তৃতীয় অধ্যায় : সোহরাওয়ার্দি—শরৎচন্দ্র বসু—আবুল হাশেম প্রচারিত পরিকল্পনা

তৃতীয় অধ্যায়
 সোহরাওয়ার্দি—শরৎচন্দ্র বসু—আবুল হাশেম প্রচারিত পরিকল্পনা

(ক) সোহরাওয়ার্দির বক্তব্য : বাংলার মুসলমান নেতৃবৃন্দের মধ্যে বঙ্গভঙ্গ দাবির প্রথম জোরালো বক্তব্য রাখেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হোসেন শহিদ সোহরাওয়ার্দি। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ৮ এপ্রিল সোহরাওয়ার্দি একটি সাক্ষাৎকারে বলেন:

আমি সবসময়েই এই অভিমত পোষণ করি যে, বাংলাদেশ বিভক্ত করা যায় না। আমি এক যুক্ত ও বৃহৎ বাংলাদেশ গঠনের পক্ষপাতী। যদি বাংলাদেশ বিভক্ত করা হয় তা হলে তা সমগ্র বাঙালির আত্মহত্যার সমতুল্য হবে।

সোহরাওয়ার্দি বলেন :

I have always held the view that Bengal cannot be partitioned. I am in favour of a united and greater Bengal.১১

পুনরায় ২৭ এপ্রিল নয়াদিল্লিতে প্রেস কনফারেন্সে সোহরাওয়ার্দি এক ঐক্যবদ্ধ, অবিভক্ত ও সার্বভৌম বাংলাদেশ গঠনের জন্য সকলের নিকট আবেদন করেন। তিনি একথাও বলেন, বাংলাদেশ বিভাগের দাবি এই প্রদেশের এক শ্রেণির হিন্দুদের হতাশা থেকে উদ্ভূত হয়েছে। তিনি বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে এক উজ্জ্বল চিত্র তুলে ধরেন। তিনি বলেন, যদি বাংলাদেশ ঐক্যবদ্ধ থাকে তাহলে বাংলাদেশ একটি মহান দেশে পরিণত হবে এবং ভারতবর্ষের মধ্যে সবচেয়ে সমৃদ্ধিশালী হবে। এখানকার অধিবাসীদের এক উন্নত জীবনযাত্রার অধিকারী করতে সক্ষম হবে। একটি মহান জাতি সগর্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে। যেভাবে সোহরাওয়ার্দির বক্তব্য প্রকাশিত হয় তা এখানে উদ্ধৃত করা হল :

‘Partition,’ he said, ‘would be suicidal even from the Hindus point of view.’ Referring to the Bengal of the future, he said that it will ‘be a great country, the richest and the most prosperous in India, capable of giving its people a high standard of living, where a great people will be able to rise to the fullest height of their stature, a land that will be truly plentiful.’ ১২

সোহরাওয়ার্দি বলেন, একসঙ্গে বসে আলাপ-আলোচনা করে এই নতুন বাংলাদেশের জন্য এমন শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করতে হবে যা এখানকার সকল সম্প্রদায়ের অধিবাসীদের সন্তুষ্ট করবে এবং বাংলার গৌরব বৃদ্ধি করবে। তিনি একথাও বলেন, যদি হিন্দু নেতৃবৃন্দ ঐক্যবদ্ধ-অবিভক্ত-সার্বভৌম বাংলাদেশকে কেবলমাত্র নীতিগতভাবে গ্রহণ করেন তাহলে তিনি হিন্দুদের ইচ্ছাকে রূপায়িত করার জন্য অনেক দূর পর্যন্ত যেতে প্রস্তুত আছেন। সোহরাওয়ার্দির ভাষায় :

Surely some method of goverment can be evolved by all of us sitting together which will satisfy all sections of the people and revivify the splendour and glory that was Bengal….I would go very very far indeed to meet the wishes of the Hindus in Bengal, if they would only accept the principle of a sovereign, undivided Bengal.১৩

তাঁকে প্রেসের প্রতিনিধিরা কয়েকটি প্রশ্ন করেন, যথা—(ক) তিনি সার্বভৌম বাংলাদেশ গঠনের বিষয়টির মীমাংসা করার জন্য কোনো রেফারেণ্ডাম গ্রহণ করতে রাজি আছেন কি না? (খ) এই স্বাধীন বাংলাদেশ পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হবে কি না? (গ) তিনি ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ রাষ্ট্রে যুক্ত নির্বাচন ব্যবস্থা (joint electorates) গ্রহণ করবেন কি না? প্রথম প্রশ্নের উত্তরে সোহরাওয়ার্দি বলেন, এই প্রস্তাব সম্পর্কে রেফারেণ্ডাম গ্রহণ করা আত্মহত্যাতুল্য হবে। শেষের দুটো প্রশ্ন সম্পর্কে তিনি কোনোই মতামত ব্যক্ত করেননি। তিনি শুধু বলেন, দেখা যাক স্বাধীন বাংলাদেশ কীভাবে কাজ করে। স্বাধীন বাংলাদেশ নিজেই তার শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করবে।১৪

প্রেসের প্রতিনিধিরা সোহরাওয়ার্দিকে জিজ্ঞেস করেন, এই স্বাধীন বাংলাদেশের পরিকল্পনা জিন্নার আশীর্বাদ ও মুসলিম লিগ বা হাই কমাণ্ডের তাঁর অন্যান্য সহযোগীদের সমর্থন লাভ করেছে কি না? এই প্রশ্নেরও কোনো সুস্পষ্ট উত্তর না দিয়ে সোহরাওয়ার্দি শুধু বলেন:

আমি নিজের পক্ষ থেকেই বলছি। আমি বাংলাদেশের পক্ষ থেকেই বলছি। আমি বিভক্ত ভারতে এক স্বাধীন, অবিভক্ত ও সার্বভৌম বাংলাদেশের চিত্র কল্পনা করেছি।

সোহরাওয়ার্দি উত্তর দেন :

I Speak for myself. I speak for Bengal. I am visualising an Independent, undivided, sovereign Bengal in a divided India. ১৫

সোহরাওয়ার্দিকে প্রশ্ন করা হয় যে, যদি বিভাগ অনিবার্য হয় তাহলে পূর্ববাংলা একটি স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে টিকে থাকতে পারবে কি না? তখন তিনি বলেন, নিশ্চয়ই টিকে থাকতে পারবে। অবশ্য তা নির্ভর করবে এই অঞ্চলের জনসাধারণ কতটা আত্মত্যাগ করতে পারবে তার ওপর। যদি পূর্ববঙ্গের অধিবাসীরা (অসমের যে অংশ তারা পাবেন তা সহ) প্রয়োজনীয় আত্মত্যাগ করতে ইচ্ছুক থাকেন, তাহলে পূর্ববঙ্গ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে অবস্থান করতে পারবে। সোহরাওয়ার্দি বলেন :

It depends upon what sacrifices the people are prepared to undergo. The people of East Bengal and whatever they might get of Assam can if they were willing to make the necessary sacrifices exist as an independent state.১৬

সোহরাওয়ার্দী বলেন, যাঁরা বাংলাদেশের উন্নতি ও সমৃদ্ধির কথা চিন্তা করেন তাঁদের কাছে বাংলাদেশ বিভাগের আন্দোলন বেদনাদায়ক মনে হচ্ছে। এক হতাশা ও অধৈর্য থেকে কতিপয় হিন্দু নেতা এই দাবি তুলেছেন। তাঁরা বলেন, হিন্দুরা সংখ্যা, অর্থ, যোগ্যতা ও শিক্ষা অনুযায়ী বাংলার মন্ত্রীসভায় তাঁদের যোগ্য আসন পান না। কিন্তু তাঁরা একথা বুঝতে পারেন না যে, বাংলার বর্তমান অবস্থা ভারতবর্ষের সঙ্গে সম্পর্কিত এবং তিনি আশা রাখেন, তাঁর কল্পিত বাংলাদেশে তা কখনোই প্রযোজ্য হবে না। বর্তমানে ভারতবর্ষে আমরা এমন এক সংগ্রামে লিপ্ত যেখানে সর্বভারতীয় গুরুত্ব আছে এমন বিষয় নিয়ে বিভিন্ন গ্রূপ প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত। প্রতিটি গ্রূপই নিজের অভিমত অন্যের ওপর চাপিয়ে দিতে বদ্ধপরিকর। তাদের বিতর্ক সমস্ত প্রদেশের রাজনীতিকে প্রভাবান্বিত করছে এবং সমস্যাসমূহকে সামগ্রিকভাবে দেখা হচ্ছে। অথচ প্রতিটি প্রদেশ যখন নিজের দিকে দৃষ্টি দেবে এবং সম্পূর্ণ স্বাধীনতা না হলেও কার্যকরী স্বাধীনতা অর্জন করবে তখন তারা এক সম্পূর্ণ ভিন্ন অবস্থা দেখতে পাবে। এই অবস্থায় বাংলাদেশের জনসাধারণও পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল হবে। সোহরাওয়ার্দি বলেন :

This frustration is largely the result of a failure to realize that present conditions in Bengal, which is linked to India, are not applicable to an independent sovereign state as I hope Bengal will be. Today we are in the midst of a struggle in India between contending factions of all-India importance, each intent on enforcing its views on the other and neither willing to give way except at a price which the other is not prepared to pay. Their disputes profoundly affect the politics of all the provinces and the problems are being treated as a whole. An entirely different state of circumstances will arise when each province will have a look after itself and when each province is sure to get practical, if not total independence, and the people of Bengal will have to rely upon each other.

It is unbelievable that under such a set of circumstances there can exist a Ministry in Bengal which will not be composed of all the important elements in its society or which can be a communal party Ministry, or where the various sections will not be better represented than are now.১৭

একথা অবিশ্বাস্য মনে হবে যে, এই পরিবর্তিত অবস্থায় বাংলাদেশে এমন এক মন্ত্রীসভা অবস্থান করতে পারে যেখানে সমাজের সকল অংশের ভূমিকা থাকবে না, অথবা যা শুধু সাম্প্রদায়িক দলের মন্ত্রীসভা হবে, অথবা যেখানে বর্তমানের চেয়ে আরও ভালোভাবে বিভিন্ন অংশের লোকেরা প্রতিনিধিত্ব করবে না। আমি মনে করি না, মুসলমানদের সংখ্যা কিছুটা বেশি থাকায় তাঁরা যদি মন্ত্রীসভায় সামান্য সংখ্যাগুরু হন তাহলে হিন্দুদের বিশেষ আপত্তির কারণ হবে। কারণ ইতিপূর্বেও এই অবস্থা সকলে মেনে নেন। কেউ কি একথা ভাবতে পারেন যে, পরিবর্তিত পরিবেশে মুসলমানেরা বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দুদের ওপর অত্যাচার করতে পারেন? অনেকগুলো কারণেই তা অসম্ভব : হিন্দুদের নিজস্ব শক্তি যে-কোনো শাসনব্যবস্থাকে পঙ্গু করে দিতে পারে। শাসনতন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে তাঁরা অধিষ্ঠিত আছেন। সরকারি চাকরিতে তাঁরাই সংখ্যাগুরু। সেক্রেটারিয়েটের শাসনব্যবস্থা তাঁদেরই কবজায় আছে। স্বভাবতই হিন্দু অফিসারের প্রভাব ও প্রতিপত্তি অগ্রাহ্য করা অসম্ভব। উপরন্তু, বাংলাদেশের সীমান্তেও দুই কোটি হিন্দু থেকে যাবেন। তাঁরা সবসময়ে সমধর্মীদের অধিকার বজায় রাখতে তৎপর থাকবেন। এই অবস্থায় বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে হিন্দুদের প্রতি অবিচার করা সম্ভব নয়। সোহরাওয়ার্দি বলেন :

I do not think that the fact that the Muslims will have a slight preponderance in the Ministry by virtue of their slender majority will be grudged by the Hindus as indeed this has hitherto been accepted by all as inherent in the nature of things in Bengal. Does any one seriously conceive that it is possible under such a set of circumstances to visualize that one section of the people, say the Muslims, can tyrannize over the majority namely the Hindus in Bengal?

There are several factors which make such a thing impossible and unbelievable. There is the internal strength which can paralyse any unfair Administration. They occupy the most important places in the Administration. They are a majority in the services. The Administration in the Secretariat is in their hands. The most important and the experienced officers of the Government are Hindus. It is just ridiculous to think that their position and influence can be ignored.

Over and above this Bengal will have 20,000,000 Hindus on its frontiers who will certainly make it their cause to see that their co-religionists have a fair deal in the province. It will just be fatuous and suicidally fatuous for any Muslim Government to give an unfair deal to the Hindus of Bengal.১৮

সোহরাওয়ার্দি বলেন, অভিযোগ করা হয় বাংলার বর্তমান সরকার হিন্দুদের প্রতি অবিচার করছে। কিন্তু এই নিন্দাবাদ অনেকটা কল্পিত অভিযোগ ভিত্তি করেই করা হয়। তিনি বলেন, বাংলাদেশ বিভাগের দাবি বাংলাদেশের বৃহৎসংখ্যক হিন্দুদের দাবি নয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের হিন্দুদের মধ্যে যোগাযোগ এতই নিবিড় যে, তাঁরা এই সম্পর্ক ছিন্ন করতে সম্মত নন। এই বিভাগ তখনই করা সম্ভব যদি মুসলমান, হিন্দু, তপশিলি সম্প্রদায় ও অন্যান্য অংশের লোকেরা তা চান। তা ছাড়া অর্থনৈতিক সংহতি ও পারস্পরিক নির্ভরশীলতার জন্যও একটি কার্যকরী রাষ্ট্র গঠন করা প্রয়োজন। বাংলাদেশের এই বিশেষ পরিস্থিতি মুসলমান কতৃক ভারত বিভাগের দাবি থেকে বাংলাদেশের সমস্যা যে স্বতন্ত্র তা উল্লেখ করছে। সোহরাওয়ার্দি মন্তব্য করেন :

I have read most fervid fulminations against the Government of Bengal on its alleged treatment of the Hindu Population. These denunciations have been built on the most slender and imaginary foundations. I, by no means, admit that the demand for the partition of Bengal is the demand of the majority of the Hindus even of West Bengal, let alone of the majority of the Hindus of Bengal. The ties and culture of the Hindus of every part of Bengal are so much the same that it is not open to the Hindus of one part of Bengal to sever those ties in the hopes of grasping power.

Indeed by the same analogy the wishes of all the peoples of Bengal, Muslims, Hindus and Scheduled Castes and others ought to be ascertained on the question of the partition of Bengal, which can only be undertaken if there is a substantial majority in its favour. It is these fundamental factors peculiar to Bengal which differentiate the question of partition of Bengal from the Muslim demand for the division of India, apart from such factors as economic integrity, mutual reliance and the necessity of creating a strong workable state.১৯

সোহরাওয়ার্দি বলেন, বাংলাদেশ বিভাগের জন্য হিন্দু মহাসভাই বিশেষভাবে উদ্যোগী হয়ে আন্দোলন শুরু করে। তাদের উদ্দেশ্য হল বর্তমান মন্ত্রীসভাকে বাতিল করা, ৯৩ নম্বর ধারা প্রয়োগ করা, পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গে পৃথকভাবে মন্ত্রীসভা গঠন করা। এইভাবে হিন্দু মহাসভা হিন্দু জনসাধারণের মধ্যে তাদের প্রভাব বৃদ্ধি করতে তৎপর হয়েছে এবং কংগ্রেসের প্রভাব ক্ষুণ্ণ করতে চেষ্টা করছে।২০ অবশ্য গত নির্বাচনে একথা প্রমাণিত হয়েছে, কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভা কেউ তপশিলি সম্প্রদায়ের মুখপাত্র নয়। তাঁদের পক্ষ থেকে কথা বলার অধিকারী হল সিডিউলড কাস্ট ফেডারেশন।২১ তা ছাড়া বাংলাদেশ বিভাগের দাবি উচ্চবর্ণ হিন্দুদেরও সকলের দাবি নয়। তাঁদের মধ্যে এমনও অনেকে আছেন যাঁরা কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভার সমর্থক নন। স্বভাবতই তাঁরা সাধারণ মানুষের উপযোগী শাসনব্যবস্থাতেই বেশি খুশি হবেন। অন্যদিকে কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভার শক্তির উৎস হল সুবিধাভোগী শ্রেণিসমূহ। সুতরাং, বাংলাদেশ বিভাগের দাবি হিন্দুসমাজের সার্বজনীন দাবি নয়।২২

১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের আদমশুমারি উল্লেখ করে সোহরাওয়ার্দি বলেন, এখানে এমন একটা থানা পাওয়া কষ্টকর হবে যেখানে উচ্চবর্ণের হিন্দুরা অবনত অংশসহ সংখ্যাগুরু জনসমষ্টি। মুসলমানেরা অভিযোগ করেন, ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের আদমশুমারি মুসলমানদের প্রতি মোটেই সুবিচার করেনি, হিন্দুদের প্রতি পক্ষপাতিত্ব প্রদর্শন করেছে। হিন্দু মহাসভা প্রচার করে, ভারতবর্ষের শাসনতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে জনসংখ্যার গুরুত্ব যথেষ্ট হবে। সুতরাং আদমশুমারিতে হিন্দুদের সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য সচেষ্ট হতে হবে। এইসব কথা উল্লেখ করে সোহরাওয়ার্দি বলেন, হিন্দু অর্থনীতিবিদেরা ও পর্যবেক্ষকেরা যতই বলুক-না কেন যে, পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুরা একটি ক্ষয়িষ্ণু জাতি, আর অন্যদিকে মুসলমানেরা পৌরুষপূর্ণ ও প্রচুর পরিমাণে উৎপাদনশীল, ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দের সংখ্যা অনুযায়ী উভয় সম্প্রদায়ের আনুপাতিক হার প্রায় একইরকম আছে। ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে এক বৃহৎসংখ্যক হিন্দু ও হিন্দুসমাজের অনির্ধারিত গ্রূপসমূহ তাদের বর্ণ (caste) উল্লেখ করতে অস্বীকার করে। এই সময়ে তপশিলি সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচার চালানো হয় যে, তাঁরা যেন নিজেদের বর্ণ উল্লেখ না করে কেবলমাত্র হিন্দু হিসেবে নিজেদের পরিচয় দেন। সম্ভবত এই কারণেই যাঁরা নিজেদের বর্ণ উল্লেখ করেননি তাঁদের মধ্যে অনেকেই তপশিলি সম্প্রদায়ের ছিলেন।২৩ প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায়, বর্ধমান জেলার বর্ণহিন্দুদের হার হল ৩২.৩৬ শতাংশ এবং অ-প্রেরিত হিন্দুদের (Non-returned Hindus) হার ১৮.৬ শতাংশ। এই আনুপাতিক হার এই জেলার প্রতিটি মহকুমাতেই দেখা যায়। বীরভূম জেলার বর্ণহিন্দুদের হার হল ২৯.০৪ শতাংশ এবং অ-প্রেরিত হিন্দুদের হার ৯.৭১ শতাংশ। এই আনুপাতিক হার এই জেলার দুটো মহকুমাতেই ছিল।২৪

তিনি বলেন, ধরে নেওয়া যাক সকল স্তরের হিন্দুরাই বাংলাদেশ বিভাগের পক্ষে আছেন। কিন্তু প্রশ্ন হল, বর্তমান শাসনব্যবস্থায় হিন্দুদের সংস্কৃতি, ধর্ম ও ভাষা কী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং তাঁরা কীভাবে চিন্তা করেন যে, ঐক্যবদ্ধ বাংলাদেশে তাঁরা নির্যাতিত হবেন, আর তা থেকে উদ্ধারের একমাত্র পথ হল পশ্চিমবঙ্গের ক্ষুদ্র অঞ্চল নিয়ে পৃথক রাজ্য গঠন করা যেখানে তাঁদের জীবন ও সংস্কৃতি রক্ষা করা যাবে ও তার সমৃদ্ধি ঘটবে? এইসব কথা উল্লেখ করে সোহরাওয়ার্দি বাঙালি হিন্দুদের পৃথক বাসভূমি গঠনের দাবিটি বিশ্লেষণ করে দেখান, হিন্দুদের দিক থেকে ভাবলেও দেখা যাবে এই দাবি তাঁদের পক্ষে আত্মহত্যাকর হবে।২৫

তবুও যদি দেখা যায় (যা সোহরাওয়ার্দি সম্ভবপর মনে করেন না,) ঐক্যবদ্ধ বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থা ধীরে ধীরে মুসলমানদের হাতে চলে গেছে এবং তাঁরা হিন্দুদের ধ্বংস করতে বদ্ধপরিকর, তা হলেও কি এই নীতি কার্যকরী করা সম্ভব? মোটেই নয়। কারণ এই মনোভাব মুসলমানদের বাধা দেবার জন্য হিন্দুদের সংঘবদ্ধ করবে। তা ছাড়া সরকারকে তো তার কর্মচারীদের সাহায্যেই এই নীতি প্রয়োগ করতে হবে, আর তাঁদের মধ্যে বেশিরভাগই হল হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত।২৬ উপরন্তু শিল্প, ব্যাবসাবাণিজ্য, বিভিন্ন পেশা ইত্যাদিও হিন্দুদের হাতে রয়েছে। হিন্দু যুবকেরা অনেক সচেতন ও অগ্রসর। তাঁরা জানেন, কীভাবে তাঁদের অধিকার বজায় রাখতে ও দাবি আদায় করতে হয়। তাই বর্তমানে হিন্দুরা বাংলাদেশ বিভাগের জন্য যে মনোভাব প্রদর্শন করছেন তা তাঁদের অস্থিরতা ও হতাশা থেকেই উদ্ভূত। এই দাবি কেবলমাত্র দূরদৃষ্টির অভাবই সূচিত করে না, এই দাবি তাঁদের পরাজিত মনের এক করুণ স্বীকৃতিও বটে। বাংলাদেশের মহান হিন্দু সম্প্রদায় থেকে এই মনোভাব মোটেই আশা করা যায় না।২৭

সোহরাওয়ার্দি বলেন, হামেশাই উল্লেখ করা হয় যে, স্বাধীন বাংলাদেশে হিন্দুদের পরিণতি কী হবে তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হল নোয়াখালি। কিন্তু সোহরাওয়ার্দি বলেন, বর্তমানের অবস্থা থেকে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়া হাস্যকর হবে। তা ছাড়া নোয়াখালি ও ওই অঞ্চলের ঘটনাবলিকে কি আদর্শ নমুনা এবং ভবিষ্যতের আভাস বলে বিবেচনা করা যায়? এমন জেলাও রয়েছে যেখানে মুসলমানেরা নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও শান্তি বজায় রয়েছে এবং হিন্দুরা পূর্বের মতোই তাঁদের প্রভাব ও সুযোগ বজায় রেখেছেন।২৮

সোহরাওয়ার্দি বলেন, বলা হয় বর্তমান সরকার চাকরি, শিক্ষা, ব্যাবসা ইত্যাদি ক্ষেত্রে সব সুযোগসুবিধাই মুসলমানদের দিচ্ছে। খুবই দুঃখের কথা, সরকারের এই কাজ সমালোচিত হচ্ছে। বর্তমানে যে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদর্শন করা হচ্ছে তা প্রধানত যুদ্ধের ফলেই উদ্ভূত হয়েছে এবং তা শীঘ্রই বিলীন হবে। এর প্রতি কোনো গুরুত্ব আরোপ করার প্রয়োজন নেই, কারণ এই উৎসাহদান করে দরিদ্র ও হীন মুসলমানদের প্রতি কিছুটা ন্যায়বিচার করার চেষ্টা হয়েছে মাত্র। সোহরাওয়ার্দি বলেন :

It is said that this Government is handing out patronage to Muslims in the way of posts, educational facilities and business. It is a pity that this is considered to be a cause for grievance. It is indeed a pity because the patronage (mostly born of the war and shortly to disappear) is of pitiful dimensions, hardly worth noticing and is merely an attempt to do some justice to the Muslims after their relegation to the position of hewers of wood and drawers of water.২৯

প্রসঙ্গত সোহরাওয়ার্দি জিন্নার কথাও উল্লেখ করেন। জিন্না প্রায়ই বলেন, কোনো সরকারই সংখ্যালঘুদের সহযোগিতা ছাড়া চলতে পারে না। সোহরাওয়ার্দির মতে, ভারতবর্ষের অন্যান্য প্রদেশ থেকে বাংলাদেশের ক্ষেত্রেই জিন্নার এই বাণী বিশেষভাবে প্রযোজ্য।৩০

সোহরাওয়ার্দি বলেন, যদি আমরা বাংলাদেশকে অবিভক্ত রাখি, যদি এই প্রদেশকে মহান করার জন্য আমরা ঐক্যবদ্ধ থাকি, তাহলে আত্মনিয়ন্ত্রণের নীতি অনুযায়ী মানভূম, সিংভূম, পূর্ণিয়া জেলার ওপর আমাদের দাবি এবং সমগ্র অসম না হলেও (তাদের সম্মতিসহ) সুরমা উপত্যকার ওপর আমাদের অধিকার স্থাপন করা সম্ভব হবে। অবশ্য বাংলাদেশে হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে বিরোধের অবসানে যখন পরস্পরের মধ্যে সহযোগিতা ও নির্ভরশীলতা গড়ে উঠবে, তখনই এই উদ্দেশ্য সফল করা সম্ভব। আর তার ফলে বৃহৎ বাংলাদেশ মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে।৩১

সোহরাওয়ার্দি বলেন, আমি যে স্বাধীন বাংলাদেশের কল্পনা করেছি তা ভারতের কোনো অঞ্চলের অংশ হিসেবে থাকবে না। একবার এই ধরনের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে তার ভবিষ্যৎ তার ওপরই নির্ভর করবে। আমি কখনোই ভুলতে পারি না বাংলাদেশের পঞ্চাশের মন্বন্তরের (১৯৪৩খ্রি.) ভয়াবহ রূপ উপলব্ধি করতে ভারত সরকারের কত বিলম্ব হয়েছিল, কীভাবে বাংলার বিশেষ প্রয়োজনে প্রতিবেশী বিহার প্রদেশ খাদ্যশস্য পাঠাতে অস্বীকার করে, কীভাবে ভারতের প্রতিটি প্রদেশ তাদের দুয়ার বন্ধ করে দেয় এবং প্রয়োজনীয় দ্রব্য থেকে বাংলাকে বঞ্চিত করে, কীভাবে ভারতীয় কাউন্সিলে বাংলাকে এক অবহেলিত স্থানে রাখা হয়েছে, আর অন্যান্য প্রদেশের প্রভাব অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি করা হয়েছে।৩২

সুতরাং, বাংলাকে যদি মহান করতে হয় তাহলে তাকে নিজের পায়ের ওপর দাঁড়াতে হবে এবং সকলকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। তার অফুরন্ত সম্পদ ও ভাগ্যের বিধাতা তাকে হতে হবে। অন্যান্যদের দ্বারা বাংলাকে শোষণ বন্ধ করতে হবে এবং বাংলা আর বাদ বাকি ভারতের স্বার্থে নিজের বেদনাকে বাড়াবে না। অচিরে কলকাতা ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল নিয়ে বিরোধের সূত্রপাত হবে। এই অঞ্চল বিদেশিদের প্রভূত অর্থসম্পদ দিয়ে তৈরি হয়েছে। বাংলার মাটির সঙ্গে সংযোগবিহীন, অর্থ উপার্জনের আশায় অন্য প্রদেশ থেকে আগত বহুসংখ্যক লোকেরা এখানে বসবাস করছে। একেই অন্যদিক থেকে শোষণ বলা চলে। এই অবস্থায় বাংলাদেশ বিভাগের দাবি ভয়ানক ক্ষতিকারক হবে। তাই সোহরাওয়ার্দি এই আন্দোলন পরিহার করতে বলেন এবং একসঙ্গে বসে সবাই মিলে বাংলাদেশে সরকার পরিচালনার জন্য উপায় নির্ধারণ করতে অনুরোধ করেন। স্বাধীন বাংলার পক্ষে সোহরাওয়ার্দি যে ভাষায় তাঁর মনোভাব ব্যক্ত করেন তা লক্ষণীয় :

I have visualized Bengal all along, therefore, as an independent state and not part of any union of India. Once such states are formed, their future rests with them. I shall never forget how long it took for the Government of India to realize famine conditions in Bengal in the year 1943, how in Bengal’s dire need it was denied food-grains by the neighbouring province of Bihar, how since then every single province of India has closed its doors and deprived Bengal of its normal necessities how in the Councils of India Bengal is relegated to an undignified corner while other provinces wield undue influence.

No, if Bengal is to be great, it can only be so if it stands on its own legs and all combine to make it great. It must be master of its own resources and riches and its own destiny. It must cease to be exploited by others and shall not continue to suffer any longer for the benefit of the rest of India. So in the end the tussle will rage round Calcutta and its environments, built up largely by the resources of foreigners, inhabited largely by people from other provinces who have no roots in the soil and who have come here to earn their livelihood, designated in another context as exploitation. Alas, if this is the main objective, as my figures would demonstrate, then no claim for the partition of Bengal can remain static, and a cause for enmity and future strife would have been brought into being of which we can see no end. To those, therefore, of the Hindus who talk so lightly of the partition of Bengal I make an appeal to drop the movement so fraught with unending mischief. Surely some method of Government can be evolved by all of us sitting together which will satisfy all sections of the people and revive the splendour and glory that was Bengal.৩৩

স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনের জন্য সোহরাওয়ার্দি বারে বারে আবেদন করেন। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল, মে ও জুন মাসে তিনি এই ধরনের কয়েকটি বিবৃতি প্রকাশ করেন। ৭ মে একটি বিবৃতিতে তিনি বলেন, যদি বাংলাদেশ বিভক্ত হয় তা হলে ভারতের অন্য প্রদেশের লোকেরা নিজেদের স্বার্থে এই অঞ্চল শোষণ করতে পারবে।৩৪ ১ মে ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় একটি বিবৃতিতে সোহরাওয়ার্দির বক্তব্যের সমালোচনা করেন এবং বাংলাদেশ বিভাগের পক্ষে অভিমত ব্যক্ত করেন। সোহরাওয়ার্দি তার উত্তর দেন। সোহরাওয়ার্দি বলেন, বাংলাকে কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত করার আগ্রহ এই বিশ্বাস থেকেই হয়েছে যে, যদি বাংলাদেশ কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত হয়, যে কেন্দ্রে প্রধানত হিন্দু আধিপত্য থাকবে, তা হলে বাংলার হিন্দুদের জীবন, স্বাধীনতা ও সংস্কৃতি রক্ষা পাবে, নতুবা ঐক্যবদ্ধ বাংলায় তা বিনষ্ট হবে। তিনি প্রশ্ন করেন, এ কি পরাজয়ের তত্ত্ব নয় এবং অস্থিরতাপ্রসূত ভয়ানক নৈতিক দুর্বলতা নয় যে, বাংলার হিন্দুদের শিথিল কেন্দ্রের সাহায্যপ্রার্থী হতে হবে? আমি দেখতে পাচ্ছি, বাংলার কতিপয় হিন্দু নেতা ভারতের হিন্দুদের চাপের নিকট আত্মসমর্পণ করছেন এবং তাঁদের খেলাই খেলছেন। যদিও তাঁরা জানেন, বাংলা বিভাগের অর্থ হল হিন্দু ও মুসলমান উভয়ের সর্বনাশ করা। তা সত্ত্বেও তাঁরা ভারতের অন্য অঞ্চলের হিন্দু নেতাদের চাপে এই দাবি আঁকড়ে রয়েছেন। অথচ ওইসব নেতারা বাংলাকে তাঁদের খেলার বোড়ে হিসেবেই ব্যবহার করতে চান শুধু, বাংলার জনসাধারণের কী হবে তা নিয়ে তাঁদের কোনো মাথাব্যথা নেই। ৭ মে সোহরাওয়ার্দি পুনরায় বলেন :

Bengal divided will mean a Bengal prey to the people of other parts of India, waiting to be exploited for their benefit. The desire that the Bengal State should be linked to the Centre seems to have been prompted by the belief that, if it is linked to the Centre, which will be predominantly Hindu, the life and liberty and culture of the Hindus of Bengal will be saved, otherwise they will perish in a united Bengal. Is this not a doctrine of defeatism and a confession of a terrible moral weakness, that the Hindus of Bengal should stand in need of protection from a loose Centre?

Once more I find that some Hindu leaders of Bengal are succumbing to the pressure of the Hindus of India and are playing their game, that the Hindu leaders, although they know fully well that partition of Bengal means the doom of Hindus and Muslims alike, have subscribed to this partition under pressure from Hindu leaders of other parts of India who want to use Bengal as a pawn in their game and who do not care what happens to the people of Bengal.৩৫

(খ) শরৎচন্দ্র বসুর প্রস্তাব : শরৎচন্দ্র বসু ভারত ও বাংলাদেশ বিভাগের বিরোধী ছিলেন। তাই কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সঙ্গে তাঁর মতপার্থক্য দেখা দেয়। ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি সেন্ট্রাল অ্যাসেম্বলিতে নির্বাচিত হন এবং সেখানে কংগ্রেস দলের নেতাও মনোনীত হন। পরবর্তীকালে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে মন্ত্রিত্বের পদে অধিষ্ঠিত হন। তিনি ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত এই দায়িত্ব পালন করেন। নভেম্বর মাসে তিনি সরকার ও কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি থেকে পদত্যাগ করে সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকান পার্টি গঠন করেন। তিনি ছিলেন এই পার্টির প্রতিষ্ঠাতা-সভাপতি।৩৬ কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে আসার পরে তিনি খুবই সুস্পষ্টভাবে নিজের মতামত ব্যক্ত করেন। যখন তিনি অনুভব করেন ভারত বিভাগ কিছুতেই রোধ করা যাবে না, তখন তিনি বাংলাদেশ ঐক্যবদ্ধ রাখার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে জানুয়ারি মাস থেকে শরৎচন্দ্র বসু বাংলাদেশে সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকান গঠনের পরিকল্পনা ঘোষণা করে বঙ্গভঙ্গ রদ করতে ও এই দাবির সমর্থনে জনমত গঠনে উদ্যোগী হন। পাঞ্জাব সম্পর্কে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির প্রস্তাব গৃহীত হবার পরে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৫ ফেব্রুয়ারি শরৎচন্দ্র বসু যে বিবৃতি দেন তাতেই তিনি পরিষ্কার করে তাঁর মনোভাব ব্যক্ত করেন। এই প্রস্তাবে কংগ্রেস পাঞ্জাবকে মুসলিম ও অমুসলিম অঞ্চলে বিভক্ত করার কথা বলে। কংগ্রেস সভাপতি প্রেসের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনার সময়ে একথাও বলেন, এই প্রস্তাবে পাঞ্জাব সম্পর্কে যে নীতি গ্রহণ করা হয়েছে তা বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগের নীতি কংগ্রেস গ্রহণ করায় শরৎচন্দ্র বসু তীব্র সমালোচনা করেন। তিনি একথাও বলেন, এইভাবে সাম্প্রদায়িক সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়। তিনি পরিষ্কার করেই বলেন, সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জটিল সাম্প্রদায়িক সমস্যার সমাধান সম্ভব।৩৭

তখন থেকে শরৎচন্দ্র বসু বাংলাদেশে সোশ্যালিস্ট রিপাবলিক গঠনের পরিকল্পনা নিয়ে হিন্দু ও মুসলিম নেতৃবৃন্দের সঙ্গে ঘন ঘন বৈঠকে মিলিত হন। অবশ্য এই চিন্তা শরৎচন্দ্র বসুর মাথায় হঠাৎ আসেনি। ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দের ২৯ জানুয়ারি যখন তিনি কারাগারে বন্দি ছিলেন তখন তিনি সুস্পষ্টভাবে সোশ্যালিস্ট রিপাবলিক গঠন করে ভারতের রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের কথা চিন্তা করেন। ওই তারিখে শরৎচন্দ্র বসু লেখেন : ভারতবর্ষ হবে কতকগুলো সোশ্যালিস্ট রিপাবলিক নিয়ে গঠিত ইউনিয়ন। এখানে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সম্মিলন ঘটবে। তার মধ্য দিয়ে এমন একটা মনোভাব গড়ে উঠবে যার ফলে দেশের সীমান্ত, জাতি ও শ্রেণি সম্পর্কে স্বতন্ত্র অস্তিত্বের ধারণা লোপ পাবে। শরৎচন্দ্র বসু লেখেন :

I Picture my country as a union of socialist republics—an immense melting-pot in which the characters of all the races and nationalities comprised in it will be mixed and out of which a new worldism will arise which will recognize no frontiers, no races and no classes.৩৮

শরৎচন্দ্র বসু বলেন, আমি সবসময়েই ধারণা পোষণ করি ভারতবর্ষ হবে স্বায়ত্তশাসন ক্ষমতাসম্পন্ন সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকসমূহের ইউনিয়ন। যদি ভারতের বিভিন্ন প্রদেশগুলোকে ভাষাভিত্তিক পুনর্গঠিত করা হয় এবং সেইসব প্রদেশসমূহকে স্বায়ত্তশাসিত সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকে রূপান্তরিত করা হয়, তবে তারা স্বেচ্ছায়, সানন্দে পরস্পরের সহযোগিতায় মিলিত হয়ে এক ভারতীয় ইউনিয়ন গঠন করবে। এই ভারতীয় ইউনিয়ন ভারতীয় চিন্তার প্রতীক হবে ও ভারতীয়দের দ্বারা গঠিত ইউনিয়ন হবে। আমি এই ধরনের ইউনিয়ন গঠনের পক্ষপাতী। ব্রিটিশ চিন্তার ও ব্রিটিশসৃষ্ট ভারতীয় ইউনিয়নের প্রতি আমার কোনো আকর্ষণ নেই। তিনি বলেন :

I have always held the view that India must be a union of autonomous socialist republics and I believe that if the different provinces are redistributed on a linguistic basis and what are called provinces are converted into autonomous socialist republics, those socialist republics will gladly co-operate with one another in forming an Indian Union. It would be an Indian Union of Indian conception and Indian making. I look forward to that union and not to a union of British conception and British making.৩৯

শরৎচন্দ্র বসু বলেন, বাংলাদেশের কয়েকজন কংগ্রেস ও মুসলিম লিগ নেতাদের সঙ্গে এই বিষয় নিয়ে আলোচনা করার ফলেই বর্তমানের প্রস্তাবসমূহ উদ্ভূত হয়। আমি দৃঢ়ভাবে কয়েকবার এই অভিমত ব্যক্ত করেছি, পাকিস্তান প্রস্তাব সমর্থন করা ও দেশভাগে সম্মত হওয়া ভারতের স্বাধীনতার ও সামাজিক অগ্রগতির পথে মস্তবড়ো অন্তরায় হবে। তার ফলে বিভক্ত প্রদেশসমূহ সাম্রাজ্যবাদীদের, সাম্প্রদায়িকতাবাদীদের ও প্রতিক্রিয়াশীলদের অবাধ বিচরণক্ষেত্র হবে। তা ভাষাগত সংহতি বিনষ্ট করবে এবং সাম্প্রদায়িক বিরোধ প্রকট করে তুলবে। সমগ্র দেশ যুদ্ধমান সাম্প্রদায়িক শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়বে। সুতরাং, পাকিস্তানের ও দেশভাগের চিন্তা পরিহার করে আমরা কীভাবে পরস্পর মিলিত হয়ে জনপ্রিয় সরকার গঠন করতে পারি, আর সরকার কোনো বিশেষ সাম্প্রদায়িক স্বার্থের কথা চিন্তা না করে সকলের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষা করতে পারে, তার প্রতি যত্নবান হওয়া একান্ত কর্তব্য।

শরৎচন্দ্র বসু বলেন, যদি ভাষাগত ভিত্তিতে সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকান গঠন করা যায় এবং সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকসমূহ নিয়ে যদি একটি কেন্দ্রীয় ইউনিয়ন তৈরি করা যায়, তা হলে বর্তমানে ভারতবর্ষে যে সাম্প্রদায়িক বিবাদ চলছে তার সমাধান সম্ভবপর হবে। শরৎচন্দ্র বসুর ভাষায় :

Since then I have had opportunities of discussing my ideas with several Congress and Muslim League leaders in Bengal as a result of which concrete proposals have emerged…..Notwithstanding all that has been said and is being said, I hold firmly to the opinion which I have expressed more than once that conceding Pakistan and supporting partition would be suicidal to the cause of Indian independence and also the cause of social progress. It will make the partitioned provinces happy hunting grounds for imperialists, communalists and reactionaries. It will dissolve the existing linguistic bonds and, instead of resolving communal differences, will accentuate and aggravate them. Instead of thinking and talking of Pakistan and partition and thereby bringing into existence armed communal camps we have to devise ways and means as to how to live and work together and how to form people’s governments which will look not to communal interests but to common political, social and economic interests of the people.

The real solution of the existing communal differences to my mind lies in the creation of socialist republics on a linguistic basic and in the establishment in this country of a Central Union of Socialist Republics.৪০

এই উদ্দেশ্য সফল করার জন্য এপ্রিল মাসে (১৯৪৭ খ্রি.) শরৎচন্দ্র বসু All Bengal Anti-Pakistan and Anti-Partition Committee (সারা বাংলা) পাকিস্তানবিরোধী ও বঙ্গভঙ্গবিরোধী কমিটি) গঠন করেন। এই কমিটির প্রেসিডেন্ট ছিলেন তিনি নিজে। আর সেক্রেটারি ছিলেন কামিনীকুমার দত্ত, এমএলসি। এই কমিটি পাকিস্তানবিরোধী ও বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলে।৪১

(গ) আবুল হাশেমের ভূমিকা : সোহরাওয়ার্দি ও শরৎচন্দ্র বসু যখন অবিভক্ত স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনের প্রস্তাব কার্যকরী করতে অগ্রসর হন তখন তাকে বাস্তবে রূপায়িত করার ব্যাপারে বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লিগের সেক্রেটারি (তখন তিনি ছুটিতে ছিলেন) আবুল হাশেম এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। আবুল হাশেম বাংলার মুসলিম লিগে ‘প্রগতিশীল’ অংশের মুখপাত্ররূপে পরিচিত ছিলেন। তিনি মুসলিম লিগ রাজনীতির একজন পুরোধা হলেও বাঙালি ঐতিহ্যের ও সংস্কৃতির সঙ্গে বাঙালি মুসলমানের যোগসূত্র ছিন্ন হোক তা কখনোই কামনা করেননি। স্বভাবতই ভারত বিভাগের ও বাংলা বিভাগের প্রস্তাবসমূহ যে জটিলতার সৃষ্টি করে, বিশেষ করে বাঙালি জীবনে, তাতে তিনি খুবই বিচলিত হন। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ২৯ এপ্রিল আবুল হাশেম এক দীর্ঘ বিবৃতিতে তাঁর মনোভাব ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, এখন সময় এসেছে সত্য কথা বলার। সস্তায় জনপ্রিয়তা অর্জনের জন্য বিকৃত চিন্তার ও সুবিধাবাদী নেতৃত্বের নিকট আত্মসমর্পণ করা প্রজ্ঞার ব্যভিচার। কেবলমাত্র ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দেই বাংলাদেশ ভারতের চিন্তার ক্ষেত্রে নেতৃপদে আসীন ছিল এবং সাফল্যের সঙ্গে পরাক্রমশালী ব্রিটিশ শাসনকে বাধা দেয়। খুবই বেদনার কথা, আজিকার বাংলাদেশ বুদ্ধিতে দেউলিয়া হয়েছে এবং চিন্তার ও নেতৃত্বের জন্য ভিনদেশি নেতাদের দ্বারস্থ হয়েছে। আমি বিস্মিত হই এই ভেবে, যাঁদের মধ্য থেকে সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, চিত্তরঞ্জন দাশ ও সুভাষচন্দ্র বসুর মতো ব্যক্তির আবির্ভাব হয়েছে, সেই বাংলার হিন্দুদের হল কী!৪২

আবুল হাশেম বলেন, ভারতের বর্তমান বৈপ্লবিক চিন্তার উৎস হল বাংলাদেশ। প্রকৃত বিপ্লব কখনোই ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতে ইন্ধন জোগায় না, তা চিন্তায় ও মননে বিপ্লব ঘটায়। বাংলাকে তার হীনম্মন্যতাবোধ ও পরাজিতের মনোভাব পরিত্যাগ করতে হবে। বাংলাকে পুনরায় তার অতীত ঐতিহ্যে ফিরে যেতে হবে, তার প্রতিভার স্ফুরণ ঘটাতে হবে এবং নিজ ভাগ্যকে তৈরি করতে হবে। গুরুত্বপূর্ণ চিন্তায় ভাবাবেগের কোনোই স্থান নেই। সাময়িক পাগলামিকে কোনোমতেই ভবিষ্যৎ ভাগ্য নির্ধারণ করতে দেওয়া যায় না।৪৩

আবুল হাশেম বলেন, বর্তমানে বাংলা এমন এক জায়গায় দাঁড়িযে আছে যেখানে একটি পথ স্বাধীনতা ও গৌরবের দিকে ধাবিত, আর একটি পথ স্থায়ী দাসত্ব ও অপমানের নির্দেশক। সুতরাং বাংলাকে এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। যদি বর্তমানে সুযোগ হারিয়ে যায়, তাহলে তা আর কখনোই আসবে না। তিনি বলেন, পশ্চিমবঙ্গে শতকরা একশত ভাগ বিদেশি মূলধন—ভারতীয় ও ইঙ্গ-মার্কিন—নিয়োজিত আছে। আমাদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান সমাজতান্ত্রিক মনোভাব দেখে এইসব বিদেশি শোষকেরা শঙ্কিত। স্বাধীন ও ঐক্যবদ্ধ বাংলায় তাদের অসুবিধা হবে, তা তারা সহজেই বুঝতে পারছে। এই বিদেশি মূলধনের স্বার্থ হল বাংলাকে বিভক্ত, দুর্বল ও অক্ষম রাখা, যাতে কোনো অংশই ভবিষ্যতে তাদের বাধা না দিতে পারে। আবুল হাশেম বলেন :

Cent per cent alien Capital, both Indian and Anglo-American, is invested in West Bengal. The growing Socialistic tendencies amongst us have created fears of expropriation in the minds of our alien exploiters. They have the prudence to visualise difficulties in a free and united Bengal. It is in the interest of alien capital that Bengal should be divided, crippled and incapacitated so that neither part thereof may have strength enough to resist it in future.৪৪

বাংলার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার প্রকৃতি বিশ্লেষণ করে আবুল হাশেম সিদ্ধান্ত করেন, এই দাঙ্গা বাধাচ্ছে বিদেশি কায়েমি স্বার্থবাদীরা ও তাদের ভারতীয় মিত্ররা। দেখা যায়, সাধারণত সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির ও দায়িত্বশীল দলের পক্ষে আগ্নেয়াস্ত্র পাওয়া খুবই কষ্টকর। কিন্তু ইংল্যাণ্ড ও আমেরিকায় প্রস্তুত অজস্র মারাত্মক আগ্নেয়াস্ত্র ভারতে হিন্দু ও মুসলিম গুণ্ডাদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। তারাই পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে বাংলা বিভাগের পরিবেশ তৈরি করেছে। আবুল হাশেমের ভাষায় :

From a study of the nature of the communal disturbances in Bengal. I am of Opinion that these are being engineered and encouraged by foreign vested interestes and their Indian allies.৪৫

আবুল হাশেম বলেন, বর্তমানে বাংলায় কোনো প্রভাবশালী নেতৃত্ব না থাকায় ইতর সুযোগসন্ধানীরা দেশটাকে বিনাশ করে ফেলছে। এই অবস্থায় হিন্দু ও মুসলিম যুবকদের ঐক্যবদ্ধ হওয়া, বিজাতীয় প্রভাব থেকে মুক্ত হওয়া, বাংলার হৃত গৌরব উদ্ধার করা এবং ভারত ও পৃথিবীর মধ্যে বাংলাকে এক সম্মানিত আসনে প্রতিষ্ঠিত করা প্রয়োজন। অতীতের ঐতিহ্য ও বর্তমানের সংগ্রাম থেকে প্রেরণা লাভ করে এক উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য বাংলার যুবকদের চরিত্র গঠন করতে হবে। আবুল হাশেম আরও বলেন, হিন্দু ও মুসলমান তাঁদের নিজস্ব সত্তা বজায় রেখে, তাঁদের যৌথ প্রচেষ্টায়, এখানকার জলবায়ুর সঙ্গে সঙ্গতি রেখে একই সুন্দর সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য গড়ে তুলেছেন। আবুল হাশেম বলেন :

In the absence of outstanding leadership the country is being rackrented by vulgar fortune-hunters. Youths of Bengal, both Hindus and Muslims, must unite, liberate their country from the shackles of extraneous influences and make a bid for regaining Bengal’s lost prestige and an honourable place in the future comity of nations, both of India and the world. Let the youths of Bengal build their character from their past traditions and derive inspiration for their present struggle from the glories of the future.

Hindus and Muslims of Bengal, preserving their respective entiles had, by their joint efforts, in perfect harmony with the nature and climatic influence of their soil, developed a wonderful common culture and tradition which compares favourably with the contribution of any nation of the world in the evolution of man.৪৬

আবুল হাশেম বলেন, ভারত বিভাগের সঙ্গে বাংলা বিভাগের তুলনা চলে না। চিন্তার দৈন্য থেকেই একথা বলা হয় যে, পাকিস্তান দাবিকে ব্যাহত করার জন্যই বাংলা বিভাগের দাবি উত্থাপন করা হয়েছে। আবুল হাশেম বলেন, এই দাবি লাহোর প্রস্তাবের প্রকৃত বিষয় ও তার তাৎপর্য সম্পর্কে মারাত্মক অজ্ঞতা থেকে উদ্ভূত। মুসলিম ভারত তো কেবলমাত্র এই প্রস্তাবের প্রতিই আনুগত্য প্রদর্শন করে। এই প্রস্তাব কখনোই এক অখন্ড মুসলিম রাষ্ট্র স্থাপনের কথা বলেনি অথবা বলপ্রয়োগ করে অন্য অঞ্চল নিয়ে কৃত্রিম মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র গঠন করতে চায়নি, যে ধরনের ঘটনা প্যালেস্টাইনে ঘটেছে অথবা লোক বিনিময়ের মারফত তুর্কি ও গ্রিস দেশে হয়েছে। এই লাহোর প্রস্তাবে কেবলমাত্র যেসব প্রদেশে মুসলমানেরা সংখ্যাগরিষ্ঠ তাদের পূর্ণ সার্বভৌমত্ব দাবি করা হয় এবং কার্যত ভারতের সকল জাতির ও প্রদেশের পূর্ণ সার্বভৌমত্ব ও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার দাবি করা হয়। এই প্রস্তাবে বাংলা ও ভারতের অন্যান্য সাংস্কৃতিক ইউনিটগুলোকে স্বেচ্ছায় ভারতীয় ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত থাকার সুযোগসহ পূর্ণ সার্বভৌমত্ব দেওয়া হয়। আবুল হাশেম যেভাবে লাহোর প্রস্তাবের ব্যাখ্যা করেন তা এখানে উদ্ধৃত করা হল :

Partition of Bengal bears no analogy to the partition of India. The lamentable perversion in thinking which suggests that the movement for the partition of Bengal is a convenient counterblast to Pakistan arises out of a colossal ignorance of the contents and implications of the Lahore resolution, to which and which alone and not this or that interpretation thereof, Muslims of India owe allegiance. That resolution never contemplated the creation of any Akhand Muslim State or any artficial Muslim majority either by forcible importation of alien elements as is being done in Palestine or by any mass transference of population as was done between Turkey and Greece.

It merely demands complete sovereignty for those countries of India which are known to the world as Muslim majority countries, and by implication demands complete sovereignty and right of self- determination of all the nations and countries of India. It gives Bengal and other cultural units of India complete sovereignty while keeping open the possibility of creating an Indian international on a purely voluntary basis for the benefit of all.৪৭

আবুল হাশেম বলেন, পাকিস্তান প্রস্তাবে একথা কখনোই বলা হয়নি যে, বাংলা ও পাঞ্জাবে মুসলমানেরাই শাসন করবে এবং অন্যান্যরা অধীনস্থ বাসিন্দা হিসেবে শাসিত হবে। বোম্বেতে গান্ধী-জিন্না আলোচনা ব্যর্থ হবার পরে কায়েদে আজম দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেন, সার্বজনীন ভোটাধিকারের ওপর প্রতিষ্ঠিত সমগ্র জনসাধারণের ইচ্ছা ও মত অনুযায়ীই মুক্ত পাকিস্তান রাষ্ট্রসমূহ (Free Pakistan States) শাসিত হবে।৪৮

আবুল হাশেম বলেন, মুক্ত বাংলাদেশ রাষ্ট্রে ধর্মীয় ও সামাজিক ক্ষেত্র ছাড়া অন্য কোনো ক্ষেত্রেই হিন্দু ও মুসলমানের স্বার্থ বিশেষভাবে আলাদা করে সংরক্ষণের ব্যবস্থা থাকবে না। মুসলিম সমাজ তাদের শরিয়ত অনুযায়ী ও হিন্দুসমাজ তাদের শাস্ত্র অনুযায়ী পরিচালিত হবে। এই অধিকারসমূহ একদিকে যেমন মুসলমানদের পাকিস্তানের আধ্যাত্মিক প্রয়োজনীয়তা মেটাবে, তেমনি হিন্দুদের নিজস্ব বিকাশের পক্ষে উপযোগী মাতৃভূমির চাহিদা মেটাবে। একথা ভাবাই যায় না, বাংলার হিন্দুরা সংখ্যায় প্রায় অর্ধেক হওয়া সত্ত্বেও মুক্ত বাংলার শাসনতন্ত্রে ও অন্যান্য ক্ষেত্রে তাঁদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হবেন। বাংলায় কোনো সম্প্রদায়ই অন্যের ওপর আধিপত্য স্থাপন করার অবস্থাতে নেই। যদি বাংলার সম্পদ এখানকার অধিবাসীদের জন্য ব্যবহার করা যায়, তাহলে হিন্দু ও মুসলমান উভয়েই দীর্ঘকাল আনন্দে ও সচ্ছলতায় দিন কাটাতে পারবে। কিন্তু বিভক্ত বাংলায় সম্ভবত পশ্চিমবঙ্গ বিদেশি ভারতীয় সাম্রাজ্যবাদীদের উপনিবেশ হবে। বাংলার হিন্দুরা বিদেশি মূলধনওয়ালাদের দিনমজুরে পরিণত হবে। তিনি বলেন :

But in a divided Bengal, West Bengal is bound to be treated as a far-flung Province, possibly a colony, of an alien Indian imperialism. However high they may pitch their expectations on partition it is clear to me that the Hindus of Bengal shall be reduced to the status of daily wage-earners of an alien capitalism.৪৯

আবুল হাশেম বলেন, গত দশ বৎসর ধরে মুসলিম মন্ত্রীসভা বাংলাদেশের শাসনতন্ত্র পরিচালনা করায় হিন্দুরা সন্দেহপ্রবণ হন। কিন্তু একথা বলা যায়, বাংলার মুসলিম লিগ অথবা সারা ভারত মুসলিম লিগ কখনোই হিন্দুদের প্রকৃত প্রতিনিধিদের সঙ্গে কোয়ালিশন মন্ত্রীসভা গঠন করার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেনি। আইনসভার মুসলিম লিগ পার্টি সব সময়েই এই ধরনের কোয়ালিশনের চেষ্টা করে। কিন্তু কংগ্রেস হাইকমাণ্ডের হস্তক্ষেপের ফলে এই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। সোহরাওয়ার্দি তাঁর মন্ত্রীসভা গঠনের পূর্বেও কংগ্রেসের সহযোগিতা লাভের চেষ্টা করেন।৫০

আবুল হাশেম বলেন, আমার পরিষ্কার মনে আছে, কলকাতার ৪০ থিয়েটার রোডে নোয়াখালি যাত্রার প্রাক্কালে আলোচনার সময়ে মি. গান্ধী বলেন : আমার কোয়ালিশনের প্রতি কোনোই আসক্তি নেই। আমি এক-পার্টি শাসনে বিশ্বাসী। সুতরাং বাংলায় কোয়ালিশন করার জন্য চাপ দিতে চাই না। আবুল হাশেম একথাও বলেন, তখন বাংলাতেই কেবলমাত্র মুসলিম লিগ মন্ত্রীসভা ছিল। সুতরাং এখানে কোনো কোয়ালিশন মন্ত্রীসভা হলে তার প্রভাব সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়ত। তাই হিন্দু বাংলা সংকটে পড়ে, যেমন অন্যত্র মুসলমানদের অবস্থা হয়। যদি বাংলার হিন্দু ও মুসলমান নিজেদের মধ্যে থাকতে পারেন এবং ভারতীয়দের ভীতিপ্রদর্শন থেকে মুক্ত থাকতে পারেন, তা হলে তাঁরা শান্তিপূর্ণভাবেই তাঁদের সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান করতে পারেন। দুর্ভাগ্যবশত মুসলিম পার্লামেন্টারিয়ানদের নিজেদের স্বার্থ সবসময়েই তাস সাজানোর মতো বাংলার মন্ত্রীসভার পরিবর্তন ঘটিয়েছে। তাঁরা কখনোই ভালো বা মন্দ নীতি বা প্রোগ্রাম কোনো বিষয়ের উপরই দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি। আবুল হাশেম বলেন :

Hindus and Muslims of Bengal left to themselves and freed from the menace of Indianism can settle their affairs peacefully and happily. Unfortunately, the paramount interests of Muslim parliamentarians have always been shuffling and reshuffling the Ministry, like a pack of cards. They could hardly concentrate on any policy and programme good, bad or indifferent.৫১

আবুল হাশেম বলেন, হিন্দুদের মনে মুসলিম মন্ত্রীসভার বিরুদ্ধে যে সন্দেহ ও বিরূপ মনোভাব দেখা দিয়েছে তা দূর করার দায়িত্ব মুসলমানদের ওপরই পড়েছে। তা কেবলমাত্র উপদেশ ও খবরের কাগজে বিবৃতি দিয়ে দূর করা যাবে না, মুসলমানদের প্রকৃত কাজের দ্বারাই তা করা সম্ভব। বর্তমানের অস্থিরতা, বিকৃত চিন্তা ও আত্মহানিকর প্রচেষ্টা সমাজজীবনের ক্ষত থেকেই উদ্ভূত। এক ঐক্যবদ্ধ স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ গঠনের মাধ্যমেই তার সমাধান সম্ভব, বাংলাদেশ বিভাগের দ্বারা নয়। আবুল হাশেমের ভাষায় :

I am unfortunate in as much as I fail to set store by a Ministry under the Act of 1935. Since, reasonably or otherwise, there is a suspicion on the part of the Hindus against them. It is now up to Muslims to clear the deck and convince them, not merely by sermons and Press statements but by actions that they do not mean to be unfair to them. The present unrest, perverse thinking, and suicidal moves constitute a disease of the social organism. Patriotism for the creation of a united and sovereign Bengal, having all the attributes of an Independent Country, is the remedy and not partition.৫২

পরিশেষে আবুল হাশেম বলেন, আজ চিত্তরঞ্জন দাশ আর নেই। তাঁর আত্মা আমাদের এক উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গঠন করতে সাহায্য করুক। চিত্তরঞ্জন দাশ প্রচারিত ফর্মূলা ৫০:৫০ হার সম্পর্কে সর্বসম্মত হয়ে বাংলার হিন্দু ও মুসলমান উভয়েই রাজনৈতিক ক্ষমতা ও অর্থনৈতিক সুযোগ ভোগ করুক। বাংলার অতীত ঐতিহ্যের ও গৌরবময় ভবিষ্যতের কথা উল্লেখ করে আবুল হাশেম পুনরায় বাংলার যুবকদের ঐক্যবদ্ধ হতে, সমস্ত রকমের প্রতিক্রিয়াশীল চিন্তাধারা থেকে মুক্ত হতে এবং আসন্ন বিপর্যয় থেকে বাংলাকে রক্ষা করতে অনুরোধ করেন। তিনি এই কথা বলে তাঁর বিবৃতি সমাপ্ত করেন :

MR. C. R. Das is dead. Let his spirit help us in moulding our glorious future. Let the Hindus and Muslims of Bengal agree to his formula of 50:50 enjoyment of political power and economic privileges. I again appeal to the youths of Bengal in the name of her past traditions and glorious future to unite, make a determined effort to dismiss all reactionary thinking and save Bengal from the impending calamity.৫৩

এইভাবে সোহরাওয়ার্দি, শরৎচন্দ্র বসু ও আবুল হাশেম বঙ্গবিভাগ রদ করে একটি অবিভক্ত বঙ্গভূমি গঠনের কথা চিন্তা করেন।

.

১১. Statement by Suhrawardy in Statesman, Wednesday, 9 April, 1947, p. l.

১২. Statement by Suhrawardy in Statesman, Monday, 28 April, 1947, p. 1.

১৩. Ibid.

১৪. Ibid.

১৫. Ibid.

১৬. Ibid.

১৭. Ibid, p. 7.

১৮. Ibid.

১৯. Ibid.

২০. Ibid.

২১. Ibid.

২২. Ibid.

২৩. Ibid.

২৪. Ibid.

২৫. Ibid.

২৬. Ibid.

২৭. Ibid.

২৮. Ibid.

২৯. Ibid.

৩০. Statement by Suhrawardy, in Statesman, Tuesday, 26 April, 1947, p. 5.

৩১. Ibid.

৩২. Ibid.

৩৩. Ibid.

৩৪. Statement by Suhrawardy, in Statesman, Thursday, 8 May, 1947, p. l.

৩৫. Ibid. pp. 1, 8.

৩৬. The Nation Calcutta, Tuesday, 21 February, 1950, p. l. এই পত্রিকার সম্পাদকীয় বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন শরৎচন্দ্র বসু।

৩৭. Statement by S C Bose, 15 February, 1947, in The Nation, Sunday, 19 March, 1950, p. 4. See Apendix A.

৩৮. Statement by S C Bose, in Statesman, Wednesday 21 May, 1947, p. 7.

৩৯. Ibid.

৪০. Ibid.

৪১. Formation of All Bengal Anti-Pakistan and Anti-Partition Committee, in Amrita Bazar Patrika, Saturday, 26 April 1947, p. 4. এই কমিটির যাঁরা সভ্য ছিলেন : অখিলচন্দ্র দত্ত, ড. নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, এমএলএ; সত্যরঞ্জন বক্সী, অনিল রায়, হেমচন্দ্র ঘোষ, ইন্দ্রনারায়ণ সেনগুপ্ত, সত্য গুপ্ত, হেমেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত, জ্যোতিষ জোয়ারদার, সুরেশচন্দ্র তালুকদার, নরেন্দ্র ব্যানার্জি, অশোকানন্দ বসু, রসোময় সুর, হেমেন্দ্রনাথ বসু, চারুচন্দ্র রায়, অধ্যাপক এস কে রায়, অধ্যাপক এ সি দাশগুপ্ত, লালমোহন ঘোষ, রাখালচন্দ্র দত্ত, অশ্বিনীকুমার ঘোষ, যোগেন্দ্র দাস, এমএলএ; আশুতোষ সিংহ, মনীন্দ্রকুমার রায়, জে সি গুপ্ত, এমএলএ; ইন্দুভূষণ বিদ, পূর্ণেন্দুশেখর বসু, প্রকাশচন্দ্র দাস এবং শ্রীমতী লীলা রায়। এই কমিটির অফিস ছিল : ৯৩/১, বকুলবাগান রোড, ভবানীপুর, কলকাতা। (Ibid).

৪২. Statement by Abul Hasim, in Star of India, Calcutta, Wednesday, 30 April, 1947, p. 2.

৪৩. Ibid.

৪৪. Ibid.

৪৫. Ibid.

৪৬. Ibid.

৪৭. Ibid.

৪৮. Ibid.

৪৯. Ibid.

৫০. Ibid.

৫১. Ibid.

৫২. Ibid, p. 5.

৫৩. Ibid.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *