বিশেষ দ্রষ্টব্য – ১৮

১৮

দোতলা বাসের ঠিক সামনের জানালায় বসে ছিলাম, তাই অমন সুন্দরভাবে দেখতে পেলাম দৃশ্যটা। সন্ধেবেলা অন্ধকার হয়ে এসেছে, বিশাল চক্চকে চৌরঙ্গি, জ্বলে উঠেছে আলো! কীড় স্ট্রিট যেখানে এসে মিশেছে চৌরঙ্গিতে, সেখানে মসৃণ কালো চওড়া চৌরঙ্গির ঠিক মাঝখানে একটি লোক শুয়ে আছে।

হঠাৎ ঝাঁকুনি দিয়ে বাসটা থেমে গেল। সমস্ত লোক হুড়মুড় করে এসে উঁকি দিল জানালা দিয়ে। চৌরঙ্গিতে এরকম দৃশ্য আগে কেউ দেখেনি, অথবা দেখেছে হয়তো— দুপাশের সিনেমা হলগুলোর মধ্যে পর্দায়—কিন্তু এমন জীবন্ত, রক্তমাংসের দৃশ্য। সত্যিই দৃশ্যটির কম্পোজিশনের তুলনা হয়না। চৌরঙ্গি রাস্তাটাকে দেখাচ্ছে ধুধু করা বিশাল, রবিবারের সায়াহ্ন হলেও পথে আর একটি লোকও নামেনি, শূন্য, কালো রাস্তার ঠিক মাঝখানে সাদা পোশাক-পরা লোকটি শুয়ে আছে। এই সন্ধেবেলা ঐ লোকটাই যেন এ রাস্তার অধিপতি। দুহাত দুদিকে সম্পূর্ণ ছড়ানো, পা-দুটো টান করা। মুখে একটু বিকৃতি নেই, দুঃখ নেই, রাগ নেই—খানিকটা যেন উদাসীনতা। কষ দিয়ে খানিকটা রক্ত গড়িয়ে পড়েছে, দেখা যায় কি, দেখা যায়না।

আমার সঙ্গিনী বললেন, ‘উঃ কী ভয়ংকর দৃশ্য!’

আমি বললাম, ‘তোমার ভয়ংকর লাগল? আমার তো সুন্দর লাগছে। ঠিক ফাঁকা রাস্তার মাঝখানে–অমন হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে থাকা সিনেমায় দেখলে তো আর্টের প্রশংসা করতে!’

–বাজে বক্‌বক্ কোরোনা। চলো নেমে পড়ি। এক্ষুনি বাস পোড়াবে।

আমি বললাম, ‘না, দেখে মনে হচ্ছে খানিক্ষণ আগে ঘটে গেছে। বাস পোড়াবার হলে এতক্ষণে শুরু হয়ে যেত! কাছেই দেখলাম কয়েকটি পুলিশ ও একটি অক্ষত একতলা বাস দাঁড়িয়ে আছে।’

—তাহলে সরিয়ে নিয়ে যায়নি কেন? এটা কি সকলের দেখার জিনিশ?

–নেবে, নেবে। অনেকরকম নিয়ম-কানুন আছে তো! চট করে ডেড বড়ি ছোঁয়া যায়না। তুমি মুখ ফিরিয়ে বসো-না!

বাসের মধ্যে ততক্ষণ হই-হল্লা, জুতোর শব্দ, জিব ও ঠোটের সংযোগে যাবতীয় বিচিত্র ধ্বনি-ব্যবহার শুরু হয়ে গেছে। কয়েকজন উৎসাহী নেমে গিয়ে কাছ থেকে দেখতে গেল, একজন কনস্টেবল কাছাকাছি এসে সরবরাহ করে গেল কিছু তথ্য। আমরা ওপরতলায় বসেই জানতে পারলাম লোকটির পকেটে কোন কাগজপত্র নেই। এখনও অজ্ঞাতপরিচয়। সঙ্গিনীকে বললাম, ‘একজন অজ্ঞাতপরিচয় মানুষের এর চেয়ে মহান মৃত্যু আর কী হতে পারে? সকলের চোখের সামনে, রাজার মতো!’

তিনি বললেন, ‘একজন মানুষ মরল, আর–‘

–কলকাতা শহরের কোথাও-না-কোথাও এই মুহূর্তে নিশ্চয়ই আরও একজন লোক মরছে। ন’বা পৃথিবীতে কয়েক শো—

—একি কথা হল?

—কেন না? মরা ইজ মরা। মানুষ মরছে এবং মানুষ মরবে এইটাই আসল। নিজেরা কতক্ষণ বেঁচে আছি সেইটাই বড় কথা, অন্য লোকের মরা নিয়ে দুঃখ করার কী আছে? তাছাড়া এই লোকটা হয়তো আত্মহত্যা করেছে। মরা আর আত্মহত্যা তো এক নয়!

–যাঃ ভাল্লাগেনা। চলো নেমে পড়ি। গোলমাল হচ্ছে। এখনই হয়তো বাসে আগুন লাগানো শুরু হতে পারে।

—না, না, ভয় নেই। আগুন লাগলে গোড়া থেকেই লাগে। তাছাড়া ওটা আগুনের গোলমাল নয়। বাস ছাড়তে দেরি হচ্ছে কেন হয়তো তা নিয়ে। আবার কেউ কেউ হয়তো বলছে আর একটু পরে, আমার এখনো দেখা হয়নি।

—তুমি তো সব-জান্তা!

—তুমি আগুন লাগাবার ভয় পাচ্ছ। আমি অন্য দৃশ্যও দেখেছি। সকাল দশটার সময় অফিসযাত্রী ভিড়ভর্তি গাড়িতে—ইংরেজিতে যাকে বলে সার্ডিন প্যাকড্ লোকে অদৃশ্য হাতল ধরে ঝুলে চলেছে এমনসময় একজন লোক পড়ে গেল, পিছনের চাকায় দুটো পা-ই কাটা গেল তার। গাড়ি থেমে গেল, পুলিশ আসবে তারপর কতক্ষণে ও-গাড়ি ছাড়বে কে জানে! বাসভর্তি লোক চেঁচিয়ে উঠল পাশ কাটিয়ে টেনে চলো-না ড্রাইভারদাদা। ব্যাটাচ্ছেলে মরার আর সময় পেলনা এই অফিসের টাইমে, এই নিয়ে তিনদিন লেট!

–সত্যি, এমনভাবে গাড়ি চালায় না! উঃ, কে কতক্ষণে প্রাণ নিয়ে বাড়ি ফিরবে–

–কী মুশকিল। গাড়ি চালাবার কী দোষ। মনে করো-না—গাড়ি-চাপা পড়াটা একটা নতুন রোগ। আগে বন্যায় প্রতি বছর হাজার-হাজার লোক মরত, এখন বাঁধ দিয়ে বন্যা বন্ধ করা হয়েছে। কলেরা-টাইফয়েড-টি বি হলে লোকে বাঁচতনা। এখন ওসব অসুখ তো নস্যি। তার ওপর শান্তির বাণী দিয়ে পৃথিবীর বড়-বড় যুদ্ধ আটকে রাখা হয়েছে। কিন্তু সব লোক তো চিরকাল বাঁচলে চলবেনা। কিংবা সবাই থুথুড়ে বুড়ো হয়ে মরলেও অনেক ঝঞ্ঝাট। তাই প্রকৃতি তার নিজের রাস্তা খুঁজে নেয়। এখন দেখা দিয়েছে গাড়ি-চাপা রোগ। ক্যান্সারেরও ওষুধ বেরুবে, কিন্তু গাড়ি-চাপা রোগের ওষুধ বেরুবেনা। কাগজে পড়নি– প্রত্যেক বছর ক্রীসমাসের সময় আমেরিকায় পাঁচ-ছ’শো লোক মারা যায়।

–এর থেকে বাবা, যুদ্ধও ভালো।

–যুদ্ধ আর কী এমন। হিটলার যত লোক মেরেছে, তার চেয়ে পৃথিবীর বেশি লোক মেরেছে মোটরগাড়ি। কতবড় সাংঘাতিক অসুখ তাহলে এটা ভেবে দেখো।

–অসুখে তবু লোকে ভুগে ভুগে মরে। এ একেবারে–

—বাঃ। তুমি কখনো শোননি একজন লোক কথা বলছেন কথা বলছেন হঠাৎ এমনসময় উঃ বলে একেবারে অক্কা। কিংবা কোন লোক খবরের কাগজ পড়ছে বসে-বসে হঠাৎ মাথাটা ঝুঁকে পড়ল সামনে, শেষ? থ্রম্বসিসেও অনেকসময় এইরকম হয়। অথবা, মাঠের মধ্যে গাছতলায় কেউ দাঁড়িয়ে আছে —হঠাৎ কড়াৎ করে বাজ পড়ল! কিছুদিন আগে বুলু দাশগুপ্ত নামে একজন খুব ভালো ফোটোগ্রাফার মারা গিয়েছিলেন এইভাবে কাগজে পড়নি? এরকমভাবে মরলে তুমি কার ওপর রাগ করবে? কীসে আগুন লাগাবে? যত রাগ গাড়ির ওপর।

—নিজে যেদিন পড়বে, সেদিন বুঝবে।

—নিজে পড়লে তো আর দুঃখ করার জন্য পরে বেঁচে থাকবনা। তুমি না-হয় দু-এক ফোঁটা চোখের জল ফেলবে।

–ইস, বয়ে গেছে আমার।

–ভূত হয়ে এসে তাহলে ঘাড় মটকাব তখন বলে দিচ্ছি।

মনোযোগ অন্যদিকে দিতে হল। রাস্তা থেকে নতুন গোলমাল শুনে আমরা আবার জানালা দিয়ে মুখ বার করে দেখলাম। সত্যি-সত্যি কি গাড়িতে আগুন লাগাবে না কি? না, পুলিশের আর-একটা গাড়ি এসেছে, সেইসঙ্গে মৃতদেহ নিয়ে যাবার ভ্যান। দুজন খাঁকি হাফশার্টপরা লোক হাত-পা ধরে ঝুলিয়ে চ্যাংদোলা করে তুলল মৃত লোকটাকে। মধ্যবয়স্ক, মাথায় অল্প টাক, জোয়ান পুরুষ, মুখখানি প্রশান্ত। বয়ে নিয়ে যাবার সময় লোকটার একটা হাত লপট্-লপট্ করে ঝুলছিল। ‘মড়ার হাত মাটি ছুঁতে চায়—’ কমলবাবুর লেখায় পড়েছিলাম। এতক্ষণ নজর পড়েনি, এখন দেখলাম লোকটার এক হাতে তখনও একটা ক্যালেন্ডার শক্ত করে ধরা। প্রাণ ছেড়েছে কিন্তু ক্যালেন্ডারটা ছাড়েনি। ওঃ, লোকটি তাহলে আত্মহত্যা করেনি, আমি বুঝতে পারলাম। কারণ সময় ও ভবিষ্যৎ জানার ওর লোভ ছিল। ‘ডেথ কাপীস নো ক্যালেন্ডার’ —ছেলেবেলায় ওয়ার্ডবুকে পড়েছিলাম, হঠাৎ মনে পড়ল।

আমাদের বাস তখন ছেড়েই ছুটে চলল হু-হু করে। শীত ফুরিয়ে এবার বসন্তের মিষ্টি হাওয়া লাগছে গায়। আমার সঙ্গিনী আর একটিও কথা না-বলে হঠাৎ চুপ করে গেলেন। ওঁকে কেমন যেন ক্লান্ত দেখাতে লাগল সেইমুহূর্তে। বুকের দিকে মুখ ঝুঁকিয়ে আর কোনদিকে না-চেয়ে বসে রইলেন। আমি আর তাঁকে বিরক্ত করলামনা।

আমরা বেরিয়েছিলাম থিয়েটার দেখব বলে। বাস থেকে নেমে কিছুক্ষণ নিঃশব্দে হাঁটার পর আমার সঙ্গিনী অকস্মাৎ বললেন, ‘আমি আজ আর থিয়েটার দেখতে যাবনা।’

—সেকি! কেন?

–আমার গা গুলোচ্ছে। আমি বাড়ি ফিরে যাব। উঃ, এরকম দৃশ্য যেন আমার কোন শত্রুও কখনো না-দেখে!

— কী ছেলেমানুষ তুমি! এরকম সামান্য ব্যাপার নিয়ে কেউ নিজের মন খারাপ করে! কত কষ্ট করে পেয়েছি টিকিট আর তোমার সঙ্গে এই সন্ধেবেলা। তা নষ্ট করবে? আমরা যারা বেঁচে আছি, আমাদের তো আনন্দে থাকতেই হবে। চলো থিয়েটার দেখি—

–থিয়েটার তো দেখলাম! রাস্তায় ঐরকম দৃশ্য–আর সেই তোমার লেক্‌চার!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *