দরিয়া-ই-নুর – ৯

অধ্যায় ৯

ডিসেম্বরের ২৭ তারিখ। আজকেই সেই ক্ষণ।

এ কয়দিনে সব কাজ গুছিয়ে এনেছে আশেক। পাভেলের সাথে বার কয়েক দেখা করে পুরো পরিকল্পনাটা সাজিয়ে নিয়েছে সে। পাভেলও এখন পুরোপুরি সন্তুষ্ট। ওর যেহেতু এনআইডি নেই তাই পাভেলেরটা দিয়ে একটা সিমও জোগাড় করে নিয়েছে।

সকালে রোজি বের হয়ে যাবার পর আর্জুমান্দের সঙ্গে একটু গল্প-গুজব করেছে। আসল কাজ শুরু হবে সন্ধ্যার পর। তবে তার আগে ছোট্ট একটা কাজ আছে।

দুপুরের পর পার্লার থেকে রোজি চলে এলে এক সঙ্গে খাওয়া-দাওয়া করলো তারা।

“আইজ আর বাইরে যাস্ নাই?” জানতে চাইলো মেয়েটা।

“বিকালে বাইর হমু।”

রোজি আর কিছু বলল না। সে পার্লারে চলে গেলে একটা সিগারেট ধরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে পরীবাগ থেকে শাহবাগের দিকে গেল আশেক। আজিজ মার্কটের সামনে আসতেই থমকে দাঁড়াল। এখানে একটা বইয়ের দোকান দেবার স্বপ্ন দেখতো দুদুমাস্টার। এই মার্কেটে দুদুর সাথে কতো আড্ডা দিয়েছে। এফডিসির পর এটাই ছিল তাদের সবচেয়ে প্রিয় জায়গা।

খুব বই পড়তো দুদু, কবিতা লিখতো ছোটবেলা থেকে। গল্প লেখার হাতও ছিল ভালো। এখানকার অনেক কবি-সাহিত্যিকদের সঙ্গে ছিল তার সখ্যতা। মাতাল হলে দুদু লাইনের পর লাইন কবিতা আবৃত্তি করতো, এমন কি বিখ্যাত কোনো উপন্যাসের প্যারার পর প্যারা বলে যেতে পারতো।

একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে এলো মির্জা আশেকের ভেতর থেকে।

আজিজ মার্কেটটাও পনেরো বছরে বেশ বদলে গেছে। আগে যেখানে বইয়ের দোকান ছিল সেখানে এখন খাবার আর জামা- কাপড়ের দোকানই বেশি। নিচতলার একটা পুরনো চায়ের দোকান দেখে খুশিই হলো। এত সব পরিবর্তনের মধ্যেও কিছু কিছু জিনিস টিকে থাকতে দেখলে ভালো লাগে।

চায়ের তেষ্টা না পেলেও এক কাপ চায়ের অর্ডার দিলো সে, আর তখনই দেখতে পেল তার পাশে দাঁড়িয়ে কালো চশমা আর হাতে একটা ছরি নিয়ে চায়ে চুমুক দিচ্ছে এক লোক। দীর্ঘদিন পর দেখলেও চিনতে সমস্যা হলো না।

“সুরেনবাবু, না?”

চশমা পরা লোকটা চমকে তাকালো ডান দিকে। “কে? কে আপনি?”

“আমি মির্জা আশেক…দুদুমাস্টার আর আপনে এক লগে থাকতেন…”

জন্মান্ধ লোকটা স্মৃতি আউড়ালো। “পরীবাগের আশেক?…ঐ যে ফিল্ম করতো যে…?”

“হ।”

“ওহ্! আপনি!” দারুণ অবাক হলো। “আপনি…মানে, ভেতরে ছিলেন না?”

“কয়দিন আগে ছাড়া পাইছি।”

সহমর্মিতা ফুটে উঠল সুরেনের অভিব্যক্তিতে। “আপনার কথা দুদু অনেক বলতো, আপনি ধরা পড়ার পর খুব চিন্তা করতো সে।”

আশেক কিছু বলল না।

“দুদুটা যে কোথায় হারিয়ে গেল!” দীর্ঘশ্বাস ফেলল লোকটা। “আমি অন্ধ মানুষ, তারপরও অনেক জায়গায় গেছি, খুঁজেছি…কেউ কিচ্ছু বলতে পারেনি। ওর গ্রামেও গেছিলাম, ওখানেও যায়নি। আপনি অ্যারেস্ট হবার পর ও ভয়ে ভয়ে ছিল, আমাকে একদিন বলল, পুলিশের হাত থেকে বাঁচতে কয়েক দিনের জন্য গা ঢাকা দিচ্ছে। আপনি যে ওর নাম বলবেন না সে বিশ্বাস ওর ছিল। কিন্তু ওর আশঙ্কা ছিল, পুলিশ খুব দ্রুত ওর সাথে আপনার সম্পর্কের কথাটা জেনে যাবে।”

সায় দিলো আশেক। দুদুর সন্দেহটা অমূলক ছিল না। মামলার তদন্তকারী অফিসারের আগেই সচিবের শ্যালক, ঐ পুলিশ এটা জেনে গেছিল। সম্ভবত এফডিসি থেকে।

“আমি ভেবেছিলাম সব কিছু শেষ হয়ে গেলে, আপনার রায় হয়ে গেলে ও ফিরে আসবে, কিন্তু আজো এলো না।” অন্ধ লোকটা আশেকের কাঁধে হাত রাখলো। “আপনার সাথে দেখা হয়ে ভালোই হলো, আপনাকে একটা জিনিস দেবার ছিল।”

“কী জিনিস?” আগ্রহি হয়ে জানতে চাইলো আশেক।

“আমার সাথে একটু আসেন, এই মার্কেটে আমার অফিসে গিয়ে বসি।”

চা খাওয়া শেষে আশেককে নিয়ে আজিজ মার্কেটের দোতলায় একটা বইয়ের দোকানে চলে এলো সুরেন।

“দুদু আমাকে এটা চাপিয়ে দিয়ে গেছে বলতে পারেন,” অফিসে বসে বলল। “ওর কথায় আমি এটা দিয়েছি।“

ছোট্ট বইয়ের দোকানটার দিকে ভালো করে তাকালো মির্জা। মাত্র একজন কর্মচারি এককোণে বসে আছে। তিন দিকের দেয়াল জুড়ে থাকা র‍্যাকে অসংখ্য বই।

“দুদুর খুব শখ ছিল একটা পাবলিকেশন্স দেবে,” দীর্ঘশ্বাস ফেলল অন্ধ লোকটি। “হাতে টাকা আসার পরই কাজে নেমে পড়েছিল। আমাকে তিন লাখ টাকা দিয়ে বলেছিল এখানে একটা স্পেসের পজেশন নেবার ব্যবস্থা করি যেন।“

আশেক জানতো, দুদুমাস্টার বইয়ের দোকান দিতে চাইতো। কিন্তু প্রকাশনীর কথা বলেছিল কি না মনে করতে পারলো না। হয়তো বইয়ের দোকান বলতে প্রকাশনীই বুঝিয়েছিল।

“টাকাটা দিয়েই লাপাত্তা হয়ে গেল। আমি তিন বছর অপেক্ষা করেছি ওর জন্য, তারপর এই দোকানটা নিয়ে নেই ওর টাকা দিয়ে। জানেনই তো, অন্ধদের স্কুলে পড়াই, খুবই ব্যস্ত থাকি…প্রকাশনীতে সময় দিতে পারি না। প্রায়ই ভাবি, দুদু একদিন এসে হাজির হবে, আমি ভারমুক্ত হবো।”

দীর্ঘশ্বাস ফেলল মির্জা। “আপনে আমারে কী জানি দেখাইবেন কইলেন?”

“ওহ্। একটা বই…” কর্মচারির উদ্দেশ্যে বলল এবার, “এক কপি হাসনাহেনা দাও তো।” সুরেনের হাতে একটা বই ধরিয়ে দিলো ছেলেটা।

“এই যে, এই বইটা…একটু দেখুন।”

বইটা হাতে নিলো আশেক : হাসনাহেনার কাব্যগাঁথা। লেখকের জায়গায় লেখা আছে, মঞ্জুর-এ-এলাহী। দুদুমাস্টারের আসল নামটা।

“ওর ট্রাঙ্ক থেকে পাণ্ডুলিপিটা পেয়েছিলাম। লেখাটা শেষ করতে পেরেছিল কি না জানি না। একজনকে দিয়ে একটু ঘষামাজা করে কয়েক বছর আগে বইটা বের করেছি,” একটু থেমে আবার বলল, “উৎসর্গ পাতাটা দেখুন। “

আশেক বইটার উৎসর্গ পাতায় চোখ বোলাল :

জন্মের পর মাকে দেখিনি, কিন্তু আমার মা দেখতে
নিশ্চয় আর্জুমান্দ বানুর মতোই ছিল!
কতো দিন আমি তাকে মা বলে ডাকতে গিয়েও
ডাকতে পারিনি অলঙ্ঘনীয় এক সঙ্কোচে।
এই বইটার গল্প আর আপত্য স্নেহ দিয়ে আমাকে ঋণী
করেছেন যিনি সেই মহিয়সীকে উৎসর্গ করলাম।

উৎসর্গের লেখাটা পড়ে আবেগাক্রান্ত হয়ে গেল মির্জা আশেক। আর্জুমান্দকে খুবই শ্রদ্ধা করতো দুদু। কতো দিন তাদের বাড়িতে এসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তার সঙ্গে গল্প করেছে! তাদেরকে দেখলে মাঝেমধ্যে হিংসেও হতো তার। আর্জুমান্দও

দুদুকে স্নেহ করতেন। তাদের দু-জনের ভাণ্ডারে গল্পের অভাব ছিল না। একে অন্যের গল্প বলতো তারা।

“আমার একটা কাজ আছে…উঠি আমি,” উঠে দাঁড়াল আশেক। এক ধরণের বিষণ্নতা জেঁকে বসেছে তার মধ্যে।

“বইটা আপনি নিয়ে যান…আপনার মাকে দেবেন,” বলল সুরেন। “আর সময় পেলে চলে আসবেন এখানে।”

“আচ্ছা,” বইটা হাতে নিয়ে বের হয়ে গেল আশেক। লক্ষ্যহীনভাবে হাঁটতে শুরু করলো সে। নানান স্মৃতি এসে ভর করছে তার মধ্যে।

জ্ঞান হবার পর থেকে নিজেকে আবিষ্কার করেছে রাস্তায়-ঠিক চার্লির মতোই। অন্যসব পথশিশুর মতো রাস্তাতেই ঘুমাতো। লোকজনের কাছে হাত পাততো, এটা ওটা করে দিয়ে কিছু কামাই করতো। বিয়ের অনুষ্ঠানে প্লেট-চামচ ধুয়ে দিয়ে উচ্ছ্বিষ্ট খেয়ে কিছু টাকা নিয়ে ফিরতে পারলে মনে করতো চমৎকার একটা দিন কাটাতে পেরছে। কখনও কখনও এক টাকাও পেতো না, কাজও জুটতো না। সেই সময়গুলোতে তারা একেকজন একেক মহল্লায় ঢুকে পড়তো, বাড়ি বাড়ি গিয়ে করুণ মুখ করে হাত পাততো। সহৃদয় কেউ এক থালা বাসি ভাত-তরকারি দিতো, দুর দুর করে তাড়িয়েও দিতো অনেকে।

এ রকমই একদিন পরীবাগে ঢুকে পড়ে সে। এ বাড়ি ও বাড়ি চুঁ মেরে ব্যর্থ হয়ে একটা বাড়ির সামনে এসে থমকে দাঁড়ায়। আশেপাশের বাড়িগুলো দোতলা-তিনতলা হলেও ঐ বাড়িটা ছিল একতলার টিনের ছাদের বাড়ি। সীমানা দেয়ালটার উপর দিয়ে ভেতরে তাকিয়ে দেখে, বাড়ির সামনে কাচা মাটির বিশাল একটি দুয়ার, প্রচুর গাছপালাও আছে, সেই দুয়ারে কাঠের একটা চেয়ারে বসে আছেন পরীর মতো সুন্দরি এক মহিলা।

তাহলে কি এজন্যেই জায়গাটার নাম পরীবাগ? ছোট্ট মাথায় এমন চিন্তাই ভর করেছিল প্রথমে।

বয়স হলেও মহিলার সৌন্দর্য ম্লান হয়নি। মাথার আধা কাচাপাকা চুলগুলো কেমন নিলচে, অনেকটা তার চোখের মণির মতোই। টকটকে ফর্সা গায়ের রঙ অদ্ভুত রকমের আভা ছড়াচ্ছে।

ম্যাম? মনে মনে বলেছিল ছোট্ট ছেলেটা। এর আগে দুয়েকবার পথেঘাটে বিলেতি ম্যাম দেখেছে। তাদের মতো রাস্তার বাচ্চারা ম্যাম দেখলেই দৌড়ে ছুটে যেত। অনেক বেশি সাহায্য করতো তারা, কাউকেই ফিরিয়ে দিতো না। এই মহিলাও সে- রকমই কোনো ম্যাম হবে!

ছোট্ট ছেলেটা যখন অপার বিস্ময় নিয়ে দেখে যাচ্ছে তখন আলতো করে তার দিকে তাকিয়েছিলেন সেই পরীটা। মুখে ফুটে উঠেছিল নিষ্পাপ হাসি।

“কী দেখছো, বেটা?” অভিজাত কণ্ঠে বলেছিলেন।

তার বাচনভঙ্গি না ম্যামদের মতো, না বাঙালিদের মতো। ধন্দে পড়ে গেছিল বাচ্চাটা। মুখ দিয়ে কোনো কথা-ই বেরোয়নি।

“ভিতরে আসো,” হাসিমুখে তাকে ডেকেছিলেন। “দরজা খোলাই আছে।”

বাচ্চাটা মন্ত্রতাড়িত ছিল, না কি ক্ষুধা নিবারণের সুযোগ দেখতে পেয়েছিল, এখন আর সেটা মনে নেই। তবে বহুকালের পুরনো কাঠের দরজাটা ঠেলে বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়েছিল সে।

“কী নাম তোমার?”

“পিচ্চি।”

“এটা কোনো নাম হলো?” বিস্ময়ে তার বড় বড় চোখদুটো আরো বড় হয়ে গেছিল। “ভালো কোনো নাম নেই তোমার?”

মাথা দুলিয়েছিল বাচ্চাটা।

“থাকো কোথায়?”

“ঐ দিকে,” আঙুল তুলে কোনো একটা দিক দেখিয়ে বলেছিল সে।

“ওইখানে তোমার বাড়ি?”

“না, রাস্তা…আমি রাস্তায় থাকি।”

হতবাক হয়ে গেছিলেন পরীটা। “তোমার আব্বা-আম্মা…?”

বাচ্চাটা জানিয়েছিল, তার এ রকম কেউ নেই। কথাটা শুনে পরীর চোখদুটো ছলছল করে উঠেছিল, কাছে টেনে নিয়েছিলেন তাকে। সারা দিন যে কিছু খায়নি, সেটা না বললেও বুঝে গেছিলেন। আদর করে খেতে দিয়েছিলেন। খাওয়ার আগে গোসল করিয়ে দিয়েছিলেন নিজহাতে। ঐ বাড়িতে তখন থাকতো শুক্কুরের মা নামের এক মহিলা, তাকে দিয়ে নতুন জামা-কাপড়ও কিনে আনিয়েছিলেন।

সেই যে পরীটার বাড়িতে ঢুকলো, আর কখনও বের হয়নি-মাঝখানের পনেরোটা বছর বাদে!

মির্জা আশেক বুঝতে পারলো তার দুচোখ ভিজে গেছে। শাহবাগ পেরিয়ে কখন যে ঢাকা ক্লাবের কাছে চলে এসেছে টেরই পায়নি।

চোখদুটো মুছে আবার উল্টোপথে হাঁটতে শুরু করলো সে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *