১
ইন্টারকমটায় ভেসে এল মিসেস্ বাসুর কণ্ঠস্বর, তোমার সঙ্গে একজন দেখা করতে চান— একজন নয়, দুজন—মিস নীলিমা সেন আর মিস্টার জয়দীপ রায়। পাঠিয়ে দেব?
বাসু-সাহেব একটা আইনের বইয়ে ডুবে ছিলেন। সেটা বন্ধ করে বলেন, মক্কেল কে? মিস্ সেন, না মিস্টার রায়?
—এখনও বোঝা যাচ্ছে না। সম্ভবত যৌথ। জিজ্ঞাসা করব?
—না থাক। পাঠিয়ে দাও। যুগলেই—
—অল্প পরে আগন্তুকদ্বয় প্রবেশ করল বাসু-সাহেবের চেম্বারে। বাসু পাইপটা দিয়ে ওদের সামনের চেয়ার দুটিকে নীরবে দেখিয়ে দিলেন। নমস্কার করে ওরা পাশাপাশি বসল। মেয়েটির বয়স ত্রিশের কোঠায়—শ্যামলা রং, গড়নটি চমৎকার। চোখ দুটি বড় বড়— বেশ-বাস ছিমছাম। ছেলেটি দু-চার বছরের বড় হতে পারে। অত্যন্ত সুদর্শন এবং সুগঠিত শরীর। দীর্ঘকায়, বলিষ্ঠ এবং চোখ-মুখে বুদ্ধিদীপ্ত একটা সপ্রতিভ ভাব। দেখলে মনে হয় সে দু-ঘা দিতে পারে, দু-ঘা নিতেও পারে।
মেয়েটিই প্রথম কথা বলল, আমার নাম—
বাধা দিয়ে বাসু-সাহেব বললেন, দু-জনের নামই আমি জানি। প্রয়োজনটা বলুন। প্রথম কথাতেই বাধা পেয়ে মেয়েটি যেন কিছু ক্ষুব্ধ হয়। তার সঙ্গীর দিকে তাকিয়ে বলে, তুমি বলো।
ছেলেটি নড়েচড়ে বসে। বলে, নীলিমার দাদু মিস্টার জগদানন্দ সেন একজন ধনী ব্যবসায়ী। বয়স আশির কাছাকাছি—এখনও বেশ শক্ত-সমর্থ আছেন। নীলিমাই তাঁর একমাত্র—কী বলব, ওয়ারিশ। কিন্তু ইতিমধ্যে এমন কতকগুলি ব্যাপার ঘটেছে…মানে নীলিমা মনে করছে…তার দাদু,
বাধা দিয়ে বাসু-সাহেব প্রশ্ন করেন, আপনি জগদানন্দবাবুর কে হন?
—আমি? না আমি কেউই হই না। আমি নীলিমার পাণিপ্রার্থী।
—আই সি। তার মানে সমস্যাটা বর্তমানে একমাত্র নীলিমা দেবীরই? কেমন?—আইনত তা বলতে পারেন আপনি।
—সেক্ষেত্রে—কিছু মনে করবেন না—সমস্যাটা আমি শুধু ওঁর মুখ থেকেই শুনতে চাই।
—আই ডোন্ট মাইন্ড! বলো নীলিমা।
মেয়েটি নড়ে-চড়ে বসে। সে কিছু বলবার আগেই বাসু-সাহেব বলেন, আই রিপিট—কিছু মনে করবেন না, সমস্যাটা আমি ওঁর মুখ থেকে জনান্তিকেই শুনতে চাই।
ছেলেটি অপ্রতিভ হল না একটুও। হেসে বললে, আই অলসো রিপিট—আই ডোন্ট মাইন্ড। আমি বরং বাইরে গিয়ে বসি—
—না বাইরে নয়, ওখানে রোদ্দুর। আপনি আমার ল-লাইব্রেরিতে গিয়ে বসুন বরং। টেবিলে অনেক ম্যাগাজিন আছে—সময় কেটে যাবে।
বাসু-সাহেব ইলেক্ট্রিক বেলটা টিপলেন টেবিলের তলায় হাত চালিয়ে। এসে দাঁড়াল বিশু—ওঁর ছোকরা চাকর। তাকে নির্দেশ দিলেন ঐ ভদ্রলোককে ল-লাইব্রেরিতে নিয়ে গিয়ে বসাতে এবং ফ্যানটা খুলে দিতে।
জয়দীপের প্রস্থানের পরে বাসু-সাহেব মেয়েটার দিকে তাকালেন। তার মুখটা থমথম করছে। বাসু-সাহেব প্রশ্ন করলেন, তোমার বয়স কত?
চোখ তুলে মেয়েটি তাকায়। একটু রূঢ় স্বরে বললে, জয়দীপকে এভাবে তাড়ানোর কোনও প্রয়োজন ছিল না। তার কাছে আমার গোপন করার কিছু থাকলে তাকে আমি এ-ভাবে সঙ্গে করে এখানে আনতাম না।
বাসু-সাহেব পাইপটা ধরালেন। বিচিত্র হেসে বললেন, তাই বুঝি? আমি ভেবেছিলাম, আমার প্রথম প্রশ্নের জবাবটাই হয়তো তুমি ওর কাছ থেকে গোপন করতে চাও! আমার প্রশ্নটার জবাব তুমি এখনও দাওনি। তোমার বয়স কত?
— চৌত্রিশ।
—কিছু হাতে রেখে বলছ না তো?
মেয়েটি উঠে দাঁড়ায়। বলে, আমি শুনেছিলাম আপনি রূঢ়ভাষী; কিন্তু কোর্টে সওয়াল করতে করতে যে ওটা আপনার এমনই বদ-অভ্যাস হয়ে গেছে তা আমি আশঙ্কা করিনি। আচ্ছা চলি, নমস্কার।
বাসু পাইপটা দিয়ে ইঙ্গিত করে বললেন, বসো! অত রাগ করা ভাল নয়। তোমার মুখ-চোখ বলে দিচ্ছে তুমি একটা বিপদের মধ্যে পড়েছ। বিপদের সময় মাথা ঠান্ডা রাখতে হয়। বস! অল রাইট! আই উইথড্র। তোমার বয়স বত্রিশ। মেনে নিলাম। এবার বলো।
মেয়েটি বসে না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বলে, না বত্রিশ নয়, চৌত্রিশ। দু-বছর আপনাকেও হাতে রাখতে হবে না। আর আমার বয়সটা সঠিক কত তা জয়দীপ জানে!
—ভেরি গুড। এবার বলো তোমার দাদুর কথা। তোমার সমস্যার কথা। বস। কী খাবে বলো, চা না কফি?
মেয়েটি বসে। বলে, ধন্যবাদ। আপ্যায়ন করতে হবে না। আমি আপনার কাছে সৌজন্যে সাক্ষাতে আসিনি, এসেছি ক্লায়েন্ট হিসাবে। সেটুকু মর্যাদা পেলেই আমি খুশি।
—রাগ পড়েনি তাহলে? আচ্ছা না হয় আমি ক্ষমাই চাইছি।
—ক্ষমা চাওয়ার কিছু নেই। ঠিক আছে শুনুন—
নীলিমা সেন যা বলল তা সংক্ষেপে এই :
জগদানন্দ সেনের সমস্ত সম্পত্তি স্বোপার্জিত। নিম্ন-মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে। পরীক্ষায় ফেল করে যখন বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যান তখন তাঁর বয়স আঠারো-উনিশ। সে বছর প্রথম বিশ্বযুদ্ধ বাধে। উনি পালিয়ে যান বর্মা মুলুকে। দীর্ঘ দশ-বারো বছর ছিলেন প্রবাসে। ব্যবসায় বেশ কিছু জমিয়ে ভারতবর্ষে ফিরে আসেন উনিশ’শ পঁচিশে। বর্মা থেকে সেগুন কাঠ আসত আর উনি কলকাতার বাজারে তা বেচতেন। রেঙ্গুনে ছিল ওঁর ব্রাঞ্চ অফিস। সেটা দেখাশোনা করতেন একজন বিশ্বস্ত ম্যানেজার—তিনি বর্মী, য়ু সিয়াঙ। তিনিই ওখান থেকে সেগুন কাঠ চেরাই করে জাহাজে করে পাঠাতেন। এভাবেই কেটে গেল আরও বছর পনের। তারপর জাপান বিশ্বযুদ্ধে নেমে পড়ার ঠিক আগে বর্মা-সেগুন আসা বন্ধ হল; কিন্তু ধুরন্ধর ব্যবসায়ী জগদানন্দ সময়েই সতর্ক হয়েছিলেন। তিনি ঐ সময়ে কাঠের ব্যবসা ছেড়ে ধরলেন লোহার ব্যবসা—হার্ডওয়ার মার্চেন্ট। যুদ্ধের ক’বছর শুধু পেরেক আর কাঁটাতার বেচে তিনি বেশ কয়েক লক্ষ টাকা কামিয়ে ফেলেন। বর্মায় থাকতেই একজন স্বজাতের বাঙালি মেয়েকে জগদানন্দ বিবাহ করেছিলেন। একটি মাত্র সন্তান হয়েছিল—পুত্র সন্তান, নীলিমার বাবা। তার পরেই ওঁর স্ত্রী মারা যান। জাপান বিশ্বযুদ্ধে নেমে পড়ার বছরখানেক আগে জগদানন্দ তাঁর একমাত্র পুত্রকে বর্মা মুলুকে পাঠিয়ে দেন। সেখানকার সমস্ত স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বেচে দেবার জন্য পুত্র সদানন্দকে পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি দিয়ে দেন। সদানন্দ সমস্ত কিছু বিক্রয় করে ব্যাঙ্ক ড্রাফট নিয়ে ফিরে আসে ভারতবর্ষে। কিন্তু সে গিয়েছিল একা, ফিরল যুগলে। ইতিমধ্যে সে রেঙ্গুনে একটি বর্মী মেয়েকে ভালবেসে বিয়ে করেছে! জগদানন্দ পুত্রকে বাড়িতে ঢুকতে দেননি। ত্যাজ্যপুত্রই করতে চেয়েছিলেন একমাত্র সন্তানকে। বছর দুই সদানন্দ এখানে ওখানে ঘুরে বেড়ায়। তারপর মহেন্দ্রবাবুর প্রচেষ্টায় পিতাপুত্রে একটা মিলন হয়।
বাধা দিয়ে বাসু-সাহেব বলেন, মহেন্দ্রবাবুটা কে?
—মহেন্দ্রনাথ বসু। দাদুর কলকাতা অফিসের ম্যানেজার। তিনি আমার বাবার বয়সি। তাঁকেও দাদু প্রায় ছেলের মতই মানুষ করেছিলেন। ঐ দু বছরের মধ্যে আমার জন্ম হয়েছে এবং আমার জন্মের সময়েই আমার মা মারা যান। বাবার আর্থিক অবস্থা তখন খুব খারাপ। মহেন্দ্রবাবুই একদিন আমাকে নিয়ে গিয়ে হাজির করলেন দাদুর কাছে। আমাকে দেখেই দাদুর রাগ জল হয়ে গেল।
—বুঝলাম। এখন তোমার সমস্যার কথাটা বলো। এতক্ষণ তো পূর্বকথন শোনাচ্ছিলে।
—পূর্বকথন আরও কিছুটা শোনাতে হবে। না হলে বর্তমান সমস্যার পারম্পর্যটা আপনি ধরতে পারবেন না। শুনুন—
সদানন্দ মারা যান আরও বছর পাঁচেক পরে। নীলিমা তখন ক্লাস থ্রিতে পড়ে। বাবার মৃত্যুর কথা অল্প অল্প মনে আছে তার—কিন্তু তার পরের কথা আরও স্পষ্টভাবে মনে আছে। একমাত্র পুত্রের মৃত্যুতে একেবারে ভেঙে পড়েছিলেন জগদানন্দ। ব্যবসাপত্র নিজে কিছুই দেখতে পারেন না। নাতনিকে নিয়েই তাঁর দিন কাটে। এভাবেই কাটল আরও দু-বছর। তারপর কী-একটা কারণে জগদানন্দের সন্দেহ হল। একদিন তিনি খাতাপত্র দেখতে বসলেন। হঠাৎ আবিষ্কার করলেন, ইতিমধ্যে মহেন্দ্র যেন বেশ কিছু টাকা হাতিয়ে ফেলেছে ব্যবসায় থেকে। হিসাব মেলাতে পারলেন না মহেন্দ্রবাবু। আইনত কিছু করার ছিল না জগদানন্দের—কারণ পুত্রের মৃত্যুর পর শোকাহত জগদানন্দ তাঁর ম্যানেজারকে জেনারেল পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি দিয়ে রেখেছিলেন। মহেন্দ্ৰ কৌশলী লোক—খাতাপত্রে সে লোকসানও দেখিয়ে গেছে আইন মোতাবেক, কিন্তু বেশ বোঝা যায় যে, সেটা ওর কারসাজি। তহবিল তছরুপের মামলা আনলেন না জগদানন্দ। তৎক্ষণাৎ অপমান করে তাঁর বিশ্বস্ত ম্যনেজারকে বিদায় করে দিলেন। মহেন্দ্র প্রতিশোধ নেবে বলে শাসিয়ে চলে যায়, আর ফেরেনি। এর পর গত পঁচিশ বছর তার কোনো খবর ছিল না। হঠাৎ গত সপ্তাহে তার নাটকীয় আবির্ভাব ঘটে। নীলিমা তাকে চিনতেই পারেনি—না চেনাই স্বাভাবিক। মহেন্দ্রবাবু এ পরিবার ছেড়ে যখন চলে যান তখন নীলিমার বয়স মাত্র আট নয় বছর। এমনকি জগদানন্দও এই ষাট বছরের বৃদ্ধের ভিতর তাঁর সেই যুবক ম্যানেজারকে খুঁজে পাননি। মহেন্দ্ৰ যখন নিজের পরিচয় দিয়ে বলেছিল, বুড়ো কর্তা, আপনি আমাকে চিনতেই পারলেন না? কিন্তু আমি যাবার দিনে তো বলে গিয়েছিলাম আবার আমি ফিরে আসব। আমি মহেন্দ্ৰ
এর পরের ইতিহাস নীলিমা বিস্তারিত জানে না। এটুকু দেখেছে মহেন্দ্ৰ সেই যে এসে ঢুকেছেন, আর বাড়ির বার হননি। আরও দেখেছে—ঐ ঘটনার পর থেকে দাদু যেন কী একটা আতঙ্কে একেবারে কাঁটা হয়ে আছেন। ব্যাপারটা কী, তা সে জানে না—কিন্তু বুঝতে পারছে যে, বৃদ্ধ জগদানন্দ একটা প্রচণ্ড আতঙ্কের তাড়নায় একেবারে দিশেহারা হয়ে গেছেন। এইটাই নীলিমার সমস্যা।
—কী জাতীয় সাহায্য তুমি চাও আমার কাছে?
—দাদু হঠাৎ এমন বদলে গেছেন কেন সেই রহস্যটা উদ্ধার করতে চাই আপনার সাহায্যে। বাসু বলেন, আমি গোয়েন্দা নই, আমি হচ্ছি ক্রিমিনাল উকিল। এক্ষেত্রে আমার সাহায্য তো তুমি আশা করতে পার না। তবে আন্দাজে বলতে পারি, ঐ মহেন্দ্র বোস তোমার দাদুকে ব্ল্যাকমেল করতে এসেছে। তোমার দাদুর অতীত জীবনের কোনও ঘটনার কথা সে প্রকাশ করে দেবার ভয় দেখাচ্ছে।
—তাহলে গত পঁচিশ বছর সে সেটা দেখায়নি কেন?
—আমার ধারণা, সেই গোপন ঘটনার কথা যে মহেন্দ্র জানে এটা জানা ছিল তোমার দাদুর—কিন্তু তাঁর বিশ্বাস ছিল মহেন্দ্র সেটা প্রমাণ করতে পারবে না। মহেন্দ্র নিশ্চয়ই অতি সম্প্রতি সেই গোপন ব্যাপারের কোনো অকাট্য প্রমাণ সংগ্রহ করেছে। সেই নথিপত্র নিয়ে এসে হাজির হয়েছে তোমার দাদুর কাছে।
—আমারও তাই অনুমান; কিন্তু ব্যাপারটা কী হতে পারে? পঁচিশ বছর পরে সবকিছুই তো তামাদি হয়ে যায়।
—তা যায় না। ধরো একটা মার্ডার কেস। পঁচিশ বছরে সে অপরাধ তামাদি হয়ে যায় না!
—আপনি কি বলতে চান আমার দাদু মানুষ খুন করেছিলেন?
—ডিড আই সে দ্যাট? তবে ঐ জাতীয় এমন কিছু তিনি করেছিলেন যে অপরাধ পঁচিশ বছরে তামাদি হয়ে যায় না। তোমাকে আগেই বলেছি, এক্ষেত্রে আমি তোমাকে খুব বেশি কিছু সাহায্য করতে পারব না—কিন্তু তোমার এক্ষেত্রে কী করণীয় তা সাজেস্ট করতে পারি। দাদুকে ঐ আতঙ্কের হাত থেকে মুক্তি দিতে তোমার কোনো প্রাইভেট ডিটেক্টিভের শরণাপন্ন হওয়া উচিত। সে খুঁজে বার করবে গোপন রহস্যটা কী, কেমন করে মহেন্দ্র সেটা সংগ্রহ করেছে—এবং হয়তো সে তোমাকে পরামর্শও দিতে পারবে কেমন করে এ বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়া যায়।
—কলকাতায় এমন প্রাইভেট গোয়েন্দা প্রতিষ্ঠান আছে নাকি? আপনি সন্ধান দিতে পারেন?
—পারি। এই বাড়িরই অপর উইং-এ আছে ‘সুকৌশলী’র অফিস। সেখানে কৌশিক মিত্র এবং সুজাতা মিত্র পার্টনারশিপ বিজনেসে এ জাতীয় কাজ করে। ওরা আমারই লোক। তুমি যদি চাও, তাহলে আমি যোগাযোগ করে দিতে পারি।
—প্লিজ স্যার-
বাসু-সাহেব ইন্টারকমের মাধ্যমে কৌশিককে সংবাদটা জানিয়ে দিলেন। মেয়েটি নমস্কার করে উঠে দাঁড়াতেই বললেন, আর একটা কথা আছে। আমাকে যেসব কথা বললে তা ঐ জয়দীপ ছেলেটি জানে?
—জানে।
—তোমার দাদু জানেন তোমাদের দু-জনের সম্পর্ক?
—জানেন—তিনি রাজি হচ্ছেন না বলেই ব্যাপারটা পিছিয়ে যাচ্ছে।
—রাজি হচ্ছেন না? কেন?
বিচিত্র হাসল মেয়েটি। তারপর বললে, যে কারণে কানা-খোঁড়া না হওয়া সত্ত্বেও এই চৌত্রিশ বছর বয়স পর্যন্ত আমি থুবড়ি হয়ে আছি!
—বুঝলাম না।
—যার সঙ্গেই আমার বিয়ের কথা হয়, দাদু ভেবে বসেন যে, সে আমাকে শুধু টাকার জন্য বিয়ে করতে চাইছে। আমার মনে হয়, দাদুর জীবদ্দশায় আমাদের বিয়েটা আদৌ হবে না। এটা ওঁর একটা, কী বলব? ফোবিয়া!
—অর্থাৎ তোমার দাদুর বিশ্বাস যে, জয়দীপও শুধুমাত্র টাকার লোভে তোমাকে বিবাহ করতে চাইছে?
—হ্যাঁ তাই।
—ও কী করে? কে আছে ওর পরিবারে?
মোটামুটি একাই। বাবা-মা নেই। এক দাদা আছেন, এক বোনও আছে। দাদা পৃথক সংসার করেন, বোনও বিবাহিত। ও বিজনেস করে। মোটামুটি সচ্ছল। তবে আদর্শের বাতিক আছে। ঘুষ-ঘাসের মধ্যে যেতে চায় না। তাই ব্যবসায় উন্নতি করতে পারছে না।
—তোমার সঙ্গে কতদিনের আলাপ?
—তা বছরতিনেকের হবে।
—একটা কথা। জয়দীপ কি ঘরজামাই হয়ে তোমাদের বাড়িতে থাকতে রাজি হতে পারে? নীলিমা আবার বসে পড়ে। বলে, হঠাৎ এ কথা কেন?
—আমার কেমন যেন মনে হচ্ছে তোমার দাদু তোমার বিয়ে দিতে রাজি হচ্ছেন না—তোমাকে হারাবার ভয়ে। তাহলে এই বৃদ্ধ বয়সে বাড়িতে তিনি একেবারে একা হয়ে পড়বেন।
নীলিমা মাথা নাড়ল। বললে, না। তা নয়। ঐ ফোবিয়ার জন্যই। তাছাড়া আমাদের বাড়ি ফাঁকা নয়। আমার এক সম্পর্কে কাকা আছেন। তাঁর এক শ্যালিকা-পুত্রও ঐ বাড়িতে থাকে। বাড়ি আমাদের ফাঁকা নয়।
—আই সি!
ইতিমধ্যে ছোকরা চাকরটা জয়দীপকে লাইব্রেরি থেকে ডেকে নিয়ে এসেছে। বাসু-সাহেব বললেন, আপনাকে একা বসিয়ে রেখেছি বলে দুঃখিত। এটা আমার প্রফেশনাল এথিক্স!
জয়দীপ নমস্কার করে বললে, আমার কোনোই অসুবিধা হয়নি। লাইফ ম্যাগাজিনে একটা ভাল প্রবন্ধ পড়া গেল।