পথের কাঁটা – ১১

১১

ঠিক কাঁটায় কাঁটায় দশটার সময় আদালত বসল।

অসমাপ্ত সাক্ষ্য দিতে উঠে দাঁড়াল জয়দীপ। কোর্ট-পেষ্কার মনে করিয়ে দিল—গতকাল হলপ নেওয়া আছে বলে আজ তাকে হলপ নিতে হচ্ছে না, কিন্তু সে আজ যা বলবে তা হলপ্ নিয়ে বলা জবানবন্দিই। সাক্ষী বলল, সে জানে!

বাসু প্রশ্ন করেন, কাল আপনি আপনার জবানবন্দিতে বলেছিলেন যে, সোমবার সকালে আপনি পার্ক হোটেল থেকে চেক আউট করে পেরিয়ে যান। ঠিক কটায় চেক-আউট করেন?

জয়দীপ বললে, ঠিক সময়টা আমার মনে নেই। সোমবার সকালের দিকে। সাতটা থেকে নটা।

—থ্যাঙ্কু! আচ্ছা জয়দীপবাবু এবার বলুন, আপনি কি বিবাহিত?

জয়দীপের মুখচোখ লাল হয়ে ওঠে। মাথা নিচু করে বলল, হ্যাঁ।

—আপনার স্ত্রীর নাম কী?

মাইতি আপত্তি করেননি। সাক্ষী নিজেই বলে ওঠে, সে প্রশ্ন অপ্রাসঙ্গিক!

—সেটা আদালত বুঝবেন, আপনার স্ত্রীর নাম কী?

জয়দীপ বিচারককে সরাসরি প্রশ্ন করে, আমি কি ও প্রশ্নের জবাব দিতে বাধ্য?

—অফ কোর্স! য় আর!

জয়দীপ মাথা নিচু করে বললে, নীলিমা সেন!

আদালতে একটা মৃদু গুঞ্জন উঠল। সকলের দৃষ্টি গেল আসামির দিকে।

—’নীলিমা সেন’ অর্থে আসামির নাতনি?

—হ্যাঁ, তাই

—কবে ও কিভাবে আপনাদের বিবাহ হয়েছে?

দাঁতে দাঁত চেপে জয়দীপ বললে, ঘটনার আগের শনিবার।

—ঘটনার আগে এবং ঐ শনিবারেরও আগে আপনার হবু স্ত্রী কি আপনাকে জানিয়েছিলেন যে, ইতিপূর্বেই জগদানন্দ একটি দানপত্র যোগে আপনার হবু স্ত্রীকে বসতবাড়িটি দিয়ে দিয়েছেন? ও বাড়ির মালিক আপনার হবু স্ত্রী। হ্যাঁ, না না?

সাক্ষী একটু ভেবে নিয়ে বলল, হ্যাঁ।

—অর্থাৎ ঘটনার দিন আপনি জানতেন যে, উইল মোতাবেক মহেন্দ্রবাবু কোনোদিনই ঐ বাড়ির দখল পাবে না। ইয়েস?

— ইয়েস!

—আপনি একথাও জানতেন যে, উইল মোতাবেক মহেন্দ্রবাবু ছাড়া অন্যান্য বেনিফিশিয়ারি তাদের ভাগ পাবে, অর্থাৎ যোগানন্দ পঞ্চাশ হাজার টাকা পাবেন?

—না জানার কী আছে?

—আপনি আরও জানতেন যে, উইলটা যদি খোয়া যায় তাহলে আপনার স্ত্রী স্বাভাবিক ওয়ারিশ হিসাবে ঐ পঞ্চাশ হাজার টাকা পাবেন?

মাইতি আপত্তি জানান—এ সব প্রশ্ন নাকি অপ্রাসঙ্গিক। বিচারক সেটা মেনে নিতে রাজি হলেন না। ফলে সাক্ষীকে স্বীকার করতে হল, সে সেটা জানত!

—এবার বলুন জয়দীপবাবু, সোমবার আপনি যখন বিকাল পাঁচটায় ঐ বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের বাড়ি ছেড়ে চলে যান তখনও আপনি জানতেন না যে, কৌশিকবাবু সে রাত্রে ওখানে থাকবেন—যেহেতু জগদানন্দবাবু আপনার প্রস্থানের পরে কৌশিকবাবুকে ঐ প্রস্তাব দেন? ইয়েস?

—হ্যাঁ, তাই।

—তার মানে দাঁড়াচ্ছে—সোমবার বিকালে ঐ বাড়ি ছেড়ে চলে আসার সময় আপনার জানা ছিল না যে, কৌশিকের রাত্রিবাসের প্রয়োজনে মহেন্দ্রবাবু এবং যোগানন্দ ঘর বদলাবে?

সাক্ষী চটে উঠে বলে, আপনি কী বলতে চান? আমি খুন করেছি?

বাসু শান্তভাবে বলেন, আমি বলতে চাই না মিস্টার রায়, আমি শুনতে চাই। আমার প্রশ্নের জবাব শুনতে চাই। বলুন, বলুন?

—না আমি জানতাম না, সে রাত্রে কে কোথায় শুচ্ছেন!

উঁহু হুঁ! ওটা তো আমার প্রশ্নের জবাব নয়! আপনি ‘জানতেন না’ নয়, আপনি ‘জানতেন’ যে, যে-খাটে যোগানন্দ নিহত হয়েছেন ঐ খাটে মহেন্দ্রবাবুর শয়ন করার কথা! সোজা হিসাবটা স্বীকার করছেন না কেন?

—বেশ তাই না হয় হল। তাই জানতাম আমি।

—এবং জানতেন যে, মহেন্দ্রবাবুর বালিশের নিচে রাখা আছে ঐ উইলটা, যেটা খোয়া গেলে আপনার হবু-স্ত্রী, আই বেগ য়োর পার্ডন,…ততক্ষণে তিনি আপনার স্ত্রী—ওটা সোমবারের ঘটনা, হ্যাঁ, আপনার স্ত্রী পঞ্চাশ হাজার টাকা পাবেন। স্বামী হিসাবে যাতে আপনারও অধিকার বর্তাবে!

মাইতি উঠে দাঁড়াল, অবজেকশান য়োর অনার। এ সব কী অবান্তর প্রশ্ন! বিচার হচ্ছে কার? আসামির না সাক্ষীর?

বিচারক দৃঢ়স্বরে বলেন, অবজেকশান ওভাররুলড। আনসার দ্যাট।

—না আমি জানতাম না—উইলটা কোথায় রাখা আছে। আমার তা জানার কথা নয়।

—জয়দীপবাবু এবার স্বীকার করুন, সেদিন রাত প্রায় বারোটার সময় আপনি ঐ বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের বাড়িতে ফিরে আসেন এবং ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে-

চিৎকার করে ওঠে সাক্ষী, ডুপ্লিকেট চাবি আমি পাব কোথায়?

—পাবেন আপনার স্ত্রীর শয়নকক্ষের ড্রয়ারে। যে-ঘরে একমাত্র আপনারই প্রবেশ-অধিকার ছিল—বাট প্লিজ ডোন্ট ইন্টারাপ্ট—স্বীকার করুন, রাত বারোটায় ঐ বাড়িতে ফিরে আসেন। ইয়েস অর নো?

—নো। অ্যান এস্ফাটিক নো। রাত বারোটায় আমি ওখান থেকে অনেক অনেক দূরে। পনের মাইল! দমদমের ভি. আই. পি. হোটেলের বাইশ নম্বর ঘরে। রাত বারোটা চল্লিশ মিনিটে যেখানে মিস্টার য়ু-সিয়াঙ টেলিফোন ধরেছিলেন তার ঠিক পাশের ঘরে!

—দ্যাটস্ য়োর অ্যালেবাই! আপনার বজ্রবাঁধুনি রক্ষাকবচ! ঘটনার মুহূর্তে আপনি ছিলেন দমদমে। তাই নয়?

সাক্ষী জবাব দেয় না। জ্বলন্ত দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে থাকে প্রশ্নকর্তার দিকে

বাসু-সাহেব বিচারকের দিকে ফিরে বললেন, মি লর্ড! ঘটনার পারম্পর্য রাখতে বর্তমান সাক্ষীকে সাময়িকভাবে অপসারণ করে আমি অপর একটি সাক্ষীর সাক্ষ্য নিতে চাই।

মাইতির তাতে আপত্তি নেই। বিচারক বললেন, নো অবজেকশান।

নবীন সাক্ষীর নাম ঘোষণা করল নকীব। সাক্ষ্য দিতে এলেন, এডনা পার্কার। অ্যাংলো ইন্ডিয়ান। পার্ক হোটেলের রিসেপশান কাউন্টারে কাজ করেন। বাসু-সাহেব তাঁর নাম ধাম পরিচয় প্রতিষ্ঠা করে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি কি গত মাসের পার্ক হোটেলের রেজিস্টারটা সঙ্গে করে এনেছেন?

—এনেছি।

—ওটা দেখে আপনি আদালতকে জানাবেন কি যে, গত অমুক তারিখ, রবিবার ঠিক ক’টার সময় জয়দীপ রায় স্বনামে আপনাদের হোটেলের চল্লিশ নম্বর ঘরটা বুক করেন?

সাক্ষী রেজিস্টার দেখে বললেন, সন্ধ্যা সাতটায়।

—কবে ক’টার সময় তিনি ঐ ঘরটি ছেড়ে দেন?

—মঙ্গলবার সকাল সাতটায়।

—জাস্ট এ মিনিট! ঠিক করে দেখে বলুন, সোমবার সকাল সাতটা নয় তো?

—না! ‘মঙ্গলবার’ সকাল সাতটায়।

—ঐ তারিখ এবং সময়টা কি লালকালি দিয়ে গোল্লা দেওয়া আছে? এবং তার পাশে কি একটি সই দেওয়া আছে? থাকলে কার সই?

—গোল্লা দেওয়া আছে, সই দেওয়াও আছে। সইটা আমাদের ম্যানেজারের।

–কেন তিনি ওটা সই দিয়েছেন তা আপনি জানেন কি?

—জানি। ম্যানেজার সাহেব আমাকে জানিয়েছেন যে, আপনি তাঁকে ঐ রকম অনুরোধ করেছিলেন। হোটেল-রেজিস্টার যাতে ট্যাম্পার না হয় তাই তিনি সাবধান হয়েছিলেন। আমাকে তিনি ঐ রেজিস্টারটা সেফ-কাস্টডিতে রেখে একটি নতুন রেজিস্টার খুলতে বলেন। তিনি আরও বলেন, এ বিষয়ে আমাকে সমন করা হবে—ঐ তারিখ এবং সময় কোনো একটি খুনের মামলার গুরুত্বপূর্ণ এভিডেন্স!

–এবার আপনি ঐ গুরুত্বপূর্ণ এভিডেন্সটি আদালতে দাখিল করুন।

এডনা পার্কার সেটা জমা দেবার পর বাসু তাকে পুনরায় প্রশ্ন করেন, বোর্ডারদের টেলিফোন কলের বিল তৈরি করবার জন্য যে রেজিস্টার রাখা হয় আপনি কি সেটাও এনেছেন?

—এনেছি।

—ওটা দেখে বলুন তো সোমবার, না ইংরেজি মতে মঙ্গলবার রাত বারোটা চল্লিশ মিনিটে ঐ চল্লিশ নম্বর ঘর থেকে দমদম ভি. আই. পি. হোটেলে কি একটা টেলিফোন করা হয়েছিল?

সাক্ষী কী জবাব দিলেন তা শোনা গেল না। ঠিক তার পূর্ব মুহূর্তেই কোর্টের প্রবেশ-পথে কী একটা হাঙ্গামা বেধে গেল।’ ঐ দিকে একটা হৈ-চৈ ছুটোছুটি শুরু হয়ে গেল। বিচারক বারম্বার হাতুড়ির শব্দ করলেন, তবু গন্ডগোল থামল না। একজন কোর্ট-পেয়াদা ছুটে এসে বিচারকের কানে কানে কী একটা কথা নিবেদন করল। তৎক্ষণাৎ দাঁড়িয়ে ওঠেন জাস্টিস ভাদুড়ী; বললেন, কোর্ট অ্যাডজনড ফর হাফ অ্যান আওয়ার!

এতক্ষণে ব্যাপারটা জানা গেল। আদালত থেকে কে একজন সাক্ষী ছুটে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করছিল। পুলিশ প্রস্তুতই ছিল। আদালতের এক্তিয়ারভুক্ত এলাকা পার হতেই লোকটাকে পুলিশ-ইন্সপেক্‌টার মণীশ বর্মণ জাপটে ধরে। কিছুটা ধস্তাধস্তি। পরে লোকটা গ্রেপ্তার হয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *