অষ্টম অধ্যায়
কৃষক প্রজা পার্টি ও ফজলুল হকের মনোভাব
ভারতের সমস্যা সমাধানে কংগ্রেস ও লিগ যে ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় কৃষক প্রজা পার্টি তার সমালোচনা করে। ২৮ মে (১৯৪৭ খ্রি.) একশত কৃষক প্রজা নেতা ও কর্মী একটি আবেদনপত্রে প্রতিটি স্বদেশহিতৈষী ভারতীয়কে সাম্প্রদায়িক যুদ্ধ বন্ধ করতে সাহায্য করতে বলেন। তাঁরা বলেন, আমরা স্বাধীনতার দ্বারদেশে এসে উপস্থিত। শীঘ্র ক্ষমতা ভারতীয়দের হাতে অর্পণ করা হবে। এক সংকটময় পরিস্থিতিতে জাতিকে যদি পরিচালনা করতে হয় তা হলে নেতৃবৃন্দের রাজনৈতিক বিচক্ষণতা ও উদারতা একান্ত প্রয়োজন। খুবই দুঃখের কথা আমরা বর্তমানে এক আত্মঘাতী সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষে লিপ্ত আছি। প্রতিটি শুভবুদ্ধিসম্পন্ন ও স্বদেশহিতৈষী ভারতীয়ের কর্তব্য এই পাগলামি বন্ধ করা। যদি প্রতিটি ভারতীয়কে স্বাধীন দেশের মানুষের মতো বাyচতে হয় তাহলে অবিলম্বে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শোষণ বন্ধ করা উচিত। প্রতিটি ভারতীয়ের প্রধান কর্তব্য হল ব্রিটিশকে ভারত পরিত্যাগ করতে বাধ্য করা।১৪৪
কৃষক প্রজা নেতা ও কর্মীরা বলেন, কেউ কেউ ব্রিটিশ এদেশ ছেড়ে যাবার পূর্বেই ভারত বিভাগের দাবি করেন, আবার অনেকে ভারত বিভাগ যদি অবশ্যম্ভাবী হয় তা হলে বাংলাদেশ ও পাঞ্জাব বিভাগের দাবি করেন। কিন্তু কৃষক প্রজা এই উভয় দাবিরই বিরোধিতা করে। কারণ এইসব বিভাগ মঙ্গলজনক হবে না। অন্যদিকে এই ব্যবস্থা ভারতের দেশরক্ষাকে দুর্বল করবে, সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ বৃদ্ধি করবে এবং ভারতের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব হ্রাস করবে। মুসলিম লিগ যদি ভারতীয় ইউনিয়নে যোগ দিতে অস্বীকার করে তা হলে তারা এক বিকলাঙ্গ পাকিস্তান পাবে। এই বিকলাঙ্গ পাকিস্তানে মুসলমানদের দুর্ভাগ্যের কথা ভেবে আমরা ভয়ে কম্পমান হই।১৪৫
কিন্তু কংগ্রেস ও লিগ কেউ নিজেদের সিদ্ধান্ত থেকে সরে যেতে প্রস্তুত নয়। কৃষক প্রজা মনে করে, ভারতের দুরূহ ও জটিল সমস্যার সমাধানের উপায় হল ১৬ মে-র ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যান সমস্ত দল কতৃক গ্রহণ করা। কংগ্রেস এই প্ল্যান গ্রহণ করে। কৃষক প্রজা কংগ্রেস হাইকমাণ্ডের নিকট আবেদন করে বলে তারা যেন ব্রিটিশ সরকারকে এই প্ল্যান অবিলম্বে কার্যকরী করতে চাপ দেয়। প্রথমে মুসলিম লিগ এই প্ল্যান গ্রহণ করলেও, পরে এই প্ল্যান গ্রহণ করতে অস্বীকৃত হয়। দেশের শান্তি ও সমৃদ্ধির জন্য কৃষক প্রজা মুসলিম লিগকে এই প্ল্যান গ্রহণ করতে অনুরোধ করে।১৪৬
যদি মুসলিম লিগ এই প্ল্যান গ্রহণ করতে অস্বীকার করে তা হলে কৃষক প্রজার দাবি হল, ঐক্যবদ্ধ ভারতে ঐক্যবদ্ধ বাংলা অথবা বিভক্ত ভারতে বিভক্ত বাংলা, এই প্রশ্নের ওপর পুনরায় নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হোক। কারণ গত নির্বাচনে কোনো দলই এই প্রশ্নসমূহ উত্থাপন করেনি। বর্তমান আইনসভার বাংলার ভবিষ্যৎ নির্ধারণের কোনোই অধিকার নেই। নতুন নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলার জনসাধারণই এই বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারে। যাতে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে সেজন্য বর্তমান মন্ত্রীসভাকে ভেঙে দিতে হবে। প্রতিযোগী সমস্ত দলের প্রতিনিধি নিয়ে গঠিত সরকার এই নির্বাচন পরিচালনা করবে।১৪৭
কৃষক প্রজার মতে, ন্যায়নীতি ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ওপর প্রতিষ্ঠিত সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রই সাম্প্রদায়িক ও অন্যান্য সমস্যা সমাধান করতে পারে। এই ধরনের রাষ্ট্রে ধর্মকে রাজনীতি থেকে সম্পূর্ণ পৃথক করতে হবে।১৪৮ সুতরাং কৃষক প্রজা কোনোরকম বিভাগের পক্ষপাতী ছিল না।
কৃষক প্রজা পার্টির প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক হুমায়ুন কবির ১১ মে একটি বিবৃতিতে ভারত ও বাংলাদেশ বিভাগের সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, মুসলিম লিগের সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি, হিংসা ও বিদ্বেষ প্রচার, গুণ্ডামির আশ্রয় গ্রহণ এবং তার সঙ্গে তুলনাবিহীন শাসনতান্ত্রিক অযোগ্যতা ও কলুষিত পদ্ধতি সংযুক্ত হওয়ায় বাংলাদেশ বিভাগের দাবি উঠেছে। অধ্যাপক কবির সোহরাওয়ার্দিকে অবিলম্বে দুটো ব্যবস্থা করতে অনুরোধ করেন, যথা—প্রদেশের জন্য যুক্ত নির্বাচন পদ্ধতি গ্রহণ করা এবং সমান অধিকার ও যৌথ দায়িত্বের ভিত্তিতে কংগ্রেস দলকে তাঁর ক্যাবিনেটে যোগদান করতে আমন্ত্রণ করা। তা হলেই সোহরাওয়ার্দি যে বাঙালির জাতিগত ঐক্য ও ঐক্যবদ্ধ বাংলার কথা বলেন তার যথার্থতা প্রমাণিত হবে।১৪৯
তখন বাংলার মুসলিম রাজনীতিতে ফজলুল হক একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি না হলেও তাঁর প্রতিক্রিয়াও লক্ষণীয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা প্রয়োজন, ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দ থেকেই ফজলুল হক জিন্নার দ্বিজাতিতত্ত্বের বিরোধিতা করতে শুরু করেন। তিনি ঐক্যবদ্ধ ভারত ও ঐক্যবদ্ধ বাংলাদেশ বজায় রেখে শাসনতান্ত্রিক ও সাম্প্রদায়িক সমস্যা সমাধানের পক্ষপাতী ছিলেন। তিনিই সর্বপ্রথম পাকিস্তান প্রস্তাবের অবাস্তব দিক প্রকাশ্যে উদঘাটন করে মুসলমানদের সচেতন করার চেষ্টা করেন। তিনি দৃঢ়তার সঙ্গেই বলেন, বাঙালির স্বার্থ সমগ্র ভারতের স্বার্থের সঙ্গে যুক্ত। ১৯৪৬-৪৭ খ্রিস্টাব্দে ভারতের রাজনীতিতে যেসব ঘটনা ঘটে তিনি তার নিন্দা করেন। তিনি উপলব্ধি করেন, একটানা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা দেশভাগের সম্ভাবনাকে ত্বরান্বিত করছে। তাই তিনি খুবই বিচলিত হন। ঐক্যবদ্ধ ভারত বজায় রাখার উদ্দেশ্যে তিনি আরও কিছুদিন ব্রিটিশ শাসন থাকার কথা বলেন। তিনি বিভক্ত ভারতে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিরোধিতা করেন। তাঁর ধারণা ছিল, আরও কিছুদিন ব্রিটিশ শাসন রেখে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা প্রশমিত করা সম্ভব হবে, হিন্দু ও মুসলমানের শুভবুদ্ধি ফিরে আসবে এবং তখন ঐক্যবদ্ধ ভারতেই ক্ষমতা হস্তান্তর করা যাবে। দেশভাগের সর্বনাশা রূপের কথা ভেবে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে ফজলুল হক যে বিবৃতি দেন তা মুসলিম লিগের নীতির বিরোধী ছিল। তিনি বলেন :
Since those who have sown the wind are unable to control the whirlwind, there must be an agitation calling upon H M G to rescind their decision of February 20 and allow India to proceed peacefully on the road of progress.১৫০
যে পরিবেশে ভারত ও বাংলাদেশ বিভাগের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় তাতে ফজলুল হক গভীর ক্ষোভ প্রকাশ করেন।১৫১
.
১৪৪. Krishak Proja’s Appeal, in Statesman, Thursday 29 May, 1947, p. 5 ; in Amrita Bazar Patrika, Friday, 30 May, 1947; in Hindusthan Standard, 29 May, 1947, P. 4.
১৪৫. Ibid.
১৪৬. Ibid.
১৪৭. Ibid.
১৪৮. Ibid. See Appendix J.
এই সময়ে নিখিল বঙ্গ কৃষক প্রজা সমিতির অর্গানাইজিং সেক্রেটারি ছিলেন জাহাঙ্গীর কবীর। এই সময়ে কৃষক প্রজা সমিতি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিরুদ্ধে সোশ্যালিস্ট স্টেট প্রতিষ্ঠার পক্ষে মনোভাব ব্যক্ত করে। জাহাঙ্গীর কবীর বিভক্ত ভারতে ও বিভক্ত বাংলায় মুসলমানদের অবস্থা নিয়েও আলোচনা করেন (vide Muslims in Mutilated Pakistan, an article, by Jehangir Kabir, in Hindusthan Standard, 7 May, 1947, p. 4 ; Hindusthan Standard, 16 May, 1947, 3)
১৪৯. Statement by Prof. Humayun Kabir, in Statesman, 13 May, 1947, p. 4 ; Hindusthan Standard, 13 May, 1947, p. 5. See Appendix K.
১৫০. অমলেন্দু দে, পাকিস্তান প্রস্তাব ও ফজলুল হক, কলিকাতা, মে, ১৯৭২ পৃষ্ঠা : ২১৬-২১৭
১৫১. ওই