পথের কাঁটা – ১০

১০

ধুতি-পাঞ্জাবি পরিহিত হওয়া সত্ত্বেও পার্ক-হোটেলের ম্যানেজার মণীশ বর্মণকে চিনতে পারল। ইতিপূর্বেই সে একবার ধড়া-চূড়া পরে তদন্ত করে গেছে। বললে, বলুন স্যার, কীভাবে আপনাদের সাহায্য করতে পারি?

মণীশ বাসু-সাহেবের পরিচয় দিয়ে বললে, ইনি একবার ঐ আটত্রিশ নম্বর ঘরটা দেখতে চান।

—তাহলে প্রথমেই জানতে হয় ঘরটা অকুপায়েড কি না।

ম্যানেজার রিসেপশান কাউন্টারে ফোন করে জেনে নিয়ে বললে, ভাগ্য ভাল। ঘরটা এখন ফাঁকা।

একটু আগেই খালি হয়েছে। আমিও আপনাদের সঙ্গে আসব?

বাসু বলেন, কোনও প্রয়োজন নেই। একজন রুম অ্যাটেনডেন্টকে শুধু আমাদের সঙ্গে দিন।

হোটেল বয়ের সঙ্গে ওঁরা লিফ্ট-এ করে তিনতলায় উঠে এলেন। ত্রিতলের একক-শয্যাবিশিষ্ট আটত্রিশ নম্বর ঘরটা করিডোরের শেষ প্রান্তে। হোটেল-বয় ঘরের তালা খুলে দিল। বাসু-সাহেব ঘরটা ঘুরে ঘুরে দেখলেন। কী দেখলেন তা তিনিই জানেন। অতি সংক্ষেপে পরিদর্শন শেষ করে এসে বললেন, চল এবার নিচে রিসেপশান কাউন্টারে যাই।

নিচের রিসেপশান কাউন্টারে আবার দেখা হয়ে গেল ম্যানেজার ভদ্রলোকের সঙ্গে। তিনি বলেন, কী হল ব্যারিস্টার-সাহেব, পেলেন কিছু?

বাসু-সাহেব, তা কিছু কিছু পেলাম বইকি। এবার আমি দেখতে চাই আপনাদের হোটেল রেজিস্টারখানা। যদি কোনো আপত্তি না থাকে।

ম্যানেজার বলেন, আপত্তি? বলেন কী? মিস্টার বর্মণ যখন চাইছেন তখন সব রকম সাহায্যই করব আমরা। আসুন।

ম্যানেজার পরিচয় করিয়ে দিলেন, এ হচ্ছে মিস্ এডনা পার্কার। আমি যদি না থাকি তাহলে এর কাছে যা জানতে চান জেনে নিতে পারেন।

মিস্ এডনা পার্কার রিসেপশান-কাউন্টারে ডিউটি দিচ্ছিল। বছর বাইশ-তেইশ বয়স। দেখতে যতটা সুন্দর তার চেয়ে বেশি দেখাচ্ছে উগ্র সাজের চটকে। নীল চোখ, সোনালি চুল। সবিনয়ে বললে, হোয়াট ক্যান আই ডু ফর য়ু স্যারস?

বাসু-সাহেব ওর কাছ থেকে হোটেলের রেজিস্টারখানা চেয়ে নিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকেন। এ কয়দিনে কয়েক পাতা এগিয়ে এসেছে খাতাটা। পাতা উল্টে খুঁজে বের করলেন উনি। হ্যাঁ, এই তো য়ু সিয়াঙের হস্তাক্ষর। শুক্রবার সন্ধ্যা সাতটা দশ-এ সে হোটেলে চেক্‌-ইন করে। আটত্রিশ নম্বর ঘর। স্থায়ী ঠিকানার ঘরে বর্মার একটি বাড়ির নম্বর। ‘প্রফেশন’-এর ঘরে লিখেছে বিজনেসম্যান, ব্যবসায়ী। বর্মার নাগরিক। পাসপোর্ট নম্বরের উল্লেখও করতে হয়েছে। রবিবার রাত দশটা পনের মিনিটে সে হোটেলের গাড়ি নিয়েই হোটেল ত্যাগ করে যায়। বাসু-সাহেব ডায়েরিতে সব কিছু টুকে নিলেন। লক্ষ্য করে দেখলেন, পরের পৃষ্ঠাতেই আছে জয়দীপের স্বাক্ষর—সে রবিবার সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ হোটেলের খাতায় সই করেছিল। অর্থাৎ কৌশিকের সঙ্গে কথাবার্তা বলে সে সোজা চলে এসেছিল এই হোটেলে। জয়দীপের এন্ট্রিটাও খুঁটিয়ে দেখলেন বাসু-সাহেব। কত নম্বর ঘরে সে উঠেছিল, কবে, কটার সময় সে হোটেল ছেড়ে দেয়।

খাতাটা বাসু-সাহেবে বাড়িয়ে ধরেন ম্যানেজারের দিকে। বলেন, এই রেজিস্টিরখানা মামলায় প্রয়োজন হতে পারে। আপনি বরং এটা আপনার নিজস্ব সিন্দুকে তুলে একটা নতুন খাতা এখন, এই মুহূর্ত থেকেই চালু করুন। এতে য়ু সিয়াঙের সই আছে, নিজ স্বীকৃতি-মতো তার স্থায়ী ঠিকানা, পাসপোর্ট নাম্বার ইত্যাদিও আছে।

ম্যানেজার বললেন, খাতাটা এখনই কাউন্টার থেকে সরিয়ে ফেলা সম্ভবপর নয়, যে সব বোর্ডার এসেছেন, এখনও হোটেলে আছেন তাঁদের নামগুলি নতুন খাতায় কপি করে নিতে হবে প্রথমে।

বাসু বলেন, বেশ এখনই কপি করতে দিন। কিন্তু সে-ক্ষেত্রে খাতার কোনো ফিগার যারতে কেউ ট্যাম্পার না করে সে জন্য আমি আপনাকে কয়েকটি এন্ট্রিতে গোল চিহ্ন দিয়ে সই দিতে অনুরোধ করব।

ম্যানেজার বলেন, এতে কোনো অসুবিধা নেই। আপনি যে যে ফিগারগুলো গোল চিহ্ন দিয়ে দেবেন, আমি তার পাশে পাশে সই দিয়ে দিচ্ছি।

বাসু-সাহেব খাতাখানি টেনে নিলেন। তিন-চারটি এন্ট্রিতে গোল চিহ্ন দিয়ে ফেরত দিলেন। ম্যানেজার তার পাশে পাশে সই দিলেন।

মণীশ কৌতূহল সম্বরণ করতে পারে না। বলে, মাপ করবেন মিস্টার বাসু, আমি কিন্তু মাথা-মুণ্ডু কিছুই বুঝছি না। এ খাতায় গোঁজামিল দিতে চাইবে কে? কেন? য়ু সিয়াঙ তো এখানে মিথ্যা কিছু লেখেনি। তার চেক্-ইন টাইম, চেক-আউট টাইম, রুম নম্বর, স্থায়ী ঠিকানা, পাসপোর্ট নম্বর সবই তো জেনুইন?

বাসু সংক্ষেপে বলেন, সাবধানের মার নেই। বাই দ্য ওয়ে, মণীশবাবু, য়ু সিয়াঙ কলকাতায় এসে খোকা গুন্ডার সঙ্গে যোগাযোগ করছিল এটা তুমি কোন সূত্রে জানলে? এ ব্যাপারটাও বুঝে নেওয়ার দরকার—কারণ য়ু সিয়াঙ নিজেই বলেছে যে, সে এই প্রথম কলকাতায় আসছে। সে-ক্ষেত্রে তার পক্ষে অমন একটি কুখ্যাত গুন্ডার সন্ধান পাওয়া বিস্ময়কর নয়?

মণীশ বললে, আপনার শেষ প্রশ্নটার জবাব জানি না, কিন্তু প্রথম প্রশ্নটার জবাব দিতে পারি। পার্ক হোটেল কর্তৃপক্ষ খুব সাবধানী। হোটেল থেকে কোনো বোর্ডার বাইরে কোনো ফোন করলে তা অপারেটারের মাধ্যমে যায়। কোনো ঘরেই অটোমেটিক ফোন নেই। এঁদের অপারেটারের কাছে নাম্বার চাইতে হয়। অপারেটার যোগাযোগ করে দেয়। বোর্ডারকে টেলিফোনের জন্য আলাদা চার্জ দিতে হয়। তাই অপারেটার খাতায় লিখে রাখে কোন বোর্ডার কটার সময় কত নম্বরে ফোন করছে। সেই সূত্র থেকেই—

মণীশ সাদা বাংলায় কথা বলছিল এতক্ষণ। এবারে ঘুরে মিস্ এডনা পার্কারকে ইংরাজিতে বললে, আপনাদের সেই টেলিফোনের খাতাটা দেখি?

খাতাটা থাকে পাশের টেলিফোন অপারেটারের কাছে। মিস্ পার্কার খাতাখানা নিয়ে এল। মণীশ তার পাতা উল্টে দেখালো শনিবার রাত্রে আটত্রিশ নম্বর ঘর থেকে য়ু সিয়াঙ একটি টেলিফোন করেছিল। সে নম্বরটি চিহ্নিত। অর্থাৎ যে নম্বরে খোকা গুন্ডার সন্ধান পাওয়া যেতে পারে। বাসু-সাহেব বললেন, এটাও একটা জবর এভিডেন্স। এ খাতাখানা ও সেফ্ কাস্টডিতে সরিয়ে রাখা ভাল।

খাতাখানা উনি খুঁটিয়ে দেখলেন। আর যে-সব নম্বরে ফোন করা হয়েছে সেই নম্বরগুলিও উনি ডায়েরিতে টুকে নিলেন। কয়েকটি স্থানে কালি দিয়ে গোলচিহ্ন দিলেন। ম্যানেজার-সাহেবকে আবার সই দিতে হল।

রাত প্রায় সাড়ে আটটা নাগাদ ওঁরা বেরিয়ে গেলেন ভবানীপুর থানার দিকে। ভবানীপুর থানায় তীর্থের কাকের মতো বসে আছে খোকাবাবু।

ছিপছিপে গড়ন। হৃষ্টপুষ্ট মোটেই নয়। কে বলবে লোকটা গুন্ডা! সাজ-পোশাকে রীতিমত ভদ্রসন্তান। সূচ্যগ্র একটি নূর আছে, মাথায় বড় বড় চুল পিছনে ফেরানো। মুখে বসন্তের দাগ। নেহাত গোবেচারি ধরন।

বাসু-সাহেবকে নিয়ে মণীশ ঘরে ঢুকতেই লোকটা তড়াক করে টুল ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। বিনীত নমস্কার করে বললে, আবার কী কসুর হল স্যার আমার? এরা আমাকে ঘরে যেতে দিচ্ছে না!

বাসু-সাহেব আসন গ্রহণ করে বললেন, অপরাধ এবার তুমি করনি খোকাবাবু, কিন্তু অপরাধ কেউ না কেউ এখনও তো করছে। তাদেরই একজনকে ধরবার জন্য তোমার সাহায্য চাইছি। যা জিজ্ঞেস করব সত্য জবাব দেবে। মিথ্যা বললে তুমিই ফাঁসবে কিন্তু!

—বলুন স্যার? মিছে কথা আমি কখনও বলি না—মা-ওলাইচণ্ডীর কসম্!—খোকা গুন্ডা এখনও গরুড় পক্ষী।

—’য়ু সিয়াঙ’ নামে একজন বর্মী ভদ্রলোককে চেন?

—না স্যার! অমন নাম বাপের জন্মে শুনিনি।

—এত তারিখ, শনিবার রাত্রি নটার সময় তুমি পার্ক হোটেলে গিয়েছিলে?

খোকা দু-চোখ বুজে অনেকক্ষণ চিন্তা করে বললে, আজ্ঞে না। সেই শনিবার আমি রানাঘাটে গেলাম স্যার। থানার বড়বাবুর কাছে ছুটি নিয়ে গেলাম। শনিবার হাজিরা দিইনি। পেত্যয় না হয়, বড়বাবুকে শুধোন

বাসু-সাহেব ধমক দিয়ে ওঠেন, তা থেকে কী প্রমাণ হয়? তুমি শনিবারে থানায় হাজিরা দাওনি মানে কি তুমি কলকাতায় ছিলে না?

—ছুটিতে ছিলাম স্যার। রানাঘাটে। মা-ওলাইচণ্ডীর দিব্যি!

—শনিবার রাত্রে কেউ তোমাকে রানাঘাটে দেখেছে প্রমাণ করতে পারবে?

—পারব স্যার! আমার শালার ছাপরায় ছিলাম। সে শালা সাক্ষী দেবে।

—শালার নাম কি ধর্মপুত্তুর?

—আজ্ঞে না, স্যার। যুধিষ্ঠির!

বাসু-সাহেব হেসে ফেলেন। তারপর বলেন, ঠিক আছে। যাঁহা ধর্মপুত্র তাঁহা যুধিষ্ঠির। তার সাক্ষ্যকে কে অস্বীকার করবে? এবার বলো তো খোকাবাবু, তার পরের সোমবার রাত্রে তুমি কোথায় ছিলে?

—রাত কটায় স্যার?

—এই ধর রাত বারোটা নাগাদ?

—নিয্যস্ সত্যি কথা বলব স্যার? অপরাধ নেবেন না তো?

—না, বলো না। মা ওলাইচণ্ডীর নামে নাহয় একটা সত্যি কথাই বললে!

—কথাটা পাঁচকান হলে আমার ঝঞ্ঝাট হবে কিন্তু!

—খুব গোপন ব্যাপার নাকি? তা হোক, বলেই ফেল!

—সৌরভীর ঘরে ছিলাম, স্যার।

—সৌরভী! কোথায় তার ঘর?

—হাড়কাটা গলি! দেখবেন স্যার, কথাটা আমার বউয়ের কানে না ওঠে। মাগি ভীষণ খাণ্ডার। কিছুতেই শালি বিশ্বাস করে না—আমি ও পাড়ায় যাই-ই না।

পরদিন কোর্টে যাবার পথে বাসু-সাহেবের গাড়ি এসে থামল বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের বাড়িটার সামনে। বেলা পৌনে নটা। আদালতে যাবার জন্য সবাই প্রস্তুত হচ্ছে। বাসু গটগট করে উঠে গেলেন দ্বিতলে। জগদানন্দের ঘরে ঢুকে দেখলেন বৃদ্ধ ঠিক কালকের মতই স্থির হয়ে বসে আছেন ইজিচেয়ারে। যেন সারা রাত তিনি ওখানে ওভাবেই বসে আছেন। বাসু জানেন, সেটা সত্য নয়—তবুও এটাও জানেন ঐভাবে বসে থাকাটাই এখন তাঁর স্বাভাবিক ভঙ্গি। কাছে এগিয়ে এসে বললেন, সেনমশাই, দোষটা আমার নয়, আপনার! আপনি ভাইটাল ব্লুটা আমার কাছ থেকে গোপন রেখেছিলেন বলেই এতদিন কষ্ট পেলেন।

ভ্রু কুঞ্চন করে জগদানন্দ বলেন, ভাইটাল ব্লু বলতে? ঐ দানপত্র করার খবরটা নীলুকে জানানো?

—এজ্যাক্টলি! আপনার ক্লু পেয়ে আমি বাকি তদন্তটা করেছি। সমস্ত রহস্যটা পরিষ্কার হয়ে গেছে। আপনাকে গ্যারান্টি দিচ্ছি আজ আপনাকে বেকসুর খালাস করিয়ে আনব। শুধু তাই নয়, যে আপনার ভাইপোকে হত্যা করেছে আজ তাকে গ্রেপ্তার করা হবে। আমি সব ব্যবস্থা করে ফেলেছি! আদালতে পুলিশ প্রস্তুত থাকবে।

জগদানন্দের ঠোঁট দুটি নড়ে উঠল। কিছু বলতে পারলেন না তিনি।

—আপনি তৈরি হয়ে নিন! ভয় কী? আজই তো এ যন্ত্রণার শেষ!

ও ঘর থেকে বেরিয়ে এসে তিনি টোকা দিলেন নীলিমার ঘরের দরজায়। সে সাজ-পোশাক পালটাচ্ছিল। দরজা খুলে দিয়ে বললে, এ সময়ে আপনি? হঠাৎ?

বাসু বিনা সঙ্কোচে ঘরে ঢুকে ড্রেসিং টেবিলের টুলটা টেনে নিয়ে বসলেন। বললেন, নীলিমা, ব’স ঐখানে। তোমাকে একটা কথা বলার আছে।

—মেয়েটি বসল। তার শুধু এক চোখে কাজল। সে সঙ্কোচ করল না তাই বলে।

—তোমাকে দুটো কথা বলব। একটা আনন্দের সংবাদ, একটা দুঃখের। কোন্‌টা আগে শুনতে চাও?

—আনন্দের সংবাদটটা?

—আজ আদালতে তোমার দাদু বেকসুর খালাস হয়ে যাবেন। প্রকৃত অপরাধী কে তা জানা গেছে।

নীলিমা উঠে দাঁড়িয়ে বলে—বলেন কী! কে সে?

মাথা নাড়লেন বাসু, নট নাউ! এবার দুঃসংবাদটা জানাই? আজ তোমার একটা বিরাট লোকসানের দিন।

নীলিমা বললে, বুঝেছি! কিন্তু তাতে আমার দুঃখ নেই। এ বাড়ির অধিকার যদি না পাই, দাদুর সম্পত্তির কণামাত্র না পাই, তাহলে আমি দুঃখ করব না। দাদু যে মাথা সোজা করে আজ বাড়ি ফিরে আসবেন এ আনন্দই আমাকে সব দুঃখের হাত থেকে রক্ষা করবে!

বাসু ওর খোঁপাটা নেড়ে দিয়ে বললেন, ভগবান তোমাকে সেই মনোবলই দিন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *