বিশেষ দ্রষ্টব্য – ১১

১১

আমাদের দুজন বন্ধু এম. এ. পাশ করে এখনও বেকার। প্রায়ই দুপুরের দিকে আমাদের আপিস-টাপিসে এসে বলে, ‘আহা, তুমি একা-একা টিফিন খাও, তাই সঙ্গ দিতে এলাম।’ বন্ধু দুজনেই বহু গুণের আকর, তবুও তাদের চাকরি না—পাওয়ার একগুঁয়েমিতে আমাদের অবাক লাগে। ওদের আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, ডিগ্রি যখন আছে, তখন কলেজ বা স্কুলে শিক্ষকতার চাকুরি কেন অন্তত খুঁজে নেয় না। কলেজে না-হলেও, স্কুলের চাকরি এখনও তো খুব দুর্লভ নয়। দুই বন্ধুর উত্তর দুরকম।

প্রথম বন্ধুর বাবা, ঠাকুর্দা প্রভৃতি সকলেই শিক্ষক ছিলেন। কয়েক বছর আগে ওর বাবা রিটায়ার করবার আগেই মারা গেছেন। আমরা শ্রাদ্ধের সময় চাঁদা দিয়েছিলাম। বন্ধুটি বলল, ‘কী করব ভাই, আমার তো ইচ্ছে আছে, কিন্তু মাতৃআজ্ঞা!’

—সেকি!

–মা প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিয়েছেন যে, একেবারে খেতে না-পেলে বরং দক্ষিণেশ্বরের কালীবাড়ির সামনে বসে লোকের জুতো রেখে পয়সা নেব, কিন্তু মাস্টারি করতে পারবনা। আমাদের বংশে আর কেউ মাস্টারি নিলেই মায়ের অভিশাপ লাগবে!

দ্বিতীয় বন্ধুর উত্তরটি একটু ঘোরালো। বলল, ‘ইস্কুল-কলেজের জীবনে কোন একজন শিক্ষকেরও নাম মনে করতে পারিস, যিনি যথার্থ শ্রদ্ধেয়?’ আমরা যখন ঠিক কোন্ নামটি বলব ভেবে ভুরু চুলকোচ্ছি, তখন সে বলল, ‘তোরা হয়তো, পারিস, কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য, আমি পারিনা। প্রাচীনকাল থেকে আমাদের দেশে কত মহৎ শিক্ষকের কথা শুনেছি, কিন্তু তাঁদের ক্ষীণছায়াও আমি মাইরি দেখিনি আমার গোটা ছাত্রজীবনের কোন শিক্ষকের মধ্যে। সকলের বিরুদ্ধেই আমার .অভিমান আছে। কেউই আমাকে বই-পড়ানো ছাড়া একটুও শিক্ষা দেননি। এমন কারুকে দেখিনি যাঁর জীবন আমার কাছে মনে হত অনুকরণের যোগ্য। রচনা লিখতে দেবার নাম করে ক্লাসে ঘুমোনো, ছাত্রদের ছলে-বলে-কৌশলে মিজের কোচিং-এ ভর্তি করার চেষ্টা, নিজের লেখা নোটবই গছানো, শক্ত প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলে ‘বখাটে’ হয়ে গেছি অপবাদ পাওয়া’ এইসব। দেবতুল্য চেহারা ও কণ্ঠস্বরের এক মাস্টারমশাই ছিলেন আমাদের স্কুলে, তিনিও—আমি অঙ্কে ফেল করেছিলাম টেস্টে, কিন্তু তাঁর জন্য ভাড়া-বাড়ি জোগাড় করে দেওয়ায়—আমাকে ষাট নম্বর দিয়ে পাশ করিয়ে দিয়েছিলেন। আমিও ওঁদের মতোই হয়েছি। আমি খুব ভালো কেরানি বা অফিসার হতে পারি, এমনকি ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ারও হতে পারতাম, কিন্তু কারুকে কিছু শেখাবার কোন সম্বল নেই। আমি আদর্শবাদী নই, জীবনে হয়তো অনেক অন্যায় করতে হবে—কিন্তু ছোট ছেলেদের ঠকাতে চাই না। বাচ্চাদের চোখকে আমি ভগবানের চেয়ে বেশি ভয় করি।

এসব সত্ত্বেও আমাদের পরিচিত বহু শিক্ষক আছেন। অনেকে নিশ্চিত সুশিক্ষক। অপর এক বন্ধু, আগাগোড়া সমস্ত পরীক্ষায় ফার্স্ট হতেন, তিনি অনায়াসে আই. এ. এস. হবার লোভ সংবরণ করে স্বেচ্ছায় শিক্ষক হয়েছেন। সুতরাং আমরা উনিশে জানুয়ারি শিক্ষকদের নীরব মিছিল দেখতে গিয়েছিলাম।

কথা রেখেছিলেন শিক্ষকরা। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত শান্ত শোভাযাত্রা। স্লোগান নেই, জিগীর নেই। অর্থাৎ ছাত্রদের মিছিল থেকে নিজেদের তাঁরা আলাদা রাখতে পেরেছিলেন। অনেক শিক্ষক তো কিছুদিন আগেই ছাত্র ছিলেন কিংবা এখনো ছাত্র, (প্রাইভেটে অনার্স বা বি. টি. ক্লাস বা রাত্তিরে এম.এ. পড়া) কিন্তু ছাত্রজীবনের অভ্যেস এখানে কাজে লাগেনি। অর্থাৎ তাঁদের নীরব মুখের ভাষা থেকে বুঝতে পারা যাবে তাঁদের দাবি ও অভিযোগ। অবশ্য মুখ দেখে বোঝা যায়না। কারণ সব মিছিলেই যা হয়, সব সমস্যা মুছে গিয়ে সেখানে একমাত্র সমস্যা হয় লাইন ম্যানেজ করা। দুজন-দুজন করে যান ওকি ওখানটায় ফাঁক পড়ে গেল যে … ভিতর দিয়ে লোক যাচ্ছে কেন … দৌড়ে মেক-আপ করুন … ইত্যাদি। সুতরাং পোস্টার ও ফেস্টুন ছিল।

অফিসফেরৎ লোকেরা মিছিল দেখলেই তিরিক্ষে হয়ে যায়। তা দুনিয়ার যে—কোন সমস্যা নিয়েই মিছিল হোক-না। অবশ্য, দু-তিন ঘণ্টা থেমে-থাকা ট্রাম—বাসের নিশ্বাস আটকানো ভিড়ে চেপটে থাকা খুব সুখকরও নয়। কিন্তু শিক্ষকদের মিছিলের জন্য রাগ করতে দেখিনি। শিক্ষকদের অবস্থার উন্নতি হোক এটা যেন প্রত্যেকেই চায়। সমবেদনায় অনেকের উক্তিও বেরিয়ে এল : শেষ পর্যন্ত মাস্টারদের মান খুইয়ে পথে নামতে হল! কবে দেশের …। যদিও যিনি এ-কথা বললেন, তিনিই হয়তো নিজের ছেলের গৃহশিক্ষককে পরীক্ষার পরের ছুটির মাসে মাইনে দিতে চাননা। কিন্তু এগুলো সামান্য মানবিক ত্রুটি। যেমন দেশের সমস্ত মানুষেরই প্রাথমিক শিক্ষা পাওয়া উচিত এ-কথায় যিনি অটল বিশ্বাসী তিনিও যে নিজের বাড়ির ঝি-চাকরের লেখাপড়া শেখার কোন ব্যবস্থা করবেন, তার কোন মানে নেই।

ছাত্ররা রাজনীতির প্যাঁচে পড়ে ধর্মঘট মিছিল করে লেখাপড়া গোল্লায় দেয়, বিভিন্ন প্রদেশে তারা হাঙ্গামা বাধাচ্ছে। তাদের নিবৃত্ত করার প্রধান দায়িত্ব শিক্ষকদেরই এতে কারুর সন্দেহ নেই। কিন্তু নিজে সন্দেশ খেয়ে অপরকে সন্দেশ খেতে বারণ করা যায় কি? আজ শিক্ষকরাই ধর্মঘট-মিছিলে নেমেছেন, শক্ত গলায় জানিয়েছেন পরীক্ষার হলে গার্ডও দেবেন না। এতে ছাত্ররা নিজেদের দুষ্টুমির খোরাক পাবে নিশ্চিত। তারা বলবে,’আরে যা-যা, স্যাররা নিজেরাই স্ট্রাইক করছে, আর আমরা পারিনা!’ সুতরাং, শিক্ষকদের এই আন্দোলন সম্পর্কে মিশ্র অনুভূতির প্রকাশ দেখতে পাওয়া স্বাভাবিক। শিক্ষকদের অভাব-অভিযোগের দাবি প্রত্যেকটা সত্যি, কোন বিবেকবান লোক তা অস্বীকার করতে পারেননা। ভিড়ের মধ্যে শোনা যাচ্ছে : ‘মাস্টারদের এতটা না করলে কি চলত না?’ ‘না হলে ওদের কোন দাবি মিটবে?’ এতটা চরম পথ না নিয়ে শিক্ষকরা যদি আরেকটু অপেক্ষা করতেন, সহ্য করতেন এই-ই বেশির ভাগ লোকের মনে-মনে ইচ্ছে। শিক্ষামন্ত্রীও বলছেন, তিনি শিক্ষকদের দাবি ন্যায়সংগত বলে মানেন, কিন্তু এখন যে আর টাকা নেই, সুতরাং চতুর্থ পরিকল্পনা পর্যন্ত অপেক্ষা না করলে। ভিড়ের মধ্যে বিদ্যাসাগরের প্রতিধ্বনি শোনা যায়: ‘কিন্তু মশাই তাকিয়ে দেখুন ওদের দিকে, ওদের তো শুধু দুরবস্থা নয়, এখন দুরাবস্থা একেবারে আকার দেখলেই বোঝা যায়!’

অভাব শুধু টাকার নয়। শিক্ষকদের সামাজিক মূল্য এখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি। পেশার সম্মান ক্রমশ নেমে যাচ্ছে। স্কুল-কলেজের বাইরে শিক্ষকদের আর কেউ গ্রাহ্য করেনা। একই রকমের দুজন ভালো ছাত্র একজন আই.এ.এস. হল, ছশো টাকা মাইনে, প্রবল প্রতিপত্তি। অপরজন শিক্ষক, সুতরাং একশো পঁচাত্তর টাকা, নগণ্য মানুষ। সরকারের যে-কোন পেটি গেজেটেড অফিসারের ক্ষমতা আছে ক্যারেক্টার সার্টিফিকেট দেবার, অন্য সার্টিফিকেটের কপি অ্যাটেস্ট করার। শিক্ষকের এই ক্ষমতা নেই। ছাত্ররা কাকে শ্রদ্ধা করবে শিক্ষককে না ওই গেজেটেড অফিসারকে? কার মতন হতে চাইবে? পাশ করার পর আর কোন চাকরি না পেলে তবেই লোকে কানামামা হিসেবে মাস্টারি নেয়। তিক্ততা এবং হতাশা জীবিকার প্রথম থেকেই জড়িত হয়ে যায়।

সবচেয়ে অসহায় লাগে প্রাথমিক শিক্ষকদের। কী পরাজিত আহত মুখ! ডায়মন্ড হারবার থেকে তিনখানা রিজার্ভ করা বাসে এসে ওঁরা অনেকে ঐ মিছিলে যোগ দিয়েছিলেন।

একই মিছিলে নাম-করা অধ্যাপক আর পাঠশালার মাস্টার। কিছু অধ্যাপকদের চেহারা দেখলেই চেনা যায়, খানিকটা বাবু-বাবু গন্ধ আছে। নোট বই এবং প্রাইভেট টিউশানির অতিরিক্ত আয়ের ছাপও আছে চেহারায়। তার পাশে গাঁয়ের মাস্টারদের ময়লা ধুতি, মলিন মুখ। প্রাথমিক ইস্কুল থেকেই খারাপ পড়ানো হয় বলে, কলেজের অধ্যাপকরা ভালো টিউশানি পান!

আমরা অধ্যাপক থেকে শুরু করে সকলেরই বেতন ও অন্যান্য সুযোগ বৃদ্ধি চাই। কিন্তু প্রথমেই নজর দেওয়া উচিত প্রাথমিক শিক্ষকদের প্রতি—এবং উচিত অধ্যাপকদের সঙ্গে তাঁদের ব্যবধান খুব কমিয়ে আনা। যাতে শুধু বিদ্যার মান অনুযায়ীই নয়, অনেক উচ্চশিক্ষিত ঝুঁক্তিও প্রাথমিক শিক্ষক হতে পারেন। তাঁদের দরকার বেশি। আজ স্বাধীনতার পর শিক্ষিতের সংখ্যা আরও কমে গেছে, সেদিনকার সরকারি রিপোর্টে জানা গেল। অর্থাৎ শিক্ষা-প্রসারে তো দূরের কথা, জন্মহারের সঙ্গেও শিক্ষার হার সমতা রাখতে পারছে না।

মিছিল শেষ হবার পর একটা টুকরো সংলাপ আমাদের কানে এল। একজন শিক্ষকের ক্যাম্বিশের জুতো পরা পায়ে একটি ডোরাকাটা শার্ট পরা ছেলে হুমড়ি খেয়ে পড়ল: আমায় চিনতে পারছেন?

—না তো।

—সেই যে স্যার, তিন বছর আগে অমুক ইস্কুলে…

—না, চিনতে পারলামনা।

টেস্ট পরীক্ষার সময় আমি টুলি করছিলাম। আপনি স্যার আমাকে ধরে হল থেকে তাড়িয়ে দিলেন! সেবার পরীক্ষা দেওয়াই হলনা স্কুল ফাইন্যাল! মাস্টারমশাইয়ের চোখে ভয় ঘনিয়ে এল। বখা ছেলেটি এখন কি আবার কোন প্রতিশোধ নিতে এসেছে নাকি? ছেলেটি কিন্তু বেশ বিনীতভাবেই পায়ের ধুলো মাথায় নিল। বলল, ‘মাস্টারমশাই, আমি অন্যায় করেছিলাম ঠিকই।’

—তুমি পরের বার পাশ করেছিলে?

—না স্যার, আমার আর লেখাপড়া হলনা। চাকরিতে ঢুকে গেলাম।

— কোথায়?

—গান্ অ্যান্ড শেল্ ফ্যাক্টরিতে। আপনার আশীর্বাদে ভালোই আছি। ওভার টাইম্‌-ফাইম্‌ মিলিয়ে শ-চারেক হয়। আচ্ছা স্যার, চলি।

মাস্টারমশাই বহুক্ষণ বিবর্ণ মুখে দাঁড়িয়ে রইলেন। শীর্ণকায়, প্রায়-প্রৌঢ়। হাত কাঁপছে তাঁর। না-কান্না গলায় পাশের সঙ্গীকে বললেন, ‘আমি বি. এ.-তে ডিস্টিংশন পেয়েছিলাম, জানেন? আমি ম্যাট্রিকে দুটো লেটার পেয়েছিলাম। আমি পরীক্ষায় টুকতে যাইনি বা ধরাও পড়িনি বলে আজ এতদিনে আমার মাইনে একশো সাতান্ন। জানেন, ঐ ছেলেটার আমি কতটা উপকার করেছি?’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *