ধাওয়া – ১২

বারো

দ্রুত পায়ে হেঁটে এক্সপ্রেস কোচের শেষমাথায় পৌছে গেল মিলার্ড আর ম্যাকেনলি। টেণ্ডারে নামার কোনও মই নেই, তবে সামান্য উঁচু হয়ে আছে জড় করা কয়লার টুকরোগুলো। লাফ দিয়ে বেকায়দাভাবে পড়লে হাত-পা ভাঙবে যে কারও। লাফ দিল ওরা, নিরাপদেই নামল টেণ্ডারের মেঝেতে।

‘তুমি না পারলেও আমি ঠিকই ফুটো করে দিয়েছি ওদের,’ চাপাবাজ বেঁটে গার্ডের গলা শুনতে পেল ওরা। কণ্ডাক্টরকে সে বলছে যে বিশ্বাস না হলে মইয়ে উঠে দেখতে পারে।

মইয়ে দাঁড়িয়ে মাথা তুলে তাকানোর ইচ্ছা বা সাহস কোনটাই হলো না বুড়ো কণ্ডাক্টরের। তাছাড়া তার কিছু যায় আসে না, লোকগুলো ডাকাতি করলে গার্ডকে দোষ দেবে কোম্পানী, ট্রেনের নিরাপত্তা দেখা তার দায়িত্ব নয়।

পেছনদিকের বিপদ কাটল তা হলে, হাসিমুখে করমর্দন করল মিলার্ড আর ম্যাকেনলি। কয়লার স্তূপ মাড়িয়ে এগোল লোকোমোটিভের ক্যাবের দিকে।

বয়লারে বেলচা ভরে কয়লা ফেলল ফায়ারম্যান, মাথা তুলে দেখল টেণ্ডার থেকে লাফ দিয়ে ক্যাবে এসে ঢুকেছে ধুলোকালি মাখা দু’জন আগন্তুক। ডাকাত! হাত থেকে বেলচা ফেলে দিল সে, ঊরুতে ছোবল মারল অস্ত্রের খোঁজে। নেই!

ভুলেই গিয়েছিল যে কাজ করার সময় গানবেল্ট খুলে রাখে সে। মিলার্ডকে এঞ্জিনিয়ারের দিকে পা বাড়াতে দেখে চিৎকার করে সতর্ক করল সে। হাত দুটো মুঠি পাকিয়ে অভিজ্ঞ মুষ্টিযোদ্ধার মত দুলতে দুলতে নিজে এগোল ম্যাকেনলির দিকে।

লোকটা ফুট দুয়েকের মধ্যে পৌঁছে যেতেই এক পা সামনে বাড়ল ম্যাকেনলি, প্রকাণ্ড হাত ঘুরিয়ে থাবড়া মারল। থপ করে ফায়ারম্যানের গালে পড়ল চড়। মুঠো করা দু’হাত শিথিল হয়ে গেল লোকটার, তাল সামলাতে না পেরে ট্রেন থেকে পড়ে গেল বাইরে। চিন্তিত ম্যাকেনলি গলা বাড়িয়ে দেখল আহত হয়নি লোকটা, একটা বড় ঝোপের ওপর পড়ায় বেঁচে গেছে।

মাথার ওপর দু’হাত তুলে রাগে লাফাচ্ছে ফায়ারম্যান, কী যেন বলছে দূরে চলে আসায় কিছু বোঝা যাচ্ছে না। বোধহয় ম্যাকেনলির বাপান্ত করছে। ট্রেন বাঁক ঘোরায় চোখের আড়ালে চলে গেল লোকটা। হাসতে হাসতে ঘুরে তাকিয়ে আউট-ল দেখল এঞ্জিনিয়ারের ব্যবস্থা করে ফেলেছে মিলার্ড। অব্যবহৃত বেলচা ঝোলানোর জন্য বড় বড় কয়েকটা হুক আছে এঞ্জিন রুমের দেয়ালে, তারই একটা থেকে ঝুলছে কোট পরা অসহায় এঞ্জিনিয়ার। কোটের ভাঁজ করা কলার হুকে আটকে দিয়েছে মিলার্ড।

হাত-পা ছুঁড়ে যত গাল জানে সব ঝাড়ছে এঞ্জিনিয়ার। মিলার্ডের চেহারা নির্বিকার, কিন্তু ম্যাকেনলির কান গরম হয়ে উঠল লোকটার স্বআবিষ্কৃত কয়েকটা গালি শুনে। এগিয়ে দাঁড়িয়ে একহাতে এঞ্জিনিয়ারের চুল, অন্যহাতে ট্রেনের হুইসল টানল সে। লোকটার বুক ফাটা চিৎকার চাপা পড়ে গেল তীক্ষ্ণ শিসের শব্দে।

.

প্রোগ্রেসে দাঁড়ানো লোকগুলোর কানে দুই মাইল দূর থেকে ভেসে এল ট্রেনের হুইসল। কর্মতৎপরতা শুরু হয়ে গেল। ব্যাগেজ হাতে নড়েচড়ে দাঁড়াল যাত্রীরা। আউট-লরা কারও সন্দেহ না জাগিয়ে রেল ট্র্যাকের ধার ঘেঁষে এল।

ওয়েস্টার্ন উপন্যাস পকেটে পুরে বেঞ্চ ছেড়ে উঠল লোকো। চোখ খুলে গেছে বাকশটের। টিকেট অফিসের ভেতর দু’হাত তুলে আড়মোড়া ভাঙল প্রহরারত আউট-ল। এরকম ভাল মানুষের মত বসে থাকলে তোমার কোনও বিপদ হবে না, দাদু,’ বুড়ো স্তেফানকে আশ্বাস দিল সে। হাত বাড়িয়ে টেলিগ্রাফের কী আর সাউণ্ডারের বেরিয়ে থাকা তারগুলো ছিঁড়ে ফেলল, তারপর উঠে দাঁড়িয়ে দরজা ভিড়িয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেল।

ডিপোতে শেডের তলায় দাঁড়িয়ে আরেকবার বাদ্য যন্ত্র বাজিয়ে সবাইকে চমকে দিল ব্যাণ্ড লিডার। লাইন করে সদস্যদের দাঁড় করিয়ে তৈরি থাকতে বলল, রেল এঞ্জিন চোখে পড়ামাত্র বাজাতে শুরু করবে তারা।

রিচার্ড জনসন বউকে নিয়ে তার চমৎকার নতুন গাড়িতে করে এল। রেললাইন পেরোবার সময় গতি কমাল সে টায়ার ফাটার ভয়ে। গাড়ি রেল ট্র্যাকের ওপর উঠতেই কাতরে উঠে বন্ধ হয়ে গেল এঞ্জিন। সামনের চাকা ট্র্যাকের এপারে, পেছনের চাকা ট্র্যাকের ওপারে; নিশ্চল হয়ে গেল গাড়ি।

আপনমনে ভাগ্যকে দোষ দিয়ে গাড়ি থেকে নেমে এল রিচার্ড জনসন, স্টার্ট দেয়ার জন্য এঞ্জিন বনেট থেকে বেরিয়ে আসা রড ঘোরাতে শুরু করল। কাজ হচ্ছে না, কোনও সাড়াই দিচ্ছে না এঞ্জিন। হাল ছেড়ে দিয়ে চামড়ার পাউচে রড ভরে আবার ড্রাইভিঙ সীটে এসে বসল সে।

‘শালার কার্বুরেটরে বেশি তেল এসেছে,’ বিড়বিড় করে বউকে শোনাল সে। ‘কাল রাতে ঘুরতে না বেরিয়ে কার্বুরেটর মেরামত করা উচিত ছিল। এখন চুপ করে বসে থাকা ছাড়া উপায় নেই, তেল না নামলে এঞ্জিন চালু হবে না।’

‘কিন্তু, ডার্লিঙ, আমরা ট্র্যাকের মাঝে আটকে আছি, এখন যদি ট্রেন আসে?’ জানতে চাইল উৎকণ্ঠিত মিসেস জনসন।

শ্রাগ করল মহিলার গাড়িপাগল স্বামী। ‘এলেই কী, ট্রেন প্ল্যাটফর্মে থামবে। থামবেই, আমরা তো স্টেশনের এপারে আছি। খামোকা চিন্তা কোরো না তো, লক্ষ্মী মেয়ের মত বসে থাকো।’

দূরে ট্রেন আসতে দেখে আতঙ্ক বোধ করল মিসেস জনসন, কথা বলতে গিয়ে টের পেল তোতলাচ্ছে। ‘রি…রিচার্ড, স্টেশনেই যদি থামবে তো…তা হলে গতি কমাচ্ছে না কেন?’

‘ও তোমার চোখের ভুল, আসলে ভয় পেয়েছ তো তাই বুঝতে পারছ না যে ট্রেনের গতি কত কম,’ বউয়ের কাঁধে হালকা চাপড় বসিয়ে হাসল রিচার্ড জনসন।

এঞ্জিনিয়ারের সরু কাঁচের জানালা দিয়ে সামনের ট্র্যাক দেখল ম্যাকেনলি। ভ্রূ কুঁচকে চেন টেনে হুইসল বাজাল কয়েকবার। তবু সামনে থেকে নড়ছে না রঙচঙা গাড়িটা। মিলার্ডকে ডাক দিয়ে আঙুল তুলে সামনেটা দেখাল সে।

ফায়ারম্যানের সীটে দাঁড়িয়ে চমকে গেল মিলার্ড, শ্বাসের ফাঁকে বলল, ‘মেয়রের প্রেমিকার স্বামীর গাড়ি।’

‘তা তো বুঝলাম, কিন্তু ওরা ট্র্যাকের ওপর কী করছে?’ আরও কয়েকবার হুইসল বাজিয়ে সতর্ক করল আউট-ল।

অনেক কাছে চলে এসেছে ট্রেন, স্বামীর হাত আঁকড়ে ধরল আতঙ্কিত মহিলা। পাগলের মত মাথা নেড়ে বলল, ‘ওরা থামবে না, রিচার্ড, দেখছ না হুইসল বাজিয়ে সামনে থেকে সরে যেতে বলছে? তুমি থাকলে থাকো, আমি বাবা এর মধ্যে নেই। গাড়ির মধ্যে থাকলে মরতে হবে, চলো নেমে সরে যাই, রিচার্ড!’

‘উঁহু, খবরদার বলে দিচ্ছি, নামবে না তুমি,’ বউয়ের হাত আঁকড়ে ধরে ধমক দিল মিস্টার জনসন। ‘যত সব ফালতু ভয়। ট্রেন মোটেও গতি বাড়াচ্ছে না, থেমে আসছে, হুইসল বাজাচ্ছে ব্যাংকের টাকা আনছে সেজন্য। খেয়াল করোনি, হুইসল শুনেই বাজনা বাজাতে শুরু করেছে ব্যাণ্ড পার্টি? টাকা, মেইল, যাত্রী নামাতে থামবেই ট্রেন। ওদের কাজ শেষ হওয়ার আগেই কার্বুরেটরের তেল নেমে যাবে, রওয়ানা হতে পারব আমরা।’

‘থামছে না, ওরা থামছে না,’ ফুঁপিয়ে উঠল মিসেস জনসন।

হঠাৎ দু’জনে দেখল স্টেশনের দিক থেকে ওদের দিকে ছুটে আসছে মেয়র, দু’হাত ঝাঁকিয়ে চেঁচাচ্ছে উন্মাদের মত। ‘নামো! গাড়ি থেকে নামো! ট্রেন স্টেশনে থামবে না!’

বউ দরজা খোলার আগেই লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল মিস্টার জনসন। গাড়ি থেকে নেমে খিঁচে দৌড় দিল, পাঁচ সেকেণ্ড পার হওয়ার আগেই তিরিশ ফুট দূরে চলে গেল সে বউকে ফেলে। সেদিকে তাকিয়ে দরজা টপকে নেমে পড়ল মিসেস জনসনও, দু’হাতে ঊরু পর্যন্ত গাউন তুলে দৌড়াতে শুরু করল। কোনদিকে হুঁশ নেই। জান বাঁচাতে ছুটছে, যেন পাগলা কুকুরের তাড়া খেয়েছে।

প্রচণ্ড শব্দে স্টেশন কাঁপিয়ে হাজির হলো ট্রেন। থামল না। গতি বজায় রেখে চোখের পলকে প্ল্যাটফর্ম পেরিয়ে গেল। যাত্রীদের মাঝে বিস্ময় আর হতাশা মেশানো চিৎকার উঠল, ওরা বুঝতে পারছে না কেন থামল না ট্রেন। বুড়ো টিকেট চেকার আর বেঁটে গার্ড ওদের বোঝানোর চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে নিজেরাই খেপে উঠল, বলল তারাও জানে না কেন ট্রেন থামেনি। প্যাসেঞ্জারদের শান্ত করা অসম্ভব বুঝে শেষ পর্যন্ত আক্রমণের ভয়ে টয়লেটে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হলো দু’জনে।

ট্রেন প্ল্যাটফর্ম পার হওয়ার সময় মিলার্ড আর ম্যাকেনলিকে এঞ্জিন রূমে দেখতে পেয়েছে লোকো, রাগে চেঁচাল সে, ‘ম্যাকেনলি হারামজাদা আমাদের ধোঁকা দিয়েছে, একাই সব মেরে দিতে চাইছে শালা! দৌড়াও সবাই, ঘোড়ায় করে ওদের ধাওয়া করব আমরা।’

‘পাগল হয়ে গেলে নাকি, ঘোড়া কি কখনও ট্রেনের সঙ্গে দৌড়ে পারে?’ প্রতিবাদ করল বাকশট।

‘দৌড়ে ধরার দরকার নেই, গাধা,’ ছুটন্ত অবস্থায় ঘাড় ফিরিয়ে চেঁচাল লোকো, ‘কয়লা শেষ হয়ে গেলেই থামতে হবে ওদের।’

লোকোর উদ্দেশ্য বুঝে পেছন পেছন ডিপোর অন্যপাশ লক্ষ্য করে ছুটতে শুরু করল সবক’জন আউট-ল। কাজ সেরে দ্রুত সরে পড়ার সুবিধের কথা ভেবে ঘোড়াগুলো ওখানেই বেঁধে রাখা হয়েছে।

শ’খানেক গজ দূরে ট্রেনের ধাক্কায় ট্র্যাক থেকে উড়ে গেল জনসনের গাড়ি, ইস্পাত ছেঁচে যাওয়ার কর্কশ শব্দ হলো। পনেরো-বিশ গজ দূরে গিয়ে পড়ল গাড়িটা। চেনার উপায় নেই, তোবড়ানো মুড়ির টিন হয়ে গেছে। বিকট শব্দে ফাটল টায়ারগুলো, আগুন লেগে যাওয়ায় পেট্রল ট্যাঙ্ক বিস্ফোরিত হলো।

দৌড় থামিয়ে ঘাড় ফেরাল রিচার্ড জনসন, প্রিয় বাহনের চূর্ণবিচূর্ণ অবস্থা দেখে মুখ বিকৃত হয়ে গেল তার। হেঁটে কাছে গেল মিসেস জনসন, মনের আনন্দ চেহারায় প্রকাশ না করে ধীরে ধীরে চাপড় মারল স্বামীর পিঠে। বলল, ‘যা যাওয়ার ছিল গেছে, রিচি। একবার ভেবে দেখো, বিয়ের পর আমাকে কতটুকু সময় দিয়েছ তুমি। ছুটির দিনগুলোতে পর্যন্ত আমার কাছ থেকে তোমাকে দূরে সরিয়ে রেখেছিল ওই জঘন্য জিনিসটা।’

‘ঠিকই বলেছ তুমি,’ ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল রিচার্ড জনসন।

জনসনদের সাবধান করেই শহরের দিকে দৌড় দিয়েছে মেয়র। মার্শালের অফিসে ঢুকে মিসেস বেন্টহ্যামকে দেখতে পেল সে। তাকে দেখে মহিলার কুৎসিত চেহারা আরও গম্ভীর হয়ে গেল, আঙুল তুলে ডেপুটি মার্শালের অফিস দেখাল সে। ‘ওখানে, মেয়র।’

‘মার্শাল উইলকার ওই ঘরে?’ নিশ্চিত হওয়ার জন্য প্রশ্ন করল মেয়র।

‘ম্‌ম্‌ম্‌ম্! মমমম!!’ অস্পষ্ট আওয়াজ শোনা গেল ভিড়ানো দরজার ওপার থেকে।

এক ধাক্কায় দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল মেয়র। সামনের দৃশ্য দেখে চোয়াল ঝুলে পড়ল তার। মেঝেতে হাত-পা বেঁধে বসিয়ে রাখা হয়েছে মার্শাল উইলকারকে, মুখে গুঁজে দেয়া হয়েছে একটা রুমাল। নিজে ব্যবহার করার জন্যই বোধহয় প্যান্ট খুলে নিয়ে গেছে আউট-ল, অথবা ব্যাপারটা তার ঠাট্টাও হতে পারে। মার্শালের রুগ্‌ণ উরুসন্ধির মাঝের জমিন ফুটো আণ্ডারওয়্যার থাকতে পারেনি বললেই চলে।.

‘আশা করছি এই অবস্থা কেমন করে হলো তার উপযুক্ত ব্যাখ্যা দিতে পারবে,’ মার্শালের গোঙানিতে সংবিৎ ফিরে পেয়ে অবশেষে বলল মেয়র।

‘ম্‌ম্‌ম্‌ফ্‌!’ মাথা ঝাঁকিয়ে জবাব দিল মার্শাল উইলকার।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *