বিশেষ দ্রষ্টব্য – ১৬

১৬

এমন গ্রীষ্মে এত অসংখ্য ফুল ফুটল কেন এ-কলকাতায়?, যেখানে যে-কোন সবুজের অস্তিত্ব আছে, এরণ্ড কিংবা মহাদ্রুম, প্রত্যেক সবুজের সঙ্গেই অন্য-একটা রঙের ফুল ফুটেছে, এমনকী, ময়দানের ঘাসেও ফুটেছে ঘাসফুল। এত ফুলের বাহার দেখে, হঠাৎ আমার অনুতাপ হল, কেন আমি সব ফুলের নাম জেনে রাখিনি আগে। নাম না-জেনে ফুলকে আদর করা যায়না। শেক্সপীয়র ভুল বলেছিলেন, কিংবা অনেক বদলে গেছে ফুল ও মেয়েরা, মেয়েদের যে-কোন নামে ডাকা যায়, বিয়ের পর তো সব মেয়েরই নাম বদলে যায়, অনেকসময় ডাকনামও, কিন্তু গোলাপকে চামেলি নামে ডাকা কে সহ্য করবে? ‘গন্ধরাজ’ শুনলেই যেমন অন্ধকারে পাতার আড়ালে লুকানো রাজমুকুটের মতো সেই ফুলটি চোখে ভাসে, ওকে আর অন্য নামে ডাকা সম্ভব? ‘রজনীগন্ধা’ নামটা কোথাও উচ্চারিত হলে, কেন জানিনা, আমার তৎক্ষণাৎ মনে পড়ে, আরাকানের পাহাড়ে পাহাড়ে পলাতক সুজার কোন-এক যুবতী কন্যার শরীর। খুব স্পষ্ট মনে পড়ে, যেন গত বছরের স্মৃতি। যেমন ভাটফুল। ঐ নামের ফুল আমি কখনও চোখে দেখিনি কিংবা দেখলেও চিনিনা, কিন্তু কী জোরালো নাম! শুনলেই শরীর কাঁপে। আমি নিশ্চিত জানি, যেদিন আমি প্রথম ভাটফুল দেখব, আমাকে নতজানু হয়ে বসে ক্ষমা প্ৰাৰ্থনা করতে হবে। দোতলা বাসে যেতে-যেতে ময়দানের একটা উঁচু গাছের মাথায় ঝাঁক-ঝাঁক বসে থাকা হলুদ ফুল দেখলাম। ও ফুলগুলোর নাম কী? কে যেন বলল, রাধাচূড়া। সবসময়ই কৃষ্ণচূড়া ফুলের গাছের উল্টোদিকে রাধাচূড়ার গাছ থাকে। কিন্তু যতক্ষণ-না এ-সম্পর্কে নিশ্চিন্ত হতে পারছি, ততক্ষণ পর্যন্ত ঐ হলদে ফুলগুলোকে পুরোপুরি তারিফ করতে পারছিনা। ফুলের নামের মূল্য অনেক।

আমার বন্ধু সমীর আমাকে বিপদে ফেলে গেল। চৌরাস্তার মুখে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ কথা বলছিলাম, ওর হাতে দুটো চাঁপা ফুল ছিল। একবার অন্যমনস্কভাবে ওর হাত থেকে ফুলদুটো একটু নিতেই, সঙ্গে-সঙ্গে ও বলল, ‘ফুলদুটো তোমাকে দিলাম।’ তারপর আমাকে প্রতিবাদ করার বিন্দুমাত্র সুযোগ না-দিয়ে আচমকা কোন মানুষকে ধাক্কা দিয়ে জলে ফেলে পালিয়ে যাবার মতো, ও ছুটে গিয়ে একটা চলন্ত ট্রামে উঠে অদৃশ্য হয়ে গেল। আমি অসহায় ও বিমূঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে রইলাম। হাতে চাঁপা ফুলদুটো। চাঁপা ফুল! ভাবতেও শরীর শিউরে ওঠে; এ-ফুল আমি হাতে রেখে কী করব? অথচ আমার পকেটের অন্ধকারে সিগারেটের প্যাকেটের পাশাপাশি, কিংবা রুমালের সহবাসে এ-ফুল রাখার নয়। আমার হাতে দুটো চাঁপা ফুল নিয়ে আমি সারা রাস্তা ঘুরব, এ-দৃশ্য আমার কাছেই কল্পনাতীত। ফুল হাতে রাখার নয়, অন্য কারুকে দিয়ে দেবার। সমীর বোধহয় এ-ফুল দেবার মতো কারুকে পায়নি, তাই আমার হাতে তুলে দিয়েই লজ্জায় দ্রুত ছুটে পালাল। কিন্তু, আমি কাকে দেব এই ফুল? তাছাড়া, আমার হাতে ফুল থাকা বেশিক্ষণ নিরাপদ নয়।

এখানে ফুল সম্পর্কে আমার একটি অত্যন্ত কুস্বভাব ব্যক্ত করি। আমি ফুল হাতে রাখা পছন্দ করিনা। গাছ-টাছে ফুটে থাকলে বেশ ভালোই লাগে, কিন্তু হাতে নিলেই আমি তৎক্ষণাৎ মানুষের মতো হয়ে যাই। অর্থাৎ অত্যন্ত লোভ হয়। কোন ফুল দেখে হঠাৎ খুব ভালো লাগলে আমার খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে। আমি অনেক ফুল খেয়েছি। ফুল-খাওয়া দেখলে অনেকে চটে যায়। কী আশ্চর্য! যেন আমি মানুষ খুন করছি। কেউ-কেউ বলে, ফুল নাকি বিষাক্ত হতে পারে। তারা নাস্তিক। আমি কোন দ্বীপে গিয়ে ‘লোটোস’ নামের ফুল খেয়ে দেখিনি, কিন্তু, জবা কিংবা গন্ধরাজ, গ্যাঁদা কিংবা গোলাপ আমি খেয়ে দেখেছি, এমনকি পদ্মফুল, পোস্তফুলও, ওরা সবাই নিষ্পাপ। ফুলটাকে না-খেয়ে শুধু গন্ধ শুঁকে বাহবা দেওয়া কীরকম অস্বাভাবিক লাগে আমার কাছে। ডলুমাসির বাড়িতে গিয়েছিলাম, নিউ আলিপুরে জাপানি কায়দায় চমৎকার বাড়ি করেছেন, আমাকে করিডরের সারি—সারি টবে ফুল দেখাচ্ছিলেন। জিনিয়ার সঙ্গে সন্ধ্যামালতীর ব্রিড করিয়ে উনি একটা হাল্কা রঙের নতুন ফুল তৈরি করেছেন। আমি দেখে এত অভিভূত হয়ে গিয়েছিলাম যে নিচু হয়ে ঝুঁকে গন্ধ শোঁকার ছলে একটা পাপড়ি দাঁত দিয়ে কেটে চিবিয়ে দেখলাম। ডলুমাসি এমন আঁতকে উঠলেন, বাড়ির সব লোকজনকে ডেকে এমন-একটা দৃশ্যের অবতারণা করলেন যে, বিরক্ত হয়ে আমি ও-বাড়িতে আর যাওয়াই ছেড়ে দিয়েছি!

সেই থেকে খানিকটা সজাগও হয়েছি অবশ্য। এই চৌরাস্তায় দাঁড়িয়ে আমি যদি চাঁপা ফুলদুটো কচ্‌কচ্ করে চিবিয়ে খাই এখন, তবে এখুনি আমায় হয়তো এক হাজার লোক ঘিরে ধরবে। ভাবতেও আমার পিঠ শিরশির করে উঠল অথচ ইচ্ছেও করতে লাগল খুব। স্বাধীনভাবে শিল্প-চর্চা করার কত বাধা! দুনিয়াটাই ফিলিস্টিনে ভর্তি।

তবু আমি নোখ দিয়ে একটা পাপড়ির কোণ ছিঁড়ে মুখে দিয়ে দেখলাম। নিখুঁত। তৎক্ষণাৎ আমার মনে হল, এ-ফুল নিশ্চয়ই ঊর্বশী চাঁপা। ফুলের শ্রেষ্ঠ চাঁপা, চাঁপার শ্রেষ্ঠ ঊর্বশী চাঁপা। দেখেই একটু মনে হয়েছিল। ঊর্বশীর মতোই এ-চাপার গায়ের রং, ঊর্বশীর বাঁ হাতের মাঝখানের আঙুলের মতো এর গড়ন।

ঊর্বশী চাঁপা আমাকে প্রথমে চিনিয়েছিলেন ডি কে। সিগনেট প্রেসের দিলীপকুমার গুপ্ত যখন এলগিন রোডে থাকতেন, ওঁদের বাড়ির পাশে ছিল একটা বিরাট চাঁপা ফুলের গাছ। চাঁপা ফুলের অত বড় গাছ আগে কখনো দেখিনি, বাড়ির মাথা ছাড়িয়ে ওপরে উঠে গেছে। ও-গাছটায় বারোমাস ফুল ফুটত। সব গাছেরই ফুল ফোটার একটা নির্দিষ্ট ঋতু আছে, কিন্তু এক-একটা চাঁপা ফুলগাছ চিরযৌবনা। সারাবছরই ফুল ফোটায়, ঊর্বশীর মতোই ভালোবাসার দিনক্ষণ মানেনা। ডি কে আমাদের মাঝে-মাঝে সেই ফুল দিতেন, আমি খেয়ে দেখেছি, ও রকম স্বাদ অন্য ফুলে জীবনে পাইনি কখনও।

কিন্তু, এখন এই দুটো ফুল নিয়ে আমি কী করব? তামাকের গুঁড়োর সঙ্গে মিশিয়ে ওদের আমি পকেটে রাখতে পারিনা। আবার বেশিক্ষণ হাতে রাখার ধৈর্য নেই। হাতে নিয়েই-বা কোথায় যাব? কাকে দেব? এই ফুল কোন মেয়ের হাতে তুলে দেবার মতো সর্বনেশে কথা আমি চিন্তাও করতে পারিনা। কোন নারীর কাছে গিয়ে আমি বলতে পারি, নাও, তুমিই এই ফুলের যোগ্য! মেয়েরা ফুল সহ্য করতে পারেনা, কিংবা ফুলের যোগ্যতা। আমি হর্টিকালচারল গার্ডেনে ফুলের প্রদর্শনী দেখতে প্রতিবার যাই। ওখানে অনেক মেয়ে তাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ সাজসজ্জা করে আসে। আমি ঠিক কাদের দেখতে যাই, নিঃসন্দেহে জানিনা। তবে ঐ ফুলের বাগানে আমি সজ্জিত মেয়েদের শত-শত দুঃখিত মুখ দেখেছি। ঈর্ষার দুঃখ। সঙ্গী পুরুষরা যখন রক্তগোলাপের ঝাড়ের দিকে উৎসুক মুখে চেয়ে থাকে, তখন দেখেছি মেয়েদের মুখে অন্যমনস্ক ঈর্ষা। ওরা সেই ফুলের পাশে কতখানি যোগ্য এই দ্বিধা। মেয়েদের হাতে যখন কেউ কোন ফুল তুলে দেয়, তখন আমি লক্ষ করেছি সেইসব মেয়েদের মুখ। মুহূর্তে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে, মুখগুলি ক্ষণকালের জন্য চলে যায় ভুলস্বর্গে। ভাবে, দাতা বুঝি কুসুমের বদলে গ্রহিতাকেই বিজয়িনী করল।

যাক, কিন্তু আমি ফুলদুটো নিয়ে কী করব? চেনা মেয়েদের কথা দূরে থাক্, পথের যে-কোন সুন্দরী মেয়েকে হঠাৎ ডেকেও আমি ফুলদুটো দিতে পারিনা? দিয়ে বলতে পারিনা, এই নিন, এ-শুধু আপনার সৌন্দর্যের প্রতি নির্লোভ স্তুতি। এ-দেশে ওরকম নীতি নেই। স্তুতি জিনিশটাকে আজকাল আর কেউ নির্লোভ ভাবেনা। সেইজন্যই তো কবিদের আর স্থান নেই এ-সমাজে।

শেষপর্যন্ত আমি বিরক্ত হয়ে উঠতে লাগলাম, ফুলদুটো নিয়ে একি ঝঞ্ঝাট! এই দুটো সুগন্ধ ফুল আমার সন্ধেবেলাটা নষ্ট করে দিচ্ছে, আমি এতক্ষণ চৌরাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে আছি স্থাণুর মতো। কী করব এদের নিয়ে, না-জেনে। শেষপর্যন্ত কি ফুলদুটো শুকিয়ে যাওয়া পর্যন্ত আমাকে অপেক্ষা করতে হবে? ঠিক করলাম, খুন করব ওদের। কুসুমহত্যায় নারীহত্যার অপরাধ নেই। ইচ্ছে হল, নির্মম আঙুলে ওদের ছিঁড়ে টুকরো-টুকরো করে ফেলি। কিন্তু এমন রাগ চড়তে লাগল আমার, মনে হল ঐ শাস্তিও যথেষ্ট নয়। তখন ঠিক করলাম, ওদের ট্রামলাইনের ওপর ফেলে দেব, তারপর পর-পর ট্রাম এসে ওদের থেঁৎলে দেবে সেটা আমি চোখের সামনে দাঁড়িয়ে দেখব। আমি রাস্তার এ-পাশে দাঁড়িয়ে ফুলদুটোকে দূরের ট্রামলাইনের দিকে ছুঁড়ে দিলাম।

ঘটনা গল্পের চেয়েও সাংঘাতিক হয়। হুস করে একটা কালো মোটরগাড়ি এল মাঝপথে, ফুলদুটো গাড়ির জানালা দিয়ে গিয়ে পড়ল একটি মেয়ের কোলে। আমি ভয় ও লজ্জায় সরু হয়ে গেলাম। আমি ফুল খেতে পারি, কিন্তু অচেনা মেয়ের গায়ে ফুল ছুঁড়ে দেবার মতো রোম্যান্টিক কু-কীর্তি করা আমার স্বপ্নের অতীত। সম্পূর্ণ আকস্মিক এই কাণ্ড। গাড়িটা একটু দূরে গিয়েই থেমে গেল। আমি চোরের মতো সরে গিয়ে গ্যাসপোস্টের আড়ালে লুকোলাম। মনে-মনে তখন আমি হাতজোড় করে আছি। কিন্তু এগিয়ে গিয়ে ক্ষমা চাইবার ইচ্ছে হলনা, বা সাহস।

গাড়িটা একটুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর দরজা খুলে একটি মেয়ে বেরিয়ে এল, আহা, কী রূপ মেয়েটির, সরল দীর্ঘ শরীর বাটিকের-কাজ-করা সিল্কের শাড়ি-পরা, কালো কোকড়া চুলের মধ্যে যেন গন্ধরাজ ফুলের মতন মুখখানা ফুটে আছে। মেয়েটি এদিকে এগিয়ে এল। তারপর গাড়ি থেকে বেরিয়ে এল একটি যুবা। এর রূপেরও তুলনা নেই—আরবদের মতো দেহ, কিন্তু কমনীয়, সাহেবি পোশাক-পরা, দাড়ি কামাবার পর ফর্সা মুখে নীলচে আভা পড়েছে। দেখে আমার চোখ জুড়িয়ে গেল, এরকম সুসদৃশ জুটি কদাচিৎ চোখে পড়ে। এরকম যৌবনবন্ত দম্পতি দেখলে সত্যিই আনন্দ হয়। এদের উচিত নয় আমাকে রাগ করে শাস্তি দেওয়া। ওরা যেমন মনের সুখে যাচ্ছিল, তেমনিই চলে যাক-না মনের সুখে। দুটো ফুল আর কী বিঘ্ন ঘটাবে!

ছেলেটি দ্রুত এসে মেয়েটির বাহু ছুঁয়ে বলল, ‘আঃ সুনন্দা, এসো, গাড়িতে ফিরে এসো, কী দরকার!’

—দাঁড়াও, একবার দেখে যাই, লক্ষ্মীটি!

–কাকে?

–আমি জানি কে ফুল ছুঁড়েছে!

হঠাৎ পুরুষটি মেয়েটির বাহু থেকে নিজের হাত সরিয়ে নিয়ে গাঢ় স্বরে বলল, ‘তুমি তাহলে আজও অজয়কে ভুলতে পারনি?’

মেয়েটি অসহায়ভাবে বলল, ‘একটু দাঁড়াও। রাগ কোরো না। একবার অন্তত দেখা করে যাই! এখানেই কোথাও নিশ্চয়ই লুকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একবার শুধু।…’

মেয়েটি আকুলভাবে তাকাল এদিক-ওদিক। যুবকটি মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। ওদের দেখে, হঠাৎ আমি বুঝতে পারলাম, ওরকম অসুখী মুখ আমি আর জীবনে দেখিনি। জানতাম ঊর্বশী চাঁপা সর্বনাশিনী!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *