বিশেষ দ্রষ্টব্য – ৫

এখানে মোক্ষদা কোথায় থাকে বলতে পারেন?

—কোন্ মোক্ষদা? নান্তির মা, না তকাইর দিদিমা? দুজন আছে এখানে। আপনি কোন্ জনকে চান?

মুশকিলে পড়লাম। বাড়ির ঝি বিনা নোটিসে চারদিন আসছেনা। একরাশ এঁটো বাসন ডাঁই হয়ে গেছে। বাড়ির তাড়নায় গ্রে স্ট্রিটের এক বস্তিতে ঝির খোঁজ করতে গিয়েছিলাম। ঝিকেই চিনি, তার সন্তান-সন্ততিদের ইতিহাস আমার জানার কথা নয়। সুতরাং কোন্ মোক্ষদাকে চাই তা বলতে পারলামনা।

খাটিয়ায় বসে-থাকা-বুড়ো লোকটি বলল, একজন মোক্ষদা থাকে ঐ ডানদিকের নিমগাছের পাশের ঘরটায়! আরেকজন পেছনের সেই অয়েল মিলের কাছে।

নিমগাছের তলায় খাপরার ঘরের দরজায় ধাক্কা দিলাম।

—কে?

—মোক্ষদা আছে?

—এখন হবেনা!

কী কথার কী উত্তর! কিন্তু ঐ দুর্বোধ্য উত্তরেও আমার কোন অসুবিধে হলনা। গলার আওয়াজেই বুঝতে পারলাম, উত্তরদাত্রী আমার উপলক্ষিত মোক্ষদা নয়। আরও বুঝতে পারলাম, ঐ কণ্ঠস্বরের অধিকারিণীর নিমগাছের তলায় বাস করা সাৰ্থক!

দ্বিতীয় মোক্ষদার সন্ধানও একটু চেষ্টা করতেই পাওয়া গেল। বস্তির পিছনে পানের দোকানে খোঁজ করতেই দেখিয়ে দিল। শুনলাম, সেই মোক্ষদার মায়ের দয়া হয়েছে। সামনের মাঠকোঠার দোতলায় থাকে। আমার উদ্যমের ওখানেই ইতি হওয়া উচিত ছিল। মনে মনে ও-ঝিকে তখুনি আমি বরখাস্ত করে দিয়েছিলাম। অতএব, তারপর আর ঐ নোংরা বস্তিতে সময়ক্ষেপ করার কোন দরকার ছিলনা। তবু কীরকম কুমতি হল। অনেকসময় যেমন আমাদের ডানদিকে যাবার দরকার, তবু বাঁদিকের রাস্তায় হাঁটি, অথবা টুথপেস্ট কিনতে বেরিয়ে সেটা না-কিনে সেই পয়সাতেই এক দোয়াত কালি কিনে আনি, সেইরকমই কোন যুক্তিতে সম্ভবত ভাবলাম, মোক্ষদাকে একবার দেখে যাই।

পানওলা হাঁক দিয়ে বলল, ‘ছেদীলাল, এ ছেদীলাল, বাবুকে উপরে মোসদার কুঠিতে লিয়ে যা।’— একটা বারো কি তেরো বছরের ন্যাংচা ছেলে আমাকে বলল, আসুন!

জিজ্ঞেস করলাম, ‘মায়ের দয়া কবে থেকে হয়েছে রে ওর।’

— দু-চারদিন। আপনি এখেনটায় জুতো খুলে আসুন। ওসব জায়গায় জুতো পরে যেতে নেই।

আমি বললাম, ‘থাম থাম, তোকে আর উপদেশ দিতে হবেনা। আমার এটা রবারের জুতো!’

নড়বড়ে হাতলহীন কাঠের সিঁড়ি দিয়ে উঠতে-উঠতে চকিতে একটা কথা মনে পড়ল। অপ্রাসঙ্গিক যদিও। মনে পড়ল, দয়া আর কৃপা শব্দদুটির মানে প্রায় এক জানতাম, কিন্তু আসলে ও দুটো কত আলাদা। মা ষষ্ঠীর কৃপা আর মা শীতলার দয়া, এই দুই কথায় জমা-খরচের দুটো দিকই বুঝিয়ে দেয়।

দরজার কাছেই বসে ছিল, মুখ ফেরাতেই চিনতে পারলাম মোক্ষদাকে, মুখে খুব বেশি গোটা ওঠেনি। আমাকে দেখে তাড়াতাড়িতে বেরিয়ে আসতে যেতেই পাশের ঘর থেকে একজন বলল, ‘ও কি মাসী, বেরিয়োনা, বেরিয়োনা, শেষে কি বাড়িসুদ্ধ সবাইকেই মারবে নাকি?’ আমিও বললাম, ‘থাক থাক।‘

দূর থেকেই উঁকি দিলাম ঘরের মধ্যে। দরজার কাছে মাথা রেখে আরেকটি যুবতী মেয়ে শুয়ে আছে, তার পাশে একটি আট-নবছরের বাচ্চা। মোক্ষদা প্ৰায় কেঁদে ফেলে বলল, ‘আমার কিছুই হয়নি। দাদাবাবু, আমার মেয়ে বগলারই হয়েছে বড্ড বেশি গো। আমার সোমখ রোজগেরে মেয়ে।’

বগলা একটু নড়ে-চড়ে উঠল। তারপর একেবারে উঠে বসে বলল, ‘মা একটা বিড়ি দে তো।’

—না, এখন খেতে নেই।

— একটা দে।

—বলছি তো, কটা দিন বিড়ি খেতে নেই।

—দে-না, তক্ক করিস কেন :

একটা বিড়ি মুখে দিল, তারপর পরপর কটা কাঠি ভেঙে আগুন ধরাল। মেয়েটার সারা মুখ ফোস্কায় ভরে গেছে। গলার আওয়াজটা তবু অহংকারী। বস্তিতে ঢুকেই একটু-একটু সন্দেহ করেছিলাম, এখন এই মেয়েটির চোখ, এলো চুল, কাপড় পরার ধরন দেখেই মনে হল, ও নিশ্চয়ই মায়ের মতো ঝি-গিরি করেনা। ওর পেশা ওকে অহংকারী করেছে।

মেয়েটার মুখের দিকে একবার তাকিয়েই আমার বুকটা ধক্ করে উঠল। আমি ডাক্তার নই, কিছুই-না, কোন অলৌকিক ক্ষমতাও নেই, জ্যোতিষীও জানিনা, তবু, মেয়েটার মুখ দেখে একমুহূর্তে আমার মনে হল, ও আর বাঁচবেনা। মাত্র দু-একদিন। মৃত্যু ওর কপালে তারিখ লিখে গেছে। আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম। আস্তে-আস্তে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ডাক্তার দেখিয়েছ?’

—না গো। আমাদের কি সে ক্ষমতা আছে। তাছাড়া, মায়ের দয়ায় ডাক্তার কী চিকিচ্ছে করবে? বাবাঠাকুর এসে মায়ের চন্নমের্ত দিয়ে গেছে আর ঝেড়ে দিয়ে গেছে।

— টিকে নিয়েছিলে?

—বাবাঠাকুরের দয়ায় ওসব আমাদের লাগেনা।

বস্তুত কোনরকম উপদেশ ঝাড়ার ইচ্ছে আমার ছিলনা। চলে আসবার আগে তবু জিজ্ঞেস করলাম, ‘ও বাচ্চাটারও কি হয়েছে নাকি?’

—না, ওর হাম হয়েছে।

—কী করে বুঝলে?

-–আমাদের এখানে কোন বাচ্চা ছেলেমেয়ের কখনও মায়ের দয়া হয়নি। বাবাঠাকুর বলে গেছেন, ওর কোন ভয় নেই।

আমি বললাম, ‘তা বটে। অনেক পুণ্য করলে মায়ের দয়া পাওয়া যায়। ও আর এমন কী করেছে যে, মা ওকে দয়া করবেন।’

বগলা বলল, ‘মা, বাবুর কাছ থেকে পাঁচটা টাকা চেয়ে নে। তোর মাইনের আগাম। বাবাঠাকুরকে আবার পাঁচ সিকে দিতে হবে পুজোর জন্য।’

মোক্ষদা বলল, ‘কোন্ মুখে চাইব? এই তো এ মাসের মাইনে নেবার দুদিন পরেই জ্বরে পড়লাম। আমার কি আরকিছু পাওনা হয়েছে?’

বগলা আমার উপস্থিতির একটুও সম্মান না-দিয়ে গলায় ঝংকার তুলে বলল, ‘তুই চা-না, বাবুদের কাছে দু-পাঁচ টাকার আবার দাম কী!’

আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসছিল প্রায়, ‘টাকা তো সঙ্গে আনিনি!’ কেননা যে দুদিন পরেই মারা যাবে তার জন্য টাকা খরচ করে কী লাভ? তবু পাঁচটা টাকা আমি পকেট থেকে বার করে চৌকাঠে ছুঁড়ে দিলাম; কারণ, একটা যুক্তি সেই মুহূর্তেই মাথায় এল। মনে পড়ল, কালীপুজোর সময় যখন বাজি পোড়াই তখন তো জেনেশুনেই টাকাগুলো খরচ করি যে, একটু পরেই বাজিগুলো আর থাকবেনা। এ-ও না-হয় একরকম বাজি পোড়ানো!

মোক্ষদা কুণ্ঠিতমুখে টাকাটা নিতে যাচ্ছিল, তার আগেই বগলা ছোঁ মেরে তুলে নিল। যেন, ও বুঝে নিয়েছে টাকাটা ওরই প্রাপ্য। আমি মৃত্যুর কথা ভেবেই দিয়েছি। কী জানি, আমি যে বুঝতে পেরেছি বগলা আর বাঁচবেনা—সেটা বগলাও বুঝতে পেরেছিল কিনা!

সিঁড়ি দিয়ে নামতে-নামতে আমি ছেদীলালের দুটি বাহুই ওর অলক্ষ্যে দেখে নিলাম। ছেলেবেলা থেকেই আমাদের বাহুতে যে গোল-গোল দাগগুলো আছে—ছেদীলালের তা নেই। যাক্, একটা সমস্যা মিটল। আমার ধারণা ছিল, দুনিয়ার সব লোকেরই হাতে ঐ বিচ্ছিরি পেঁচার চোখের মতো দাগগুলো আছে।

এক প্যাকেট সিগারেট কিনে জানতে পারলাম, ঐ পানওলাই মাঠকোঠাটা এবং আদ্দেক বস্তির মালিক। জিজ্ঞেস করলাম, ‘টিকে দেবার ব্যবস্থা করনি কেন? বস্তি যে এবার তোমার উজাড় হয়ে যাবে! টিকে তো বিনে পয়সায় দেয়।’

—খবর দিলেও আসেনা।

—গিয়ে তো নিয়ে আসতে পার?

কী হবে বাবু! একবার এই বস্তিতে একজন ডাক্তার এসেছিল। তার পরদিনই রুগীটা মারা যায়! ডাক্তার চার টাকা ফিস্ ভি নিল, রুগীও নিল। আর আমরা এখানে ডাক্তার বোলাইনা। আমার বউয়েরও তো মায়ের দয়া হয়েছে, বাবাঠাকুর দেখছেন।

—বাবাঠাকুরের চিকিৎসায় বুঝি কেউ মরেনা?

—যার যখন নিয়তি টানে। কালকেই তো দুটো গেছে।

—বাবাঠাকুর থাকেন কোথায়?

—ঐ তো খালপারে মন্দির। আর আধাঘণ্টা বাদেই বাবাঠাকুর এসে যাবেন। আজ সক্কলে আলাদা করে পুজো দেব।

আমার হাতে অনেক কাজ ছিল। আর ওখানে সময় নষ্ট করার কোন মানে হয়না। বরং অন্য জায়গায় গিয়ে নতুন ঝি-ঠাকুরের খোঁজ নেওয়া উচিত। কিন্তু বাবাঠাকুরটির সঙ্গে একবার দেখা করার অদম্য ইচ্ছে হল। এদের দেখলাম কারুরই কোন ক্ষোভ নেই, বাবাঠাকুরের ওপর অসীম নির্ভরতা। সুতরাং একবার সেই মহাপ্রভুকে চাক্ষুষ না-দেখলে চলেনা। বললাম, ‘আমি ঐ চায়ের দোকানে আছি, বাবাঠাকুর এলে ছেদীলালকে দিয়ে কষ্ট করে আমায় একবার ডেকে পাঠাবে আমি ওঁকে একবার প্রণাম করে যাব।‘

বড় রাস্তার ওপারে চায়ের দোকানে বসলাম। আমার টিকে নেওয়া আছে, সুতরাং আমার ভয় নেই, তাছাড়া চা তৈরি হয় গরম জলে। খবরের কাগজটা টেনে নিয়ে আমি ভিয়েতনাম এবং কঙ্গোর সমস্যায় খুবই বিচলিত এবং মগ্ন হয়ে পড়লাম।

খানিকটা বাদে ছেদীলালের সঙ্গে বাবাঠাকুর নিজেই এলেন। মাটির ভাঁড়ে চা খেতে তাঁর আপত্তি নেই, সুতরাং দুজনে দুভাঁড় চা নিয়ে বসলাম। লোকটির চেহারায় ব্যক্তিত্ব আছে। রং কালো কিন্তু বেশ লম্বা। গলার আওয়াজ কর্কশ, খুব গভীরভাবে তাকাতে জানেন। সারা কপালে চন্দনের ছাপ, বুকেপিঠেও আছে কিনা বুঝতে পারলামনা; কারণ শীতের জন্যই বোধহয়, ফুলহাতা সোয়েটার পরে তার ওপর নামাবলি জড়িয়েছেন। বললাম, ‘আপনাকে ওরা সবাই খুব মানে দেখছি।’

—আমাকে মানেনা। ঠাকুর-দেবতাকে মানে।

—তা আপনি ওদের টিকে নিতে বারণ করেছেন কেন?

—দেখুন, একটা কথা বলি। টিকে নিলে কিংবা ডাক্তারি ওষুধ খেলেই যে সব লোক বাঁচবে এ জোর করে বলতে পারেন? আপনাদের ও চিকিৎসা করলেও অনেক লোক বাঁচে অনেক লোক মরে। চরণামৃত খেয়েও অনেক লোক মরে আবার অনেক লোক বেঁচেও যায়। সুতরাং কোন্টা ঠিক আপনি তা কী করে বলবেন?

—তা ঠিক। তবে পৃথিবীর অনেক দেশ আছে জানি, যেখানকার লোকেরা চরণামৃত একেবারেই খায়না, পায়না আরকি, বসন্ত রোগেও কেউ মরেনা।

—কথায়-কথায় পৃথিবীর কথা তুলবেননা। আর কোন্ দেশের সঙ্গে ভারতবর্ষের তুলনা চলে? কোথায় এমন—

—থাক, থাক্। আপনি ঠিকই বলছেন। কিন্তু আমি বলছিলাম টিকের কথা। ওটা তো আর কোন ওষুধ নয়। ওটা হচ্ছে, মানে, কী বলে, অসুখটা যাতে না—হয় তার ব্যবস্থা। ঠাণ্ডা না-লাগাবার জন্য যেমন আপনি গলায় মাফলার জড়ান। অসুখটা হবার পর তো চিকিৎসার কথা। তার আগে অসুখটা না-হবার ব্যবস্থা করাই কি উচিতনা?

—ন্যায্য কথা। আমি কি বারণ করেছি? আমি মশাই আপনাদের ওসব টিকে—ফিকে বিশ্বাস করিনা। কিন্তু ওরা যদি নিজেই নেয়, তবে আমি বারণ করবার কে? কিন্তু দেয় কে? আপনি কি ভেবেছেন কলকাতার সব বস্তিতে করপোরেশনের লোক এসে টিকে দিয়ে যায়? মোটেইনা। ওসব আপনাদের জন্য। এদের বুঝিয়ে—সুঝিয়ে টিকে দেবার গরজ কারুর নেই! টিকে দিলেও যে বাঁচবে তার অবশ্য কোন মানে নেই, অন্য অসুখে মরবে। কর্মফল যাবে কোথায়!

—মরতে তো আপনাকেও হবে। নাকি আপনার মরার ভয় নেই?

—কাজ ফুরোলেই মরব। তার আগেওনা, পরেওনা।

—আপনার মনের জোর আছে দেখছি। আপনি যে এসব পক্সের রুগীদের ঘাঁটাঘাঁটি করছেন, আপনার ভয় করেনা?

—ভয় করলেই ভয়। কে কিসে মরবে তা তো কপালে লেখা হয়েই আছে!

—আপনি হাত দেখতে জানেন?

—না। আমরা পূজারী ব্রাহ্মণ। সাতপুরুষ ধরে কলকাতা শহরে মা শীতলার পূজারী। ওসব হাত দেখার কাজ আমরা করিনা। কেন হঠাৎ?

—আমি একটু-একটু জানি। দিন আপনার আয়ু বলে দিচ্ছি।

—আমি ভদ্রলোকের ডান হাতটা টেনে নিলাম। তারপর প্রায় জোর করেই পুরো হাত-ঢাকা সোয়েটারটা ঠেলে অনেকখানি ওপরে তুলে দিলাম। হাতে সদ্য টিকে নেবার দাগ। হয়তো গতকালই নিয়েছেন, একটু-একটু পেকে উঠেছে। আমি চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘সত্যিই আপনি গুণী লোক, পায়ের ধুলো দিন।’

বিষম অপ্রস্তুতভাবে বাবাঠাকুর বললেন, ‘কী করব বলুন। আমি নিজেও মরতে চাইনা, ওদেরও মারতে চাইনা। কিন্তু ওরা যে মরতেই চায়।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *