ধাওয়া – ২

দুই

প্রোগ্রেস। উঠতি শহর। জনসংখ্যা পাঁচ হাজার দুশো ছাপান্ন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত তাল মিলিয়ে উন্নতি হচ্ছে শহরের। জনসাধারণ মোটামুটি সচ্ছল। ঘোড়াহীন ক্যারিজ কেনার মত টাকাও আছে অনেকের। পথচারী আর ঘোড়াগুলোকে প্রচণ্ড শব্দে ভয় দেখিয়ে শহরের রাস্তায় ছুটে চলে তারা যান্ত্রিক ক্যারিজে চড়ে।

কিন্তু শহরের উন্নতির সবচেয়ে বড় প্রমাণ হচ্ছে দুর্গ চেহারার একটা পাকা দালান। বিল্ডিঙের দরজা-জানালা শক্ত ইস্পাতে তৈরি। ঢোকার মুখে বাড়ির সদর দরজা থেকে ঝুলছে লম্বা একটা কাপড়ের ব্যানার। ওতে লেখা আছে: ‘শীঘ্রি খুলছে- প্রোগ্রেসের প্রথম ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক- শনিবার, পনেরোই অক্টোবর।’

রাস্তায় রাস্তায় টাঙানো হয়েছে নীল, লাল, সাদা রঙের আরও অসংখ্য ব্যানার। ওগুলোতে আসন্ন টাউন ইলেকশনের কথা বলা হয়েছে। বেশিরভাগ ব্যানারেই লেখা: মেয়র উইলিয়ামকে পুনর্নির্বাচিত করুন, শহরের উন্নতি অব্যাহত রাখুন। মেয়র উইলিয়াম আমাদের সবার প্রতিনিধি।

সৌজন্যে- প্রোগ্রেসের জনসাধারণ।

লাল-সোনালী রঙের একটা অটোমোবাইল রাস্তা ধরে ধেয়ে এল। ওটার চেন ড্রাইভ আর্তনাদ করছে গতির তীব্রতায়। মানুষ, কুকুর আর ঘোড়াগুলোকে প্রচণ্ড শব্দে হর্ন বাজিয়ে ভড়কে দিচ্ছে গাড়ির মালিক। একবার করে এঞ্জিন গর্জে উঠলেই কালো ধোঁয়ার মেঘ বের হচ্ছে গাড়ির টেইল পাইপ থেকে। গগস্ পরা ড্রাইভার ভারিক্কি চালে একহাতে স্টিয়ারিঙ হুইল আঁকড়ে ধরেছে, অন্য হাতে হর্নের রাবার বা টিপছে অনবরত।

রাস্তার একধারে বোর্ডওয়াকে দাঁড়িয়ে আছে একটা বারো-তেরো বছরের ছেলে। মুখ হাঁ করে অবাক বিস্ময় আর প্রশংসা মাখা চোখে দেখছে চমৎকার গাড়িটাকে। ছেলেটার বিরক্ত মা পাশে দাঁড়িয়ে। রুক্ষ, জাঁদরেল চেহারা মহিলার। ছেলের হাত ধরে অধৈর্য ভঙ্গিতে টান দিল সে, ধমকে উঠল, ‘হ্যারি, কতবার না বলেছি রাস্তায় দাঁড়িয়ে এসব দেখতে হবে না! চলো!’

‘এত সুন্দর বাগি আগে আর দেখিনি,’ বকা খেয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে মায়ের দিকে তাকাল হ্যারি। ‘আমাকে একদিন ওটাতে চড়াবে, মা?’

‘ওই জঘন্য শব্দ করা নোঙরা বিপজ্জনক যন্ত্রটায়? না, কক্ষণও না!’

রাস্তার কিছুটা সামনে জটলা করে দাঁড়িয়ে আছে অনেক মানুষ। ওখান থেকে হৈ-হুল্লোড়ের আওয়াজ ভেসে আসছে, মাঝে মাঝে দু’একজন পিস্তলের নল আকাশে তাক করে গুলি ছুঁড়ছে। ছেলের হাত ধরে টানতে টানতে জনির সেলুনের সামনে ভিড় করে থাকা লোকগুলোর দিকে হাঁটতে শুরু করল মহিলা। জনির সেলুনের নিচতলাতেই শুধু সেলুন, ওপরতলায় ড্রিঙ্ক সার্ভ করার মেয়েগুলো থাকে। সেলুন ড্যান্সারদের আখড়াও ওখানেই।

বদনাম আছে ওই সব মেয়েরা শুধু নাচগান আর ড্রিঙ্কই সার্ভ করে না, বাড়তি রোজগারের অন্য ধান্দাও করে। শহরের ভদ্রমহিলা সমিতি অনেকদিন হলো ওদের তাড়াতে চেষ্টা করছে, কিন্তু এতদিন তাদের কথায় কান দেয়নি মেয়র উইলিয়াম। সামনে ইলেকশন, তাই মহিলাদের ভোট পাওয়ার আশায় এখন কঠোর ব্যবস্থা নিতে হয়েছে তাকে।

একে একে জনির সেলুন থেকে মুখে রঙ মাখা মেয়েগুলোকে বের করে আনা হচ্ছে, জোরজার করে তুলে দেয়া হচ্ছে রাস্তায় দাঁড়ানো একটা ওয়্যাগনে। জনি নিজে দাঁড়িয়ে আছে সেলুনের দরজায়। উদাস চোখে দেখছে মেয়েদের চলে যাওয়া। চেহারায় তার ভাবান্তর নেই, জানে, ইলেকশনের পরেই আবার ফেরত আসবে ওরা।

বোর্ডওয়াকে দাঁড়ানো ভদ্রমহিলারা ঘটনা দেখছে চোখে উৎসাহ নিয়ে। তাদের চোখে-মুখে ফুটে উঠেছে বিজয়ের আনন্দ। ভিড়ের মধ্যে দাঁড়ানো বেশির ভাগ পুরুষেরই চেহারায় কী যেন হারানোর একটা দুঃখ দুঃখ ভাব। অনেকেই বউ সন্দেহ করবে এই ভয়ে চেষ্টাকৃত হাসি ঠোঁটে লটকে রেখেছে। পিস্তলের গুলি ছুঁড়ে হৈচৈয়ে ব্যস্ত লোকগুলো পুরোদস্তুর মাতাল, কী হারাতে যাচ্ছে বোঝার অবস্থায় নেই ওরা।

ভিড়ের পেছনে দাঁড়ানো এক মহিলার পাশে থেমে দাঁড়াল হ্যারির মা। রুক্ষ, কর্কশ স্বর যতটা সম্ভব নরম করে বলল, ‘এখনই সময় ওই নোঙরা সেলুনটা বন্ধ করে দেয়ার। অনেকদিন হলো আমাদের শহরের কলঙ্ক হয়ে আছে জায়গাটা। কি বলেন?’

মিসেস ট্র্যাভার ঘন ঘন মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিল। ‘ঠিক, মিসেস বেণ্টহ্যাম, একদম ঠিক বলেছেন!’

মা আলাপে মনোযোগী হয়ে পড়ায় আস্তে করে হাত ছাড়িয়ে নিল হ্যারি, অদম্য কৌতূহল মেটাতে ভিড় ঠেলে ভেতরে ঢুকে পড়ল কী হচ্ছে দেখার জন্য।

এক তরুণীকে পাঁজাকোলা করে সেলুন থেকে বেরিয়ে এল একজন লোক। মেয়েটার প্রতিবাদ, কিল, চড় গ্রাহ্য না করে এগোল সে ওয়্যাগনের দিকে। এতক্ষণ ঠিক জুত করতে পারছিল না, হঠাৎ মওকা পেয়ে প্রচণ্ড থাপ্পড় বসাল তরুণী ভার বাহকের গালে। এত জোর শব্দ হলো যে এক ব্লক দূর থেকে কেউ শুনলে মনে করত টুটু বোর রাইফেলের আওয়াজ। করতালি দিল কয়েকজন মাতাল। রাগে লাল চেহারায় তরুণীকে ওয়্যাগনে প্রায় আছড়ে নামিয়ে ধুপধাপ পা ফেলে চলে গেল লোকটা।

এরপর সেলুন থেকে বেরল দুঃখী দুঃখী চেহারার এক তরুণ। সোনালী চুলের এক অনিচ্ছুক মেয়েকে কব্জি ধরে হিঁচড়ে আনছে সে। হাতের কার্পেট ব্যাগ দিয়ে তরুণকে বাড়ি দেয়ার চেষ্টা করল মেয়েটা। না পেরে রাগে চেঁচাল উঁচু গলায়। ‘কাল রাতে আরও কিছুক্ষণ থাকতে অনুরোধ করেছিলে, ভুলে গেছ, জেস?’

হঠাৎ ঝাঁকুনি দিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল তরুণী, কার্পেট ব্যাগ ঘুরিয়ে আঘাত করল তরুণের পেটে। মাটিতে চিতপাত হয়ে আছড়ে পড়ল তরুণ ভারসাম্য হারিয়ে। সে ওঠার চেষ্টা করতেই এক পা সামনে বেড়ে প্যান্টের পেছন দিকটায় গায়ের জোরে লাথি কষাল তরুণী। ‘ভদ্রমহিলাদের সঙ্গে যেরকম ব্যবহার করো এখন থেকে আমার সঙ্গেও করবে, নাহলে এরপর আর পেছনে লাখ্ মারব না।’

হৈহৈ করে উঠল মাতালের দল। একজন জড়ানো স্বরে জানতে চাইল, ‘লেগেছে নাকি, জেস?’

লজ্জায় লাল হয়ে গেল তরুণের চেহারা, হাঁচড়েপাঁচড়ে উঠে দাঁড়িয়ে তরুণীর কাঁধ আঁকড়ে ধরল সে। মেয়েটা মোচড় মেরে সরে যাওয়ায় কাপড় ছিঁড়ে তার হাতে রয়ে গেল। উন্নত বক্ষ দু’হাতে ঢাকল তরুণী উপায় না দেখে।

‘জেনি,’ শ্বাসের ফাঁকে বিড়বিড় করল জেস, ‘তুমি তো জানো ব্যাপারটা ব্যক্তিগত না; মেয়রের আদেশ!’

‘ব্যক্তিগত না?’ উঁচু গলায় চেঁচিয়ে উঠল তরুণী। ‘তা হলে জীবনে প্রথম ব্যক্তিগত কারণ ছাড়া আমার গায়ে হাত দিয়েছ তুমি!’

হাসি ঠাট্টা আরম্ভ হয়ে যেতে ভিড়ের মধ্যে হাওয়া হয়ে গেল জেস। সেলুন থেকে এবার যে মেয়েটা বেরিয়ে এল তাকে কেউ ধরে আনেনি, স্বেচ্ছায় এসে ওয়্যাগনে উঠল সে। চেহারা হ্যারির খুবই পরিচিত, তাই হাত নেড়ে সে চেঁচাল মেয়েটার উদ্দেশে, ‘হাই, জোলিন!’

ভিড়ের মধ্যে বাচ্চা ছেলেটা কথা বলেছে বুঝে বিস্ময়ে হাঁ হয়ে গিয়েছে জোলিন। কোনমতে বলল, ‘তোমাকে আমি চিনি না। চিনি?’

হ্যারি কথা বলার আগেই ভিড় ঠেলে বেরিয়ে এল ওর মা। হাত আঁকড়ে ধরে জোর করে টেনে নিয়ে যাচ্ছে দেখে ঘাড় বাঁকিয়ে মেয়েটার দিকে তাকাল হ্যারি। ‘বাই, জোলিন!

ওয়্যাগনে বসে বোকা বোকা চেহারায় জোলিন আপন মনে আওড়াল, ‘বুঝলাম না! কাস্টোমার হলে নিশ্চয়ই মনে পড়ত!’

ভিড় পেরিয়ে আসার পর হ্যারিকে ছেড়ে দিল তার মা, কোমরে হাত রেখে বলল, ‘শয়তান ছেলে! বলো ওই…ওই জঘন্য প্রাণীর সঙ্গে কোথায় দেখা হয়েছে তোমার!’

চেহারা দেখে মনে হলো মায়ের কথা হ্যারি শুনতেই পায়নি। বোর্ডওয়াকের ওপর দিয়ে খাবার বয়ে বাসায় চলেছে একসার পিঁপড়ে, ওদিকেই তার নজর। মিসেস বেণ্টহ্যাম রাগে মাটিতে পা ঠুকল, গলার স্বর কয়েক পর্দা চড়েছে ইতিমধ্যে।

‘হ্যারি বেণ্টহ্যাম, কথা বলছ না কেন! তুমি ওই মহিলাকে চিনলে কোত্থেকে?’

জীববিজ্ঞানের ব্যাপারে উৎসাহ হারিয়ে মুখ তুলল হ্যারি। শ্রাগ করে বলল, ‘আসলে আমি চিনি না, মা। জোলিন বাবার বন্ধু।’

.

সবক’জন ওয়েইট্রেসকে ওয়্যাগনে তুলে দেয়া হলো। শহরের একপ্রান্তে ট্রেনের হুইসল বাজাচ্ছে অধৈর্য ড্রাইভার। দক্ষিণ দিক থেকে রেল লাইনের পাশ দিয়ে শহরে ঢুকল মার্শাল জো মিলার্ড। রেল এঞ্জিনের কাছ দিয়ে যাবার সময় শুনতে পেল এঞ্জিনিয়ার মুখ খিস্তি করছে কয়েকটা বাজারে মেয়ের জন্য দেরি করতে হওয়ায়।

প্রোগ্রেসের বড় রাস্তার ওপর চোখ পড়তেই মিলার্ড দেখল একটা ওয়্যাগন আসছে স্টেশনের দিকে। মেয়ে ভরা ওয়্যাগনের পেছনে পেছনে হেঁটে এগোচ্ছে ওদের অসংখ্য ভক্ত। ঘোড়া থামিয়ে কৌতূহলী চোখে তাকাল মার্শাল। দুটো গাড়ি এসে কড়া ব্রেক করে থামল দু’পাশে। ভয় পেয়ে পাগলের মত লাফাতে শুরু করল ওর স্ট্যালিয়ন। জন্তুটাকে সামলে নেয়ার পর ড্রাইভারদের দিকে শীতল চোখে তাকাল সে, ওদের কোনও কথার জবাব দিল না।

ওয়্যাগন স্টেশনে পৌঁছতেই প্রতিবাদের ঝড় উঠল মেয়েদের মাঝে। মেয়র ওদের কথা দিয়েছিল প্রাইভেট বগি দেয়া হবে, অথচ এখন দেখা যাচ্ছে ক্যাটল ট্রেনের বগি। মেঝেতে এখানে ওখানে গোবর পড়ে আছে। ট্রেন ছেড়ে দেয়ার পরও চেঁচামেচি থামাল না মেয়েরা।

জো মিলার্ডের ডেপুটি হার্বার্ট উইলকারের সঙ্গে ভিড়ের সামনে দাঁড়িয়ে আছে মেয়র উইলিয়াম। তরুণ ডেপুটির মত রোগা দুর্বল নয় মেয়র। অত্যন্ত সুদর্শন। দোহারা গড়ন। কাপড়চোপড়ে আভিজাত্যের ছাপ। সেন্ট লুইয়ের সেরা দরজিকে দিয়ে কোট-প্যান্ট বানায় সে। কোটের বুক পকেটে ফুল গুঁজে রেখেছে, পাশ থেকে ঘড়ির সোনার চেন বের হয়ে আছে। এক কথায় মেয়র লেডি কিলার। গুজব আছে ব্যালট বাক্স আর সুন্দরী মেয়েদের দিকে একই সঙ্গে নজর রাখতে গিয়ে তার নাকি চোখের অসুখ হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে।

পাশে দাঁড়ানো তরুণ ডেপুটিকে দেখে কাকতাড়ুয়া ভেবে ভুল হতে পারে যে কারও। মেয়রের চেয়ে অন্তত এক হাত লম্বা সে। হঠাৎ বড় হয়ে যাওয়া স্কুলের ছাত্রদের মত লাগছে তাকে দেখতে। শার্ট-প্যান্ট ছোট হয়ে গিয়েছে খেয়াল নেই। মার্শাল জো মিলার্ডের ডেপুটি হতে পারায় তার মনে কোনও গর্ব নেই, কখন কী ভুল হয়ে যায় এই ভয়ে তটস্থ থাকে সর্বক্ষণ। চাকরি যাতে হারাতে না হয় সেজন্য মেয়র আর মার্শাল, দু’জনকেই তোষামোদ করে চলে।

‘আমি…আমি ভাবিনি এত লোক হবে,’ ভিড়ের ওপর চোখ বুলিয়ে ডেপুটির চেহারায় অস্বস্তি ফুটে উঠল।

‘যত লোক তত ভাল প্রচারণা, হার্বার্ট,’ জ্ঞান দিচ্ছে এমন ভঙ্গিতে বলল মেয়র, ‘আর প্রচারণা যত ভোটও তত। আমার কাছ থেকে শেখো এসব।’

কুৎসিত চেহারার এক মহিলা ঝড়ের গতিতে এসে ওদের সামনে দাঁড়াল। ‘চমৎকার কাজটার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ দিতেই হয়, মেয়র। ওই…ওই মেয়েগুলো সমাজের ঘা হয়ে ছিল।’

‘আমার ধন্যবাদও গ্রহণ করুন, মিসেস পিটারসন। আপনার সঙ্গে আমিও একমত, ওদের তাড়ানো তো আমার কর্তব্য ছিল। কী আর এমন করেছি,’ লাজুক লাজুক হাসি উপহার দিল মেয়র উইলিয়াম।

মহিলার চর্বিসর্বস্ব টেকো স্বামী পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। চেহারা বিকৃত করে রেখেছে লোকটা, দেখে মনে হচ্ছে এখনই কান্নায় ভেঙে পড়বে। বউয়ের পেছন পেছন চলে যাচ্ছিল সে, কাঁধে চাপড় দিয়ে মেয়র ফিসফিস করে বলল, ‘মন খারাপ কোরো না, এলিয়াস, সবাইকে বলে দিয়ো ইলেকশনের পরেই মেয়েরা এখানে ফেরত আসবে।’

না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন, এতই দ্রুত হাসিখুশি হয়ে উঠল স্বামীপ্রবর। থেমে পড়ে মেয়রের হাত আঁকড়ে ধরে বলল, ‘দারুণ! তোমার মত লোকের জন্যই এখনও টিকে আছে আমাদের সমাজ।’

‘না, না, এ তো কিছুই নয়; আমার কর্তব্য,’ হাত ছাড়িয়ে নিল মেয়র। ‘যাই, অফিসে যেতে হবে। পাবলিক সার্ভেন্টের কাজের শেষ নেই, কী আর করা!’

‘এক মিনিট, মেয়র,’ পেছন থেকে চেনা কণ্ঠস্বর ডাক দেয়ায় একসঙ্গে ঘুরে দাঁড়াল ডেপুটি আর মেয়র।

ওদের পাশে এসে ঘোড়া থেকে নামল মার্শাল। কণ্ঠে চাপা উত্তেজনা নিয়ে বলল, ‘পাসি করতে বিশ পঁচিশজন লোক লাগবে আমাদের।’

‘পাসি?’ প্রতিধ্বনি তুলল মেয়র। ‘কেন?’

‘ওদের অস্ত্র আর গোলাবারুদ বেশি করে নিতে বোলো। আমরা…’

‘দাঁড়াও দাঁড়াও,’ হাত তুলে বাধা দিল মেয়র। ‘ধীরে সুস্থে বলো দেখি পাসির কথা কী বলতে চাও।’

মিস্টার এলিয়াস পিটারসন বিদায় নিয়ে চলে গেল। কথা বলার আগে বাইরের কেউ শুনছে না নিশ্চিত হয়ে নিল মার্শাল, তারপর বলল, ‘শনিবার সকালে ব্যাংকের টাকা নিয়ে ট্রেন আসছে না?’ মেয়র মাথা ঝাঁকানোয় গম্ভীর হয়ে গেল তার চেহারা। গলার স্বর আরও কয়েক পর্দা নামিয়ে বলল, ‘আমার ধারণা ওই ট্রেনে ডাকাতি হবে।’

‘ট্রেন ডাকাতি?’ বিস্ফারিত চোখে বিড়বিড় করল ডেপুটি হার্বার্ট।

‘অসম্ভব,’ মাথা নাড়ল মেয়র। ‘জো বয়, ভুলে যাচ্ছ কেন যে পশ্চিমের সেই আগের অবস্থা আর নেই; এযুগে ওরকম পাগলামি আর কেউ করে না।’

‘জিম ম্যাকেনলিকে টেরিটোরিতে দেখা গেছে,’ মুখ কালো করে বলল মিলার্ড।

যা আশা করেছিল প্রতিক্রিয়া সেরকম হলো না। ফাঁকা দৃষ্টিতে মার্শালের দিকে তাকিয়ে থাকল মেয়র আর ডেপুটি। কিছুক্ষণ পর মেয়র জানতে চাইল, ‘জিম ম্যাকেনলি আবার কে?’

এবার জো মিলার্ড বোকার মত একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল মেয়রের দিকে। ওর চেহারা দেখে মনে হচ্ছে ভিন গ্রহের আগন্তুক দেখছে। ‘জিম ম্যাকেনলি কে?’ আবার জানতে চাইল মেয়র।

‘এদেশের সবচেয়ে কুখ্যাত ব্যাংক ডাকাত,’ শ্বাসের ফাঁকে বলল জো মিলার্ড।

‘মানে, বলতে চাইছ সেই ট্রেন-ডাকাত জিম ম্যাকেনলি?’ চোখ সরু হয়ে গেল মেয়রের। জানে, বছর বিশেক আগে ত্রাসের সৃষ্টি করেছিল এই লোক। কোনও শেরিফ বা মার্শাল কখনও ধরতে পারেনি তাকে। গত ডাকাতির সময়েও মারাত্মক আহত অবস্থায় পালিয়েছে সবাইকে কাঁচকলা দেখিয়ে।

‘হ্যাঁ, সেই জিম ম্যাকেনলি; জেসি জেমসের চেয়েও বিপজ্জনক ডাকাত।’ ভ্রূ কুঁচকে মাথা চুলকাতে ব্যস্ত ডেপুটি জিজ্ঞেস করল, ‘টেক্সাসের কোথায় যেন মরেছে না সে? আমার যতদূর মনে পড়ে…’

উপযুক্ত গুরুত্ব বোঝাতে পারছে না বলে ধৈর্য ধরে রাখা কঠিন হলো মিলার্ডের। বলল, ‘মরলে আমি এখানে এসে বলতাম না. যে ডাকাতি করার জন্য হাজির হয়েছে ম্যাকেনলি। এ ব্যাপারে তোমার কী মতামত, মিস্টার উইলকার?’

‘কিন্তু বইতে পড়েছি…’

‘বইতে কী আবোল তাবোল পড়েছ তাতে কিছু যায় আসে না,’ প্ৰায় ধমকে উঠল মার্শাল। ‘আমি বলছি সে বেঁচে আছে!’

‘তো এখন কী করতে চাইছ তুমি, জো বয়?’ মোলায়েম স্বরে হাসি হাসি চেহারায় জানতে চাইল মেয়র।

‘ফালতু কথা বন্ধ করে পাসি নিয়ে ওদের ধরতে যেতে চাইছি,’ গোমড়া মুখে বলল মিলার্ড। খেয়াল করে দেখল মেয়রের হাসি অম্লান। পাঁড় রাজনীতিক।

‘পরে যদি শহরের সবাই তৈরি হয়ে ওখানে গিয়ে দেখে খবরটা ভুয়া, তা হলে খুব খারাপ হবে আমার,’ বলল সে, ‘আর তাছাড়া এতদিনে আউট-লর বয়স হবে বোধহয় একশোর কাছাকাছি।’

রাগে লাল চেহারায় উরুতে চাপড় দিল মার্শাল মিলার্ড। ‘ম্যাকেনলির বয়স বড় জোর পঞ্চাশ। বিশ বছর আগেও ওকে ধাওয়া করেছি আমি। আমার চেয়ে খুব বেশি হলে পাঁচ-সাত বছরের বড়।’

‘ঠিক আছে, জো বয়। তোমার অফিসে চলো, আলাপ করতে হলে পরিবেশ দরকার,’ হাঁটতে শুরু করল মেয়র।

ছোট একটা অগোছাল ঘরে জো মিলার্ডের অফিস। চার দেয়ালের রঙ দেখা যায় না, অসংখ্য ওয়ান্টেড পোস্টারে ঢেকে গেছে। বদ্ধ বাতাসে সিগারের ধোঁয়ার গন্ধ। এক কোণের র‍্যাকে কয়েকটা রাইফেল। ওগুলো ছাড়া ঘরের আর সবকিছু ধূলিময়।

মেয়র ডেস্কের ওধারে কাঠের চেয়ার টেনে বসার পর হলুদ রঙের জীর্ণ একটা পোস্টার ড্রয়ার থেকে বের করল জো মিলার্ড। মেয়রের দিকে বাড়িয়ে ধরল। কাগজে কমবয়সী চমৎকার চেহারার এক লোকের স্কেচ আঁকা, নিচে বড় বড় অক্ষরে লেখা, ‘ওয়ান্টেড! জিম ম্যাকেনলি- ট্রেন এবং ব্যাংক ডাকাত। পুরস্কার দুই হাজার ডলার।’

‘এই লোক,’ আঙুলের ইশারায় ছবি দেখিয়ে বলল মার্শাল।

অন্যকিছু ভাবছে মেয়র, অন্যমনস্কভাবে স্কেচ দেখল। উঠে দাঁড়িয়ে জানালা খোলার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে বলল, ‘এঘরে পরিষ্কার বাতাস ঢোকে না কতদিন কে জানে!’

পোস্টার দেখায় ব্যস্ত মিলার্ড কোনও জবাব দিল না। হেঁটে গিয়ে ডেপুটির অফিসে ঢোকার দরজা খুলল মেয়র। খোলা জানালা পথে আলো ঢুকছে ঘরে। প্রতিটা জিনিস ঠিক জায়গা মত সাজানো আছে। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। দেখে বোঝার উপায় নেই ব্যাচেলরের অফিস।

‘হ্যাঁ, এইটা হলো অফিস,’ পেছন পেছন আসা মার্শাল আর ডেপুটির উদ্দেশে বলল মেয়র। ‘মানুষ অন্তত এঘরে বসে কাজ করতে পারবে। আলো বাতাস আছে, দম বন্ধ হয়ে আসে না।’ দুঃখিত চেহারায় কান চুলকে নিয়ে মিলার্ডের দিকে তাকাল সে। ‘আমার ধারণা বন্ধ ঘরে বসে কাজ করো বলেই তোমাকে দেখতে বুড়ো বুড়ো লাগে। ওই ঘর দেখে কে বলবে ওটা অফিস!’ উৎসাহ দেয়ার ভঙ্গিতে ডেপুটির দিকে তাকিয়ে হাসল মেয়র। ‘হ্যাঁ, উইলকার, তোমার অফিস দেখে ভাল লাগল। পরিচ্ছন্নতা হচ্ছে ভাল সংগঠনের চিহ্ন, আর ভাল সংগঠন হচ্ছে সৃষ্টির জরায়ু।’

‘আমার ধারণা, শুকনো চেহারায় মেয়রের হাতে ধরা পোস্টার দেখিয়ে বলল মার্শাল, ‘শনিবার ব্যাংকের এক লক্ষ ডলার ট্রেন থেকে নামার আগেই ছিনিয়ে নেবে ম্যাকেনলি, আর তখনও ভাল লাগবে তোমার!’

আরেকবার পোস্টার দেখল মেয়র। ‘এই নোটিশ তো বিশ বছর আগের। তোমার কি ধারণা সে এখনও বিপজ্জনক?’

‘হ্যা, জিম ম্যাকেনলি তুলনাহীন। এখানে হাজির হয়েছে সে, বর্ণনা দেয়া হয়েছে আমাকে।’

‘বর্ণনা?’ ভ্রূ কুঁচকে গেল মেয়রের। ‘তারমানে তুমি তাকে দেখোনি, জো বয়। কে দেখেছে?

‘লিয়োনেল।’

হেসে ফেলল মেয়র। পাগল লোকটাকে সে চেনে ভালমতন। কী বলতে কী বলে ঠিক নেই, ওর কথার কোনও দাম দেয়া বোকামি। ‘জো, তোমার কি মাথা খারাপ নাকি যে পাহাড়ী পাগলটার কথা বিশ্বাস করছ! পাসি নিয়ে ম্যাকেনলির ভূতকে খুঁজতে বেরলে সারা শহরে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়বে।’

‘লিয়োনেল পাগল না,’ উত্তেজিত স্বরে বলল মার্শাল। ‘ওর কথা বিশ্বাস করা যায়।’

‘না, না, জো বয়,’ মোম দেয়া গোঁফে মোচড় মেরে মাথা নাড়ল মেয়র। ‘এতবড় ঝুঁকি আমি নিতে পারি না। সামনেই ইলেকশন। বিশ পঁচিশজন সশস্ত্র লোক জোগাড় করে সোনার হরিণ খোঁজার জন্য পাঠালে আমার জেতার সম্ভাবনা শূন্য। তাছাড়া, প্রোগ্রেসের লোকরা টেরিটোরিতে হাসির পাত্র হয়ে যাবে।’

‘কিন্তু…’

হাত তুলে থামিয়ে দিল মেয়র। ‘আমাকে কথা শেষ করতে দাও, জো বয়। তুমি যদি ম্যাকেনলিকে নিজের চোখে দেখতে, আমি পাসির ব্যাপারে আপত্তি করতাম না। কিন্তু পাগলের কথায়…।’ মার্শালের কাঁধ চাপড়ে দিল সে। ‘বাড়ি যাও, জো, তোমার বিশ্রাম দরকার। ঘুমাও গিয়ে। চুরি ডাকাতির কথা ভুলে আরাম করো। যুগ পাল্টে গেছে, এখন আর ব্যাংক বা ট্রেন ডাকাতি হয় না।’

‘আমি এখনও প্রোগ্রেসের মার্শাল,’ অস্বাভাবিক শান্ত স্বরে বলল জো মিলার্ড। ‘যতক্ষণ এই ব্যাজ পরে আছি নিজের দায়িত্ব পালন করব। ভেবেছিলাম তোমার সাহায্য পাব, কিন্তু এখন বুঝছি ভুল ভেবেছিলাম। পাসির জন্য লোক আমি নিজেই জোগাড় করে নেব।’

‘ভেবে দেখার জন্য আমাকে কয়েক ঘণ্টা সময় দাও তা হলে,’ ব্যক্তিত্বের সংঘাত পাশ কাটিয়ে হাসল মেয়র উইলিয়াম। ‘বেশি কিছু চাইছি না, ভেবে দেখার জন্য দু’ঘণ্টা এমন কিছু না। তাছাড়া, ম্যাকেনলি তো আর পালিয়ে যাচ্ছে না!’

‘বেশ, দু’ঘণ্টা অপেক্ষা করব।’

খুশি মনে মার্শালের পিঠ চাপড়ে দিল মেয়র। উদ্দেশ্য পূরণ হওয়ায় বলল, ‘এজন্যই তো তোমাকে এত পছন্দ করি, জো বয়। হাতের কার্ড খারাপ থাকলে জুয়াতে বাজির অঙ্ক বাড়াও না তুমি, একেবারে যুক্তি মেনে চলো!’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *