২৫
আমি একটি অলীক শহরের অধিবাসী। যখন একা-একা পথ হেঁটে যাই, তখন আমি আমার ছায়ার মুখোমুখি থাকি, পাশাপাশি নয়। আমি ঠিক কোন্ দিকে যাব বুঝতে পারিনা, আমার ছায়া পথনির্দেশ করে। অনেকসময় বলে, রাস্তাটা বাঁদিকে বেঁকে গেছে, তোমার যাবার দরকার সামনে, কিন্তু তুমি এখন ডানদিকেই যাও। এমন অবাস্তব, অলীক, অভ্রপুষ্প, মায়া, দৃষ্টিবিভ্রম এই পথগুলি।
বস্তুত, যে-কোন বাস্তব শহরের রাস্তাই হওয়া উচিত সোজা। কখনও বাম—দক্ষিণে বেঁকে যাবেনা। রাস্তা তো আর নদী নয় যে, যে-কোন দিকে ঘুরে যাবার অধিকার আছে। নদী ইচ্ছেমতো যায়, ইচ্ছেমতো লুকোচুরি খেলে, নারী-শরীরের মতো প্রত্যেক বাঁকে-বাঁকে নতুন সৌন্দর্য দেখানো তাকে মানায় —কারণ খেয়ালিপনা প্রকৃতিরই ভূষণ। কিন্তু মানুষ যেখানে সম্মিলিতভাবে কাজ করে সেখানে খেয়ালিপনার কোন অবকাশ নেই—সেখানে শুধু কেজো, দরকারি, শ্রীহীন —সরকারি চিঠির ভাষা ও কাগজের মতো কঠোর ও কুৎসিত হওয়াই স্বাভাবিক। যেমন, নদী আঁকাবাঁকা হয়, কিন্তু মানুষের কাটা খাল হয় সোজা আর লম্বা। মঙ্গলগ্রহে কিংবা চাঁদে প্রথম মানুষের অস্তিত্বের কথা বিজ্ঞানীদের মনে আসে–যখন দূরবীনে কয়েকটা লম্বা-লম্বা খালের মতো দেখা গিয়েছিল। ওরকম সোজা বলেই মনে হয়েছিল ওগুলো নদী নয়, প্রাকৃতিক নয়, প্রাণীর তৈরি। সেই নিয়মে, প্রতি শহরের পথ হওয়া উচিত চওড়া, সোজা, বিচার-বিভাগীয় তদন্তের মতো দীর্ঘ। তার বদলে আমার এই অলীক কলকাতা শহরে সব রাস্তাই কুটিল ও বক্র, মানুষের মনের মতো অলিগলি।
আরেকটি অদ্ভুত কাণ্ড এই শহরের বাড়িগুলি। এক-একটা বাড়ির দেয়াল এক-এক রঙের হয় কেন? বাড়ি চিনতেই পারিনা। এমন নানান রঙের বাড়ি হলে কি সহজে চেনা যায়! আমার কোন-একটা বাড়িতে যাবার দরকার হলে আমি যে-কোন রাস্তায়, যে-কোন দিকে মোড় ঘুরে যে-কোন বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হই। দরজায় ধাক্কা দিয়ে বলি, অমুক আছে? ঠিক কোন-না-কোন অমুক বেরিয়ে আসে। বাংলা ভাষায় দুটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় শব্দ আছে, ‘অমুক’ আর ‘ইয়ে’, অধিকাংশ বাক্যালাপ আমি এই দুটি শব্দপ্রয়োগে সেরে ফেলি। কোন অসুবিধে হয়না। কিন্তু বাড়িগুলো নানা রঙের হওয়ার কোন যুক্তিই নেই। ‘ঈশ্বর গ্রাম সৃষ্টি করেছেন, মানুষ সৃষ্টি করেছেন, আর মানুষ সৃষ্টি করেছে নগর।’ তাহলে, মানুষের গড়া নগর ঈশ্বরের সৃষ্টির চেয়ে আলাদা হবেনা? লাল-নীল-হলুদ-গোলাপী কেন বাড়ির রং, ওসব তো ফুলের রং হয়, বাস্তব শহরের যে-কোন বা প্রতিটি বাড়ির রং হওয়া উচিত কালো, কালোই হওয়া উচিত সমস্ত মানবসমাজের রং। প্রকৃতির একমাত্র কালো অঙ্গ তো যা দেখছি কয়লা, তাও থাকে মাটির নিচে, মানুষ সেগুলো ওপরে তুলেও পুড়িয়ে ছাই রং করে দিচ্ছে। সুতরাং, সমস্ত শহরের বাড়ির রং কালো করে দেওয়া উচিত আইন করে, কোন বাড়ি আর ময়লা দেখাবেনা, কুৎসিত দেখাবেনা, আলাদা দেখাবেনা। একমাত্র আলাদা রং, সাদা রঙের হোক দেবালয়গুলো—মন্দির মসজিদ চৈত্য গির্জা সিনাগগ্। দেবালয় আর মানুষের বাড়ির রং যদি এক হয়, তবে দেবালয়গুলো আলাদা করে-করে তৈরি করার দরকার কী?’হৃদয়-মন্দির’ শব্দটা যে আজকাল অপ্রচলিত হয়ে যাচ্ছে, তার কারণ হৃদয়ের কোন রং নেই, মানুষের দেহকে দেবতার আয়তন হিসেবে ভাবতে অনেক কষ্ট হয়, কেননা মানুষকে শুধু মানুষ হিশেবে চিনতেই বহু সময় কেটে যায়।
আঃ, কল্পনা করেও কত সুখ! যেদিন আমার শহর বাস্তব হয়ে উঠবে প্রতিটি পথ পিচবাঁধানো চকচকে, যতদূর দৃষ্টি যায় সোজা–দুপাশের প্রাসাদসারি নিখুঁত কালো রঙের, কোথাও অন্য রঙের মলিনতা নেই—মাঝে-মাঝে দু-একটি শ্বেত-শুভ্র দেবালয় ছাড়া। প্রকৃতি জানে কীভাবে সুন্দরের দর্শন করতে হয়, মানুষ জানেনা। প্রকৃতি জানে, সুন্দর জিনিশ সবসময় দেখতে নেই, মাঝে-মাঝে চোখের আড়াল করতে হয় পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সৌন্দর্যের আকর যে নারী তাকেও অনবরত দেখলে পুরোনো ও মলিন হয়ে যায় মানুষ তবুও নারীকে মলিন করে। আমি এই তত্ত্ব জেনে একটি বিশেষ নারীকে ঘনঘন দেখতে যাইনি। কিন্তু নারীও মলিনা হতে চায় সে আমাকে ভুলে গিয়ে অপর ঘনঘন-আসা পুরুষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠা হয়েছে। প্রকৃতির যেটুকু কালো রং, সেটুকু সৃষ্টির নয়, বিস্মৃতির, অর্থাৎ রাত্রি। প্রকৃতির যত সৌন্দর্য দিনেরবেলায় দেখায়, সেগুলো আবার আড়াল করে রাখে সারারাত। সেইজন্যই প্রকৃতি মলিন হয়না, হয়তো।
না, শুধু তাই নয়। রাত্রিবেলা চাঁদ ও তারাগুলো দেখার জন্য অমন চমৎকার অন্ধকার পটভূমিকা তৈরি করে। দিনের আলোয় যাঁরা চাঁদ দেখেছেন তাঁরা জানেন, সে চাঁদ ব্যবসায়ীর লাল রঙের বাড়ির পাশে লাল রঙের মন্দিরের মতোই কুৎসিত দেখায়। শুভ্র দেবালয় দর্শনের জন্য শহরের প্রতিটি বাড়ি কালো না হলে চলেনা।
এই অলীক শহরের মানুষগুলোও এমন দুর্বোধ্য যে, আজ পর্যন্ত কারুকে একবিন্দু বুঝতে পারলামনা। একদা আমি দুটি লোকের সংলাপ শুনেছিলাম একটি জটিল রাস্তার মোড়ে। দুটি লাল ও বেগুনি রঙের মানুষ। বলা বাহুল্য, ওদের গায়ের রং লাল কিংবা বেগুনি ছিলনা, স্বাভাবিক মানুষের গায়ের রং যেমন হয়, ময়লা ঘোলাটে জলের মতো। কিন্তু ওদের একজন একটা কটকটে লাল রঙের র্যাপার মুড়ি দিয়ে ছিল, বাকিজন বেগুনি রঙের স্যুট। ওদের দুজনের পোশাকই এমন চড়া রঙের যে দেখলে প্রথমেই মনে হয় ওদের কোন নাম নেই—দুটি লাল ও বেগুনি রঙের মানুষ মাত্র। ওদের সংলাপ এইরকম : বেগুনি লালকে দেখে হন্তদন্ত হয়ে বলল, এই যে বাবলু, তোর সঙ্গে দেখা হয়ে ভালোই হল, তিরিশটা টাকা দে তো। লাল একটু উদাসীন ভঙ্গিতে বলল, টাকা নেই তো ভাই।
–বাড়ি গিয়ে দিবি চল্! আমার হঠাৎ বিশেষ দরকার পড়েছে!
–আমার বাড়িতেও টাকা নেই।
–মহা মুশকিল হল তো। আচ্ছা, তুই একটা চেক্ লিখে দে-না, আমি কাল দশটার মধ্যেই ভাঙিয়ে নেব এখন।
—আমার ব্যাঙ্ক চেক্-বই দেয়না।
–সেকী রে, তোর কোন্ ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট?
–ব্লাডব্যাঙ্কে।
আমি স্তম্ভিত হয়ে এই বাক্যালাপ শুনলাম। সারাদিনটা সেদিন আমার দুশ্চিন্তায় গেল ওদের কথার মর্মার্থ বুঝতে না-পেরে নয়, অন্য কারণে, ওদের রং বুঝতে না-পেরে। যে-লোকের ব্লাডব্যাঙ্কে অ্যাকাউণ্ট তাকে দেখে লাল মানুষ মনে হতে পারে, কিন্তু যে ঋণ চাইছে সে বেগুনি কেন? কী যুক্তি থাকতে পারে এর? সম্পূর্ণ দুর্বোধ্য এই কাণ্ডটি ওরা করে গেল আমার চোখের সামনে!
আরেকদিনও এরকম সংলাপ শুনেছিলাম আমি। সেদিন আমার মনে হয়েছিল –কোন বাস্তব শহরে চিড়িয়াখানা থাকা উচিত নয়। সম্পূর্ণ অবান্তর পাগলামি বলা যায়। একদিন আমার এই অলীক শহরের চিড়িয়াখানা দেখতে গিয়েছিলাম আমি তখন শীতের মৌসুমি পাখি এসেছে। কিন্তু পাখি দেখার বদলে—হিংস্র জন্তু-জানোয়ারগুলো দেখার কৌতূহলই বেশি হল আমার—কারণ ওদের তো সহজে দেখতে পাইনা। একটি ঝোপের পাশ দিয়ে যাচ্ছি, ঝোপের আড়ালের বেঞ্চি থেকে টুকরো সংলাপ কানে এল। একটি বিরক্তি ও ভয়-মিশ্রিত বালিকার চাপা কণ্ঠ, ‘না, একী অসভ্যতা হচ্ছে, ছাড়ুন।
গলার মধ্যে আস্ত পান্তুয়া ঢোকানো অবস্থার মতো স্বরে একটি পুরুষের উক্তি, ‘একি লীলা, তুমি রাগ করছ!’
—না, সত্যি ভাল্লাগেনা। চলুন এবার যাই।
–একটু বসো! আমাকে বুঝি তোমার একটুও ভালো লাগেনা?
–ওসব কী কথা। আঃ না, চলুন।
–তোমাকে আমার এমন ভালো লাগে। সত্যি লীলা, তোমার মতন–
—একি একি! না আপনার সঙ্গে আমার আসাই উচিত হয়নি।
—আমাকে তুমি ভুল বুঝছ। আমি সত্যি তোমাকে এত -। তোমাকে কাছে পাবার জন্য–
—ইস্, ছি-ছি-ছি। ছাড়ুন, ছাড়ুন, উঃ, দূর হয়ে যান! আমি একাই যেতে পারব। অসভ্য, জানোয়ার কোথাকার!
—হা-হা-হা। তুমি সত্যি রেগে যাচ্ছ–
আমার পায়ের নিচ দিয়ে দুটো শিকড় বেরিয়ে আমাকে মাটির সঙ্গে গেঁথে রেখেছিল। নইলে, আগেই আমি স্থানত্যাগ করতাম। কিন্তু পরেও বহুক্ষণ আমি ওখান থেকে নড়তে পারলামনা। ওই একদৃশ্যের বেতার নাটকটার জন্য নয়, ওরকম তো যেখানে-সেখানে আছার ঘটছে, এমনকী বেতারেও ওরকম কুচ্ছিৎ নাটক শোনা যায় অসংখ্য। কিন্তু, আমি অনড় হয়ে ছিলাম, কারণ মেয়েটির ‘জানোয়ার’ বলার সঙ্গে-সঙ্গে লোকটির হা-হা করে হেসে ওঠার মধ্যে আমি অবিকল একটি হায়নার ডাক শুনতে পেয়েছিলাম। চিড়িয়াখানার রেলিংয়ের বাইরে, খোলামেলা মাঠে ঝোপের পাশে হায়নার ডাক শুনতে পাই। তাহলে আর চিড়িয়াখানায় ও-সব জানোয়ার পুষে লাভ কী? সেদিনই আমার উপলব্ধি হয়েছিল একথা যে, ক্লাইভ স্ট্রিট কেন রেলিং দিয়ে ঘিরে রাখেনি। ক্লাইভ স্ট্রিটে একদিন প্রকাশ্য দিনমানে আমি দুটি কুমীরকে পাশাপাশি বুকে হেঁটে যেতে দেখেছিলাম। তাদের দুজনেরই মাথায় পাগড়ি এবং হাতে গ্ল্যাডস্টোন ব্যাগ। কুমীর দুটো গল্প করতে-করতে পাশের একটা গলির মধ্যে ঢুকে গেল। এবং একটা সর্ষের তেলের পুকুরে নেমে সাঁতার কাটতে লাগল।
কিন্তু এরসঙ্গে কিছুরই তুলনা হয়না সেই বৃদ্ধের। এই অলীক শহরের দুর্বোধ্যতম মানুষ। কাল রাত্রে।
আমার এক বন্ধু আমাকে একবার বলেছিল যে, যে-কোন অচেনা মেয়েকেই ‘আপনাকে আগে অনেকবার দেখেছি’ বললে খুব খুশি হয়। মেয়েদের সঙ্গে আলাপ করার উপায় এবং রোগ শুনলেই ওষুধের নাম বলা–পৃথিবীর যাবতীয় লোকের স্বভাব। যাই হোক, বন্ধুটির উপদেশমতো আমি একবার এক জনসম্মিলনীতে একটি অচেনা রূপসী যুবতীকে বলেছিলাম, আমায় চিনতে পারছ, ইন্দ্রাণী? কেমন আছ? এর উত্তরে মেয়েটি বলে যে, সে আমাকে একটুও চিনতে পারেনি, তাঁর নাম ইন্দ্রাণী নয় এবং আমাকে দেখার পরমুহূর্ত থেকে সে আর ভালো নেই। একটুও দমিত না-হয়ে আমি তবু বলেছিলাম—আমি তাকে বহুকাল ধরে চিনি, একজন্ম আগে থেকে, গতজন্মে তার নাম ছিল ইন্দ্রাণী। আমার মনে আছে, আমি জাতিস্মর! মেয়েটি এ-কথায়ও একটুও বিচলিত হয়নি, এবং এর পরবর্তী আখ্যান এখানে আর বিবৃত করার দরকার নেই—শুধু এটুকু বললেই হবে–সেদিনের স্মৃতি আমার পক্ষে সুখকর নয়।
কিন্তু, কাল রাত্রে আমি একজন সত্যিকারের জাতিস্মরেরই দেখা পেয়েছিলাম হয়তো। সন্ধের পর আকাশ-জোড়া মেঘ, আমি একা ছিলাম। এই শহরে আমার কোথাও যাবার জায়গা ছিলনা, কোন একটি মুখও মনে পড়েনি, যার কাছে গিয়ে নির্ভয়ে বলতে পারি, কতদিন তোমায় দেখিনি, তুমি কেমন আছ? মেঘলা আকাশের নিচে বোধহয় সব মানুষই নিজেকে খুব একা মনে করে, কারণ সে—সময় তার ছায়াও পড়েনা। একা থাকতে-থাকতে আমার মন বিষম ভারী হয়ে গেল। আমি রাস্তার মানুষদের মুখের দিকে চেয়ে রইলাম, এরা সন্ধেবেলায় কে কোথায় যায় বোঝা যায়না। কে এখনই বাড়ি থেকে বেরুল, কে বাড়ি ফিরে চলেছে কে এইমাত্র একটি মেয়ের সঙ্গে দেখা করে এলো, কে এখন দেখা করতে যাচ্ছে এসব কিছুই কারুর মুখে লেখা নেই। এমনকী, একটা ফার্নিচারের দোকানের পাশে দাঁড়িয়ে আয়নায় দেখতে পেলাম আশ্চর্য, সব মানুষের মুখই আমার মতো দেখতে, কোন তফাত নেই। আমি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে ময়দানের মধ্যে বহুক্ষণ হাঁটতে-হাঁটতে হঠাৎ থেমে ঘাসের ওপর শুয়ে পড়ি, একটু পরেই ঘুম আসে।
যখন ঘুম ভাঙে, তখনও বৃষ্টি আসেনি, বরং মেঘ কেটে জ্যোৎস্না উঠছে। নীল রঙের জ্যোৎস্না। জ্যোৎস্নার রং এমন স্পষ্ট নীল রেখায় যে আমি অবাক হতে গিয়েও ভাবি–অভিসারে যাবার সময় রাধাও নিজেকে জ্যোৎস্নার সঙ্গে মিলিয়ে দেবার জন্য নীল রঙের শাড়ি পরত। ফলে, আমি জ্যোৎস্না থেকে অন্যমনস্ক হয়ে রেড রোড ধরে হাঁটতে শুরু করি। সেইসময় সেই জাতিস্মরের সঙ্গে আমার দেখা হয়। লোকটি বিশাল কৃষ্ণচূড়াগাছের সঙ্গে মিশে দাঁড়িয়ে ছিল। অত রাত, প্রথমে আমি ভেবেছিলাম দুর্বৃত্ত। কিন্তু, লোকটি অতিশয় বৃদ্ধ। দাঁড়িয়ে থাকার ভঙ্গিটাও অস্বাভাবিক—গাছে হেলান দিয়ে বাহুতে মুখ ঢেকে। আমি কাছে এগিয়ে বলি, ‘আপনার কি শরীর অসুস্থ লাগছে? আমি কোন সাহায্য করতে পারি?’
লোকটি আমার দিকে ভারী কাচের চশমার মধ্য দিয়ে তাকালেন। তারপর বললেন, ‘না, আমি ভালো আছি। আপনি ভালো আছেন তো?’
আমি একটু বিব্রত হয়ে বলি, ‘ও আচ্ছা, বিরক্ত করলাম বলে ক্ষমা চাইছি। এত রাত্রে–এভাবে, সেইজন্যই—’
–আমি রোজ এখানে আসি। অনেক রাত পর্যন্ত থাকি। এই গাছটি আমার বন্ধু!
আমি একটু কাষ্ঠ হাসির চেষ্টা করে বলি, ‘তা বটে, গাছপালা ছাড়া খাঁটি বন্ধু আজকাল পাওয়াই মুশকিল।’
–না, মানুষই মানুষের বন্ধু হয়। গাছ গাছের।
আমি চলে যাবার ভঙ্গিতে দু-একপা এগিয়েছিলাম, এবার লোকটির দিকে আবার ঘুরে তাকালাম। লোকটি আমার মুখের দিকে স্থিরভাবে তাকিয়ে বললেন, ‘যদি বলি, আমি আরজন্মে গাছ ছিলাম? আমার মনে আছে!’
আমি বললাম, ‘যদি বলি’ আর সত্যি-সত্যি বলার মধ্যে অনেক তফাত।
–সত্যিই আমি আগের জন্মে গাছ ছিলাম। এই গাছটার পাশে। এ তখন ছিল আমার বন্ধু। আমার ফুল থেকে মৌমাছি উড়ে গিয়ে ওর ফুলে বসত। আমি জাতিস্মর। আমার মনে আছে।
আমি এবার বৃদ্ধকে যা সন্দেহ করার তাই করি। একটু হেসে বললাম, ‘তা নয়, আপনার আগের জন্মের কথা মনে আছে। কিন্তু এ-জন্মের সবকথা মনে আছে কি? যেমন আপনার নাম কী, বাড়ি কোথায়, আজ কী বার? কত তারিখ, এখন কটা বাজে এইসব?’
লোকটি বললেন, ‘সব জানি, সব মনে আছে। আর এও জানি, তুমি একটি অজ্ঞান ছোকরা। তোমার চোখ খুব খারাপ। তুমি অবিলম্বে চশমা নাও। নইলে হোঁচট খেয়ে মরবে!’
—আচ্ছা ধন্যবাদ, চলি এবার।
আমার ক্ষিদে পেয়েছিল, তাই একটু জোরে হাঁটতে থাকি। তারপর শর্টকাট করার জন্য রেড রোড ছেড়ে মাঠের মধ্যে নামার সঙ্গে-সঙ্গে একটা গর্তে পড়ে হোঁচট খেয়ে পা মুচকে পড়ে যাই। কিন্তু ব্যথার বদলে বিস্ময়ে কঁকিয়ে উঠি আমি। আশ্চর্য, বৃদ্ধ কী করে জানাল আমি হোঁচট খাব। অথবা, ও বলেছে বলেই আমি হোঁচট খেলাম। ইচ্ছে হল জাতিস্মর বৃদ্ধের কাছে ফিরে গিয়ে গাছের পাশে যদি বৃদ্ধকে দেখতে না-পাই, যদি অদৃশ্য হয়ে গিয়ে থাকে তবে এই মধ্যরাত্রে শুধু-শুধু ভয় পেতে হবে আমাকে। অথবা, বুড়োটাকে সত্যিই ওখানে এখন দেখতে পেলে আমি এবার ভয় পাব দেখতে না-পেলে বরং নিশ্চিত হতে পারি। কিন্তু, ঝুঁকি নিয়ে আমি আর ফিরে গেলামনা।
তাহলে, হোঁচট-খাওয়া সম্পর্কে বুড়োর কথা সত্যি হলে–আগের কথাগুলোও সত্যি। আমার চোখ খারাপ–এটা ওই বুড়ো পুরু কাচের চশমা দিয়ে দেখতে পেল! আমার দেখার ভঙ্গি খারাপ, অনেকেই বলেছে, আমি মানতে চাইনা, আমি বলি, আমি বিশেষভাবে দেখি। সে যাই হোক্, আমার আই-সাইট অত্যন্ত ভালো–আমি এক মাইল দূর থেকে কোন বন্ধুর পকেটের দশ টাকার নোট দেখতে পাই—এত শক্তিশালী আমার দৃষ্টিশক্তি, অথচ, আমার চোখের দেখা খারাপ, সেটাকে স্বাভাবিক করার জন্য আমাকে চশমা নিতে হবে–তবে আমি হোঁচট খাবনা–এ-কথা আমাকে বলে এক চশমা-পরা জাতিস্মর—যুক্তির জালে আমি বিহ্বল হয়ে পড়ি। দূরে, শহরের সবকটা বাড়ির রং এখন কালো দেখাচ্ছে।
জ্যোৎস্নায় আমার একটা ছোট্ট ছায়া পড়েছে। সেই দিকে তাকিয়ে আমি টুকরো হেসে নিচু গলায় বলি, থাক্, যথেষ্ট হয়েছে। নীললোহিত, আর তুমি ‘বিশেষ দ্রষ্টব্য’ লিখোনা।