বিশেষ দ্রষ্টব্য – ১৯

১৯

তর্কাতর্কি হচ্ছিল বাড়ির ঝি-চাকরকে অবসর সময়ে লেখাপড়া শেখানো উচিত না কি এই নিয়ে। প্রায় সকলেই এতে একমত ছিলাম, কিন্তু একবন্ধু রেগে উঠে বললেন, ‘কী বিশ্রী ধারণা তোমাদের! বাড়িতে ঝি-চাকরদের লেখাপড়া শেখানো খুব একটা মহৎ কাজ হবে মনে করছ? বাড়িতে ঝি-চাকর রাখাই যে কত অন্যায়, সেটা বুঝতে পারছনা? আর কতদিন এরকমভাবে মনুষ্যত্বের অপমান করা হবে? প্রত্যেকের উচিত, নিজের-নিজের পরিবারের কাজ নিজেদের করে নেওয়া। তাকিয়ে দেখো আমেরিকার দিকে। জান, সেখানে স্বয়ং রকফেলারের বাড়িতেও চাকর নেই?’

অপর বন্ধু বিনীতভাবে বললেন, ‘জানি, কথায়-কথায় আমেরিকার কথা উল্লেখ করা তোমার একটা কু-স্বভাব। আমরা কেউ আমেরিকায় যাইনি, সে দেশ দেখিনি। তবে যতদূর শুনেছি, আমেরিকার সঙ্গে আমাদের দেশের তুলনা করা বোকামি না, না, তোমার ক্ষেত্রে বোকামি বলছিনা, বরং বলা যায়, বুদ্ধি ব্যয় করার আলস্য। ঝি-চাকর রাখার প্রয়োজনটা পারস্পরিক। সকলেই যদি ভদ্রভাবে জীবিকা অর্জনের সুযোগ পায়, তবে লোকে বাড়িতে ঝি-চাকরের কাজ করতে আসবে কেন? রিক্শা চাপা অমানবিক বলে এখনই সকলে রিক্‌শায় চড়া বন্ধ করে রিক্শাওলাদের না-খেতে দিয়ে মেরে ফেলার মধ্যে কোন্ মনুষ্যত্বের পরাকাষ্ঠা আছে আমি জানিনা। আমেরিকার কথা আপাতত ভুলে, তোমার উচিত রাস্তার একটি ভিখিরির ছেলেকে তোমার বাড়িতে চাকরের কাজ দেওয়া, আর–

—হাঁ, চুরি করে সব ফাঁক করে দিক আর কি!

–সেটুকু লোক চেনার ক্ষমতা নেই? তাকে কিছু-কিছু লেখাপড়া শেখালে, সে বরং পরে স্বাধীন জীবিকা নেবার সুযোগ পেতে পারে। আর ভিখিরি হয়ে থাকলে, সে পড়ে না-খেয়েই মরত বা চোর-গুণ্ডা হত। একটু লেখাপড়া শেখালে আমাদেরও সুবিধে। অন্তত চিঠি ফেলে দিয়ে আসতে বললে চিঠিটা রাস্তায় গিয়ে ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে আসবেনা, কিংবা ঘড়িতে চাবি দিতে বললে– তারপর সারা বাড়ি খুঁজে চাবি নিয়ে আসবেনা, কিংবা সেই যে, একজন তার চাকরকে বলেছিল—‘আমায় যখন কেউ ডাকবে, তখন আগে তাকে বাইরের ঘরে বসাবে আমায় খবর দেবে, বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখবেনা।’ তারপর একদিন চাকর এসে বলেছিল, ‘আজ্ঞে আপনাকে একজন ডাকছেন, কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও বসাতে পারিনি, শেষটায় শুইয়ে রেখে এসেছি!’ অর্থাৎ টেলিফোন!

অপর একজন বন্ধু বললেন, ‘চাকরদের লেখাপড়া শেখানো খুব ভালো। কিন্তু তাতে অনেক মূল্য দিতে হয় নিজেদেরও। আমাদের বাড়িতে শত্রুঘ্ন বলে একটি চাকর ছিল। বেশ জোয়ান, ছটফটে ছেলেটা। বড়দা তাকে লেখাপড়া শেখালেন। ছেলেটার মাথাও ছিল, চটপট অনেকখানি শিখে গেল। তারপর বড়দা তাঁর বন্ধুকে বলে কুলটির কারখানায় চাকরি করে দিলেন। এখন বেশ ভালো চাকরি করছে, স্কিল্ড ওয়ার্কার হয়ে গেছে, কাজকর্ম শিখে ওভারটাইম ইত্যাদি নিয়ে মাসে চারশোর মতো রোজগার—আমার চেয়ে বেশি। একদিন ওর সঙ্গে হাওড়া স্টেশনে দেখা, চমৎকার ফিটফাট চেহারা, প্যান্টালুন, জুতোর সঙ্গে মোজা, নাইলনের হাওয়াই শার্ট। দেখে আমার খুব ভালো লাগল, ছেলেটা জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে, শুনলাম বিয়েও করেছে। ওর প্রতিষ্ঠার সবখানি কৃতিত্বই আমাদের পরিবারের—এই কথা ভেবে বেশ গর্বও বোধ করলাম। কিন্তু তারপরই এমন একটা কাণ্ড করল! একটা সিগারেটের প্যাকেট বার করে একটা কায়দা করে ঠোটে আটকাল, তারপর কিছুক্ষণ এ-পকেট ও-পকেট হাতড়ে–ফস্ করে আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘ছোড়দাবাবু, আপনার কাছে দেশলাই আছে?’ আমার এমন খারাপ লাগল।’

—এটা তোমার অন্যায়। দু-একজন চেঁচিয়ে উঠলেন।

–জানি তোমরা কী বলবে। রাস্তার যে-কোন লোক, অচেনা কোন কারখানার শ্রমিক এমনকী কোন ভিখিরিও দেশলাই চাইলে আমরা অপমানিত বোধ করিনা। কিন্তু পুরোনো চাকর চাইলেই অপমানিত বোধ করা আমার ডিকাডেণ্ট মেন্টালিটি। তা হয়তো ঠিক। কিন্তু অপমানিত যে হয়েছিলাম, তা অকপটেই স্বীকার করছি। শড় হয়েছিলাম বলা যায়। আগে কখনো চাইতনা, এখন এরকম স্বাভাবিক ভাবে…। বলতে পারো, ওর স্বভাব বদলাবার অধিকার আছে। কিন্তু তাহলে আমাকে ‘ছোড়দাবাবু’ কেন ডাকল? ‘এই যে অমুক বাবু’ বলে নাম ধরে ডাকাই ওর উচিত ছিল। বাড়িতে এসে এ-ঘটনাটা বলতে বাড়িশুদ্ধ সবাই, এমনকী বড়দা পর্যন্ত হঠাৎ বিষম চটে গেল শত্রুঘ্নর ওপর। সকলেই ওকে বলল নিমকহারাম।

উপস্থিত অনেকে আমার এ-বন্ধুর গল্প শুনে হেসে ফেললেন। তখন আর কে-যেন বললেন, কেন শরতের বাড়ির চাকরের গল্প? শরৎ, বলো-না! সে ঘটনাটা সত্যিই চমকপ্রদ। শরৎ বলতে শুরু করলেন :

ছেলেটা সত্যিই ভালো ছিল। মুখ বুজে কাজ করত, মুখে কখনো, কোন বিরক্তির ছায়া ছিলনা। মেদিনীপুরের ছেলে, কী যেন ছিল ওর আসল নাম, আমরা ওকে ডাকতাম মদন বলে। আমাদের বাড়িতে সব চাকরের নামই মদন, পুরুষানুক্রমে চলে আসছে। নিত্যনতুন চাকর এলে প্রত্যেকের নাম মনে রাখা কষ্ট, আর চাকরদের নাম সাধারণত বেশ গালভারি হয় গোবর্ধন, বগলাপ্রসাদ, দীনতারণ, কালীয়দমন এইসব—কাজেই ওসব ঝঞ্ঝাটের বদলে আমাদের বাড়িতে সবাই মদন। একমাত্র ঠাকুরমারই এই নামে আপত্তি, ওঁর কাছে সব চাকরের নামই বদন, কারণ মদন হাজার-হোক দেবতার নাম, আর চাকরবাকরের নাম ঠাকুর—দেবতার নামে হলে ওঁর নাকি সবসময় বকুনি-ঝকুনি দিতে অসুবিধে হয়।

এ ছেলেটা আমাদের বাড়িতে এসেছিল খুব বাচ্চা বয়সে। নিজের নাম ভুলে ও মদন নামটাই বেশ মানিয়ে নিয়েছিল। সবসময় ফিটফাট পরিচ্ছন্ন থাকত। স্মৃতিশক্তিও ছিল ভালো, বাজার থেকে যা-যা আনতে বলা হত, প্রত্যেকদিন নির্ভুলভাবে সবকটা আনত। ওরকম স্মৃতিশক্তি দেখেই ওকে লেখাপড়া শেখাবার কথা আমাদের মনে আসে। মা ওকে এক-দুই লিখতে শেখালেন। আমার বোন শেখাল অ-আ-ক-খ। তারপরও ওর প্রবল উৎসাহ দেখে আমরা সব ভাইরাই মাঝে-মাঝে একটু-আধটু পড়াতে লাগলাম ওকে। দু-চারখানা বই কিনে দিলাম। ছেলেটা সবকটা বই পড়ে-পড়ে মুখস্থ করে ফেলল, হাতের লেখা লিখে-লিখে লেখাটা করে ফেলল মুক্তোর মতো। ইংরেজিও পড়তে শিখলে কিছু-কিছু। বিশ্বাস করো ছ-সাতবছরের মধ্যেই ছেলেটা প্রায় ম্যাট্রিক স্ট্যান্ডার্ড পর্যন্ত শিখে ফেলল। স্বভাব হয়ে গেল আরও ভদ্র, মার্জিত। চাকর বলে লোকে বুঝতেই পারতনা। অনেকে আমাকে ডাকতে এসে ওকে বলত, তোমার দাদাকে ডেকে দাও তো! আমরাও ওকে একটু সমীহ করতে শুরু করলাম, সবরকমের কাজের হুকুম করতে দ্বিধা করতাম।

ছেলেটা হয়ে উঠল বইয়ের পোকা। আমাদের বাড়ির যাবতীয় বই পড়ে শেষ করল–আমার আলমারির তোমাদের দেওয়া আধুনিক কবিতার বইগুলো পর্যন্ত! দুপুরবেলা, বাড়ির রোয়াকে বসে রাজ্যের ঠাকুর-চাকররা যখন বিড়ি ফুঁকতে—ফুঁকতে এক-এক বাড়ির কেচ্ছা বিনিময় করে, আমাদের মদন তখন ছাদের সিঁড়িতে বসে-বসে গল্পের বই পড়ছে। অন্য চাকরদের সঙ্গে একদম মিশতনা। কোন কুসংসর্গে পড়েনি, মাইনে পেয়ে প্রত্যেকমাসে দেশে টাকা পাঠায় নিজে মনিঅর্ডার ফর্ম ফিল-আপ করে। আমরা ওকে অন্য কোথাও একটা চাকরি জুটিয়ে দেবার কথা বলেছিলাম। যেতে চায়নি। মদন বলত, এ-বাড়িতে ও ঘরের ছেলের মতো আছে। যদি এ-বাড়ির কাজ ছেড়েই দেয়–তবে অন্য কোথাও ও আর চাকরি করবেনা—কারখানা বা অফিসেও না, ও স্বাধীনভাবে ব্যবসা করবে। সেজন্য পয়সা জমাচ্ছে।

যা হোক, চাকর হিশেবে মদন আইডিয়াল। মালটিপারপাস চাকর। আমার বাবা চোখে ভালো দেখতে পেতেননা। দুপুরবেলা মদনের অতিরিক্ত কাজ হল বাবাকে খবরের কাগজ পড়ে শোনানো। সেজন্য ওর তিনটাকা মাইনে বাড়িয়ে দেওয়া হল। ও পুরো কাগজটা, প্রথম লীড থেকে শেষপাতার প্রিন্টারস লাইন পর্যন্ত সবকথা, বিজ্ঞাপন সমেত তন্ন-তন্ন করে পড়ে শোনাত। বাড়ি থেকে সক্কলে বেরিয়ে গেলেও মদনকে পাহারা রেখে যেতাম নির্ভয়ে। তারপর

তারপর একদিন সকালে আর মদন নেই। একটা অলওয়েভ রেডিও আর আমার মেজো ভায়ের একটা হাতঘড়িও নেই। আছে মদনের একটি চিঠি, টেবিলের ওপর চাপা দেওয়া। অনবদ্য চিঠি। ঠিক ভাষাটা মনে নেই। তবে অনেকটা এইরকম। আমার মাকে লেখা:

শ্রীচরণকমলেষু মা,

কিছুকাল হইতে আমার একঘেয়ে লাগিতেছিল জীবন। তাই ভাগ্যপরীক্ষার জন্য বাহির হইয়া পড়িলাম। ব্যবসাই করিব ঠিক করিয়াছি। এখন আপনার আশীর্বাদ পাইলে হয়। পুরা মূলধন হাতে নাই, তাই রেডিও আর ঘড়িটা লইয়া গেলাম। দুটোই আপনাদের অপ্রয়োজনীয়। বড় দাদাবাবু একটি নতুন ট্রানজিস্টার রেডিও কিনিয়াছেন, সুতরাং এটাতে আর আপনাদের কী দরকার? একবাড়িতে দুটো রেডিও রাখার দরকার দেখিনা। ট্রানজিস্টারটা বড়দাদাবুর শখের, তাই অলওয়েভটাই লইলাম। আর মেজদাদাবাবু, গতমাসে বিবাহে একটা সোনার হাতঘড়ি পাইয়াছেন। সেটি লইনাই। কিন্তু তিনি পুরানোটি দিয়া এখন কী করিবেন? বাড়ির আর-সকলেরই হাতঘড়ি আছে। মেজদাদাবাবু দুই হাতে দুইটি ঘড়ি পরিবেননা জানি। সেরকম কাহাকেও দেখিনাই। সুতরাং পুরানোটি আমি লইলাম। তবে শপথ করিতেছি, একদিন-না-একদিন এই দুইটি জিনিশের দাম ঠিকই আপনাদের শোধ করিয়া দিব। ইতি আপনার দাস মদন।

আমাদের পরিবারে একটা মিটিং বসে গেল পুলিশে খবর দেওয়া হবে কিনা, এই নিয়ে। মায়ের প্রবল আপত্তি। শেষপর্যন্ত সবাই ঠিক করল পুলিশে জানানো হবেনা। মদনের চিঠিটা ভাঁজ করে রেখে দেওয়া হল। বাড়িতে আত্মীয়-স্বজন এলে মা তাঁর চাকরের গৃহ-শিক্ষার নিদর্শনটি গর্বের সঙ্গে দেখাতেন।

দিন-পনেরো পর, আর-একটা চিঠি এল। মদন লিখেছে, সে বিষম অনুতপ্ত সে খুব দুরবস্থায় আছে। পাপকাজ দিয়ে শুরু করলে কোন উদ্দেশ্যই সফল হয়না। তার ওপর আমাদের যে বিশ্বাস ছিল সেটা ভঙ্গ করে সে মহাপাপ করেছে। হাতঘড়িটা সে বেচে ফেলেছে। কিন্তু রেডিওটা সে ফেরত দিতে চায়। তাছাড়া চোরাই মাল বলে লোকে মাত্র ৬০। ৭০ টাকায় কিনতে চায় ওটা। কিন্তু মায়ের অমন দামি, শখের জিনিশটা সে জলের দামে বেচতে পারেনি। ওটা সে ফেরত দেবে—কিন্তু নিজে মুখ দেখাতে চায়না। বউবাজারের একটা ঠিকানায় বলাই নামে একটি লোকের কাছে ওটা আছে, আমরা যেন কেউ গিয়ে নিয়ে আসি। এবং মদনকে সর্বান্তঃকরণে ক্ষমা করি।

এবার পুলিশে খবর দিলাম। কারণ ঠিকানাটা বউবাজারের একটি কুখ্যাত পল্লীর। পুলিশের লোক তো পুরো ঘটনাটা শুনে হেসেই বাঁচেনা। তারপর বলল, কাল ভোরে হানা দেবে। চোরাইমাল উদ্ধারের জন্য ভোরে হানা দেওয়াই নাকি প্রকৃষ্ট উপায়। আমাকেও সঙ্গে যেতে হবে আইডেন্টিফাই করতে।

গেলাম। একটু দূরে দুজন সেপাইকে নিয়ে ইন্সপেক্টার আর আমি দাঁড়িয়ে রইলাম। একজন সাদা পোশাক-পরা পুলিশ চিৎকার করে ডাকতে লাগল, ‘বলাই, বলাই!’ তখনো ভালো করে ভোর হয়নি, সাড়ে চারটে পাঁচটা বাজে। অনেকক্ষণ ডাকাডাকির পর দোতালার জানালা দিয়ে একটা শুটকো মতো লোক গলা বাড়িয়ে বলল, ‘কে?’ তারপরই কী ভেবে মুখটা সরাৎ করে ভেতরে ঢুকিয়ে নিল আবার। আর কোন সাড়া-শব্দ নেই। তখন ফের শুরু হল ডাকাডাকি, দরজায় ধাক্কা। এবার একটি মেয়েছেলে দরজা খুলে জানাল, এখানে বলাই বলে কেউ থাকেনা। আমরা সবাই হুড়মুড় করে ঢুকে পড়লাম বাড়ির মধ্যে। ইন্সপেক্টার প্রবল ধমক দিয়ে বললেন, ‘ডাক্ বলাইকে। দেখেছি সে দোতালায় আছে! বেগড়বাই করবি তো সবাইকে চালান দেব!’

বলাই নেমে এল এবং মা কালীর দিব্যি করে জানাল, সে মদন বলে কারুকে চেনেনা।

—চিনিস্‌ না-চিনিস্ রেডিওটা বার কর্ আগে।–

—কিন্তু রেডিওর তো সব পার্টস খুলে ফেলা হয়েছে!

—নিয়ে আয় সেই খোলা পার্টস! এরপর ইন্সপেক্টার হুংকার দিয়ে উঠলেন, এবার বল্ সেই ধৰ্ম্মপুত্তুর মদনটা কোথায়?’—পেছন থেকে মেয়েটা হঠাৎ বলল, ‘সে এখানে থাকেনা, সত্যিই থাকেনা, তাকে ছেড়ে দিন বাবু!

একটা জিনিশ দেখে আগাগোড়া অবাক হয়েছিলাম যে, মাত্র ১৫ দিনের মধ্যে মদন এসে কোন্ পরিবেশে উঠেছে। আগে সে কারুর সঙ্গে মিশতনা। বেশ—একটা রুচিজ্ঞান ছিল। একটা অন্যায় করার সঙ্গে-সঙ্গে চুম্বকের মতো আন্ডারওয়ার্লড তাকে টেনে এনেছে। আবার একটা দরদ-দেখানো মেয়েও জুটিয়েছে। মেয়েটা তখনও বলছে, ‘মদনকে ছেড়ে দিন বাবু, সে বেচারি

আমি আগাগোড়া চুপ করেই শুনছিলাম। শরতের গল্প শুনতে-শুনতে খানিকটা অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম। ভৃত্যতন্ত্র সম্পর্কে আমার উৎসাহ কম, অভিজ্ঞতাও নেই। আমাদের বাড়িতে কোনদিন চাকর রাখা হয়নি। ফুটফরমাশ বেশির ভাগ আমাকে দিয়েই খাটানো হয়। কিন্তু হঠাৎ একটা মজার প্রশ্ন মনে পড়তেই আমি শরতের গল্প-বলা থামিয়ে দিলাম। তারপর জিজ্ঞেস করলাম, ‘আচ্ছা, একটা প্রশ্ন তোমাদের কারুর মনে এসেছে? মদন চুরি-করা শিখল কী করে?’

কারণ মদন খুব বাচ্চা বয়েস থেকে আছে শরৎদের বাড়ি। ওখানেই বড় হয়েছে। অন্য চাকরদের সঙ্গে মিশতনা। লেখাপড়া শিখেছে। শরৎদের বাড়ির পরিবেশেই মানুষ। আর পরিবেশ অনুযায়ীই তো মানুষের চরিত্র তৈরি হয়। তাহলে, চুরি করার কথা ওর মনে এল কী করে? শরৎদের বাড়িতে নিশ্চয়ই চুরিবিদ্যের চর্চা নেই, আশা করা যায়। আর পাঠ্যবইগুলোর মধ্যেও বোধহয় চুরি করতে শেখানো নেই। তবে ছোঁড়াটা শিখল কোথা থেকে?

বন্ধুদের দু-একজন বললেন, ‘আঃ আগে গল্পটা শেষ করতে দে-না।’ আমি বললাম, ‘ছিঁচকে চুরির গল্প কী-আর-এমন রোমাঞ্চকর হবে। তার চেয়ে এ-প্রশ্নটা অনেক জরুরি। আমার তো মনে হয়, ঐ যে বললে ও রোজ দুপুরে খবরের কাগজ পড়ে শোনাত সেই খবরের কাগজ থেকেই চুরি করতে শিখেছে। বিশেষ করে ওর ছিল ব্যবসা করার ইচ্ছে। খবরের কাগজে কি প্রত্যেক দিন ও পড়েনি বড়-বড় ব্যবসায়ীদের চুরির কাহিনী? চুরির খবরেই তো ভর্তি। এক-একদিন এক—একজন বাঘা-বাঘা ব্যবসায়ীর চুরির কাহিনী! আর-একটা ইন্টারেস্টিং পয়েন্ট, মদন চুরি করল ঘড়ি আর রেডিও, কিন্তু শুধু রেডিওটা ফেরত দেবার কথা লিখেই সে নিজেকে সর্বান্তঃকরণে ক্ষমা পাবার অধিকারী ভাবল কী করে? এটাও সে শিখেছে খবরের কাগজ পড়ে! সে শিখেছে চুরি করার পর অর্ধেকটা ফেরত দিলেই আর কোন শাস্তি নেই, অপমান নেই, একেবারে সসম্মানে মুক্তি। দেখনি কাগজে কৃষ্ণমাচারীর ঘোষণা? ব্ল্যাকমানির বাংলা চোরা-টাকা যাদের কাছে লক্ষ-লক্ষ কোটি-কোটি চোরা-টাকা আছে, তারা যদি স্বেচ্ছায় এসে স্বীকার করে–ব্যাস, তা হলে শুধু ৬০ ভাগ জমা দিয়ে দিলেই হবে। আর সব মাপ, কোন বিচার নেই, শাস্তি নেই। চম্বলের ডাকাতদেরও আত্মসমর্পণ করার পরও শাস্তি হয়েছিল। কিন্তু যে ব্যবসায়ীরা চোরা কারবার করে, খাদ্য বাজার থেকে লুকিয়ে, ওষুধে ভেজাল দিয়ে পরোক্ষভাবে বহু লোককে খুন করে কোটি-কোটি টাকা জমিয়েছে—তারা শুধু এসে একবার স্বীকার করলেই হল, ষাট ভাগ জমানো টাকা জমা দিয়ে দিলেই হল, আর কোন শাস্তি নেই! যে আসনে ছিল সেখানেই রয়ে গেল। মদনও দেখেই শিখেছে নিশ্চিত। মদনের আর দোষ কী! মদনকে লেখাপড়া শিখিয়ে বেশ করেছিলে, কিন্তু খবরের কাগজ পড়তে দিলে কেন? তাইতো ও মহাজনদের পথ অনুসরণ করতে চেয়েছে!’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *