অধ্যায় ১২
সময় যতই গড়াচ্ছে উত্তেজনা বাড়তে শুরু করছে পাভেলের মধ্যে।
দেড় ঘণ্টা হলো আশেক চলে গেছে। দশ মিনিট আগে কল দিয়েছিল তাকে, রিং হলেও কলটা রিসিভ করেনি তার বন্ধু। বাজে কিছুর আশঙ্কায় ছোট্ট অফিসে পায়চারী করছে সে। আশেকের কি খারাপ কিছু হয়েছে?
না। দরিয়া-ই-নুর তো আশেকের কাছে নেই, ওটা আছে তার ডেস্কে-নিজেকে শুধরে দিলো পাভেল। মাথা থেকে খারাপ চিন্তাগুলো বাদ দিয়ে ইতিবাচক কিছু ভাবলো। গাড়িতে আছে আশেক, পথে অনেক জ্যাম থাকতে পারে। তার ফোনটা সাইলেন্ট মোডে রাখা হয়তো। কিংবা টাকাগুলো গুণতে সময় লাগছে।
এক কোটি নয় দু’কোটি নয়, দশ কোটি টাকা!
এক হাজার টাকার নোটের বান্ডিল হলেও অনেক সময় লাগবে গুণতে। পনেরো বছর আগে চার কোটি বিশ লাখ টাকা গুণতে তাদের তিনজনেরও অনেক সময় লেগেছিল।
ফোনের রিংটোনটা বেজে উঠলে তার চিন্তায় ব্যাঘাত ঘটলো। ডিসপ্লেতে দেখতে পেল, আশেক কল দিয়েছে।
“হ্যালো? কী খবর? সব ঠিক আছে তো?” হড়বড় করে বলে গেল সে।
“সব ঠিক আছে,” শান্ত কণ্ঠে বলল আশেক। “অনেক ট্যাকা, দোস্ত…গুণতে টাইম লাগে। তুমি যে ফোন দিছো টের পাই নাই।”
হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো পাভেল। যা ভেবেছিল তা-ই। “এখন কি আসতাছো?”
“একটু পর রওনা দিমু…পনেরো-বিশ মিনিট লাগবো। আমি নিচে আইসা ফোন দিমু তোমারে।
“ঠিক আছে।”
নিজের ডেস্কে গিয়ে বসলো পাভেল। ড্রয়ার থেকে লাইসেন্স করা রিভলবারটা বের করে কোমরে গুঁজে নিলো। খারাপ কিছুর আশঙ্কা করছে না, তবে সতর্ক থাকতে দোষ কী।
নিচের পার্কিংয়ে তার ঘনিষ্ঠ জামিল আর কফিল নামের দু’জন লোক আছে। রেস্টুরেন্টের ভেতরে আছে আরো দু’জন। কাস্টমার সেজে একটা টেবিলে বসে আছে তারা। দরকার হলে ওদেরকে কাজে লাগানো যাবে।
আশেকের ফোনটা এলো পনেরো মিনিট পর। সে জানালো, বায়ারসহ নিচের পার্কিং এরিয়াতে এসে পৌছেছে তারা। সঙ্গে সঙ্গে পাভেল ফোন করে কফিলকে জানিয়ে দিলো, জহুরি লোকটাকে উপরে নিয়ে আসতে।
তিন-চার মিনিট পর মাঝবয়সি এক রোগাটে লোককে নিয়ে এলো কফিল। মোটাফ্রেমের চশমা পরা, মাথায় টুপি, ছোট করে ছাটা চাপ দাড়ি। পরণে সাদামাটা শার্ট-প্যান্ট। লোকটার হাতে ছোট্ট একটা হ্যান্ডব্যাগ।
“কই ওটা?” অফিসে ঢুকেই জানতে চাইলো জহুরি।
কফিলকে ইশারা করলো পাভেল, সে বের হয়ে যেতেই ড্রয়ার থেকে ছোট্ট বাক্সটা বের করে ডেস্কের উপরে রাখলো। ডেস্কের সামনে একটা চেয়ারে বসেছে জহুরি, হ্যান্ডব্যাগ থেকে একটা ম্যাগনিফাইং গ্লাস বের করে বাক্সটা খুলল সে। দরিয়া-ই- নুর দেখামাত্র চোখদুটো চক চক করে উঠল তার। হালকা হাসির আভা দেখা গেল মুখে। ম্যাগনিফাইং গ্লাসটা ডান চোখের সামনে ধরে হীরাটা ভালোমতো পরখ করতে শুরু করলো।
লোকটার দিকে তাকিয়ে আছে পাভেল। টের পেল তার হৃদস্পন্দন একটু বেড়ে গেছে। জহুরির অভিব্যক্তি দেখে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। একটু আগে হীরাটা দেখার সময় যে হাসি ছিল মুখে, সেটা এখন নেই। গম্ভীর হয়ে গেছে। ছোট্ট অফিস ঘরটায় কয়েক মুহূর্তের জন্য নেমে এলো সুকঠিন নীরবতা। অবশ্য রেস্টুরেন্টের বাইরে যে কোলাহল সেটা মৌমাছির গুঞ্জনের মতো
ভেসে আসছে কাচের দরজা ভেদ করে।
ম্যাগনিফাইং গ্লাসটা চোখ থেকে সরিয়ে কিছু ভাবলো জহুরি। লোকটার ভাবভঙ্গি দেখে পাভেলের কেমন জানি আশঙ্কা হচ্ছে।
ম্যাগনিফাইং গ্লাসটা রেখে গভীর করে শ্বাস নিলো লোকটা। “কোটি কোটি টাকার কারবার, বুঝলেন না? আমার উপরে বিশ্বাস করেই হীরাটা কিনবে। যদি কেনার পর দেখে এটা আসল না, তাহলে বুঝতে পেরেছেন কী হবে আমার?”
পাভেলের চোখদুটো গোল গোল হয়ে গেল।
“আমাকে তো মারবেই, আমার ফ্যামিলিও শেষ করে দেবে। ভাববে, আমি আপনাদের কাছ থেকে টাকা খেয়ে ভেজাল জিনিস গছিয়ে দিয়েছি।”
“এইটা কি আসল না?” আতঙ্কের সাথে জানতে চাইলো।
কয়েক মুহূর্ত তার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ করেই হেসে ফেলল জহুরি। “আলবৎ আসল। কয়েক ঘণ্টা আগেও এটা আমি পরীক্ষা করে দেখেছি।”
ভুরু কুঁচকে গেল আশেকের পার্টনারের।
“এ শহরে হীরার জহুরি খুব বেশি নেই। আমি সরকারের হয়েও কাজ করি।” প্রশান্তির হাসি দিলো লোকটা। “একদিনে দু’বার পরীক্ষা করলাম দরিয়া-ই-নুর! কী কপাল আমার!” ম্যাগনিফাইং গ্লাসটা ব্যাগে ভরে নিলো। “সরকার দিলো পাঁচ হাজার, আর এরা আমাকে দেবে এক লাখ।”
“ইনকাম তো ভালাই হইলো…” হেসে বলল পাভেল।
মাথা দোলালো লোকটা। “এমন বেচাবিক্রি তিন-চার বছরে একবার হয়,” কথাটা বলে সস্তা একটা চায়নিজ ফোন বের করে কল দিলো কাউকে—সম্ভবত বায়ারকে। “জিনিস ঠিকঠাকই আছে, ভাই।”
পাভেলের চেহারায় খুশির ঝলক দেখা গেল।
ফোনটা রেখে তার দিকে তাকালো জহুরি। “আপনার লোককে টাকাগুলো আনতে পাঠান।”
পাভেল সঙ্গে সঙ্গে ফোন দিলো কফিলকে। “ট্যাকাগুলা নিয়া আসো অফিসে।” কলটা কেটে দিয়েই আশেককে ফোন দিলো আবার। “জিনিস আসল, দোস্ত!” উচ্ছ্বাসে বলে উঠল সে। “আমি লোক পাঠাইছি, ট্যাকাগুলান ওগোরে দিয়া দিও।”
“আচ্ছা,” ওপাশ থেকে বলল মির্জা। “লাগেজগুলা অফিসে আসলেই তুমি হীরাটা জহুরিরে দিয়া দিবা, ঠিক আছে?”
“ঠিক আছে।” কলটা কেটে দিয়ে জহুরির দিকে তাকালো। লোকটা তার দিকে চেয়ে মিটিমিটি হাসছে।
“একটা ডিল ভালোমতো হয়ে গেলে আমার খুব ভালো লাগে।“
পাভেলও হাসলো নিঃশব্দে। “এইটাই আপনার পেশা?”
“আরে না। আমার আসল ব্যবসা রত্নপাথরের। যে কেউ ডাকলেই এই কাজ করি না। এই বায়ারের হয়ে কাজ করছি মনু জায়গীরদারের রেফারেন্সে। আপনি তাকে চিনবেন না, উনি এ দেশের সবচেয়ে বড় ডায়মন্ডের ব্যবসায়ি।”
পাভেল যে মনু জায়গীরদারের নাম শুনেছে আশেকের কাছ থেকে সেটা আর বলল না।
“বায়ার আমাদের সাথেই এসেছেন, তবে উনি এখানে আসবেন না।”
পাভেলের ধারণা, সম্ভবত সিসিক্যামের ব্যাপারটা নিয়ে বায়ার আশ্বস্ত হতে পারেনি। যদিও সে এই রেস্টুরেন্টের সবগুলো ক্যামেরাই বন্ধ করে রেখেছে। এমন কি, নিচের পার্কিং এরিয়ারগুলোও।
একটু পরই কফিল আর জামিল দুটো বড় লাগেজ নিয়ে তার অফিসে ঢুকলো। লাগেজ দুটো ডেস্কের উপরে রাখতেই পাভেল ইশারা করলো সেগুলো খুলে দেখাতে।
কফিল লকের কম্বিনেশন মিলিয়ে খুলে ফেলল ওগুলো। প্রথমে কালো রঙের লাগেজের ঢাকনাটা লাগেজের ঢাকনাটা একটু তুলে দেখালো—হাজার টাকার বান্ডিলে ভর্তি সেটা। জহুরি মিটি মিটি হাসছে। এরপর ক্রিম রঙের লাগেজটাও খুলে দেখালো কফিল। পাভেলের মুখে ফুটে উঠল হাসি। সন্তুষ্ট হয়ে দরিয়া-ই-নুরের ছোট্ট বাক্সটা তুলে দিলো জহুরির হাতে।
নিজের হ্যান্ডব্যাগে বাক্সটা ভরে উঠে দাঁড়াল লোকটা। “আমি তাহলে আসি।”
জহুরি চলে গেলে কফিল আর জামিলের দিকে তাকালো পাভেল। “তোমরা এখন বাইরে ওয়েট করো…আমি ডাকলে আসবা।“
“ওকে, ভাই,” কথাটা বলেই জামিলকে নিয়ে ঘর থেকে চলে গেল কফিল এখন পাভেলের প্রাইভেট কারটা নিয়ে বায়ারের গাড়ির সাথে সাথে যাবে আশেক। বায়ারের লোক থাকবে তার সঙ্গে। নির্দিষ্ট গন্তব্যে যাবার পর, বায়ার যখন আশ্বস্ত হবে আর কোনো সমস্যা নেই, তখন আশেককে ছেড়ে দেবে। সে গাড়িটা চালিয়ে চলে আসবে এখানে।
নিজের চেয়ারে হেলান দিলো পাভেল, লাগেজ দুটোর দিকে তাকালো। দশ কোটি টাকা আছে এখানে। দরিয়া-ই-নুরের বেচাবিক্রির কাজটা যে এত সহজে হবে কল্পনাও করেনি। পনেরো বছরের জেল খাটা আশেক এবার আর কোনো রকম ভুল করেনি। প্রশান্তির হাসি ফুটে উঠল মুখে।
এমন সময় তার ফোনটা বেজে উঠল, আশেক ফোন করেছে। একটু অবাক হলো সে। যে রকম কথা হয়েছে, তাতে করে এই সময় আশেক তাকে ফোন করার কথা নয়; ছাড়া পেলেই কেবল যোগাযোগ করতে পারবে।
এত তাড়াতাড়ি ছেড়ে দিলো তাকে?
নড়েচড়ে বসলো পাভেল। কলটা রিসিভ করলো সে। “কী হইছে?” ভুরু কুঁচকে গেল তার। “কোনো সমস্যা?” এরপর ফোনের ওপাশ থেকে যা শুনলো, নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারলো না।