বিশেষ দ্রষ্টব্য – ৩

বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলাম, এমনসময় শুনতে পেলাম দূরের একটা বাড়িতে যেন একসঙ্গে অসংখ্য কাঁসার বাসন ভাঙা হচ্ছে সেই ঝনঝন শব্দ। একটু মনোযোগ দিতেই বুঝতে পারা গেল, কাঁসার বাসন নয়, অনেকগুলি স্ত্রী-কণ্ঠের চিৎকার। ক্রমাগত, একটানা সেই স্বর কিছুক্ষণ চলল। কান্নার না আনন্দের, দূর থেকে মেয়েদের কণ্ঠ শুনে আমি কোনদিন বুঝতে পারিনা।

কিন্তু ধ্বনি বেশ প্রবল, আশেপাশের বাড়ি থেকে একসঙ্গে বহুলোক ছুটে গেল সেদিকে। বেলা আন্দাজ এগারোটা, সুতরাং ভিড় তেমন উপযুক্ত হলনা—অধিকাংশই বৃদ্ধ ও অপর মেয়েরা, বাচ্চার দল, কয়েকটি বেকার ছোঁড়া। প্ৰথমে গণ্ডগোল কিছুই বোঝা গেলনা, আমার বারান্দা থেকে স্পষ্ট দেখা যায়, কিন্তু ঠিক শ্রবণ-দূরত্বে নয়। আমি খুব কৌতূহলী ছিলামনা। কিছুটা অলস চোখেই তাকিয়ে ছিলাম, এ সমস্ত লোকাল কোলাহল অধিকাংশ ক্ষেত্রেই খুব লঘু কারণে হয়।

একটু পরেই একটা কালো পাৎলুন-পরা ছোকরা এগিয়ে এসে, তার তিনতলা বাড়ির রান্নাঘরে কড়াই চাপানো উনুনের কাছ থেকে সরে আসতে-না-পারা উদগ্র ব্যগ্রতাময়ী বউদির উদ্দেশে চেঁচিয়ে জানাল যে, ও বাড়ির একতলার ভাড়াটে বউটি আত্মহত্যা করেছে। খবরটা আমিও ওর মুখ থেকেই জানতে পারলাম, এবং জেনে চমকে উঠতেই হল।

আত্মহত্যা? বেলা এগারোটায়? ব্যাপারটার মধ্যে বিশেষত্ব আছে সন্দেহ নেই। প্রথমটায় আমি বিশ্বাস করিনি। আত্মহত্যা তো রাত্তিরের কারবার, চিরকাল সেইরকমই হয়ে আসছে। কিন্তু এই কাঁচা দুপুরে? সুতরাং আমার মনে হল, হয়তো উনুন থেকে হঠাৎ কাপড়ে আগুন লেগে ভদ্রমহিলা অজ্ঞান হয়ে গেছেন।

কিন্তু, না। জনতার উচ্চগ্রাম থেকে জানা গেল ভদ্রমহিলা বিষ খেয়েছেন, পাশেই ‘আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়!

কয়েকজন সশব্দে ছুটে গেল থানা ও অ্যাম্বুলেন্সে ফোন করতে।

আমি বারান্দায় দাঁড়িয়েই তৎক্ষণাৎ ভেবে দেখলাম, ভদ্রমহিলাকে আমি কখনও দেখেছি কিনা। হয়তো না, দেখলেও ওঁর মুখ আমার মনে নেই, কিংবা ঠিক কোন ভাড়াটে বউটি, তা আমি জানতে পারিনি। আমি তখনও বারান্দাতেই দাঁড়িয়ে ছিলাম।

মাসছয়েক আগের ঘটনা। আমি তৎক্ষণাৎ যে বারান্দা থেকে নেমে ছুটে যাইনি জনতার মধ্যে, তার কারণ ছিল খুবই সামান্য। আমার চটিজোড়া একেবারে ছেঁড়া ছিল—আমি পা-জামা পরে দাঁড়িয়ে ছিলাম খালি পায়ে। একজোড়া শু সম্বল। পাজামার সঙ্গে তো আর শু পরে রাস্তায় বেরুতে পারিনা। অথবা, একজন ভদ্রমহিলা মারা গেছেন শুনে—সেই মুহূর্তে আমি পোশাক বদলে প্যান্ট-শার্ট পরে সেজেগুজে তবে পথে বেরুব, এটা কেমন দৃষ্টিকটু লাগল। অথবা খালিপায়েই দ্রুত ছুটে—কিন্তু কলকাতা শহরে খালি পায়ে? অসম্ভব, জামাকাপড় পরে খালিপায়ে—ঐ ভদ্রমহিলার জন্য আমার অশৌচ শুরু করার কোন কারণই নেই। আমি বারান্দাতেই দাঁড়িয়ে ছিলাম।

হয়তো, ছুটে না-যাবার আরেকটু গুপ্ত কারণ আমার ছিল। আমি কোন মরা—মেয়ের মুখ দেখতে চাইনা। একবার দৈবাৎ দেখে ফেলেছিলাম, একটি অচেনা যুবতীর মরা-মুখ, একঝলক, কিন্তু সেই থেকে সে মুখ আমার মনে গেঁথে আছে, কিছুতেই তাড়াতে পারিনা। আমি আমার বান্ধবীদের মুখ অনেকসময় ভুলে যাই, কিন্তু কখনও ভুলতে পারিনি সেই মৃত মেয়েটির মুখ। আমি আরেকটি ওরকম মুখ বাড়াতে চাইনা। আমার বুকের মধ্যে কয়েকটি মরা মেয়ের মুখের প্রদর্শনী থাক, আমি চাইনা।

তাছাড়া, অলস ভঙ্গিতে আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম, সেই ভঙ্গি বদলে ব্যস্ত হবার আমার কীই-বা প্রয়োজন। রেডিওতে বিবিধ ভারতীর কু-সঙ্গীত হচ্ছে, ওরা তো এই মৃত মহিলার সম্মানে গান বন্ধ করেনি, এমনকি অনেক বাড়িতে রেডিও পর্যন্ত বন্ধ হয়নি দূরে ট্রাম ও বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছি—কেউ থামেনি, একটি মহিলার মৃত্যুতে কোথাও কিছু বদল হয়নি—সবই একরকম চলছে, শুধু এই গলিটুকুতে ছাড়া।

ততক্ষণ এই গলিপথ ভর্তি হয়ে গেছে মানুষে, কী করে এত মানুষ এত দ্রুত খবর পায় জানিনা। মানুষ মরার গন্ধে শকুন আসেনা, মানুষই আসে। আমি সেই জনতাকেই লক্ষ করছিলাম।

সেইদিনই আমি আবিষ্কার করেছিলাম, জনপ্রিয় লেখকদের জনপ্রিয়তার রহস্য। তাঁরা জীবন বা মৃত্যুর সমগ্রতার সম্পর্কে কিছু লেখেননা, একটি লাইনও না, কারণ, কেউ তা শুনতে চায়না। ওঁরা শুধু লেখেন জীবন ও মৃত্যুর গল্প। মাত্র গল্পটুকু। দুঃখ, বেদনা, মমতা—বিশেষ করে মমতা এড়িয়ে যেতে হয় অতি সন্তর্পণে, মমতা শব্দের অর্থ ‘আমারও যদি এরকম হয়’ এই বোধের বেদনা। কেউ তা চায়না, নিজের কথা মিলিয়ে নিতে চায়না। আমি সেদিন দেখলাম, ভিড়ের মধ্যে প্রতিটি মানুষের মুখে, চোখে, ভুরুতে, চশমার কাচে, আঙুলের ডগায়, ছাতার বাঁটে, জামার হাতায়—একটিমাত্র প্রশ্ন লেখা আছে—কেন, কেন, কেন, কেন? অর্থাৎ গল্পটা কী? গল্পটা? গল্পটা? জীবন ও মৃত্যু ঐ ভদ্রমহিলার জীবনে কতখানি খেলা খেলেছে কেউ জানতে চায়না, সবাই জানতে এসেছে শুধু সেই ক্রুর ঘটনাটুকুমাত্র—কেন মরল? কেন?

নির্লজ্জের মতো সরবে অনেকে অনেকরকম থিয়োরি দিচ্ছিল, অর্থাৎ প্রত্যেকের এক-একটি আলাদা গল্প—ব্যর্থ-প্রেম, মানসিক অসুখ, স্বামীর অবহেলা, ক্যান্সার, স্বামীই মেরে রেখে আত্মহত্যার মতো সাজিয়ে রেখে গেছে—এইসব। প্রত্যেকটা গল্পই কাঁচা, সবাই যেন অপেক্ষা করছিল একজন পাকা ঔপন্যাসিকের যে এসে সবকিছু নিখুঁতভাবে জুড়ে দেবে। কেউ-কেউ বলছে, এই সরু গলিতে অ্যাম্বুলেন্স ঢুকবে? অর্থাৎ, তখন গল্পের নায়িকার চেহারাটা ভালো করে দেখা যাবে তো? পুলিস আসতে এত দেরি করছে কেন?—অর্থাৎ পুলিশ এসে যদি সেই মুহূর্তেই গল্পটা আবিষ্কার করে ফেলে!

ফ্ল্যাশব্যাকে ভদ্রমহিলার পূর্বপরিচয়ও আমি বারান্দায় দাঁড়িয়েই শুনতে পেলাম। সুন্দরী। চার বছর বিয়ে হয়েছে—কিন্তু এ পাড়ায় ভাড়াটে হয়েছেন দেড় বছর। স্বামী কাস্টমসে কাজ করেন। ভদ্রমহিলা বি. এ. পাশ, কিন্তু কী আশ্চর্য, ভালো সেলাইও জানেন। কুমারী মেয়েরা ওঁর কাছে প্রায়ই দুপুরবেলা ডিজাইন তোলা শিখতে যেত। সাবুর পায়েস রান্না উনিই এ পাড়ায় প্রবর্তন করেছেন। ওঁর স্বামী একবার পাড়ার স্পোর্টসের পুরস্কার-বিতরণীতে সভাপতি হয়েছিলেন মূল সভাপতির অনুপস্থিতিতে। প্রেম করে বিয়ে কিনা, তাই এখনও ছেলেমেয়ে হয়নি। স্বামী-স্ত্রীতে একসঙ্গে প্রায়ই সন্ধেবেলা সিনেমা দেখতে যেতেন। আত্মীয়স্বজন তো বেশি দেখা যায়নি, প্রায়ই আসতেন ভদ্রমহিলার মা, স্বামীর অফিসের বন্ধুরা! আর আসত মাঝে-মাঝেই একজোড়া স্বামী-স্ত্রী, ওরা ভদ্রমহিলার বান্ধবী ও তার স্বামী, অথবা ভদ্রলোকের বন্ধু ও তার স্ত্রী—এ কথা জনতা ঠিক জানেনা। ঘটনার দিন স্বামী ঠিক নটার সময় চলে গেছেন অফিসে, পানের দোকানের সামনে জটলা—করা ছেলের দল ওঁকে সিগারেট কিনে ট্রামে উঠতে দেখেছে, ভদ্রমহিলাকেও নাকি তারপর ছাদে কাপড় শুকোতে দিতে দেখা গেছে।

এ তো সরল সাদামাটা সংসার। তবে, এই সকাল এগারোটায় আত্মহত্যা? যদি নেহাৎ আত্মহত্যা করার দরকারই হয় তো রাত্রে করলেই তো হত। চুপি—চুপি। এইরকম দিনদুপুরে নাটকীয়ভাবে কেন? এরকম উত্তেজক ঘটনার পুরো গল্পটা জানার জন্য জনতা প্রায় হিংস্র হয়ে উঠেছে। কোথাও কোন ফিসফাস, আহা-উহু বা ইস্ নেই। নানান জটলায় এক ধ্বনি উঠছে, কেন, কেন, কেন, কেন, কেন, কেন? গল্পটা? গল্পটা? গল্পটা? স্বামীর অফিসে টেলিফোন করা হয়ে গেছে। তাঁর আসতে দেরি হচ্ছে বলেও লোকে অসহিষ্ণু। স্পষ্ট বোঝা যায়, লোকটিকে সমবেদনা জানাবার জন্য নয়, সকলেই দেখতে চায় তাঁকে স্বচক্ষে, স্বামীটি এ গল্পের নায়ক না খলনায়ক! স্বামী এসে কান্নায় ভেঙে পড়বে, না গুম্ হয়ে থাকবে? তার মুখ দেখে বোঝা যাবে কি—এ ঘটনা সে আগেই জানত, নাকি হঠাৎ জেনে আকাশ থেকে পড়ল! এমনসময় অ্যাম্বুলেন্স আসতেই আমি বারান্দা থেকে সরে গেলাম। আমি ভদ্রমহিলার মুখ দেখতে চাইনা।

ভদ্রমহিলার আত্মহত্যার গল্পটা আমি জানিনা। শেষ পর্যন্ত জানা হয়নি। আমি গোয়েন্দা বা গল্পলেখক নেই। অন্যান্য সমস্ত জন্তু-জানোয়ারের থেকে মানুষ মাত্র দুটো ব্যাপারে আলাদা। মানুষই একমাত্র চিৎ হয়ে শুয়ে থাকতে পারে—বাঘ, ভাল্লুক এমনকি বাঁদরও তা বেশিক্ষণ পারেনা, মরার আগে। মানুষই একমাত্র মরার আগেও যতক্ষণ খুশি আকাশের দিকে মুখ করে শুয়ে থাকতে পারে। মরার আগে মড়ার ভঙ্গি মানুষকেই মানায়। আর, মানুষই একমাত্র আত্মহত্যা করতে সক্ষম, মৃত্যুর আগে নিজেই নিজের জীবনকে শেষ করার ইচ্ছে একমাত্র মানুষেরই হয়। এ ব্যাপারে সে ঈশ্বরের চেয়েও বড়। ঈশ্বর অজর, অমর—তাই তাঁর আত্মহত্যা করার ক্ষমতা নেই। মানুষের আছে। আত্মহত্যার ইচ্ছে যে কোন মানুষের একান্ত, অতি ব্যক্তিগত, আমি কারণ জানতে চাইনা।

তবে, একটা কথা কানে এসেছিল। ভদ্রমহিলা শেষ পর্যন্ত মারা যাননি। হাসপাতালে স্টমাক পাম্প করে বিষ বার করে ফেলা হয়, কয়েকদিন ভুগে ভদ্রমহিলা আবার ফিরে এসেছিলেন। কেন আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলেন, তা যেমন আমার জানা হয়নি, অকস্মাৎ বেঁচে উঠে তিনি লজ্জিত বা অনুতপ্ত, আরও বেশি কাতর না বেশি আনন্দিত হয়েছেন, তাও জানিনা।

ছ-মাস আগে এই ঘটনা ঘটেছিল। আজ সকালে আবার সেই বাড়ি থেকে কান্নার রোল উঠল। তবে সেবারের মতো অত জোরে নয়। একটা ট্যাক্সি থেকে ভদ্রমহিলা, তাঁর মা ও স্বামীর সঙ্গে নামলেন এইমাত্র। বাড়িতে ঢুকেই দুজন নারীর কণ্ঠের কান্না। পাড়ায় দু-একটি বাড়ির জানলা খুলে গেল, দেখা গেল কয়েকটি উৎসুক মুখ। কিন্তু বাড়ির সামনে একটুও ভিড় হলনা, একজন লোকও এসে দাঁড়ালনা। পাড়ার লোক রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে, আজ ছুটির দিনের সকালে অনেক লোক, কিন্তু কেউ ভুলেও বাড়ির সামনে দাঁড়াচ্ছেনা।

কারণ, এবারের গল্প সবারই জানা। কয়েকদিন আগে নার্সিং হোমে ভদ্রমহিলা একটি মৃতসন্তান প্রসব করেছেন। দু-একদিন আগে সে খবর ছড়িয়ে গেছে এ পাড়ায়। তাই আজ সকালে আর কারুর কোন কৌতূহল নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *