পথের কাঁটা – ৬

মাত্র সাতদিনে প্রাথমিক তদন্ত শেষ করে মামলাটা ট্রাইং ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে গেল এবং আসামিকে তিনি দায়রায় সোপর্দ করলেন। মাত্র তিন সপ্তাহের মধ্যে কেস উঠল দায়রা জজের আদালতে। এতটা তাড়াতাড়ি সচরাচর হয় না। এ ক্ষেত্রে সেটা করতে হয়েছে রাজনৈতিক চাপে। মামলায় একজন সাক্ষী আছেন যিনি বিদেশের নাগরিক তিনি সমন পেয়েছেন। বার্মিজ কনসুলেট ভারত সরকারকে জানিয়েছেন, যে, হয় অবিলম্বে জবানবন্দি নিয়ে তাঁদের নাগরিককে দেশে ফিরে যেতে দিতে হবে অথবা তাঁর কলকাতায় অবস্থানের ব্যয়ভার ও খেসারত ভারত সরকারকে বহন করতে হবে। ফলে এই তাড়াহুড়া

তদন্তকারী অফিসার মোটামুটি নিঃসন্দেহ হয়েছে অপরাধীর অপরাধ সম্বন্ধে। পুলিশের বক্তব্য অনুযায়ী কেসটা এই—

আসামি জগদানন্দের ভাইপো যোগানন্দ কোন সূত্রে একটি পারিবারিক গোপন রহস্য জেনে ফেলেন। সেই রহস্যটা ফাঁস করে দেবার ভয় দেখিয়ে তিনি দীর্ঘদিন ধরে জগদানন্দকে শোষণ করছেন। জগদানন্দ ঐ উপার্জনহীন ভাইপোটিকে এতদিন খোরপোশ দিয়ে যাচ্ছিলেন বিনা প্রতিবাদে। সম্প্রতি যোগানন্দ চাপ সৃষ্টি করায় বৃদ্ধ একটি উইল করে তাঁকে পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়ে যাবার লোভ দেখান। উইলটি লেখা হয় এবং সেটা পাওয়াও গেছে। রেজিস্টার্ড উইল নয়। তারপর ঘটনার পূর্বদিন রবিবার, যোগানন্দ এবং তাঁর কাকা জগদানন্দ দীর্ঘসময় রুদ্ধদ্বার কক্ষে আলোচনা করেন। এই সময় নাকি জগদানন্দ বলে উঠেছিলেন, এরা ভেবেছে কী? সব কটাকে খুন করব আমি। তারপর ঘটনার দিন সকালে জগদানন্দ তাঁর আলমারি খুলে একটি ছোরা বার করেন। ঘটনার রাত্রে যোগানন্দ ভিতর থেকে তালা বন্ধ করে ঘরে শুয়েছিলেন—কিন্তু জগদানন্দের কাছে একটি ‘মাস্টার-কী’ ছিল, যা দিয়ে সব ঘর বাইরে থেকে খোলা যায়।

পুলিশের মতে মৃত্যুর সময় বারোটা থেকে সোয়া বারোটা। সময়টা নির্ধারণ করা হচ্ছে শ্যামলের জবানবন্দি থেকে। শ্যামল রাত সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত জেগে ব‍ই পড়েছে। তারপর সে আলো নিবিয়ে শুয়ে পড়ে; কিন্তু তার ঘুম আসেনি। ঠিক বারোটার সময় সে বাইরের বারান্দায় কার পদশব্দ শুনতে পায়। একতলার কোনো বাসিন্দা বাথরুমে যাচ্ছে মনে করে সে আর খেয়াল করেনি। পরে অর্থাৎ মিনিটদশেক পরে তার মনে হল পদশব্দটা সিঁড়িতে হচ্ছে। এতে সে কৌতূহলী হয়ে পড়ে। কারণ, দোতলায় পৃথক বাথরুম আছে। সে প্রয়োজনে মধ্য রাত্রে কাউকে উপর থেকে নিচে নামতে অথবা নিচে থেকে উপরে উঠতে হয় না। তাই শ্যামল উঠে পড়ে। ঘরের আলো জ্বালে না; জানলা দিয়ে দেখতে চায়। চাদরে আপাদমস্তক ঢাকা দেওয়া একজনকে সে সিঁড়ির মুখে দেখতে পায়। লোকটা তখন উপর থেকে নেমে আসছে। লোকটা মাঝারি উচ্চতায়, তার মুখটা সে দেখেনি। শ্যামল সাহস করে দরজা খোলেনি। আবার শুয়ে পড়ার আগে ঘড়িটা দেখেছিল। রাত তখন সওয়া বারোটা।

অটোপ্সি-সার্জেনের মতেও মৃত্যুর সময় রাত সাড়ে এগারোটা থেকে সাড়ে বারোটা।

জগদানন্দের বিরুদ্ধে হত্যার মামলা দায়ের করা হয়েছে। অবশ্য ওঁর সামাজিক মর্যাদা এবং বয়সের কথা বিবেচনা করে তাঁকে জামিন দেওয়া হয়েছে।

বলা বাহুল্য আসামি, পক্ষের ডিফেন্স কাউন্সেল পি.কে.বাসু, বার-এ্যাট-ল।

বাসু-সাহেব তাঁর নিজস্ব পদ্ধতিতে অনুসন্ধান চালিয়েছেন যথারীতি। তাতে আবিষ্কৃত হয়েছে একটি নূতন ব্লু, যার সন্ধান তাঁকে দিয়েছে জয়দীপ। বাসু-সাহেব ঐ সূত্রটি যাচাই করে দেখে বুঝেছেন খবরটা মিথ্যা নয়।

জয়দীপ ঘটনার দিন সকাল সাতটা নাগাদ দমদমের হোটেল থেকে ফোন করেছিল। তখন এ বাড়িতে ইন্সপেক্‌টার তদন্ত করছেন। টেলিফোন ধরেছিল কৌশিক। জয়দীপ বলেছিল, একটা জরুরি খবর আছে, শুনুন—

কৌশিক বলেছিল, যত জরুরি খবরই হোক আপনি এখনই চলে আসুন। এখানে বিশ্রী ব্যাপার হয়ে গেছে, কাল রাত্রে।

—কাল রাত্রে! কী ব্যাপার?

—আপনি চলে আসুন—লাইন কেটে দিয়েছিল কৌশিক।

জয়দীপ বেলা নটা নাগাদ এসে পৌঁছায়। তখন পুলিশ চলে গেছে, কিন্তু বাসু-সাহেব এসেছেন। জয়দীপ বলে, আগের রাত্রে দমদম এলাকায় লোডশেডিং হয়েছিল। হোটেলে এয়ার কন্ডিশনার বা ফ্যান চলেনি। রাত ঠিক বারোটা চল্লিশ মিনিটে পাশের ঘরে টেলিফোন বেজে ওঠায় জয়দীপের ঘুম ভেঙে যায়। বার তিনেক টেলিফোনটা বাজার পরেই শোনা যায় য়ু সিয়াঙের ভারী কণ্ঠস্বর।

—হ্যালো!

ইতিমধ্যে জয়দীপ টর্চটা জেলেছে। ডায়েরিটা খুলে তৈরি হয়ে নিয়েছে। স্তব্ধ রাত্রি, গরমের জন্য জানলা খোলা। য়ু সিয়াঙের প্রত্যেকটি কথা সে স্পষ্ট শুনতে পেয়েছে ঠিক পাশের ঘর থেকে এবং তৎক্ষণাৎ লিখে ফেলেছে। আদ্যোপান্ত কথা সে বলেছে ইংরেজিতে। তার আক্ষরিক অনুবাদ নিম্নোক্তরূপ :

‘হ্যালো…হ্যাঁ কথা বলছি…কে?…আমি চিনি না আপনাকে, কী চান?…এমন মাঝে রাত্রে বিরক্ত করছেন কেন?…হ্যাঁ চিনি, মহেন্দ্রবাবুকে চিনি। আপনি তাঁর কে?…কী? জোরে বলুন!…ও বুঝেছি, সলিসিটার! বলুন…আমি আপনার কথা কিছু বুঝতে পারছি না। পথের কাঁটা দূর হয়েছে মানে কি?… টেলিফোনে যদি বলা না যায় তবে মাঝ রাতে বিরক্ত করছেন কেন?…আচ্ছা বেশ, আমি সকালে অপেক্ষা করব।…সকাল বারোটা পর্যন্ত। শুভরাত্রি।

বাসু তৎক্ষণাৎ উঠে পড়েছিলেন। এখানকার সব কাজ ফেলে রেখে সোজা এসে উপস্থিত হয়েছিলেন দমদমের হোটেলে। ওঁর কার্ড দেখে য়ু সিয়াঙ বললে, কাল মাঝ রাত্রে আপনিই ফোন করেছিলেন?

বাসু হ্যাঁ-না এড়িয়ে বললেন, মাঝ রাতে ঘুম থেকে উঠে টেলিফোন ধরতে হলে সকলেরই মেজাজ খারাপ হয়ে যায়।

য়ু সিয়াঙ বলেন, থাক, কী বলতে চান বলুন? মহেন্দ্রবাবুকে সঙ্গে করে আনলেন না কেন?

বাসু বললেন, মহেন্দ্রবাবুর আসা এখন সম্ভবপর নয়—কিন্তু কালকের সেই কথাটা মনে আছে নিশ্চয়। আপনাদের দুজনেরই পথের কাঁটা দূর হয়েছে।

—পথের কাঁটা। কী বলছেন আপনি। কে সে?

—যোগানন্দ সেন। যাকে জগদানন্দ তাঁর উইলে পঞ্চাশ হাজার টাকা দিতে চেয়েছিলেন। কাল রাত্রে তিনি খুন হয়েছেন!

‘খুন’ কথাটা শুনেই উঠে দাঁড়াল য়ু সিয়াঙ। বলল, খুন হয়েছেন! বলেন কী! কে খুন করেছে? বাসু হেসে বলেন, সেটা আর আমার মুখ দিয়ে নাই বা বলালেন।

য়ু সিয়াঙ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকল বাসু-সাহেবের দিকে। তারপর বললে লুক হিয়ার স্যার! ব্যাপারটা একটা মার্ডার কেস। আপনাকে আমি চিনি না। আপনি মহেন্দ্রবাবুর সলিসিটার কি না তাও আমি জানি না। আপনি কি প্রমাণ করতে পারেন যে, আপনি সত্যিই-

বাধা দিয়ে বাসু বলেন, আমার ভিজিটিং কার্ড আপনি দেখেছেন, আমার ড্রাইভিং লাইসেন্সটাও পরখ করে দেখতে পারেন।—পকেট থেকে বের করেন সেটা।

য়ু সিয়াঙ বলে, তাতে কী প্রমাণ হয়? প্রমাণ হয় যে, আপনি ব্যারিস্টার পি.কে. বাসু, বার-অ্যাট-ল কিন্তু আপনি যে মহেন্দ্রবাবুর শত্রুপক্ষের ব্যারিস্টার নন তা আমি বুঝব কী করে?

বাসু-সাহেব বাড়িয়ে ধরেন একখানি কাগজ। একটু আগে জয়দীপ যা লিখে দিয়েছে। বলেন, কাল রাত্রি বারোটা চল্লিশ মিনিটে আপনি টেলিফোনে এই কটা কথাই বলেননি কি? মিলিয়ে দেখে নিন।

য়ু সিয়াঙ অত্যন্ত সাবধানী। কাগজটা পড়ে বললে, হ্যাঁ বলেছি। কিন্তু তাতেও প্রমাণ হয় না যে, আপনি মহেন্দ্রবাবুর উকিল। এটুকু প্রমাণ হয় যে, গতকাল রাত্রে আপনিই আমাকে ফোন করেছিলেন। আপনি প্রমাণ দিন আপনি মহেন্দ্রবাবুর সলিসিটার।

বাসু-সাহেব নীরবে উঠে দাঁড়ান। বলেন, আমি একবারও বলিনি যে, আমি মহেন্দ্রবাবুর সলিসিটার। আচ্ছা নমস্কার।

—তার মানে?—হতচকিত য়ু সিয়াঙ অবাক হয়ে যায়।

কোর্টে মামলা ওঠার আগের দিন বাসু-সাহেব জনান্তিকে ডেকে পাঠালেন নীলিমা আর জয়দীপকে। বললেন, তোমরা দুজনে বসো। কথা আছে তোমাদের সঙ্গে।

জয়দীপ আর নীলিমা বসল পাশাপাশি।

—তোমরা জান যে, পুলিশের মতে যোগানন্দ একটা গোপন পারিবারিক রহস্য অবলম্বন করে ব্ল্যাকমেল করছিলেন জগদানন্দকে—

বাধা দিয়ে মেয়েটি বলে ওঠে, কিন্তু সেটা তো একেবারে মিথ্যা।

—যোগানন্দবাবুর ব্ল্যাকমেল করাটা মিথ্যা; কিন্তু পারিবারিক রহস্যটার অস্তিত্ব মিথ্যা নয়। বস্তুত সেই রহস্য নিয়ে মহেন্দ্র এবং য়ু সিয়াঙ ওঁকে ব্ল্যাকমেলিং করছিল। কেন, তোমরা জান না?

নীলিমা বললে জানি। কিন্তু রহস্যটা কী, তা জানি না। আপনি জেনেছেন?

—জেনেছি। সে কথা কোর্টে অনিবার্যভাবে উঠবে। তাই আগেভাগেই তা তোমাদের জানিয়ে রাখতে চাইছি।

—বলুন?—নীলিমা উৎকর্ণ।

বাসু একটু ইতস্ততঃ করে বললেন, বলছি; কিন্তু তার আগে মনটা প্রস্তুত করো নীলিমা। খবরটা তোমার পক্ষে শকিং! একটা প্রচণ্ড আঘাত তুমি পাবে—উপায় নেই—এ আঘাত সইবার মতো মনের জোর তোমার আছে—আমি বিশ্বাস করি।

মেয়েটি মাথা ঝাঁকিয়ে বলে, বলুন আপনি। আমি প্রস্তুত! দাদু কাউকে খুন করেছিলেন?

—না, খুন নয়। তাছাড়া অপরাধটা তিনি করেননি।

—তিনি করেননি? তবে তাঁকে ব্ল্যাকমেইলড করছে কী করে ওরা?

–ঐ যে বললাম। পারিবারিক কলঙ্ক! ধরো তোমার বাবার নামে, অথবা মায়ের নামে কোনো কথা। যেটা গোপন রাখতে চান জগদানন্দ।

ভ্রু-দুটি কুঁচকে ওঠে নীলিমার। বলে, প্লিজ, যা বলবার এক নিশ্বাসে বলে ফেলুন আপনি!

—তোমার বাবার সঙ্গে তোমার মায়ের যখন প্রথম সাক্ষাৎ হয় তার আগেই তুমি এসে আশ্রয় নিয়েছিলে তোমার মায়ের দেহে।

মেয়েটি একেবারে পাথর হয়ে যায়।

জয়দীপ চীৎকার করে ওঠে, আমি বিশ্বাস করি না! বাজে কথা।

নীলিমার চোখ দুটি জলে ভরে ওঠে। অস্ফুটস্বরে বলে, তবে কে আমার বাবা?

—আমি জানি না নীলিমা। আমরা কেউই জানি না! তোমার দাদুও নয়!

হঠাৎ উঠে পড়ে মেয়েটি। দ্রুত পায়ে ঢুকে যায় বাথরুমে। সশব্দে দরজাটা বন্ধ হয়ে যায়। জয়দীপ স্তব্ধ বিস্ময়ে উঠে দাঁড়ায়। বাসু বলেন, ইয়ং ম্যান! এজন্য যদি নীলিমার জীবন থেকে সরে দাঁড়াতে চাও তাহলে এই তোমার সুযোগ। নিশব্দে চলে যাও। এতবড় আঘাতটা যখন সয়েছে, তখন তোমার দেওয়া আঘাতটাও ও সইতে পারবে।

জয়দীপ বসে পড়ল চেয়ারে। দৃঢ়স্বরে বললে, মিস্টার বাসু, আপনাকে জানাবার সময় হয়েছে—আমরা বিবাহিত! নীলিমা আমার স্ত্রী।

এবার চমকে ওঠার পালা বাসু-সাহেবের। বলেন, মানে! কবে থেকে?

—দাদু যেদিন উইল করলেন তার পর দিন। ম্যারেজ রেজিস্ট্রার আমার পরিচিত বিনা নোটিসে রাতারাতি বিয়ে দিতে তিনি আপত্তি করেননি!

বাসু-সাহেব তাঁর হাতটা বাড়িয়ে জয়দীপের বলিষ্ঠ হাতখানা টেনে নেন। বলেন, মাই কনগ্র্যাচুলেসন্স!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *