল,’ বলে সে বুকের সঙ্গে ঝুলতে থাকা লকেটটা চেপে ধরল দুই হাতে। ‘এই জংলাটিলায় আরেকবার আমি সেটাই প্রমাণ করতে চাই।’

পদ্ম কিছু না বলে তাকিয়ে রইল তার দিকে। তারপর ফিরে তাকাল নিজের লোকেদের দিকে। ‘ঠিক আছে জাহাজি, জীবন দিয়াই যদি জীবনের মূল্য চুকাইতে হয় এই জংলাটিলাতেই আরেকবার আমরা প্রমাণ করব সেইটা।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *