ধাওয়া – ৯

নয়

সকালের আলো ফুটে উঠেছে চারধারে। শহরের নতুন বাড়িগুলো ঝকমক করছে প্রথম রোদে। রাস্তার দু’পাশের দোকানপাট খুলতে শুরু করেছে, তবে পুরোদমে ব্যস্ততা শুরু হয়নি এখনও। আজকের বিশেষ দিনে রাস্তায় যারা বেরোচ্ছে তারা অন্য কোনও দিকে না তাকিয়ে রেল ডিপোতে ছুটছে। ঘণ্টা দু’তিনেক পর ট্রেন আসবে ব্যাংকের টাকা নিয়ে, কিন্তু ততক্ষণ তীর্থের কাকের মত হাঁ করে ট্র্যাকের দিকে তাকিয়ে থাকার ধৈর্য অনেকেরই আছে।

বাড়ি থেকে বের হলো মেয়র উইলিয়াম। ক্লিন শেভড। আজকে চমৎকার একটা স্যুট গায়ে চড়িয়েছে সে। মনটা ফুরফুরে, দশ ডলারের পারফিউম উপহার দিয়ে সম্পর্ক জোড়া লাগিয়ে ফেলেছে মিসেস জনসনের সঙ্গে। স্বামী যদি আজ রাতেও গাড়ি নিয়ে ব্যস্ত থাকে, তা হলে মহিলা ওর কাছে আসবে কথা দিয়েছে।

একটা দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছে কঠোর চেহারার দুই আউট-ল। মেয়র ওদের সামনে দিয়ে হেঁটে যাওয়ায় একজন আরেকজনকে জিজ্ঞেস করল, ‘ফুলবাবুটা কে?’

‘মেয়র।’

‘জেসাস!’ সঙ্গীর কথা শুনে হাসল আউট-ল। ‘এই যদি হয় মেয়র, তা হলে বাকিরা কেমন? আমার তো মনে হয় হাসতে হাসতে আজকের কাজটা শেষ করতে পারব আমরা!’

আট-দশজন ছেলে রাস্তায় মার্বেল খেলছিল, মেয়রকে দেখে দূর থেকে ছুটে এল ওরা। চেঁচাচ্ছে সবাই। হাসিমুখে কোটের পকেটে হাত ভরল মেয়র। বাচ্চাদের জন্য সবসময় ক্যাণ্ডি রাখে সে। ওরাই তো ভবিষ্যতে তাকে ভোট দেবে। দলের নেতা বুড়ো খোকার নাম পার্ডি। সে মানা করায় একটা ছেলেও ক্যাণ্ডি নিতে হাত বাড়াল না। পার্ডিকে চটালে ফল ভাল হয় না জানে ওরা, একেকজনকে ধরে পিটিয়ে তক্তা বানিয়ে দেয়।

‘আমরা ক্যাণ্ডি চাই না, আমরা বুড়ো লিয়োর খুনিটাকে দেখতে চাই,’ চেঁচাল সে।

ক্যাণ্ডি নিতে না পেরে যারা মনক্ষুণ্ণ হয়েছিল তারাও নেতার কথায় খুশি হয়ে উঠল। ক্যাণ্ডি পরেও খাওয়া যাবে, কিন্তু খুনি পরে আর দেখা যাবে কি না সন্দেহ! সমস্বরে পার্ডির কথায় সায় দিল ওরা।

রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়েছিল বলে কিছুই জানে না মেয়র। বিস্ময়ে চোয়াল ঝুলে পড়ছিল, কিন্তু সামলে নিল সে। ছেলেদের সামনে বোকা বনতে চায় না। মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, ‘চলো। মার্শালের সঙ্গে কথা আছে আমার, খুনি যদি থাকে পাঁচ মিনিটের জন্য দেখতে দেব তোমাদের।’

‘মাত্র পাঁচ মিনিট!’ খুশি হয়নি পার্ডি। নেতাদের খুশি হতে নেই। হুমকি দিল সে, ‘আমাদের বাবা-মাকে বলব তোমাকে ভোট না দিতে। ‘

‘যতক্ষণ খুশি দেখবে, অসুবিধা কী!’ তড়িঘড়ি করে বলল মেয়র। মনে মনে পার্ডির চোদ্দ গুষ্টি উদ্ধার করল। লোকদের নিয়ে ভয় নেই, ব্রথেলের মেয়েরা ফিরে আসবে জেনে যাওয়ায় ওকেই ভোট দেবে তারা। যত চিন্তা মহিলাদের নিয়ে, বাচ্চাদের কথা শুনে মহিলারা বুড়ো হাবড়া প্রতিদ্বন্দ্বীটাকে ভোট দিলে সর্বনাশ হতে পারে।

ছেলের দলের আগে আগে হেঁটে জেলখানার দরজার সামনে পৌঁছুল মেয়র উইলিয়াম। দরজা বন্ধ, খোলার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো সে। ধাক্কা দিয়ে শব্দ করে চেঁচাল, ‘উইলকার, দরজা খোলো!’

দরজা খুলল না। ভেতরে কোনও সাড়াশব্দ নেই। মার্শাল থাকলে নিশ্চয়ই দরজা খুলত! ঘুরে তাকিয়ে মেয়র বুঝল ছেলেরা ছাড়াও কয়েকজন লোক দাঁড়িয়ে গেছে তার কাণ্ডকারখানা দেখার জন্য। সুন্দর হাসির জয় বিশ্বজুড়ে। মিষ্টি একটুকরো মাপা হাসি উপহার দিল মেয়র উপস্থিত জনতার উদ্দেশে। দু’হাত তুলে বলল, ‘আমাদের সুযোগ্য নতুন মার্শাল প্রায়ই চাবি নিয়ে ভুলে চলে যায় বাড়িতে। কিন্তু আশ্চর্য! ফিরে আসার সময় চাবি আনতে ভোলে না সে!’

চলে যেতে গিয়েও একটা জানালা আধ খোলা দেখে উঁকি দিল মেয়র। সেলের দরজা খোলা, ভেতরে কোনও বন্দি নেই। মার্শালকে কোথাও দেখা গেল না। ছেলেরা মিথ্যে বলেনি, তা হলে খুনি গেল কোথায়? মার্শালেরই বা কী হলো? ফ্যাকাসে চেহারায় ঘুরে দাঁড়িয়ে হাসল মেয়র, বাচ্চাদের উদ্দেশে বলল, ‘একটু অপেক্ষা করো, আমি এখুনি আসছি। ফিরে এসে তোমাদের খুনি দেখাব।’

মিলার্ডের ধারণা কি তা হলে ঠিক? ব্যাংক ডাকাতি হবে এ যুগেও? রেল ডিপোর দিকে দ্রুত পায়ে হাঁটতে শুরু করল মেয়র। ভয়ে চিন্তায় মনে মনে কাহিল হয়ে পড়েছে সে, কিন্তু পরিচিতদের পাশ কাটানোর সময় হাসতে ভুলছে না একবারও।

প্ল্যাটফর্মে লোকজন দাঁড়িয়ে আছে বেশ ক’জন। টিকেট কাউন্টার ফাঁকা। বুড়ো এজেন্ট ছাড়া ওখানে কেউ নেই। আরেকটু পরেই লোকে ভিড় করে টিকেট কাটতে আসবে, তাই ব্যস্ত হয়ে বিভিন্ন গন্তব্যের টিকেট আলাদা খোপে রাখছে লোকটা।

‘গুড মর্নিঙ, স্তেফান,’ কাউন্টারে বুক ঠেকিয়ে দাঁড়াল মেয়র। ‘এক্সপ্রেস ট্রেন ঠিক সময় পৌঁছবে?’

‘হ্যাঁ, মেয়র।’

‘অস্বাভাবিক কোনও কিছু তোমার চোখে পড়েছে, স্তেফান?’ চারপাশে তাকিয়ে অকারণেই গলা নামিয়ে জানতে চাইল মেয়র। ‘সন্দেহজনক কিছু দেখলেই আমাকে জানাবে, বুঝেছ?’

‘না, মানে, জী, মেয়র। কিছু দেখলেই জানাব।’

এই প্রথম মেয়র লক্ষ করল ভয় পেয়েছে বুড়ো লোকটা। টিকেট ধরা দু’হাত কাঁপছে থরথর করে। কিছু কি জানে লোকটা? ডাকাতি হবে? আতঙ্ক সংক্রমিত হলো মেয়রের মধ্যে। মিলার্ডকে সরিয়ে নিজের পছন্দের লোককে মার্শাল পদে বসানো ভুল হয়ে গেছে, ভাবল সে। ব্যাংক ডাকাতি হলে এখন আর মিলার্ডের ঘাড়ে দোষ চাপানো যাবে না। উইলকারকে মার্শাল করায় সবাই তাকেই দোষ দেবে, নির্বাচনে জেতার আশা থাকবে না আর। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিল মেয়র। এজেন্টকে শান্ত স্বরে বলল, ‘কী বলেছি মনে রেখো, সন্দেহ হলেও আমাকে জানাবে। কোনও লোককে দেখে খারাপ মনে হলেও বলতে ভুলো না।’

মেয়র যতক্ষণ কথা বলল ততক্ষণ বুড়ো এজেণ্ট তাকে চোখের ইশারা করল। বাম কাঁধের পেছনের কিছু দেখাতে চাইছে সে মাথা না নেড়ে। সেদিকে তাকিয়ে ধক করে উঠল মেয়রের হৃৎপিণ্ড। ছোট্ট অফিস ঘরের পেছন দিকে উঁচু করে দেয়ালের মত সাজিয়ে রাখা হয়েছে অনেকগুলো বড় ব্যাটারি। ওগুলো টেলিগ্রাফ যন্ত্রে পাওয়ার সাপ্লাই দেয়।

একপাশের জানালা দিয়ে সূর্যের আলো ঢুকেছে ঘরে। উল্টোদিকের দেয়ালে ব্যাটারিগুলোর ছায়া পড়েছে। শুধু ব্যাটারি নয়, ভাল করে তাকালে বোঝা যায় অস্বাভাবিক একটা ছায়া। একজন লোক পিস্তল বাড়িয়ে ধরে বসে আছে ব্যাটারিগুলোর পেছনে। টিকেট এজেণ্ট এত ভয় পাচ্ছে কেন বুঝতে অসুবিধা হলো না মেয়রের। তার নিজেরও হাত কাঁপত পিঠ বরাবর কেউ পিস্তল তাক করে বসে থাকলে।

‘ও, হ্যাঁ, স্তেফান, আমরা তোমার অবসরের ব্যবস্থা করছি। চিন্তা কোরো না, মিস্টার মিলার্ডের সঙ্গে আলাপ করব যাতে তোমার অবসর ভাতা পেতে সুবিধা হয়।’ শান্ত কণ্ঠে কথা ক’টা বলে ঘুরে হাঁটা দিল মেয়র উইলিয়াম।

পদশব্দ দূরে চলে যাওয়ার পর আড়াল ছেড়ে হাসতে হাসতে বেরিয়ে এল লোকোর ডানহাত জর্জ প্যারট। অকৃত্রিম প্রশংসা ভরে বলল, ‘তোমার অভিনেতা হওয়া উচিত ছিল, বুড়া দাদু, নাম করতে পারতে!’

.

ফায়ারপ্লেসের আগুন নিভে গেছে অনেকক্ষণ হলো। পার্লারের ভেতরে শীত জাঁকিয়ে বসেছে। নতুন আরেকটা হুইস্কির বোতল খোলা হয়েছে। গ্লাস হাতে অস্থির পায়ে একটানা পায়চারি করছে জো মিলার্ড, চুমুক দিচ্ছে না একবারও। ম্যাকেনলি চেয়ারে বসে দৃষ্টি দিয়ে অনুসরণ করছে মিলার্ডকে।

অজস্র অনুভূতি, স্মৃতি আর বর্তমান-ভবিষ্যতের চিন্তা জট পাকিয়ে গেছে মিলার্ডের মাথায়, গম্ভীর উদ্ভ্রান্ত চেহারায় গিঁট ছাড়ানোর চেষ্টা করছে সে।

‘ভেবে কী লাভ, ওরা সংখ্যায় অনেক,’ এক সময় নীরবতা ভাঙল ম্যাকেনলি।

‘তারমানে বলতে চাইছ চোখের সামনে ওদের ব্যাংক ডাকাতি দেখতে হবে?’ থমকে দাঁড়িয়ে চোখ গরম করে তাকাল জো মিলার্ড। ‘ভেবেছ আমার বন্ধুকে খুন করে পার পেয়ে যাবে ওরা? আমি বেঁচে থাকতে নয়, দরকার হলে একাই ওদের সবার বিরুদ্ধে লড়ব আমি।’

‘তাতে কী লাভ, শুধু শুধু মরবে তুমিও।’

জবাবে মিলার্ড কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই দরজায় জোর ধাক্কা পড়ল। বাইরে থেকে মেয়র উইলিয়ামের উৎকণ্ঠা মিশ্রিত চিৎকার ভেসে এল। ‘মিসেস উডল্যাণ্ড! দরজা খোলো, মিসেস উডল্যাণ্ড!’

কিচেনে মেরিয়ানের পায়ের শব্দ শুনতে পেল ওরা। তারপরই দরজা খোলার শব্দ হলো। ভদ্রতার ধার দিয়েও গেল না মেয়র, চোখের সামনে মেরিয়ানকে দেখেই ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলল, ‘মার্শাল জো-কে খুব দরকার। জীবন- মরণের প্রশ্ন, কোথায় সে?’

মেরিয়ান বোধহয় নিঃশব্দে পার্লার দেখিয়ে দিয়েছে, কারণ বড় বড় চোখ করে প্রায় দৌড়ে ওদের সামনে উপস্থিত হলো মেয়র। ঘামে দেহ চকচক করছে, সুদর্শন চেহারা চিন্তায় মলিন দেখাচ্ছে। তার অবস্থা দেখে মনে হলো খোদ শয়তানের তাড়া খেয়ে ছুটে এসেছে।

‘জো বয়, আমরা শেষ হয়ে গেছি!’ দু’হাত যতদূর সম্ভব ছড়িয়ে নাটকীয় ভঙ্গিতে বলল মেয়র। হঠাৎ ম্যাকেনলির ওপর চোখ পড়তেই অপ্রস্তুত হয়ে গেল। মনে পড়ে গেছে মিলার্ডকে দু’একদিন আগেও পাত্তা দেয়নি, উল্টে বরখাস্ত করেছে অবসর দেয়ার ভঙ্গি দেখিয়ে। কথার খেই হারিয়ে গেল মেয়রের, জিজ্ঞেস করল, ‘এ…এখানে কী করছে?’

‘কী করছে বলে তোমার ধারণা?’ খেপে উঠল জো মিলার্ড। ‘আমি জীবন বাজি রেখে ম্যাকেনলিকে ধরে আনলাম, আর কী; না, আমাদের মেয়রের তখন জরুরী কাজ পড়ে আছে, দেয়ার মত সময় হাতে নেই! তুমি মেয়েমানুষের চিন্তায় ব্যস্ত, অযোগ্য উইলকারের হাতে ওকে তুলে দেব নাকি আমি?’

‘বুঝেছি, তোমার যুক্তি আমি বুঝেছি, জো বয়, লজ্জায় লাল চেহারায় বলল মেয়র। এ প্রসঙ্গে কথা বলে আর কী হবে এমন একটা ভঙ্গি করে হাত নাড়ল। তারপর জানতে চাইল, ‘এখন কী হবে, জো বয়? ওরা ব্যাংক ডাকাতি করবে বলে এসে হাজির হয়েছে, এখন উপায়?’

‘মার্শালের কী হলো?’ জবাব না দিয়ে তির্যক প্রশ্ন ছুঁড়ল মিলার্ড।

‘তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, আছে বোধহয় কোথাও,’ অস্বস্তিতে হাত কচলাল মেয়র। ‘এদিকে আউট-লদের একজন ডিপোতে বুড়ো স্তেফানের পিঠে পিস্তল ধরে বসে আছে। জেলখানায় উঁকি দিয়ে দেখলাম লিয়োর খুনিও উধাও! কে জানে, মার্শাল উইলকারকেও হয়তো খুন করে রেখে গেছে!’

‘আমার কাছে এসেছ কেন?’ মাথায় রক্ত উঠে গেলেও ঠাণ্ডা স্বরে জিজ্ঞেস করল মিলার্ড। ‘হঠাৎ ভুলে গেছ বোধহয় যে আমাকে অবসর দেয়া হয়েছে? কত কাজ পড়ে আছে আমার! মাছ ধরার জায়গা, রোদে বিশ্রাম নেবার জায়গা; এসব আমাকে খুঁজতে হবে না?’-

চেহারা আর তাকানোর ভঙ্গি দেখে মনে হলো মেয়র কেঁদে ফেলতে যাচ্ছে। কিন্তু না, মিলার্ড না বুঝলেও ম্যাকেনলি বুঝল পুরোটাই এই লোকের ভান। কাঁচুমাচু মুখ করে মেয়র বলল, ‘মস্ত বড় ভুল করে ফেলেছি, জো বয়। তুমি তো জানো, জীবনে এই প্রথম। ক্ষমা করে দাও। আমি না হয় দোষ করেছি, কিন্তু শহরের বাকি সবাই? অন্তত ওদের মুখের দিকে তাকিয়ে হলেও…’

‘আউট-লরা টের পেয়েছে যে তুমি সন্দেহ করেছ?’ রাগ খানিকটা কমেছে মিলার্ডের।

‘না।’ মিলার্ডের কৌতূহল জাগাতে পেরে মনে মনে হাসল মেয়র উইলিয়াম। জানে, লিয়োর খুনিকে শাস্তি দেবার জন্য হলেও দায়িত্ব এড়াতে পারবে না প্রাক্তন মার্শাল।

‘ওরা ব্যাংক ডাকাতি করবে না,’ হঠাৎ সিলিঙের দিকে তাকিয়ে মন্তব্য করল ম্যাকেনলি।

‘তো? মানে?’ বিস্ময়ে হাঁ হয়ে গেল মেয়র।

‘তুমিও বুঝতে পারোনি, মিলার্ড?’ হেঁয়ালির সুরে জানতে চাইল আউট-ল। ‘বুঝেছি!’ উজ্জ্বল হয়ে উঠল মিলার্ডের রাতজাগা চেহারা। ‘এজন্যই সারারাত মনের মধ্যে খচখচ করছিল, আগে যে কেন মাথায় আসেনি! ওরা ব্যাংকের বদলে ট্রেন ডাকাতি করে এক লক্ষ ডলার কেড়ে নিতে চাইবে, তাই না?’

নীরবে মাথা ঝাঁকাল ম্যাকেনলি।

‘তুমি হঠাৎ এসব আমাদের জানাচ্ছ কেন?’ চোখে সন্দেহ নিয়ে জানতে চাইল মেয়র। তাকিয়ে আছে ম্যাকেনলির দিকে।

‘কারণ সিদ্ধান্ত পাল্টেছি, কাপুরুষদের দলে আমি থাকব না। ওদের সঙ্গে থেকে বদনামের ভাগীদার হতে চাই না। তাছাড়া লিয়োকে আমার ভাল লেগেছিল।’ উঠে দাঁড়িয়ে মিলার্ডের দিকে তাকিয়ে বলল আউট-ল, ‘স্টেশনে ট্রেন থামলেই ওরা ডাকাতি করবে।’

‘শহরের সবাই যদি অস্ত্র হাতে…’.

হাতের ঝাপটায় মেয়রকে থামিয়ে দিল মিলার্ড। ‘নিরীহ কিছু লোক মরবে তা হলে। না, যা করার আমাদেরই করতে হবে। আউট-লদের ঠেকানোর একমাত্র উপায় হচ্ছে স্টেশনে ট্রেন থামার ব্যাপারটা থামিয়ে দেয়া।’

‘কী থামাথামি বলছ, কিচ্ছু বুঝতে পারছি না,’ অসহায় ভঙ্গিতে শ্রাগ করল মেয়র।

‘ট্রেন যদি স্টেশনে না থামে, যদি গতি বজায় রেখে ছুটে চলে যায়—’

‘তা হলে বোকা বনে যাবে আউট-লর দল। হাঁ করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চলন্ত ট্রেন দেখবে ওরা, আর ভাববে কোত্থেকে হঠাৎ কী হয়ে গেল!’ মিলার্ডের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে মেয়রকে বুঝিয়ে দিল ম্যাকেনলি।

‘কিন্তু ট্রেন তো থামবেই। আমাদের প্রোগ্রেস হলো গিয়ে বড় একটা শহর,’ পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখের ঘাম মুছল মেয়র। ট্রেন প্রোগ্রেসে থামবে না ভাবতেই আত্মসম্মানে লাগছে তার। আবার যদি সত্যিই থামে তা হলে কী হবে ভেবেও আতঙ্ক বোধ করছে, দোটানায় পড়ে এখন কী বলা উচিত বুঝে উঠতে পারছে না।

‘কেউ যদি স্টেশনে ঢোকার আগেই ট্রেনে উঠে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে তা হলে ওরা প্রোগ্রেসে থামবে না,’ জানি দোস্তের মত মেয়রকে চোখ টিপে জানাল আউট-ল।

‘চমৎকার! তোমার বুদ্ধি আছে, মিস্টার ম্যাকেনলি, প্রশংসা করতেই হয়, ‘ খুশি হয়ে আউট-লর পিঠ চাপড়ে দিল মেয়র।

‘চির কৃতজ্ঞ হয়ে গেলাম তোমার প্রশংসা পেয়ে,’ গম্ভীর চেহারায় টিটকারি মারল ম্যাকেনলি। মনে মনে ভাবছে, ঠিক কয় আউন্স গোবর আছে নিজেকে বিরাট কিছু ভেবে বসা মেয়রের মাথায়।

‘তা হলে এ-কথাই রইল, জো বয়,’ উৎসাহের সঙ্গে বলল মেয়র। ‘আমরা ঘোড়ায় চেপে ছুটে যাব, ট্রেনে উঠে ওদের জানাব প্রোগ্রেসে ট্রেন যাতে না থামায়। প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ানো আউট-লগুলোর চোখের সামনে হাত নাড়তে নাড়তে দূর থেকে দূরে মিলিয়ে যাব আমরা।’

‘তুমিও যাবে ভাবছ নাকি, মেয়র?’ তির্যক দৃষ্টিতে তাকাল ম্যাকেনলি।

‘অবশ্যই। যেতে আমাকে হবেই, এরকম সুযোগ জীবনে বারবার আসে না। সফল হতে পারলে আমার ভবিষ্যৎ খুলে যাবে। গভর্নর ..না, প্রেসিডেন্ট হওয়ার পথেও আর কোনও বাধা থাকবে না। নিজস্ব ট্রেনে বক্তৃতা করতে দেশময় ছুটব আমি, প্রেসিডেন্ট…হ্যাঁ, প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম র‍্যালের কথা শুনতে হাজার হাজার লাখ লাখ লোক আসবে। পেপারে ছাপা হবে…প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম র‍্যালে শুনতে কী চমৎকার লাগে, তাই না? আমি হব…’

দিবাস্বপ্নে বিভোর মেয়র খেয়াল করল না অবাক চেহারায় পরস্পর দৃষ্টি বিনিময় করল আউট-ল আর মিলার্ড। হুইস্কির বোতল থেকে বড় একচুমুক গিলে আউট-লর দিকে বাড়িয়ে ধরল জো। মাথার চারপাশে হাত ঘুরিয়ে বোঝাল মাথাটা গেছে এই লোকের। কোনও দিকে নজর নেই মেয়রের, একটানা কী থেকে কী হবে আর কী হতে পারে তার বয়ান দিচ্ছে।

‘মিস্টার প্রেসিডেন্ট,’ অধৈর্য হয়ে শেষ পর্যন্ত কর্কশ গলায় ডাক দিল ম্যাকেনলি। ‘আপনি যদি একটু এদিকে নজর দেন তা হলে কৃতার্থ হই।’

‘অ্যা, কী?’ যেন ঘুম থেকে জেগে উঠেছে, চোখ পিটপিট করে জানতে চাইল মেয়র।

‘আপনাকে কি আমি মেয়র বলব, না প্রেসিডেন্ট? আপাতত মেয়রই বলি, ঠিক আছে? ঘোড়া নিয়ে জীবন হাতে করে ছুটতে হবে কিন্তু ট্রেনে উঠতে হলে। এক ইঞ্চি হিসেবে এদিক ওদিক হলেও চলবে না।’

‘ছুটতে হবে?’ ফ্যাকাসে চেহারায় মিলার্ডের দিকে তাকাল মেয়র। ‘তারমানে চলন্ত ট্রেনে উঠতে হবে?’

‘হ্যাঁ।’

‘আর হাতের মুঠোয় জোর না থাকলে সর্বনাশ,’ বলল ম্যাকেনলি। ‘আমার দলের ডাস্টি রোডসের মত অবস্থা হবু প্রেসিডেন্টের হোক তা চাই না।’

‘কী হয়েছিল ওর?’

‘বেচারা ডাস্টি,’ দুঃখিত চেহারায় মাথা চুলকাল ম্যাকেনলি। ‘একবার চলন্ত ট্রেনে উঠতে গিয়ে পিছলে পড়েছিল। কীভাবে কী হয়েছিল আমরা ঠিক বুঝতে পারিনি, ফিরে এসে দেখলাম…। দেখলাম ট্র্যাকের ওপর রক্ত আর দলা দলা মাংস ছড়িয়ে আছে অনেকখানি জায়গা জুড়ে। হাত পিছলে পড়ে গিয়েছিল হয়তো!’

অনেক কষ্টে বমি ঠেকাল মেয়র, ঘন ঘন ঢোক গিলে গলা পরিষ্কার করে বলল, ‘ঝুঁকির ব্যাপারটা আমি বিবেচনায় আনিনি, মিস্টার ম্যাকেনলি, মনে করিয়ে দেয়ার জন্য ধন্যবাদ। আমার জীবনের নিরাপত্তার কথা ভাবছি না, কিন্তু আমি তো আমার নই। আমি সমাজ সেবক, মেয়র এই শহরের, আমাকে ছাড়া লোকজনের তো চলবে না। ওদের কথা আমাকে ভাবতেই হবে। নাহ্, ইচ্ছের বিরুদ্ধে হলেও ওদের জন্যই আমাকে থেকে যেতে হবে!’

‘সে তো বটেই,’ বিড়বিড় করে বলল মিলার্ড।

‘দেশ সুযোগ্য একজন হবু প্রেসিডেন্ট হারাল বোধহয়,’ মনে মনে হাসল ম্যাকেনলি।

‘ঠিক আছে, মেয়র,’ বলল মিলার্ড। ‘যেতে যখন পারছ না, শহরেই থাকো। স্বাভাবিক আচরণ কোরো, দুর্বৃত্তরা যাতে বুঝতে না পারে যে তুমি কিছু বুঝে ফেলেছ।’

‘আর তুমি কী করবে?’ স্বস্তির শ্বাস ফেলে জানতে চাইল মেয়র।

‘ট্রেনে গিয়ে উঠব।’

‘একা?’

‘একা।’

‘বুদ্ধিটা মিস্টার ম্যাকেনলির, ওকে সঙ্গে নেবে না?’

‘না। তুমি বোধহয় ভুলে গেছ সেও আউট-লদের একজন, তাই না?’

‘কথাটা বোধহয় ঠিক না,’ পার্লারের দরজা থেকে বলল মেরিয়ান। ম্যাকেনলির চোখে চোখ রেখে জানতে চাইল, ‘তুমি এখনও আউট-লদের সঙ্গে থাকবে?’

একমুহূর্ত কী যেন চিন্তা করল ম্যাকেনলি, তারপর বলল, ‘লিয়োকে আমার ভাল লেগেছিল। তাছাড়া অযথা খুনোখুনি আমার মারাত্মক অপছন্দ। না, ম্যাম, আমি ওদের সঙ্গে থাকব না মরতে হলেও।’

‘তা হলে ওদের ঠেকাতে তোমরা দু’জন একসঙ্গেই যাবে,’ অনুরোধ নয় সিদ্ধান্তের সুর মেরিয়ানের কণ্ঠে ফুটল।

পরস্পরের দিকে তাকাল জো মিলার্ড আর বিগ জিম ম্যাকেনলি, কথা হলো না ওদের মাঝে। ঘরে ঢুকে দু’জনের ডানহাত মিলিয়ে দিয়ে মেরিয়ান বলল, ‘হ্যাণ্ডশেক করে কথা দাও। একজন আরেকজনের দিকে খেয়াল রাখবে।’

পেরিয়ে গেল দীর্ঘ কয়েকটা মুহূর্ত, দু’জনের হাত দুটো শুধু ছুঁয়ে আছে। মিলার্ডই প্রথম নীরবতা ভেঙে জানতে চাইল, ‘এবার তুমি কথা দিচ্ছ, ম্যাকেনলি?’

‘দিচ্ছি।’ গম্ভীর চেহারায় মাথা ঝাঁকাল আউট-ল।

শক্ত মুঠোয় পরস্পরের হাত আঁকড়ে ধরে ঝাঁকাল ওরা দু’জন। মেরিয়ান আর মেয়রের মুখে হাসি ফুটল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *