বিশেষ দ্রষ্টব্য – ১০

১০

একঠো কালীঘাট।

আমি ভেবেছিলাম শুধু আমিই বুঝি মেয়েটিকে লক্ষ করছি। তা নয়, মেয়েটি কথাটা বলামাত্রই পাঁচ-সাতজন লোক আঁৎকে উঠে তৎক্ষণাৎ সমস্বরে বলে উঠল, ‘কালীঘাট, কালীঘাট এদিকে কোথায়?’ এমনকি মদ্রদেশবাসী দাড়িওয়ালা ড্রাইভার পর্যন্ত মুখ ঘুরিয়ে মেয়েটিকে দেখল।

ব্যারাকপুরের বাস, চিড়িয়ার মোড় পেরিয়ে ছুটছে। সকাল সাড়ে আটটা। মেয়েটি বাঁ হাতে একটা চক্চকে সিকি উঁচু করে ধরেছিল, আস্তে-আস্তে সেটা নামিয়ে কেমন অভূতপূর্ব চোখে তাকাল। জানলা দিয়ে একটা রোদ্দুরের তীর তার বুক ভেদ করে ওদিকে পর্যন্ত পৌঁছিয়েছে।

জানলার ওপর কনুই ভর দিয়ে হেলে বসেছিল মেয়েটি, বাঁ পা-টা একটু উঁচু করে তুলে রেখেছে। আমি অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে দেখছিলাম। একমাথা সোনাঝুরি লতার মতো হিজিবিজি ময়লা চুল, আঙুল দিয়ে মাঝে-মাঝে পিছনে টেনে সরিয়ে দিচ্ছিল। একপর্দা ধুলো সত্ত্বেও বোঝা যায় মেয়েটির গায়ের রঙ সদ্য রংধরা আপেলের মতো, বয়স চোদ্দ থেকে একুশের মধ্যে নিশ্চয়ই। চোখের মণিদুটি কটা, বনবিড়ালের মতো ভয়ংকর সরল। ঘাগরা আর কাঁচুলি পরে আছে, কাঁচুলির ঠিক মধ্যে দিয়ে একটি রুপালি স্ট্র্যাপ দেওয়া–মাঝে-মাঝে রোদ্দুরে সেটা ঝলসে উঠছে।

নিশ্চয়ই বেদেনী, অথবা যাযাবরী, আমি ভেবেছিলাম– অর্থাৎ ভ্রাম্যমাণ ভিখারিনী। বহু গল্পে পড়েছি এদের কথা, চলচ্চিত্রে দেখেছি, কলকাতাতেও কোথাও-কোথাও, কার্জন পার্কের পাশে, হাওড়া ময়দানে কখনো চোখে পড়েছে, দলবলশুদ্ধ, ছাগল-খচ্চর মোটঘাট সমেত। কিন্তু এমন একলা, এরকম বাসে, এই সুকুমার সকালবেলায় একটি বেদেনী দেখতে পেয়ে অত্যন্ত আকৃষ্ট বোধ করেছিলাম। মফঃস্বলমুখী বাসে বিবর্ণ এবং পিষ্ট চেহারার মানুষের ভিড়ে এই মেয়েটিকে মনে হল আকস্মিক প্রাপ্তির মতো। বেদেনী না-হলেও আমি তাকিয়ে থাকতাম। কোন সুন্দরী মেয়ের দিকে খোলাখুলি তাকাতে আমার লজ্জা করেনা।

… বাস রোকে, এখানে নামিয়ে দাও, উল্টোদিকা বামে উঠো … কিছু লোক চেঁচিয়ে উঠল। ব্যারাকপুরের দিকে কালীঘাট কোথায়! বাস থেমে গেল, মেয়েটি একটি বিচিত্র ভূভঙ্গি করে সতেজ পায়ে নেমে গেল। যেন কালীঘাট পৌঁছনো সম্বন্ধে তার কোন দ্বিধা নেই।

আমি ছট্‌ফট্ করছিলাম। যেন আমার বুক থেকে কোন এক অস্পষ্ট বক্তব্য প্রকাশ করবার জন্য ব্যাকুলতা বোধ করছিলাম আমি। জানালা দিয়ে অনেকখানি মুখ বাড়িয়ে ছিলাম, তারপর বাস একটু চলতে শুরু করতেই আমি যেন আমার কোন বন্ধুকে দূরে দেখতে পেয়েছি, এই ভঙ্গি করে তৎক্ষণাৎ বাস থেকে ছিটকে নেমে পড়লাম। আমার পরিধানে ভদ্র পোশাক, দাড়ি কামানো চকচকে মুখ, কোন গম্ভীর কার্যে ব্যারাকপুর যাচ্ছিলাম। কিন্তু এই অস্বাভাবিক মেয়েটি কেন এই অসময়ে, এইখানে বাসে উঠেছিল এবং কোনদিনও সে কালীঘাটে পৌঁছুবে কিনা—এ কথা জানবার জন্য আন্তরিক ইচ্ছে বোধ করলাম। মনে হল, এ কথা জানতে না-পারলে, এই কৌতূহলের অসুখে আমাকে বহুদিন ভুগতে হবে।

চকচকে কালো পিচ ঢালা ব্যারাকপুর ট্রাঙ্ক রোডের ওপর মেয়েটি দাঁড়িয়ে ছিল। রোদ্দুর তার দেহের চেয়েও ছোট ছায়া ফেলেছে। দাঁড়িয়ে থাকতে-থাকতে মেয়েটি হঠাৎ বাঁ পায়ের গোড়ালিতে ভর দিয়ে এক পাক ঘুরে গেল তারপর অকারণে রাস্তার অন্যপারে চলে গেল এক ছুটে।

একি, আবার ও ব্যারাকপুরের বাসে উঠতে চায় নাকি? আমি একটু দূরে অন্যমনস্কভাবে দাঁড়িয়েছিলাম, মেয়েটির সঙ্গে কথা বলতে পারিনি। মনে হচ্ছিল, রাস্তার প্রত্যেকটি লোক ভেবে নিয়েছে যে আমি মেয়েটির জন্য দাঁড়িয়ে আছি, এখন রাস্তার ওপারে মেয়েটির কাছে আর যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। দূরে একটা বাস আসছে। আমি চোরা চোখে চেয়ে দেখলাম, নর্দমার ধারের একটি বনতুলসীর ফুলহীন ডাঁটা ভাঙবার চেষ্টা করছে সে। হঠাৎ চলন্ত গাড়ির সামনে দিয়েই প্রায় ছুটে এপারে এল, এবং সদ্য-থামা বাসে উঠে পড়ল। অন্য দরজা দিয়ে উঠলাম আমি। ওর দিকে সোজা মুখ করে বসলাম।

–কাঁহে নেই কালীঘাট যায়গা?

এবার কন্ডাক্টারের প্রত্যাখ্যানের বিরুদ্ধে সে দৃপ্ত ভঙ্গিতে রুখে উঠল। যেন রাস্তায় দুদিকের কোন দিকের বাসই কালীঘাট যাবেনা এ-ত্রুটি সে সহ্য করবে—না। সহৃদয় ভদ্রমহোদয়গণ এবং কন্ডাক্টার তাকে বুঝিয়ে দিলে যে শ্যামবাজার গিয়ে বাস বদল করতে হবে। এটুকু বোঝাবার জন্য তাদের অনেক বাক্যব্যয় করতে হল, যতক্ষণ-না বাস শ্যামবাজারে এসে থামল।

তখন শ্যামবাজার অঞ্চল মানুষের ভিড়ে লিবিয়ার জঙ্গলের মতো। সেখানে মেয়েটিকে বড় সামান্য এবং অসহায় মনে হয়। প্রথম দর্শনেই আমি মেয়েটির প্রেমে পড়ে যাইনি। মেয়েটিকে কেন্দ্র করে কোন রোম্যান্টিক কল্পনা আসেনি। কেন আমি মেয়েটির সঙ্গে-সঙ্গে এসেছি নিজেও জানিনা। শুধু ভেতরে-ভেতরে একটা কষ্ট হচ্ছে, মেয়েটি যেন ভুল জায়গায় না-পৌঁছয়।

আমার ইচ্ছে হয়েছিল, মেয়েটিকে যত্ন করে কোন কালীঘাটের বাসে তুলে দিই। কিন্তু তখন উল্টে আমার এই ভয় হচ্ছিল যে, যদি সে আমায় চিনে ফেলে কোন কথা বলে, কোন মিনতি কিংবা আদেশ করে, কিংবা চেঁচিয়ে উঠে আমাকে গালাগালি দেয়, তবে আমার ভদ্রপদবী বিচলিত হবে, এক হাজার লোক আমার দিকে আঙুল দেখিয়ে হাসবে। আমি চোরের মতো মেয়েটির পিছন-পিছন আসতে লাগলাম নিঃশব্দে।

ততক্ষণে অফিস যাত্রীদের ভিড় শুরু হয়েছে। হৌসের বাবুরা পানের ডিবে হাতে করে ধীর-স্থিরভাবে প্রতীক্ষা করছে গাড়ির। জামার কলার চকচকে ইস্ত্রি করা, সকলেরই ভিজে মাথায় চিরুনির চিহ্ন আছে। কেরানিরা জামার হাতায় বোতাম লাগাতে ভুলে গিয়ে পরস্পর অনেক কথা বলাবলি করছে। শোভন পোশাকে সজ্জিত হয়ে মেয়েরা ধীর-স্থিরভাবে একটু বাদেই প্রচণ্ড ভিড়ের হুল্লোড় ছিনিমিনি খেলার প্রতীক্ষায় দাঁড়িয়ে। ট্রাম-বাসের পাদানিতে পা রাখবার জন্য পরম যত্নে শাড়িটা একটু উঁচু করা।

এই প্রসঙ্গে বেদেনী মেয়েটির উপস্থিতি বিরল ব্যতিক্রমের মতো। ফুটপাতের রেলিঙে পা তুলে সে ঘাগরার হাঁটু পর্যন্ত তুলে পরম অভিনিবেশ সহকারে পা চুলকোচ্ছে এবং কোন ব্যথার জায়গায় হাত বুলোচ্ছে। তারপর সে মাথা থেকে একটা উকুন বার করে দুই বুড়ো আঙুলের নখে টিপে শব্দ করে মেরে নাকের কাছে হাত এনে রক্তের গন্ধ শুঁকল। তারপর পিছন ফিরে হঠাৎ তীব্র চোখে আমার দিকে চেয়ে একটা বাসে উঠে পড়ল।

আমি শিউরে উঠলাম, এবং বলবার চেষ্টা করলাম, ও বাস নয়, ও বাস কালীঘাট যাবে না, হাওড়া যাবে। বলা হলনা। মাথা দিয়ে চুঁ-মেরে ভিড় সরিয়ে নির্বিকারভাবে মেয়েটা ভিতরে ঢুকে গেল। আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম।

আমাকে এখন জরুরি গম্ভীর কাজে ব্যারাকপুর যেতে হবে। সারাদিন এক ছাঁচের এক মাপের মানুষের মধ্যে ঘোরাফেরা করতে হবে। মেয়েটা শেষ পর্যন্ত কোথায় যাবে, কোনদিন কালীঘাট পৌঁছবে কিনা, সকালবেলা কোথা থেকে ও এসেছিল—এই না-জানা রহস্যগুলি আমাকে যাবার পথের একা বাসের জানালার চারপাশের অন্যসব দৃশ্যগুলি সম্পর্কে অন্ধ করে রাখবে নাকি? এই বি-পথে যাওয়া মেয়েটির ছবি আমাকে আরও কতদিন জ্বালাবে কে জানে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *