ধাওয়া – ১৩

তেরো

এঞ্জিনিয়ারের সীট থেকে ম্যাকেনলিকে উঠিয়ে দিয়ে নিজে বসল মিলার্ড। ওরা বুঝতে পারছে না ট্রেনের গতি কমে আসছে কেন। ডায়াল, ভালভ আর লিভারগুলো পরীক্ষা করে দেখছে মিলার্ড। থ্রটল টেনে দেখল পুরো খুলে দেয়া আছে। গতি না বাড়ালেও অন্তত সমান থাকার কথা, কমে যাচ্ছে কেন? ক্যাবের দরজায় দাঁড়িয়ে আছে ম্যাকেনলি, চিন্তিত চেহারায় গলা বাড়িয়ে ফেলে আসা ট্র্যাক দেখছে।

কিছুক্ষণ পর ঘাড় ফিরিয়ে সে বলল, ‘ওরা আসছে! ট্রেন আরও জোরে না চললে দশ মিনিটের মধ্যেই খুনির দল ধরে ফেলবে আমাদের।’

‘চেষ্টা করেছি, জোরে না চললে আমি কী করব!’ হাতের তালুতে কপালের ঘাম মুছল মিলার্ড।

হতাশ ভঙ্গিতে শ্রাগ করল ম্যাকেনলি, হুকে ঝুলন্ত এঞ্জিনিয়ারের ওপর দৃষ্টি স্থির হলো তার। বাচ্চা ছেলেকে নামাচ্ছে এমন ভঙ্গিতে মোটা লোকটাকে হুক থেকে ছাড়িয়ে মেঝেতে নামাল সে, ঘাড়ে চেপে ধরে দরজা দিয়ে বাইরে তাকাতে বাধ্য করে বলল, ‘ঘোড়া ছুটিয়ে আসছে যে লোকগুলো তাদের চেনো? ওরা খুনে ডাকাত, ট্রেন ডাকাতি করতে চাইছে। কথাটা তোমার মোটা মাথায় ঢুকিয়ে নাও, ওরা আমাদের ধরে ফেললে…’ কথা শেষ না করে বামহাতে গলায় পোঁচ মারার ভঙ্গি করল ম্যাকেনলি, চেহারা দেখে বুঝতে পারল ইঙ্গিতের অর্থ ধরতে পেরেছে এঞ্জিনিয়ার।

জিভ দিয়ে শুকনো ঠোঁট ভিজিয়ে ঘন ঘন মাথা ঝাঁকাল লোকটা। আরেকবার তার ঘাড় ধরে ঝাঁকি দিল ম্যাকেনলি। ‘ট্রেনের স্পীড কমে যাচ্ছে, ওরা এগিয়ে আসছে, ব্যাপারটা কী?’

‘স্টিম, কাঁপা হাতে একটা ডায়াল দেখাল এঞ্জিনিয়ার, ‘স্টিম শেষ হয়ে যাচ্ছে, বয়লারে কয়লা দিতে হবে।’

লোকটাকে ছেড়ে হাতে বেলচা তুলে নিল ম্যাকেনলি, বড় বড় নরম কয়লার চাক ফেলতে লাগল ফায়ারবক্সে। আগুন বেড়ে উঠতেই প্রেশার গজের নিম্নগতি বন্ধ হয়ে গেল। মনে হলো যেন কখনও নড়বে না কাঁটা, এক জায়গায় স্থির হয়ে আছে। তারপর অতি ধীরে উঠতে শুরু করল।

দরজা দিয়ে মাথা বের করে ম্যাকেনলি দেখল শেষ কোচের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে লোকোর দল। ট্রেনের গতি বেড়ে যাওয়ায় এগিয়ে আসতে পারছে না, তবে পিছিয়েও যাচ্ছে না ওরা। সবার সামনে লোকো, স্যাডলবুট থেকে একটা লিভার অ্যাকশন কারবাইন বের করে ক্যাব লক্ষ্য করে গুলি করল সে। সময়মত মাথা সরিয়ে নিল ম্যাকেনলি, দরজায় লেগে ছিটকে চলে গেল বুলেট।

ম্যাকেনলিকে তাড়াহুড়ো করে ফায়ারবক্সে কয়লা ঢালতে দেখে চোখ কপালে উঠল এঞ্জিনিয়ারের, কানের কাছে মুখ নিয়ে চেঁচিয়ে বলল, ‘গজ দেখো! আর কয়লা দিলে ফেটে যাবে বয়লার, কিন্তু এঞ্জিনের গতি বাড়বে না। অনেক বেশি বোঝা, এঞ্জিন এরচেয়ে বেশি জোরে টানতে পারছে না।’

.

মার্শালের অফিস থেকে মেয়রকে বেরতে দেখে লোকজন অবাক হয়ে গেল। জীবনে প্রথম গানবেল্ট আর সিক্সশুটার ঝুলিয়েছে মেয়র, চেহারায় শহুরে পরিপাটি ভাব নেই। পায়ে পায়ে হাঁটছে মার্শাল, তার চেহারা-পোশাকের অবস্থা আরও করুণ। একটা থ্রী কোয়ার্টার প্যান্টে গানবেল্ট ঝুলিয়েছে সে, হাতে একটা শটগানও শোভা পাচ্ছে।

ডিপোর দিক থেকে অস্পষ্ট গর্জন শুনে তাকাল মেয়র। চওড়া রাস্তার পুরোটা জুড়ে মিছিল করে হেঁটে আসছে ওরা, শহরের ছেলে-বুড়ো থেকে নিয়ে কেউ বাদ পড়েনি। সবার সামনে হাঁটছে প্রোগ্রেস থেকে ট্রেনে উঠে রওয়ানা হওয়ার কথা যেসব যাত্রীর, তারা। স্টেশনে ট্রেন না থামায় রেগে গেছে সবাই। যাত্রীরা রেগেছে টিকেট কেটেও রওয়ানা হতে না পেরে, শহরের লোকজন খেপেছে ব্যাংকের টাকা নামানো হয়নি তাই। উপযুক্ত কৈফিয়ত দিতে হবে কর্তৃপক্ষকে, জবাব শুনতে আসছে সবাই।

‘ওদের হাবভাব ভাল ঠেকছে না, মিস্টার মেয়র। ‘ ভয় পেলেও সাহস দেখানোর চেষ্টা করল মার্শাল উইলকার, ‘আপনি আমার অফিসে ঢুকে পেছন দরজা দিয়ে চলে যান, আমি সবাইকে বুঝিয়ে শুনিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করছি।’

‘বলার জন্য ধন্যবাদ, উইলকার, এখন বুঝতে পারছি তোমাকে মার্শাল করে ভুল করিনি। কিন্তু, আমি সবার সামনে চলে গেলে বদনাম হবে। বুড়ো র‍্যানডলফকে তো চেনোই, মেয়র হওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে লোকটা। নির্বাচনের আগে আমাকে কাপুরুষ বলবে সেই সুযোগ তাকে দিতে পারি না, আমি থাকছি।’ হাঁটুর কাঁপুনি থামাবার জন্য বোর্ডওয়াকের পাশে একটা খুঁটিতে হেলান দিল মেয়র। ভেতরে ভেতরে আতঙ্কে কুঁকড়ে গেছে, কিন্তু মুখে স্মিত হাসি।

‘প্রিয় প্রোগ্রেসবাসীগণ,’ মিছিল সামনে এসে থমকে দাঁড়াতেই নাটকীয় ভঙ্গিতে দু’হাত শূন্যে ছড়িয়ে দিল সে। হৈচৈ, হট্টগোল কিছুটা স্তিমিত হয়ে এলে গলা কাঁপিয়ে আবেগ ঢেলে বলল, ‘আমি জানি সবাই বিরক্ত, রেগে আছে, জানতে চায় আজকের ঘটনার কারণ। জানার অধিকারও আছে প্রত্যেকের। আমরা গুটিকয়েক গুরুত্বপূর্ণ লোক যারা খবরটা জানতাম তারা এত ব্যস্ত ছিলাম যে অন্যদের জানানোর সময় করে উঠতে পারিনি।’

ভিড়ের মধ্যে কর্কশ স্বরে চেঁচাল একজন, ‘এখন সময় করে উঠতে পারবে, কেউ তোমার লেজ মুচড়ে আটকে রাখেনি, কী বলবে বলে ফেলো তাড়াতাড়ি।’

একমুহূর্ত নীরব থেকে কী বলা হয়েছে বুঝে নিল জনতা। তারপর হাসল। জমাট বাঁধা উত্তেজনা কেটে গেল খানিকটা। সুযোগের পুরো সদ্ব্যবহার করে সবার চেয়ে জোরে হাসল মেয়র, যেন চমৎকার কোনও কৌতুক শুনেছে। পরিবেশ স্বাভাবিক হয়ে আসছে বুঝে হাত নেড়ে বক্তৃতা শুরু করল আবার।

‘গত দু’দিন আগে আমরা জানতে পেরেছি যে একদল আউট-ল এসেছে ব্যাংক লুটে নিয়ে যেতে। দুর্বৃত্তরা ঠিক করে ট্রেন স্টেশনে থামলেই হামলা চালাবে। স্টেশনে তোমাদের চোখের সামনে যে লোকগুলো ট্রেনের পেছনে ছুটে বেরিয়ে গেল তারাই ওরা। প্রোগ্রেসের মেয়র হিসেবে আমি চাইনি তোমাদের আগে জানাতে, কারণ ওদের বাধা দিতে গেলে আমার এই শহরের অনেক ভাই খুন হয়ে যেত। আমার দোষে কেউ মারা গেলে নিজেকে জীবনেও ক্ষমা করতে পারতাম না, আত্মহত্যা করতে হত ব্যর্থতা সইতে না পেরে।’

হাততালির আশায় সবার ওপর চোখ বোলাল মেয়র। কিন্তু সময় নির্বাচনে ভুল করে ফেলেছে, এখন খোশ মেজাজে নেই জনতা, নীরবে তাকিয়ে আছে দিক নির্দেশনার জন্য। মেয়র এই সুযোগে নির্বাচনী প্রচারণাও চালিয়ে নেবে ভেবেছিল, কিন্তু মার্শাল উইলকারের জন্য পারল না। মার্শাল তার কানের কাছে বলল, ‘আউট-লরা ট্রেন ধরে ফেললে…’

মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিল মেয়র, হাত তুলে জনতাকে গুঞ্জন বন্ধ করতে ইশারা করে বলল, ‘মার্শাল মিলার্ড আর তার সঙ্গী প্রোগ্রেসের মাইল দুই তিনেক দূরে কোথাও চলন্ত ট্রেনে উঠেছে, তারপর ক্রুদের বুঝিয়েছে স্টেশনে ট্রেন না থামিয়ে বেরিয়ে যেতে। কিন্তু কতক্ষণ ওরা নিজেদের বাঁচাতে পারবে? বেশিক্ষণ না! ধাওয়া করে আউট-লরা ওদের ধরে ফেললেই সব শেষ হয়ে যাবে, ঠেকানোর কোনও উপায় থাকবে না। আমি অনুরোধ করছি সুস্থ সবল প্রত্যেকে অস্ত্র হাতে তুলে নিক, পাসি নিয়ে আমরাও যাব, উল্টো ধাওয়া করব আউট- লদের।’

মেয়রের কথা ওদের মনঃপূত হয়েছে, হৈহৈ করে উঠল জনতা। দ্রুত দৌড়ে বেশিরভাগ লোক রাস্তা ফাঁকা করে চলে গেল অস্ত্র নিয়ে আসতে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে এল তারা অপেক্ষমাণ মেয়রের কাছে। প্রত্যেকেরই হাতে কিছু না কিছু আছে, সবাই পছন্দ মত অস্ত্র নিয়ে এসেছে। শটগান, রাইফেল, কুঠার থেকে নিয়ে ধারাল সব কিছুই দেখা গেল তাদের হাতে, এমনকী কয়েকজনের হাতে বেসবল ব্যাটও আছে।

গাড়ি, ক্যারিজে রাস্তা ভরে গেছে; অনেক কষ্টে ওয়্যাগন চালিয়ে এগিয়ে এল স্থানীয় আণ্ডারটেকার অ্যাডাম। রওয়ানা হবার সময় যারাই তাকে দেখল মনে মনে প্রার্থনা করল যাতে ওই ওয়্যাগনে করে ফিরতে না হয়। অ্যাডামের পাঁশুটে চেহারা দেখে যাদের যাবার ইচ্ছে দূর হয়ে গেল তারাও শেষ পর্যন্ত মহিলাদের সামনে মান ইজ্জত খোয়াতে রাজি হলো না, ছুটল ট্রেন যেদিকে গেছে সেদিকে।

মেয়রের পেছনে রেল ট্র্যাক ধরে এগুচ্ছে ওরা। বিশেষ ব্যবস্থা করা হয়েছে মেয়রের জন্য, হস্তচালিত রেল কার্টে চড়ে যাচ্ছে সে। চারজন গায়ের জোরে লিভার আগুপিছু করে দ্রুতগতিতে ছোটাচ্ছে কার্টকে, মজাসে বসে বসে উৎসাহ দিচ্ছে মেয়র।

.

ম্যাকেনলির কানের কাছে মুখ নিয়ে কী যেন বলল মোটা এঞ্জিনিয়ার, মাথা ঝাঁকিয়ে হাসল বিশালদেহী প্রৌঢ় আউট-ল। কাঁধ চাপড়ে প্রশংসা করে মিলার্ডের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ব্যবস্থা হয়ে গেছে, জো বয়, ফায়ারবক্সে আরও কয়লা না দিলেও জোরে ছুটবে আমাদের ট্রেন।’

মিলার্ডকে অবাক চোখে তাকাতে দেখে ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করল এঞ্জিনিয়ার। এতক্ষণে তার বিশ্বাস এসে গেছে যে ওরা ডাকাত নয়, সাহায্য করতে উন্মুখ হয়ে উঠেছে লোকটা, চায় না আসল ডাকাতরা ট্রেনের কাছাকাছি এসে হুমকি সৃষ্টি করুক।

পাতলা গোঁফে তা দিয়ে সে বলল, ‘বাড়তি কোচ বইতে হচ্ছে বলেই সাড়া দিচ্ছে না এঞ্জিন, যদি বাড়তি বোঝা ঝেড়ে ফেলা যায় তা হলে অন্তত দশ মাইল বেড়ে যাবে গতি। প্যাসেঞ্জার কোচগুলো ট্রেন থেকে আলাদা করে দিতে হবে, একজনকে গিয়ে কাপলিঙ পিন খুলতেই হবে কাজটা করতে হলে।’

মুহূর্তে বুঝে ফেলল মিলার্ড এঞ্জিনিয়ারের বক্তব্য, হাসিমুখে সীট ছেড়ে উঠে যন্ত্রপাতির সামনে বসে ট্রেনের দায়িত্ব নিতে ইশারা করল লোকটাকে এঞ্জিনিয়ার সীটে বসে পড়ার পর তাকাল সে প্রৌঢ় আউট-লর দিকে, শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি না আমি?’

দু’জনেই সচেতন যে ছাদে উঠে যাত্রীদের কোচের আগের কাপলিঙ পিন খোলা আউট-লদের উপস্থিতিতে প্রায় অসম্ভব, তবু প্রায় চেঁচিয়ে উঠল ম্যাকেনলি, ‘আমি! আমার চেয়ে সিক্সগানে তোমার হাত অনেক ভাল, কাভার দাও তুমি।’

আগেও ওরা গানফাইটে মুখোমুখি হয়েছে দু’জন। মিলার্ড জানে ম্যাকেনলি মিথ্যে মোটেও বলেনি। গতবারে মিলার্ডের সিক্সগানে গুলি ছিল না, তবে আগে ড্র করতে পেরেছিল। ম্যাকেনলি প্রতিপক্ষের অস্ত্রে গুলি ফুরিয়ে গেছে বলে শেষ মুহূর্তে ট্রিগারে টান দেয়নি, তবে জানে লোডেড সিক্সগান হাতে ডুয়েল লড়লে কে জিতবে। লক্ষ্যভেদ সম্বন্ধেও ওর মনে কোনও সন্দেহ নেই, সে নিজে ছাড়া দুনিয়ার আর কারও সাধ্য নেই মিলার্ডের ধারে কাছে আসতে পারে।

ম্যাকেনলির নির্বিঘ্ন চেহারা দেখে মনে মনে দ্বিগুণ সতর্ক হয়ে উঠল মিলার্ড। আউট-লদের ঠেকানোর ব্যাপারে লক্ষ্যভেদ করতে বিন্দুমাত্র ভুল হয়ে গেলেও ম্যাকেনলিকে বাঁচানো যাবে না। ক্যাবের জানালা দিয়ে শরীর বের করে এক নাগাড়ে গুলি শুরু করল সে।

বিপদ বুঝে গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে পিছিয়ে গেল আউট-লর দল, নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে অনুসরণ করছে এখন। মিলার্ডের কাভার নিয়ে ছাদে উঠল ম্যাকেনলি, এক্সপ্রেস কার পেরিয়ে প্ল্যাটফর্মে নামল।

এক্সপ্রেস কারের ভেতরে এক লক্ষ ডলার পাহারা দিচ্ছে চারজন গার্ড, বাইরে কী ঘটছে দেখতে না পেলেও আন্দাজ করতে পারছে ওরা। প্রত্যেকের চেহারা ভয়ে রক্তশূন্য হয়ে গেছে, এখনও বিশ্বাস করতে পারছে না যে এ-যুগেও ট্রেনে ডাকাত পড়তে পারে। এক্সপ্রেস কার লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়া হলে আহত হতে হবে, ভারী স্টীলের সিন্দুকের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল ওরা।

জঙ ধরা কাপলিঙ পিন ধরে গায়ের জোরে টান দিল ম্যাকেনলি, এক্সপ্রেস কার থেকে যাত্রীবাহী কোচগুলোকে আলাদা করে দিতে চাইছে। একটানা দেড় মিনিট ম্যাকেনলির ঘাম ঝরিয়ে শেষ পর্যন্ত খুলল পিন। খুব ধীরে পিছিয়ে যেতে শুরু করল যাত্রীদের বগিগুলো। মাঝখানের দূরত্ব যখন ফুট বিশেক, বাঁক নিতে শুরু করল ট্র্যাক। শেষ বগির আড়াল নিয়ে এগিয়ে এল লোকো, গুলি করল ম্যাকেনলির মাথা লক্ষ্য করে।

কানের কাছে লোহায় পিছলে বেরিয়ে গেল বুলেট, পাল্টা জবাব দিল ম্যাকেনলি। গুলি লাগল না, আগেই ঘোড়া পিছিয়ে সরে গেছে আউট-ল। দূর থেকে গুলি করলেও কাছে আসার ঝুঁকি আর নিচ্ছে না তারা।

প্রাণ হাতে করে মই বেয়ে এক্সপ্রেস কারের ছাদে উঠল ম্যাকেনলি, দৌড় দিল টেণ্ডার লক্ষ্য করে। এক ঝাঁক গুলি বাতাসে গুঞ্জন তুলে পাশ কাটাল ওকে। মিলার্ড গুলি ছুঁড়ে আউট-লদের ব্যস্ত না রাখলে কোনদিনই টেণ্ডার পর্যন্ত পৌঁছতে পারত না ম্যাকেনলি, তার ওপর সহজ টার্গেট প্র্যাকটিস করত আউট-লর দল।

লাফ দিয়ে কয়লার ওপর পড়ল প্রৌঢ় আউট-ল, দেখল এঞ্জিনিয়ার নিজের সীটে বসে কন্ট্রোল নিয়ে নাড়াচাড়া করছে। হাঁপাতে হাঁপাতে একটা বেলচা হাতে তুলে নিল সে, মিলার্ডের দেখাদেখি ফায়ারবক্সে কয়লা দিতে শুরু করল। কিছুক্ষণ পর ক্যাবের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখল পাল্টা গুলি না হওয়ায় সাহস বেড়ে গেছে আউট-লদের, প্রায় এক্সপ্রেস কারের পেছনের প্ল্যাটফর্ম পর্যন্ত পৌঁছে গেছে।

জানালা দিয়ে কোল্ট বের করে সাবধানে লক্ষ্যস্থির করল ম্যাকেনলি, গুলি করার পর চেহারা হাসি হাসি হয়ে গেল। একহাতে রাইফেল উঁচিয়ে ধরে প্ল্যাটফর্মে ওঠার জন্য লাফ দিয়েছিল এক আউট-ল, মাঝ পথে যেন ধাক্কা খেয়ে থেমে গেল। দেহটা শূন্যে ঝুলে থাকল এক সেকেণ্ড, তারপর আছড়ে পড়ল কাঁকর ভর্তি ট্র্যাকের ওপর। নড়ছে না একবিন্দু, নড়বেও না আর কোনদিন।

গতি কমিয়ে পিছিয়ে গেল আউট-লর দল, ধাওয়া করছে এখনও, তবে দূরত্ব বজায় রাখছে সাবধানতার সঙ্গে। শিক্ষা হয়ে গেছে ওদের, অনর্থক গুলিও খরচ করছে না এখন আর, জানে কয়লা শেষ হলেই প্রতিপক্ষ অসহায় হয়ে পড়বে, তখন বাগে পাওয়া যাবে ম্যাকেনলিদের 1

পেছনে ফেলে আসা যাত্রীবাহী কোচগুলোর সম্মুখ গতি একেবারে থেমে গেল অবশেষে। নেমে এসে রুক্ষ বিরান প্রান্তরে চোখ বোলাল যাত্রীরা, গ্র্যাণ্ড মাউন্টিন রেলওয়ে সম্বন্ধে তাদের একান্ত গোপন মতামত প্রকাশ করতে এই মুহূর্তে দ্বিধা করছে না কেউ। টয়লেট থেকে বেরিয়ে একটা ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল কণ্ডাক্টর আর গার্ড, খেপে ওঠা যাত্রীদের চোখের সামনে ঘোরাফেরা করে মার খাওয়ার ইচ্ছে নেই তাদের। –

পার হয়ে আসা ঢালু জমিনের দিকে তাকাল সবাই শব্দ শুনে। অস্পষ্ট আওয়াজ জোরাল গর্জনে পরিণত হলো ধীরে ধীরে। হঠাৎ দেখা গেল উদ্ভট বাহনটাকে।

রেলরোডের একটা হ্যাণ্ডকার ছুটে আসছে ট্র্যাক ধরে। এসব বাহন ট্র্যাক বসাতে আসা কর্মী আর ভারী মালপত্র বয়ে নিয়ে যায় সাধারণত। চারজন লোক পাম্প করার ভঙ্গিতে লিভার টানছে পাগলের মত, ফলে হ্যাণ্ডকারের গতি একেবারে কম নয়। মেয়র উৎসাহ দিয়ে চলেছে ওদের। মিষ্টি কথার জালে আটকা পড়ে গেছে লোকগুলো, কোনদিকে না তাকিয়ে কাজ করে যাচ্ছে এক মনে।

হ্যাণ্ডকারের সামনে বসে আছে মেয়র উইলিয়াম, কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে তার পিঠ কোচগুলোর দিকে। মার্শাল আর তার ব্যস্ত তিন সঙ্গীও মাথা তুলে তাকাচ্ছে না, দেখছে না যে সামনের ট্র্যাক জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে কাঁচা লোহার বগি। সোজা ছুটে চলেছে হ্যাণ্ডকার, যাত্রীরা চেঁচিয়ে সাবধান না করলে গুরুতর আহত হত সবাই।

চিৎকার চেঁচামেচি শুনে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল মেয়র, স্থির বগিগুলো বিশ- পঁচিশ গজ দূরে দেখে চোখ বড় বড় হয়ে গেল, আতঙ্কে ঘাড়ের কাছে চুল দাঁড়িয়ে গেল তার। ‘বাঁচতে যদি চাও এখনই লাফ দাও,’ কথাটা কোনমতে বলেই নিজে আর দেরি করল না মেয়র, লাফ দিয়ে পড়ল একটা ঝোপের ওপর। বাকিরাও তার দৃষ্টান্ত অনুসরণ করতে সময় নিল না। পাঁচ সেকেণ্ডের মাথায় প্রচণ্ড শব্দে বগির গায়ে বাড়ি লাগাল হ্যাণ্ডকার, ট্র্যাক থেকে চার-পাঁচ হাত দূরে ছিটকে গিয়ে পড়ল।

উঠে দাঁড়িয়ে কাপড় ঝাড়ল মেয়র, কৌতূহলী যাত্রীদের অজস্র প্রশ্ন উপেক্ষা করে উত্তেজিত স্বরে বলল, ‘হাত লাগাও সবাই, হ্যাণ্ডকার বগি পার করে ট্র্যাক তুলে ফেলো, নষ্ট করার মত সময় নেই একবিন্দু!’

কয়েকজন যাত্রী সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিল, হ্যাণ্ডকারটাকে শূন্যে তুলে বগি পার করে ট্র্যাকে বসিয়ে দেয়া হলো। কোনমতে ধন্যবাদ দিয়েই লাফ দিয়ে নিজের আসনে গিয়ে বসল মেয়র, মার্শাল আর বাকি তিনজন হ্যাণ্ডেল পাম্প করতে শুরু করল কারে উঠেই। অল্পক্ষণের মধ্যেই অপসৃয়মান ট্রেনের পিছু পিছু দ্রুত গতি তুলে ছুটতে শুরু করল হ্যাণ্ডকার।

ওদিক থেকে চোখ ফিরিয়ে আঁতকে উঠল যাত্রীরা, এক দৌড়ে গিয়ে নিজেদের কোচে ঢুকে পড়ল। এতক্ষণে ওরা বুঝতে পারছে এত গর্জন কীসের। পশ্চিমের ইতিহাসের সবচেয়ে উদ্ভট যন্ত্র মিছিল দেখতে পেল ওরা। কী নেই মিছিলে; গাড়ি, মোটর সাইকেল, ওয়্যাগন, বাকবোর্ড- সব বিপজ্জনক গতি তুলে ছুটে যাচ্ছে। ওগুলোর ড্রাইভাররা সবাই যেন উন্মাদ হয়ে গেছে, কী এক আশায় যেন জীবন হাতে নিয়ে চলেছে, একটু দেরি হলেই যেন ঘটে যাবে চরম সর্বনাশ!

বগির দু’পাশ দিয়ে পার হয়ে গেল অজস্র যানবাহন। অনেকখানি সামনে হ্যাণ্ডকারে মেয়রকে দেখা যাচ্ছে, রাইফেল নাচিয়ে সবাইকে দ্রুত এগোতে ইশারা করছে সে।

অনেক দূরে জুনিপার পাসে গরু চরাচ্ছে এক কাউহ্যাণ্ড। গরুগুলোকে ট্র্যাকের দু’পাশে ছেড়ে দিয়ে স্যাডলে আরাম করে বসেছে সে, স্প্যানিশ গিটারে প্লাক করে বিমর্ষ সুর ছড়িয়ে দিচ্ছে চারপাশে। গুনগুন করে গলাও মেলাচ্ছে, অদ্ভুত সুন্দর গলা তার, সুরের মূর্ছনায় বিভোর হয়ে আছে যেন একাকী প্রকৃতি।

বেশিক্ষণ কপালে সুখ সইল না তার, হঠাৎ শুনতে পেল ট্রেনের তীক্ষ্ণ হুইসল। ঢালের ওপার থেকে নাক উঁচু করল কুৎসিত দর্শন লোকোমোটিভ এঞ্জিন। প্রায় লেজহীন এঞ্জিনের প্রচণ্ড গতি দেখে চোখ কপালে উঠল কাউহ্যাণ্ডের, গিটার শোল্ডার স্ট্র্যাপে ঝুলিয়ে নিয়ে ঘোড়ার পেটে স্পার ছোঁয়াল সে। মাথার হ্যাট খুলে বাড়ি লাগাল গরুগুলোর পেছনে। ট্রেন আসার কয়েক সেকেণ্ড আগে শেষ গরুটা ট্র্যাক থেকে সরাতে পারল সে।

দম ফিরে পাবার আগেই বেচারা দেখল গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে ট্রেনের পিছু পিছু ছুটে আসছে দশ-পনেরোজন অশ্বারোহী। পিস্তল, বন্দুকের আওয়াজে ভয় পেয়ে গরুগুলো দিগ্বিদিকে ছুটল। স্ট্যাম্পিড থেকে নিজেকে কোনমতে বাঁচাল কাউহ্যাণ্ড। আউট-লরা তাকে পার করে চলে যাবার পর একটানা দশ মিনিট অমানুষিক পরিশ্রম করল সে, অবশেষে গরুগুলো রাউণ্ডআপ করতে পারল। গালির স্টক ফুরিয়ে যাওয়ায় চুপ হয়ে গিয়েছিল সে, কিন্তু ঢালের দিকে তাকিয়ে নতুন নতুন গালি মনে আসতে লাগল তার।

ট্র্যাক ধরে এগিয়ে আসছে একটা হ্যাণ্ডকার; ওটার এক হাজার গজ দূরে পুরো ঢাল জুড়ে মাথা তুলেছে অসংখ্য গাড়ি, মোটর সাইকেল, বাগি আর ওয়্যাগন। যান্ত্রিক গর্জনে মনে হলো কাঁপছে ধরণী। পালাতে শুরু করল এইমাত্র রাউণ্ডআপ করা আতঙ্কিত গরুগুলো। এবার আর গরুগুলোকে নিরাপদে পার করার চিন্তা মনেও আনল না কাউহ্যাণ্ড, গরুর জীবন গরু না বাঁচালে তার কিছু করার নেই, স্পার দাবিয়ে নিজের জান বাঁচাতে একটা উঁচু রিজের দিকে ছুটল সে।

.

মাঝে মাঝে ক্যাবের জানালা থেকে গুলি করে দূরত্ব বজায় রাখতে আউট-লদের বাধ্য করছে ম্যাকেনলি। শেষবার ট্রিগার টানতেই শূন্য খোলের ওপর পড়ল হ্যামার, পকেট হাতড়ে গুলি বের করে চেম্বারে ভরল সে। এঞ্জিনিয়ারের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল রাইফেল আছে কি না।

‘ওখানে,’ মেঝেতে পড়ে থাকা একটা লম্বা লোহার বাক্স দেখিয়ে দিল এঞ্জিনিয়ার।

বাক্সে শোয়ানো ঝকঝকে উইনচেস্টার হাতে তুলে নিল ম্যাকেনলি, কয়েক বাক্স গুলিও রয়েছে ওখানে। খুশিতে দাঁত বেরিয়ে পড়ল প্রৌঢ় আউট-লর, দ্রুত হাতে উইনচেস্টার লোড করল সে। পুরানো একটা নোঙরা ম্যাগাজিনের তলা, থেকে বেরল ছোট কয়েক টুকরো ফিউজ সহ দুটো দস্তার ক্যাপ লাগানো ডিনামাইটের স্টিক। ‘এগুলো এখনও ঠিক আছে?’ স্টিক দুটো উঁচিয়ে ধরে এঞ্জিনিয়ারের উদ্দেশে চেঁচাল ম্যাকেনলি।

নিশ্চিত নয় এমন ভঙ্গিতে শ্রাগ করল এঞ্জিনিয়ার। জানালা দিয়ে রাইফেলের নল বের করে তিনবার ট্রিগার টানল ম্যাকেনলি। শেষ গুলিটা মিস করল, তবে ওদের আর কখনোই ধাওয়া করবে না দু’জন আউট-ল। বাধ্য হয়েই খুন করতে হচ্ছে ম্যাকেনলিকে। প্রোগ্রেসে থেমে কয়লা না নেয়ায় ফুরিয়ে আসছে, শেষ মুহূর্তে শত্রু যত কম থাকে তত ওদের বাঁচার সম্ভাবনা বাড়বে।

অদৃশ্য হয়ে গেল আউট-লর দল। ওরা এখন ট্র্যাকের খুব কাছ দিয়ে ঘোড়া ছোটাচ্ছে, ফলে ম্যাকেনলি দেখতে পাচ্ছে না ওদের। দু’এক মুহূর্ত চিন্তা করে রাইফেল নামিয়ে রাখল ম্যাকেনলি। দাঁতে কামড়ে ছিঁড়ে ফেলল একটা স্টিকের দস্তার ক্যাপ, ডিনামাইটের ভেতর ফিউজ গেঁথে আগুন জ্বালল। প্রথমবার উজ্জ্বল আলো ছড়িয়েই নিভে গেল ফিউজ। সিগারে বড় করে টান দিয়ে দ্বিতীয়বার ফিউজে ছোঁয়াল সে। এবার একটানা জ্বলছে ফিউজ।

জানালা দিয়ে অর্ধেক শরীর বের করে গায়ের জোরে স্টিক ছুঁড়ল ম্যাকেনলি। দূরত্বের আন্দাজ চমৎকার হলো, লোকোর ঘোড়ার পায়ের কাছে গিয়ে পড়ল ডিনামাইট। ফাটল না। সময়ের হিসেবে ভুল করে ফেলেছে সে, ফিউজের আগুন এখনও ডিনামাইট স্টিক পর্যন্ত পৌঁছয়নি। শেষ আউট-ল ওটা পেরিয়ে পাঁচ গজ এগিয়ে আসার পর বিস্ফোরণ হলো প্রচণ্ড আওয়াজে, চমকে দেয়া ছাড়া কোনও ক্ষতি করতে পারল না ডিনামাইট।

ম্যাকেনলি দ্বিতীয় স্টিকে ফিউজ ঠেসে ঢুকিয়ে ছুঁড়ে মারল আগুন ধরিয়ে। এবার ফিউজের মাপ ঠিক ছিল, কিন্তু হাত গেছে ফস্কে, ঠিকমত ছুঁড়তে পারেনি এক্সপ্রেস কারের বন্ধ দরজার সামনে শূন্যে বিস্ফোরিত হলো ডিনামাইট। আতঙ্কে এমনিতেই কুঁকড়ে ছিল গার্ড চারজন, গায়ের কাছে জোরাল বোমা ফাটতে শুনে ভয়ে উন্মত্ত হয়ে উঠল। একজন দৌড়ে গিয়ে উল্টোদিকের স্লাইড ডোর টেনে খুলতে লাগল।

‘এক লাখ ডলার ফেলে চলে গেলে জেল হবে,’ বাস্তব বুদ্ধি লোপ পায়নি তেমন একজন গার্ড চেঁচিয়ে সাবধান করল সিন্দুকের আড়াল থেকে।

‘অন্তত জানে তো বাঁচব!’ দরজা খুলে বাইরে ঝাঁপ দিল গার্ড

‘চার্লি ঠিকই বলেছে, আমিও এখানে থেকে মরতে পারব না,’ উঠে দাঁড়িয়ে বলল গার্ডদের নেতা।

‘আমিও একমত।’ তাকে অনুসরণ করল তৃতীয় গার্ড।

‘দাঁড়াও, দাঁড়াও আমাকে ফেলে যেয়ো না,’ লাফ দিয়ে উঠে দৌড় দিল টনটনে বাস্তব বুদ্ধিসম্পন্ন গার্ড, দেখা গেল সঙ্গীদের আগেই ট্রেন থেকে ঝাঁপ দিয়েছে সে।

ডিনামাইট ছুঁড়েই জায়গা বদল করল ম্যাকেনলি আর মিলার্ড। সিক্সগান হাতে আউট-লদের ওপর চোখ রাখল মিলার্ড, জানে লোকগুলো একবার ট্রেনে উঠে পড়তে পারলে প্রাণে বাঁচবে না ওরা কেউ। ম্যাকেনলি ফায়ারবক্সে কয়লা ভরছে, কাজে ব্যস্ত এঞ্জিনিয়ার প্যানেল থেকে মুখ তুলে দেখল ওদের অজান্তে উল্টোদিক দিয়ে এগিয়ে এসেছে তিন আউট-ল। ঘোড়ার ওপর ঝুঁকে পড়ে পিস্তল বের করছে তারা। চিৎকার করে সাবধান করার চেষ্টা করল এঞ্জিনিয়ার, তার গলার আওয়াজ এঞ্জিনের গর্জনে তলিয়ে গেল। ট্রেনের গতি কমে যাবে জেনেও বাধ্য হয়ে স্টিম লিভার ধরে টান দিল সে।

সাদা বাষ্পের গরম মেঘ ঢেকে দিল আউট-লদের। পাঁচ সেকেণ্ড পর বাম্প সরলে দেখা গেল তাপ সইতে না পেরে পিছিয়ে আড়ালে চলে গেছে লোকগুলো।

স্বস্তির শ্বাস ফেলে আবার ট্র্যাকের দিকে তাকাল এঞ্জিনিয়ার, পরমুহূর্তে আতঙ্কে গলা দিয়ে আওয়াজ বের হলো না তার। বিকৃত চেহারায় দেখল সামনে তীক্ষ্ণ বাঁক নিয়েছে লাইন, গভীর একটা পাথুরে ক্যানিয়নের ওপর দিয়ে চলে গেছে। চারপাশে এত বিপদ দেখে সামনের এই জায়গাটার কথা মনেই ছিল না তার। দুর্বল সরু একটা ব্রিজের ওপর দিয়ে পার হতে হবে ক্যানিয়ন, ব্রিজটাও বাঁকা। ট্র্যাকের পাশে মাটিতে খুঁটি পুঁতে সাইনবোর্ড টাঙানো হয়েছে। ওতে লেখা: সর্বোচ্চ গতিসীমা ঘণ্টায় দশ মাইল।

তরিত্ব সিদ্ধান্ত নিল এঞ্জিনিয়ার, থ্রটল বন্ধ করে ব্রেক চাপল। কর্কশ শব্দে আটকে গেল লোহার হুইলগুলো, না ঘুরেই চারপাশে আগুনের ফুলকি ছড়িয়ে দিল।ট্রেনের গতি কমল না মোটেও, পিছলে এগোচ্ছে সমান জোরে। ঝাঁকি ___ করে ম্যাকেনলি আর মিলার্ড বুঝল গোলমাল হয়ে গেছে কোথাও।

ঘাড় ফিরিয়ে ওরা দেখল সীট ছেড়ে লাফ দিয়ে উঠেছে এঞ্জিনিয়ার। দরজার দিকে দৌড় দিয়ে লোকটা চেঁচাল, ‘সামনে বাঁক! লাফ দাও, ট্রেন উল্টে যাবে!’

এঞ্জিনিয়ারের শরীর দরজা থেকে অদৃশ্য হতেই সংবিৎ ফিরে পেল ম্যাকেনলি। হাতের বেলচা ফেলে রাইফেল তুলে নিয়ে দরজা দিয়ে লাফ দিল সে। সময় নষ্ট না করে ম্যাকেনলিকে অনুসরণ করল মিলার্ড। ঘাস ঢাকা জমিতে পড়ায় আহত হলো না ওরা, তবে গতির তীব্রতায় গড়িয়ে চলে গেল দশ-পনেরো ফুট।

উঠে দাঁড়িয়ে ওরা দেখল মাথার চুল খামচে ধরে হাঁটু গেড়ে বসে আছে এঞ্জিনিয়ার, ছুটন্ত ট্রেনের দিকে তাকিয়ে এক নাগাড়ে আক্ষেপ করছে, ‘আমার ট্রেন! আমার ট্রেন!’

বাঁকের কাছে পৌঁছে গেল ট্রেন, তারপর ট্র্যাক ধরে মোড় নিতে শুরু করল। একমুহূর্তের জন্য মনে হলো না উল্টে পেরিয়ে যেতে পারবে তীক্ষ্ণ বাঁক, কিন্তু তা হলো না। লাইন উপড়ে বেরিয়ে গেল লোহার মোটা হুইলগুলো, ব্রিজের স্টীলের রেলিঙ পাটকাঠির মত ভেঙে নিয়ে ছুটল ট্রেন। এঞ্জিনের পেছনে এক্সপ্রেস কারটাকে সহ উল্টে গেল টেণ্ডার, চারপাশে কয়লা ছড়িয়ে পড়ল। ভয়াবহ শব্দ তুলে মোচড় খেয়ে ছেঁচড়ে ক্যানিয়নের ভেতর খসে পড়ল ট্রেন। চার-পাঁচ সেকেণ্ড পর বাজ পড়ার মত গুরুগম্ভীর গর্জন শোনা গেল। বয়লার ফাটল বিকট শব্দে, তারপর চারদিকে নেমে এল নৈঃশব্দ। ক্যানিয়নের মেঝেতে চির বিশ্রাম নিচ্ছে যন্ত্রদানব।

ঘন কালো ধোঁয়া উঠছে ক্যানিয়নের ভেতর থেকে। সেদিকে তাকিয়ে আড়ষ্ট পায়ে এগোল ওরা। হাড় ভাঙেনি কোনও, তারপরও ওদের মনে হচ্ছে জোরে হাটলে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সব খুলে পড়ে যাবে। ক্যানিয়নের কিনারে দাঁড়িয়ে উঁকি দিল ওরা। চূর্ণবিচূর্ণ ট্রেনের অবস্থা দেখে কেঁদে ফেলার দশা হলো এঞ্জিনিয়ারের।

‘দুঃখ কোরো না, বেঁচে আছ সেজন্য ভাগ্যকে ধন্যবাদ দাও,’ সান্ত্বনা দিল ম্যাকেনলি।

মিলার্ডও কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু থেমে গেল পেছনে আউট-লদের গুলির শব্দ শুনে। বাঁকের আড়ালে থাকায় লোকগুলোকে দেখা যাচ্ছে না, তবে উল্লসিত চিৎকার শোনা যাচ্ছে। আউট-লরা বোধহয় কী ঘটেছে আঁচ করতে পেরেছে।

দৌড়ে ট্র্যাকের অন্য পাশে চলে এল ওরা। অসংখ্য বড় বড় গ্র্যানিট বোল্ডার পড়ে আছে, গা ঢাকা দিল একটার পেছনে। এত বিপদের মাঝেও বিস্ময় প্রকাশ করল ম্যাকেনলি মোটা এঞ্জিনিয়ারকে ওদের আগে দৌড়ে গন্তব্যে পৌঁছে যেতে দেখে।

‘পাঁচশো মিটার দৌড়ে চ্যাম্পিয়ান ছিলাম,’ ভুঁড়িতে হাত বুলিয়ে বলল এঞ্জিনিয়ার।

ঠোঁটে আঙুল তুলে কথা বলতে নিষেধ করল মিলার্ড। ক্যানিয়নের কিনারায় এসে ঘোড়া থামিয়েছে আউট-লরা। লোকোর হাসি পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছে ওরা পাথরের আড়ালে বসে।

‘ঠিক যা ভেবেছিলাম আমি, হাসির ফাঁকে ফাঁকে বলছে লোকো, ‘পুরো এক্সপ্রেস কারে আগুন ধরে যাওয়ার আগেই সিন্দুক সরাতে হবে। ওই যে ক্যানিয়নে নামার ট্রেইল। চলো, আমাদের জন্য এক লাখ ডলার অপেক্ষা করছে।’

‘ওদের একা মজা লুটতে দিচ্ছি না, আমি ওদের অনুষ্ঠানে অতিথি হব। কি, যাবে তোমরা কেউ?’ আউট-লদের ঘোড়ার খুরধ্বনি দূরে চলে যাওয়ার পর জানতে চাইল মিলার্ড।

‘আমি নেই এসবে,’ মাটিতে চিত হয়ে শুয়ে পড়ল এঞ্জিনিয়ার।

‘আমি আছি। চলো যাই,’ হাসল ম্যাকেনলি। একসঙ্গে পাথরের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল দু’জন।

এক্সপ্রেস কারের সামনে ঘোড়া বেঁধে নামল আউট-লরা। একটা স্লাইড ডোর অল্প একটু খুলে আছে, ধোঁয়া বের হচ্ছে ওখান দিয়ে। কয়েকজনের সাহায্য নিয়ে কাত হয়ে পড়ে থাকা এক্সপ্রেস কারে চড়ল লোকো, দরজার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখল গার্ডদের ভাঙা লণ্ঠন থেকে আগুন ধরে গেছে ভেতরে কয়েক জায়গায়। এক কোণে উল্টে পড়ে আছে সিন্দুক, ক্ষতি হয়নি কোনও।

‘ডারবি, হ্যারল্ড, বিলি, গ্রাণ্ডি তোমরা উঠে এসো,’ চেঁচিয়ে নিৰ্দেশ দিল লোকো। সে চাইছে ভালমত আগুন ধরে যাওয়ার আগেই এক্সপ্রেস কার থেকে সিন্দুক উদ্ধার করতে। একবার বের করতে পারলে চিন্তার কিছু নেই, ওর দলে তালার যাদুকর ইয়ান চ্যাপেল আছে, পাঁচ মিনিটও লাগবে না সিন্দুক খুলতে। ‘তোমরা বাকিরা সিন্দুক খোলার পর স্যাডলব্যাগে মাল ঢুকাবে,’ ডারবি আর তার সঙ্গীরা দরজা দিয়ে ধোঁয়া ভরা এক্সপ্রেস কারে ঢুকে পড়ার পর অন্যদেরকে বলল লোকো, ‘খেয়াল রেখো কোনও ঘোড়াকে যেন বেশি বোঝা টানতে না হয়। কেউ অতি লোভ করে পিছিয়ে পড়লে থামব না আমরা, ফেলে রেখে চলে যাব।’

এক্সপ্রেস কারের ভেতর কাশতে কাশতে জান খারাপ হয়ে গেল চার আউট- লর, ঘন কালো ধোঁয়ায় দম নেয়া প্রায় অসম্ভব। কোনমতে ভারী সিন্দুক দরজা দিয়ে ওপরে তুলে ধরল তারা। লোকোর নির্দেশে আরও দু’তিনজন এক্সপ্রেস কারের গায়ে উঠে ওটা সরিয়ে নিল, ঠেলে ফেলে দিল ওপর থেকে। চাবি বানানোর যন্ত্রপাতি নিয়ে সিন্দুকের দিকে দৌড়ে এল চামচিকের মত চিকন ইয়ান চ্যাপেল। কাছ থেকে দেখে শ্রদ্ধা ফুটে উঠল তার চোখে। এই সিন্দুক ভাল কোম্পানীর তৈরি যত্নের জিনিস, খুলতে মিনিট দশেক লাগবে।

সবাই এসে ঘিরে দাঁড়াল ইয়ান চ্যাপেলকে। সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন বোধ করছে না কেউ। পোড়া, দুমড়ে যাওয়া ট্রেনের অবস্থা দেখেই বুঝে গেছে এই ধ্বংসস্তূপে মানুষ বেঁচে থাকতে পারে না; অসম্ভব।

দু’জন আউট-লকে আরও ঝুঁকে দাঁড়াতে দেখল ওরা, তারপর শুনতে পেল সিক্সগানের গর্জন। আট-দশবার ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়ে মিলিয়ে গেল শব্দ। হুমড়ি খেয়ে ইয়ান চ্যাপেলকে নিয়ে মাটিতে পড়ল আউট-ল দু’জন। বিস্মিত হয়ে ওরা দেখল গাঢ় লাল রক্ত স্রোত গড়িয়ে যাচ্ছে ক্যানিয়নের মেঝেতে।

সবচেয়ে আগে সামলে নিল লোকো। এক দৌড়ে এক্সপ্রেস কারের আড়ালে সরে এল, সঙ্গীদের বুকে বুলেট ঢুকেছে দেখেই বুঝে গেছে কোনদিকে আছে শত্রু। হতভম্ব আউট-লদের চেঁচিয়ে সাবধান করল সে। ছিটকে খোলা জায়গা ছেড়ে সরে গেল সবাই, বোল্ডার আর এক্সপ্রেস কারের পেছনে গা ঢাকা দিল বেশির ভাগ আউট-ল। ইয়ান চ্যাপেল গা থেকে লাশ ঝেড়ে ফেলে সিন্দুকের পেছনে লুকাল। সারা দেহে হাত বুলিয়ে স্বস্তির শ্বাস ফেলল। আহত হয়নি সে, নিজের রক্ত লেগে নেই শরীরে।

‘কাউকে দেখতে পাইনি, তবে আমি জানি ওরা কোথায় আছে,’ এক্সপ্রেস কারের অন্য প্রান্ত থেকে চেঁচিয়ে বলল বাকশট। ‘সবাই কাভার দাও, ব্যাটাদের গর্ত থেকে বের করে আনছি আমি।’

তার কথার জবাবে গর্জে উঠল একটা সিক্সগান। ক্যানিয়নের দেয়ালে লেগে পিছলে গেল বুলেট, পাথরের সঙ্গে সংঘর্ষে চ্যাপ্টা হয়ে যাওয়া সীসা বাকশটের পায়ের কাছে পড়ল এসে।

‘লোকো, আমি দেখেছি ওদের!’ উত্তেজিত হয়ে উঠল এক আউট-ল। ‘ওই লাল রঙের বড় বোল্ডারটার পেছন থেকে গুলি করছে!’

‘হ্যারল্ড আর পারভিস, তোমরা এক্সপ্রেস কারের পেছন দিয়ে এগোও, ‘ নির্দেশ দিল লোকো। ‘ক্যানিয়নের উঁচু দেয়ালে উঠে ওদের পেছনে চলে যাবে। আমরা লাল পাথর লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়ে ব্যস্ত রাখছি শালাদের, তোমরা পেছন দিকে পজিশন নিলেই ফাঁদে আটকে রাখা যাবে। ড্যানি আর সাইমন যাও ওদের সঙ্গে। মাঝপথে লুকিয়ে অপেক্ষা করবে, যাতে সত্যিকার ক্রসফায়ার কাকে বলে বোঝে বাটপাড়ের দল।’

এক্সপ্রেস কারের আগুন বেড়ে উঠেছে, গলগল করে ধোঁয়া ছড়াচ্ছে চারপাশে, পটপট শব্দে পুড়ছে ভেতরের কাঠ। উজ্জ্বল দিনের আলোতেও ক্যানিয়নের ভেতরে কেমন যেন ভূতুড়ে পরিবেশ। বিধ্বস্ত ট্রেন আর পড়ে থাকা লাশগুলো দেখতে অবাস্তব লাগছে। লোকোর নির্দেশ মেনে ক্রল করে এগোল চার আউট-ল। এক্সপ্রেস কারের আড়াল পেরিয়ে এসে দৌড়াতে শুরু করল। একটানা বেশিক্ষণ খোলা জায়গায় থাকছে না কেউ, সঙ্গীদের কাভারিঙ ফায়ার শেষ হওয়ার আগেই লুকিয়ে পড়ছে বড় বড় বোল্ডারগুলোর পেছনে।

কয়েকবার ওদের দেখতে পেল মিলার্ড। কিছু করা সম্ভব হচ্ছে না। লক্ষ্যস্থির করে গুলি করতে হলে উঠে দাঁড়াতে হবে তাকে, কিন্তু আউট-লরা প্রায় একটানা গুলি ছুঁড়ছে বোল্ডার লক্ষ্য করে। আউট-লরা ধারণা করছে এখানে তারা দু’জনেই আছে, এই ভুল না ভাঙলে হয়তো বাঁচবে সে।

ক্যানিয়নের দেয়াল ঘেঁষা ঘন ঝোপের ভেতর অপেক্ষা করছে ম্যাকেনলি। আউট-লদের মনোযোগ অন্যদিকে বুঝে হামাগুড়ি দিয়ে এইবার সে চলে এল লোকোমোটিভের এঞ্জিনের সামনে। উত্তাপ ছড়াচ্ছে আগুনে পোড়া ইস্পাত, তবু ওই জায়গা ছেড়ে নড়তে ইচ্ছে করছে না তার। আউট-লরা তাকে দেখতে পাচ্ছে না, কিন্তু উঁকি দিলেই এখান থেকে আউট-লদের দেখতে পাবে সে।

আলো হঠাৎ কমে গেল, ধোঁয়া সূর্যকে ঢেকে দিয়েছে। বাতাস নেই, ঘাসের একটা ডগাও নড়ছে না। মিলার্ডের দিকে এগুচ্ছে আউট-ল দু’জন, সতর্ক নজর রাখছে সামনে। এক পলকের জন্য ওদের দেখতে পেয়ে গুলি করল ম্যাকেনলি। ড্যানির সঙ্গীকে বাতাসে হাত ছড়িয়ে উপুড় হয়ে পড়ে যেতে দেখল। ছোট বোল্ডার দৃষ্টি পথে বাধা হয়ে দাঁড়াল, আউট-ল মারা গেছে কি না নিশ্চিত হতে পারল না ম্যাকেনলি।

গাল বকে পাথর টপকে দৌড় দিল ড্যানি। এঁকেবেঁকে দৌড়াচ্ছে গুলি লাগার ভয়ে। হতচকিত আউট-লরা কাভারিঙ ফায়ার বন্ধ করে দেয়ায় উঠে দাঁড়াল মিলার্ড, এক গুলিতে এফোঁড় ওফোঁড় করে দিল ছুটন্ত আউট-লর কণ্ঠনালী। দু’হাতে গলা চেপে ধরে ক্যানিয়নের মেঝেতে পড়ে গেল আউট-ল, ঘড়ঘড় শব্দ উঠছে বুকের গভীর থেকে। রক্তের ছিটে লেগে রঙচঙে হয়ে গেল কাছের বোল্ডারটা। ভীষণ আক্ষেপে মিনিটখানেক শরীর মোচড়াল আউট-ল। তারপর রক্ত হারিয়ে নড়াচড়ার শক্তি থাকল না, একসময় একেবারেই নিথর হয়ে গেল।

আউট-লর দল কিছু বুঝে ওঠার আগেই মিলার্ড আর ম্যাকেনলি দু’জনেই আড়ালে চলে গেল। দেখতে না পেলেও ম্যাকেনলির অবস্থান কোথায় জেনে ফেলল লোকো গানস্মোক দেখে। তার নির্দেশে মিলার্ডের ওপর থেকে নজর সরিয়ে এক নাগাড়ে গুলি করতে শুরু করল আউট-লরা এঞ্জিন আর আশপাশের জমিতে। এ-জায়গা আর নিরাপদ নয় বুঝে ক্রল করে এগোতে লাগল ম্যাকেনলি।

আউট-লরা অস্ত্র রিলোড করার আগ পর্যন্ত ঘাপটি মেরে থাকল সে। তারপর ঝুঁকি নিয়ে দৌড় দিল মিলার্ডের দিকে। জানে, সবাই অস্ত্র একসঙ্গে খালি করবে না কখনোই; তবু এরপর এমন সুযোগ আর না-ও মিলতে পারে। সঙ্গী হারিয়ে উন্মাদ হয়ে উঠেছে, বেহিসেবী গুলি খরচ করছে আউট-লরা। একটু পরই স্বাভাবিক বুদ্ধি ফিরে আসবে ওদের। তখন আর আনাড়ীর মত গুলি করবে না, তখন গুলি করবে খুন করতে পারবে বুঝেই।

মিলার্ড যে বোল্ডারের পেছনে আছে ঠিক সেখানে রোদ পড়ছে না। গ্র্যানিটের একটা স্ল্যাব ক্যানিয়নের গা থেকে বেরিয়ে ছায়া দিচ্ছে। মিলার্ড জানে না স্বস্তিকর ছায়া দেয়া স্ল্যাবের ওপর আছে ওর মৃত্যুদূত। হ্যারল্ড আর পারভিস ঘুরপথে এসে উঠে বসেছে স্ল্যাবের ওপর। একটু একটু করে এগোচ্ছে ওরা, ঝুঁকি না নিয়ে মিলার্ডের পিঠে গুলি করবে।

ট্রেনের দিক থেকে গুলি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সন্দেহ হলেও ব্যাপারটা পাত্তা দিল না মিলার্ড। হয়তো গুলি অপচয় করছে বুঝে থেমে গেছে আউট-লরা! উঁকি দিয়ে ম্যাকেনলিকে আসতে দেখল সে। দৌড়ের ফাঁকে চেঁচাচ্ছে প্রৌঢ় আউট-ল, ক্যানিয়নের ভেতরে গমগম করছে তার গলার আওয়াজ। ‘ওরা মাথার ওপরে, জো বয়!’

বক্তব্য বুঝে বিন্দুমাত্র দেরি না করে বোল্ডারের ওপর দিয়ে ঝাঁপ দিল মিলার্ড। মাটিতে পড়েই উঠে দাঁড়াল এক ঝটকায়। তাকিয়ে দেখল গ্র্যানিট ছাদের কিনারায় পৌছে গেছে দুই নিঃশব্দ খুনি। এক মুহূর্ত চোখাচোখি হলো ওদের, তারপর ডানদিকে লাফ দিয়ে পর পর দুই বার ট্রিগার টানল মিলার্ড। প্রথম আউট-ল পিস্তল তাক করার সময় পেল না, বুক খামচে ধরে পড়ে গেল গ্র্যানিট স্ল্যাবের ওপর। তাকে আর উঠতে দেখা গেল না। হ্যারন্ডের গুলি মিলার্ডের চুলে সিঁথি কেটে একটা বোল্ডারে গিয়ে আঘাত হানল।

আউট-লকে মিস করেছে সে, হাঁটু গেড়ে বসে দ্বিতীয়বার তাকে লক্ষ্য করে ট্রিগার টানল মিলার্ড। ক্লিক শব্দে ব্যবহৃত কার্তুজের খোসায় পড়ল হ্যামার। সিক্সগানে গুলি নেই। আউট-লর চোখে খুনের নেশা দেখে মনে মনে প্রস্তুত হয়ে গেল সে, মৃত্যু বড় কাছে এসে গেছে। মেরিয়ান, বাড আর লিয়োর ছবি চোখে ভেসে উঠল। মনে মনে বলল, ‘বন্ধু, শোধ নিতে পারলাম না।’

প্রায় একই সঙ্গে দুটো অস্ত্রের গর্জন শুনল মিলার্ড, দেখতে পেল আছাড় খেয়ে স্ল্যাব থেকে বোল্ডারের ওপর পড়েছে আউট-ল। ম্যাকেনলি একেবারে কাছে চলে এসেছে দেখে শেষ মুহূর্তে তাকেই বেছে নিয়েছিল লোকটা। ঘাড় ফিরিয়ে দেখল একটা বোল্ডারের গায়ে ঠেস দিয়ে বসে আছে ম্যাকেনলি, ব্যথায় কুঁচকে গেছে চেহারা। বাম কাঁধ চেপে ধরে আছে, আঙুলের ফাঁক দিয়ে বের হচ্ছে তাজা রক্ত।

‘আরে, গাধা, গুলি খাবে তো,’ বোকার মত দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দাঁতে দাঁত চেপে মিলার্ডকে বলল সে।

চট করে শুয়ে পড়ল মিলার্ড, এগোল ম্যাকেনলির দিকে ক্রল করে। থেমে থেমে গুলি করছে আউট-লরা। লোকোর নির্দেশে কয়েক মিনিটের চেষ্টায় সিন্দুক খুলে ফেলল ইয়ান চ্যাপেল। স্যাডল ব্যাগে তাড়াহুড়ো করে ভরা হলো বিশ ডলারের স্বর্ণ ঈগলগুলো। মিলার্ড আর ম্যাকেনলিকে ব্যস্ত রাখার মাঝে ঘোড়ায় ওঠানো হলো স্যাডল ব্যাগগুলো। এতক্ষণের অভিজ্ঞতায় লোকো বুঝে গেছে এখানে বেশিক্ষণ থাকা বিপজ্জনক। অবশিষ্ট সবাইকে গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে পিছিয়ে যেতে নির্দেশ দিল সে।

মিনিট দুয়েকের মধ্যেই ক্যানিয়নের ভেতরে স্ট্যাম্পিডের শব্দ তুলে ছুটতে শুরু করল আউট-লদের ঘোড়া।

ম্যাকেনলির কাঁধে রুমাল দিয়ে ব্যাণ্ডেজ বেঁধে দিল মিলার্ড। আহত হলেও টনটনে জ্ঞান আছে আউট-লর, দাঁতে দাঁত পিষে সে বলল, ‘লোকো সিন্দুক খালি না করে যাবার লোক না। কষ্ট করে খেটে মরলাম আমরা, আর সেদিনের ওই ছোকরা আসল জিনিস নিয়ে কেটে পড়ল!’

দৌড়ে ক্যানিয়নের ঢাল বেয়ে উঠতে শুরু করল মিলার্ড। ‘পারলে সঙ্গে এসো, ম্যাক। আমার ধারণা যেপথে এসেছে সেপথেই যাবে ওরা। তাড়াতাড়ি উঠতে পারলে ওদের অ্যাম্বুশ করতে পারব আমরা। লিয়োর খুনি একটা বুলেট পায় আমার কাছে।’

‘ওকে চিনিয়ে দেব যদি লোকো ইঁদুরটাকে আমার হাতে ছেড়ে দাও,’ পেছনে ম্যাকেনলির ছুটন্ত পদশব্দ পেল মিলার্ড।

‘লোকো তোমার।

প্রায় একই সঙ্গে ক্যানিয়নের কিনারায় উঠে এল ওরা দু’জন। হাত-পা ছড়িয়ে মাটিতে বসে পড়ল হাঁপাতে হাঁপাতে। কিছুক্ষণ পর ইশারায় ক্যানিয়নের একপ্রান্ত দেখাল ম্যাকেনলি। ওদিকের ট্রেইল বেয়ে উঠে ওদের দিকে এগিয়ে আসছে ছ’সাতজন অশ্বারোহী। বাড়তি ঘোড়াও আছে তাদের সঙ্গে। সবগুলোর পিঠে রয়েছে ফোলা স্যাডল ব্যাগ।

‘জুনিপার পাসের দিকে যেতে হলে এ-জায়গা পেরতে হবে ওদের,’ বলল মিলার্ড। হাত বিশেক দূরে পড়ে থাকা বোল্ডার দেখাল সে। ‘আমি ওগুলোর পেছনে থাকব, তুমি থাকো ক্যানিয়নের ঢালে। ওদের ওপর দু’দিক থেকে একসঙ্গে ফায়ার ওপেন করব আমরা।’

‘ভেবে বলছ?’ কৌতূহলী চোখে তাকাল ম্যাকেনলি। ‘হয়তো ওদের কয়েকটাকে এভাবে ফেলতে পারব আমরা, কিন্তু জেতার সম্ভাবনা শতকরা শূন্যের নিচে। সবচেয়ে বড় কথা লড়াই শুরু হয়ে গেলে আটকে যাব আমরা, বাইরে থেকে সাহায্য না এলে গুলি ফুরিয়ে গেলে পরে মরতে হবে।’

শান্ত চেহারায় মাথা ঝাঁকাল মিলার্ড। ‘আমাদের সময় ফুরিয়ে এসেছে, ম্যাক, আমরাও ফুরিয়ে গেছি। নতুন সভ্যতার আমাদের মত মানুষকে আর প্রয়োজন নেই। আর জীবন? জীবন মানেই তো ঝুঁকি। মৃত্যুকে আমি ভয় পাই না, ম্যাক, পৃথিবীতে মৃত্যুই একমাত্র স্থির সত্য। ইচ্ছে হলে তো কেউ চির জীবন বাঁচে না! অবসর নিয়ে ধুঁকে ধুঁকে মরার চেয়ে একবারে জীবনকে বিদায় দেয়া ভাল।’

‘ঠিকই বলেছ, জো বয়, একটা বোতল থাকলে কয়েক ঢোক গিলে তোমাকে উইশ করতাম,’ ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল প্রৌঢ় আউট-ল। ‘যাও, পাথরের পেছনে গিয়ে তৈরি হয়ে নাও; আমিও নেমে যাচ্ছি ক্যানিয়ন রিমে, ওরা বুঝবে দু’দিক থেকে দোজখ ভেঙে পড়লে কেমন লাগে।’

পাড় ধরে ঘোড়া ছুটিয়ে এল আউট-লরা। ক্যানিয়নের ভেতরে সঙ্গীদের মৃত্যুর ধাক্কা এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি, লুটের অর্থ কব্জা করলেও কারও মুখে হাসি নেই। গম্ভীর চেহারায় সবার আগে চলেছে লোকো আর ডারবি। ‘ডান দিকেরটা ডারবি,’ বলে ম্যাকেনলি চিৎকার দেয়ার আগে আউট-লরা টেরও পেল না অ্যাম্বুশে পড়েছে।

আউট-লরা পিস্তলে হাত দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে গর্জে উঠল মিলার্ড আর ম্যাকেনলির সিক্সগান। আড়াল ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে ওরা দু’জনই। বিস্ফোরিত হলো লোকোর মগজ, ঘোড়া থেকে আছড়ে মাটিতে পড়ল সে। মিলার্ডের বুলেট ডারবির কপালে ঢুকল ছোট্ট একটা ফুটো করে। দেখে মনে হলো তৃতীয় একটা চোখ গজিয়েছে কপালে। ঘোড়ার ওপর চিত হয়ে গেল আউট-ল, তারপর ঢলে পড়ল নিচে। স্টিরাপে পা বেধে গেল। আতঙ্কিত ঘোড়া তাকে ছেঁচড়ে নিয়ে ছুটল।

থমকে গেছে আউট-লরা, প্রথমে মনে হলো নেতার মৃত্যু এত সহজে হলো দেখে অস্বাভাবিক আচরণ করছে। ওদের মাথার ওপর দিয়ে সবক’জন তাকিয়ে আছে রেল ট্র্যাকের দিকে। ব্যাপার তা নয়, ঘাড় ফিরিয়ে তাকিয়ে কারণটা মিলার্ডও বুঝতে পারল। একটা হ্যাণ্ডকার আসছে ট্র্যাকের ওপর দিয়ে, ওটার পেছনে আসছে শতখানেক যানবাহন। গুরুগম্ভীর গুঞ্জন করছে গাড়ির এঞ্জিনগুলো, আকাশ বাতাস কাঁপাচ্ছে মোটর সাইকেল।

খুব দ্রুত এগিয়ে এল হ্যাণ্ডকার, মেয়রই প্রথম খেয়াল করল যে ক্যানিয়নের ওপর রেলওয়ে ব্রিজ ভেঙে পড়েছে। ‘লাফ! লাফ!!’ বলেই রাইফেল হাতে লাফ দিল সে। বাকি চারজনের কেউ কারও চেয়ে কম দ্রুত নয়, মুহূর্তে খালি হয়ে গেল হ্যাণ্ডকার। ব্রিজের ওপর উঠে উড়াল দিল ওটা, একটু পরে লোহার সঙ্গে লোহা বাড়ি খাওয়ার শব্দ হলো ক্যানিয়নের ভেতরে।

পলকহীন চোখে দেখছে আউট-লরা, পালাবার বা ড্র করার চেষ্টাও করল না। ওরা বুঝে গেছে ধরা পড়তেই হবে, আর কোনও উপায় নেই। ইশারা করতেই মাথার ওপর হাত তুলল সবক’জন।

মেয়র উইলিয়াম রাইফেল হাতে দৌড়ে এল ওদের কাছে। পৌঁছে গেছে যানবাহনের মিছিল। ক্রুদ্ধ জনতা হাত-পা বেঁধে ফেলল আউট-লদের। ডারবির ঘোড়া ধরে আনার পর গুনে দেখা গেল ব্যাংকের এক ডলারও খোয়া যায়নি।

‘একেবারে চেঁছেপুঁছে সিন্দুক সাফ করেছে!’ মন্তব্য করল মেয়র। হাত নেড়ে সবাইকে চুপ করিয়ে বলল, ‘আজ পশ্চিমের ইতিহাসে এক স্মরণীয় দিন।’

নোটবুক আর পেন্সিল হাতে রুগ্ন, দাড়িওয়ালা এক লোক দৌড়ে এসে দাঁড়াল মেয়রের সামনে। নিজেকে ফ্রী প্রেসের সাংবাদিক বলে পরিচয় দিল সে, জানতে চাইল, ‘অনেকের মুখে শুনলাম এই অভিযানে সফল হওয়ায় আপনি গভর্নর পদে দাঁড়াতে পারেন, কথাটা কি সত্যি?’

‘গভর্নর? কেন, গভর্নর কেন?’ বিস্মিত হওয়ার অভিনয় নিখুঁত হলো মেয়রের। ‘আমার যা কর্তব্য ছিল তার বেশি কিছু তো আমি করিনি। এখনও এ ব্যাপারে কিছু ভেবে দেখিনি, তবে আমি গভর্নর হলে জরুরী অনেক বিষয়ে দ্রুত উন্নতির জন্য পদক্ষেপ নিতাম।’ গোপনে কথা বলার জন্য সাংবাদিকের কাঁধে হাত দিয়ে হাঁটতে শুরু করল মেয়র।

‘তোমাদের মেয়র সত্যি সত্যি প্রেসিডেন্ট হয়ে গেলেও আমি অবাক হব না,’ মিলার্ডের পাশে দাঁড়িয়ে ভ্রূ কোঁচকাল ম্যাকেনলি।

সসংকোচে ওদের সামনে এসে দাঁড়াল মার্শাল উইলকার, কিছুক্ষণ ইতস্তত করে বলল, ‘আমি মার্শাল হওয়ার যোগ্য নই, তুমি তোমার ব্যাজ ফিরিয়ে নাও।’ হাসল মিলার্ড, তরুণ উইলকারের দিকে তাকিয়ে বুক থেকে ব্যাজ না খুলতে ইশারা করে বলল, ‘লেগে থাকো, তোমারও যোগ্যতা এসে যাবে।’

আউট-লদের স্যাডল চড়ানো ঘোড়াগুলো দাঁড়িয়ে আছে, সেদিকে ম্যাকেনলির দৃষ্টি আকর্ষণ করল সে। ‘চলো, মেয়র তার বিশাল বক্তৃতা শুরু করার আগেই রওয়ানা হয়ে যাই।’

মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিল ম্যাকেনলি।

ঘোড়ায় ওঠার পর মিলার্ডের দিকে হাত বাড়িয়ে দিল। ‘জো বয়, এখান থেকেই আমাদের পথ আলাদা হয়ে গেছে। আমি কানাডায় যাচ্ছি, ছেলের কাছে।’

আউট-লর হাত ধরল মিলার্ড, পরক্ষণেই দুটো তালা লাগানোর শব্দ হলো। বিস্মিত, ক্রুদ্ধ ম্যাকেনলি দেখল মিলার্ডের ডানহাত আর তার বামহাত আটকা পড়েছে হ্যাণ্ডকাফে।

‘বিশ্বাসঘাতক, শয়তান…’ হিসিয়ে উঠল সে।

‘তোমার ছেলে খুশি হবে যখন জানবে তার বাবাকে আইন আর খুঁজছে না,’ হাসল মিলার্ড।

‘ঈশ্বর তোমাকে তাড়াতাড়ি বেহেস্তে নিক,’ গম্ভীর চেহারায় বলল আউট- ল। ‘আমি যখন জেল থেকে বের হব ততদিনে আমার ছেলেরও এত বয়স হয়ে যাবে যে তার ছেলেকে নিয়ে মাছ ধরতে যেতে পারবে না।’

‘না, ম্যাকেনলি, জাজ আমার বন্ধু। আমি সাক্ষ্য দেব ডাকাতি ঠেকানোর জন্য বারবার জীবনের ঝুঁকি নিয়েছ তুমি। জেল হবে না তোমার, কপাল ভাল হলে সোনার মেডেল আর ব্যাংকের রিওয়ার্ড মানিও পাবে।’

‘এবার আমার দিকে পেছন ফিরো না, জো মিলার্ড, এবার আমি কথা তো দেবই না কথা বলবও না,’ মুখ ঘুরিয়ে নিল ম্যাকেনলি। ‘আমাকে টানা হ্যাঁচড়া না করে এখানেই ছেড়ে দিতে পারতে,’ কিছুক্ষণ পর ধীর গলায় বলল আউট-ল, ‘তুমি আমার পেছনে লাগবে না জানি, আর কারও সাধ্য নেই আমাকে ধরে, ছেলের কাছে ফিরে যেতে পারতাম।’

‘তুমি আমার বন্ধু, কয়েকবার জীবন বাঁচিয়েছ, তাই অতীতের কলঙ্ক থেকে তোমাকে মুক্ত করতে চাইছি। আমি চাই না পুরস্কারের টাকার জন্য অতর্কিতে তুমি খুন হয়ে যাও কোনও কাপুরুষের হাতে।’

মিলার্ডের কথায় কোনও জবাব দিল না ম্যাকেনলি, তবে চেহারা দেখে মনে হলো ওর বক্তব্য বুঝতে পেরেছে।

‘চলো, ম্যাক,’ হ্যাণ্ডকাফে আলতো টান দিল মিলার্ড। ‘আমিও চাই তাড়াতাড়ি ঝামেলা মিটে যাক। প্রোগ্রেসে মেরিয়ান আর বাড় আমার জন্য অপেক্ষা করছে, এমনিতেই বোকার মত অনেক দেরি করে ফেলেছি।’

***

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *