দ্বিতীয় অধ্যায় : বঙ্গভঙ্গ দাবির সময়কাল

দ্বিতীয় অধ্যায়
 বঙ্গভঙ্গ দাবির সময়কাল

১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ১৬ আগস্ট কলকাতার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময়েই এই দাবি উত্থাপিত হয়। মুসলমানদের হাত থেকে হিন্দুদের রক্ষা করার জন্য হিন্দু মহাসভা বঙ্গভঙ্গের দাবি করে। এই সময় থেকেই হিন্দু মহাসভা হিন্দু মধ্যবিত্তের মধ্যে এই দাবির সমর্থনে প্রচার শুরু করে। কয়েকজন খ্যাতনামা অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারীও এই প্রচার অভিযানে অংশগ্রহণ করেন।

১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে আজাদ হিন্দ ফৌজের মেজর জেনারেল এ সি চ্যাটার্জি বঙ্গভঙ্গের উদ্দেশ্যে একটি সমিতি গঠন করেন। লিগ মন্ত্রীসভা নাগরিকদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে ব্যর্থ হওয়ার হিন্দুদের মধ্যে এই দাবির প্রতি সমর্থন ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পায়। অন্যদিকে কংগ্রেস এই প্রচারের বিরুদ্ধে জনমত সংগঠিত করতে সচেষ্ট না হওয়ায় স্বাধীনতাকামী জাতীয়তাবাদীদের মধ্যেও বঙ্গভঙ্গের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের মনোভাব জাগ্রত হয়। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে হিন্দু মহাসভা ‘বাংলার হিন্দুদের জন্য একটি স্বতন্ত্র প্রদেশ’ গঠনের উদ্দেশ্যে একটি কমিটি গঠন করে এবং তারপর বিভিন্ন জেলায় হিন্দু মহাসভার নেতৃত্বে বঙ্গভঙ্গের সমর্থনে প্রবল আন্দোলন শুরু করে। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ৪ এপ্রিল শুক্রবার থেকে তিনদিন ধরে বঙ্গীয় হিন্দু মহাসভা কনফারেন্স তারকেশ্বরে বঙ্গীয় প্রাদেশিক হিন্দু মহাসভার কার্যকরী সভাপতি নির্মলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়। ৪ এপ্রিল নির্মলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর ভাষণে বলেন, যেহেতু মুসলিম লিগ বাংলাদেশে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় বদ্ধপরিকর, সেজন্য হিন্দুরাও বাংলায় একটি শক্তিশালী জাতীয় সরকারের অধীনে একটি পৃথক প্রদেশ গঠন করবে। বাঙালি হিন্দুদের নিকট এটি একটি জীবন-মরণের প্রশ্ন। যদি হিন্দুদের পছন্দমতো কোনো শাসনতন্ত্র না হয়, তা হলে তাঁদের হিন্দুবিরোধী সাম্প্রদায়িক শাসনের অধীনে দাসত্বের জীবনযাপন করতে হবে। তিনি তাঁর দীর্ঘ ভাষণে খুবই সুস্পষ্টভাবে বলেন, আমরা বঙ্গভঙ্গের মারফত হিন্দুদের জন্য একটি পৃথক মাতৃভূমি চাই। নির্মলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ভাষণ থেকে কিছু অংশ এখানে উদ্ধৃত করা হল :

Let us declare today that as the Muslim League persists in its fantastic idea of establishing Pakistan in Bengal, the Hindus of Bengal must constitute a separate Province under a strong National Government. This is not a Question of Partition. It is a question of life and death for us, the Bengalee Hindus. Unless you can have an administration of your own choice, you shall be serfs under an anti-Hindu communal regime and you can never get out of the prevailing sense of frustration and defeatism and you can never protect your oppressed brother and sister.

৫ এপ্রিল তারকেশ্বরের এই হিন্দু মহাসভা সম্মেলনে ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় বলেন, দেশভাগের মধ্য দিয়েই সমস্যার প্রকৃত সমাধান সম্ভব। তিনি বলেন :

I can conceive of no other solution of the communal problem in Bengal than to divide the Province and let the two major communities residing herein live in peace and freedom.

৪ এপ্রিল বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটি বাংলাদেশ বিভাগের পক্ষে যে সিদ্ধান্ত নেয় তাকে স্বাগত জানান শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়।

৬ এপ্রিল তারকেশ্বরে এই সম্মেলন উপলক্ষ্যে এক মহতী জনসভা হয় এবং ওই দিনই সম্মেলনের মূল প্রস্তাবটি গৃহীত হয়। প্রস্তাবটি উত্থাপন করেন সনৎকুমার রায়চৌধুরী ও সমর্থন করেন ঢাকার সূর্যকুমার বসু।

প্রায় একই সময়ে বাংলার কংগ্রেসও বাংলাদেশ বিভাগের দাবিতে প্রস্তাব গ্রহণ করে। এপ্রিল কলকাতাতে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির কার্যকরী সমিতি একটি প্রস্তাবে দাবি করে, যদি ব্রিটিশ সরকার ২০ ফেব্রুয়ারির ঘোষণা অনুযায়ী বাংলার বর্তমান প্রাদেশিক সরকারের নিকট ক্ষমতা অর্পণ করে, তাহলে বাংলার যে অংশ ভারতীয় ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত হতে চায় সেই অংশে একটি স্বতন্ত্র প্রদেশ গঠন করতে হবে এবং বাংলাদেশের গঠনতন্ত্র রচনায় যদি সার্বজনীন ভোটের অধিকার, যুক্ত নির্বাচন প্রথা ও সংখ্যালঘুদের স্বার্থরক্ষার ব্যবস্থা না গৃহীত হয় তাহলে বাংলাদেশ বিভক্ত করে দুটো প্রদেশ গঠন করতে হবে, আর যে অংশ উল্লিখিত নীতি অনুযায়ী শাসনতন্ত্র রচনা করতে চাইবে সেই অংশকে সেই অধিকার দিতে হবে। প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটি এও দাবি করে যে, ক্ষমতা হস্তান্তর না হওয়া পর্যন্ত অবিলম্বে অন্তর্বর্তীকালীন দু-টি আঞ্চলিক মন্ত্রীসভা গঠন করতে হবে। লক্ষণীয় এই যে, বিশেষভাবে আমন্ত্রিত হয়ে প্রাদেশিক কংগ্রেসের এই কার্যকরী সভায় উপস্থিত ছিলেন ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, কে সি নিয়োগী, এমএলএ ডা. বি সি রায়, নলিনীরঞ্জন সরকার, ড. পি এন ব্যানার্জি, কুমার দেবেন্দ্রলাল খান, এমএলএ (সেন্ট্রাল), মাখনলাল সেন ও অতুলচন্দ্র গুপ্ত। বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটি বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব গ্রহণ করায় বাংলার কংগ্রেস সক্রিয়ভাবে এই দাবির সমর্থনে জনমত গঠন করে। এইভাবে কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভা একই ধরনের প্রস্তাব গ্রহণ করে এবং একইসঙ্গে বঙ্গভঙ্গের দাবিতে আন্দোলন পরিচালনা করে।

হিন্দু মহাসভার নেতৃবৃন্দ বঙ্গভঙ্গের আন্দোলনকে এমন একটা পর্যায়ে নিয়ে যান যে, তাঁরা একথাও বলতে শুরু করেন, যদি পাকিস্তান গঠিত নাও হয় তাহলেও বাংলায় হিন্দুপ্রধান অঞ্চল নিয়ে একটি স্বতন্ত্র প্রদেশ গঠন করতে হবে। ২২ এপ্রিল নয়াদিল্লিতে একটি জনসভায় শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় বলেন :

পাকিস্তান যদি গঠিত না-ও হয়, মুসলিম লিগ যদি মন্ত্রী মিশন-পরিকল্পিত দুর্বল কেন্দ্রীয় ক্ষমতা মানিয়াও লয়, তাহা হইলেও বাংলার হিন্দু মেজরিটি অঞ্চলে একটি স্বতন্ত্র প্রদেশ গঠন করিতে হইবে।

শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের ভাষণ থেকে কিছু অংশ এখানে উদ্ধৃত করা হল :

This Separation must not be dependent on Pakistan. Even if Pakistan is not conceded and some form of a weak and loose centre envisaged in the Cabinet Mission Scheme is accepted by the Muslim League, we shall demand the creation of a new province composed of the Hindu majority areas in Bengal.

প্রসঙ্গত উল্লেখ করা প্রয়োজন, ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ২৯ মার্চ কলকাতাতে ব্রিটিশ ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের ৯৫তম বাৎসরিক সাধারণ সভাতে একটি প্রস্তাবে বাংলাদেশ বিভাগের দাবি ও হিন্দুদের জন্য পশ্চিমবঙ্গে একটি পৃথক প্রদেশ গঠনের দাবি করা হয়। তখন ব্রিটিশ ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের কর্মকর্তা ছিলেন বর্ধমানের মহারাজা স্যার উদয়চাঁদ মহতাব, পি এন সিংহরায়, মহারাজা শিরীষচন্দ্র নন্দী, মহারাজা প্রবেন্দ্রমোহন ঠাকুর, মহারাজ কুমার সীতাংশুকান্ত আচার্য চৌধুরী, অমূল্যধন আড্ডি ও অমরেন্দ্র নারায়ণ রায়।১০

এইভাবে বাঙালি হিন্দুর স্বতন্ত্র মাতৃভূমির দাবি উত্থাপিত হয়।

.

৩. ভবানী সেন, বঙ্গভঙ্গ ও পাকিস্তান, কলিকাতা, মে, ১৯৪৭, পৃষ্ঠা. ৪

৪. ওই, Separate homeland for Bengali Hindus, Demand by N C Chatterjee in Tribune, 4 March 1947, p 1, Amrita Bazar Patrika, Tuesday, 22 April, 1947, p. 8, Hindusthan Standard, 20 April, 1947, pp. 8-12, Partition of Bengal a study of Political, Economic and Financial Implications of Partition, by Statistician, Calcutta 1947, pp. 1-32; S. P. Chatterjee. The Partition of Bengal. a Geographical Study, Calcutta, 1947. ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে বঙ্গভঙ্গের দাবিকে রূপায়িত করার উদ্দেশ্যে New Bengal Association নামে একটি সংগঠন গড়ে ওঠে। এই সংগঠন গড়ে তোলার ব্যাপারে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন মেজর জেনারেল এ সি চ্যাটার্জি, শ্রীকুমার ব্যানার্জি, এস এন মোদক, নির্মলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ। এ সি চ্যাটার্জি New Bengal Association-এর প্রেসিডেন্ট হন (vide Amrita Bazar Patrika, 22 April, 1947, p. 8).

৫. Speech by N C Chatterjee. in Amrita Bazar Patrika, Saturday, 5 April, 1947 pp. 1, 3.

৬. Speech by Dr. S P Mookerjee, in Amrita Bazar Patrika, Sunday, 6 April, 1947, p. 3.

৭. Resolution by Bengal Provincial Hindu Mahasabha Conference at Tarakeswar, 6 April, 1947, in Amrita Bazar Patrika, Monday, 7 April 1947, pp. 1, 8.

৮. Resolution by Bengal Provincial Congress Committee April 4, at Calcutta, In Amrita Bazar Patrika, Saturday, 5 April, 1947, p. 1.

৯. Speech by Dr. S P Mookerjee, April 22, at New Delhi. in Amrita Bazar Patrika, Friday, 25 April, 1947, p. 7. এই সভায় মেজর জেনারেল এ সি চ্যাটার্জিও বক্তৃতা দেন।

১০. Resolution by British Indian Association, 29 March 1947 at Calcutta in Amrita Bazar Patrika, Thursday, 3 April, 1947, p. 4.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *