প্রথম অধ্যায় : পটভূমিকা

প্রথম অধ্যায়
 পটভূমিকা

১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে নির্বাচনের পর থেকেই কংগ্রেস ও মুসলিম লিগ নেতৃবৃন্দের মধ্যে তিক্ততা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পায়। ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের ২৪ মার্চ লাহোর প্রস্তাব বা পাকিস্তান প্রস্তাব গ্রহণের পরে দ্রুতগতিতে কংগ্রেস-লিগ মতান্তর হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ককে জটিল করে তোলে। জিন্নার নেতৃত্বে মুসলিম লিগ পাকিস্তান প্রস্তাবকে রূপায়িত করতে সচেষ্ট হয়। অন্যদিকে কংগ্রেস ভারতবর্ষের অখন্ড রূপকে বজায় রেখে রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করে, হিন্দু মহাসভা অখন্ড হিন্দুস্থানের দাবিতে মুখর হয়ে ওঠে। মোটকথা, হিন্দু ও মুসলিম এই দুটি সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্যবধান আরও বৃদ্ধি পায়। স্বভাবতই বিদেশি শাসক এই অবস্থার সুযোগ পুরোপুরি গ্রহণ করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরিসমাপ্ত হওয়ার পরে ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে ভারতীয়দের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয় নিয়ে নতুন করে আলোচনার সূত্রপাত হয়। একই সময়ে ভারতের সর্বত্র সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ঢেউ প্রবাহিত হয়। ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ১৬ আগস্ট কলকাতায় ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়। একটানা চারদিন এই দাঙ্গা চলে। ২০ আগস্ট ঢাকাতে দাঙ্গা হয়। এই অবস্থায় ২ সেপ্টেম্বর ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার’ (Interim Government) গঠিত হয়। প্রথমে মুসলিম লিগ এই সরকারে যোগদান করেনি। ১২ অক্টোবর মুসলিম লিগ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে যোগদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ১৪ অক্টোবর পূর্ববঙ্গের নোয়াখালি ও ত্রিপুরা জেলায় ভয়াবহ দাঙ্গা হয়। ২৪ অক্টোবর বিহারে দাঙ্গা ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। ২৬ অক্টোবর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে যোগদানকারী মুসলিম লিগ সদস্যরা শপথ গ্রহণ করেন। অবশ্য ১৪ নভেম্বর মুসলিম লিগ ঘোষণা করে যে, গণপরিষদে (Constituent Assembly) যোগদান না করার সিদ্ধান্তে লিগ অবিচল থাকবে। ৩০ নভেম্বর ভারতীয় নেতৃবৃন্দ ভাইসরয় লর্ড ওয়াভেলের সঙ্গে লণ্ডনে ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে আলোচনার জন্য যাত্রা করেন। ৯ ডিসেম্বর গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন বসে। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য এই যে, একই সময়ে ভারতের সর্বত্র পাকিস্তান ও অখন্ড হিন্দুস্থানের দাবিতে দু-টি সম্প্রদায় পরস্পরবিরোধী শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়ে এবং বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সূত্রপাত হয়। লিগ সদস্যরা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে যোগদান করার পরে কংগ্রেস ও লিগ মন্ত্রীদের সম্পর্ক এতটা তিক্ত হয়ে পড়ে যে, একসঙ্গে তাঁদের পক্ষে কাজ করা কষ্টকর হয়। মন্ত্রীসভার কংগ্রেস সদস্যরা ভারত বিভাগের অনিবার্যতা উপলব্ধি করে ভারত বিভাগের মধ্যে এই সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ও তিক্ততা অবসানের কথা চিন্তা করতে শুরু করেন। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ২৪ জানুয়ারি পাঞ্জাবের ভয়াবহ দাঙ্গা অবস্থার আরও দ্রুত অবনতি ঘটায়। ২০ ফেব্রুয়ারি (১৯৪৭ খ্রি.) ব্রিটিশ সরকার ঘোষণা করে যে, ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসের মধ্যে তারা দায়িত্বশীল ভারতীয়দের হাতে ক্ষমতা অর্পণ করবে। একই দিনে লর্ড মাউন্টব্যাটেনকে ভাইসরয় পদে নিয়োগ করা হয়। ২০ ফেব্রুয়ারির ঘোষণার পরে মুসলিম লিগ পাকিস্তান প্রস্তাবকে কার্যকরী করতে উদ্যোগী হয়। অন্যদিকে কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভা চেষ্টা করে যাতে ভারত বিভাগ অনিবার্য হলে পাঞ্জাব ও বাংলার শিখ ও হিন্দুপ্রধান অঞ্চল হিন্দুস্থানের অন্তর্ভুক্ত করা যায়। যখন নেতৃবৃন্দের মধ্যে তিক্ততা প্রভূত পরিমাণে বৃদ্ধি পায়, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সমগ্র ভারতকে গ্রাস করে ও ভারত বিভাগ প্রায় অনিবার্য হয়ে ওঠে তখন এক অবিভক্ত, স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ গঠনের পরিকল্পনা রচনা করেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দি, বাংলাদেশে সোশ্যালিস্ট রিপাবলিক গঠনে প্রয়াসী হন শরৎচন্দ্র বসু। পরে এই পরিকল্পনাকে বাস্তবে রূপায়িত করার জন্য সোহরাওয়ার্দি ও শরৎচন্দ্র বসু যুগ্মভাবে চেষ্টা করেন। তাই এই পরিকল্পনা ‘সোহরাওয়ার্দি-বসু পরিকল্পনা’ নামে খ্যাত। এইভাবে তাঁরা বঙ্গবিভাগ রদ করার চেষ্টা করেন।

.

১. A C Banerjee & Dakshina Ranjan Bose (Compiled), The Cabinet Mission in India, Calcutta, 1946; Shyam Sundar Bose & Samarendra Nath Roy (Compiled). Distribution of Muslims in Bengal by Police Stations, Calcutta, 1947; C H Philips. The Evolution of India and Pakistan 1858 to 1947, Selected Documents, London, 1965; C H Philips & Mary Doreen Wainwright (Edited). The partition of India, Policies and Perspectives 1935-1947, London, 1970; অমিয়কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় (সংকলিত), মন্ত্রী-মিশন ও পরবর্তী অধ্যায়, কলিকাতা ১৯৪৭; সন্তোষ ঘোষ, নোয়াখালি ও মহাত্মা গান্ধী, কলিকাতা ১৯৪৭; নির্মলকুমার বসুর অপ্রকাশিত ডায়েরি (এশিয়াটিক সোসাইটিতে রক্ষিত); আকবরউদ্দিন, কায়েদে আযম, ঢাকা, ১৯৬৯, ৭০—৭৬ পরিচ্ছেদ; অমলেন্দু দে, পাকিস্তান প্রস্তাব ও ফজলুল হক, কলিকাতা, মে, ১৯৭২; অমলেন্দু দে, বাঙালী বুদ্ধিজীবী ও বিচ্ছিন্নতাবাদ, কলিকাতা, মে, ১৯৭৪।

২. Statement by H S Suhrawardy, in The Statesman, Calcutta, Wednesday, 9 April, 1947 p 1; Statement by Sarat Chandra Bose, in The Statesman, Wednesday, 21 May, 1947, p. 7; এ এস এম আবদুর রব, শহিদ সোহরাওয়ার্দি, ঢাকা, ১৯৬৮, পৃষ্ঠা. ৬৩—৬৫; Kazi Ahmed Kamal, Politicians and Inside Stories, Dacca, 1970, pp. 67—70. এ এস এম আবদুর রবের ও কাজি আহমেদ কামালের গ্রন্থে সোহরাওয়ার্দি—শরৎ বসু প্ল্যান সম্পর্কে কোনো বিস্তৃত আলোচনা নেই। তাঁরা খুবই সংক্ষেপে বিষয়টির উল্লেখ করেছেন মাত্র। ড. মযহারুল ইসলাম লিখিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব (বাংলা অ্যাকাডেমি, ঢাকা মার্চ, ১৯৭৪) নামক বারো-শো পৃষ্ঠার তথ্যসমৃদ্ধ গ্রন্থে এই বিষয়ের ওপর কোনো আলোচনা নেই বললেই চলে। এই প্ল্যান সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর মনোভাব কী ছিল, লেখক তা আলোচনার অন্তর্ভুক্ত করেননি। আকবরউদ্দিন কায়েদে আযম নামক গ্রন্থে এই বিষয় নিয়ে কোনো আলোচনা করেননি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *