পথের কাঁটা – ৮

কোর্ট থেকে ফিরে ওঁরা এসে বসলেন বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের বাড়িতে। একতলার বৈঠকখানায়। বাসু-সাহেব, কৌশিক, জয়দীপ আর শ্যামল। মহেন্দ্র এবং বিশ্বম্ভর বর্তমানে এ বাড়িতে থাকেন না। তাঁরা হোটেলে উঠেছেন। জগদানন্দ দ্বিতলে নিজের ঘরে উঠে গেলেন। এসব আলোচনায় তিনি আজকাল আর থাকেন না।

কৌশিক বললে, আপনার জেরায় আজ বেশ বোঝা গেছে যে, মহেন্দ্ৰ-সিয়াঙ কোম্পানিই ব্ল্যাকমেলিং করছিল, যোগানন্দ নয়। ফলে জগদানন্দের পক্ষে খুন করার কোনও মোটিভ বাদী-পক্ষ দেখাতে পারবে না।

বাসু বলেন, তা তো হল; কিন্তু তাহলে খুনটা করল কে? কেন?

কৌশিক বলে, তা নিয়ে আপনার কেন মাথা-ব্যথা? আসামি খুন করেনি এটুকু প্রমাণ করারই তো দায়িত্ব আপনার!

—আই ডোন্ট এগ্রি। সত্যকে উদ্ঘাটিত করার দায়িত্ব আমার!

নীলিমা একটি স্বগতোক্তি করে, আশ্চর্য, সেই ডুপ্লিকেট চাবির গোছাটা আর খুঁজে পাওয়া গেল না! জয়দীপ বললে, না পাওয়াই স্বাভাবিক। সেটা যথাস্থানে রেখে যাবার ঝুঁকি খুনিটা নেবে কেন?

শ্যামল বললে, বাসু-সাহেব, আপনি জেরায় আর একটু অগ্রসর হলেন না কেন? দ্বিতলবাসীর বদলে খুনি যদি একতলার বাসিন্দা হয় তাহলে দ্বিতলবাসীকে খুন করতে হলে তাকে সিঁড়ি ব্যবহার করতে হয়—এ কথাটিও তো আমাকে দিয়ে বলিয়ে নিতে পারতেন।

—পারতাম, বাট দ্যাটস্ অবভিয়াস্। জাস্টিস ভাদুড়ী জানেন,—দুইয়ে দুইয়ে চার হয়। কৌশিক বললে, মহেন্দ্র যে বিশ্বম্ভরবাবুকে দিয়ে খেসারত বাবদ একটা ড্রাফ্‌ট তৈরি করেছিল সে প্রসঙ্গ তো তুললেন না?

—কী লাভ হত কৌশিক? ওরা সেটা অস্বীকার করে যেত। মহেন্দ্র তো স্বীকারই করছে না যে, তাকে অন্যায়ভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে এই অজুহাতে সে এ বাড়িতে এসেছে।

—আপনি বিশ্বম্ভরকে কাঠগড়ায় তুলবেন না? সে রাত বারোটা চল্লিশে ফোন করেছিল কি না—

বাসু-সাহেব কী যেন চিন্তা করছিলেন। হঠাৎ উঠে দাঁড়ান। বলেন, তোমরা কথা বলো, আমি, আমি এখনই আসছি।

উনি উঠে এলেন দ্বিতলে। জগদানন্দের ঘরে ঢুকে দেখেন বৃদ্ধ চুপ করে বসে আছেন ইজিচেয়ারে। বাসু-সাহেবকে দেখে উদাস দৃষ্টি মেলে তাকান। বাসু বসে পড়েন পাশের চেয়ারটায়। বলেন, বলুন তো—আপনি যে আমার মাধ্যমে এ বসতবাড়িটি আপনার নাতনিকে দানপত্র করে দিয়েছেন, এ খবরটা কে কে জানে?

—আপনি, আমি, কৌশিকবাবু আর যোগানন্দ জানত।

—আর কেউ?

—হ্যাঁ, নীলিমাও জানে!

—নীলিমা কেমন করে জানল?

জগদানন্দ বলতে থাকেন। বুধবার দানপত্রটা রেজেস্ট্রি হয়। পরদিন, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় তিনি নীলিমা আর জয়দীপকে দানপত্রের কথা গোপন করে উইলটা দেখান। তারপর জয়দীপ চলে যায়। জগদানন্দ নীলিমার ঘরে এসে দেখেন, মেয়েটা টেবিলে মাথা রেখে কাঁদছে। জগদানন্দ মর্মাহত হন। নীলিমা ওকে দেখে বলে, তুমি ছোটকাকুকে পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়ে যাচ্ছ এতে আমি খুশি। তুমি বসতবাড়িটা আমাকে দিচ্ছ না তাতেও আমার দুঃখ নেই দাদু। কিন্তু তুমি ঐ মহেন্দ্রবাবুকে কেন দিচ্ছ বাড়িটা? কোনো সৎ কাজে এটা দান করে যাও না দাদু? তোমার নামে অনাথ-আশ্রম হোক, হাসপাতাল হোক। তুমি যখন থাকবে না তখন তো আর ঐ মহেন্দ্র তোমাকে আর ব্ল্যাকমেল করতে আসবে না? বলেছিলেন, মহেন্দ্র কোনোদিনই উইলের প্রবেট নিয়ে এ বাড়ি দখল করতে পারবে না—কারণ এ বাড়ির মালিক জগদানন্দ নন, নীলিমা।

বাসু উঠে দাঁড়ান। বলেন, কী আশ্চর্য! কী অপরিসীম আশ্চর্য! এতবড় খবরটা এতদিন বলেননি?

—খবরটা কী এতই গুরুত্বপূর্ণ?

—আলবৎ! এ থেকেই যে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে যোগানন্দকে কে খুন করেছিল?

—জগদানন্দ স্তব্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকেন।

বাসু-সাহেবের গাড়ির আওয়াজ শোনা গেল। কাউকে কিছু না জানিয়ে তিনি কোথায় যেন চলে গেলেন।

কৌশিক বৈঠকখানা থেকে উঁকি মেরে দেখে বললে, এ কী? উনি এমন কাউকে কিছু না বলে চলে গেলেন যে? আমি যে ঐ গাড়িতেই ফিরতাম?

জয়দীপ হেসে বললে, এ থেকে প্রমাণ হয় বাসু-সাহেব একজন জিনিয়াস্! জিনিয়াসদেরই অমন মগজের দু’চারটে স্ক্রু আলগা থাকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *