পথের কাঁটা – ২

দিনতিনেক পরে কৌশিক এসে বাসু-সাহেবকে বলল, বরাতে নেই কো ঘি, ঠক্‌ঠকালে হবে কী? আপনি এমন একটি শাঁসালো মক্কেল পাঠালেন আমার কাছে, অথচ সেটা বুমেরাঙের মতো আবার আপনার হাতেই ফিরে এল।

—কী হল আবার? কোন্ কেসটা?

—ঐ যে লোহার দালাল জগদানন্দের ব্ল্যাকমেলের কেসটা। নীলিমা দেবী দিন তিনেক আগে আমাকে এনগেজ করলেন। সবে জাঁকিয়ে তদন্ত শুরু করেছি, আজ এসে বলছেন ওটা স্থগিত রাখতে।

—কেন? সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে?

—তাই অনুমান করা যাচ্ছে। এবার ওঁরা এসেছেন আপনার সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করতে। জগদানন্দ একটি দলিল তৈরি করতে চান আপনার পরামর্শ মতো। আন্দাজ করছি— ব্ল্যাকমেলারের সঙ্গে টাকায় খেসারত দিয়ে ব্যাপারটা মিটিয়ে নিতে চান।

—এবারও কী ওরা যুগলে এসেছে? কোথায়?

—আমার অফিসে বসিয়ে রেখে এসেছি, দু’জনকেই।

—ঠিক আছে, পাঠিয়ে দাও—না, সঙ্গে করে নিয়ে এস।

একটু পরে কৌশিক ওদের দু-জনকে নিয়ে ঢুকল। জয়দীপ নমস্কার করে বলল, আপনার লাইব্রেরি ঘরটা খোলা আছে নিশ্চয়ই?

বাসু-সাহেব বললেন, এবার আর তার দরকার হবে না। সেবার কেসটা জানতাম না। তাই আমার ক্লায়েন্টের স্বার্থে আপনাকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলাম; কিন্তু আমার ক্লায়েন্ট তাতে ক্ষুণ্ণ হয়ে জানিয়েছেন যে, আপনি তাঁর কাছের মানুষ! বসুন আপনিও।

নীলিমা চেয়ারে গুছিয়ে নিয়ে বসে। বলে, আজ কিন্তু আমি আপনার ক্লায়েন্ট নই। আমি ক্লায়েন্টের তরফে কথা বলতে এসেছি। আমি দূতমাত্র। ফলে আজ নিশ্চয়ই আপনার বাক্যবাণে বিদ্ধ হব না। দূত মাত্রেই অবধ্য। বাসু হেসে বলেন, হ্যাঁ দূত মাত্রেই অবধ্য।

সেদিন অত করে অনুরোধ করলাম, তবু আজও রাগ পুষে বসে আছ। যাই হোক বল, কী খবর?

—আপনার নিমন্ত্রণ! আজ সন্ধ্যা সাতটা পাঁচের পর থেকে সাতটা পঁয়তাল্লিশ, কিম্বা আগামিকাল বেলা এগারোটা সতের গতে—

—এ হপ্তায় এ-দুটিই বিবাহের লগ্ন আছে বুঝি?

—বিবাহ! কার?

—তবে এগারোটা সতের গতে কিসের নিমন্ত্রণ?

বুঝিয়ে বলে নীলিমা। জগদানন্দ পঞ্জিকা মেনে চলেন। ঐ দুটি সময় হচ্ছে তাঁর ঠিকুজি-কুষ্ঠি অনুসারে শুভ লগ্ন। ঐ সময়েই তিনি একটি জরুরি দলিলে সই দিতে চান। তার পূর্বে পি.কে.বাসু বার অ্যাট ল. যদি অনুগ্রহ করে দলিলটা দেখে নেন, তবে জগদানন্দ কৃতকৃতার্থ থাকবেন। শুধু দলিলের যথার্থ নয়, উকিল হিসাবে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্যই নয়—ঐ সঙ্গে তিনি কিছু আইনঘটিত পরামর্শও নিতে চান। জগদানন্দ উনআশি বছরের বৃদ্ধ হলেও এখনও কিছু চলচ্ছক্তিহীন নন—তিনি নিজে আসতে পারেন। তবে বাসু-সাহেব তাঁর বাড়িতে গেলেই উনি খুশি হবেন।

সব শুনে বাসু-সাহেব বলেন, দলিলটা কিসের তা আন্দাজ করতে পারছ?

—না। তবে বাড়িতে আরও একজন অতিথি বেড়েছেন। উকিল বিশ্বম্ভর রায়। তিনি মহেন্দ্রবাবুরই অতিথি। ফলে আমাদেরও।

—এত উকিল থাকতে হঠাৎ আমাকে কেন? তোমরা ‘সাজেস্ট’ করেছিলে?

—না। দাদুর সলিসিটার ছিলেন ব্যারিস্টার এ.কে. রে-র অ্যাটর্নি ফার্ম। রে-সাহেব অবসর নিয়েছেন। উনিই নাকি আপনার নাম দাদুকে বলেছেন

—ঠিক আছে। আমি আজই সন্ধ্যার পর যাব। কৌশিকও থাকবে আমার সঙ্গে। তোমাদের ঠিকানা এবং টেলিফোন নাম্বারটা দিয়ে যাও।

—তা দিচ্ছি। আপনারা কিন্তু ঘুণাক্ষরেও তাঁকে জানাবেন না যে, আমরা ইতিপূর্বে আপনাদের দ্বারস্থ হয়েছিলাম। আজই আপনাদের সঙ্গে আমাদের দু-জনের পরিচয় পূর্বকথা আপনি কিছুই জানেন না।

—বুঝলাম। আচ্ছা তোমার দাদু বোধহয় হাঁচি-টিক্‌টিকি পাঁজিপুঁথি মেনে চলেন?

—তা চলেন। এজন্য মাহিনা-করা একজন গ্রহাচার্যও আছেন তাঁর। আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপ আমাদের জন্মপত্রিকায় বাঁধা!

.

—সন্ধ্যার পর বাসু-সাহেব নিজেই ড্রাইভ করে কৌশিককে নিয়ে এলেন। বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে প্রকাণ্ড হাতাওয়ালা দ্বিতল বাড়ি। সাবেক ডিজাইন। দু-খানি ঘর বর্তমানে দখল করেছেন মহেন্দ্র-কাম-বিশ্বম্ভর পার্টি। দ্বিতলে দক্ষিণের বড় ঘরখানা কর্তামশায়ের। ঠিক তার বিপরীতে নীলিমার ঘর।

গাড়িটা পোর্চে এসে দাঁড়াতেই নেমে এল নীলিমা। বললে, আসুন। দাদু আপনাদের জন্য অপেক্ষা করছেন। গাড়ি থেকে নামতেই কৌশিকের নজর হল দ্বিতলের একটা ঘরের বন্ধ-জানলার খড়খড়ি হঠাৎ উঁচু হয়ে উঠল। না দেখলেও তার ওপাশে দু-জোড়া কৌতূহলী চোখ যে তীব্র আগ্রহ নিয়ে ওদের লক্ষ্য করছে সেটা বুঝতে অসুবিধে হল না কৌশিকের। মার্বেল পাথরে বাঁধানো চওড়া করিডর, প্রশস্ত সিঁড়ি। জানলা-দরজা, সিঁড়ির হাতল সবই পালিশ করা বর্মা সেগুনের। তা তো হবেই। বাড়িটি যে-আমলের তখন বুড়ো কর্তা ছিলেন বর্মা-টিকের রাজা।

জগদানন্দের দ্বিতলের ঘরটি প্রকাণ্ড। ইটালিয়ান-মার্বেলের সাদা-কালো চৌখুপিকাটা মেজে। ঘরের আসবাবপত্র মধ্য-ভিক্টোরীয় যুগের। সবই পালিশ-করা বর্মা সেগুন। ঘরের একদিকে ডবল বেড খাট। এ পাশে শ্বেতপাথরের নিচু টেবিল ঘিরে সোফা-সেট। ও পাশে আয়না-বসানো কাঠের আলমারি, বইয়ের র‍্যাক। এত আসবাবেও ঘরটা ফাঁকা-ফাঁকা লাগছে—মাপে সেটা এতই বড়।

পর্দা সরিয়ে ওঁরা প্রবেশ করতেই যুক্তকরে ওঁদের অভ্যর্থনা করলেন গৃহস্বামী। দেখলে মনে হয় না তাঁর বয়স উনআশি। বরং ষাটের ঘরে বলে মনে হয়। মাথার চুল ধপধপে সাদা, গালে খাঁজও পড়েছে—কিন্তু একেবারে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছেন। ঘরের ভিতর চলাফেরা করছেন। বিনা লাঠিতে। ঊর্ধ্বাঙ্গে একটি সামারকুল গেঞ্জি, পরনে কোঁচানো ধুতি। বাঁ-হাতে একাধিক কবচ ও মাদুলি। দু-হাতে সর্বসমেত গোটা-পাঁচেক আংটি। প্রবাল, পোখরাজ, নীলা—একটা বোধহয় হীরাও। অলঙ্করণের গূঢ় উদ্দেশ্য অবশ্য গ্রহশান্তির প্রয়োজনে।

আপ্যায়ন করে গৃহস্বামী ওঁদের বসালেন। তাঁর নির্দেশে নীলিমা একটি শৌখিন কাজ-করা কাঠের বাক্স এনে রাখল শ্বেতপাথরের টেবিলে। ডালাটা খুলে দেওয়ায় দেখা গেল তার ভিতর আছে চুরুট, সিগারেট, দেশলাই এবং ভাজা-মশলা—বিভিন্ন খোপে।

বাসু-সাহেব বললেন, ধন্যবাদ। আমি পাইপ খাই।

গৃহস্বামী বললেন, আপনার নাম আমার জানা ছিল। কাগজে কয়েকটি বিচিত্র ফৌজদারি মামলায় আপনার নাম দেখেছি! পরিচয় ছিল না। আমার আইনঘটিত পরামর্শ এককালে দিতেন ব্যারিস্টার এ.কে.রে। গত বিশ বছরের ভিতর আর আইন-ঘটিত কোনো পরামর্শ নেবার প্রয়োজনই হয়নি। রে-সাহেব আমার চেয়ে বছর দুয়েকের বড়ই হবেন। কিন্তু বুড়িয়েছেন আমার চেয়ে অনেক বেশি। তিনিই আপনার নাম করলেন, কিন্তু এঁকে তো—

—ও আমার সহকারী। নাম কৌশিক মিত্র। আমার কনফিডেন্সিয়াল কাজকর্ম ওই

দেখাশোনা করে। আমার সামনে যা বলতে পারেন, তা ওর সামনেও বলতে পারবেন।

—না না, গোপন ব্যাপার তেমন কিছু নয়। একটা সাদামাটা দলিল। আচ্ছা নীলুদিদি—তুমি একটু জলখাবারের আয়োজন করো—আমি ততক্ষণ এঁকে বৈষয়িক ব্যাপারটা বোঝাই।

বাসু-সাহেব আপত্তি জানান, না না, জলখাবারের প্রয়োজন নেই-

গৃহস্বামী যুক্তকরে বলেন, প্রয়োজনটা আপনার নয়, আমার। অতিথি যদি মুখে কুটোটি না কাটেন গ্রহ কুপিত হন। গৃহস্থের অকল্যাণ হয়!

বাসু-সাহেব শ্রাগ করলেন। নীলিমা চলে গেল।

জগদানন্দ একটি চেয়ারে ঘনিয়ে এসে বসলেন। বললেন, ব্যাপারটা সামান্য। অনেক অনেকদিন আগে আমি আমার একজন ম্যানেজারকে কর্মচ্যুত করেছিলাম। তা, ধরুন পঁচিশ বছর আগে। চাকরি থেকে বরখাস্ত করার কারণটা হচ্ছে এই যে, আমি মনে করেছিলাম তিনি তহবিল তছরুপ করেছেন। তাঁকে আমার জেনারেল পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি দেওয়া ছিল। আমার অজ্ঞাতে তিনি কিছু সম্পত্তি বেচে দেন এবং টাকাটা আমার অ্যাকাউন্টে ঠিক মতো জমা দেন না। সেটা যখন আমি টের পেলাম তখন তাঁকে ডেকে তাঁর কৈফিয়ত তলব করলাম। উনি সন্তোষজনক কৈফিয়ত পেশ করতে পারেননি। ফলে, তাঁকে বরখাস্ত করি। আজ পঁচিশ বছর পরে তিনি ফিরে এসে প্রমাণ দাখিল করছেন যে, তিনি আদৌ কোনও তহবিল তছরুপ করেননি। তাঁর কৈফিয়ত এখন আমি মিলিয়ে দেখেছি—বুঝেছি আমারই অন্যায় হয়েছিল। এজন্য ক্ষতিপূরণ হিসাবে তিনি পঞ্চাশ হাজার টাকা দাবি করেছেন। আমি সেটা তাঁকে দিতে রাজি হয়েছি। এই ক্ষতিপূরণটা একটা লেখাপড়ার মাধ্যমে আমি করতে চাই—যাতে ঐ দাবি নিয়ে ম্যানেজার ভদ্রলোক আবার না পরে একদিন এসে হাজির হন। আপনাকে তার একটা ড্রাফট করে দিতে হবে। নিজে উপস্থিত থেকে এবং মধ্যস্থ হয়ে এই ব্যাপারটা চুকিয়ে দিতে হবে।

—বুঝলাম। এবার একটু বিস্তারিত করে বলুন।

জগদানন্দ যেটুকু বিস্তার করলেন তাতে প্রকাশ পেল—দাবিদারের নাম, বোঝা গেল তিনি এ বাড়িতেই বর্তমানে আছেন। একা নন, স-উকিল। এর বেশি কিছু ভাঙলেন না তিনি।

বাসু বলেন, পঞ্চাশ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ খুব বেশি হয়ে যাচ্ছে না?

—না, যাচ্ছে না। উনি যখন বরখাস্ত হন তখন ওঁর মাসিক বেতন ছিল চারশ’ টাকা। বয়স ছিল চৌত্রিশ। উনি যদি ঐ বেতনেই পঞ্চাশ বছর পর্যন্ত আমার কাছে চাকরি করতেন তবে তাঁর পাওনা হত সওয়া একলাখ টাকা। অ্যানুইটির হিসাব করলে আজ পঁচিশ বছরে তাঁর হয়তো লাখ দুই টাকা দাঁড়াবে।

বাসু বলেন, তা হতে পারে। কিন্তু তিনি তো কাজ করেননি আপনার ম্যানেজার হিসাবে। আপনার ঐ ফর্মুলা অনুসারে হিসাব করলে দেখতে হবে চারশ’ টাকার মাইনের চাকরি হারিয়ে বাস্তবে উনি কত রোজগার করেছিলেন। ধরুন যদি তিনি তখনই একটা তিনশ টাকা মাইনের চাকরি ধরেন, তাহলে তাঁর মাসিক লোকসান হয়েছে একশ’। আপনার হিসাবমত তাঁর ক্ষতির নোট পরিমাণ প্রায় ত্রিশ হাজার টাকায় নেমে আসে।

জগদানন্দ একটি চুরুট ধরিয়ে বললেন, টাকাটা যখন আমি দিতে রাজি তখন আর আপনার আপত্তি কিসের?

—আপত্তি এইজন্য যে, আমার মনে হচ্ছে আপনি সব কথা বলছেন না—বেশ কিছু গোপন করছেন।

একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে জগদানন্দ বলেন, ধরা যাক, আপনার কথাই সত্য। তাতেই বা আপনার আপত্তি কী? আপনি তো ক্ষতিপূরণের একটা দলিলের মুসাবিদা করে দেবেন শুধু।

বাসু-সাহেব বললেন, সে-ক্ষেত্রে আপনি রাম-শ্যাম-যদুকেই বা ডেকে পাঠালেন না কেন? এমন মামুলি দলিল তো যে-কোনো উকিল তৈরি করে দিতে পারে আপনাকে। তার জন্য ব্যারিস্টার এ.কে. রে-র শাগরেদকে এগিয়ে আসতে হবে কেন?

জগদানন্দ চোখ বুজে মিনিটখানেক কী-যেন ভেবে নেন। তারপর বলেন, ডাক্তারের কাছে রোগ আর সলিসিটারের কাছে আইনের ফাঁক গোপন করতে নেই। কিন্তু ব্যতিক্রম আছে বলেই না নিয়মটাকে নিয়ম বলে মানি? এখানে আমাকে কিছু গোপন করে যেতে হচ্ছে—আমি স্বীকার করছি—কিন্তু কী গোপন করছি তা আমি স্বীকার করতে পারি না। না, আপনার কাছেও নয়।

বাসু পাইপটা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে বলেন, অর্থাৎ প্রকারান্তরে আপনি স্বীকার করলেন ঐ মহেন্দ্র এসেছে আপনাকে ব্ল্যাকমেল করতে—এবং আপনি তার হাত থেকে রেহাই পেতে চান?

–ধরুন তাই।

—এ ক্ষেত্রে আপনি স্বতঃই চাইবেন ক্ষতিপূরণের দলিলটা এমনভাবে প্রস্তুত হোক যাতে ঐ লোকটা টাকা পাওয়ার পরেও যেন আপনাকে এসে শোষণ করতে না পারে। কেমন তো?

স্বাভাবিক অনুসিদ্ধান্ত।

—সে-ক্ষেত্রে আপনার গোপন তথ্যটা কী, তা না জানলে আমি কেমন করে আপনাকে রক্ষা করব?

—মাপ করবেন—সেটা আমি বলব না, বলতে পারি না।

—ধরুন আপনি যৌবনে একটা খুন করেছিলেন—আজ পঁচিশ বছর পরে মহেন্দ্র এসেছে সেই খুনের একটা অকাট্য প্রমাণ নিয়ে। আপনি ক্ষতিপূরণ দিয়ে তো মার্ডার-চার্জ থেকে অব্যাহতি পেতে পারেন না।

জগদানন্দ হেসে বলেন, আপনার উদাহরণটা ভুল। যৌবনে আমি কোনো খুন করিনি—তার অকাট্য প্রমাণটাও নিয়ে নেব—মানে যদি আপনার উদাহরণটাই সত্য হয়।

—কারেক্ট! কিন্তু তার একটা ফটোস্ট্যট কপি ওর কাছে থেকে যেতে পারে।

ভ্রুকুঞ্চিত হয় জগদানন্দের। অনেকক্ষণ নীরবে ধূমপান করেন তিনি। তারপর মনস্থির করে বলেন, না। সে রিস্ক আমিই নেব। আপনাকে বলা যাবে না।

—এ-ক্ষেত্রে আমি আপনার কেসটা নিতে পারি না।

জগদানন্দ বিচিত্র হাসি হেসে বললেন, তাহলে এ আলোচনার এখানেই শেষ। আমি অন্য কোনো উকিলের সন্ধানই করব। আপনার ভিজিটটা এনে দিই। আর আমার যুক্তকর নিবেদন—জলখাবারটা আপনাদের খেয়ে যেতে হবে।

জগদানন্দ উঠে গেলেন। আলমারি খুলে একটি চেকবই বার করে আনলেন। বাসু বলেন, দাঁড়ান। আপনাকে কয়েকটা প্রশ্ন করি আগে। জবাব না দিতে চান দেবেন না, কিন্তু জবাবে যেটুকু বলবেন তা সত্য করেই বলবেন।

কৌতুক উপচে পড়ল জগদানন্দের দু-চোখে। বলল, সওয়াল-জবাবের মাধ্যমে রহস্য উদঘাটন! বেশ! করে দেখুন; কিন্তু সেটা পণ্ডশ্রম হবে মিস্টার বাসু! আমি ঘাঘু ব্যবসায়ী। এই করে চুল পাকিয়েছি। ও-ভাবে আমার পেটের কথা আপনি বার করতে পারবেন না।

বাসু-সাহেব সে কথায় কর্ণপাত না করে বললেন, আপনি বর্মা থেকে শেষ কবে ফিরে এসেছিলেন?

—ওরে বাবা! সে তো বহু-বহুদিন আগে। উনিশ’শ পঁচিশে। সদু—মানে নীলুর বাবা তখন দু-বছরের। তারপর আমি আর বর্মায় যাইনি।

—সদানন্দবাবুই বড় হয়ে বর্মার কাজ দেখাশোনা করতে যেতেন?

—না। বর্মার কাজ দেখাশোনা করতেন আমার সেখানকার ম্যানেজার য়ু সিয়াঙ। সদানন্দ একবারই মাত্র বর্মায় যায়, মানে তার সেই ছেলেবেলার কথা বাদ দিলে। ওর জন্ম ওখানেই।

—একবারই যান, মানে ঐ বিজসেন গুটিয়ে নিতে—সবকিছু বেচে দিয়ে আসতে?

—হ্যাঁ। জাপান বিশ্বযুদ্ধে নেমে পড়ার আগেই আমার আশঙ্কা হয় এমন একটা কিছু ঘটতে পারে। ঐ সময়ে লোহার ব্যবসায়ে আমার টাকারও প্রয়োজন ছিল প্রচুর। তাই সদুকে স্পেশাল পাওয়ার-অফ্ অ্যাটর্নি দিয়ে বর্মায় পাঠিয়ে দিই, মাসখানেক সে ওখানে ছিল। সব কিছু বিক্রি করে ব্যাঙ্ক ড্রাফট নিয়ে সে ফিরে আসে।

—কত টাকায় বর্মার সম্পত্তি বিক্রি হয়?

—ঘর-বাড়ি, স্টক এবং গুড-উইল সমেত প্রায় সত্তর হাজার টাকায়।

—ব্যাঙ্ক-ড্রাফটের নাম্বারটা আমায় দিতে পারেন?

—কী হবে সে নম্বর দিয়ে?

বাসু মাথা ঝাঁকিয়ে বলেন, এমন শর্ত তো ছিল না সেন-মশাই। আপনার কোনো প্রতিপ্রশ্ন করার অধিকার নেই। হয় সত্য জবাব দেবেন, অথবা জবাব দিতে অস্বীকার করবেন।

জগদানন্দ হাসলেন। বললেন, ঠিক কথা। ব্যাঙ্ক-ড্রাফট-এর নম্বরটা আপনাকে দিতে পারি। এখনই চান?

—ইয়েস।

জগদানন্দ তাঁর কাঠের আলমারিটা খুললেন। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই পুরাতন ইনকাম-ট্যাক্স ফাইল হাতড়ে নম্বরটা দাখিল করলেন। ব্যাঙ্ক অফ বর্মা ড্রাফ্‌ট্ দিচ্ছেন কলকাতার লয়েডস্ ব্যাঙ্কের উপর। টাকার অঙ্ক একাত্তর হাজার পাঁচশ বত্রিশ টাকা তিন আনা। তারিখ আঠারোই মে, 1940। বাসু-সাহেব নোটবুকে টুকে নিলেন। তারপর বললেন, ঠিক আছে। আমি আপনার কাজটা করবার দায়িত্ব নিচ্ছি। ড্রাফট আমি করে দেব। এবার বরং মহেন্দ্রবাবু এবং বিশ্বম্ভরবাবুকে ডেকে পাঠান।

জগদানন্দ বললেন, গোপন তথ্যটা না জেনেই রাজি হলেন?

—ওটা তো কালকেই জানতে পারব। ব্যাঙ্ক খুললেই।

হো হো করে হেসে উঠলেন জগদানন্দ। বললেন, আপনার আশা যে, মহেন্দ্ৰ আমাকে কী সূত্রে ব্ল্যাকমেল করছে তা আপনাকে জানিয়ে দেবে লয়েডস্ ব্যাঙ্ক

বাসু কঠিন স্বরে বললেন, আগামিকাল এই সময় এসে সেটা অন্তত আমি আপনাকে জানিয়ে যাব। এবার ডাকুন ওঁদের।

জগদানন্দ স্থির হয়ে কয়েক মুহূর্ত একদৃষ্টে দেখতে থাকেন বাসু-সাহেবকে। তারপর মাথা নেড়ে বললেন, অসম্ভব বাসু-সাহেব। আই অ্যাকসেপ্ট য়োর চ্যালেঞ্জ। পঁচিশ বছর সময় লেগেছে মহেন্দ্রর—তাও সে আমার নাড়ি-নক্ষত্ৰ জানত। আপনার পক্ষে এটা অসম্ভব!

বাসু-সাহেব ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন, আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। অল্প পরেই এলেন মহেন্দ্র আর বিশ্বম্ভরবাবু

মহেন্দ্রবাবুর বয়স ষাটের কাছাকাছি। এক মাথা কাঁচা-পাকা কদম-ছাঁট চুল। ঝোলা গোঁফ, আর ঘন ভ্রু। চোখে সন্ধানী দৃষ্টি। দেখলেই বোঝা যায় লোকটা ধূর্ত এবং সাবধানী। অপর পক্ষে বিশ্বম্ভরের বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। রীতিমত হৃষ্টপুষ্ট—মোটাই বলা চলে। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। কাপড়-জামায় দেহের যেটুকু ঢাকা পড়েনি সেখানে মেদের বাহুল্য নজরে পড়ে। জগদানন্দ ওঁদের পরিচয় করিয়ে দিলেন। মহেন্দ্র হাত তুলে নমস্কার করল। বিশ্বম্ভর একটা কাগজে নিবদ্ধ দৃষ্টি থাকার অজুহাতে নমস্কার করার হাত এড়ালো। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই ওঁরা আলোচনায় ডুবে গেলেন।

কিন্তু বেশিদূর অগ্রসর হওয়া গেল না। মতদ্বৈধ দেখা দিল। বিশ্বম্ভর একটি ড্রাফট্ করে এনেছিলেন—সেটাই হল আলোচনার মূল সূত্র। বাসু-সাহেব বললেন, না, ঐ সঙ্গে মহেন্দ্রবাবুকে বলতে হবে তিনি জগদানন্দের ওয়ারিশদেরও ভবিষ্যতে ঐ দাবি নিয়ে বিব্রত করতে পারবেন না।

বিশ্বম্ভর বললেন, মামলা হচ্ছে এমপ্লয়ার আর এমপ্লয়ির মধ্যে—এর ভিতর ওয়ারিশদের প্রসঙ্গ আসবে কী করে?

—সেটা আমাদের বিবেচ্য। ওঁকে দ্বিতীয়ত লিখে দিতে হবে—কোনো অজুহাতেই তিনি জগদানন্দ অথবা তাঁর ওয়ারিশদের কাছে কোনো দাবি নিয়ে কোনোদিন উপস্থিত হবেন না।

বিশ্বম্ভর চটে উঠে বললে, এ যে অন্যায় দাবি করছেন মশাই! অতীতে আমার মক্কেলের প্রতি যে অন্যায় করা হয়েছে এখন তারই ফয়সালা করছি আমরা। ভবিষ্যতে জগদানন্দবাবু যদি আমার মক্কেলের প্রতি নতুন কোনো অন্যায় করেন, তবে তাঁকে মুখ বুজে সয়ে যেতে হবে?

বাসু-সাহেব বললেন, তৃতীয়ত ওঁকে আরও স্বীকার করতে হবে যে, ভবিষ্যৎ অনুসন্ধানে যদি পুনরায় প্রমাণিত হয় যে, আমার মক্কেল জগদানন্দ বুঝতে পারেন আপনার মক্কেল মহেন্দ্রবাবু সত্যই তহবিল তছরুপ করেছিলেন তাহলে তদানীন্তন ব্যাঙ্ক-রেট সুদ সমেত ঐ পঞ্চাশ হাজার টাকা মহেন্দ্রবাবু প্রত্যর্পণের জন্য বাধ্য থাকবেন!

বিশ্বম্ভর উঠে দাঁড়ান চেয়ার ছেড়ে। বাসু-সাহেবকে ডিঙিয়ে জগদানন্দকে বলেন, আপনি যদি ফয়সালা করতে না চান সেটা সম্পূর্ণ পৃথক কথা। আমরা অন্য পন্থার আশ্রয় নিতে বাধ্য হব। ইনি যা দাবি করছেন তা অযৌক্তিক। অন্তত গতকাল এসব ফ্যাকড়া আপনি তোলেননি।

জগদানন্দ বলেন, আচ্ছা আপনারা একটু অপেক্ষা করুন। আমি ওঁকে বুঝিয়ে বলছি।

বাসু-সাহেবকে নিয়ে জগদানন্দ চলে গেলেন পাশের ঘরে। বললেন, এসব ফ্যাকড়া তুলছেন কেন?

—স্বাভাবিক কারণে। ধরুন যদি খেসারতের টাকাটি নিয়ে ও আবার আসে। আপনার যে গোপন ব্যাপারটা আছে সেটা প্রকাশ করে দেয়—প্রমাণ না-ই করতে পারুক স্ক্যান্ডাল ছড়াবার চেষ্টা করে তখন একটা ‘শো-ডাউন’ অনিবার্য হয়ে পড়বে। তখন মামলা করে ওর কাছ থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা আপনি দাবি করতে পারবেন। সে-টাকা আদায় হবে না, কিন্তু সেই ভয়ে ও স্ক্যান্ডালটাও ছড়াতে সাহস পাবে না।

জগদানন্দ ব্যাপারটা ভেবে দেখেন। একটু পরে বলেন, আপনার যুক্তি ঠিক; কিন্তু এসব শর্ত তো আমি আগে আরোপ করিনি, এখন ওরা শুনতে চাইবে কেন?

—এক কাজ করুন। ওদের কাছে একদিন সময় চেয়ে নিন। কাল এসে একটা ফয়সালা করা যাবে। কাল সন্ধ্যায়, এই একই সময়ে।

জগদানন্দ বিচিত্র হেসে বললেন, কেন বলুন তো? আপনি কি সত্যিই আশা রাখেন যে, কাল সন্ধ্যার মধ্যেই লয়েডস্ ব্যাঙ্ক থেকে জেনে আসবেন রহস্যের সন্ধান?

—তাই আশা করছি। মোট কথা একদিন সময় আপনি চেয়ে নিন শুধু।

তাই নেওয়া হল। বিশ্বম্ভর গজগজ করতে করতে উঠে গেল।

মহেন্দ্র কিন্তু যাবার সময় সবিনয় নমস্কার করে গেল তার প্রাক্তন মনিবকে এবং তাঁর সলিসিটারকে।

জলখাবার খেতে বসে শুরু হল খোশগল্প। বাসু-সাহেব বলেন, সেন-মশাই, আপনার নাতনিটিকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে। বেশ তেজি মেয়ে।

নীলিমা দাঁড়িয়েছিল সামনেই। জগদানন্দ তার পিঠে একটা স্নেহের চাপড় মেরে বলেন, হবেই তো! ওর জন্ম যে সিংহরাশিতে!

—তাই নাকি! সিংহরাশিতে জন্ম হলে বুঝি খুব তেজি হয়?

হা-হা করে হেসে ওঠেন জগদানন্দ। বলেন, না, জ্যোতিষচর্চা অত সহজ নয়; ওটা একটা রসিকতা করছিলাম। তবে নীলু-মা একটি ক্ষণজন্মা মেয়ে—যাকে বলে লগন-চাঁদা! ওর লগ্নে রবিও আছে কিনা! মুশকিল হয়েছে ওর নবমে শনি রয়েছেন— তারপর হঠাৎ বাসু-সাহেবের দিকে ফিরে বললেন, আপনি জ্যোতিষ মানেন? বাসু বলেন, গণিত জ্যোতিষ মানি, ফলিত জ্যোতিষ মানি না।

—আপনার কী রাশি?

—আমি নিজেই তা জানি না। ও সব রাশিচক্র তিথি-নক্ষত্র আমি বুঝিই না।

জলখাবার খেয়ে বৃদ্ধের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ওঁরা নিচে নেমে এলেন। নীলিমা ওঁদের গাড়িতে তুলে দিতে এল। বাসু-সাহেব হঠাৎ প্রশ্ন করেন, নীলিমা, তোমার জন্মবারটা কী বল তো?

—জন্মবার দিয়ে কী হবে? সোমবার!

বাসু বলেন, এমনিই কৌতূহল হল জানতে! আচ্ছা চলি!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *