আট
টয়লেটের দরজার দিকে কয়েক পা এগিয়ে থমকে দাঁড়াল মিলার্ড। মৃদু খুটখাট শব্দ হচ্ছে টয়লেটের ভেতরে। ম্যাকেনলি, না ওপাশের দরজা দিয়ে ঢুকে শব্দ করছে অন্য কেউ? ম্যাকেনলি চলে গিয়ে থাকলে আর ওর দেখা পাওয়া যাবে না; আবার না গিয়ে থাকলে ঠিকই আসবে। পরিস্থিতির ওপর হাত নেই বুঝে ফিরে এসে চেয়ারে বসল মিলার্ড। লম্বা চুমুকে বোতলের অবশিষ্ট হুইস্কি গলায় ঢালল।
গেলার আগেই টয়লেটের দরজা খুলে বেরিয়ে এল আউট-ল। চেহারা দেখে গলায় হুইস্কি আটকে কাশতে শুরু করল মিলার্ড। ম্যাকেনলি এসে ওর পিঠে চাপড় দিল দম ফিরে পেতে সাহায্য করার জন্য। বিস্ফারিত চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বড় করে শ্বাস টানল মিলার্ড। আউট-লর চেহারা টয়লেটে যাওয়ার আগে দাড়ি-গোঁফে ভরা ছিল, কিন্তু এখন একদম ফকফকা। সব কামিয়ে এসেছে। যৌবন ফিরে না এলেও বুড়ো বুড়ো দেখাচ্ছে না আর এখন, মনে হচ্ছে বয়স কমে গেছে বছর দশেক।
‘টয়লেটে একটা রেজর ছিল, কেটে ফেললাম,’ মিলার্ডের চেহারায় বিস্ময় দেখে লজ্জায় লাল হয়ে উঠল আউট-ল।
হ্যাণ্ডকাফ পরার জন্য ডানহাত এগিয়ে দিয়েছে দেখে মিলার্ড বলল, ‘দরকার দেখছি না। তুমি ইচ্ছে করলে পালাতে পারতে, টয়লেটের জানালা যথেষ্ট বড়।’
‘ভাবলাম চলে গিয়ে কী হবে। আর কতদিন পালাব,’ চেয়ারে বসে পড়ে বলল ম্যাকেনলি।
পরস্পরের দিকে তাকিয়ে হাসল ওরা। ধীরে ধীরে ওদের মধ্যে বন্ধুত্ব হয়ে যাচ্ছে বুঝে দু’জনেই একটু অস্বস্তিতে ভুগছে।
বোর্ডিঙ হাউসের সদর দরজায় করাঘাতের দ্রুত শব্দে গল্প থেমে গেল ওদের। লাফ দিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠল মিলার্ড। ‘নিশ্চয়ই লিয়ো। বুড়ো ছাগলটা এত দেরি করল কেন!’ কপট রাগ দেখালেও সতর্কতায় ঢিল পড়ল না, দরজার কাছে গিয়ে সিক্সগান বের করে মিলার্ড জানতে চাইল, ‘কে?’
‘আমি বার্থা, দরজা খোলো,’ কান্না জড়ানো মহিলা কণ্ঠ ভেসে এল বাইরে থেকে।
দরজা খুলে মিলার্ড দেখল সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদছে জনির বউ। কান্নার ফাঁকে ফাঁকে কী ঘটেছে জানাল সে। মহিলা চলে যাওয়ার পরও একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকল মিলার্ড। ওর মধ্যে ঝড় বয়ে যাচ্ছে। একজন বন্ধু হারিয়েছে ও। ওকে বুঝতে পারত এমন একজন বন্ধু আর নেই, অন্যায়ভাবে খুন করা হয়েছে লিয়োকে। আর কখনও ওর ওপর রেগে উঠবে না লিয়ো। কখনও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাহায্য করতে ছুটে আসবে না। আজ সত্যি সভ্যতার কাছ থেকে অনেক দূরে চলে গেছে সে। এতই দূরে যে মিলার্ডের সাধ্য নেই ওর কাছে যায়। দ’ফোঁটা পানি টলমল করে উঠল মিলার্ডের চোখে। অপ্রস্তুত হয়ে সে বলল, ‘ঠাণ্ডা বাতাসের ঝাপটায় চোখে পানি এসে যায়!’
পেছন থেকে মিলার্ডের কাঁধে হাত রাখল ম্যাকেনলি। দু’জনে একসঙ্গে গেল লিয়োকে দেখতে। ফিরে আসার সময় ম্যাকেনলি বলল, ‘আমি জানি তোমার কেমন লাগছে। দলের সবাই মরেছে চোখের সামনে, কিছুই করতে পারিনি আমি। জানি বন্ধু হারানোর কষ্ট কতখানি, মিথ্যে সান্ত্বনা দেব না তোমাকে। লিয়োকে আমারও ভাল লেগেছিল। বন্ধুকে বাঁচানোর জন্যই আমাকে খুন করতে চেয়েছিল বুড়ো।’
ভোরের প্রথম আলো পুবাকাশ ছুঁয়েছে। কিছুক্ষণ পর রাস্তার ধুলো লাল হয়ে উঠবে রোদ মেখে। রাস্তার গ্যাসের বাতি নেভায় যে লোকটা সে কাজ শুরু করে দিয়েছে। একের পর এক বাতি নিভিয়ে বোর্ডিঙ হাউসের সামনে দিয়ে চলে গেল সে, খেয়াল করল না বোর্ডিঙ হাউসের বারান্দায় দাঁড়ানো নিঃসঙ্গ লোকটাকে।
বারান্দার রেলিঙে এক পা উঠিয়ে দিয়ে অনড় দাঁড়িয়ে আছে মিলার্ড। পাইপটা অনেকক্ষণ আগে নিভে গেছে, নতুন করে তামাক ভরার কথা মনে পড়েনি ওর। চোখ কুঁচকে দিগন্তের দিকে তাকিয়ে আছে সে, কিন্তু দেখছে না কিছুই। খেয়াল করল না পেছনে মৃদু শব্দে খুলে গেছে দরজা।
নীরবে মিলার্ডের পাশে এসে দাঁড়াল মেরিয়ান। ভারী একটা সোয়েটার পরে গলা পর্যন্ত বোতাম এঁটে দিয়েছে সে, তবুও কাঁপছে ভোরের শীতল বাতাসে। হাতের চাদরটা মিলার্ডের কাঁধে জড়িয়ে দিল মেরিয়ান। নড়ল না মিলার্ড। একটা কথাও বলল না। চেয়ে আছে দিগন্তের কাছে অনন্ত বিস্তৃত আকাশের দিকে। কথা না বলে মিলার্ডকে দেখল মহিলা। তাকিয়েই থাকল। যেন বুঝতে পারছে মিলার্ডের বেদনা। উপশম জানা নেই, তবু দৃষ্টিতে সহমর্মিতা আছে।
হঠাৎ একসময় মিলার্ড বলল, ‘লিয়োর বদলে আমারই মরা উচিত ছিল। আমিই ওকে বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছি।’
‘না বোধহয়, ওর ভাগ্যে এই ছিল।’
‘ভাগ্য? ভাগ্য আমি বিশ্বাস করি না। আমার ভাগ্যে লেখা ছিল যে তুমি অন্য লোকের বউ হবে? ভাগ্য বলে কিছু নেই, মেরি। সব দোষ আমার।’
নীরবতা নামল ওদের মাঝে। মেরিয়ান বুঝল জীবনের হিসেবে মস্ত বড় একটা ভুল করে ফেলেছে সে। আকাশ দেখছে মিলার্ড। অনেকক্ষণ পর শীতে কাঁপতে কাঁপতে মেরিয়ান বলল, ‘এখানে খুব শীত। চলো, ভেতরে যাই।’
‘তুমি যাও। একটু পরে আসব আমি।’
‘তোমার সর্দি লেগে নিউমোনিয়া হতে পারে কিন্তু।’
‘যা হয় হোক, কিছুক্ষণ একা থাকতে চাই আমি,’ ঠাণ্ডা স্বরে সিদ্ধান্ত জানাল মিলার্ড। ও চাইছে না মেরিয়ান ওকে কাঁদতে দেখে ফেলুক। কয়েকটা ব্যাপারে মনস্থির করতে হবে ওকে। কয়েকজনের জীবন কেড়ে নিতে হবে। যে আউট-ল লিয়োকে খুন করেছে তার বেঁচে থাকার অধিকার নেই। লোকটাকে জেলে পুরেছে উইলকার, কিন্তু হাতে যথেষ্ট প্রমাণ না থাকলে ছেড়েও দেবে। জীবন থাকতে আউট-ল আর তার সঙ্গীদের বাঁচতে দেবে না মিলার্ড।
‘জো,’ মিলার্ডের কাঁধে হাত রেখে ভীত স্বরে ডাকল মেরিয়ান। মিলার্ডের চেহারা দেখে বুঝতে পারছে কী চলছে ওর মাথায়। বলল, ‘আমি জানি কী ভাবছ তুমি, জো। যা-ই করো লিয়োকে আর ফেরত পাবে না। মনে রেখো আরও অনেকে তোমাকে ভালবাসে, তোমার ওপর নির্ভর করে। তোমার কিছু একটা হয়ে গেলে তখন…’
‘লিয়ো আমার বন্ধু ছিল, মেরি,’ শান্ত কণ্ঠে বলল মিলার্ড মেরিয়ানের চোখে চোখ রেখে। ‘ওরকম বন্ধু মানুষ এক জীবনে দু’বার পায় না। আমাকে সাহায্য করতে গিয়ে মারা গেছে লিয়ো। কোনও দরকার ছিল না ওর, শহরে এসেছিল শুধু আমি যাতে বিপদে না পড়ি সেজন্য। এখন আর আমি পিছিয়ে যেতে পারব না, মেরি।’
‘শহরের সবাই তোমাকে পছন্দ করে, ওদের জন্য হলেও বেঁচে থাকা দরকার তোমার,’ রাগে কাঠের মেঝেতে পা ঠুকল মেরিয়ান, ‘বাজে চিন্তা বাদ দাও, জো, ভুলেও বোকার মত কিছু করতে যেয়ো না। এখন আইনের ব্যাপারগুলো দেখার দায়িত্ব মার্শাল উইলকারের, তোমার না। পছন্দ করে বলেই শহরের সবাই তোমাকে অবসর দিয়েছে!’
ঠোঁট বাঁকা করে মিলার্ডকে নিঃশব্দে হাসতে দেখে রাগ আরও বাড়ল মেরিয়ানের, প্রায় চেঁচিয়ে উঠল, ‘বোকার মত কিছু করবে না বলে দিলাম, জো মিলার্ড! তোমাকে বাড়ের দরকার; ভীষণ দরকার।’ এক মুহূর্ত ইতস্তত করল মেরিয়ান, তারপর দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে বলল, ‘আমারও তোমাকে দরকার, জো।’
এতদিন অপেক্ষার পর হঠাৎ অপ্রত্যাশিতভাবে মেরিয়ানের মুখে কথাটা শুনে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল মিলার্ড। ভাবছে, কানে ঠিক শুনলাম তো? ওকে পছন্দ করে, ভালবাসে মেরি? ভয়ে ভয়ে মেরির হাত ধরল মিলার্ড। টের পেল শীতে কাঁপছে বেচারি। আলতো করে টান দিল মিলার্ড, বাধা এল না মেরির তরফ থেকে। মিলার্ডের চওড়া পেশিবহুল কাঁধে মাথা রেখে ফিসফিস করে সে বলল, ‘ভয় করছে, জো। বুঝতে পারছি তোমার কিছু হয়ে গেলে সইতে পারব না আমি, মরে যাব।’
‘চিন্তা কোরো না, মেরি,’ মিষ্টি একটা গন্ধ চুলে, নাক ডুবিয়ে শ্বাস টানল মিলার্ড। ‘জেনে গেছি তুমি আমাকে ভালবাস, আর কখনও ঝুঁকি নেব না আমি।’
‘নিতে দেব না,’ ফিসফিস করে বলল মেরিয়ান।
বিধাতা অলক্ষে হাসলেন।